৫১. জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)

মাইকেল এইচ. হার্ট

জেমস ওয়াইট বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছিলেন–এরকম একটা ধারণাই সাধারণভাবে চালু আছে। আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। বাষ্পের বৈশিষ্ট্য এবং গুণাগুণ নিয়ে জেম্‌স ওয়াটের নশো বছর আগে থেকেই বৈজ্ঞানিক এবং আবিষ্কারকরা মাথা ঘামিয়ে আসছেন। আসলে জেমস ওয়াট যা করেছিলেন, তা হল বাষ্পীয় শক্তি নিয়ে তাঁর পূর্বসূরীরা যেসব সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন সেগুলোকে বিস্তারিত ভাব বিশ্লেষণ করে তাকে হাতেকলমে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা।

খ্রিস্টের জন্মেরও একশো বছর আগে হিবেরা নামে এক গ্রীক দার্শনিক “এওলিফাইল” বা “এওলাসের বল” নামে এক অদ্ভুত খেলনার সাহায্যে বাষ্পের শক্তিকে কাঁচে লগিয়েছিলেন। এই যন্ত্ররূপী খেলনাটিতে ছিল ধাতুর তৈরি নিজের অক্ষের ওপর ঘূর্ণায়মান একটি ফাপা গোলক এবং তার নীচে রাখা একটি পানির বড় কড়াই। গোলকটির সাথে লাগানে থাকত মুখ আটকানো সছিদ্র কয়েকটি টিউব। এবার কড়াই এর পানি আগুনে ফুটতে শুরু করলেই গোলকটি বাষ্পে ভরে উঠত এবং টিউবের ছিদ্র দিয়ে ঢোকা বাতাসের ওপর বাষ্পের চাপ পড়ে গোলকটি নিজের অক্ষের উপর ঘুরতে শুরু করত।

বাষ্পশক্তি চালিত সম্ভবতঃ এই প্রথম যন্ত্রটি ষোড়শ শতাব্দীতে গবেষকদের মধ্যে খুবই কৌতূহল ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। পরের দু’শতাব্দী ধরেই পন্ডিতেরা ফুটন্ত পানির বাষ্পের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনায় মেতে রইলেন। তাঁরা লক্ষ্য করে দেখলেন যে, বাষ্প দিয়ে যদি কোন নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত ওপরে ঠেলে ওঠে–কতটা উঠবে তা অবশ্য নির্ভর করে বাইরের আবহাওয়া মন্ডলের চাপের ওপর। এছাড়া আরো দেখলেন, বাম্পকে কোন পাত্রে ঘনীভূত করলে সেখানে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয় এবং পানি এসে সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করে। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের প্রথমটি ব্যবহার করে সলোমান দ্য কাউস বাষ্পীয় চাপ চালিত ফোয়ারা তৈরি করেছিলেন। একটি গোলাকার পাত্রে দুটি নল আটকানো থাকত; তার মধ্যে পথমটি দিয়ে পানি ঢোকানো হত, এবং দ্বিতীয়টি দিয়ে উত্তপ্ত পত্রের বাষ্পের চাপে ফিনকি দিয়ে পানি বেরোত। আর বাম্পের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটিকে কাজে লাগিয়ে ক্যাপটেন টমাস স্যাভেরি নামে একজন ইংরেজ সামরিক ইঞ্জিনিয়ার পাম্প তৈরি করে কর্ণিশ অঞ্চলের টিনের খনি থেকে পানি বার করার কাজে লাগালেন।

স্যাভেরিকে নিয়ে এ সম্বন্ধে একটি ভাল কাহিনী চালু আছে। একদিন একটি সরাইখানায় এক বোতল কিয়ান্তি মদ পান করার পর খালি বোতলটি চুল্লীতে ফেলে দিয়ে উনি একটা পানিপাত্র আনিয়ে তাতে হাত ধুচ্ছিলেন। এমন সময় তার নজরে পড়ল যে বোতলের পড়ে থাকা মদটুকু বাষ্প হয়ে উঠেছে। হঠাৎ কেঁকের মাথায় বোতলটি চুল্লী থেকে বার করে এনে সেটিকে উল্টো মুখ করে পানিতে ঢুকিয়ে দিলেন তিনি এবং অবাক হয়ে দেখলেন যে বোতলের বাম্পটি ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোতলের মধ্যে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে পাত্রের পানি সেখানে গিয়ে ঢুকছে।

এই সূত্রটি ধরেই তৈরি হল তাঁর পাম্প। দুটি বড় গোলাকার পাত্র রাখা হল আর একটিতে সঙ্গে বয়লার থেকে বাষ্প ঢোকানো হত। অপরটিতে ঢোকান হত খনির পানি। এরপর বাষ্পের চাপে অন্য একটি নল পানি বাইরে ফেলে দেওয়া হত। কিন্তু এ প্রক্রিয়া বিশেষ কার্যকরী হয়ে ওঠেনি করণ পাম্প করে যতটুকু পানি বারকরা হত, তার চাইতে বেশি পানি খনিতে এসে ঢুকত। পূর্বসূরীদের মত স্যাভেরিও বাম্পের অসীম সম্ভাবনার কথা বুঝে উঠতে পারেনি।

বাম্পকে ঠিকমত প্রথম কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিলেন টমাস নিউকোমেন (১৬৬৩–১৭১৯)। বাস্পের সহায্যে যন্ত্রের অংশবিশেষকে নড়িয়ে তার সহায্যে অন্য যন্ত্রকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি তাঁর যন্ত্র ছিল পাম্প।

নিউকোমেনের ইঞ্জিনের তলে ‘চেম্বার’ যুক্ত একটি খাড়া সিলিন্ডার থাকত, সিলিন্ডারটির ভেতরে থাকত একটি পিষ্টন’। আলাদা একটি বয়লরে বাষ্প তৈরি করে তাকে পিষ্টনের নীচে নিয়ে আসা হত। পিষ্টনটি আবার আটকানো থাকত একটি নিজের সমেত ঘূর্ণয়মান বীমের সঙ্গে। এই বীমটির সঙ্গে যে নব বা রডটি থাকত, সেটিই পাম্পটিকে চালু রাখত। প্রথমে সিলিন্ডারটির মধ্যে পাম্প ঢুকিয়ে দেওয়া হত। সিলিন্ডারটিও তার ফলে একটু উঠে যেত। এবার পিষ্টন আর রযের যুক্ত ওঠানামায়। পাম্পটি কাজ করত। সিলিন্ডারের মধ্যেকার বাম্পকে সিলিন্ডারের গায়ে ঠান্ডা জলের ফিকি দিয়ে ঘনীভূত করে নীচের চেম্বারটিতে এক আংশিক শূন্যস্থান পূরণ করত। পুরো

প্রক্রিয়াটিই ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ। ঘন্টায় ১৫৬ ফুট গভীরতা থেকে এই ইঞ্জিনে ৫০ গ্যালন (প্রায় ২৫০ লিটার) পানি তোলা যেত। ইঞ্জিনটি চালু রাখতে দুটি লোককে সবসময়েই ব্যস্ত থাকতে হত একজন সারাক্ষণ বয়লারের আগুনের দিকে নজর রাখত, অন্যজন পালা করে দুটি “ভালভ খুলত আর বন্ধ করত একটি বাষ্পের, অন্যটি ঠান্ডা পানির।

নিউ কোমেনকেই প্রকৃতপক্ষে বাষ্পীয় শক্তি ব্যবহারের আদি পুরুষ বলা যায়। কিন্তু তার সম্বন্ধে খুব বেশি জানতে পারা যায়নি। তখনকার দিনে আবিষ্কার বা উদ্ভাবককে প্রায় সবাই খুব অবিশ্বাসের চোখে দেখতেন তাই শ্রদ্ধার বদলে সন্দেহটাই তাঁর বরাতে জুটত বেশি।

প্রথম জীবনে নিকোমেন ফুটন্ত কেটলির ঢাকনার ওঠানামা নিয়ে যে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন সেটাই পরবর্তীকালে বাষ্পচালিত যন্ত্রের আজীবন গবেষক জেমস ওয়াটের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। অনেকেই মনে করেন জেমস ওয়াটের রোমাঞ্চকর কাজকর্মকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই এই কাহিনীটি চালু করা হয়েছিল। নিউকোমেন ছিল ডার্টমুখের এক কামার। স্যাভেরিও তাঁর পাত্রে কিছু কিছু ব্যাপারে নিউকোমেনের পরামর্শ নিয়েছিলেন। এবং নিউকোমেও স্যাভেরির কাজ সম্বন্ধে খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠে। অবশেষে স্যাভেরির মৃত্যুর পর তাঁর নেওয়া “পেটেন্টগুলোর মালিক হয়েছিলেন। কোলি নামে তাঁর এক কাজের মিস্ত্রী বন্ধুর তত্ত্বাবধানে পাম্পের ঐ ইঞ্জিনটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হতে থাকে। এরপর সুদীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে নিউকোমেনের এই “আগুনের যন্ত্রটিই” খনি থেকে পানি বার করবার একমাত্র উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

নিউকোমেন কিন্তু তার এই সৃষ্টির জন্য প্রায় কোন স্বীকৃতিই পাননি। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার করার বেশিরভাগ কৃতিত্বই দেওয়া হয় জেমস ওয়াটকে। এই দাবীর মধ্যে অবশ্য কিছুটা যুক্তি আছে। কারণ ওয়াটই বাষ্পচালিত ইঞ্জিনকে তার অতি সীমিত ক্ষমতার এমন এক উৎসে, যাকে অজস্র বিভিন্ন ধরনের কাজে লাগানো যায়। তার বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের নকশা নিখুঁত রূপ পাওয়ার পরে পাম্পের শক্তিকে দিয়ে খনির পানি পাম্প করা, কলকারখানার যন্ত্রপাতি চালানো, ময়দার কল চালানো, সুড়ঙ্গ খোঁড়া, বাড়ি তৈরি করা, জাহাজে বা খনিতে সরানো, পাহাড় বা মরুভূমির ওপর দিয়ে মালপত্র টেনে নিয়ে যাওয়া-এসবই করানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়াট আসলে নিউকোমেনের নক্শাটিকে উন্নততর করে তুলেছিলেন মাত্র, নিজে কিছু আবিষ্কার করেননি।

ওয়াটের এই মাত্রাতিরিক্ত খ্যাতির জন্য মূলতঃ দায়ী একটি প্রচলিত জনপ্রিয় কাহিনী। শৈশবে তাঁর মধ্যে তেমন কোন চোখে পড়ারমত বৈশিষ্ট্য তো ছিল না, বরং আলসে স্বভাবের জন্য ওঁর অভিভাবকরা ওঁকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। একদিন চায়ের টেবিলে ওঁর ওর কাকীমা জেমসকে তো দারুন বকাবকি করে বললেন–”জেমস্, তোমার মত কুঁড়ে ছেলে আমি দুটি দেখিনি। হয পড়াশোনা কর না হয় যাহোক একটা কাজে কাজ কিছু কর। গত এক ঘণ্টা ঘরে দেখছি, তুমি কোন কথাবার্তা না বলে খালি ঐ কেটলির ঢাকনাটা খুলছ, আর বন্ধ করছ। কখনো বা একটা কাপ, আর কখনো বা একটা চামচ নিয়ে বাষ্পের ওপর ধরছ, কি করে কেটলির নল দিয়ে বাম্পটা বেরোচ্ছে, সেটা মন দিয়ে দেখছ, আর বাম্প থেকে তৈরি হওয়া পানির ফোঁটাগুলো হয় গুনছ নয়তো ধরবার চেষ্টা করছে।”

পরবর্তী কালের ভাষ্যকারেরা এই অতিরঞ্জিত কাহিনীর মধ্যে জেমস্ ওয়ার্টের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। আসলে কিন্তু নেহাৎ আকস্মিকভাবেই তার মনে বাম্প নিয়ে কৌতূহল দেখা দিয়েছিল। উনি নানারকম যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন; সৌভাগ্যক্রমে একবার গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিনি কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কলেজের গবেষণাগারে একটি নিউকোমেনের ইঞ্জিনের মডেল তাকে সারাতে দেওয়া হয়েছিল। উনি দেখলেন যে, ইঞ্জিনটির সব যন্ত্রপাতি ঠিক থাকা সত্ত্বেও একবারে কয়েক মিনিটের বেশি সেটি চলছে না। ব্যাপারটা ঘটছে সেটা কিছুতেই তাঁর মাথায় ঢুকছিল না। হঠাৎই এক রবিবারের সকালে বেড়াতে বেড়াতে এমন একটা সমাধান তাঁর মাথায় খেলে গেল, যাতে উনি হয়ে গেলেন “শিল্প বিপ্লবের জনক। উনি বুঝতে পারলেন, ইঞ্জিনের পক্ষে বয়লারটি খুবই ছোট আর তাই ইঞ্চিনে অহেতুক বাষ্প নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান এটাই। কম বাষ্প খরচ হবে। এমন একটি ইঞ্জিন তৈরি করা।

ওয়াট দেখলেন বাম্পের অপচয় বন্ধ করতে গেলে দুটি জিনিস করতে হবে। প্রথমতঃ যে “চেম্বারে বাষ্প ঘণীভূত হয়, সেখানকার তাপমাত্রা কম রাখতে হবে; এবং দ্বিতীয়তঃ মূল সিলিন্ডাটির তাপমাত্রা বেশি রাখতে হবে। ওয়াট করলেন কি বাষ্প ঘণীভূত হওয়ার চেম্বার টি মূল সিলিন্ডার থেকে আলাদা করে দিলেন। দুটির মধ্যে অবশ্য যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হল। আলাদা এই “ চেম্বারটিতে বাষ্প ঢুকিয়ে অনবরত ঠান্ডা পানি ঢেলে তাকে ঠান্ডা রেখে বাম্পকে ঘণীভূত করা হতে লাগল এবং এর ফলে মূল সিলিন্ডারটির তাপমাত্রা না কমিয়েই আংশিক বায়ুশূন্যতা তৈরি করা গেল। এই বায়ুশূন্য অবস্থা ঠিক রাখার জন্য আর ঘণীভূত বাম্প সরিয়ে ফেলার জন্য ওয়াট এর একটি “হাওয়া পাম্প” ও জুড়ে দিলেন। এর ফলে জ্বালানির খরচ তিন-চতুর্থাংশ কমে গেল। ওয়াটের কোম্পানী এই জ্বালানি খরচ কমার ওপর এক-তৃতীয়াংশ স্বত্ত্ব বা “রয়্যালটি” দাবি করলেন। এই ইঞ্জিনের কার্যকারিতা এত গুণ বেড়ে গেল যে, আগে যে পরিমাণ পানি খনি থেকে বার করতে কয়েক মাস লেগে যেত, এখন সেই পানি মাত্র ১৭ দিনেই বার করে দেওয়া গেল।

এরপরে ওয়াট উন্নততর জীবনের ইঞ্জিন তৈরি করতে উদ্যোগী হলেন এই ধরনের ইঞ্জিনেই বাষ্পের ক্ষমতা পূর্ণ সদ্বব্যবহার করার সুযোগ হল। বাম্পচালিত ইঞ্জিনের সাহায্যে ভারি যন্ত্রপাতি চালাতে গেলে ঐ ইঞ্জিনে কোন কিছু ঘোরানোর বন্দোবস্ত রাখতে হবে। এই ঘোরানোয় গতি আনার সহজতম উপায় ছিল হাতল আর চাকার ব্যবহার করা। দাঁতওয়ালা চাকা, হাতল আর পিষ্টন লাগিয়ে, সিলিন্ডারের দুটি দিকের সঙ্গেই বয়লারের যোগসূত্র ঘটিয়ে রেগুলেটার বসিয়ে, বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে একেবারে ভোজবাড়ির মত রূপান্তর ঘটালেন। জেমস ওয়াট এই ইঞ্জিনের কার্যকরী ক্ষমতা শক্তি আর গতির আমূল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন এর সঙ্গে ইঞ্জিনে বাষ্পের চাপ ও পরিমান মাপার জন্য “ষ্টীম প্রেসারগেজ” ও লাগালেন। ডাক্তারের কাজে স্টেথোস্কোপ যে রকম গুরুত্বপূর্ণ, একজন ইঞ্জিনিয়ারের কাছে এই “ষ্টীম প্রেসার গেজ” ও তাই। বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের যে নকশা জেমস্ ওয়াট তিলে তিলে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, এখনো পর্যন্ত তাতে আর বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি।

দুটি ক্ষেত্রে অবশ্য ওয়াট কিছুতেই তাঁর ইঞ্জিনকে আরে বেশি উন্নতর করে তুলতে রাজি হননি। এদের মধ্যে প্রথমটি হল ইঞ্জিনের বহুমুখী, “যৌগিক” প্রসারণ যার ফলে বাষ্পের সাহায্যে ট্রেন চালানো সম্ভব হতঃ আর দ্বিতীয়টি হল খুব উঁচু চাপে বাষ্প ব্যবহার করা। বহুমুখী, “যৌগিক” প্রসারণ তিনি করতে চাননি, কারণ উনি ভেবেছিলেন, এতে তাঁর নিজের সংস্থার একচেটিয়া অধিকার নষ্ট হয়ে যাবে। আর উঁচু চাপে বাষ্প ব্যবহার করতে তিনি রাজি হননি বিস্ফোরণের সম্ভাবনার কথা ভেবে। তাঁর এই মনোভাবের ফলেই পরে রিচার্ড ট্রেভিথিক (১৭৭১–১৮৩৩) আর জর্জ স্টিফেনসন (১৭৮১– ১৮৪৮) বাম্পশক্তি চালিত রেলগাড়ি তৈরি করতে পেরেছিলেন, এবং তার ফলে স্থলপথে যাতায়াত খুবই দ্রুত হয়ে উঠেছিল। অবশ্য বাষ্পচালিত জাহাজ তৈরির ব্যাপারে ওয়াটের বেশ খানিকটা ভূমিকা ছিল। আমেরিকার বাম্পচালিত জাহাজের প্রথম নির্মাণকারী রবার্ট ফুলটন ওয়াটের কারখানাতেই তার জাহাজের ইঞ্জিনের জন্য অর্ডার দিয়েছিলেন।

প্রায় সব আবিষ্কারকের মতই ওয়াটেরও তার আবিষ্কারগুলোকে বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভজনক করে তোলার মত ব্যবসা বুদ্ধি বা ক্ষমতা কোনটাই ছিল না। তবে তাঁর। ভাগ্য খুবই ভাল বলতে হবে এইজন্য যে তিনি “ক্যারন আইরন ওয়াস”-এর প্রাণপুরুষ ডঃ রোয়েবা এবং বার্মিংহামের বিখ্যাত রেটপ্যকার ম্যাথিউ বাউলটনকে এ ব্যাপারে তাঁর পাশে পেয়েছিলেন। এই দুজন ব্যক্তি তাঁকে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা দিয়ে খুবই সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাউলটন ওয়াটের ব্যবসায়ের অংশীদারও হয়েছিলেন। তাঁর প্রখর ব্যবসার বুদ্ধির সহায়তা না পেলে হয়তো কাজ বন্ধই করে দিতে হত। রৌপ্যকার বাউলটন যে শুধু তাঁর অভিজাত “মাডেমে” গহনার শিল্পমন্ডিত কাজ ছেড়ে ওয়াটের তৈরি ইঞ্জিনগুলো যথাযথভাবে বসানো ও দেখানোর জন্য দরকারে বিপুল পরিমাণে অর্থ জুগিয়েছিলেন তাই এর ইঞ্জিন তৈরি করার জন্য শ্রমিক জোগাড় করে দিয়ে ওয়াটের তাঁর প্রথম ইঞ্জিনটি তৈরি করেছিলেন, সেখানে কামার ও টিনের মিস্ত্রী ছাড়া অন্য কোন শ্রমিক পাওয়াই যেতনা। ঐসব মিস্ত্রীদের কোন বড় কাজ করার যোগ্যতাই ছিল না। বাউলটনের যেসব শ্রমিক ছির তারা সবরকম ধাতুর কাজে এত দক্ষ ছিল যে, যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই তারা যথাসম্ভব নিখুঁত কাজ তুলে দিতে পারত। ওয়াট যে সমস্ত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলেন তা তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে; তাই খুব সুদক্ষ হাতের কাজ জানা লোকের পক্ষেওঁ তাড়াতাড়ি এবং পুরোপুরি নিখুঁত কাজ করা ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ এবং অতি কঠিন। শস্তা এবং কর্মক্ষম শক্তির উৎস ছাড়া যন্ত্রপাতিও তৈরি করা যাচ্ছিল না। আবার সঠিক যন্ত্রপাতির অভাবে ঠিকমত শক্তির উৎস গড়ে তোলাও সম্ভব হচ্ছিল না এইসব একটা জটিল গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়েছিল। ওয়াইট এই গোলকধাঁধার দুষ্ট চক্র ভাঙতে পেরেছিলেন।

ওয়াটের শেষ জীবন কিছুটা করুণ। চৌষট্টি বছর বয়সে ব্যবসাপত্রের ঝমেলা ঝাট থেকে সরে এসে তিনি নতুন আবিষ্কার করার কাজেই পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে যে ব্যক্তিটির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, সেই ব্যক্তিটি তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে নানারকম তুচ্চ যন্ত্রপাতি নিয়ে টুকটাক করায় মেতে উঠলেন। তাঁর শেষ আবিষ্কারটি ছিল ভাস্কর্যের কাজ নকল করার একটি যন্ত্র। একটি নির্দেশক বা “পয়েন্টার” ভাস্কর্যর ওপরে ঘুরে বেড়াত এবং তার নিয়ন্ত্রণে একটি ঘুরন্ত যন্ত্র অন্য একটি পাথরের চাইয়ের ওপর একইরকম ভাবে খোদাই করে যেত। মৃত্যুর কিছুদিন আগেই এরকম একটি ভাস্কর্যের নকল তাঁর বন্ধুদেরকে “৮৩ বছরের এক তরুণ শিল্পীর” উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন।

১৮১৯ সালে ৮৩ বছর তিনি মারা যান। ওয়েষ্ট মিনিষ্টার অ্যাবিতে তাঁর স্মৃতিফলক রাখা আছে।

স্যাভেরি এবং নিউকোমনে অগ্রদূত হলেও ওয়াইট বর্তমান যুগের আধুনিক বাষ্পচালিত যন্ত্রের আসল উদ্ভাবক ও সৃষ্টিকর্তা। বাষ্পের যে অসীম শক্তি আজ মানুষের করায়ত্ব, তার প্রধান অগ্রদূত জেমস ওয়াট। বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিনের জনক ট্রেভিথিক ও স্টিফেনসনকেও তিনিই পথ দেখিয়েছেন।

সকল অধ্যায়

১. ১. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) (৫৭০-৬৩২ খ্রি:)
২. ২. হযরত ঈসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ৬-৩০)
৩. ৩. হযরত মুসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী)
৪. ৪. ইমাম আবু হানিফা (রঃ) (৭০২–৭৭২ খ্রি:)
৫. ৫. জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৩ খ্রি:)
৬. ৬. ইমাম বোখারী (রঃ) (৮১০-৮৭০ খ্রি:)
৭. ৭. আল বাত্তানী (৮৫৮–৯২৯ খ্রি:)
৮. ৮. আল ফারাবী (৮৭০-৯৬৬ খ্রি:)
৯. ৯. মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪১–১০২০ খ্রি:)
১০. ১০. আল বেরুনী (৯৭৩–১০৪৮ খ্রি:)
১১. ১১. ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি:)
১২. ১২. ওমর খৈয়াম (১০৪৪-১১২৩ খ্রি:)
১৩. ১৩. ইমাম গাজ্জালী (রঃ) (১০৫৮–১১১১ খ্রি:)
১৪. ১৪. ইবনে রুশদ (১১২৬১১৯৯ খ্রি:)
১৫. ১৫. আল্লামা শেখ সা’দী (রঃ) (১১৭৫–১২৯৫ খ্রি:)
১৬. ১৬. মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ) (১২০৭-১২৭৩ খ্রি:)
১৭. ১৭. ইবনুন নাফিস (১২০৮-১২৮৮ খ্রি:)
১৮. ১৮. ইবনে খালদুন (১৩২২–১৪০৬ খ্রীঃ)
১৯. ১৯. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রীঃ)
২০. ২০. মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)
২১. ২১. গৌতম বুদ্ধ (খ্রি: পূ: ৫৬৩ খ্রি: পূ: ৪৮৩)
২২. ২২. শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৩৩-১৮৮৬)
২৩. ২৩. শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩)
২৪. ২৪. স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)
২৫. ২৫. যোহান উলফগ্যঙ ভন গ্যেটে (১৭৪৯–১৮৩২)
২৬. ২৬. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১-১৯৫৫)
২৭. ২৭. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)
২৮. ২৮. ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি (১৮২১-১৮৮১)
২৯. ২৯. আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৫৬ খ্রিস্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিস্ট পূর্ব)
৩০. ৩০. লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)
৩১. ৩১. মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬)
৩২. ৩২. কনফুসিয়াস (খ্রি: পূর্ব ৫৫১ খ্রি: পূর্ব ৪৭৯)
৩৩. ৩৩. বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
৩৪. ৩৪. পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩)
৩৫. ৩৫. ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬)
৩৬. ৩৬. হেলেন কেলার (১৮৮০-১৯৬৮)
৩৭. ৩৭. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)
৩৮. ৩৮. কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)
৩৯. ৩৯. হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩)
৪০. ৪০. ত্যাগরাজ (১৭৬৭–১৮৪৭)
৪১. ৪১. নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১)
৪২. ৪২. ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫)
৪৩. ৪৩. পার্সি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)
৪৪. ৪৪. জোহন কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)
৪৫. ৪৫. জোহান্স গুটেনবার্গ (১৪০০–১৪৬৮)
৪৬. ৪৬ জুলিয়াস সিজার (খ্রি: পূ: ১০০খ্রি: পূ: ৪৪)
৪৭. ৪৭. গুলিয়েলমো মার্কোনি (১৮৭৪-১৯৩৭)
৪৮. ৪৮. রাণী এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩)
৪৯. ৪৯. জোসেফ স্টালিন (১৮৮২-১৯৫৩)
৫০. ৫০. ফ্রান্সিস বেকন (খ্রি: ১৫৬১ খ্রি: ১৬২৬)
৫১. ৫১. জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)
৫২. ৫২. চেঙ্গিস খান (১১৬২–১২২৭)
৫৩. ৫৩. এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫)
৫৪. ৫৪. লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)
৫৫. ৫৫. অশোক (আনুমানিক খ্রি: পূ: ৩০০–২৩২ খ্রি: পূর্ব)
৫৬. ৫৬. সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)
৫৭. ৫৭. আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল (১৮৪৭-১৯২২)
৫৮. ৫৮. যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫–১৭৫০)
৫৯. ৫৯. জন. এফ. কেনেডি (১৯১৭-১৯৬৩)
৬০. ৬০. গ্যালিলিও গ্যালিলাই (১৫৬৪-১৬৪২)
৬১. ৬১. হো চি মিন (১৮৯০–১৯৬৯)
৬২. ৬২. মহাত্মা গান্ধীজী (১৮৬৯-১৯৪৮)
৬৩. ৬৩. লেভ তলস্তয় (১৮২৮–১৯১০)
৬৪. ৬৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
৬৫. ৬৫. হিপোক্রেটস (৪৬০-৩৭০)
৬৬. ৬৬. জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮–১৯৩৭)
৬৭. ৬৭. আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫)
৬৮. ৬৮. উইলিয়ম শেকস্‌পীয়র (১৫৬৪-১৬১৬)
৬৯. ৬৯. জন মিলটন (১৬০৮–১৬৭৪)
৭০. ৭০. সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূ:)
৭১. ৭১. জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯)
৭২. ৭২. উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)
৭৩. ৭৩. পিথাগোরাস (৫৮০–৫০০)
৭৪. ৭৪. ডেভিড লিভিংস্টোন (১৮১৩-১৮৭৩)
৭৫. ৭৫. লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)
৭৬. ৭৬. নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)
৭৭. ৭৭. এন্টনি লরেন্ট ল্যাভোশিঁয়ে (১৭৪৩-১৭৯৪)
৭৮. ৭৮. এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯–১৮২৩)
৭৯. ৭৯. ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (১৮২০-১৯১০)
৮০. ৮০. হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)
৮১. ৮১. টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১)
৮২. ৮২. জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৬৫-১৯৫০)
৮৩. ৮৩. মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯–১৯৬৮)
৮৪. ৮৪. সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২)
৮৫. ৮৫. রম্যাঁ রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪)
৮৬. ৮৬. পাবলো নেরুদা (১৯০৪–১৯৭৩)
৮৭. ৮৭. আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২খৃ. অব্দ)
৮৮. ৮৮. অ্যারিস্টটল (৩৮৫-৩২২খৃ. পূ.)
৮৯. ৮৯. মেরি কুরি (১৮৬৭-১৯৩৪)
৯০. ৯০. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-১৮৭৯)
৯১. ৯১. চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)
৯২. ৯২. উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট (১৮৭১-১৯৪৮) (১৮৬৭-১৯১২)
৯৩. ৯৩. চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)
৯৪. ৯৪. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)
৯৫. ৯৫. ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩২)
৯৬. ৯৬. আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫)
৯৭. ৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)
৯৮. ৯৮. প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭-খ্রীস্টপূর্ব ৩৪)
৯৯. ৯৯. মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪)
১০০. ১০০. স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন