২০. মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)

মাইকেল এইচ. হার্ট

মুস্তাফা কামাল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে স্যালেনিকার এক চাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যে পরিবারে তাদের জন্ম, তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ম্যাসিডনের অধিবাসী। তার বাবার নাম ছিল আলি রেজা, মা জুবেইদা। ছেলেবেলা থেকেই মুস্তফা ছিলেন সকলের চেয়ে আলাদা।

যখন তার সাত বছর বয়স তখন বাবা মারা গেলেন। চাচা এসে তাকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। চাচার ভেড়ার পাল চরাতে হত। জুবেইদা চাচাকে বলে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।

সহপাঠীদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি মারামারি লেগেই থাকত। কোন বিষয়ে অন্যায় দেখলে মেনে নিতে পারতেন না। জন্ম থেকে তার মধ্যে ছিল বিদ্রোহী সত্তা। একদিন কোন এক শিক্ষকের অন্যায় দেখে স্থির থাকতে পারলেন না। তার সাথে মারামারি করে স্কুল ছাড়লেন।

বাড়ি ফিরে এসে স্থির করলেন, স্কুলে আর ফিরে যাবেন না। তিনি সৈনিক হবেন। বাড়ির লোকের অজান্তে সৈনিক স্কুলে ভর্তির জন্য দরখাস্ত করলেন। তারপর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্যালেনিকার সৈনিক স্কুলে ভর্তি হলেন।

এখানেই তার সুপ্ত প্রতিভার প্রথম স্ফুরণ ঘটল। কুচকাওয়াজ ড্রিল যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন সকলের সেরা। অন্য সব বিষয়ের মধ্যে অঙ্ক ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। অঙ্কে তার অসাধারণ জ্ঞান লক্ষ্য করে তার এক অধ্যাপক তাকে কামাল অর্থাৎ সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন উপাধি দিয়েছিলেন। সেই থেকে সকলে তাকে কামাল বলেই ডাকত।

তিনি কৃতিত্বের সাথে সতেরো বছর বয়সে সৈনিক স্কুল থেকে পাশ করলেন।

এরপর ভর্তি হলেন মনাস্টির সামরিক উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানে এসে এক নতুন একদিন যে অটোমান সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য, আজ তার কি করুণ পরিণতি। দেশের সুলতান অন্য দেশের কাছে অবজ্ঞার পাত্র। কামাল অন্তরে অনুভব করেন এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।

একদিকে মনের মধ্যে জেগে উঠছিল নতুন স্বপ্ন অন্যদিকে চলছিল সামরিক শিক্ষা। কুড়ি বছর বয়েসে কনস্তান্তিনোপল সৈনিক কলেজে ভর্তি হলেন। এখানে থাকবার সময়েই তিনি বতন অর্থাৎ পিতৃভূমি (Vatan=Fatherland) নামে গোপন সমিতি গড়ে তুললেন। সেই সমিতির সকলেই ছিল সৈনিক কলেজের ছাত্র।

চার বছর পর কলেজ থেকে পাশ করে অশ্বারোহী বাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসাবে নিযুক্ত হলেন। তখন বতনের সভ্যরা মাঝে মাঝেই মিলিত হয়ে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করত। এই দলের মধ্যে একজন সুলতানের পুলিশের তরফে ঘুষ নিয়ে গুপ্তচরের কাজ করতে আরম্ভ করল। একদিন যখন সব সদস্যরা গোপন আলোচনায় যোগ দিয়েছে, সে সকলের অগোচরে পুলিশের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলকে বন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হল কারাগারে। বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। কিন্তু সুলতানের মনে হল এই তরুণ অফিসারদের মৃত্যুদণ্ড দিলে সামরিক বাহিনীর উপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। নিজেদের সহকর্মীর মৃত্যুতে হয়ত তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। তাই শেষ মুহূর্তে তার মার্জনা ঘোষণা করলেন।

সকলকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হল। কামালকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সুদূর দামাস্কাসে অশ্বরোহী বাহিনীর সেনানী করে। পার্বত্য বন্ধুর অঞ্চল।

স্যালেনিকাতে গড়ে উঠেছিল বতনের একটি শাখা। কামাল পাশার কাছে সংবাদ এল স্যালেনিকায় বতনের সভ্যরা বৃহত্তর আনোদালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি স্থির করলেন সেখানে গিয়ে সকলের সাথে মিলিত হবেন। ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়লেন। মিশর এবং গ্রীসের পথ ধরে সবেমাত্র এসে পৌঁছেছেন, এমন সময় এক গুপ্তচরের নজর পড়ল তার উপর।

কর্তৃপক্ষের কাছে সংবাদ যেতেই নির্দেশ এল কামাল পাশাকে বন্দী কর। এক বিশ্বস্ত বন্ধুর মারফৎ এই গোপন সংবাদ পেতেই এক ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে আবার পালিয়ে গেলেন গ্রীসে, সেখান থেকে এলেন জাফায়। কামাল পৌঁছবার আগেই তাকে বন্দী করবার নির্দেশ সেখানে এসে পৌঁছেছিল।

জাফায় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন আহমেদ বেগ। বতনের প্রতি বের ছিল গভীর সমর্থন। তিনি তৎক্ষণাৎ কামালকে নিজের কাছে নিয়ে এসে সৈনিকের পোশাক পরিয়ে জাহাজে করে গোপনে পাঠিয়ে দিলেন গাঁজায়। সেখানে তুর্কী সেনাদলের সাথে স্থানীয় বিদ্রোহী আদিবাসীদের লড়াই চলছিল। কামালও সেই লড়াইয়ে যোগ দিলেন। আহমেদ বে সুলতানের কাছে সংবাদ পাঠালেন কামাল পাশা সিরিয়া ত্যাগ করে কোথাও যায়নি। সে গাঁজায় যুদ্ধ করছে।

বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন কামাল পাশা। কিন্তু বুঝতে পারলেন স্যালেনিয়া ছাড়া অন্য কোথাও বিপ্লবকে সংগঠিত করা সম্ভব হবে নাই। তিনি সুলতানের কাছে আবেদন জানালেন, যেন তাকে তার জন্মভূমি স্যালনিকাতে বদলি করা হয়। শেষ পর্যন্ত তার অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাকে স্যালনিকয় বদলি করা হল।

এখানে ইতিপূর্বেই একটি রাজনৈতিক সমিতি গড়ে উঠেছিল। অটোমান ফ্রিডম সোসাইটি (Ottoman Freedom Society)। কামাল এই দলের একজন সক্রিয় সদস্য হলেন। কিন্তু এই দলের অন্যদের সাথে দলের লক্ষ্য কর্মপন্থা নিয়ে মতভেদ দেখা দিল। কামাল চাইতেন স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হোক, কোন আপোষ মীমাংসা নয়, প্রয়োজন নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার।

দলের অন্য নেতারা ছিলেন সংস্কারবাদী। তারা চাইতেন প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই সংস্কার সাধন। এদের প্রধান ছিলেন এনভার বে ও মেজর নিয়ামি। তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের সংবাদ সুলতান আবদুল হামিদের কাছে পৌঁছতে বিলম্ব হল না।

সুলতানের প্রধান সেনাপতি বিরাট সৈন্যদল নিয়ে স্যলনিকা অবরোধ করল। বিদ্রোহীদের সপক্ষেও এগিয়ে আসে আরো সৈন্য। সুলতান বুঝতে পারলেন গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই যুদ্ধ এড়াবার জন্য সুলতান বিদ্রোহীদের সংস্কারের দাবি মেনে নিয়ে তাদের ক্ষমা করলেন। চারদিকে বে আর নিয়ামির জয়ধ্বনি উঠল। দুজনে হয়ে উঠলেন জনগণের নতুন নেতা।

কামাল তার গভীর দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন এই সংস্কারের অঙ্গীকার সুলতানের সিংহাসন রক্ষার একটা কৌশল মাত্র।

কামাল পাশার অনুমান অভ্রান্ত হল। ১৯০৯ সালে সুলতানের কিছু অনুগামী ইসলাম ধর্ম বিপন্ন বলে দেশময় আন্দোলন শুরু করল। দেশে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা হল। সব কিছুর জন্য দায়ী করা হল সংস্কারবাদীদের। একদিন যারা হয়ে উঠেছিল সমাজের সবচেয়ে শ্রদ্ধার–তারাই হয়ে উঠল সবচেয়ে ঘৃণায়। জেনারেল নিয়ামি পথের মাঝে খুন হলেন, এনভার বেকে একটি সামরিক দলের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হল জার্মানিতে। কামালকে পাঠানো হল ত্রিপলিতে।

দেশের এই বিবাদ-বিসংবাদের সুযোগ নিয়ে ইউরোপের অন্য দেশগুলো তুরস্কের অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চল অস্ট্রিয়া, বসনিয়া অধিকার করল। গ্রীস ক্রীট দ্বীপ দখল করে নিল। বুলগেরিয়া তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করল।

গুপ্তচরদের ক্রমাগত প্ররোচনায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সাধারণ সৈন্যরা। সেখানকার সংস্কারবাদী সমস্ত নেতাকে হত্যা করে সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করে নিল।

এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই এনভার বে ও কামাল পাশা তাদের অনুগত সৈন্যদের নিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সুলতানের অনুগত বাহিনীর উপর। মাত্র একদিনের যুদ্ধেই সুলতানের বাহিনী পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করল। সুলতানের ভাইপোকে নামমাত্র সিংহাসনে বসানো হল।

এই সময় কামাল উন্নত সামরিক জ্ঞান লাভ করবার জন্য ফ্রান্সে গেলেন। এই প্রথম তুরস্কের বাইরে নতুন কোন দেশ প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। ফ্রান্সের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিমণ্ডল দেখে মুগ্ধ হলেন।

ফ্রান্সে সামরিক শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে এলেন। কিছুদিনের মধ্যেই এই শিক্ষার সুফল পেলেন। ১৯১১ সালে ইতালির সৈন্যবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরস্কের উপর। তুরস্কের উপর এনভারের অধীনে কামাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা হল। একদিকে যখন এনভার বিলাসবহুল তাবুতে নিজের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে, অন্যদিকে সাধারণ তাবুতে বসে কামাল যুদ্ধের পরিকল্পনায় সমস্ত রাত্রি বিনিদ্র। কাটিয়ে দিচ্ছেন। পরদিন যুদ্ধ শুরু হতেই অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করলেন কামাল।

এই যুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হল। দেশের বিরাট অংশ দিতে হল মিত্রপক্ষের হাতে। এনভার বে দেশের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে নিজেই সব ক্ষমতা দখল করলেন। সাময়িক যুদ্ধ বিরতি হল। কিন্তু কয়েক মাস পরেই মিত্রপক্ষের নিজেদের মধ্যেই বিবাদ দেখা দিল। এই সুযোগে বেশ কিছু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করলেন এনভার বে। তার জয়গানে সমস্ত দেশের মানুষ মুখরিত হয়ে উঠল। অন্যদিকে যার শৌর্যে বীরত্বে এই জয় সম্ভব। হল সেই কামাল রয়ে গেলেন সকলের অজ্ঞাতে।

এই যুদ্ধে জয়লাভ করে এনভার নতুন তুর্কী সাম্রাজ্য গড়ে তোলবার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করলেন।

শুরু হল সৈন্যসংগ্রহের কাজ। একজন জার্মান জেনারেলকে এই সৈন্যদের গড়ে তোলবার ভার দেওয়া হল। এই কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলেন কামাল।

এনভারের কিরুদ্ধে এ সমালোচনা করবার জন্য তাকে সোফিয়ার দূতাবাসে সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

ইউরোপের বুকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। এনভার মাথায় এক নতুন ভাবনা জেগে উঠল। ঠিক করলেন, রাশিয়া আক্রমণ করে তাদের ককেশাসের সীমান্তের ওপারে বিতাড়ন করবেন। এনভার শুধু রুশ সৈন্যদের কথা চিন্তা করেছিলেন, সে দেশের প্রচণ্ড শীতের কথা চিন্তা করেননি। বরফাবৃত পাহাড়ি পথে যেতে যেতে প্রায় ৮০,০০০ হাজার সৈন্য পথেই মারা পড়ল।

অন্যদিকে মিত্রপক্ষের পক্ষে ইংল্যাণ্ড কনস্তান্তিনোপল অধিকার করবার জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে। কামাল অতুলনীয় সাহস আর বীরত্বের সাথে ইংরেজ বাহিনীর গতিরোধ করে তাদের বিতাড়ন করলেন। তার এই অভাবনীয় সাফল্যের জন্য এনভার তাকে পাঠালেন ককেশাস অঞ্চলে। সেখানে রুশ বাহিনীর কাছে তুর্কীর সেনাদল পরাজয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। সৈন্যদল নিয়ে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চললেন। কামাল। এইবার ভাগ্য তাকে সাহায্য করল। রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে জারের উৎখাত হল। তার সেনাপতিরা রণে ভঙ্গ দিল।

এদিকে মিত্রপক্ষের ক্রমাগত চাপের মুখে বিপর্যস্ত তুরস্ক। বিপদ আসন্ন অনুভব করে। এনভার দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন।

দেশের এই বিপদের মুহূর্তে কামাল এগিয়ে এলেন। তিনি এ্যাঙ্গোরাতে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত করলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই গ্রীস তুরস্ক আক্রমণ করল। দেশের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল জয় করে নিল।

এই সময় কামাল ছিলেন এ্যাঙ্গোলার কাছেই এক গ্রামে। জীবনের এক চরমতম সঙ্কটে পড়লেন কামাল। তার হাতে নিয়মিত সৈন্যের সংখ্যা ছিল নগণ্য। বেশির ভাগই ছিল উপজাতিদের থেকে সংগ্রহ করা লোকজন। সৈন্যদের দেবার মত প্রয়োজনীয় অস্ত্র নেই, পরিবহন ব্যবস্থা অপ্রতুল। খাবারের অভাব।

কামাল বুঝতে পারলেন এই সীমিত শক্তি নিয়ে শক্তিশালীকে এক বিরাট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। তাই তিনি কৌশল অবলম্বন করলেন। গ্রীক সৈন্যদের অগ্রসর হবার সুযোগ দিলেন না। নিজে সাখারিয়া নদীর তীরে সুবিধাজনক জায়গায় সৈন্য সাজালেন। ১৯২১ সালের ২৪শে আগস্ট দুই পক্ষে শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। কামাল পাশার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ। চৌদ্দ দিন লড়াইয়ের পর গ্রীক বাহিনী পিছু হটতে আরম্ভ করল।

তুরস্কের সাহায্যে এগিয়ে এল রাশিয়া। ফরাসীদের সঙ্গে এক গোপন চুক্তিতে সিরিয়ার সীমান্ত থেকে ৮০,০০০ সৈন্য নিয়ে এলেন কামাল।

গ্রীক বাহিনী পরাজিত হলে পালিয়ে গেল। সীমান্তে অবস্থান করছিল ব্রিটিশ শক্তি। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন কামাল। দুই পক্ষ মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগেই একজন বৃটিশ সেনাপতির মধ্যস্থতায় কামালের সঙ্গে নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি হল।

ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা, ইতালি, রুমানিয়া, জাপান, গ্রীস, তুরস্কের প্রতিনিধিরা ল্যাসেন নামে এক জায়গায় নতুন চুক্তি করলেন। তাতে তুরস্কের সার্বভৌমিকতা, স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হল। এইভাবে একমাত্র কামালের একনিষ্ঠ দেশাত্মবোধ ও অক্লান্ত শ্রমে তুরস্ক সাম্রাজ্য রক্ষা পেল।

ইতিমধ্যে ১৯২২ সালের ১লা নভেম্বর তুর্কী জাতীয় পার্লামেন্ট সুলতান ষষ্ঠ মহম্মদকে পদচ্যুত করল। এবং সর্বসম্মতভাবে কামাল পাশাকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে ঘোষণা করা হল।

তুরস্ক হল প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র (২৯শে অক্টোম্বর ১৯২৩)। কামাল পাশা নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হলেন। দেশের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হল তার হাতে। তার People’s Party দেশের সর্বত্র নির্বাচনে জয়লাভ করল।

এইবার তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে হাত দিলেন। এতদিন তুরস্ক ছিল ইসলামিক রাষ্ট্র। ধর্মীয় বিধান অনুসারেই সমাজ পরিচালিত হল। তিনি ঘোষণা করলেন তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। মুহূর্তে সমস্ত দেশ জুড়ে যেন ঝড় বয়ে গেল। শুধু মৌলবাদী ধর্মীয় নেতারা নয়, বিরোধীপক্ষও প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। সৈন্যবাহিনীর মধ্যেও বিদ্রোহের আশঙ্কা ঘণীভূত হয়ে উঠল।

কামাল পাশা প্রথমে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই বিবাদের সমাধান করবার চেষ্টা করলেন কিন্তু যখন সফল হলেন না, কঠোর হাতে সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠকে নীরব করে দিলেন। পার্লামেন্টে যখন এই বিল অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হল তখন অধিকাংশ সদস্যই তাতে সম্মতি দিতে অস্বীকার করল। তিনি বললেন, যদি প্রয়োজন হয় পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে দ্বিধা করব না।

তার অনমনীয় দৃঢ়তার কাছে শেষ পর্যন্ত সব বাধাই দূর হল। তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষিত হল।

তুর্কী নারীদের সামাজিক মর্যাদা প্রদান তার সংস্কারের প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয়। ১৯২৫ সালে তিনি বহুবিবাহ প্রথা আইন করে বন্ধ করলেন। রেজেস্ট্রি বিয়ে চালু হল। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স ঠিক হল ১৭, পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৮। মেয়েদের ইচ্ছামত পোশাক পরবার অনুমতি দেওয়া হল। বোরখা পরার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হল।

মেয়েদের জন্যে তৈরি হল স্কুল-কলেজ। তাদের ভোট দেবার অধিকার দেওয়া হল। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের সব বাধা দূর হল।

ইউরোপে বিভিন্ন দেশ দেখে তার মনে হয়েছিল শিক্ষার উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য স্কুল খোলা হল। সাত থেকে ষোল বৎসরের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হল। ১৯২২ সালে নিরক্ষরতার হাত ছিল শতকরা ৮২ জন। মাত্র দশ বছরের মধ্যে সেই হারকে কমিয়ে ৪২ জনে নামিয়ে আনা হল।

তিনি ধর্মশিক্ষাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা প্রসারের উপর গুরুত্ব দিলেন। আরবি লিপির পরিবর্তে রোমান লিপির ব্যবহার শুরু হল। পৃথিবীর অন্য দেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বর্ষপঞ্জী সংস্কার করা হল। দশমিক মুদ্রা চালু হল।

শুধুমাত্র দেশের শিক্ষার উন্নতি নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দেওয়া হল। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সমগ্র দেশ জুড়ে রেলপথ তৈরির কাজে হাত দেওয়া হল। তৈরি হল নতুন নতুন পথঘাট।

শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরিণ সংস্কার নয়, বৈদেশিক ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করা হল। ১৯৩২ সালে তুরস্ক লীগ অব নেশনস-এর সদস্য হল। সামরিক দিক থেকে যাকে কোন বিপদ না আসে তার জন্যে প্রতিবেশী প্রতিটি দেশের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করা হল।

ইতিমধ্যে কামাল পাশা পর পর চারবার সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। ১৯২৩ সালে প্রথম তিনি নির্বাচিত হন, তারপর ১৯২৭, ১৯৩১, ১৯৩৫।

তুরস্কের সর্বাত্মক উন্নতির জন্য অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে তার স্বাস্থ্য ক্রমশই ভেঙে পড়ছিল। ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি মারা গেলেন।

যদিও কামাল পাশার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় তিনি একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালু করেছিলেন, সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দেশ পরিচালনা করেছেন, তবুও তিনি তুরস্কের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ। যে পরিস্থিতিতে তিনি দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তখন কঠোরতা ছাড়া উন্নতির কোন পথই খোলা ছিল না।

সকল অধ্যায়

১. ১. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) (৫৭০-৬৩২ খ্রি:)
২. ২. হযরত ঈসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ৬-৩০)
৩. ৩. হযরত মুসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী)
৪. ৪. ইমাম আবু হানিফা (রঃ) (৭০২–৭৭২ খ্রি:)
৫. ৫. জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৩ খ্রি:)
৬. ৬. ইমাম বোখারী (রঃ) (৮১০-৮৭০ খ্রি:)
৭. ৭. আল বাত্তানী (৮৫৮–৯২৯ খ্রি:)
৮. ৮. আল ফারাবী (৮৭০-৯৬৬ খ্রি:)
৯. ৯. মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪১–১০২০ খ্রি:)
১০. ১০. আল বেরুনী (৯৭৩–১০৪৮ খ্রি:)
১১. ১১. ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি:)
১২. ১২. ওমর খৈয়াম (১০৪৪-১১২৩ খ্রি:)
১৩. ১৩. ইমাম গাজ্জালী (রঃ) (১০৫৮–১১১১ খ্রি:)
১৪. ১৪. ইবনে রুশদ (১১২৬১১৯৯ খ্রি:)
১৫. ১৫. আল্লামা শেখ সা’দী (রঃ) (১১৭৫–১২৯৫ খ্রি:)
১৬. ১৬. মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ) (১২০৭-১২৭৩ খ্রি:)
১৭. ১৭. ইবনুন নাফিস (১২০৮-১২৮৮ খ্রি:)
১৮. ১৮. ইবনে খালদুন (১৩২২–১৪০৬ খ্রীঃ)
১৯. ১৯. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রীঃ)
২০. ২০. মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)
২১. ২১. গৌতম বুদ্ধ (খ্রি: পূ: ৫৬৩ খ্রি: পূ: ৪৮৩)
২২. ২২. শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৩৩-১৮৮৬)
২৩. ২৩. শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩)
২৪. ২৪. স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)
২৫. ২৫. যোহান উলফগ্যঙ ভন গ্যেটে (১৭৪৯–১৮৩২)
২৬. ২৬. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১-১৯৫৫)
২৭. ২৭. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)
২৮. ২৮. ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি (১৮২১-১৮৮১)
২৯. ২৯. আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৫৬ খ্রিস্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিস্ট পূর্ব)
৩০. ৩০. লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)
৩১. ৩১. মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬)
৩২. ৩২. কনফুসিয়াস (খ্রি: পূর্ব ৫৫১ খ্রি: পূর্ব ৪৭৯)
৩৩. ৩৩. বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
৩৪. ৩৪. পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩)
৩৫. ৩৫. ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬)
৩৬. ৩৬. হেলেন কেলার (১৮৮০-১৯৬৮)
৩৭. ৩৭. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)
৩৮. ৩৮. কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)
৩৯. ৩৯. হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩)
৪০. ৪০. ত্যাগরাজ (১৭৬৭–১৮৪৭)
৪১. ৪১. নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১)
৪২. ৪২. ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫)
৪৩. ৪৩. পার্সি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)
৪৪. ৪৪. জোহন কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)
৪৫. ৪৫. জোহান্স গুটেনবার্গ (১৪০০–১৪৬৮)
৪৬. ৪৬ জুলিয়াস সিজার (খ্রি: পূ: ১০০খ্রি: পূ: ৪৪)
৪৭. ৪৭. গুলিয়েলমো মার্কোনি (১৮৭৪-১৯৩৭)
৪৮. ৪৮. রাণী এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩)
৪৯. ৪৯. জোসেফ স্টালিন (১৮৮২-১৯৫৩)
৫০. ৫০. ফ্রান্সিস বেকন (খ্রি: ১৫৬১ খ্রি: ১৬২৬)
৫১. ৫১. জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)
৫২. ৫২. চেঙ্গিস খান (১১৬২–১২২৭)
৫৩. ৫৩. এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫)
৫৪. ৫৪. লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)
৫৫. ৫৫. অশোক (আনুমানিক খ্রি: পূ: ৩০০–২৩২ খ্রি: পূর্ব)
৫৬. ৫৬. সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)
৫৭. ৫৭. আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল (১৮৪৭-১৯২২)
৫৮. ৫৮. যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫–১৭৫০)
৫৯. ৫৯. জন. এফ. কেনেডি (১৯১৭-১৯৬৩)
৬০. ৬০. গ্যালিলিও গ্যালিলাই (১৫৬৪-১৬৪২)
৬১. ৬১. হো চি মিন (১৮৯০–১৯৬৯)
৬২. ৬২. মহাত্মা গান্ধীজী (১৮৬৯-১৯৪৮)
৬৩. ৬৩. লেভ তলস্তয় (১৮২৮–১৯১০)
৬৪. ৬৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
৬৫. ৬৫. হিপোক্রেটস (৪৬০-৩৭০)
৬৬. ৬৬. জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮–১৯৩৭)
৬৭. ৬৭. আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫)
৬৮. ৬৮. উইলিয়ম শেকস্‌পীয়র (১৫৬৪-১৬১৬)
৬৯. ৬৯. জন মিলটন (১৬০৮–১৬৭৪)
৭০. ৭০. সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূ:)
৭১. ৭১. জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯)
৭২. ৭২. উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)
৭৩. ৭৩. পিথাগোরাস (৫৮০–৫০০)
৭৪. ৭৪. ডেভিড লিভিংস্টোন (১৮১৩-১৮৭৩)
৭৫. ৭৫. লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)
৭৬. ৭৬. নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)
৭৭. ৭৭. এন্টনি লরেন্ট ল্যাভোশিঁয়ে (১৭৪৩-১৭৯৪)
৭৮. ৭৮. এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯–১৮২৩)
৭৯. ৭৯. ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (১৮২০-১৯১০)
৮০. ৮০. হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)
৮১. ৮১. টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১)
৮২. ৮২. জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৬৫-১৯৫০)
৮৩. ৮৩. মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯–১৯৬৮)
৮৪. ৮৪. সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২)
৮৫. ৮৫. রম্যাঁ রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪)
৮৬. ৮৬. পাবলো নেরুদা (১৯০৪–১৯৭৩)
৮৭. ৮৭. আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২খৃ. অব্দ)
৮৮. ৮৮. অ্যারিস্টটল (৩৮৫-৩২২খৃ. পূ.)
৮৯. ৮৯. মেরি কুরি (১৮৬৭-১৯৩৪)
৯০. ৯০. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-১৮৭৯)
৯১. ৯১. চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)
৯২. ৯২. উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট (১৮৭১-১৯৪৮) (১৮৬৭-১৯১২)
৯৩. ৯৩. চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)
৯৪. ৯৪. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)
৯৫. ৯৫. ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩২)
৯৬. ৯৬. আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫)
৯৭. ৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)
৯৮. ৯৮. প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭-খ্রীস্টপূর্ব ৩৪)
৯৯. ৯৯. মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪)
১০০. ১০০. স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন