অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৪

সৈকত মুখোপাধ্যায়

চার

বুধোদা কাঁধের ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ভিসুক পাহানের দেওয়া সেই ছবির অ্যালবামটা বার করে সেটাকে সেন্টার-টেবলের ওপর রেখে বলল, এই ছবিগুলোর কথা বলছেন কি?

মিস সায়গল অবাক হয়ে বললেন, একি! এটা আপনার কাছে গেল কেমন করে? এটা তো আমি ওই কাবার্ডের মধ্যে রেখেছিলাম। কথা বলতে বলতেই মিস সায়গল উঠে গিয়ে ঘরের কোনায় রাখা একটা পুরোনো কাঠের কাবার্ডের পাল্লায় চাবি ঢোকাতে গিয়েও থেমে গেলেন। চাবির দরকার ছিল না। পাল্লাদুটো ভেজানো ছিল।

উনি একবার উঁকি দিয়ে কাবার্ডের ভেতরটা দেখলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বললেন, দ্যাট স্কাউন্ড্রেল…ভিসুক পাহান। ওই-ই নিশ্চয় এটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। ভিসুককে বাড়িতে এন্ট্রির দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু কী করব? গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের একটা মাধ্যম না থাকলে এখানে থাকতাম কেমন করে? ভিসুক ছাড়া আর কারুর তো ডাইনির বাড়িতে পা দেওয়ার সাহস নেই। যাই হোক, জিনিসটা আলটিমেটলি দেখছি, ঠিক লোকের হাতেই পড়েছে। আপনার কী মনে হয় মিস্টার মজুমদার? হাউ মাচ মানি দিস অ্যালবাম ক্যান ফেচ টু মি?

বুধোদা অ্যালবামের কয়েকটা পাতা অন্যমনস্কভাবে ওল্টাতে-ওল্টাতে বলল, দ্যাট ডিপেন্ডস মিস সায়গল। যদি কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তাহলে এগুলোর দাম অনেক বাড়বে। ছবি যারা কেনেন তাঁরা ছবির সঙ্গে তার ইতিহাসটাও কেনেন কিনা।

মিস সায়গল চিন্তিত মুখে বললেন, যেমন?

যেমন আপনার বাবা যে-সময়ে প্যারিসে ছবি আঁকা শিখতে গিয়েছিলেন, সেই সময়টা ছিল ইওরোপে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট পেইন্টিংস-এর যুগ। সুর-রিয়ালিজমের যুগ। অর্থাৎ বস্তু নয়, বস্তুর ভেতরের ভাবটাকে ছবিতে ফুটিয়ে তোলাই ছিল তখনকার ট্রেন্ড। পল ক্লী, ক্যানডনস্কি, সালভাদোর দালি, মন্দ্রিয়ার মতন শিল্পীরা তখন এই ধারায় ছবি এঁকে খ্যাতির মধ্যগগনে। শিল্পের জগতে তখন কেউই রিয়ালিটিকে ফলো করতেন না। তাহলে কোন গুরুর কাছে আপনার বাবা এমন রিয়ালিস্টিক ছবি আঁকা শিখেছিলেন? কেনই বা শিখেছিলেন?

এর উত্তর আমার জানা নেই। আর কিছু?

স্বর্গত প্যারিমোহন সায়গলের অ্যালবামের একটা পাতার ওপরে আঙুল বোলাতে বোলাতে বুধোদা বলল, এই যে মিডিয়ামটার ওপরে ছবিটা আঁকা হয়েছে, এটা কাগজ নয়। ক্যানভাসও নয়। এটা কী?

এর উত্তরও আমার জানা নেই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুধোদা অ্যালবামটা বন্ধ করল। তারপর বলল, মিস সায়গল! আমার ভিজিটিং-কার্ডটা দেখলে বুঝবেন, আমি নিছক অ্যান্টিকের ব্যবসায়ী নই। আমি অ্যান্টিক হান্টার। আপনি সাহায্য করলে প্রশ্নের উত্তরগুলো আমি নিজেই খুঁজে বার করতে পারি। করবেন সাহায্য?

না। তীক্ষ্ন গলায় সপাট উত্তরটা চাবুকের মতন ছিটকে এসে পড়ল আমাদের মুখের ওপরে। এক মুহূর্তের জন্যে আমি মিস সায়গলের মুখে হিংস্র এবং উন্মাদ এক জন্তুর মুখের ছায়া দেখলাম। পরক্ষণেই ওনার গলার স্বর আগের মতন মধুর হয়ে গেল। উনি শান্ত গলায় বললেন, না, মিস্টার মজুমদার। আমার বাবা জীবনে অনেক শোক পেয়েছেন। মৃত্যুর পরে ওনার অতীত নিয়ে টানা হেঁচড়া করতে দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি বরং ছবিগুলো আমাকে ফিরিয়েই দিন। আমি ইংল্যান্ডে ফিরে ওখানকার আর্ট-ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যা করার করব।

অ্যাস ইউ উইশ। বুধোদা অ্যালবামটা সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও।

অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে মিস সায়গল জিগ্যেস করলেন, আপনারা আর কতদিন এখানে থাকছেন?

বুধোদা বলল, আমার এই বন্ধু ডাক্তার। ওর একটি ক্রিটিকাল পেশেন্ট রয়েছে ওই নীচের গ্রামে। সেই বাচ্চাটা কেমন থাকে তার ওপরেই ডিপেন্ড করছে আমরা কবে ফিরব সেই ব্যাপারটা।

রঘুদা দেখলাম এই কথা শুনে হাঁ করে বুধোদার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। টুসাই-কে একটু আগেই নিজের চোখে গাছে উঠতে দেখে এসেছে কিনা। আমি রঘুদার হাতে টান দিয়ে বললাম, চলো, বেরোই।

বেরোতে গিয়েও বুধোদা হঠাৎ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। সরাসরি মিস সায়গলের চোখে চোখ রেখে বলল, আরেকটা কথা। ভিসুক পাহানকে গত আঠেরো তারিখ থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ব্যাপারে কিছু জানেন?

মিস সায়গল বললেন, তাই নাকি? চিন্তায় ফেললেন তো। ভালো করে দেখতে হবে ঘর থেকে আরও কিছু দামি জিনিস হারিয়েছে কিনা। বদমাশটা নিশ্চয় চোরাই মাল বিক্রি করে কোথাও ফুর্তি করছে।

তাই হবে। বুধোদা একটা ছোট্ট শ্রাগ করে দরজা খুলে বাইরে বেরোল। পেছন পেছন আমি আর রঘুদা। আমাদের পেছনে বাংলোর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে আমরা বারান্দা থেকে বাগানে নেমে এলাম।

এই প্রথম ভালো করে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। টিলার মাথার কাছে প্রায় দু-বিঘে জমিকে সমতল করে তার ওপরে তৈরি হয়েছে এই বাংলো আর বাংলোকে ঘিরে গোল বাগান। বাগানে এককালে নিশ্চয় ফুলগাছ ছিল। এখন আর নেই। তবে ফলের গাছ অঢেল। চারিদিকের দৃশ্য মন ভরিয়ে দেবার মতন। পূবে তাকালে টুরা নামের সেই নদীটাকে দেখা যাচ্ছে, আসবার পথে যেটা আমরা পেরিয়ে এলাম। এমনকী আমাদের গাড়িটাকেও দেখাচ্ছে যেন নদী থেকে উঠে আসা একটা ছোট কচ্ছপ—বালির ওপরে শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। চারদিকে জমাট ঢেউয়ের মতন ছড়িয়ে রয়েছে দলমা রেঞ্জ। পাহাড়কে ঢেকে রেখেছে জঙ্গল আর সেই জঙ্গল এখন পাতা ঝরিয়ে অনেকটাই নিঃস্ব।

বুধোদাও কোমরে হাত রেখে চারদিকটা দেখছিল। হঠাৎ কী মনে হতে বলল, চল, একটু পেছনদিকটায় ঘুরে আসি।

চলো!—রঘুদা একপায়ে খাড়া। যে-ডাইনির ভয়ে চার-পাঁচ রাত ঘুমোতে পারেনি, তার হাত থেকে একটু আগে লেবুর শরবত খেয়ে মনে হচ্ছে জীবন ফিরে পেয়েছে। আর আমার তো না যাবার প্রশ্নই নেই। ঘোরার জন্যেই তো এসেছি। আবার পড়াশোনায় ফিরে যাওয়ার আগে যতটা অক্সিজেন বুকে ভরে নিয়ে যেতে পারি ততই আমার ভালো।

বাগানের বেড়ার গা দিয়েই ইটের পায়ে-চলা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমরা বাংলোটাকে বেড় দিয়ে পেছনের দিকে চললাম। যেতে যেতেই দেখছিলাম, বাংলোর সবক’টা জানলা আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেরকম উত্তুরে হাওয়ার দাপট, তাতে সেটাই বরং স্বাভাবিক।

বাংলোর পেছনে বেশ কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে তারপর একটা একতলা বিশাল ঘর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরটা কিন্তু মূল বাড়ির মতন কাঠ আর টিনের তৈরি নয়; ইট সিমেন্টের শক্তপোক্ত স্ট্রাকচার। জানলাগুলো দেয়ালের অনেক উঁচুতে বসানো। চওড়া দরজা লোহার শাটার টেনে বন্ধ করা রয়েছে।

রঘুদা ঘরটার দিকে তাকিয়ে বলল, লেট প্যারিমোহন সায়গলের ছবি আঁকার স্টুডিও।

উঁহু। বুধোদা ঘাড় নাড়ল, এটা তস্য পিতা লেট জানকীনাথ সায়গলের কারখানা ঘর। ওই দ্যাখো।

দেখলাম, বুধোদা যেদিকে আঙুল দেখাচ্ছে সেদিকে দরজার অনেকটা ওপরে প্রমাণ-সাইজের সিমেন্টের অক্ষরে কী যেন লেখা। শ্যাওলা-জমা দেয়ালের গায়ে রঙচটা রোমান হরফগুলো প্রায় মিশে গেছে, তবু একটু চেষ্টা করতেই পড়তে পারলাম—’লুধিয়ানা লেদার ইন্ডাস্ট্রি’। তার মানে বুধোদা ঠিকই বলেছে। এটা আদতে সেই লেদার-ফিল্টার বানানোর কারখানাই ছিল। পঞ্চাশ বছর আগে মিস সায়গলের বাবার হাতে স্টুডিওয় বদলে গিয়েছে।

আমরা তিনজন পায়ে পায়ে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর ঘরটাকে একটা বেড় দিয়ে চলে গেলাম পেছনদিকটায়। মুখে কেউ কিছু না বললেও তিনজনেরই যে মনের ইচ্ছেটা এক ছিল তা বুঝতে পারছিলাম। সেটা আর কিছুই নয়, একবার ঘরের ভেতরটায় ঢোকার ইচ্ছে। কিন্তু কোথাওই সেরকম কোনো ফাঁকফোঁকর দেখতে পাচ্ছিলাম না।

ঘরটার পেছনেই বাগানের এদিকের শেষ সীমানা। ওখান থেকেই পাহাড়ের ঢাল প্রায় আটশো ফিট নেমে গিয়ে মিশেছে লোহুরং গ্রামের রাস্তায় আর সেই ঢালের গায়েই ধসে পড়া লাল কাঁকরের ক্ষতচিহ্ন। এই সবই আমরা বাউন্ডারির তারের বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম।

হঠাৎ আমাদের অবাক করে দিয়ে ওই ঢাল বেয়েই উঠে এল একটা মেয়ে। প্রথমে দেখতে পেলাম কোঁকড়া-কোঁকড়া চুলে ভর্তি মাথা। তারপর কপাল, চোখ, মুখ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আস্ত মেয়েটা তারের বেড়ার ওপাশে এসে দাঁড়াল।

মেয়েটাকে দেখে মনে হল ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ে। মানে হয়তো চোদ্দো কি পনেরো বছর বয়স। রোগা, ফরসা, বড়বড় চোখ আর একটু বোঁচা নাক। একটা নীল ডেনিম আর হাতা গোটানো সাদা শার্ট পরে রয়েছে। কাঁধে ঝুলছে নীল ক্যানভাসের মেসেঞ্জার ব্যাগ। দেখলাম, ওর নাকের ডগায় চড়াই ভাঙার পরিশ্রমে গুড়িগুড়ি ঘামের ফোঁটা জমে রয়েছে। অল্প অল্প হাঁফাচ্ছিলও মেয়েটা। তবে মানতেই হবে, শক্তপোক্ত হেলথ। ঠিক দুবার লম্বা শ্বাস নিয়েই ফিট হয়ে গেল। বেড়ার একটা আলগা অংশ একহাতে তুলে ধরে, তার নীচ দিয়ে স্মার্টলি এদিকে গলে এসে, অল্প হেসে বলল, আমার পুরো নাম সপ্তদ্বীপা রায়। সবাই অবশ্য দীপা বলেই ডাকে। আপনারা?

মেয়েটা যখন হাসল, তখন দেখলাম ওর ক্যানাইন টিথ দুটো একটু উঁচু। যাকে বলে গজদন্ত। আর সেইজন্যেই বোধহয় ওর হাসিটা আমার চেনা অন্য সব মেয়ের চেয়ে অন্যরকম। অন্যরকমের ভালো।

সপ্তদ্বীপার আত্মপরিচয় দেওয়ার ধরন দেখে বুধোদাও হেসে ফেলল। ওকে নকল করে বলল, আমার পুরো নাম বোধিসত্ত্ব মজুমদার। সবাই অবশ্য বুধো বলেই ডাকে। তুমি বুধোদা বলতে পারো। ইনি রঘুনাথ দ্বিবেদী, এ হচ্ছে মাল্যবান মিত্র। ডাকনাম রুবিক। আমরা মিস সায়গলের কাছে কয়েকটা ছবির ব্যাপারে কিছু জানতে এসেছিলাম। তুমি কোথায় থাক? বেড়াতে এসেছ?

দীপা তার কাঁধের মেসেঞ্জার ব্যাগের মধ্যে হাত গলিয়ে তিনটে বেশ বড়সড় পাকা আতা বার করে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, খান, খুব মিষ্টি।

বুঝলাম আতা সংগ্রহেই বেরিয়েছিল মেয়েটা।

আমরা ফেরার পথ ধরেছিলাম। আমাদের পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে সপ্তদ্বীপা বুধোদার প্রশ্নের উত্তর দিল,—না, ঠিক বেড়াতে আসিনি। মোতিদিদাকে আগলাতে এসেছি।

বুধোদা দীপার কথায় হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ভেরি সুইট, ভেরি ইনটেলিজেন্ট। টিমোথি হেবার্ড থেকে মোতিদিদা। সপ্তদ্বীপা রায়! তুমি শিবানী রায়ের কে হও?

নাতনি। যাকে আমাদের বাংলার টিচার রঞ্জনা-ম্যাম বলেন, দৌহিত্রী। মানে মেয়ের মেয়ে।

বুধোদা একটু আগে চোখটোখ কুঁচকে কী ভাবছিল। সেটা মুহূর্তের মধ্যে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। টিমোথি সায়গলের বাড়িতে এক বাঙালি মেয়ের উপস্থিতির কারণ। তবে টিমোথির গভর্নেস শিবানী রায়, যিনি পঞ্চাশ বছর আগে জাঙ্গল ম্যালেরিয়ায় এই লোহুরঙের বাংলোবাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে সপ্তদ্বীপা রায়কে আমাদের দুজনের মধ্যে কেউই মেলাতে পারিনি। বুধোদা পেরেছে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাংলোর কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। বুধোদা হঠাৎ একজায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ওখানে বাগানের রাস্তার একপাশে একটা বড় চ্যাটালো পাথর পড়েছিল। বোঝাই যায়, পুরো জমিটাকে চৌরস করার সময় ইচ্ছে করেই পাথরটাকে সরানো হয়নি, যাতে ওটাকে একটা ন্যাচরাল বেঞ্চের মতন ব্যবহার করা যায়। সেই পাথরটার ওপর বসে বুধোদা বলল, দীপা, তুমি আমার পাশে একটু বোসো। রঘু, রুবিক তোরাও আয়। দীপা তোমার কাছে আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে।

দীপা বুধোদার পাশে বসল। রঘুদাও। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বুধোদা দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তোমাদের ফ্যামিলির সঙ্গে সায়গল ফ্যামিলির এতগুলো বছর ধরে যোগাযোগ রয়ে গেছে, তাই না? তুমি জন্মানোর আগেও সেই যোগাযোগ ছিল। ইনিশিয়েটিভটা কার দীপা?

দীপা বলল, মোতিদিদার। ওনার মনের মধ্যে আমার দিদার মৃত্যুর জন্যে একটা গিলটি-ফিলিং রয়ে গেছে। দিদা যখন মারা যান তখন দিদার বয়স ছিল মাত্র আঠাশবছর আর আমার মায়ের পাঁচ। দাদু তার তিন-বছর আগে মারা গিয়েছিলেন। অভাবে পড়ে নিজের একমাত্র মেয়েটাকে তার পিসির কাছে রেখে এই লোহুরঙে গভর্নেসের চাকরি করতে এসেছিলেন দিদা।

সেই থেকে যতদিন না মা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন ততদিন মোতিদিদা প্রতিমাসে মায়ের জন্যে বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়েছেন। মায়ের বিয়ের সময় উনি শেষবারের জন্যে কলকাতায় এসেছিলেন। আমি বড় হওয়ার পর থেকে উনি আমার সঙ্গেও রেগুলার ই-মেলে, স্কাইপে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। ভীষণ ভালোবাসেন আমাকে। আমিও ওনাকে ভালোবাসি।

দাঁড়াও। বুধোদা হাত তুলে দীপার কথার তোড় থামালো। তারপর জিগ্যেস করল, ‘গিলটি-ফিলিংস’ কেন?

আমার দিদার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।

জাঙ্গল ম্যালেরিয়ায় মারা যাননি উনি?

মোস্ট প্রোব্যাবলি, না।

তাহলে?

ব্যাপারটা শুনলে হয়তো আমাকে পাগল ভাববেন। তবুও বলেই ফেলি। আসলে এখানে আমার বড্ড একলা লাগছে, বড্ড ভয় করছে। আপনাদের বললে আপনারা যদি একটু আমার পাশে দাঁড়ান।

দেখলাম, সপ্তদ্বীপার ঝলমলে মুখটায় সত্যিকারেই ভয়ের ছায়া পড়েছে। বুধোদা ওর আংটি-আংটি চুলে ভর্তি মাথার পেছনে হাত রেখে বলল, বলে ফেল দীপা। তারপর আমিও তোমাকে বলব আমাদের ভয়ের কথা।

দীপা হাসল।

দীপা বলল, আপনাকে একটু আগে যা বলেছিলাম বুধোদা, সেটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আমি এখানে মোতিদিদাকে আগলাতে আসিনি। আমি নিবেদিতা গার্লস স্কুলের ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়ে, আমার কি ক্ষমতা আছে ওনাকে আগলাব? আমার এখানে আসার পেছনে অন্য একটা উদ্দেশ্য রয়েছে।

পঞ্চাশ বছর আগে যখন দিদার মৃত্যুর খবর কলকাতায় পৌঁছেছিল, তখন আমার দিদার এক ভাই এসেছিলেন দিদার মৃতদেহের সৎকার করতে। তিনি এখনো বেঁচে আছেন, তাকে আমি মামাদাদু বলে ডাকি।

এমনিতে মামাদাদু তখন ছিলেন কাঠ বেকার, অপদার্থ। কিন্তু সেবার তিনি এই লোহুরং থেকে এত ক্যাশ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন যে, তাই দিয়ে বাগবাজারের মোড়ে একটা জমকালো শাড়ি-কাপড়ের দোকান খুলে ফেললেন। এখনো সেই দোকান সেইখানেই রয়েছে।

বটে? কথা যাতে পাঁচকান না হয় তার জন্যে ঘুষ? তারপর…? বুধোদার গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে।

এমনিতে মামাদাদু আমার বা মায়ের সঙ্গে কোনোদিনই সম্পর্ক রাখেননি, যদিও তাঁর বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছেই। কিন্তু রিসেন্টলি সেই দাদুর মাথাখারাপের মতন হয়ে গেছে। এখনকার কোনো ঘটনা মনে রাখতে পারেন না, কোনো লোককে চিনতে পারেন না। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে কোন বন্ধুর বিয়েতে কী খাইয়েছিল দিব্যি গড়গড় করে বলে যান। মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমাকে দেখলেই ভারি খুশি হয়ে ওঠেন। মাঝে-মাঝে আমাকে শিবু বলে ডাকেন, মানে শিবানী রায়ের ডাকনামে। বুঝতে পারি, দিদার সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন।

মানসিক রুগির ওপরে তো আর রাগ পুষে রাখা যায় না। তাছাড়া উনি আমাকে দিদার ছোটবেলার অনেক গল্প বলেন। আমার খুব ভালো লাগে শুনতে। যে-দিদাকে কখনো চোখে দেখিনি, মনে হয় তাকে যেন ওই গল্পগুলোর মধ্যে দিয়ে ছুঁতে পারছি। কিন্তু উনি আজকাল প্রায়ই একটা কথা বলেন, যেটা শুনে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়।

আমরা তিনজনেই চোখে প্রশ্ন নিয়ে সপ্তদ্বীপার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ও কিছুক্ষণ মুখ নীচু করে বসে রইল। হয়তো মনে মনে সেই ভয়ঙ্কর কথাটা বলার জন্যে সাহস সঞ্চয় করছিল। তারপর হঠাৎই মুখটা তুলে ও এক নিশ্বাসে কথাটা বলেই ফেলল, মামাদাদু বলেন, আমার দিদা নাকি মারা যাওয়ার পরে কাচ হয়ে গিয়েছিলেন। ম্যালেরিয়ায় মারা গেলে কারুর শরীর কাচের মতন স্বচ্ছ হয়ে যায় না। কখন যায় তাও আমি জানি না। আপনারা জানেন?

এতক্ষণ অনেক রকমের শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছিল চারিদিকে। পাখির ডাক, শুকনো পাতার মধ্যে দিয়ে উত্তুরে হাওয়ার শনশনানি, নীচের গ্রাম থেকে ভেসে আসা লোকজনের গলার আওয়াজ। হঠাৎই কিছুক্ষণের জন্যে আমার কান থেকে সব শব্দ মুছে গেল। শুধু একটাই কথা আমাকে পাক দিয়ে দিয়ে ঘুরতে লাগল—কাচের মতন স্বচ্ছ…কাচের মতন স্বচ্ছ…

সাড় ফিরল দীপার কথাতে। শুনলাম ও বলছে—মামাদাদুর মাথার গন্ডগোল আছে ঠিকই। হয়তো সেইজন্যে কোনো কোনো ঘটনার কথা বলতে গেলে একটু সময়ের এদিক-ওদিক হয়ে যায়। কিন্তু ওনার গল্পে তথ্যের কোনো ভুল থাকে না। ওনার দূরের স্মৃতি ভয়ঙ্কর ধারালো।

জানেন বুধোদা! তাই এবারে যখন মোতিদিদা আমাকে জানালেন যে উনি লোহুরঙে আসছেন, আমি আর কৌতূহল সামলাতে পারলাম না। বায়না ধরে ওনার সঙ্গে চলে এলাম। দিদা কেমন করে মারা যাওয়ার পরে কাচের পুতুল হয়ে গিয়েছিলেন, সেটা আমাকে খুঁজে বার করতে হবে। করতেই হবে।

সকল অধ্যায়

১. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ১
২. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ২
৩. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৩
৪. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৪
৫. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৫
৬. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৬
৭. অ্যান্টিক আতঙ্ক – উপসংহার
৮. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ১
৯. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ২
১০. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৩
১১. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৪
১২. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৫
১৩. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৬
১৪. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৭
১৫. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৮
১৬. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৯
১৭. খুনি ম্যাজিক – ১
১৮. খুনি ম্যাজিক – ২
১৯. খুনি ম্যাজিক – ৩
২০. খুনি ম্যাজিক – ৪
২১. খুনি ম্যাজিক – ৫
২২. খুনি ম্যাজিক – ৬
২৩. খুনি ম্যাজিক – ৭
২৪. খুনি ম্যাজিক – ৮
২৫. খুনি ম্যাজিক – ৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন