সৈকত মুখোপাধ্যায়
ডাম্পি মাহাতো কুলি-ব্যারাকে নিজের বাড়িতে শুতে চলে গেল, কিন্তু তার বলে যাওয়া কথাগুলো যেন বাংলোর মধ্যে কুয়াশার মতন পাক খেয়ে বেড়াতে লাগল। একটা অস্বস্তি আমাদের দুজনেরই মনের ওপরে চেপে বসেছিল। বুঝতে পারছিলাম সেটার জন্যে এই কুকড়াঝোরার পরিবেশও অনেকটা দায়ী। এত গভীর অন্ধকার, এত নিস্তব্ধতা আমি শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ছিল না। এমন পরিবেশে সবই মনে হয় সম্ভব। আর প্রেত-নেকড়ের ব্যাপারটা গল্প হতে পারে, কিন্তু সুবেশ তির্কের ভয়ঙ্কর মৃত্যু তো গল্প নয়। অমন কত সুবেশের দীর্ঘনিশ্বাস এই কুকড়াঝোরার হাওয়ায় মিশে আছে কে জানে!
ডাম্পিভাই চলে যাওয়ার পর আমি খুব মন দিয়ে বাংলোর সবক’টা জানলা দরজা ভেতর থেকে ভালো করে বন্ধ করা হয়েছে কিনা চেক করে এলাম। দুটো ঘর, ডাইনিং-হল, কিচেন সব মিলিয়ে জানলার সংখ্যা বারোটা, তবে দরজা মাত্র দুটো। একটা সামনের দিকে, আরেকটা পেছনে, রান্নাঘরের দেয়ালে।
সামনের দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে আমি দেখতে গেলাম পেছনেরটাও লাগানো আছে কিনা। জানতাম না যে, ডাম্পিভাই দুটো দেশি-মুরগির পায়ে দড়ি বেঁধে রান্নাঘরের এক কোণায় শুইয়ে রেখে গেছে। আমাকে ল্যাম্প নিয়ে ঢুকতে দেখে মুরগিদুটো আচমকাই এমন কঁক কঁক শব্দ করে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল যে ভয়ে আমার বুকটা ধক করে উঠেছিল। ব্যাপারটা বোঝার পরে নিজের মনেই একটু হাসলাম। একটা সামান্য গল্প যে মানুষের নার্ভের ওপর কতটা চাপ ফেলতে পারে তার প্রমাণ এই মুরগির ডাকে আমার চমকে ওঠা।
যাই হোক, মুরগিদুটোকে পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই দরজাটা যাতায়াতের জন্যে ব্যবহার করার দরকার পড়ে না। শুধু ডাম্পিভাইকেই দেখেছি রান্না করার সময় ওই দরজা দিয়ে কখনো কখনো কুঁয়োতলা থেকে জল আনতে যেতে। হ্যাঁ, ওদিক দিয়েই একটা বারান্দা পেরিয়ে কুঁয়োতলায় যাওয়া যায়। ওটাই সেই বারান্দা, যেখান থেকে উইলিয়াম সাহেবের পেয়ারের কুকুরকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল প্রেত-নেকড়ে।
কী মনে হতে আমি দরজাটা খুলে একবার বাইরে মুখ বাড়ালাম। আকাশে ঘন-ঘন বিদ্যুত চমকাচ্ছিল। সেই আলোয় দেখলাম কুঁয়োতলার ওপাশ থেকেই শুরু হয়ে গেছে জঙ্গল। মাঝখানে শুধু একটা কাঁটাতারের বেড়া, যেটা আবার জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি দরজার খিলটা ভালো করে আটকে দিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলাম।
বুধোদা দেখলাম বেশি কথাবার্তা বলছে না। কিছুক্ষণ ল্যাম্পের আলোয় একটা বই খুলে বসে রইল। বোধহয় মন বসছিল না, তাই একটু বাদে একটা মস্ত হাই তুলে শুয়েও পড়ল। আমাকে বলল, তুইও আর রাত না করে শুয়ে পড় রুবিক। কাল বরং ভোর ভোর উঠে পড়ব।
একটা ঘরেই পাশাপাশি দুটো খাট। মাঝখানে কিছুটা গ্যাপ। আমি কেরোসিন-ল্যাম্পের ফ্লেম টা কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
আমাদের ঠিক পায়ের কাছের দেয়ালে বেশ কয়েকটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফোটোগ্রাফ মাউন্ট করে রাখা ছিল। কিছুক্ষণ আগে অন্যান্য জিনিসের মতন এই ফোটোগুলোকেও আমি আর বুধোদা খুঁটিয়ে দেখেছিলাম। সবই একশো বছর আগের কুকড়াঝোরার সিন-সিনারি। একটা ছবিতে দেখেছিলাম, বিরাট একটা উঠোনের মতন জায়গায় সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে চা-বাগানের হতদরিদ্র কুলির দল। বুধোদা আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল, তখন প্রতিদিন সকালে কুলিদের গুনতি হত। তাতেই ধরা পড়ে যেত কেউ পালাল কিনা। একদম জেলখানার স্টাইল। ওটা সেই কুলি-গুনতির ছবি।
তখন যে ছবিটাকে সব চেয়ে কম গুরুত্ব দিয়েছিলাম, সেই ছবিটাই এখন আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছিল না। একটা কুকুরের ছবি। ভোঁতা মুখ, কুঁতকুঁতে চোখ। লেজটা দেখলে মনে হয় যেন কেউ কাঁচি দিয়ে গোড়া থেকে কেটে দিয়েছে। এটাই নিশ্চয় গ্যাবন উইলিয়ামের সেই খুনে কুকুর যেটাকে তিনি পালিয়ে যাওয়া কুলিদের ধরে আনতে কাজে লাগাতেন। ওই দাঁতগুলোই নিশ্চয় সুবেশ তির্কে নামে এক সাতাশ বছরের ছেলের গলায় বসে গিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা কথাও ভাবছিলাম। এরকম ভয়ঙ্কর একটা কুকুরকে যে রাতারাতি নিঃশব্দে লোপাট করে দিতে পারে সে কে? সে কি সত্যিই প্রেত?
এইসব চিন্তা মাথার মধ্যে নিয়েই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয়তো সেইজন্যেই আমার স্বপ্নের মধ্যে ফিরে এল প্রেত-নেকড়ে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম, বিশাল একটা কালো রঙের জন্তু আমাকে তাড়া করেছে। আমি দৌড়তে দৌড়তে কোনোরকমে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে খিল তুলে দিলাম, কিন্তু সেই জন্তুটা আমাকে ছাড়ল না। সে বন্ধ দরজার ওপর লাফিয়ে পড়ল। জন্তুটা দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছিল। কাঠের পাল্লার ওপর তার নখের আওয়াজে আমি কেঁপে উঠছিলাম।
ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ল্যাম্পটা নিভে গিয়েছিল। অন্ধকার ছাদের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নটার কথাই ভাবছিলাম, এমন সময় একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। কাঠের ওপর নখ দিয়ে আঁচড়ালে যে খরখর শব্দটা হয়, সেই শব্দ। এবার আর স্বপ্ন নয়, সত্যিই কোনো জন্তু বাংলোর পেছনের দরজাটা আঁচড়াচ্ছে। খুব বড় কোনো জানোয়ারই হবে, কারণ এতটা দূরত্ব পেরিয়েও সেই শব্দ আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে যেন একটা চাপা গর্জনও শুনলাম। আমি ডাকলাম—বুধোদা, বুধোদা।
বুধোদার ঘুম ভীষণ পাতলা আর একবার ঘুম ভাঙলে ওর পুরোপুরি সজাগ হয়ে যেতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে না। আমি তৃতীয়বার ডাকবার আগেই ও উত্তর দিল—শুনেছি। ঘাবড়াস না।
তারপরেই ও চট করে হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে রিভলবারটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। তখনও সেই দরজা আঁচড়ানোর শব্দটা হচ্ছিল। বাইরে ডিনার টেবিলের ওপর ডাম্পিভাই পাঁচ-সেলের একটা টর্চ রেখে গিয়েছিল। সেটা হাতে নিয়ে যতক্ষণে আমি আর বুধোদা কিচেনের মধ্যে দিয়ে পেছনের দরজায় গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে আঁচড়ানোর শব্দ থেমে গেছে। দরজার পাশেই একটা বড় কাচের জানলা ছিল। তার সার্সির ভেতর দিয়ে বুধোদা বাইরে টর্চের আলো ফেলল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। বুধোদা বলল, মনে হয় কুকুর। এঁটোকাঁটার গন্ধে দরজা আঁচড়াচ্ছিল।
আমি বললাম, কুকুরের দরজা আঁচড়ানোর শব্দ কি এত জোরে হয় বুধোদা? তাছাড়া আমি একটা গর্জন শুনেছি।
বুধোদা বলল, চল তাহলে বাইরে গিয়ে দেখি। ভয় নেই, আমি তৈরি আছি। একহাতে রিভলভারটা তাক করে রেখে অন্য হাত দিয়ে চট করে দরজাটা খুলে বুধোদা বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াল। পেছনে আমি।
জন্তুটাকে দেখতে পেলাম না, কিন্তু সে যে এসেছিল তার প্রমাণ আমাদের সামনেই ছিল।
দেখতে পেলাম, শক্ত কাঠের পাল্লার ওপর গভীর হয়ে কেটে বসেছে সারি সারি নখের দাগ আর ভিজে মাটির ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে ফিরে গেছে একসারি থাবার ছাপ।
আমি আর বুধোদা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কোনো কুকুরের থাবা যে অত বড় হয় না সেটা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম।
ভালো করে দরজাটা বন্ধ করে আমরা আবার ঘরে ফিরে এলাম।
তারপর স্বাভাবিকভাবেই আর ঘুমোতে পারিনি। বাকি রাতটা মুখোমুখি দুটো চেয়ারে দুজনে চুপ করে বসেছিলাম। বুধোদার মনের মধ্যে কী হচ্ছিল বলতে পারব না, কিন্তু আমি যেন প্রত্যেক জানলার কাছে একটা কালো নেকড়ের হিংস্র মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। যে কোনোদিক থেকে সামান্য শব্দ ভেসে আসলেই মনে হচ্ছিল সেই প্রাণীটা আমাদের এই জরাজীর্ণ বাংলোর দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবার চেষ্টা করছে।
একটুবাদেই আবার মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। তাতে অবশ্য এক দিয়ে ভালোই হয়েছিল। বাইরের ওইসব ভয় দেখানো শব্দ আর দৃশ্য সেই বৃষ্টির তোড়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
বৃষ্টি যখন থামল, তখন ঘড়িতে ভোর ছটা।
বৃষ্টি থামতেই বুধোদা হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নাঃ, এইভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়। রুবিক, গেট রেডি। এই বলে টুথব্রাস নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। আমি জিগ্যেস করারও সময় পেলাম না কিসের জন্যে রেডি হব।
আমরা তৈরি হয়ে বাংলো থেকে বেরোনোর আগেই ডাম্পি মাহাতো এসে উপস্থিত হল। মনে পড়ল, ও কাল রাতেই কথা দিয়ে গিয়েছিল, সাড়ে ছ’টায় এসে আমাদের ডেকে দেবে। আমাদের এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে দেখে ও একটু অবাক হল ঠিকই, কিন্তু বুঝতে পারল না যে, এর পেছনে অন্য কোনো গল্প আছে। আমরাও ওকে কিছু বললাম না। বুধোদা আগেই বলে রেখেছিল, প্যানিক ছড়িয়ে লাভ নেই।
আমরা বেরোবো শুনে ডাম্পিভাই আমাদের চা আর জলখাবার না খাইয়ে ছাড়ল না। তাতে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতন সময় গেল। শেষ অবধি যখন আমরা বাংলোর বাইরে পা রাখলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা।
বাইরে বেরিয়ে বুধোদা সোজা-রাস্তায় না গিয়ে বাংলোটাকে একটা চক্কর দিয়ে পেছনের বাগানে চলে এল। আমরা পেছনের দরজাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম মাটির ওপরে কাল রাতের সেই থাবার ছাপগুলো আর নেই। বৃষ্টিতে সব ধুয়ে গিয়েছে। বুধোদা বলল, ভালোই হয়েছে। আশা করি নখের দাগগুলোও ডাম্পি দেখতে পাবে না। কারণ, ও দরজা খোলে বা বন্ধ করে রান্নাঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে। সেদিকে কোনো দাগ নেই।
আমরা আবার বাংলোর সামনের রাস্তায় ফিরে এলাম। সেখান থেকে বুধোদা হাঁটা লাগাল সোজা সামনের দিকে।
এইবার বুধোদাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম—আমরা কোথায় যাচ্ছি বুধোদা?
পুরনো চার্চে। বুধোদা গম্ভীর মুখে জবাব দিল।
আমাকে কেউ কোনোদিন ভীতু বলেনি। বরং ডাকাবুকো বলেই চিরকাল আমার বদনাম। ইচ্ছে করেই আমি অনেক বিপজ্জনক কাজে জড়িয়ে পড়েছি —তার কোনোটা একা, কোনোটা বুধোদার সঙ্গে। কিন্তু আজ বুধোদার এই কথা শুনে আমার বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।
ভয়টা বোধহয় আমার মুখেও ফুটে উঠেছিল। বুধোদা একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওর রিভলভারটা বার করে আমাকে দেখাল। তারপর আবার সেটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে বলল, কাঠের দরজার গায়ে যে জন্তুর নখের আঁচড় পড়ে, তার নিশ্চয় শরীর আছে। অশরীরী সে নয়। আর শরীর যদি থাকে, সেই শরীরে বুলেটও বিঁধবে। ঠিক কিনা বল?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন