অ্যান্টিক আতঙ্ক – ২

সৈকত মুখোপাধ্যায়

দুই

গাড়িটা বুধোদার। এটা ও নতুন কিনেছে। অলিভ গ্রিন এস ইউ ভি। চওড়া রেডিয়াল টায়ার আর উঁচু স্যাসির জন্যে খারাপ রাস্তায় ড্রাইভ করার পক্ষে আদর্শ। কাল দুপুরে উত্তরপাড়া থেকে রওনা হয়ে এই গাড়িটা চালিয়েই বুধোদা আর আমি চান্ডিল চলে এসেছি। রঘুদার বাড়িতে যখন ঢুকেছি তখন রাত বারোটা।

আজ অবশ্য গাড়িটা রঘুদাই চালাচ্ছে। কারণ লোহুরঙে যাবার ভাঙাচোরা পাথুরে পথে অভ্যেস না থাকলে নাকি গাড়ি চালানো অসম্ভব। ড্রাইভারের পাশের সিটে বুধোদা বসে রয়েছে। পেছনে আমি। মিনিট দশেক একটানা ড্রাইভ করে গাড়িটাকে চান্ডিল শহরের বাইরে বার করার পর রঘুদা প্রথম মুখ খুলল। বলল, জানতাম তোমরা আসবে। তবে একেবারে আক্ষরিক অর্থে পত্রপাঠ চলে আসবে সেটা ভাবিনি।

গাড়ির জানলার কাচগুলো ওঠানো ছিল, তবু ছোটনাগপুর মালভূমির সকালের হিমেল হাওয়ায় আমার দাঁতে দাঁতে ঠকঠকি লেগে যাচ্ছিল। বুধোদা উলের টুপিটাকে কানের ওপর আরেকটু টেনে নিয়ে উত্তর দিল, পত্রপাঠ চলে আসার একটা কারণ হল রুবিকের স্কুল। নেতাজীর জন্মদিন, শনি-রবি, আর প্রজাতন্ত্র দিবস মিলিয়ে ওর এখন চারদিন ছুটি আছে বলেই আসতে পারল। আর অন্য কারণ তোমার টোপ। ওই ছবিগুলো আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে।

যদি সত্যিই ওগুলো হাতে আঁকা হয় তাহলে মানতেই হবে সেটা পেইন্টিং-এর দুনিয়া তোলপাড় করে দেওয়ার মতন ঘটনা। ফোটোগ্রাফির চল হওয়ার আগে প্রকৃতিবিদেরা স্পেসিমেনের ছবি হাতেই আঁকতেন একথা ঠিক। তার মধ্যে রঙিন ছবিও যে ছিল না তা নয়। মারিয়া সিবিলা মেরিঅ্যান নামে এক জার্মান ভদ্রমহিলা তো সেই কবে সতেরোশো-পাঁচ সালেই নিজের হাতে আঁকা রঙিন ছবি দিয়ে একটা বই বার করে ফেলেছিলেন। নাম ‘মেটামরফোসিস ইনসেক্টোরাম সুরিনামেনসিয়াম’। মানে সুরিনাম দ্বীপের পোকামাকড়দের রূপবদল। সেই বইতে একেবারে ডিম থেকে শুঁয়োপোকা হয়ে প্রজাপতি অবধি সবক’টা স্টেপের ছবি ছিল। কিন্তু তবু সেইসব ছবিকে হাতে আঁকা ছবি বলে দিব্যি বোঝা যায়। তোমার ডাইনি-বাংলোর অ্যালবামের মতন এমন ফোটোগ্রাফিক কোয়ালিটির জীবজন্তুর ছবি দেখিনি।

বুধোদার কথা শুনতে শুনতে আমি আমার পাশেই সিটের ওপরে রাখা অ্যালবামটা হাতে তুলে নিলাম। বারবার নেড়েচেড়ে দেখতে হচ্ছে বলে বুধোদা এটাকে আর কোনো ব্যাগের মধ্যে ঢোকাতে দেয়নি।

দেড়ফিট বাই দু-ফিট মাপের ওইরকম বাইশটা ছবি একসঙ্গে ফিতে দিয়ে সেলাই করা আছে। সবই হয় পোকামাকড় আর নাহলে ছোটখাটো জীবজন্তুর লাইফ-স্টাডি।

বুধোদাও ছবিগুলো দেখেই বলেছিল, ক্যামেরা-ট্যামেরার গল্পই নেই। ওগুলো রঙ দিয়েই আঁকা। ম্যাগনিফাইং-গ্লাসের নীচে ছবিগুলোকে ধরলে পিগমেন্টের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দানাগুলো নাকি দিব্যি দেখা যাচ্ছে। তবে কী ধরনের রং সেটা ও এখনো বুঝতে পারেনি। তার জন্যে বোধহয় ফরেনসিক ল্যাবরেটরির হেল্প লাগবে।

যে-জিনিসটা দেখে বুধোদার মুখে সত্যিকারের খুশি ফুটে উঠেছিল, সেটা হল প্রতিটি ছবির নীচে সন তারিখের উল্লেখ। রঘুদা একটুও বাড়িয়ে বলেনি। ছবিগুলো সবই উনিশশো সাতষট্টি থেকে উনসত্তরের মধ্যে আঁকা। মানে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো।

অ্যান্টিক বলা যায় বইকী।

কাল রাতে যখন চান্ডিলে পৌঁছে প্রথমবার রঘুদার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, তখন আমার আর বুধোদার দুজনেরই মনে একটাই প্রশ্ন জেগেছিল—রঘুনাথ দ্বিবেদীর মতন একজন হাসিখুশি ফুর্তিবাজ এবং চরম দুঃসাহসী মানুষ কেমন করে এতটা পালটে যেতে পারে? রঘুদার মুখে তখন হাসি তো ছিলই না, বরং যেভাবে সামান্য শব্দেই চমকে উঠছিল এবং বারবার চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাচ্ছিল, তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম একটা আতঙ্ক রঘুদাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। একটা অমঙ্গলের আশঙ্কায় রঘুদা ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে।

কতটা ভয় পেলে রঘুদার মতন একজন যুক্তিবাদী, সাহসী মানুষের এই হাল হয় সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু একথাও ঠিক, রঘুদা কিন্তু ভয়ের সামনে থেকে পিছিয়ে আসেনি। বরং ডাক দিয়েছে ওর নিজের গোত্রেরই আরেকজন মানুষকে। বুধোদাকে।

রঘুদা জানে, যে-কাজে ও একলা এগোতে সাহস পায়নি, বুধোদা সঙ্গে থাকলে ঠিক সেখানে পৌঁছে যেতে পারবে। রঘুদা কথায়-কথায় বললও সেই কথা। বলল, রুবিক! মন থেকে লোহুরঙের ডাইনির ভয় যদি তাড়াতে না পারি, তাহলে আমি আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারব না।

আজ সকালে রঘুদার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, এক রাত্তিরেই রঘুদা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সত্যিকথা বলতে কি, সেইমুহূর্তে মসৃণ ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে রঘুদা স্টিয়ারিং-এর ওপরে আঙুলের টোকা দিয়ে কী যেন একটা দেহাতি সুরও ভাঁজছিল। বুধোদা সেটা খেয়াল করে বলল, গান গাইলেই হবে রঘু? চিঠিতে তো বিস্তারিত লিখতে পারোনি। কাল রাতে মুখেও কিছু বলতে পারলে না। তোমার নাকি গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই যে আমাদের লোহুরং নিয়ে যাচ্ছ, এখনো যদি না বলো তোমার ডাইনির গল্প…স্যরি, ঘটনা…তাহলে কেমন করে চলে বলো তো?

রঘুদা হেসে ফেলল। বলল, স্যরি ইয়ার! কাল রাতে সত্যি আমার ইয়ে…মানে মনটা একটু খারাপ ছিল। যাগগে, এখন শুনবে? চলো তাহলে, ওই ধাবাটায় নাস্তা সেরেনি। নাস্তা করতে করতেই বাকি চ্যাপটার-টুকু তোমাদের শুনিয়ে দেব।

হাইওয়ের ধারে একটা পাঞ্জাবি-ধাবার উঠোনে পেতে-রাখা খাটিয়ায়, পিঠে রোদ নিয়ে, আরাম করে তিনজনে বসলাম। রঘুদা গলা তুলে ধাবার মালিককে আন্ডা-ভুজিয়া আর আলু-পারাঠার অর্ডার দিয়ে কাহিনী শুরু করল—

শঙ্কু পাহানের সঙ্গে লোহুরং গ্রামে যখন প্রথম পা রাখলাম তখন দুপুর হয়ে গেছে। রাতটা কেটে গেল ওর পাতার কুঁড়ের মধ্যে টুসাইয়ের বিছানার পাশে বসে। প্রতি ঘণ্টায় মেয়েটার মুখে ওষুধ দিচ্ছি আর নাড়ি দেখছি।

আগের তিনটে রাত জাগার ক্লান্তিতে শঙ্কু পাহান আর তার বউ ঘরের অন্য এক কোনায় মেঝেতে পাতা চাটাইয়ের ওপরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি জেগে ছিলাম আর আমার সঙ্গে জেগেছিল ভিসুক পাহান। হ্যাঁ, সেই গুণিন—যে শঙ্কুকে বলেছিল, ওর মেয়েকে ডাইনিতে বাণ মেরেছে; তাকে বাঁচানোর নাকি আর কোনো উপায় নেই।

গুণিন লোকটাকে দেখে কিন্তু আমার রাগের বদলে মায়াই হচ্ছিল বেশি। ওর কানদুটো অদ্ভুত রকমের বড়। মাথার চুল কড়ুয়া তেলে জবজবে করে ভিজিয়ে উল্টে আঁচড়ানো। কপালের ওপরে একটা মুরগির ডিমের সাইজের আব। কিন্তু সবার আগে চোখে পড়ে লোকটার রোগা, হাড় জিরজিরে, না-খেতে-পাওয়া চেহারা। বীরহোররা নিজেরাই এত গরিব, তারা গুণিনকে আর কত ভিজিট দেবে? লোকটাকে অভাবী বলে বুঝতে পারছিলাম বলেই মায়া হচ্ছিল।

ভিসুক ডাইনি সম্বন্ধে নানান অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল। সেগুলোকে একেবারেই গাঁজাখুরি গল্প বলে উড়িয়ে দিতাম যদি না গল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য থাকত।

সাধারণত এইসব আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দারা তাদের কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা প্রতিবেশীকেই ডাইন বা ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করে। বলে, ওই বুড়িই ডাইনি। ও তোর ছেলেকে বাণ মেরেছে, তাই তোর ছেলের জ্বর সারছে না। কিংবা বলে, ওই বুড়ো ডাইন। ও তোর গোয়ালে নজর দিয়েছিল বলে তোর গোরুগুলো সব মরে গেল। তারপর সেই অসহায় বুড়োবুড়িদের ওপর যতরকমের অত্যাচার শুরু করে। গ্রামের গুণিনরাই এসবের পেছনে থাকে। তারাই সাধারণ মানুষদের খেপিয়ে তোলে।

ভিসুক পাহান কিন্তু বলছিল, লোহুরঙের ডাইনি মোটেই ওদের সমাজের লোক নয়। তার গায়ের রং ধবধবে সাদা। মাথার চুল সোনালি। সে সাগরের ওদিকের কোনো দেশ থেকে ঝাঁটায় চেপে লোহুরঙে উড়ে এসেছে। ডাইনি গ্রামের ভেতরে থাকে না, থাকে টিলার মাথায় একটা বাংলোয়। একশোবছর আগে ডাইনির দাদু ওই বাংলোটা বানিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, ওই বিদেশি ডাইনি বরাবর লোহুরঙে থাকেনি। পঞ্চাশ বছর আগে কিছুদিনের জন্যে এসে একটা মানুষকে মেরেছিল। পঞ্চাশ বছর বাদে এখানে ফিরে এসেই আবার তার কালাজাদু শুরু করেছে। নাহলে টুসাইয়ের এমন অবস্থা হবে কেন? এর আগে গ্রামে যতগুলো ডাইনি ছিল সবকটাকেই তো ভিসুক গ্রামছাড়া করেছে। এখন তো ওই ফরসা বুড়ি ছাড়া ডাইনি হবার মতন আর কাউকে ধারেকাছে দেখা যাচ্ছে না।

আমি থার্মোমিটার দিয়ে টুসাইয়ের জ্বর মাপতে মাপতে জিগ্যেস করলাম, তুমি সেই ডাইনিকে দেখেছ?

দেখেছি মানে? রীতিমতন কথা বলেছি। আমি তো প্রায় প্রতিদিনই ওর ওখানে যাই। বাজারহাট করে দিই।

আমি ঠাট্টা করে বললাম, সাগরপাড়ের ডাইনি তোমার সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলেন? তুমি কি বিদেশি ভাষা বোঝো?

ভিসুক চটে উঠে বলল, বিদেশি ভাষা বলবে কেন? বললাম না, ছোটবেলায় ওর বাবার সঙ্গে ওই বাংলোতেই অনেকবছর থেকেছিল। তখন ওর বয়েস ছিল ষোলো কি সতেরো। সেবারে ও একটা মেয়েকে বাণ মেরে শেষ করে ফেলেছিল। তারপর ওরা বাপ-বেটি লোহুরং ছেড়ে পালিয়েছিল। আজ পঞ্চাশ বছর বাদে আবার ফিরে এসেছে।

আমি বললাম, বুঝেছি। সেইজন্যে উনি তোমাদের ভাষা জানেন। সেই ভাষাতেই তোমার সঙ্গে কথা বলেন। তাহলে ওনাকে ডাইনি বলছ কেন?

ভিসুক বলল, ওসব আমরা বুঝতে পারি। এই যে শঙ্কুর বেটি টুসাই, ও বয়ড়া-ফল কুড়োতে টিলার মাথায় উঠেছিল। তখনই ডাইনির নিশ্বাস ওর গায়ে লেগে গিয়েছে। পুরোপুরি নজর লাগলে আপনারও ক্ষমতা ছিল না ওকে বাঁচানোর।

ব্যঙ্গের সুরে বললাম, তোমার গায়ে নজর লাগে না?

হাড় জিরজিরে বুকের খাঁচাটা যতটা সম্ভব ফুলিয়ে ভিসুক পাহান উত্তর দিল—মনে রাখবেন কোবরেজমশাই, আমি একজন গুণিন। যত বড়ই ডাইনি হোক, আমার কিছু করতে পারবে না। আমরা আর ডাইনিরা অনেকটা একই গোত্রের লোক। শুধু আমাদের অলৌকিক ক্ষমতা আমরা মানুষের ভালোর জন্যে ব্যবহার করি। আর ডাইনিরা সেই একই ক্ষমতা দিয়ে মানুষের ক্ষতি করে।

ভিসুক আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝে-মাঝেই একটা শুকনো লাউয়ের খোলা থেকে কী যেন এক ঝাঁঝালো গন্ধের লিকুইড গলার মধ্যে ঢালছিল। বারণ করে লাভ ছিল না। নেশা ছাড়া এসব লোক বাঁচতে পারে না। আমি তাই ওর দিকে নজর না দিয়ে টুসাইয়ের নার্সিং-এর কাজটাই মন দিয়ে করে যাচ্ছিলাম। মুশকিল হল, যতই সেই লিকুইড ভিসুকের পেটের মধ্যে যাচ্ছিল ততই ওর মধ্যে একটা বীররস জেগে উঠছিল। ও বোধহয় বুঝতে পারছিল ওর গল্পগুলো আমি খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না। তাই হঠাৎ একটা সময়ে ও টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়ান কোবরেজমশাই। আপনাকে একটা জিনিস দেখালেই আপনি বুঝতে পারবেন ওই ডাইনির কত ক্ষমতা। এই বলে নিজের কুঁড়েঘর থেকে ওই ছবির অ্যালবামটা এনে আমার হাতে দিল।

শঙ্কু পাহানের ঘরের কাঁপা কাঁপা লম্ফের আলোয় সেই প্রথম আমি দেখলাম নানান পোকামাকড় আর জীবজন্তুর অসমান্য রঙিন ছবিগুলো। তুমি নিশ্চয়ই একমত হবে, ছবিগুলোর বিবর্ণতা দেখলে একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে ছবির নীচে লেখা তারিখগুলো জাল নয়। ছবিগুলো সত্যিই পুরোনো। সব মিলিয়ে তাই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ভিসুককে জিগ্যেস করলাম, এগুলো কোথায় পেলে ভিসুক?

ডাইনি দিয়েছে। ডাইনি বলেছে এগুলোর খরিদ্দার দেখতে। ওর খুব পয়সার দরকার। পয়সার জন্যেই ও সমুদ্রের ওপার থেকে এখানে উড়ে এসেছে। ও বলেছে এরকম ছবি ওর কাছে আরও অনেক রয়েছে—আরও বড়, আরও জীবন্ত।

ভিসুককে জিগ্যেস করলাম, ছবি ছাড়া আর কী আছে? তখন আমার মাথায় তোমার মহারাজা কালেকশনসের কথা ঘুরছিল। ভাবছিলাম, যেমন অ্যান্টিক কোনো মানুষ কখনো চোখে দেখেনি, তেমন কিছু তোমার হাতে তুলে দিতে পারি কিনা।

ভিসুক আমার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ যেন মহা দোটানায় পড়ে গেল। যেন একটা কোনো গোপন কথা বলবে কি বলবে না তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আবার হাতের লণ্ঠনটা নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। আমি জিগ্যেস করলাম, কোথায় চললে?

ভিসুক ফিসফিসে গলায় বলল, আরও একধরনের অদ্ভুত জিনিস ওই বাংলোয় দেখেছি। সেগুলোকে ডাইনিটা ওর বাবার ছবি আঁকার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল, তবু আমি দেখে ফেলেছি। আমি একবার আপনাকে দেখাতে চাই।

তারপর একেবারে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ছবির বইটা যদি আপনি কেনেন তাহলে সে পয়সা আমি ডাইনিটাকে দিয়ে দেব। কিন্তু এখন আমি যে জিনিসটা আনতে যাচ্ছি, সেটা যদি আপনি কেনেন তাহলে পুরো পয়সাটাই আমার, কেমন?

আমি ঘাড় হেলিয়ে বললাম, রাজি। সঙ্গে সঙ্গে সেই গভীর রাতে ভিসুক পাহান রওনা দিল টিলার মাথায় ডাইনি বাংলোর দিকে। উত্তুরে হাওয়ায় একবার ঘরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখা চাটাই উড়ে যেতেই দেখলাম, জমাট কুয়াশার মধ্যে ভিসুকের লণ্ঠনের আলো একটা হলুদ জোনাকির মতন দুলতে দুলতে দূরে চলে যাচ্ছে। কুয়াশার আড়ালে ভিসুককে আর দেখা যাচ্ছে না।

জ্যান্ত অবস্থায় ভিসুককে সেই শেষবার দেখেছিলাম।

ভোর-রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই কাঁচা ঘুমও ভেঙে গেল শঙ্কুর ঘরের বাইরে অনেক মানুষের ভয়ার্ত গলার শব্দে। বাইরে বেরিয়ে দেখি দলে দলে নারীপুরুষ দ্রুতপায়ে হেঁটে চলেছে টিলার দিকে। ঘরে শঙ্কু নেই। শঙ্কুর বউ ওর মেয়েকে কোলের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে ভীষণ ভয় পাওয়া মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। ওকে কয়েকবার জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে? ও কোনো উত্তর দিল না। মনে হল প্রবল আতঙ্কে ওর কথা বলার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। অগত্যা গায়ে ব্লেজারটা চাপিয়ে ওইসব মানুষজনের পেছন পেছন টিলার দিকে হাঁটা লাগালাম।

টিলার মাথায় উইচ-কটেজ। তার ঠিক নীচ থেকে শুরু হয়েছে একটা বিশাল ধস। পুরো জায়গাটায় এক কুচি ঘাস অবধি নেই। শুধুই টকটকে লাল পাথর আর কাঁকর। কাল যখন গ্রামে ঢুকছিলাম তখনই জায়গাটা চোখ টেনেছিল। কিন্তু তখন জায়গাটা ছিল খটখটে শুকনো, আর রঙটা ছিল ফিকে। এখন ভিজে কাদা হয়ে রয়েছে আর রং হয়েছে রক্তের মতন লাল। যে কেউ বুঝতে পারবে, গ্রামের মাথার কাছে ঝুলে থাকা ওই রক্তমাখা জিভের মতন জমিটার জন্যেই গ্রামের নাম হয়েছে লোহুরং। শুধু একটা ব্যাপারই আশ্চর্য লাগছিল। এত জল এল কোথা থেকে? রাতে তো বৃষ্টি হয়নি।

সেই ধসে যাওয়া জমির নীচের প্রান্তে, যেখানে জমিটা একটু সমতল হয়ে এসেছে, সেখানেই গ্রামবাসীদের ভিড়টা একটা বৃত্তের মতন জমাট বেঁধে দাঁড়িয়েছিল। আমি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, বৃত্তের মাঝখানে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছে লোহুরং গ্রামের গুণিন, ভিসুক পাহান। তার হাড়-জিরজিরে চেহারা, খাড়া খাড়া কান, উলটিয়ে আঁচড়ানো চুল আর কপালের মস্ত আব—সমস্তই ঠিক কাল রাতে যেমন দেখেছিলাম তেমনই রয়েছে। শুধু এখন সব কিছুই বদলে গেছে ঘোলাটে রঙের কাচে। রক্ত নয়, মাংস নয়, চামড়া নয়—শুধু কাচ।

অনেকক্ষণ অবধি আমার চোখ ছাড়া অন্য সমস্ত ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে গিয়েছিল। চোখ দিয়ে গিলছিলাম সেই বীভৎসের চেয়েও বীভৎস দৃশ্য। কতক্ষণ পরে কে জানে, আবার কানে শব্দ ঢুকতে শুরু করল। শুনলাম, আশেপাশের লোকজন ফিসফিস করে বলছে—ডাইনির বাণ, ডাইনি ওকে মেরেছে। ঠিক এইভাবে পঞ্চাশ বছর আগে ওই ডাইনি একটা মেয়েকে মেরেছিল। তাকেও ঠিক এইভাবে কাচের পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল।

আমাদের খাবার সার্ভ করে দিয়েছিল। রঘুদা কথা থামিয়ে এক টুকরো আলু-পারাঠা নিয়ে মুখে ঢোকাল। বুধোদা চিন্তিত মুখে বলল, তার মানে শুধু শিল্পী নন, লোহুরঙের উইচ-কটেজে একজন ভাস্করও বাস করেন যিনি গ্লাস-স্কাল্পচার বানাতে ওস্তাদ। পঞ্চাশবছর আগেও তিনি ছিলেন, আজও রয়েছেন। তিনি কি ওই বিদেশি মহিলা? নাকি অন্য মানুষ? যাই হোক, আর্ট সম্বন্ধে যদি এতবছরে সামান্য কিছুও শিখে থাকি, তাহলে এটুকু বলতে পারি ওই কুঁড়েঘরের মধ্যে রাজার সম্পদ লুকোনো রয়েছে।

বুধোদার কথাটা শুনেই রঘুদা হঠাৎ ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়ল। বলল, মনে হচ্ছে তোমরা আমার কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিচ্ছ না। কিসের শিল্প? কিসের ভাস্কর্য? তোমাকে বললাম না, ওখানে পড়েছিল একটা কাচের মৃতদেহ? ভিসুক পাহানের লাশ? সেটা তাহলে তোমার কাছে ভাস্কর্য? এই তোমার মানবিকতা?

শান্ত হও রঘুনাথ, শান্ত হও। বুধোদা এক হাত দিয়ে বন্ধুর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। তারপর বাচ্চাছেলেকে বোঝানোর মতন করে বলল, তুমি ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে ভাব রঘুনাথ। তুমি যা দেখেছ, তা কাচের স্ট্যাচু ছাড়া কিছু নয়। গ্লাস-স্কাল্পচার। চূড়ান্ত সুন্দর, চূড়ান্ত নিখুঁত। তবু মূর্তি ছাড়া সেটা আর কিছু হতে পারে না।

আর শোন, ভিসুক পাহান মরেনি। সে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। ওই বিদেশি ভদ্রমহিলা কিংবা অন্য কেউ ভিসুক-কে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে যে কাচের মূর্তিটা বানিয়েছিলেন সেটাকেই তোমরা টিলার নীচে পড়ে থাকতে দেখেছ। এর মধ্যে কোনো ডাইনিগিরি নেই। কোনো অলৌকিক নেই।

তোমার মনে আছে, ভিসুক শেষবার ডাইনি-বাংলোয় যাবার আগে তোমাকে বলে গিয়েছিল, ওখানে আরেক ধরনের অদ্ভুত জিনিস রয়েছে? আমার মনে হয়, ও গ্লাস-স্কাল্পচারের কথাই বলেছিল। ওই ভদ্রমহিলার বানানো আরও মূর্তি ওই বাংলোয় রয়েছে।

রঘুদা একটু থমকে গেল। ওর চোখের দৃষ্টি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল। বলল, তাই তো! এভাবে তো ভাবিনি। ইয়েস, দ্যাটস পসিবল। তার মানে, ভিসুক আমাকে দ্যাখানোর জন্যে ওর নিজের মূর্তিটা নিয়েই নেমে আসছিল। তারপর হয়তো নেশার ঝোঁকে ওটাকে ওইখানেই নামিয়ে রেখে অন্য কোথাও হাঁটা লাগিয়েছে।

বুধোদা বলল, রাইট। এবার তাহলে আমরা লোহুরঙের দিকে রওনা দিই?

চলো!

রঘুদা খাবারের দাম মিটিয়ে পকেট থেকে গাড়ির চাবিটা বার করে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে এস ইউ ভি-র দিকে হাঁটা লাগাল। পেছন পেছন আমি আর বুধোদা।

সকল অধ্যায়

১. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ১
২. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ২
৩. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৩
৪. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৪
৫. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৫
৬. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৬
৭. অ্যান্টিক আতঙ্ক – উপসংহার
৮. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ১
৯. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ২
১০. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৩
১১. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৪
১২. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৫
১৩. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৬
১৪. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৭
১৫. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৮
১৬. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৯
১৭. খুনি ম্যাজিক – ১
১৮. খুনি ম্যাজিক – ২
১৯. খুনি ম্যাজিক – ৩
২০. খুনি ম্যাজিক – ৪
২১. খুনি ম্যাজিক – ৫
২২. খুনি ম্যাজিক – ৬
২৩. খুনি ম্যাজিক – ৭
২৪. খুনি ম্যাজিক – ৮
২৫. খুনি ম্যাজিক – ৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন