সৈকত মুখোপাধ্যায়
দুপুরে ডাম্পিভাই আর গাপ্পিও আমাদের সঙ্গেই লাঞ্চ করল। তারপর ডাম্পিভাই ছেলেকে কোয়ার্টারে রেখে আসতে গেল। বুধোদা ওকে বলে দিয়েছিল, তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে, অনেক কাজ আছে। ডাম্পিভাই ফিরে এল ঠিক আড়াইটের সময়। তারপরেই আমরা কাজে নেমে পড়লাম। যে কাজে এখানে আসা, সেই কাজে। অর্থাৎ অ্যান্টিকগুলোকে দেখে, তাদের ঠিকুজি-কুলুজি লিখে, সম্ভাব্য দাম ফেলে, একটা ক্যাটালগ বানানো।
সে এক বিশাল কাজ। ডাম্পিভাই একটা একটা করে লফট, ক্যাবিনেট কিম্বা সিন্দুক খুলছে আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে একেক রকমের জিনিস। কোনো ক্যাবিনেটের ভিতরে বন্দুক-রাইফেল আর রিভলবারের সারি। কোনো সিন্দুকের ভেতরে রুপো আর পোর্সেলিনের বাসনপত্র। ঘড়িই ছিল অন্তত দশ রকমের—সিঁড়ির কোণায় রাখা বিশাল আকারের গ্র্যান্ডফাদার-ক্লক, দেয়ালে টাঙানো কুকু-ক্লক ছাড়াও একটা কাবার্ডের মধ্যে থেকে পাওয়া গেল কাচের ছোট্ট বেল-জার দিয়ে ঢাকা একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘড়ি, যেটার ডায়ালের সামনে বল-ড্যান্সের ভঙ্গিতে এক সাহেব-পুতুল আর এক মেম-পুতুল দাঁড়িয়েছিল। বুধোদা খুব সাবধানে ঘড়িটায় দম দেওয়া মাত্র একশো বছরের পুরনো সেই টেবিল-ক্লকের ভেতরে পুতুলদুটো ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করল।
ব্যাপার-স্যাপার দেখে বুধোদা মন্তব্য করল, এখানে যা আছে তাই দিয়ে একটা নতুন মিউজিয়াম খুলে ফেলা যায়।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বুধোদার ল্যাপটপে এখনো অবধি যে কটা অ্যান্টিক পাওয়া গেছে তার একটা লিস্ট টাইপ করে ফেললাম। তারপরে কী করব ভাবছিলাম। বাংলোর মধ্যে একটা আলমারিতে কয়েকটা পুরনো বই ছিল। তার মধ্যে যেমন সেই বৃটিশ আমলের বই ছিল, তেমনি হাল আমলের বাঙালি ম্যানেজারদের পছন্দের বইও কয়েকটা ছিল। সেরকমই একটা বই নিয়ে পাতা ওলটাতে শুরু করলাম। কিন্তু একটু বাদেই এমন হাই উঠতে শুরু করল যে, কী বলব!
পাশের বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি বুধোদা একটা বেশ মোটা খাতার মতন কী যেন খুলে খুব মন দিয়ে পড়ছে। ওর পাশে পড়ে রয়েছে ক্যামেরা- ব্যাগটা।
ব্যাপারটা কেমন হল? বুধোদা ক্যামেরা-ব্যাগের মধ্যে থেকে ওই খাতাটা বার করেছে নাকি? আমার চোখ থেকে তক্ষুণি ঘুম ছুটে গেল। আমি এক লাফে মেঝে টপকে চলে গেলাম বুধোদার খাটে। বুধোদা একবার শুধু ভুরু কুঁচকে বলল, ওঃ রুবিক, এরকম হনুমানগিরি করিস না। তারপর আবার ডুবে গেল পুরনো খাতাটার মধ্যে।
আমি বললাম, বুধোদা, তুমি আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। তার মানে যখন ক্যামেরা-ব্যাগ আনতে ফিরে গিয়েছিলে, তখনই তুমি চার্চ থেকে এই খাতাটা তুলে এনেছিলে। এটা কী? একটু দ্যাখাও আমাকে।
বুধোদা খাতাটা আমার হাতে আলতো করে তুলে দিয়ে বলল, খুব সাবধানে পাতা ওলটাস। একশো বছরের পুরনো জিনিস তো, পাতাগুলো পাপড়ের মতন ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। তাও তো এটা চামড়ায় বাঁধানো আর রাখাও ছিল খুব যত্ন করে। তাই নষ্ট হয়নি।
খাতাটা হাতে নিয়ে জিগ্যেস করলাম, এটা কী বুধোদা?
বুধোদা বলল, একে বলা হয় parish register। একটা চার্চের আন্ডারে যতটা এরিয়া থাকে তাকে বলা হয় প্যারিস, আর সেই প্যারিসের মধ্যে যত ব্যাপটিজম, ম্যারেজ কিম্বা বেরিয়াল সব কিছুর ডিটেইলস হাতে লিখে রাখা হয় এই প্যারিস রেজিস্টারে। এটা কুকড়াঝোরার পুরনো চার্চের প্যারিস রেজিস্টার। কেন যে নতুন চার্চে এটা নিয়ে যাওয়া হয়নি তা বলতে পারব না। কোনো কুসংস্কার কাজ করেছিল হয়তো।
তোমার চোখে পড়ল কেমন করে?
বুধোদা মিচকি হেসে বলল, ছোটবেলা থেকে বার্ড-ওয়াচিং করতে করতে চোখদুটোই এমন হয়ে গেছে, বুঝলি? কোন ঝোপের আড়ালে কোন পাখি লুকিয়ে বসে আছে, ঠিক চোখে পড়ে যায়। তোদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতেই যেমন দেখলাম, প্রেয়ার হলের এক কোণায় একটা আলমারির মতন ফার্নিচার রাখা আছে। পাল্লার বদলে সেটার গায়ে দু-সারিতে চারটে চারটে করে মোট আটটা ড্রয়ার। তার মধ্যে সাতটা ড্রয়ারের মেটালের হ্যান্ডেলে কালচে ছোপ আর একটা হ্যান্ডেল বেশ চকচকে। বুঝলাম, ওটা রেগুলার খোলা-বন্ধ করা হয়।
তারপর?
তারপর আর কী? ক্যামেরা-ব্যাগ খোঁজার নাম করে ওখানে ফিরে গেলাম। চকচকে হ্যান্ডেলটা ধরে টান দিলাম।
তারপর?
দেখলাম, যা ভেবেছি তাই। লক করা আছে।
সর্বনাশ! তুমি কী করলে?
সেটা আর জিগ্যেস করিস না।
জিগ্যেস করার সত্যি খুব একটা দরকারও ছিল না। আমি জানতাম পুরনো তালাচাবিও অ্যান্টিকের মধ্যে পড়ে, আর তাই ওসব জিনিসও বুধোদা হাতে নিয়ে প্রচুর নাড়াঘাটা করেছে।
আমি রেজিস্টারের পাতাগুলো খুব সাবধানে ওলটাতে শুরু করলাম। প্রথম এন্ট্রি র আঠেরোশো নিরানব্বইয়ের পঁচিশে ডিসেম্বর। লেখাটায় চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, ওইদিনেই চার্চের উদ্বোধন হয়। যারা মধ্যরাতের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল তাদের নাম লেখা রয়েছে। একটা নামের দিকে চোখ আটকে গেল। হেনরি সুবেশ তির্কে।
এর পরের পাতাগুলোয় পরের ছমাসে ওই চার্চে যে কটা অনুষ্ঠান হয়েছিল তার ডিটেইলস। তার মধ্যে যেমন ব্যাপটিজম ছিল তেমনই বিয়ের অনুষ্ঠানও ছিল। ওই ছমাসে মৃত্যুও দেখলাম কম হয়নি। মোট আঠেরোজন খ্রিস্টান কুলিকে চার্চের জমিতে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। তাদের নাম, বাবার নাম, বয়স সবই লেখা ছিল প্যারিস রেজিস্টারের পাতায়। বয়সগুলো দেখতে দেখতে আমার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। কুড়ি, বাইশ, পঁয়ত্রিশ। বোঝাই যাচ্ছিল কি নারকীয় পরিবেশের মধ্যে বেচারাদের কাজ করতে হত। তা নাহলে এমন অকালে চলে যেতে হয়?
শেষ এন্ট্রি রটায় পৌঁছে আবার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। সেই পাতায় লেখা ছিল হেনরি সুবেশ তির্কের সৎকারের বিবরণ।
বুধোদা নিশ্চয় আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বলল, কী দেখছিস? সুবেশ তির্কের বেরিয়ালের এন্ট্রি র?
আমি ঘাড় নাড়লাম।
মন দিয়ে পড়। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাবি। দ্যাখ, লেখা আছে —অন্যান্য কুলিদের দাবী মেনে হেনরি জোসেফ তির্কেকে ঠিক যে অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, সেই অবস্থাতেই সমাধিস্থ করা হল। তার মানে মৃত্যুর সময় সুবেশের গলায় যদি একটা তাবিজ থাকে, ওর হাতে যদি একটা আংটি থাকে, কিম্বা ওর ট্রাউজারের পকেটে যদি কয়েকটা খুচরো পয়সা থাকে, সেই সবকিছুই এখনো ওই কবরের মধ্যেই রয়েছে।
তা থাকতে পারে। সেটাকে যে বুধোদা অদ্ভুত ব্যাপার বলল কেন বুঝলাম না। বরং অন্য একটা কথা বুধোদার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছিল। খাতাটাকে মুড়ে রেখে বললাম, বুধোদা, সত্যি করে বলো তো—নেকড়ে-মানুষের ঘটনাটাকে তুমি গল্প হিসেবেই দেখছ?
নিশ্চয়।
কেন?
কারণ, এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ইওরোপিয়ান গন্ধ রয়েছে। কেউ যদি বলে আরামবাগে একটা পুকুরের পাড়ে একটা আপেল গাছ দেখলাম, তাহলে তার মধ্যে যেমন বানানো গল্পের গন্ধ পাওয়া যায়, এই ঘটনাটার মধ্যেও আমি সেইরকম গন্ধ পাচ্ছি।
জিগ্যেস করলাম, তুমি কি werewolf-এর কথা বলছ?
একদম ঠিক। ভেবে দ্যাখ, ফিফটিনথ সেঞ্চুরির কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইওরোপে একটা বিশ্বাসের জন্ম হল। কী বিশ্বাস? না, কোনো-কোনো মানুষ নিজেকে নেকড়েবাঘে বদলে ফেলতে পারে। তারাই হল ওয়ারউলফ বা নেকড়ে-মানুষ। এই বিশ্বাসের সঙ্গে ন্যাচরালি যোগ হল যতরকমের বীভৎসতা। নেকড়ে-মানুষ নাকি অন্য মানুষকে মেরে খেয়ে ফেলে। তারা বাচ্চা চুরি করে।
তারপর চারশো বছর ধরে সেই অন্ধবিশ্বাস গোটা ইওরোপে পাক খেতে লাগল। একটা সময় যেমন ‘উইচ’, মানে ডাইনি সন্দেহে জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হত সেইরকমভাবেই ওয়ারউলফ সন্দেহেও মানুষকে পুড়িয়ে মারা হতে লাগল।
এবার তুই বল রুবিক, ইওরোপ থেকে অনেক দূরে এই যে ডুয়ার্সের জঙ্গল, যেখানে বাস্তবে নেকড়ের কোনো অস্তিত্বই নেই, সেখানে সেই ইওরোপের ওয়ারউলফের গল্প কোথা থেকে ঢুকে পড়ল? এর আগে আমাদের এখানকার কোনো রূপকথা, কোনো মিথ, কোনো ফোক-লোরে ওয়ারউলফের কোনও রেফারেন্স পেয়েছিস?
আমার মাথায় কাল থেকেই একটা গল্প ঘুরপাক খাচ্ছিল। বললাম, বুধোদা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এরকম একটা ঘটনার কথা লিখে রেখে গেছেন।
আরণ্যকে কি? আবছা মনে পড়ছে।
হ্যাঁ। বনের মধ্যে পাতার কুঁড়েঘরে একটা ছেলে আর তার বাবা থাকত। বাবা দেখত রাতের অন্ধকারে মাঝে-মাঝেই একটা মেয়ে চুপিচুপি ছেলের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। একদিন বাবা ওই মেয়েটাকে হাতেনাতে ধরবার জন্যে ছেলের ঘরে ঢুকে পড়ল, কিন্তু কোনো মেয়েকে দেখতে পেল না। শুধু একটা সাদা কুকুর ছেলেটার বিছানার নীচ থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজা পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। পরে ছেলেটা নিজেও দেখেছিল একটা সাদা কুকুরকে তার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু বাইরে বেরিয়েই কুকুরটা হয়ে গিয়েছিল একটা মেয়ে।
বুধোদা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, মনে পড়েছে। তার কিছুদিন পরে ওই চালাঘর থেকে একটু দূরে ছেলেটার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল। বিস্ফারিত চোখ, যেন ভয়ঙ্কর একটা কিছু দেখে তার প্রাণটা শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু রুবিক, খেয়াল কর, ওই গল্পেও কিন্তু নেকড়ে ছিল না; ছিল কুকুর। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। আরণ্যকের যে পটভূমি, গয়া- ভাগলপুরের জঙ্গল, নেকড়ে জন্তুটা তো সেখানেও সুলভ নয়।
তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে জানিস? কুকড়াঝোরায় যখন একটা কুকুর আর দুজন মানুষ পরপর অ্যানিমাল অ্যাটাকে মারা পড়ল, তখন চা-বাগানের সাহেবরাই তার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিল সুবেশ তির্কের অপমৃত্যুর ব্যাপারটা। তাদের মাথা থেকেই প্রথম বেরিয়েছিল সুবেশ তির্কের ওয়ারউলফ হয়ে যাওয়ার গল্প। সেই আমলে যারা বৃটেন থেকে ইন্ডিয়ায় চাকরি করতে আসত, তারাও তো আর খুব একটা উঁচুদরের লোক ছিল না। বেশিরভাগই ছিল অশিক্ষিত এবং এখানকার আদিবাসীদের মতনই সুপারস্টিশাস। গায়ের চামড়াটাই যা ছিল সাদা।
তারপর সাহেবদের মুখে সেই গল্প শুনতে শুনতে এখানকার আদিবাসী কুলিদের মধ্যে একটা মাস-হিস্টিরিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা ছায়ার মধ্যে প্রেত-নেকড়ে দেখতে শুরু করেছিল। আর নতুন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই হিস্টিরিয়া থিতিয়ে গিয়েছিল।
বুধোদার কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে করতেই কখন চোখ জুড়ে গিয়েছিল জানি না, হঠাৎ বুধোদার ডাকেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই বুধোদা বলল, রুবিক, আমি একটু ঘুরে আসছি। তুই দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে শুয়ে পড়। আমি ফিরে এসে ওই পায়ের কাছের জানলাটায় ঠকঠক আওয়াজ করলে দরজা খুলে দিবি।
মোবাইলের স্ক্রিনে দেখলাম রাত বারোটা বাজে। আমি অবাক হয়ে উঠে বসলাম। বললাম, তার মানে? তুমি এত রাতে কোথায় যাবে?
বুধোদা বলল, সুবেশ তির্কের কবর দেখতে।
এখন!
তা ছাড়া আর উপায় নেই। সন্ধের দিকে একবার বেরিয়ে দেখেছি, মিস্টার জোসেফ চার্চের রাস্তায় বাঘের মতন ওঁত পেতে বসে আছেন। ওনাকে এড়িয়ে যেতে হলে রাতের বেলাতেই যেতে হবে।
কিন্তু কেন? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
আমার কথার উত্তর না দিয়ে বুধোদা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে বুধোদার হাত টেনে ধরলাম। বললাম, দাঁড়াও। আমিও যাব। তোমাকে আমি একা ছাড়ব না।
বুধোদা আমাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। জানে, একবার যখন বলেছি তখন আমি যাবই। তাই বেশি আপত্তি না করে বলল, তাহলে ভালো করে গরম-জামা পরে নে। তোর একটা নীল রঙের উইন্ড-চিটার আছে না? ওইটা সবকিছুর ওপরে চাপিয়ে নিস। অন্ধকারে মিশে থাকতে সুবিধে হবে। ও নিজেও দেখলাম একটা ডার্ক-কালারের রেন-কোট গায়ে চাপিয়েছে। আমি আর বললাম না, সত্যিকারেই যদি প্রেত-নেকড়ের সঙ্গে দেখা হয় তাহলে এইসব ক্যামুফ্লাজ আদৌ কাজে দেবে না। কারণ, যে কোনো প্রেতাত্মাই অন্ধকারে ভালো দেখতে পায়।
বাংলোর দরজায় তালা ঝুলিয়ে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম একটা অদ্ভুত ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে আর সেই হাওয়ায় গা ভাসিয়ে অসংখ্য কালো মেঘের টুকরো চাঁদের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। পালা করে জ্যোৎস্না আর অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশের পাহাড় বন আর টি-এস্টেটের ঘরবাড়ি।
চার্চের কম্পাউন্ডে পৌঁছনোর পর আমরা দুজনেই চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। খুব তাড়াতাড়ি জ্যোৎস্না আর অন্ধকার জায়গা বদল করছিল বলেই বোধহয় একটা সাইকোডেলিক এফেক্ট তৈরি হয়েছিল, আর সেইজন্যেই মনে হচ্ছিল আমাদের চারপাশে যত নিষ্প্রাণ বস্তু সবই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভাঙা গির্জা, ভাঙা ঘরবাড়ি আর সারি সারি কবরের ক্রশ—সবকিছুই যেন নড়েচড়ে উঠছিল।
সত্যিকারে যা নড়ছিল, তা হল ওক-গাছের ডালপালা আর বাদুড়ের ঝাঁক। কয়েকটা বাদুড় প্রায় আমাদের মুখে ঝাপটা মেরেই উড়ে গেল আর তাতেই আমাদের ঘোর কেটে গেল। বুধোদা ফিসফিস করে বলল, চল রুবিক। দেরি করে লাভ নেই। কবরটা খুঁজে বার করি।
চার্চের উলটোদিকে সেই কবরখানাটা আমরা সকালেই দেখে গিয়েছিলাম। লোহার গেটটায় তালা দেওয়া ছিল। কাজেই আমাদের পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকতে হল।
এতক্ষণ অবধি বুধোদার হাতের টর্চ জ্বলছিল। ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ও টর্চটা নিভিয়ে দিল। তার মানে ও এক্সপেক্ট করছে ভেতরে কেউ থাকতে পারে, যে টর্চের আলো দেখে আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পারবে।
কার কথা ভাবছে ও? মিস্টার জোসেফের কথা কি?
কোনো কালে এই কবরখানার ভিতরে লুডোর বোর্ডের মতন আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। মাঝখানের ফাঁকা জমিগুলো আস্তে আস্তে কবরে ভরে উঠবে, এমনই হয়তো ভেবেছিলেন তখনকার মালিকেরা। কিন্তু বাস্তবে যে তা হয়নি সে তো আমরা জানিই। মাত্র আঠেরো জন কুলিকে এখানে গোর দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে শেষজনের নাম ছিল হেনরি সুবেশ তির্কে। আর তারপরেই ছড়িয়ে পড়েছিল নেকড়ে-মানুষের আতঙ্ক। আর কোনও কবর এখানে গড়ে ওঠেনি।
যুক্তি বলছিল একদম শেষ সারির কোনো একটা কবরেই হেনরি সুবেশের নাম লেখা থাকবে। মিনিট দশেক লাগল সেই কবরটাকে খুঁজে বার করতে। সাদামাটা ইঁটের স্ট্রাকচারটাকে একটা মস্ত বড় সিন্দুকের মতন দেখতে লাগছিল। আমার বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডটা এত জোরে ধ্বকধ্বক আওয়াজ করছিল যে, ভয় হচ্ছিল বুধোদা না সেই শব্দ শুনতে পায়।
কবরটা লম্বায় চওড়ায় আট-ফুট বাই ছ-ফুট হবে। উঁচু প্রায় আমার বুকের সমান। অনেক জায়গাতেই ইঁট খসে গিয়ে বড় বড় গর্ত হয়ে গিয়েছে। মনে হল, একটা নেকড়ে অনায়াসেই ওইসব গর্তের কোনো একটার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।
ঠিক সেই সময়েই পর পর এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটল যেগুলো আমি কোনও দিন ভুলব না।
প্রথমেই একটা বড় মেঘ এসে চাঁদটাকে আবার ঢেকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক গভীর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। বুধোদা হয়তো তার আগেই কিছু একটা দেখেছিল। ও টর্চটা জ্বালিয়ে আমাদের পায়ের কাছে মাটিতে আলো ফেলল। যা দেখলাম তাতে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। আগের রাতের বৃষ্টিতে তখনো মাটি নরম ছিল।
দেখলাম, সেই নরম মাটির ওপরে কিছু মানুষের পায়ের ছাপ।
আর কিছু থাবার ছাপ। ঠিক যেরকম থাবার ছাপ দুদিন আগে দেখেছিলাম বাংলোর পেছনের দরজায়।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি ভয় পেয়েছিলাম। সেরকম ভয় আমি জীবনে কখনো পাইনি। বুধোদার মধ্যে অবশ্য ভয়ের কোনও লক্ষণ দেখলাম না। ও টর্চটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর মন দিয়ে থাবার ছাপগুলোকে দেখতে শুরু করল।
কিন্তু ঠিক তখনই কবরের ভেতর থেকে এমন একটা আওয়াজ ভেসে এল যে, বুধোদা অবধি লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। আমি তো ততক্ষণে বেশ কয়েক পা পিছিয়ে গেছি। এই প্রথম দেখলাম, বুধোদার মুখেও ভয়ের ছাপ। ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। আমার মতন ও-ও কান পেতে শুনছে, কবরের ভেতর থেকে ভেসে আসা সদ্যোজাত বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। ওঁয়া ওঁয়া করে খুব দুর্বল গলায় একটা বাচ্চা কাঁদছে। কোনো ভুল নেই, কান্নাটা ভেসে আসছে ওই কবরের ভেতর থেকেই। বুধোদা আমার হাতে একটা টান মেরে বলল, রুবিক, কুইক। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না। চল পালাই।
এর আগে বুধোদার কোনও প্রস্তাব আমার কানে এত মধুর লাগেনি। বুধোদার কথা শেষ হবার আগেই আমি উলটোদিকে ঘুরে দৌড় মারলাম। দু-চারবার পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। কাঁটার খোঁচায় হাত পা ছড়ে গেল। তবে তখন ওসব কিছুই খেয়াল ছিল না। শুধু ভাবছিলাম কতক্ষণে এই টিলা থেকে নামতে পারি।
বাউন্ডারি-ওয়াল টপকে যখন বাইরে বেরিয়ে এসেছি, তখন বুধোদা পেছন থেকে ডাকল—রুবিক!
আমি দৌড় থামিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম।
রুবিক, ওদিকে দ্যাখ।
বুধোদা ঠিক কোনদিকে দেখাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না, তাই একটু সময় লাগল। তবে শেষ অবধি দেখতে পেলাম। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে কবরখানার পেছনদিকের পাঁচিলটা অনেক দূর। তবু যেহেতু তখন মেঘ সরে গিয়েছিল, কিছুক্ষণের জন্যে জ্যোৎস্নায় ভেসে গিয়েছিল চারিদিক, তাই একমুহূর্তের জন্যে দেখতে পেলাম, পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এক চতুষ্পদ প্রাণীর সিল্যুয়েট।
আমি ভালো করে দেখার আগেই প্রাণীটা পাঁচিলের ওপর থেকে কবরখানার ভেতরে লাফিয়ে পড়ল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন