খুনি ম্যাজিক – ৬

সৈকত মুখোপাধ্যায়

ছয়

সত্যিই কাচের স্যুইং-ডোর ঠেলে সিসিডির ভেতরে ঢুকে এলেন সুদীপকাকু, মানে দীপার বাবা। ওনার জন্যে ক্যাপুচিনো এল। দীপা খুব চটপট সুবিনয় মুস্তাফির ভূত-নামানোর আসরের পুরো গল্পটা বাবাকে শুনিয়ে দিল। এবার আমরা সবাই বুধোদার দিকে তাকালাম। কাকিমা বললেন, বোধিসত্ত্ব! পুরোটাই যে ধাপ্পাবাজি সে তো বুঝতেই পারছি। না-হলে সেই সর্বজ্ঞ-প্রেত এটুকু জানতো না যে, তোমার কাকাবাবু সুস্থশরীরে কলকাতায় রয়েছেন? কিন্তু সুবিনয় মুস্তাফি প্ল্যানচেটের আসরের ঘটনাগুলো ঘটাল কেমন করে?

বুধোদা বলল, এটা বুজরুকির একটা ক্ল্যাসিক উদাহরণ। একটা কথা জানেন তো? সারা পৃথিবীতেই ম্যাজিকের শুরুটা কিন্তু এই সুবিনয় মুস্তাফির মতন ধাপ্পাবাজদের হাতেই হয়েছিল। তারা কখনো ছিল মন্দিরের পুরোহিত, কখনো রাস্তার ধারের বাজিকর আবার কখনো ভূত-নামানোর ওঝা। সাধারণ ম্যাজিকের খেলাকে এরা বলত দৈবী ঘটনা। ভক্তদের কাছে নিজেদের প্রোজেক্ট করত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে। সাধারণ মানুষ চিরকালই অলৌকিকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। ভাবে, পুরোহিত, ওঝা কিম্বা বাজিকরের আশ্চর্য ক্ষমতা তাদের সবরকম বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করবে। এই সুযোগটাই ভণ্ড-সাধুরা যুগ-যুগ ধরে নিয়ে আসছিল। বেশ নির্বিঘ্নেই রাজ্যপাট চালাচ্ছিল তারা।

মুশকিলটা বাধল এই ধরুন নাইনটিনথ সেঞ্চুরির মাঝামাঝি থেকে। ওইসময়েই আমেরিকা, ইওরোপ আর চীনে একইসঙ্গে একঝাঁক প্রতিভাবান ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিককে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। মন্দির কিম্বা রাস্তার ধারের গাছতলা থেকে ম্যাজিককে তুলে আনলেন স্টেজের ওপর। তারা বললেন না যে, তারা যা দেখাচ্ছেন সেগুলো কোনো অলৌকিক ঘটনা। তারা নিজেদের অতিজাগতিক শক্তির অধিকারী বলেও দাবি করলেন না। বরং খেলা দেখাতে উঠে তারা জোর গলায় ঘোষণা করতে শুরু করলেন, যা দেখাচ্ছি তা জাগলারি, জিমনাস্টিক কিম্বা নাচগানের মতনই একটা আর্ট। আপনারা এর পেছনে লুকিয়ে থাকা বুদ্ধি আর সাধনাকে উপভোগ করুন, আর কিছু নয়।

ন্যাচারালি, এই ম্যাজিশিয়ানদের সঙ্গে ভণ্ড সাধুদের লড়াই বাঁধল। সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে, কিন্তু ম্যাজিশিয়ানদের চোখে তো আর ভণ্ডামি লুকিয়ে রাখা যায় না। তাই ইওরোপ আর আমেরিকায় বহু নামজাদা যাদুকর, ম্যাজিক দেখানোর পাশাপাশি, এইসব ভণ্ডদের মুখোশ খুলে দেওয়ার কাজে নেমে পড়লেন। সময়টা, ওই-যে একটু আগেই বললাম, আঠেরোশো পঞ্চাশ সালের কাছাকাছি।

ওইসময়ে আমেরিকায় আর বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ‘স্পিরিচুয়ালিস্ট’ নামে একদল ভণ্ড খুব লোক ঠকিয়ে খাচ্ছিল। ঠিক এই সুবিনয় মুস্তাফির মতন ওরাও প্রচার করত, ওরা মৃতমানুষের আত্মাকে ডেকে আনতে পারে। সেই আত্মাকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারে নানান অসম্ভব কাজ। আর কাজই বা করাতে হবে কেন? শুধু মাত্র মৃত প্রিয়জনের গলাটুকু একবার শোনার জন্যে, একবার তার নিজের হাতের লেখায় সে পরলোকে গিয়ে কেমন আছে জানার জন্যেই তো কত মানুষ হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। তারা দলে-দলে গিয়ে ভিড় জমাত ওই স্পিরিচুয়ালিস্টদের প্রেত নামানোর আসরে। মুগ্ধ এবং আতঙ্কিত চোখে দেখত অদৃশ্য আত্মা কেমন করে টেবিলে টোকা মেরে সাংকেতিক ভাষায় প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, কেমন করে আপনা থেকেই বেজে উঠছে ঘরের কোনায় রাখা হারমোনিয়াম কিম্বা এই আপনারা যেমন দেখলেন, সাদা খাতায় ভূতুড়ে-পেনসিল লিখে দিয়ে যাচ্ছে প্রশ্নের উত্তর।

এরকমই এক স্বঘোষিত মিডিয়াম ছিলেন এক ধুরন্ধর আমেরিকান মহিলা, নাম মিসেস ডিস-ডেবার। আঠেরোশো সত্তর সাল থেকে তার অপকর্মের শুরু। প্রথমে কেনটাকি, তারপর বালটিমোরে হিপনোটিস্ট সেজে অনেক লোককে ঠকালেন। সেখানকার লোকে যখন তার স্বরূপ বুঝে গেল তখন ডিস-ডেবার পালালেন নিউইয়র্কে এবং কী সৌভাগ্য তার, পেয়ে গেলেন এক শাঁসাল শিকার। এক কোটিপতি নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ—নাম লুথার মার্শ।

প্রথমে কিছুদিন মিসেস ডিস-ডেবার লুথারের কাছে বিগত যুগের নামজাদা সব চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি বিক্রি করলেন। রাফায়েল, মিকেলেঞ্জেলো এনাদের আত্মারা এসে বন্ধ আলমারির ভেতরে রেখে দেওয়া ক্যানভাসের ওপরে ছবি এঁকে দিয়ে গেলেন। বিনিময়ে ওই আলমারির ভেতর থেকেই মার্শের টাকার থলি নিয়ে গেলেন শিল্পীরা। লুথার মার্শ তো বিশ্ববরেণ্য শিল্পীদের আঁকা ছবি পেয়ে মহা খুশি; তা হোক না তাঁদের মৃত্যুর পরে আঁকা।

বুঝতেই পারছেন আত্মাদের নিয়ে যাওয়া সব টাকাই জমা পড়ল ডিস-ডেবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।

ডিস-ডেবারের লোভ বেড়ে গেল। তিনি এবার একদিন প্ল্যানচেটে লুথার মার্শের মৃত মেয়েকে ডেকে আনলেন। বহুকাল আগে মৃত সেই মেয়ে করুণগলায় বাবাকে বলল, বাবা! তোমার সমস্ত টাকাপয়সা আর বাড়িগাড়ি তুমি ডেবারমাসির নামে লিখে দাও। প্লিজ।

লুথার মার্শ তো হারানো মেয়ের এই আবদারে একেবারে আপ্লুত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। কিন্তু দেখা গেল মার্শের আত্মীয়স্বজন অত্যন্ত পাজি। তারা ডিস-ডেবারের নামে নিউইয়র্কের কোর্টে চিটিংবাজির কেস ঠুকে দিল। তারা বলল, ডিস-ডেবার জোচ্চোর। ওসব প্ল্যানচেট- ট্যানচেট সব ডাঁহা মিথ্যে। সেই মিথ্যেটা প্রমাণ করার জন্যে তারা কোর্টে হাজির করল তখনকার বিখ্যাত জাদুকর কার্ল হার্টজকে। কার্ল হার্টজ ভরা কোর্টরুমের মধ্যে দিনেদুপুরে ডিস-ডেবার যা-যা করেছিলেন সব করে দেখিয়ে দিলেন। শুধু দেখিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, সবাইকে বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন, কোন অলৌকিকের পেছনে কোন লৌকিক কায়দা রয়েছে।

কার্ল হার্টজ পরে নিজেই এই ঘটনার কথা লিখেছিলেন আর সেই লেখাটা আমি পড়েছিলাম। আপনাদের কথা শুনে বুঝলাম, দেড়শোবছর বাদে এই কলকাতাতে বসে সুবিনয় মুস্তাফি অবিকল ডিস-ডেবারের কায়দায় মানুষ ঠকাচ্ছেন।

শোনো দীপা! যেরকম সাদা প্যাড টেবিলের ওপরে রাখা ছিল, অবিকল সেরকম একটা প্যাডের কাগজে আগে থাকতেই ভক্তদের প্রশ্নের উত্তর-টুত্তর লিখে সুবিনয়বাবু নিজের সিল্কের আলখাল্লার ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সিয়াঁসের শেষ দিকে কোনো একটা সময়ে টুক করে সাদা প্যাডের সঙ্গে লেখা-প্যাড বদলাবদলি করে নেওয়াটা, যে লোক ম্যাজিকের অ-আ-ক-খ জানে, তার কাছে কিছুই কঠিন নয়। আর আমার দৃঢ় ধারণা, পেনসিলটার ডগার কাছে লোহা কিম্বা নিকেলের টুকরো লুকোনো ছিল। চুম্বকটা ছিল টেবিলের নীচে, সুবিনয়বাবুর হাঁটুর ওপরে। হাঁটু নাড়িয়ে উনি পেনসিলকে নাড়াচ্ছিলেন।

মণিকাকিমা বললেন, কিন্তু পেনসিল দিয়ে যদি কিছু লেখাই না হয়, তাহলে ওরকম খসখস শব্দ হবে?

হবে। কেমন করে হবে সেটা দেড়শো বছর আগে কার্ল হার্টজ নিউইয়র্কের কোর্টরুমে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। উনিও সেদিন কোর্টের মধ্যে ঠিক এইভাবে আত্মাকে দিয়ে প্যাডের কাগজে প্রশ্নের উত্তর লিখিয়েছিলেন। সেদিনও সকলে আপনার মতনই লেখার খসখস আওয়াজ পেয়েছিল। হার্টজ পরে দেখিয়েছিলেন, ওনার ডানহাতের মাঝের আঙুলের একটা নখ অনেকটা বড় আর সেই নখটার মাঝখান বরাবর লম্বালম্বি চেরা। যতক্ষণ জাদুকর হার্টজ ওই চেরা নখটা টেবিলে ঘসেছেন ততক্ষণই ঠিক পেনসিলের শিস ঘসার মতন শব্দ উঠেছে। ডিস-ডেবার এবং তার মতন স্পিরিচুয়ালিস্টরা এইভাবেই আত্মাকে দিয়ে উত্তর লেখাত।

আজ সুবিনয় মুস্তাফিও ঠিক একই কায়দায় আত্মা নামিয়েছেন। আর ওই যে আপনাদের চারপাশে ফিসফিসে গলার আওয়াজের কথা বলছিলেন, আমার বিশ্বাস ওটাও ভেনট্রিলোকুইজমের কায়দা ছাড়া আর কিছুই নয়। সুবিনয় মুস্তাফি তার বাবার কাছ থেকে ম্যাজিকের এই বেসিক কয়েকটা বিদ্যে তো শিখেইছিলেন।

আমরা সবাই মন দিয়ে বুধোদার কথা শুনছিলাম। এবার বুধোদা কথা শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, মনে হয় আমাদের ওঠা উচিত।

সুদীপকাকু বললেন, কিন্তু বোধিসত্ত্ব, ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? আজ দীপা আর ওর মা যা দেখে এল তাতে সুবিনয় মুস্তাফিকে একটা নীচু গ্রেডের জোচ্চোরের বেশি তো কিছু মনে হচ্ছে না। ওনার দাদু, মানে তারাপদবাবুর ডায়েরি বা চিঠিপত্রের মধ্যে যদি এমন কোনো একটা জিনিসের কথা থেকেও থাকে, তাহলেও সেটাকে অ্যান্টিক বলে চিনে নেওয়ার ক্ষমতা কি লোকটার আছে?

বুধোদা বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন কাকু। আরও একটা কথা আছে। রাম শ্যাম যদুর হাতে অ্যান্টিক চলে এলেও তারা কিন্তু সেটার দাম কত হতে পারে আন্দাজ করতে পারে না। এ তো আর সোনা কিম্বা হিরে নয় যে, গ্রাম কিম্বা ক্যারাটে ওজন করলেই দাম বেরিয়ে যাবে। সেইজন্যেই ভাবছি, জিনিসটার অ্যান্টিক-ভ্যালু ছাড়া অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য আছে কিনা, যেটা একমাত্র সুবিনয় মুস্তাফির কাছেই দামি। তাই যদি হয়, তাহলে আমার পক্ষে সেটা ধরা মুশকিল।

সুদীপকাকু বললেন, কিন্তু তাহের আলি লেনের ওই বাড়িতে সেরকম কিছু যে আছে সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত, তাই তো?

হ্যাঁ। এখনো অবধি সুবিনয় মুস্তাফি যে-পরিমাণ উদ্যোগ নিয়েছেন—যেভাবে ওনার স্পাই প্রতাপবাবুকে উত্তরপাড়া অবধি ধাওয়া করেছে, যেভাবে উনি নিজে আমাকে হুমকি দিতে চলে এসেছেন, তাতে অন্যরকম কিছু ভাববার স্কোপ কোথায়?

তাহলে তুমি প্রতাপবাবুকে বাড়িটা বিক্রি করতে বারণ করছ না কেন?

বুধোদা বলল, কেমন করে বারণ করি বলুন। কিসের ভিত্তিতে বারণ করব? ঘিঞ্জিগলির মধ্যে ওই ছোট্ট পুরোনো বাড়িটার জন্যে সুবিনয় মুস্তাফি ওনাকে যে দাম দিচ্ছেন তা আর কে ওনাকে দেবে? আমি কি পারব সেরকম কোনো বিকল্প খরিদ্দার জোগাড় করে দিতে?

আমরা পাঁচজনেই আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সিসিডি থেকে বেরিয়ে এলাম। সুদীপকাকুর কোয়ালিসটা দোকানের সামনেই পার্ক করা ছিল। দীপা বলল, বাবা, আমরা রুবিকদাদাদের ডানলপ মোড় অবধি নামিয়ে দিয়ে বাগবাজারে ব্যাক করতে পারি তো।

সুদীপকাকু কড়াচোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি না বললেও আমি তাই করতাম।

ওর মুখটা চুন হয়ে গেল। আমি লুকিয়ে-লুকিয়ে দীপার হাতটা মুঠোর মধ্যে ধরে ফিসফিস করে বললাম, ডোন্ট মাইন্ড। বাবারা একটু বকাঝকা করেই থাকেন—এই বলে সামনের সিটের দিকে এগোতে যাচ্ছি, দীপা আমার হাতে টান দিয়ে ততোধিক ফিসফিস করে বলল, ব্যাকসিটে আমার পাশে বসবে চলো। বোকচন্দর।

সকল অধ্যায়

১. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ১
২. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ২
৩. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৩
৪. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৪
৫. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৫
৬. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৬
৭. অ্যান্টিক আতঙ্ক – উপসংহার
৮. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ১
৯. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ২
১০. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৩
১১. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৪
১২. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৫
১৩. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৬
১৪. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৭
১৫. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৮
১৬. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৯
১৭. খুনি ম্যাজিক – ১
১৮. খুনি ম্যাজিক – ২
১৯. খুনি ম্যাজিক – ৩
২০. খুনি ম্যাজিক – ৪
২১. খুনি ম্যাজিক – ৫
২২. খুনি ম্যাজিক – ৬
২৩. খুনি ম্যাজিক – ৭
২৪. খুনি ম্যাজিক – ৮
২৫. খুনি ম্যাজিক – ৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন