৯৩. চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)

মাইকেল এইচ. হার্ট

কঠোর জীবন-সংগ্রাম আর ক্লান্তিহীন অধ্যবসায়ের বলে দীনহীন ধূলার জীবন থেকে নিজেকে পরিণত করেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম মহত্তম ব্যক্তিতে একজন মাত্র মানুষ যার হৃদয় ছিল মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা, সহমর্মিতা আর বিশ্বাসে ভরপুর, সুদীর্ঘ জীবনে যিনি বিশ্বমানবতাবোধের আদর্শকে প্রচারের মাধ্যম করেছিলেন চলচ্চিত্রকে, যিনি অন্যায়কে কোন দিন প্রশ্রয় দেননি, ভালবাসা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করেননি–তাঁর নাম চার্লস চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিন নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।

লন্ডনের ইস্ট লেনের এক দরিদ্র শিল্পী পরিবারে ১৮৮৯ খ্রি: ১৬ই এপ্রিল জন্ম হয়েছিল চার্লির। তাঁর বাবা অভিনয় করতেন থিয়েটারে, মা ছিলেন গায়িকা।

বাবা যা রোজগার করতেন মদের পিছনেই তা ফুকে দিতেন। ফলে অভাবের সংসারে বাসা বেঁধেছিল নিত্য অশান্তি।

চার্লির যখন এক বছর বয়স, আর তাঁর দাদা সিডনির চার বছর সেই সময় মা বাবা দুজনের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। দুঃখিনী মা দুই ছেলেকে নিয়ে উঠে এলেন আলো বাতাসহীন এক বস্তির অন্ধকার ঘরে।

থিয়েটারে গান করে মা যা রোজগার করতেন তিনটি মানুষের কায়ক্লেশে চলে যেত।

একটু বড় হয়ে মাকে সাহায্য করবার জন্য সিডনি বাচ্চাদের মধ্যে মজার মজার খেলা দেখিয়ে রোজগারের চেষ্টা করতেন। চার্লির ভারি ভাল লাগত দাদার খেলাগুলো। তিনি ভাবতেন বড় হয়ে দাদার মত খেলা দেখাবেন।

চার্লির যখন পাঁচ বছর বয়স, সেই সময় সংসারের দুঃখের অন্ধকার আরও ঘণীভূত হল। একদিন গান গাইতে গাইতে মায়ের কণ্ঠস্বর কেমন বিকৃত হয়ে গেল। সে গলা আর কোনদিন স্বাভাবিক হল না–চিরদিনের জন্য তার গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

চরম দুঃখের গ্লাসে পড়লেন তিনটি অসহায় প্রাণী। এই সময়ের দিনগুলো যেন কাটতেই চাইত না। মনে হতো এই অর্ধাহার অনাহারের গ্লানিময় জীবন বুঝি এমনিই শেষ হয়ে যাবে।

দাদা সিডনি ইতিপূর্বে জাহাজে চাকরি নিয়ে দূরে কোন দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। অসুস্থ মাকে নিয়ে একা কোন রকমে দিন গুজরান করতে লাগলেন চার্লি। এই সময় যখন যে কাজ পেয়েছেন ক্ষুধার রুটি জোগাড় করবার জন্য তাই করতে হয়েছে তাঁকে।

কখনও খবরের কাগজ ফিরি করেছেন, জুতো পালিশ করেছেন,মোট বইতেও দ্বিধা করেন নি। পুঁড়িখানার সামনে মাতালদের গান শুনিয়ে, নাচ দেখিয়ে টুপি পেতে ভিক্ষেও করেছেন। এমনি করে চরম দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে বারোবছরে পা দিলেন চার্লি। তদদিনে মা আরও নির্জীব হয়েছেন। তার বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখ, কোটরে বসা চোখ আর অনাহারে ক্লিষ্ট শরীর সহ্য করতে পারতেন না তিনি। বুকের ভিতরটা অসহ্য ব্যথায় মুচড়ে উঠত। আকুল হয়ে ভাবতেন, কবে তিনি দু’হাত ভরে মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারবেন–মায়ের মলিন শীর্ণ মুখে আবার হাসি দেখতে পাবেন।

একদিন জাহাজ থেকে ফিরে এলেন সিডনি। কিন্তু সংসারে সাহায্য করবার মত সম্বল কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি। এদিকে দুঃখের জ্বালা সইতে না পেরে মায়ের মাথায় দেখা দিয়েছে গোলমাল। দুভাই মিলে অগত্যা মাকে পাঠালেন পাগলা গারদে।

আর নিরুপায় অবস্থায় তাদের উঠতে হল গিয়ে বাবার আশ্রয়ে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হল না! সম্মায়ের যাতনা ছিল অসহনীয়।

কিছুদিনের মধ্যে মা ভাল হয়ে উঠলেন। আবার তিনজনে ফিরে এলেন আগের বস্তির ঘরে। ভাগ্য এবারে বুঝি কিছুটা প্রসন্ন হল। সিডনির একটা চাকরি জুটল। যৎসামান্য মাইনে। কিন্তু সেই সামান্যই দরিদ্রের সংসারে অসামান্য।

দাদার রোজগারে যদি কিছু যোগ করা যায় এই আশায় চার্লিও কাজের সন্ধানে পথে নামলেন।

নাটক দলের আখড়া বেডফোর্ড স্ট্রিটের কাছেই ছিল বস্তিটা। প্রতিদিন সেই পথে যাতায়াতের সময় নাটক দলের অফিসগুলো চোখে পড়তো চার্লির।

অভিনয় তার রক্তের। ছোটবেলায় বাবার অভিনয়ও দেখেছেন দু-একবার। তখন থেকেই স্বপ্ন বাবার মত অভিনেতা হবার। তাই কাজের সন্ধানে নেমে নাটকের দলের কথাই আগে মনে পড়ল তাঁর। যদি কোন নাটক দলে সামান্য একটা কাজ পাওয়া যায়।

কিন্তু একের পর এক অফিস ঘরগুলোর দরজা পার হয়ে যান। ভিতরে ঢোকার সাহস করে উঠতে পারেন না।

একদিন মনে বল সঞ্চয় করলেন। তারপর কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লেন এক নাটক দলের অফিস ঘরে। কিন্তু কাজের কথা পাড়তেই কেরানী ভদ্রলোক দরজা দেখিয়ে দিলেন।

সেদিনের মত নিরাশ হয়ে ফিললেও হাল ছাড়লেন না চার্লি। দু’চারদিন পর পরই গিয়ে হাজির হন সেই অফিসে।

ততদিনে ভয় সঙ্কোচ কেটে গেছে। কাজ একটা তার চাই যে করে হোক, কে বিরক্ত হল তা দেখলে তো চলবে না।

ভাগ্যক্রমে একদিন পড়ে গেলেন মালিকের চোখে। সপ্রতিভ চার্লিকে দেখে তার ভাল লেগে গেল। কাজও জুটে গেল।

সেই সময় শার্লক হোমস নামে একটা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে সেই দলের। তাতে বিলি বলে একটা ছোট ছেলের ভূমিকায় যে ছেলেটি অভিনয় করতো, সে চলে যাবে বলে তার জায়গায় নেওয়া হল চার্লিকে।

মাইনে ঠিক হল সপ্তাহে ২ পাউন্ড ১০ শিলিং। টাকাটা প্রত্যাশার চাইতেও অনেক বেশি। খুশি হয়ে চার্লি ভাবলেন, এবার বুঝি সংসারের অভাব ঘুচল।

ভবিষ্যতে যার অনবদ্য অভিনয় গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে তুলবে, অভিভূত করবে,সেই অবিস্মরণীয় শিল্পীর অভিনয় জীবন এভাবেই শুরু হল।

এই সময় দলের সঙ্গে নাটক দেখাবার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে হয়েছে চার্লিকে। সেই ভ্রাম্যমাণ জীবন ভাল লাগতো তার।

যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যে দাদাকেও নাটুকে দলে ভিড়িয়ে নিলেন চার্লি। নিজে জায়গা করে নিলেন আরও বড় দলে। তিনি তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন- ইংলন্ডের সব সেরা অভিনেতা হবেন।

চার্লির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফ্রেডকারননা নামে এক থিয়েটার মালিক। তাঁর দলের নাম কারোনার। সেখানে ফুটবল ম্যাচ নাটকে হাসির অভিনয় করবার জন্য চার্লিকে তাঁর দলে নিয়ে এলেন। সেই সময় চার্লির সতেরো বছর বয়স।

প্রথম রাতে অভিনয় করেই হল মাতিয়ে দিলেন চার্লি। দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন চার্লি।

সুনামের সঙ্গে টানা দুই বছর এই দলে অভিনয় করলেন তিনি। এখানেই তাঁর পরিচয় হল অভিনেত্রী হেটি কেটীর সঙ্গে।

প্রথম আলাপেই দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সেই প্রথম প্রেম চার্লির জীবনে। কিছুদিন মেলামেশার পর চার্লি বিয়ে করতে চাইলেন কেটীকে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন কেটীর মা।

দুজনের মিলন আর সম্ভব হল না। জীবনের প্রথম প্রেমই এভাবে ব্যর্থ হল। অনেক দিন এই ব্যর্থতার বেদনা চার্লিকে পীড়া দিয়েছিল। জীবনে কেটীর সঙ্গে আর কোনদিন

দেখা হয়নি। কিন্তু তার স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন।

চার্লির জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা ১৯০৯ খ্রি:। নাটকের দলের সঙ্গে প্যারিসে গেলেন। এখানকার মানুষের খোলামেলা উজ্জ্বল জীবন মুগ্ধ করল তাঁকে। পাশাপশি নিজের জীবন, জীবনযাত্রাকে খুবই অকিঞ্চিতকর মনে হল তার। যেন তিনি অদৃশ্য কোন গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন। কিছুতেই বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না। অথচ ক্রমাগত হাতছানি তাকে টানছে যেন অনুভব করছেন।

ইংলন্ডে ফিরে এসে আবার সেই ভ্রাম্যমাণ জীবনের একঘেয়েমির সঙ্গে যুক্ত হলেন।কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেন ক্রমশই ভিতরে ভিতরে। ভাঁড়ামো, রঙ্গ-তামাশা এসব যেন হঠাৎ কেমন কাটার মত বিঁধতে লাগল। অথচ এটাই তার নাটকের জীবনে বাঁধাধরা গন্ডি।

এই সময় অপ্রত্যাশিত ভাবেই চার্লির জীবনে পরিবর্তনের সুযোগ এসে গেল। আমেরিকায় দলের একটা নতুন শাখা খোলার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে একজন কৌতুকাভিনেতার প্রয়োজন পড়েছিল।

কারোনার দলের মালিক ফ্রেডকারননা আমেরিকা যাবার প্রস্তাব দিতেই একরকম লুফে নিলেন চার্লি। নতুন কিছু করার জন্য ভিতরে ভিতরে তিনি প্রবল অস্থিরতা বোধ করছিলেন। ইংলন্ডে তা করবার সুযোগ ছিল না। কেননা এখানকার দর্শকরা তাঁর রঙ্গ কৌতুকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। নতুন কিছু ওরা সহজে মেনে নিতে চাইবে না।

চার্লি ইংলন্ড ছেড়ে আমেরিকায় চলে এলেন ১৯১০ খ্রি:। প্রথম অভিনয় করলেন ৩রা অক্টোবর নিউইয়র্কের কলোনিয়াল থিয়েটারে। নাটকের নাম অউ-হাউস।

নিউইয়র্কের দর্শকদের মন জয় করে নিলেন প্রথম অভিনয়ের রাতেই। পত্রপত্রিকাতেও তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রকাশিত হল। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন চার্লি।

এরপর যেখাইে দলের সঙ্গে গেছেন সেখানেই তাঁর কৌতুকাভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ, আপুত করেছে।

চার্লির জীবনে এভাবেই ধীরে ধীরে সৌভাগ্যের সূত্রপাত হতে লাগল।

একদিন নাটক দেখতে এসেছিলেন এক সিনেমা কোম্পানির কর্মকর্তা অ্যাডাম কেসেল। চার্লির অভিনয় দেখে তিনি এমন মুগ্ধ হলেন যে নাটক শেষ হলে নিজে গিয়ে

তার সঙ্গে আলাপ করলেন। সাগ্রহে প্রস্তাব দিলেন সিনেমায় অভিনয় করবার।

ততদিনে শিল্পী চার্লির স্বকীয় চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছে। তিনি কি করতে চান, কিভাবে তা করবেন- এসব বিষয়ে পরিষ্কার একটা ছক নিজের মনে তৈরি করে নিয়েছেন।

সেই সময় সিনেমা সবে হাঁটতে শিখেছে। নির্বাক যুগ। অভিনেতাদের মুখে সংলাপ থাকে না। পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝাবার জন্য অভিনয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে বাজনা বাজানো হয়।

আমেরিকায় আসার পর এরকম দু-একটা সিনেমা দেখেছিলেন চার্লি। কিন্তু তাঁর মোটেই ভাল লাগেনি। অভিনয়কে মনে হয়েছে নিতান্তই কৃত্রিম। আর বাজনা তো একেবারেই সামঞ্জস্যহীন।

এই ধারার সঙ্গে নিজেকে জড়াবার মত মানসিক সাড়া পেলেন না চার্লি। যদিও সপ্তাহে ষোল ডলার মাইনেটা ছিল রীতিমত লোভনীয়। তবুও তিনি সিনেমার অভিনয়ের প্রথম সুযোগ সুবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন।

কেসেল ছিলেন পাকা জহুরী। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাঁর। চার্লি সহজাত প্রতিভা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও চার্লিকে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন।

আমেরিকায় থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে সেবারের মত চার্লিকে ইংলন্ডে ফিরে আসতে হল। ফেরে এলেন দু বছর পরে।

এবারে মন স্থির করেই এসেছিলেন। প্রথমেই দেখা করলেন কেসেলের সঙ্গে। জানালেন থিয়েটারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই তার কোম্পানিতে যোগ দেবেন।

কিছুদিন পরেই নাটকের সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন চার্লি, যোগ দিলেন সিনেমায়। মাইনে স্থির হল সপ্তাহে পঁচিশ ডলার। নাটক দিয়ে অভিনয় জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল এভাবেই তার ছায়াছবির পর্দায় পদার্পণ ঘটল।

তখনো হলিউড সাধারণ পর্যায়ে। সাদামাটা কিছু যন্ত্রপাতি ও ছবির সেট ছাড়া সেখানে আর কিছু ছিল না।

কেসেলের সঙ্গে হলিউডে এসে চার্লির মন দমে গেল। এখানকার কাজের পরিবেশ, মানুষজন দেখে কাজের উৎসাহ ঝিমিয়ে গেল তার। তবু প্রথম একটা ছবিতে অভিনয় করলেন। নিতান্তই যেন দায়সারা ভাবে।

থিয়েটারের সেই প্রণোচ্ছল টগবগে চার্লি যেন কেমন নিস্তেজ, প্রাণহীনভাবে হাতমুখ নেড়ে গেলেন কেবল। অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততার স্পর্শ তার মধ্যে ছিল না।

কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে গেলেন চার্লির অবস্থা দেখে। কোম্পানির মালিক ম্যাক সেনেট তো রীতিমত নিরাশ হলেন এবং তা প্রকাশ করতেও ইতস্ততঃ করলেন না।

চার্লি সরাসরি তার অভিযোগগুলো প্রকাশ করলেন। অভিনয়ে তার কোন স্বাধীনতা ছিল না। এ ছাড়া সাজপোশাকও করতে হয়েছিল নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

এরপর চার্লি প্রস্তাব করলেন, তাঁর মত করে অভিনয় করতে দিতে হবে। আর সাজপোশাকও নিজেই ঠিক করবেন।

শিল্পীর স্বাধীনতা মেনে নিলেন ম্যাক সেনেট। জানালেন, দ্বিতীয় ছবিতে তাঁকে অভিনয় করতে হবে এক সাংবাদিকের ভূমিকায়। সম্পূর্ণ হাসির রোল।

এবারে চার্লি নিজেই পড়লেন মুশকিলে। পোশাকের ব্যাপারটা নিয়ে আগে বিশেষ কিছু ভেবে রাখেননি তিনি। অথচ তার ইচ্ছা এমন কিছু একটা করা, যা আগে কেউ কখনো করেনি। আবার তা হবে এমন, যা দেখেই দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়তে বাধ্য হবে। চিন্তায় ডুবে গেলেন চার্লি পোশাকটা কেমন হওয়া দরকার কেবল তাই নিয়ে। পোশাকটাই হবে অভিনীত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।

চার্লি যে ঘরে থাকতেন, তার পাশের ঘরেই থাকতেন দশাসই চেহারার এক অভিনেতা। তাকে লক্ষ্য করে হঠাৎই একদিন তার মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গেল।

চার্লির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দৈহিক মাপের সেই অভিনেতার ঢোলাঢালা ট্রাউজারটা পরে নিলেন। কিন্তু গায়ে চাপালেন নিজেরই ছোট হয়ে যাওয়া একটা জ্যাকেট।

মাথায় পরলেন বাউলার টুপি। লম্বা টাই ঝোলালেন গলায়। প্রতিবেশী অভিনেতার। বিরাট আকারের জুতো দিয়ে পা ঢাকলেন, তবে উল্টোভাবে। এরপর হাতে নিলেন ছোট্ট

ছড়ি, ঠোঁটের ওপরে সঁটলেন খাটো গোফ।

সাজটা উদ্ভট-বিকুটে রকমের হলেও চার্লির বেশ মনের মতই হল। তবে সেদিন তিনি নিশ্চয় কল্পনাও করতে পারেননি যে এই বিচিত্র উদ্ভট সাজেই একদিন জগৎজোড়া খ্যাতির অধিকারী হবেন।

পোশাক অনুমোদন করার পর চার্লি পাকাপাকিভাবে ঠিক করে নিলেন, এই বিচিত্র · পোশাকের সঙ্গে তাঁর অভিনয়টাও হবে অদ্ভুত করমের।

শিল্পী হিসেবে তাঁর যা বক্তব্য তা তিনি প্রকাশ করবেন এই পোশাক ও অভিনয়ের মোড়কেই। এরপর পোশাক ও অভিনয় ভঙ্গিতে এক নতুন চার্লির আবির্ভাব ঘটল পর্দায়। যাত্রা শুরু হল চার্লি চ্যাপলিনের। এরপরে কেবল অর্থ, খ্যাতি, যশ, সম্মান–এরই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল শিল্পী চার্লির জীবন।

স্বাধীনভাবে ছবি তৈরি করার উদ্দেশ্যে চার্লি কিছুদিন পরে দুই ধনী ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় গঠন করলেন ইউনাইটেড আর্টিস্ট ফিলাস। ১৯১৭ খ্রি: চার্লির সোলডার আর্মস ছবি চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা লাভ করল। ছবির সুবাদে অর্থাগম হতে থাকে স্রোতের মত।

১৯১৮ খ্রি: তিনি বিয়ে করলেন সুন্দরী তরুণী মিলড্রেড হ্যারিসকে। কিন্তু এই বিয়ে শান্তির হল না। অল্পদিন পরেই বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেল।

এরই মধ্যে একে একে মুক্তি পেতে লাগল চার্লির দুনিয়া কাঁপানো সব ছবি। দি কিড, দি পিলগ্রিম, এ উওম্যান অব প্যারিস, দি গোল্ডরাশ, দি সার্কাস, দি সিটি লাইট ইত্যাদি।

শেষোক্ত ছবিতে চার্লির প্রতিভার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ছবি তার এক অনন্যসাধারণ অবদান।

চার্লি আগাগোড়া সেই ঢলঢলে ট্রাউজার, পায়ে বেঢপ মাপের জুতো, গায়ে আঁটোসাটো জামা, মাথায় বাউলার টুপি ইত্যাদি নিয়ে সব ছবিতে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেছেন।

হলিউডে নিজস্ব বাড়ি তৈরি হলে চার্লি সেখানে তাঁর চিরদুঃখিনী মাকে নিয়ে এসেছিলেন। জীবনের অবশিষ্ট কাল তিনি এখানেই মাতৃভক্ত পুত্রের সেবাযত্নে সুখে। অতিবাহিত করেছেন।

১৯৩১ খ্রি: হলিউডে নির্বাক ছবির যুগে শেষ হলে নরদানব হিটলারকে নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নির্মিত হল চার্লির দি গ্রেট ডিকটেটর ছবি। এই ছবিতে তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আর কৌতুকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুললেন হিটলারের চরিত্র। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চার্লির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল,তিনি কমিউনিজম প্রচার করছেন।

চার্লির ছবির বিশেষত্ব হল, মানুষের জীবনের ছোট ছোট দুঃখ, সুখ, ব্যথা-বেদনা, অনুভূতির বাঙ্গময় প্রকাশ। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, প্রগাঢ় ভালবাসা, অন্যায়ের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও মানবিক চেতনা তাঁর প্রতিটি ছবির মূল প্রতিপাদ্য।

সঁসিয়ে ভার্দু, লাইম লাইট, এ কিং অব নিউইয়র্ক চার্লির অসামান্য ছবিগুলোর অন্যতম।

১৯১৪ খ্রি: থেকে ১৯৩৯ খ্রি: পর্যন্ত তৈরি হয়েছে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সব ছবি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের একচ্ছত্র অধিপতি। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তাকে আপনজন বলে মেনে নিয়েছে। দেশে দেশে তিনি লাভ করেছেন রাজকীয় সম্বর্ধনা।

চার্লির চতুর্থ স্ত্রীর নাম উনা। ইনি ছিলেন আমেরিকান নাট্যকার ইউজিন ও-নীলের কন্যা। চুয়ান্ন বছর বয়সে আঠারো বছরের উনাকে বিয়ে করেছিলেন চার্লি এবং তাঁদের বিবাহিত জীবন ছিল সুখ শান্তিতে পরিপূর্ণ।

যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির সপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন চার্লি। তাঁর জীবন ছিল অনন্য নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও মানব প্রেমের প্রতিভূস্বরূপ। আত্মজীবনীতে তাঁর জীবনবোধ ও আদর্শ অকপটভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি।

১৯৭৭ খ্রি: ২৫শে ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডের বাসভবনে বিশ্বমানবতার পূজারী ও রুপোলী পর্দার অনন্য নায়ক চার্লি চ্যাপলিনের জীবনাবসান হয়।

সকল অধ্যায়

১. ১. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) (৫৭০-৬৩২ খ্রি:)
২. ২. হযরত ঈসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ৬-৩০)
৩. ৩. হযরত মুসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী)
৪. ৪. ইমাম আবু হানিফা (রঃ) (৭০২–৭৭২ খ্রি:)
৫. ৫. জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৩ খ্রি:)
৬. ৬. ইমাম বোখারী (রঃ) (৮১০-৮৭০ খ্রি:)
৭. ৭. আল বাত্তানী (৮৫৮–৯২৯ খ্রি:)
৮. ৮. আল ফারাবী (৮৭০-৯৬৬ খ্রি:)
৯. ৯. মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪১–১০২০ খ্রি:)
১০. ১০. আল বেরুনী (৯৭৩–১০৪৮ খ্রি:)
১১. ১১. ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি:)
১২. ১২. ওমর খৈয়াম (১০৪৪-১১২৩ খ্রি:)
১৩. ১৩. ইমাম গাজ্জালী (রঃ) (১০৫৮–১১১১ খ্রি:)
১৪. ১৪. ইবনে রুশদ (১১২৬১১৯৯ খ্রি:)
১৫. ১৫. আল্লামা শেখ সা’দী (রঃ) (১১৭৫–১২৯৫ খ্রি:)
১৬. ১৬. মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ) (১২০৭-১২৭৩ খ্রি:)
১৭. ১৭. ইবনুন নাফিস (১২০৮-১২৮৮ খ্রি:)
১৮. ১৮. ইবনে খালদুন (১৩২২–১৪০৬ খ্রীঃ)
১৯. ১৯. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রীঃ)
২০. ২০. মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)
২১. ২১. গৌতম বুদ্ধ (খ্রি: পূ: ৫৬৩ খ্রি: পূ: ৪৮৩)
২২. ২২. শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৩৩-১৮৮৬)
২৩. ২৩. শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩)
২৪. ২৪. স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)
২৫. ২৫. যোহান উলফগ্যঙ ভন গ্যেটে (১৭৪৯–১৮৩২)
২৬. ২৬. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১-১৯৫৫)
২৭. ২৭. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)
২৮. ২৮. ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি (১৮২১-১৮৮১)
২৯. ২৯. আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৫৬ খ্রিস্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিস্ট পূর্ব)
৩০. ৩০. লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)
৩১. ৩১. মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬)
৩২. ৩২. কনফুসিয়াস (খ্রি: পূর্ব ৫৫১ খ্রি: পূর্ব ৪৭৯)
৩৩. ৩৩. বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
৩৪. ৩৪. পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩)
৩৫. ৩৫. ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬)
৩৬. ৩৬. হেলেন কেলার (১৮৮০-১৯৬৮)
৩৭. ৩৭. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)
৩৮. ৩৮. কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)
৩৯. ৩৯. হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩)
৪০. ৪০. ত্যাগরাজ (১৭৬৭–১৮৪৭)
৪১. ৪১. নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১)
৪২. ৪২. ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫)
৪৩. ৪৩. পার্সি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)
৪৪. ৪৪. জোহন কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)
৪৫. ৪৫. জোহান্স গুটেনবার্গ (১৪০০–১৪৬৮)
৪৬. ৪৬ জুলিয়াস সিজার (খ্রি: পূ: ১০০খ্রি: পূ: ৪৪)
৪৭. ৪৭. গুলিয়েলমো মার্কোনি (১৮৭৪-১৯৩৭)
৪৮. ৪৮. রাণী এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩)
৪৯. ৪৯. জোসেফ স্টালিন (১৮৮২-১৯৫৩)
৫০. ৫০. ফ্রান্সিস বেকন (খ্রি: ১৫৬১ খ্রি: ১৬২৬)
৫১. ৫১. জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)
৫২. ৫২. চেঙ্গিস খান (১১৬২–১২২৭)
৫৩. ৫৩. এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫)
৫৪. ৫৪. লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)
৫৫. ৫৫. অশোক (আনুমানিক খ্রি: পূ: ৩০০–২৩২ খ্রি: পূর্ব)
৫৬. ৫৬. সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)
৫৭. ৫৭. আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল (১৮৪৭-১৯২২)
৫৮. ৫৮. যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫–১৭৫০)
৫৯. ৫৯. জন. এফ. কেনেডি (১৯১৭-১৯৬৩)
৬০. ৬০. গ্যালিলিও গ্যালিলাই (১৫৬৪-১৬৪২)
৬১. ৬১. হো চি মিন (১৮৯০–১৯৬৯)
৬২. ৬২. মহাত্মা গান্ধীজী (১৮৬৯-১৯৪৮)
৬৩. ৬৩. লেভ তলস্তয় (১৮২৮–১৯১০)
৬৪. ৬৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
৬৫. ৬৫. হিপোক্রেটস (৪৬০-৩৭০)
৬৬. ৬৬. জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮–১৯৩৭)
৬৭. ৬৭. আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫)
৬৮. ৬৮. উইলিয়ম শেকস্‌পীয়র (১৫৬৪-১৬১৬)
৬৯. ৬৯. জন মিলটন (১৬০৮–১৬৭৪)
৭০. ৭০. সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূ:)
৭১. ৭১. জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯)
৭২. ৭২. উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)
৭৩. ৭৩. পিথাগোরাস (৫৮০–৫০০)
৭৪. ৭৪. ডেভিড লিভিংস্টোন (১৮১৩-১৮৭৩)
৭৫. ৭৫. লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)
৭৬. ৭৬. নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)
৭৭. ৭৭. এন্টনি লরেন্ট ল্যাভোশিঁয়ে (১৭৪৩-১৭৯৪)
৭৮. ৭৮. এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯–১৮২৩)
৭৯. ৭৯. ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (১৮২০-১৯১০)
৮০. ৮০. হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)
৮১. ৮১. টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১)
৮২. ৮২. জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৬৫-১৯৫০)
৮৩. ৮৩. মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯–১৯৬৮)
৮৪. ৮৪. সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২)
৮৫. ৮৫. রম্যাঁ রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪)
৮৬. ৮৬. পাবলো নেরুদা (১৯০৪–১৯৭৩)
৮৭. ৮৭. আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২খৃ. অব্দ)
৮৮. ৮৮. অ্যারিস্টটল (৩৮৫-৩২২খৃ. পূ.)
৮৯. ৮৯. মেরি কুরি (১৮৬৭-১৯৩৪)
৯০. ৯০. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-১৮৭৯)
৯১. ৯১. চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)
৯২. ৯২. উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট (১৮৭১-১৯৪৮) (১৮৬৭-১৯১২)
৯৩. ৯৩. চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)
৯৪. ৯৪. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)
৯৫. ৯৫. ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩২)
৯৬. ৯৬. আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫)
৯৭. ৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)
৯৮. ৯৮. প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭-খ্রীস্টপূর্ব ৩৪)
৯৯. ৯৯. মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪)
১০০. ১০০. স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন