সৈকত মুখোপাধ্যায়
সপ্তদ্বীপার এই আশ্চর্য গল্পে প্রথম রিঅ্যাকট করল রঘুদা। বলল, তাহলে ভিসুকের ওই কথাটা মিথ্যে ছিল না? সেই যে, ও বলেছিল, পঞ্চাশ বছর আগে ডাইনি আরেকটা মেয়েকে কাচের পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল।
দীপা বলল, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি।
কী শুনেছ? কোথায় শুনেছ? রঘুদা জিগ্যেস করল।
সেদিন যখন ভিসুক পাহানের ডেডবডি এই টিলার নীচে পড়েছিল, তখন ওকে ঘিরে যে ভিড়টা জমেছিল তার মধ্যে আমিও ছিলাম। আপনি আমাকে খেয়াল করেননি, কিন্তু এটা নিশ্চয় শুনেছিলেন, ভিলেজার্স-রা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে যে, ডাইনিবুড়ি পঞ্চাশ বছর আগে আরেকটা মেয়েকে ঠিক এইভাবে মেরে কাচের পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল। সেই মেয়েটিই ছিলেন আমার দিদা। বাই দা ওয়ে, ওরা ডাইনি বলছিল কাকে? মোতিদিদাকে?
রঘুদা অপ্রস্তুত মুখে বলল, ওসব নিয়ে ভেব না। এরা যাকে-তাকে যখন তখন ডাইনি বানিয়ে দেয়। সমস্যাটা অন্যজায়গায়। আমরা তো ভেবে নিয়েছিলাম যে, পঞ্চাশ বছর আগেই হোক বা এই সেদিনই, কাচের মানুষ মানে আসলে কাচের পুতুল। কিন্তু তুমি যা বলছ তাতে তো আবার সেই অলৌকিকের দিকেই ব্যাপারটা মোড় নিচ্ছে। যিনি নিজের হাতে শিবানী রায়ের সৎকার করেছিলেন, তিনিই যদি তোমাকে বলে থাকেন যে শিবানী রায়ের মৃতদেহ কাচ হয়ে গিয়েছিল, তাহলে তো আর কিছু বলার থাকে না।
বুধোদা বলল, দীপা, তুমি তো গত দশদিন এখানে মিস টিমোথি সায়গলের সঙ্গে রয়েছ। যে রহস্যের সন্ধানে এসেছিলে তার কোনো সূত্র পেলে?
না। তবে এমন একটা জিনিস পেয়েছি, যেটার সঙ্গে হয়তো এর কোনো রিলেশনসিপ থাকতেও পারে। এই বলে দীপা তার ব্যাগের মধ্যে হাত গলিয়ে একটা কাচের তৈরি কুকুর বার করে বুধোদার হাতে দিল। কুকুরটা খুব ছোট, একটা খরগোশের মতন সাইজ হবে। ছুঁচলো মুখ, বেঁটে বেঁটে পা। স্ট্যাচুটা দেখে মনে হচ্ছিল সারা গা বুরুশকুচির মতন ছোট ছোট লোমে ঢাকা ছিল এবং অদ্ভুত ব্যাপার—গলা ঘিরে এখনো ওই রকম ঘন চকোলেট রঙের কুচি কুচি লোম লেগে রয়েছে। যেন কাচের কুকুরটার গলায় একটা লোমের বকলশ পরানো রয়েছে।
বুধোদার মতন কঠিন ধাতের মানুষের মুখটাও কুকুরটাকে হাতে নিয়েই কেমন যেন বিকৃত হয়ে উঠল। আমরা তিনজনেই পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, ওটা কাচের তৈরি কুকুর নয়। ওটা আসলে একটা মরা কুকুর, যার শরীরটা কাচে বদলে গিয়েছে। নাহলে ওর স্বচ্ছ চামড়ার ভেতর দিয়ে কাচের তৈরি হার্ট, কাচের লাং, কাচের সরু পাইপের মতন প্যাঁচানো-প্যাঁচানো ডাইজেস্টিভ ক্যানাল সব দেখা যাবে কেন? কোন শিল্পীর দায় পড়েছে অত পরিশ্রম করে পুতুলের ভেতরের দেহাংশগুলো বানাবার?
ওটা দেখেই রঘুদার মুখে সেই পুরোনো ছাইয়ের মতন রং আবার ফিরে এল। রঘুদা কোনোরকমে বলল, ভিসুকের মৃতদেহটাও ঠিক এইরকম ছিল, জানো।
বুধোদা দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ইনক্রেডিবল। কোথায় পেলে এটা?
দীপা বলল, যেদিন ভিসুক পাহান মারা গেল, সেদিন আমাদের বাংলোয় সকাল থেকে একফোঁটা জল ছিল না। মোতিদিদার বাড়িতে জল আসে এই টিলার মাথায় একটা ছোট্ট ঝোরা থেকে। ঝোরার সরু জলের ধারা প্রথমে ওই স্টুডিওঘরের মেঝের নীচে একটা বিশাল ট্যাঙ্কের মধ্যে জমা হয়। তারপর সেখান থেকে পাইপের মধ্যে দিয়ে বাংলোয় পৌঁছয়। বাড়তি জল একটা ড্রেন দিয়ে টিলার নীচে বয়ে যায়, গ্রামের লোকেরা সেই জল ইউস করে। যখন স্টুডিওঘরে কারখানা ছিল, তখন থেকেই এইরকম সিস্টেম। আমি এতসব জানতাম না। সেদিন মোতিদিদাই আমার হাতে স্টুডিওঘরের চাবি দিয়ে বললেন, একবার ট্যাঙ্কটায় উঁকি দিয়ে দেখে আয় তো দীপা, জল আছে না নেই?
বুধোদা প্রশ্ন করল, তুমি ওই ঘরে ঢুকেছিলে?
ঢুকেছিলাম, ওই একবারই। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। ভীষণ ভয় করছিল।
কেন? ভয় করছিল কেন?
কি জানি, ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার হলে হয়তো ভয় করত না। কিন্তু সেরকম অন্ধকার তো ছিল না। জানলা-টানলা সব চেপে বন্ধ করা ছিল ঠিকই, কিন্তু সেদিনই প্রথম দেখলাম, ওই ঘরের ছাদের ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট গোল কাচের স্কাইলাইট রয়েছে। নীচ থেকে দেখা যায় না, কিন্তু রয়েছে। ঠিক যেন একটা ক্যামেরার লেন্স। সেটার মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত সবজেটে একটা আলো এসে পড়েছিল মেঝের একটা লোহার প্ল্যাটফর্মের ওপরে। সেটাকে দেখতে আবার অবিকল একটা ডাবল বেড খাটের মতন। খাটের মতোই চারটে পায়া, চারকোনায় মশারি টাঙানোর ছত্রীর মতন চারটে রড। শুধু মশারির বদলে ছত্রীর মাঝখানে একটা স্বচ্ছ পাথরের স্ল্যাব আটকানো রয়েছে। সকালের আলো প্রথমে লেন্সের মধ্যে দিয়ে এসে তারপর ওই পাথরের স্ল্যাবের মধ্যে দিয়ে নানান রঙে ভেঙে গিয়ে খাটের ওপরে এসে পড়েছিল।
কিছুক্ষণ ওইদিকে তাকিয়ে থাকার পরেই আমার মনে হল কেউ যেন খাটটার…স্যরি, লোহার প্ল্যাটফর্মটার ওপরে শুয়ে রয়েছে। কোনো মহিলা। তার খোলা চুল প্ল্যাটফর্মের একদিক দিয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছে। ভালো করে চোখ রগড়ে তাকিয়ে দেখি, কই। কেউ নেই তো।
ওই প্ল্যাটফর্মটার নীচে পাঁজা করে রাখা আছে চৌকো করে কাটা অনেকগুলো মোটা চামড়ার টুকরো। সেইজন্যেই মনে হয় ওটা একটা প্রেস, যার ওপরে মোতিদিদার দাদুর কারখানায় লেদারের ফিল্টার তৈরি হত। কিন্তু তার সঙ্গে ওই লেন্স আর কাচের স্ল্যাবের কী সম্পর্ক থাকতে পারে বুঝতে পারছি না।
তারপর আমি কোনোরকমে সাহস করে এগিয়ে গেলাম ঘরের কোনায় জলের ট্যাঙ্কের মুখের কাছে। আমার সেলফোনের আলোয় ট্যাঙ্কের ঢাকনা তুলে ভেতরে উঁকি মারলাম। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল ট্যাঙ্কের নীচে কেউ বসে আছে। এক্ষুনি সে আমার হাত ধরে আমাকে নীচে টেনে নেবে। যাইহোক, সেসব কিছু হয়নি। পুরোটাই আমার মনের কল্পনা ছিল।
সেদিন সকালে ট্যাঙ্কের ভেতরে জল ছিল না বললেই চলে। তবে ঝোরার জল তিরতির করে খালি ট্যাঙ্কের ভেতরে জমা হচ্ছিল, তার শব্দ পাচ্ছিলাম। বিকেলের মধ্যেই নিশ্চয় আবার ট্যাঙ্ক ভরে গিয়েছিল। কারণ, আমাদের বাংলোর পাইপ-লাইনেও জল ফিরে এসেছিল।
কিন্তু কুকুরটা? বুধোদা জিগ্যেস করল।
দীপা বুধোদাকে বলল, বলছি, দাঁড়ান। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে খুব ক্যাজুয়ালি বলল, রুবিকদা, একটু জল খাওয়াও না। আমার ব্যাকপ্যাকের সাইড-পাউচে জলের বোতলটা ও দেখতে পেয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি বোতলটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতেই ও এক নিশ্বাসে অনেকখানি জল খেয়ে, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলল, থ্যাঙ্কইউ।
তারপর আবার শুরু করল।
রাউন্ড স্কাইলাইটের মধ্যে দিয়ে যে অদ্ভুত সবজেটে আলোটা ঘরে ঢুকেছিল, তার তেজ সবচেয়ে বেশি ছিল ঘরের মাঝখানে। প্রায় দিনের আলোর মতোই। তারপর আলো কমতে কমতে দেয়ালগুলোর লাগোয়া অংশে আর আলো বলতে কিছুই প্রায় ছিল না। ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও মাথায় যে কী ভূত চাপল, মনে হল ওই অন্ধকার কোণাগুলো একটু দেখে নিই তো, কিছু পাওয়া যায় কিনা।
ওই দেয়ালের ধারে-ধারেই ডাঁই করে রাখা ছিল মোতিদিদার বাবার আঁকার সরঞ্জাম—ঘুন ধরা ট্রাইপড, রঙের প্যালেট, অজস্র বিদেশি রঙের দোমড়ানো মোচড়ানো টিউব আর গুটিয়ে রাখা ক্যানভাস। একটা মরচে ধরা বড় লোহার বাক্সের মধ্যে দেখলাম অন্তত কুড়িটা পুরোনো আমলের ক্যামেরা। আর এক জায়গায় ওই স্কাইলাইটের লেন্সটার মতন বড় বড় লেন্স, তার মধ্যে অনেকগুলোই ক্র্যাক করে গেছে। সেলফোনের আলোয় এক এক করে জিনিসগুলো দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই এক জায়গায় একটা বড় চটের বস্তার কাছে এই কুকুরটাকে পড়ে থাকতে দেখে কুড়িয়ে নিলাম।
বস্তাটা এত বছরের জলে হাওয়ায় পচে গিয়েছিল। ছিঁড়ে গিয়েছিল। ওরকমই একটা ছেঁড়া ফুটোর মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল এই স্ট্যাচু-টা। আমার খুব ভয় করছিল, তবু একহাতে সেলফোন ধরে অন্য হাত দিয়ে বস্তার মুখটা ফাঁক করলাম। করতেই ভেতর থেকে একগাদা কাচের পুতুল মেঝের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল। সবই ছোটখাটো জন্তুর কাচের রেপ্লিকা—ইঁদুর, ব্যাঙ, বেজি। পাখিও ছিল কয়েকটা। সবচেয়ে বড় জন্তু বলতে একটা খ্যাঁকশেয়াল। সবক’টাই রেপ্লিকা, কিন্তু মৃতপ্রাণীর রেপ্লিকা। সবারই চোখ বন্ধ, দাঁত বেরিয়ে এসেছে, একেকটা জন্তুর ঘাড় বেঁকে রয়েছে একেক দিকে।
সেলফোনের জোরালো আলোয় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ওদের পেটের ভেতরের কাচের নাড়িভুড়ি। এত গা গুলিয়ে উঠেছিল যে কী বলব। তবু এই কুকুরটাকে হাতছাড়া করলাম না। কেন জানেন? আমি একে চিনি, এর ছবি দেখেছি। মোতিদিদার ঘরের দেয়ালে একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙানো রয়েছে ওর ছবি। ওই অ্যালবামের ছবিগুলোর মতন রঙিন আর মরা ছবি নয়, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে জ্যান্ত ছবি। সেই ছবিতে ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে, জিভ লকলক করছে, ছোট্ট ল্যাজটা যতটা পারে উঁচিয়ে রেখেছে।
ওটা ক্যামেরায় তোলা ছবি। মোতিদিদার বাবা তুলেছিলেন। ওই কুকুরটা ছিল মোতিদিদার পোষা কুকুর। ওর নাম ছিল জিজো।
জিজোকে ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সামনের দরজার শাটার টেনে, তালা দিয়ে, বাংলোয় ফিরতে না ফিরতেই দেখি মোতিদিদা আমার অপেক্ষায় সিঁড়ির মুখে রুদ্রমূর্তিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে দেখেই সে কী বকুনি! কোথায় ছিলে এতক্ষণ? তোমার ট্রাউজার্সের হাঁটুতে এত কাদা কেন? সারা জামায় কী করে এত ধুলো মেখেছ? তোমাকে একটাই ছোট কাজ দিয়ে পাঠিয়েছিলাম, তুমি সেটা না করে এতক্ষণ কী করছিলে ওই ঘরের মধ্যে?
সত্যি বলছি, এতদিনের মধ্যে আমি মোতিদিদার অমন ভয়ঙ্কর রূপ কক্ষনো দেখিনি। উনি তো এমনিতে ভেরি নাইস লেডি। কিন্তু ওই স্টুডিও-ঘরে সময় কাটানোর ব্যাপারে ওনাকে অমন চটে উঠতে দেখেই আমার মনে হল, জিজোকে দ্যাখানো উচিত হবে না। সেই থেকে একে ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
বুধোদা কুকুরটাকে দীপার হাতে ফেরত দিয়ে সংক্ষেপে ওকে আমাদের এখানে আসার ইতিহাসটা বুঝিয়ে বলল। তারপর বলল, বুঝতেই পারছ, আমরা একই রহস্যের পেছনে দৌড়চ্ছি। তুমি আমাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছ। এবার ব্যাটনটা আমাদের হাতে দিয়ে দাও। কারণ আমার মন বলছে বাকি রাস্তাটায় হার্ডলস অনেক বেশি। দৌড়টা আমরা শেষ করি।
আমি পারব না?
না। তুমি বড্ড ছোট। উইন করব কিন্তু আমরা সবাই, অ্যাস আ টিম। বুধোদা আবার সপ্তদ্বীপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
সপ্তদীপা ঠোঁট বাকিয়ে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আর উনি আমার থেকে অনেক বড়, না কি? ওর কথা শুনে রঘুদা আর বুধোদা অত্যন্ত বিশ্বাসঘাতকের ভঙ্গিতে হেসে উঠল। আমি চেষ্টা করলাম সপ্তদ্বীপার ওপরে খুব রেগে উঠতে, কিন্তু পারলাম না। এক্ষুনি এই মেয়েটা তার নাইট- অ্যাডভেঞ্চারের যে গল্প শোনাল তাতে আমার সত্যিই মনে হচ্ছিল, আমি যা পারি ও-ও তাই পারে। হয়তো একটু বেশিই পারে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা কখন যেন বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম, সিঁড়ির মুখে কোমরে হাত রেখে মাথা উঁচু করে মিস টিমোথি সায়গল দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দীপা একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল, মোতিদিদা আবার খেপে গেছেন মনে হচ্ছে। একটু দাঁড়ান। একটা শেষ কথা বলে দিই আপনাদের। হয়তো এটাও পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে রিলেটেড।
আমি আর মোতিদিদা বাড়ির ভেতরের দিকে একটা ঘরে পাশাপাশি দুটো খাটে শুই। আমি অবশ্য বলেছিলাম, আমার দিদা যে-ঘরে শুতেন আমি সেই ঘরেই শোব। কারণ, ওই ঘরটায় এখনো দিদার গল্পের বই, সাজগোজের টেবিল, এমনকী দেয়ালে আমার মায়ের ছোটবেলার একটা ছবি অবধি টাঙানো রয়েছে। কলকাতা ছেড়ে লোহুরঙে চাকরি করতে আসার সময় দিদা ওইসবই কলকাতার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মোতিদিদা আমার কথায় রাজি হলেন না। ওই ঘরটা আসলে যাকে বলে ‘অ্যাটিক’, মানে চিলেকোঠার ঘর। একটাই মাত্র জানলা আর খুব ঠান্ডা। তাই উনি নিজের ঘরেই আমার শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আঠেরো তারিখ রাতে খুব ঠান্ডা পড়েছিল। শীতের চোটে অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমি ভাবলাম একটা কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে কম্বলের নীচে ঢুকি। তাহলে শীতটা একটু কম লাগবে। কার্ডিগানটা ছিল ঘরের বাইরে করিডরের দেয়ালে বসানো একটা ওয়ার্ডরোবের মধ্যে। ওটা নিতে গিয়েই করিডরের জানলা দিয়ে দেখলাম, ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একটা লণ্ঠনের আলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে।
জানলার কাচে মুখ ঠেকিয়ে চিনবার চেষ্টা করলাম, লোকটা কে। কিন্তু ভালো করে কিছু বোঝার আগেই ওই ঢালের মাঝখানে একটা জায়গায় লন্ঠনের আলোটা হারিয়ে গেল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন আর কিছু দেখতে পেলাম না তখন ভাবলাম আমার চোখের ভুল। ঘরে ফিরে শুয়ে পড়লাম।
রঘুদা আমাদের মুখের দিকে আড়চোখে তাকাল। যেন বলতে চাইল, মনে আছে তো? আমি বলেছিলাম, ভিসুক পাহান আঠেরো তারিখ রাতে লণ্ঠন নিয়ে ডাইনি বাংলোর দিকে রওনা দিয়েছিল।
হ্যাঁ, মনে আছে। শুধু ভাবছিলাম, ভিসুক যদি সেই রাতে বাংলো অবধি পৌঁছিয়ে না থাকে, তাহলে মরল কেমন করে? লোহুরঙের ঘাতক কি তাহলে এই বাংলোর বাইরে ছড়িয়ে-থাকা জঙ্গল পাহাড়ের মধ্যে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে?
এইসব ভাবতে ভাবতে আমরা আবার হাঁটতে শুরু করেছিলাম। দীপা পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, না, দাঁড়ান। আরও একটা কথা বলার আছে। ওইদিনই ভোরের দিকে মোতিদিদা একাই কোথাও বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন অন্তত ঘণ্টাখানেক পরে। এমন কাজ উনি কখনো করেন না। যখন ফিরেছিলেন তখন ওনার গাউন ঘামে ভিজে গিয়েছে। ওনারও হাতে পায়ে আমার মতন ধুলো। আমি কোনো প্রশ্ন করিনি। মটকা মেরে বিছানায় পড়েছিলাম। আর কিছু বলার নেই।
দীপার কথা ভাবতে ভাবতেই আমরা বাংলোর দিকে এগিয়ে চলেছিলাম। কিন্তু যে-মুহূর্তে বাংলোর দরজার সামনে পৌঁছেছি সেই মুহূর্তেই আমাদের চমকে দিয়ে মিস সায়গল তীক্ষ্ন গলায় বিশুদ্ধ ইংরিজিতে চিৎকার করে উঠলেন। উনি জানতে চাইছিলেন, কার অনুমতি নিয়ে আমরা বাংলোর বাগানে ট্রেসপাস করেছি। কেন আমরা যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সর্বোপরি উনি সপ্তদ্বীপার কাছে জানতে চাইছিলেন, এই অভদ্র লোকগুলোর সঙ্গে ওর এত কথা বলার দরকার কী?
বুধোদা হাত তুলে ওনাকে শান্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ওয়েল ওয়েল মিস সায়গল। উই আর লিভিং ইয়োর প্লেস জাস্ট নাও। আরও অনেক কিছুই বলল, কিন্তু মিস সায়গল কিছুই শুনতে চাইছিলেন না। মনে হচ্ছিল উনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। দীপা ইতিমধ্যে ওর মোতিদিদার কাছে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিস টিমোথি সায়গল দীপার চুলের মুঠি ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ওকে দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। দীপা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল।
হোয়াট দা হেল! বুধোদা রাগে গরগর করে উঠল। রঘুদার ফর্সা মুখটাও লাল টকটকে হয়ে উঠল। আমরা তিনজনেই দৌড়লাম মিস সায়গলের হাত থেকে দীপাকে ছাড়ানোর জন্যে, কিন্তু তার আগেই আমাদের মুখের ওপরে ভারী শালকাঠের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। পরিষ্কার শুনতে পেলাম, দীপার কান্নার আওয়াজ ক্ষীণ হতে হতে ওই ডাইনি-বাংলোর খুব ভেতরের কোনো ঘরে মিলিয়ে গেল।
একটুক্ষণ সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে বুধোদা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, আচ্ছা! আমারও নাম বোধিসত্ত্ব মজুমদার। এর শেষ দেখে ছাড়ব। চল রুবিক। চলো রঘুনাথ।
ফেরার পথে ইট-বাঁধানো পাকদণ্ডী রাস্তা ছেড়ে বুধোদা সেই রক্তলাল ধসের মাথার দিকে হাঁটা লাগাল। আমি বললাম, ওদিকে কোথায় চললে বুধোদা?
ওদিক দিয়েই নামব। মনে হয় না ব্যাপারটা খুব একটা কঠিন হবে। একটা মাতাল যদি ওই জমি বেয়ে উঠতে পারে তাহলে আমরাও নামতে পারব।
কিন্তু কেন? লাভ কী? আমি আবারও জিগ্যেস করলাম।
দেখতে হবে না ভিসুক পাহান কোথায় হারিয়ে গেল?
সত্যিই তো। এটা মাথায় ছিল না। মনে মনে জিভ কাটলাম।
ধসে-যাওয়া জমি বেয়ে নামার কাজটা সত্যিই খুব একটা কঠিন হল না। কারণ, ওখানে পাথর বা নুড়ি খুব একটা আলগা ছিল না আর ঢালটাও ছিল ম্যানেজেবল। কিন্তু যে ব্যাপারটা অবাক লাগছিল, সেটা হল, পুরো জায়গাটাতে গাছপালা তো দূরের কথা, একটা ঘাসের কুচি অবধি নেই। তাহলে ভিসুক পাহান সেদিন দীপার চোখের সামনে থেকে ভ্যানিস হয়ে গিয়েছিল কেমন করে? কোথায় লুকিয়েছিল?
তিনজনে প্রায় একসঙ্গেই উত্তরটা খুঁজে পেলাম। বলা ভালো, উত্তরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
একটা টানেল। হ্যাঁ, কংক্রিটে বাঁধানো প্রায় চার ফিট ডায়ামিটারের একটা টানেল। যে বড় পাথরটা দিয়ে ওই টানেলের মুখটা আড়াল করা ছিল সেটাতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে আমি সামলে নিলাম। আমার ঠিক পেছনেই ছিল বুধোদা আর রঘুদা। ওরাও মাটিতে পা গেঁথে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বুধোদা বলল, সন্দেহ নেই এই টানেলটার মধ্যেই ঢুকে পড়েছিল ভিসুক। এখন আমাদের কী করণীয়?
বুধোদার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে একটা ব্যাপারে আমার বেশ বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে—যে-কোনো রহস্যের সমাধানে রাত্রিবেলাটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সে কালো-অর্কিডের খোঁজই হোক, কিংবা নেকড়ে-মানুষের পিছু নেওয়া। কাজেই বিন্দুমাত্র না ভেবেই বলে দিলাম, আজ রাতে একবার টানেলটার ভেতরে ঢুকলে হয় না বুধোদা?
অবশ্যই। এই না হলে চ্যালা! এই বলে বুধোদা এত জোরে আমার পিঠ চাপড়ে দিল যে, আরেকটু হলে টিলার ঢাল গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। সেসব খেয়াল না করে বুধোদা বলল, এখন মিস সায়গল নিশ্চয় জানলার ফাঁক-ফোকর দিয়ে চারিদিকে নজর রাখছেন। কাজেই রাত ছাড়া সময় কোথায়? চলো রঘুনাথ। গ্রামে ফিরে নিজেদের হাতে ফুটিয়ে দুটি ডালভাত খাই। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।
এরপর আমরা তিনজন লোহুরঙ গ্রামে শঙ্কু পাহানের ঘরে দুপুরের আশ্রয় নিলাম। ডালভাত খেতে হয়নি। শঙ্কু আমাদের সম্মানে দেশি মুরগির ঝোল রেঁধেছিল। বুধোদা আর রঘুদা সেই ঝোল আর কুদরিভাজা দিয়ে যতগুলো করে বাজরার রুটি খেল তাতে মনে হল সেই চিকেন-কারির স্বাদ ভালোই হয়েছিল। কিন্তু আমার মুখে কিছুই ভালো লাগছিল না।
আমি শুধু ভাবছিলাম, দীপা কি আজ খেতে পেল, নাকি উপোসেই রইল?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন