৫৮. যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫–১৭৫০)

মাইকেল এইচ. হার্ট

১৭৬০ সালের লিজিগ শহর। সবার অলক্ষ্যে ফুটপাথের এক ভিখারিনী মারা যাচ্ছেন। ভিখারিনীর মৃত্যু তেমন নতুন কিছু নয়। তাই কারোই দরকার নেই সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার। তবু সেখানে উপস্থিত রয়েছেন দু-একজন। তাদের মধ্যে একজন একসময়ে এই ভিখারিনীর পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। পেশায় মাংসবিক্রেতা। এই ভিখারিনী ওর মাংসের দোকানের পাশের ফুটপাথেই বাস করেছেন গত দশ বছর। এই বন্ধুটির দাক্ষিণ্যেই ফুটপাথে আশ্রয় পেয়েছিলেন ভিখারিনীটি। ভিখারিনীটির নাম অ্যানা ম্যাগডালানা বাখ। যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ-এর দ্বিতীয় স্ত্রী, তার প্রিয়তমা অ্যানা। ১৭৫০ সালে, ওপরের ঘটনার বছর আরও করুণ। বাহ্ ছিলেন লিপজিগের সেন্ট টমাস চার্চের সংলগ্ন সেন্ট টমাস স্কুলের কয়ার মাস্টার। দীর্ঘকাল সারাদিন পরিশ্রমে করার পর বাতি জ্বালিয়ে রাত্রিবেলায় গান আর স্বরলিপি রচনা করার অভ্যাসের ফলে একটা সময়ে তার চোখের অসুখ হয়েছিল। ডাক্তারদের নিদান ছিল অস্ত্রোপচার করতে হবে চোখে। সেটা ১৭৪৮ সাল, শীতকাল।

চোখের অসুখ হওয়ার পরে লিপজিন শহরের অনামী এই কয়ার মাস্টারটিকে খুবই অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। একজন কয়ার মাস্টারের অর্গান বাজানোতে অধিকার নেই। দিনের বেলায় তাই সেই সুযোগ নেই। আবার রাতের বেলাতে অর্গান বাজালে অনেকেরই ঘুমের অসুবিধা হয়। অথচ বাখ-এর জীবনে সুরই ছিল একমাত্র জীবনীশক্তি। ফলে অকল্পনীয় মানসিক কষ্টে তাকে দিন যাপন করতে হচ্ছিল। তখন তার বয়স ৬৫। প্রথমা স্ত্রী নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানাই শুধু সর্বক্ষণের সঙ্গিনী। অথচ তার সন্তান সন্ততির সংখ্যা কুড়ি। অবশ্য তাদের মধ্যে দশজন আগেই মারা গেছে। তবু বেঁচে আছে। বাকি দশজন এবং তাদের প্রায় প্রত্যেককে না হলেও কেউ কেউ তো খুবই প্রতিষ্ঠিত। এইরকম এক মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে বাম্ চোখে অস্ত্রোপচার করতে রাজী হতে বাধ্য হলেন তিনি।

অস্ত্রোপচারে দিন ঠিক হল। আগের দিন রাতে বা ভয়ঙ্করভাবে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন যে তাকে একটু অর্গান বাজাতে দেওয়া হোক। বাখ-কে নিয়ে ইতিমধ্যেই চার্চের মধ্যে বেশ অশান্তি হচ্ছিল। কাজ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, অথচ অন্য কোথাও যাওয়ার সংস্থান নেই। অগত্যা চার্চের দয়ায় থাকার জায়গাটুকু অন্তত রয়েছে। ফলে চার্চের হাতে তোলা হয়ে থাকার জন্য খুবই সাবধানে সবার মন জুগিয়েই থাকতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে রাত্রিতে অর্গান বাজিয়ে অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে যে বাসস্থানটুকু আছে তাও হয়ত চলে যাবে। বাখের কাকুতি মিনতিতে তাই অ্যানা খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। তাছাড়া পরের দিনই অপারেশন। কে জানে অপারেশনের পরে আবার পড়ে কোন নতুন বিপত্তির উদ্ভব হয়। হয়ত ক্ষতি হতে পারে। ডাক্তাররা সেইরকমই ভয় দেখিয়ে গেছে। অনেক ভেবে চিন্তে অ্যানা শেষমেষ মনস্থির করে ফেললেন। না, তার স্বামী জীবনের শেষ সায়াহ্নে কেবল শুধু একটু অর্গান বাজাতে চেয়েছেন মাত্র, আর কিছু নয়। সেটার ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে।

রাত গম্ভীর হল। অ্যানা ধীরে ধীরে বাকে নিয়ে এলেন চার্চের বড় হলঘরে। বিশাল অর্গান সামনে। শিশুর মতন বাখ সেটাকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল। তারপর তিনি বাজাতে লাগলেন। অল্প সময়, খুব অল্পক্ষণ মাত্র। তারপর বাজনা শেষ করে, অ্যানাকে বললেন, ঠিক আছে অ্যানা, এবারে আমি প্রস্তুত।’

ততক্ষণে বাজনা শুনে ছুটতে ছুটতে ছলে এসেছেন চার্চের ডিরেক্টর, কিউরেটর উইনলিক ভয়ংকর চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। এর আগেও অর্গান বাজানোর অপরাধে বারবার অপমানিত হয়েছেন বাখ। আজ যেন সেসবই চুড়ান্ত আকার ধারণ করে। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে অ্যানা আজ চোরের মতন নিয়ে এসেছেন তার প্রিয় যোহানকে। কাল তার চোখের অপারেশন। কে জানে তার ফল কি হয়। তাই যোহানের শিশুর মতন শেষ আবদার তিনি উপেক্ষা করতে পারেন নি। কিন্তু উইনলিকের প্রত্যেকটি কথায় চার্চ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ধমক মুখ বুজে সহ্য করতে হয় তাকে। তবু তো যোহান একটুক্ষণ হলেও তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছেন। শান্ত হয়েছে তার মন। এবারে অপারেশনের জন্য সে প্রস্তুত। চোরের মতন মুখ নীচ করে নিজের ঘরে ফিরে এলেন অ্যানা যোহানকে সঙ্গে নিয়ে। পরের দিন চোখের অপারেশন হল। কিন্তু অপারেশনের পরে সারা শরীরে প্যারালিসিস হয়ে গেল বাখ-এর। দুবছর অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে অবশেষে বাখ মারা গেলেন ২৮ জুলাই ১৭৫০ সালে। অ্যানা মারা গেলেন তারও দশ বছর পরে ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৭৬০ সালে।

বাখ মারা যাওয়ার পর অ্যানাকে চার্চের ঘর ছেড়ে দিতে হয়েছিল। যা কিছু জিনিসপত্র রইল সব বিক্রি করে দিলেন অ্যানা। শুধু বাখের অসংখ্য রচনার পাণ্ডুলিপির স্তূপ তিনি প্রাণে ধরে ফেলে দিতে পারেন নি। চেনা অচেনা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে সকলের দরজায় দরজায় তিনি ধন্না দিলেন, নিজের আশ্রয়ের জন্য নয়, শুধু এই পাণ্ডুলিপিগুলো যত্ন করে রাখার জন্য। কিন্তু কেউই শেষ পর্যন্ত জঞ্জাল ভেবে সেগুলো রাখতে রাজী হয় না। ততদিনে অ্যানার শেষ বাসস্থানটুকুও চলে গেছে। এখন তিনি ফুটপাথের বাসিন্দা। সেই সময় লিপজিগের এই মাংসের দোকানদারটি, যে বাখ কে এক সময় চিনত গান ভালবাসত একটু আধটু, সে দয়াপরায়ণ হয়ে অ্যানার এই পাণ্ডুলিপির স্তূপ নিজের সেলারে রেখে দিতে সম্মত হল। সেই মাংসের ব্যবসায়ীর দয়াতে, তারই দোকানের পাশের ফুটপাথে কেটে যায় অ্যানার আরও দশ বছর। মাংসের ব্যবসায়ীটিই তাকে যতটুকু সম্ভব খাবার দাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। অবশেষে একদিন অ্যানা ম্যাগডালানা বা–এরও মৃত্যু হয়, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭৬০ সালে। অ্যানার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাগ্‌-এর যাবতীয় সঙ্গীত রচনার ওপরেও যাবনিকাপাত ঘটল। সেই যবনিকা আবার উত্তোলিত হয়েছিল তারও প্রায় একশো বছর পরে। ততদিনের লিপজিগের সেই মহান মাংসবিক্রেতা কোয়েলারের মৃত্যু হয়েছে।

কলিপজিগের জিওয়ানড়হাউস অর্কেস্ট্রার কনডাকটার ফেলিক্স মেনডেলেসনের ঠিক ইচ্ছে ছিল না লিপজিগ শহরে আসতে। ইচ্ছে ছিল তার স্বপ্নের শহর বার্লিনের অর্কেস্ট্রাতে কাজ করা। কিন্তু স্যাক্সানির রাজা স্বয়ং তার নাম প্রস্তাব করে পাঠিয়েছেন। যত্ন করে ডেকেছে লিপজিগ অর্কেস্ট্রার বোর্ড অব ট্রাষ্টি। নিয়োগপত্র পেয়ে ফেলিক্স খুব একটা খুশি হয়নি। কোথায় বার্লিন, আর কোথায় লিপজিগ। কিন্তু বউ সিসেল শুনেই কেন যেন মন্তব্য করে বলেছিল যে হয়ত স্বয়ং ঈশ্বরের ইচ্ছে যে ফেলিক্স লিপজিগেই যাক। অগত্যা ফেলিক্স কিছুদিন লিপজিগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তারপর একটা সময়ে সিসেলির কাছে স্বীকার করে, তার নিজেরও মনে হয়েছিল যে ঈশ্বরই হয়ত তাকে জোর করে লিপজিগের দিকে ডেকে নিচ্ছেন। এবং সেটা প্রমাণিতও হল। সেদিন ওরা একসঙ্গে ফিরছিল বাড়িতে, ধূসর সন্ধ্যা নেমে আসছে। ফেলিক্স ক্লান্ত বোধ করছিল। কিন্তু সিসেলের মাংসের দোকানটা ঘুরে যাওয়া দরকার। কয়েকমিনিটের ব্যাপার তাই ফেলিক্স আপত্তি করে না। মাংসের দোকানে তখন ভিড়। কেয়েলারের মাংস লিপজিগে খুবই বিখ্যাত। মুহূর্তের মধ্যে নিঃশব্দে মাংস কাটা হচ্ছে। কাগজ জড়িয়ে খরিদ্দারকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটা আগে বুঝি মাংস মোড়ানোর কাগজ ফুরিয়ে গেছে। মার্টিন কোয়েলারের বউ ছুটে গেছে বাড়ির ভেতরের চিলে কোঠায় রাখা কাগজের স্তূপ থেকে কিছু কাগজ নিয়ে আসতে। সিসেল দোকানে ঘুরে ঘুরে মাংস পছন্দ করছে। আর ফেলিক্স অলসমনে লক্ষ্য করছিল মার্টিন এর বউয়ের কাণ্ডকারখানা। হঠাৎ যেন ভুত দেখার মতন চমকে উঠল ফেলিক্স মেনডেলেসন। সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল ওর। সব রোমকূপগুলো যেন বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। বিস্ফোরিত চোখে ফেলিক্সের নজর পড়ল, মার্টিন কোয়েলায়ের বউয়ের নিয়ে আসা নতুন কাগজের পাঁজাটার ওপরে। এমন হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের পাজাটার একদম ওপরের কাগজটাতে লেখা রয়েছে “দি প্যাশন অফ আওয়ার লর্ড, অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাসু–বাই যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ।” সময়টা হল ১৮৬০ সাল। বাখ জন্মেছিলেন জার্মানির স্যাক্সনির অঞ্চলের আইসনাখ-এর ১৬৮৫ সালের ২১শে মার্চ। যোহান অ্যারোনিয়াস বাখ আর এলিজাবেথ লামারাহার্ট-এর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি। বাবা ছিলেন আইস বাখ–এর টাউন কনসার্ট-এর যন্ত্রবাদক। বাখের বয়স যখন দশ, তখনই তার মায়ের মৃত্যু হয়, অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাবাকেও। সংসারের সব দায়িত্ব পড়ল বড়ভাই যোহান ক্রিস্টোফারের ওপর।

প্রথম জীবনে সঙ্গীতের তালিম তিনি পেয়েছিলেন যোহান পাসলবেলের কাছে। চমৎকার সুরেলা কণ্ঠস্বর ছিল তার। সেই কণ্ঠস্বরের জন্যই মাত্র পনেরো বছর বয়সেই তিনি চাকরি একটা পেয়ে যান। চাকরিটা নিতে বাধ্য হন সংসারিক কারণে। তবে সঙ্গীতে রচনার শুরু সেই পনেরো বছর বয়স থেকেই। যখন তার বয়স বছর বাইশ তখন বিয়ে করলেন, ১৭০৭ সালে পারিবারিক আত্মীয়া মেরিয়া বারবারাকে। দীর্ঘ তের বছর স্থায়ী হয়েছিল এই বিয়ে। কিন্তু ১৭২০ সালে মেরিয়া বারবারা হঠাৎ মারা যান। বড় অসহায় হয়ে পড়েন বাখ। তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। শোকে তাপে, সঙ্গীত রচনার সৃষ্টি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়লেন। মেরিয়া মারা যান ১৭২০ সালে ৭ই জুলাই। বছরখানেক পেরোতেই না পেরোতেই দ্বিতীয়বার বিয়ে না করে থাকতে পারলেন না বাখ। বিয়ে করলেন অ্যানা ম্যাগডালেনাকে ১৭২১ সালে। ইতিমধ্যে বহুবার কর্মক্ষেত্র বদল করতে হয়েছিল তাকে। নানান শহরে চাকরি করার পর অবশেষে লিপজিগে আসেন ১৭২৩ সালে। আর সেখানেই থেকে যান সাতাশ বছর আমৃত্য।

বাখ এমন একটা সময়ে জন্মেছিলেন যখন সঙ্গীতকে সমাজে তেমন সম্মানসূচক পেশা বলে ভাবতেই পারত না কেউ। তার ফলে একদিকে যেমন মানুষ হিসেবে নিজের সম্মান আর অর্থ উপার্জনের জন্য তাকে রুখে দাঁড়াতে হত, তেমনিই আবার সঙ্গীতের সম্মান রক্ষার জন্যও তাকে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যেতে হত। এই দুটি কাজ একালেও যেমন যেখানে চাকরি কররেছেন, জার্মানির অনেক কটি শহরেই চাকরি করেছেন তিনি, কোথাও তাকে নিয়ে তেমন অসুবিধায় পড়তে হয়নি কর্তৃপক্ষকে। তার কারণ কাজের ব্যাপারে চিরকালই বাখ ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ। খুবই বিনয়ী। আত্মসচেতন তিনি ছিলেন অবশ্যই।

স্পর্শকাতরও কম নন। কিন্তু বৃহত্তর আদর্শ, সৃষ্টিশীল রচনার প্রতি একান্ত আনুগত্য কূপমণ্ডুকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেছিল তাকে। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তার যে অবিসংবাদী স্থান তার উপযুক্ত সবরকম গুণের কোনটারই কম ছিল না তার মধ্যে। হয়ত তার থেকেও বেশি কিছুটা ছিল। সেটা তা রোমান্টিসিজম। কিংবা দুর্দান্ত প্যাশন। জ্ঞানীর বিনয় আর অনুসন্ধান ছিল তার সহজাত। কিন্তু শত বৈরিতার মধ্যে, শত কষ্টের মধ্যেও আপোস করেছেন কদাচিত। আপনভোলা এই সম্মানিত শিল্পী উন্মাদের মতন সঙ্গীত রচনা করেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর অক্লান্তভাবে। কিন্তু তা নিয়ে প্রচার করার মতন মানসিকতা তার একবারেই ছিল না।

জীবনের সায়াহ্নে অন্ধত্ব ছিল তার অভিশাপ। চার্চ কর্তৃপক্ষ প্রথমেই তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল তার সঙ্গীত। অর্গান বাজানো তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার অর্গান। কিন্তু সেই অর্গান থেকে বিছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। একথা ঠিকই যে বাখ যখন বেঁচেছিলেন তখন অর্থ এবং ক্ষমতার চূড়ায় আসীন না হলেও তাকে অশ্রদ্ধা করার মতন সাহস এবং ক্ষমতা শুধু অসামাজিক বা সমাজবিরোধী যারা শিল্পরবিরোধী যারা তাদেরই ছিল। অন্য কারও নয়। তবে এক্ষেত্রে ঠিক একজন ধ্রুপদী শিল্পীকে রক্ষা করার যে গুরু দায়িত্ব সমাজের থাকে সেই কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয়নি। বাখকে অখ্যাত অজ্ঞাত অসুস্থ দরিদ্র হিসেবেই মারা যেতে হয়েছিল। তার স্ত্রীকে ফুটপাথে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তার সারাজীবনের আমানুষিক পরিশ্রম করে রচিত সঙ্গীতের পাণ্ডুলিপি একজনও নিজের কাছে অন্তত রেখে দিতেও রাজী হয়নি।

যাহোক, তিনশো বছর পরে ভূগোল আর ইতিহাস আর দেশকালের সীমানা পেরিয়ে সারা পৃথিবীতে বাখ যেভাবে গৃহীত হয়েছে, যেভাবে সমাদৃত হয়েছে, সত্যিকথা যে তার এক শতাংশও তিনি তার জীবদ্দশায় পাননি। এখন তাকে সর্বসময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীর মর্যাদা দিতে দ্বিধা করবেন এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। এক গতানুগতিক সঙ্গীতের পরিবেশে বাখ জন্মেছিলেন। সঙ্গীতের ইতিহাস বাখের আগে ছিল এক একঘেঁয়ে ঐতিহ্য। বাখ, সম্যক বিবেচনার, অক্লান্ত পরিশ্রমের সেই স্থিতাবস্থায় বিল্পব এনেছিলেন, ভেঙে দিয়েছিলেন নিয়মের নিগঢ়। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে গতি এসেছিল তার পরই। প্রিন্সিপল স্বহন্সি ‘ আর ‘ফর্ম’-এর প্রাচীন ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধনের কৃতিত্বে তিনি ছিলেন অসাধারণ।

আর সেই যে তিনশো বছর আগে পরীক্ষা নিরীক্ষার উত্তরের জানলা খুলে দিলেন, সেই পর্ব অনুসৃত হচ্ছে অদ্যাবিধি। নতুন ভাবনাচিন্তাও মিশে যাচ্ছে সেখানে প্রত্যেকদিন।

গান ভালবাসে এমন পরিবারেই জন্মেছিল বাখ। ১৭৩৫ সালে বাখ তার পরিবারের ইতিহাস সংগ্রহ করে একটা খসড়া তৈরি করেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘অরিজিন অফ দি মিউজিক্যাল ফ্যামিলি’। তবে তার পূর্বপুরুষরা সঙ্গীতের জগতে খ্যাতিমান হলেও সঙ্গীত রচনার জগতে পা বাড়াননি কখনও। বাখই প্রথম যিনি সঙ্গীত রচনা করতে অগ্রসর হন। তবে বাখের পূর্বে তার সন্তানদের মধ্যে যেমন উইনহেলস ক্রেডিম্যান, কার্ট ফিলিপ ইম্যান্নায়ন বা যোহান ক্রিষ্টিয়ান সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন তেমনিই তার আগেও তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে যোহান ক্রিস্টোফার যোহান মাইকেল আর যোহান লাউইসও খ্যাতি কম পাননি।

বাখের সন্তানদের মধ্যে যোহান ক্রিষ্টিয়ানকে তো ইংলণ্ডের বাখ বলে অভিহিত করা হত। যে আকস্মিক ও দৈব ঘটনার মধ্যে বাখ রচিত সঙ্গীতের শেষ খণ্ডটি (প্যাশন) লিপজিগের অখ্যাত এক মাংসবিক্রেতার চিলেকোঠা থেকে উদ্ধার করেছিলেন ফেলিক্স মেনডেলেসন তার রূপায়ণের গল্পটিও চমকপ্রদ। মৃত্যুশয্যায় ফেলিক্স বলেছিলেন, যদি আমার গানের শেষ রেশটুকুর হিসাবটিও কালের গতিতে মুছেও যায়, ভবিষ্যতের মানব সভ্যতাকে আমাকে মনে করে রাখতেই হবে। তার কারণ আমি জেকব লাডউইড ফেলিক্স মেনডেলেসন একজন ইহুদি-(আমি খ্রিস্টানদের তাদের সবচাইতে সার্থক সঙ্গীত উপহার দিতে সমর্থ হয়েছিলাম) ফেলিক্স–জীবনে বাখ এর প্যাশন সঙ্গীতে রূপান্তরিত করতে যে সংগ্রাম, বা কৃষ্ণসাধনা, বা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল তার ভাবতেও বিস্মিত হতে হয়। সেই গান গাহিবার ব্যবস্থা করার বিরুদ্ধে বাধা এসেছিল সমাজের সর্বস্তর থেকে। মূলত ইহুদিদের দিক থেকেই বেশি। মজার কথা হল সেই গান প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল সঙ্গীতবিশারদ, সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে নয়, করতে হয়েছিল চারশোজন অখ্যাত চাষী অনুচরদের নিয়ে। এমনকি সেই কাজ করতে বাধা এসেছিল বিস্তর। কিন্তু বাখ-এর সেই গান ঠেকানো যায়নি।

তারপর থেকে সেই গান যেই শুনেছে পৃথিবীর একপ্রান্তে থেকে অন্যপ্রান্তের যে কোনও মানুষ সেই মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বারবার শুনতে চেয়েছে সেই গান। এখন আর বাখকে ভাল লাগা মন্দ লাগার প্রশ্ন পৃথিবীতে নেই। বাখ এখন একটি অভিজ্ঞতা একটা অবশেসন, যে একবার শুনেছে তার আর পরিত্রাণ নেই সেই মুগ্ধ মূচ্ছনায় হারিয়ে যাওয়া ছাড়া। বাখ মারা গেলেন। সংগ্রামের একটা অধ্যায় সম্পূর্ণ হল। মৃত্যুর সময়ে তার শেষ কথা ছিল হে ঈশ্বর, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।

সেন্ট জন করবখানায় তাকে সমাহিত করা হল। কয়েকবছর পর একটা নতুন রাস্তা তৈরি করার প্রয়োজনে সেই কবরখানা গেল ভেঙে। সেই ডামাডোলে বাখ––এর সমাধিটিও সরানো হল। আর সেটা হারিয়েও গেল চিরতরে, আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানুষের মন থেকে দূরে থেকেও ভোলেননি তাকে ঈশ্বর যার কাছে তিনি সমর্পণ করেছিলেন নিজেকে এবং তার সৃষ্ট সঙ্গীতের অমূল্য পাণ্ডুলিপিগুলো।

সকল অধ্যায়

১. ১. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) (৫৭০-৬৩২ খ্রি:)
২. ২. হযরত ঈসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ৬-৩০)
৩. ৩. হযরত মুসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী)
৪. ৪. ইমাম আবু হানিফা (রঃ) (৭০২–৭৭২ খ্রি:)
৫. ৫. জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৩ খ্রি:)
৬. ৬. ইমাম বোখারী (রঃ) (৮১০-৮৭০ খ্রি:)
৭. ৭. আল বাত্তানী (৮৫৮–৯২৯ খ্রি:)
৮. ৮. আল ফারাবী (৮৭০-৯৬৬ খ্রি:)
৯. ৯. মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪১–১০২০ খ্রি:)
১০. ১০. আল বেরুনী (৯৭৩–১০৪৮ খ্রি:)
১১. ১১. ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি:)
১২. ১২. ওমর খৈয়াম (১০৪৪-১১২৩ খ্রি:)
১৩. ১৩. ইমাম গাজ্জালী (রঃ) (১০৫৮–১১১১ খ্রি:)
১৪. ১৪. ইবনে রুশদ (১১২৬১১৯৯ খ্রি:)
১৫. ১৫. আল্লামা শেখ সা’দী (রঃ) (১১৭৫–১২৯৫ খ্রি:)
১৬. ১৬. মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ) (১২০৭-১২৭৩ খ্রি:)
১৭. ১৭. ইবনুন নাফিস (১২০৮-১২৮৮ খ্রি:)
১৮. ১৮. ইবনে খালদুন (১৩২২–১৪০৬ খ্রীঃ)
১৯. ১৯. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রীঃ)
২০. ২০. মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)
২১. ২১. গৌতম বুদ্ধ (খ্রি: পূ: ৫৬৩ খ্রি: পূ: ৪৮৩)
২২. ২২. শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৩৩-১৮৮৬)
২৩. ২৩. শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩)
২৪. ২৪. স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)
২৫. ২৫. যোহান উলফগ্যঙ ভন গ্যেটে (১৭৪৯–১৮৩২)
২৬. ২৬. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১-১৯৫৫)
২৭. ২৭. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)
২৮. ২৮. ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি (১৮২১-১৮৮১)
২৯. ২৯. আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৫৬ খ্রিস্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিস্ট পূর্ব)
৩০. ৩০. লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)
৩১. ৩১. মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬)
৩২. ৩২. কনফুসিয়াস (খ্রি: পূর্ব ৫৫১ খ্রি: পূর্ব ৪৭৯)
৩৩. ৩৩. বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
৩৪. ৩৪. পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩)
৩৫. ৩৫. ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬)
৩৬. ৩৬. হেলেন কেলার (১৮৮০-১৯৬৮)
৩৭. ৩৭. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)
৩৮. ৩৮. কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)
৩৯. ৩৯. হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩)
৪০. ৪০. ত্যাগরাজ (১৭৬৭–১৮৪৭)
৪১. ৪১. নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১)
৪২. ৪২. ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫)
৪৩. ৪৩. পার্সি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)
৪৪. ৪৪. জোহন কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)
৪৫. ৪৫. জোহান্স গুটেনবার্গ (১৪০০–১৪৬৮)
৪৬. ৪৬ জুলিয়াস সিজার (খ্রি: পূ: ১০০খ্রি: পূ: ৪৪)
৪৭. ৪৭. গুলিয়েলমো মার্কোনি (১৮৭৪-১৯৩৭)
৪৮. ৪৮. রাণী এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩)
৪৯. ৪৯. জোসেফ স্টালিন (১৮৮২-১৯৫৩)
৫০. ৫০. ফ্রান্সিস বেকন (খ্রি: ১৫৬১ খ্রি: ১৬২৬)
৫১. ৫১. জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)
৫২. ৫২. চেঙ্গিস খান (১১৬২–১২২৭)
৫৩. ৫৩. এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫)
৫৪. ৫৪. লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)
৫৫. ৫৫. অশোক (আনুমানিক খ্রি: পূ: ৩০০–২৩২ খ্রি: পূর্ব)
৫৬. ৫৬. সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)
৫৭. ৫৭. আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল (১৮৪৭-১৯২২)
৫৮. ৫৮. যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫–১৭৫০)
৫৯. ৫৯. জন. এফ. কেনেডি (১৯১৭-১৯৬৩)
৬০. ৬০. গ্যালিলিও গ্যালিলাই (১৫৬৪-১৬৪২)
৬১. ৬১. হো চি মিন (১৮৯০–১৯৬৯)
৬২. ৬২. মহাত্মা গান্ধীজী (১৮৬৯-১৯৪৮)
৬৩. ৬৩. লেভ তলস্তয় (১৮২৮–১৯১০)
৬৪. ৬৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
৬৫. ৬৫. হিপোক্রেটস (৪৬০-৩৭০)
৬৬. ৬৬. জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮–১৯৩৭)
৬৭. ৬৭. আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫)
৬৮. ৬৮. উইলিয়ম শেকস্‌পীয়র (১৫৬৪-১৬১৬)
৬৯. ৬৯. জন মিলটন (১৬০৮–১৬৭৪)
৭০. ৭০. সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূ:)
৭১. ৭১. জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯)
৭২. ৭২. উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)
৭৩. ৭৩. পিথাগোরাস (৫৮০–৫০০)
৭৪. ৭৪. ডেভিড লিভিংস্টোন (১৮১৩-১৮৭৩)
৭৫. ৭৫. লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)
৭৬. ৭৬. নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)
৭৭. ৭৭. এন্টনি লরেন্ট ল্যাভোশিঁয়ে (১৭৪৩-১৭৯৪)
৭৮. ৭৮. এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯–১৮২৩)
৭৯. ৭৯. ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (১৮২০-১৯১০)
৮০. ৮০. হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)
৮১. ৮১. টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১)
৮২. ৮২. জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৬৫-১৯৫০)
৮৩. ৮৩. মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯–১৯৬৮)
৮৪. ৮৪. সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২)
৮৫. ৮৫. রম্যাঁ রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪)
৮৬. ৮৬. পাবলো নেরুদা (১৯০৪–১৯৭৩)
৮৭. ৮৭. আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২খৃ. অব্দ)
৮৮. ৮৮. অ্যারিস্টটল (৩৮৫-৩২২খৃ. পূ.)
৮৯. ৮৯. মেরি কুরি (১৮৬৭-১৯৩৪)
৯০. ৯০. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-১৮৭৯)
৯১. ৯১. চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)
৯২. ৯২. উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট (১৮৭১-১৯৪৮) (১৮৬৭-১৯১২)
৯৩. ৯৩. চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)
৯৪. ৯৪. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)
৯৫. ৯৫. ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩২)
৯৬. ৯৬. আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫)
৯৭. ৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)
৯৮. ৯৮. প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭-খ্রীস্টপূর্ব ৩৪)
৯৯. ৯৯. মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪)
১০০. ১০০. স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন