৩৯. হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩)

মাইকেল এইচ. হার্ট

১৭৫৫ সালের ১০ এপ্রিল কারো কারো মতে (১১ এপ্রিল) মধ্যরাতে জার্মান দেশের অর্ন্তগত মারগ্রেওয়েট প্রদেশের অন্তর্গত মিসেন শহরে এক দরিদ্র চিত্রকরের গৃহে জন্ম হল এক শিশুর। দরিদ্র পিতামাতার মনে হয়েছিল আর দশটি পরিবারে যেমন সন্তান আসে, তাদের পরিবারেও তেমনি সন্তান এসেছে। তাকে নিয়ে বড় কিছু ভাববার মানসিকতা ছিল না তাদের। তাই অবহেলা আর দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হয়ে উঠল সেই শিশু। তখনো কেউ কল্পনা করতে পারেনি এই শিশুই একদিন হয়ে উঠবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন ধারার জন্মদাতা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার জনক ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিখ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান।

হ্যানিম্যানের বাবা গগফ্রিড মিসেন শহরের একটা চীনামাটির কারখানায় বাসনের উপর নানান নক্সা করতেন, ছবি আঁকতেন। এই কাজে যা পেতেন তাতে অতি কষ্টে সংসার চলত। হ্যানিম্যান ছিলেন চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। পিতামাতার প্রথম পুত্র সন্তান। গডফ্রিডের আশা ছিল হ্যানিম্যান বড় হয়ে উঠলে তারই সাথে ছবি আঁকার কাজ করবে, তাতে হয়তো সংসারে আর্থিক সমস্যা কিছুটা দূর হবে।

কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই হ্যানিম্যানের ছিল শিক্ষার প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ। বাড়িতেই বাবা-মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শুরু হল। বারো বছর বয়েসে হ্যানিম্যান ভর্তি হলেন স্থানীয় টাউন স্কুলে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন তার শিক্ষকরা। বিশেষত গ্রীক ভাষায় তিনি এতখানি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তিনিই প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্রদের গ্রীক ভাষা পড়াতেন।

টাউন স্কুলে শিক্ষা শেষ করে হ্যানিম্যান ভর্তি হলেন প্রিন্সেস স্কুলে (Prince’s School)। এদিকে সংসারে ক্রমশই অভাব আর দারিদ্র্য প্রকট হয়ে উঠেছিল। গডফ্রিডের পক্ষে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। নিরুপায় হ্যানিম্যানকে স্কুলে থেকে ছাড়িয়ে লিপজিক শহরে এক মুদির দোকানে মাল কেনাবেচার কাজে লাগিয়ে দিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ এ কথা জানতে পেরে হ্যানিম্যানের স্কুলের মাইনে ও অন্যসব খরচ মকুব করে দিল যাতে আবার হ্যানিম্যান পড়াশুনা আরম্ভ করতে পারেন। যথাসময়ে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হলেন হ্যানিম্যান। তিনি একাধিক ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

ক্রমশই তাঁর মধ্যে উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠছিল। পিতার অমতেই লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্যে বেরিয়ে পড়লেন। হাতে সম্বল মাত্র ২০ খেল (আমাদের দেশের ১৪ টাকার মত)। তিনি ভর্তি হলেন লিপজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজের খরচ মেটাবার জন্য এক ধনী গ্রীক যুবককে জার্মান এবং ফরাসি ভাষা শেখাতেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রকাশকের তরফে অনুবাদের কাজ করতেন।

হ্যানিম্যানের ইচ্ছা ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করবেন। তখন কোন ডাক্তারের অধীনে থেকে কাজ শিখতে হত। লিপজিক কোন ভাল কোয়ারিনের কাছে কাজ করার সুযোগ পেলেন। তখন তাঁর বয়স বাইশ বছর। ইতিমধ্যেই তিনি গ্রীক, লাটিন, ইংরাজি, ইতালিয়ান, হিব্রু, আরবি, স্প্যানিশ এবং জার্মান ভাষায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন। এবার ভাষাতত্ত্ব ছেড়ে শুরু হল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন।

দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় তার সামান্য গচ্ছিত অর্থ একদিন চুরি হয়ে গেল। নিদারুণ অর্থসংকটে পড়লেন হ্যানিম্যান। এই বিপদের দিনে তাকে সাহায্য করলেন স্থানীয় গভর্নর। তাঁর লাইব্রেরী দেখাশুনার ভার দিলেন হ্যানিম্যানকে। এই সুযোগটিকে পুরোপুরি সদব্যবহার করেছিলেন তিনি। এক বছর নয় মাসে লাইব্রেরীর প্রায় সমস্ত বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন।

হাতে কিছু অর্থ সঞ্চয় হতেই তিনি ভর্তি হলেন আরল্যানজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি চব্বিশ বছর বয়েসে “ডক্টর অব মেডিসিন” উপাধি পেলেন।

ডাক্তারি পাস করে এক বছর তিনি প্র্যাকটিস করার পর জার্মানির এক হাসপাতালে চাকরি পেলেন।

এই সময় চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধীয় প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। এই প্রবন্ধে নতুন কিছু বক্তব্য না থাকলেও রচনার মৌলিকত্ব অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

অন্য সব বিষয়ের মধ্যে রসায়নের প্রতি হ্যানিম্যানের ছিল সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। সেই সূত্রেই হেসলার নামে এক ঔষধের কারবারীর সাথে পরিচয় হল। নিয়মিত তার বাড়িতে যাতায়াত করতে হত। হেসলারের সাথে থাকতেন তার পালিতা কন্যা হেনরিয়েটা। হেনরিয়েটা ছিলেন সুন্দরী বুদ্ধিমতী। অল্পদিনেই দুই তরুণ-তরুণী পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। ১৭৮২ সালের ১৭ নভেম্বর দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। হ্যানিম্যানের বয়স তখন ২৭ এবং হেনরিয়েটার ১৮। বিয়ের পরের বছরেই তাঁদের প্রথম সন্তান জন্ম নিল।

এই সময় হ্যানিম্যান রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন রচনা প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ, “কিভাবে ক্ষত এবং ঘা সারানো যায় সে বিষয়ে নির্দেশনামা।”

এই বই পড়লেই বোঝা যায় তরুণ চিকিৎসক হ্যানিম্যান নিজের অধিগত বিষয়ে কতখানি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এই সময় থেকেই আরো গভীরভাবে পড়াশুনা এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা ও অনুবাদের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

সে যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অন্য বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন না। কিন্তু হ্যানিম্যানের আগ্রহ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে। বিশেষভাবে তিনি রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ফরাসি ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় একাধিক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুই খণ্ডে Art of Manufacturing chemical products. এছাড়া দুই খণ্ডে Art of distilling liquors. রসায়নের ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা সেই যুগে যথেষ্ট সাড়া জগিয়েছিল।

তাঁর লেখা On Arsenic poisoning ফরেনসিক গবেষণার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

এই সময় তিনি ডাক্তার ওয়াগলার-এর সাথে টাউন হাসপাতালে ডাক্তারি করতেন। হঠাৎ ডাক্তার ওয়াগলার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সমস্ত হাসপাতালের দায়িত্ব এসে পড়ল হ্যানিম্যানের উপর।

পরের কয়েক বছর তিনি অজস্র বই অনুবাদ করেন এবং Mercurius Solubilis আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়ে গেলেন। চিকিৎসক হিসাবে তখন তার নাম যশ চারদিকে এতখানি ছড়িয়ে পড়েছিল যে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। মনের মধ্যে তখন নতুন কিছু উদ্ভাবনের স্বপ্ন ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন সমস্ত দিন হাসপাতালে কাটিয়ে মনের ইচ্ছা পূর্ণ করা সম্ভব হবে না। তাই হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য পুরোপুরি অনুবাদের কাজে হাত দিলেন।

১৭৯১ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাক্তার কালেনের একটি বই এ্যালোপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকার ইংরাজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদের কাজ হাতে নেন। এই বইয়ের একটি অধ্যায়ের Cinchona Bark পাদটীকায় লেখা ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের ঔষধ কুইনাইন যদি কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা যায় তবে অল্পদিনের মধ্যেই তার শরীরে ম্যালেরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবে।

কালেনের এই অভিমত হ্যানিম্যানের চিন্তাজগতে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করল। তিনি এর সত্যাসত্য পরীক্ষার জন্য নিজেই প্রতিদিন ৪ ড্রাম করে দুবার সিঙ্কোনার রস খেতে আরম্ভ করলেন। এর তিন-চারদিন পর সত্যি সত্যিই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলেন। এরপর পরিবারের প্রত্যেকের উপর এই পরীক্ষা করলেন এবং প্রতিবারই একই ফলাফল পেলেন। এর থেকে তার মনে প্রশ্ন জেগে উঠল, কুইনাইনের মধ্যে কি রোগের লক্ষণ এবং ঔষধের লক্ষণের সাদৃশ্য সৃষ্টিকারী কোন ক্ষমতা আছে? অথবা অন্য সমস্ত ঔষধের মধ্যেই কি এই ক্ষমতা আছে? অর্থাৎ যে ওষুধ খেলে মানুষের কোন রোগ নিরাময় হয়, সুস্থ দেহে সেই ওষুধ খেলে সেই রোগ সৃষ্টি হয়।

এতদিন চিকিৎসকদের ধারণা ছিল বিরুদ্ধভাবাপন্নতাই বিরুদ্ধভাবাপন্নকে আরোগ্য করে। অর্থাৎ মানুষের দেহে অসুস্থ অবস্থায় যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায় তার বিপরীত ক্রিয়াশক্তি সম্পন্ন ঔষধেই রোগ আরোগ্য হয়। এই প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে শুরু হল তার গবেষণা।

এই সময় তিনি যাযাবরের মত এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্থায়ী কোন আস্তানা গড়ে তুলতে পারেননি। গোথার ডিউক মানসিক রোগের চিকিৎসালয় খোলার জন্য তার বাগানবাড়িটি হ্যানিম্যানকে ছেড়ে দিলেন। ১৭৯৩ সালে হ্যানিম্যান এখানে হাসপাতাল গড়ে তুললেন এবং একাধিক মানসিক রোগগ্রস্ত রুগীকে সুস্থ করে তোলেন। সেকালে মানসিক রুগীদের উপর কঠোর নির্যাতন করা হত। শারীরিক নির্যাতনকে চিকিৎসার প্রধান অঙ্গ বলে মনে করা হত। হ্যানিম্যান কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করেন।

কিছুদিন মানসিক হাসপাতালে থাকার পর তিনি আবার অন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ইতিমধ্যে তাঁর আটটি সন্তানের জন্ম হয়েছে। সংসারে আর্থিক অনটন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার গবেষণার কাজে সামান্যতম বিঘ্ন ঘটেনি। একদিকে যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করতেন, তেমনি পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজনে নিজেই বিভিন্ন ঔষুধ খেতেন। এতে বহুবার তিনি অসুস্থ পড়েন, তা সত্ত্বেও কখনো গবেষণার কাজ থেকে বিরত থাকেননি।

দীর্ঘ ছয় বছরের অক্লান্ত গবেষণার পর তিনি সিদ্ধান্তে এলেন যথার্থই সাদৃশ্যকে সদৃশ আরোগ্য করে। (similia similiabus curantur অর্থাৎ like cures likes)–এই ধারণা কোন অনুমান বা কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এ সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক সত্য।

তাঁর এই আবিষ্কার ১৭৯৬ সালে সে যুগের একটি বিখ্যাত পত্রিকায় (Hufeland’s Journal) প্রকাশিত হল। প্রবন্ধটির নাম দেওয়া হল “An essay on a new Principle for Ascertaining the curative Powers of Drugs and some Examination of the previous principal.”

এই প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে তিনি সিদ্ধান্তে এলেন Every Powerful medicinal sub stance produces in the human body a peculiar kind of discase the more Powerful the medicine, the more peculiar, marked and violent the disease.

We should imitate nature which sometimes cures a chronic disease by super adding another and employ in the (especially shronic) disease we wish ne which is able to Produce another very similar artificial disease and the former will be cured. Similia-Similibus.

এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আধুনিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ভিত্তি পত্তর করলেন হ্যানিম্যান–সেই কারণে ১৭৯৬ সালকে বলা হয় হোমিওপ্যাথিক জন্মবর্ষ। হোমিওপ্যাথিক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রীক শব্দ হোমস (Homoeos) এবং প্যাথস, (Pathos) থেকে। সদৃশ এবং এর অর্থ রোগ লক্ষণের সম লক্ষণ বিশিষ্ট ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা।

হ্যানিম্যানের এই যুগান্তকারী প্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে চিকিৎসা জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হল।

চিকিৎসা জগতের প্রায় সকলেই এই মতের ঘোরতর বিরোধী হয়ে উঠলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তীব্র সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে আরম্ভ করল। তাকে বলা হল অশিক্ষিত হাতুড়ে চিকিৎসক। নিজের আবিষ্কৃত সত্যের প্রতি তাঁর এতখানি অবিচল আস্থা ছিল, কোন সমালোচনাতেই তিনি সামান্যতম বিচলিত হলেন না।

হ্যানিম্যান নিজেই শুরু করলেন বিভিন্ন ঔষধের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তার মনে হয়েছিল সুস্থ মানবদেহের উপর ঔষধ পরীক্ষা করেই তার ফল উপলব্ধি করা সম্ভব। ঔষধের মধ্যে যে আরোগ্যকারী শক্তি আছে সেই বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার অন্য কোন উপায় নেই। সাধারণ পরীক্ষায় বা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে কোন ঔষধের সাধারণ বৈচিত্র্য বৈশিষ্ট্য বোঝা যায় কিন্তু মানুষের উপর কিভাবে তা প্রতিক্রিয়া করে তা জানবার জন্যে মানুষের উপরেই পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

পরীক্ষার প্রয়োজনের নিজেই সমস্ত ঔষধ খেতেন। তারপর পরিবারের লোকেদের উপর তা পরীক্ষা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন চিকিত্সক হিসাবে রোগীর কোন ক্ষতি করবার তার অধিকার নেই। এইভাবে একের পর এক ঔষধ পরীক্ষা করে যে জ্ঞান অর্জন করলেন তার ভিত্তিতে ১৮০৫ সালে লাটিন ভাষায় প্রকাশ করলেন Fragment-de viribus নামে ২৭টি ঔষধের বিবরণ সংক্রান্ত বই। এই বইটি প্রথম হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা বা ভেষজ লক্ষণ সংগ্রহ। চিকিৎসা জগতে মেটিরিয়া মেডিকার গুরুত্ব অপরিসীম।

এর পর থেকেই তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা আরম্ভ করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর পরিক্ষিত সত্যকে যতক্ষণ না রোগীর রোগ চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তা জনগণের কাজে ব্যবহার করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তা জনগণের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করতে সক্ষম হবে না। এই সময় তাকে রোগীর দেখাশুনা করা, চিঠিপত্র লেখা, গবেষণার কাজ, এছাড়া বই লেখার জন্যে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত।

প্রতিদিন ভোর ৬ টায় ঘুম থেকে উঠতেন। সকালের জলখাবার ছিল দু কাপ দুধ। তারপর কিছুক্ষণ বাগানে পায়চারি করে চেম্বারে চলে যেতেন। দুপুরবেলায় বাড়ি ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। তাঁর এই বিশ্রামের সময়টুকু কড়া পাহারায় রাখতেন মেয়েরা। সামান্য সময় পেলেই চিঠিপত্র লেখার কাজ শুরু করে দিতেন। অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার রুগী দেখার কাজ। সন্ধ্যে অবধি চলত তার রুগী দেখা।

তারপর এককাপ গরম দুধ আর রাতের খাওয়া খেয়ে চলে যেতেন পড়ার ঘরে। মধ্যরাত, কোন কোন সময় শেষরাত অবধি চলত তাঁর রোগের বিবরণ লেখা, চিঠিপত্র লেখা, বই লেখা।

অবশেষে ১৮১০ সালে প্রকাশিত হল অর্গানন অব মেডিসিন (Organon of Medicine)। এই অর্গাননকে বলা হয় হোমিওপ্যাথির বাইবেল। এতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির নীতি ও বিধান সমূহের বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আর অকাট্য যুক্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন তার প্রতিটি অভিমত। এতে হোমিওপ্যাথিক মূল নীতির আলোচনা ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসা প্রণালীর সাথে আলোচনা করে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এছাড়াও সে যুগে চিকিৎসার নামে যে ধরনের অমানুষিক কার্যকলাপ প্রচলিত ছিল তার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করলেন।

অর্গাননের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮১০ সালে। এই বই প্রকাশের সাথে সাথে সমালোচনা আর বিতর্কের ঝড় বইতে থাকে। তার উপর শুরু হল নির্যাতন। হ্যানিম্যান জানতেন যারাই নতুন কিছুর আবিষ্কারক তাঁদের সকলকেই এই ধরনের অত্যাচার সইতে হয়। এই ব্যাপারে তিনি প্রথম ব্যক্তি নন, শেষ ব্যক্তিও নন। নিজের উপর তার এতখানি আত্মবিশ্বান ছিল তাই ১৮১৯ সালে যখন অর্গাননের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, বইয়ের প্রথমে তিনি লিখলেন Aude sapere-এর অর্থ আমি নিজেকে বুদ্ধিমান বলে ঘোষণা করছি। এইভাবে তিনি তৎকালীন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে তীব্র ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপ ফেটে পড়লেন। হ্যানিম্যানের জীবনকালে এর পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রতিটি সংস্করণেই তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত থেকে উন্নততর রূপে বর্ণনা করেছেন।

১৮১০ সালে অর্গানন প্রকাশের সাথে সাথে হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে একাধিক রচনা প্রকাশিত হল। হ্যানিম্যানের ছয়জন ছাত্রের বিরুদ্ধে বেআইনি ঔষধ তৈরি ও বিতরণের অভিযোগ আনা হল। একজন ছাত্রকে জেলে পোরা হল, তার সমস্ত ঔষধ আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলা হল।

লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক হ্যানিম্যানের চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগের একাংশ এই কাজে প্রবল বাধা সৃষ্টি করল। কিন্তু তাদের বাধাদান সত্ত্বেও হ্যানিম্যানকে বক্তৃতা দেবার জন্যে অনুমতি দেওয়া হল।

তাঁর এই বক্তৃতা শোনবার জন্য দলে দলে ছাত্ররা এসে ভিড় করল। সকলেই হ্যানিম্যানের নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানতে উৎসাহী, কৌতূহলী। তখন হ্যানিম্যান প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় পৌঁছে গিয়েছেন, তবুও তরুণ অধ্যাপকদের মত তেজদীপ্ত বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে হোমিওপ্যাথিক তত্ত্বের বর্ণনা করতেন। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে কেউই তার অভিমতকে গ্রহণ করতে পারল না। কারণ তাদের মধ্যে প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে নতুন কিছুকে গ্রহণ করবার মত মানসিকতা সৃষ্টি হয়নি। তা সত্ত্বেও সামান্য কয়েকজন ছাত্রকে শিষ্য হিসাবে পেলেন যারা উত্তরকালে তার নব চিকিৎসা ব্যবস্থার ধারক-বাহক হয়ে উঠেছিল। এই সময় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তাদের মধ্যে বহু সংখ্যক সৈন্য টাইফাস রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কোন চিকিৎসাতেই তাদের রোগের প্রকোপ,হাস না পাওয়ায় হ্যানিম্যানকে চিকিৎসার জন্যে ডাকা হয়। তিনি বিরাট সংখক সৈন্যকে অল্পদিনের মধ্যেই সুস্থ করে তোলেন। এতে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ Schwarzenberg পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ্যালোপাথি চিকিৎসায় কোন উপকার না পেয়ে হ্যানিম্যানের চিকিৎসা জগতে সুনামের কথা শুনে তাকে চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ করলেন। হ্যানিম্যানের চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ করলেন। হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় অল্পদিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। সামান্য সুস্থ হতেই হ্যানিম্যানের নির্দেশ অমান্য করে মদ্যপান করতে আরম্ভ করলেন। এতে হ্যানিম্যান ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন এবং যুবরাজের চিকিৎসার জন্য আর তার প্রাসাদে গেলেন না। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই যুবরাজ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।

এই ঘটনায় অস্ট্রিয়ানদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হল। এ্যালোপাথিক চিকিৎসকরা এই সুযোগে হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শুরু করল এবং যুবরাজের মৃত্যুর জন্য সরাসরি হ্যানিম্যানকে দায়ী করল। জার্মান সরকার হ্যানিম্যানের ঔষধ তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল।

১৮২০ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি হ্যানিম্যানকে আদালতে উপস্থিত হতে হল। আদালত তাঁর সমস্ত ঔষধ তৈরি এবং বিতরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। কারণ হিসাবে বলা হল এই ঔষধ মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর।

হ্যানিম্যান এর জবাবে শুধু বললেন, ভবিষ্যই এর সঠিক বিচার করবে।

সম্মিলিতভাবে চিকিৎসকরা তার বিরোধিতা করতে আরম্ভ করল। তাঁকে লিপজিগ: থেকে বহিষ্কারের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠল। হ্যানিম্যান বুঝতে পারলেন আর তার পক্ষে লিপজিগে থাকা সম্ভব নয়। তিনি নিরুপায় হয়ে ১৮২১ সালের জুন মাসে লিপজিগ ত্যাগ করে কিথেন শহরে এসে বাসা করলেন।

হ্যানিম্যানের জীবনের এই পর্যায়ে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পালভাঙা নৌকার মত। সংসারে চরম অভাব। চারদিকে বিদ্বেষ আর ঘৃণা। প্রতি পদক্ষেপে মানুষের অসহযোগিতা আর বিরুদ্ধাচারণ।

এই প্রতিকূলতার মধ্যেও হ্যানিম্যান ছিলেন অটল, নিজের সংকল্পে পর্বতের মত দৃঢ়। অসাধারণ ছিল তাঁর মহত্ত্বতা। যে চিকিৎসকরা নিয়ত তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করত তাদের বিরুদ্ধেও কখনো কোন ঘৃণা প্রকাশ করেননি। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন “চিকিৎসকরা আমার ভাই, তাদের কারোর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই।” আরেকটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন “সত্যের বিরুদ্ধে এই নির্লজ্জ প্রচার মানুষের অজ্ঞাতারই প্রকাশ। এর দ্বারা হোমিওপ্যাথিক অগ্রগতি রোধ করা সম্ভব নয়।

হোমিওপ্যাথির এই দুর্দিনে হ্যানিম্যানের পাশে এসে দাঁড়ালেন কিথেন শহরের ডিউক ফার্দিনান্দ। তিনি কিথেন শহরে শুধু বাস করবার অনুমতি নয়, চিকিৎসা করবারও অনুমতি দিলেন। হ্যানিম্যান তাঁর ঔষধ প্রস্তুত ও চিকিৎসা করবার অনুমতির জন্য যখন ডিউকের কাছে আবেদন করলেন, সেই আবেদন পরীক্ষার ভার পড়ল আদম মূলারের উপর। হ্যানিম্যানের সাথে সাক্ষাতের অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন মূলার। “এই লাঞ্ছিত অপমানিত মানুষটিকে দেখে চোখে জল এসে গেল। এই মানুষটির দুঃখে আমার হৃদয় বেদনার্ত হয়ে উঠল। উপলব্ধি করতে পারছিলাম আমার সামনে বসে আছে এই শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিক, ভবিষ্যৎ কালই যার আবিষ্কারের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারবে।”

ডিউক ফার্দিনান্দও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন হ্যানিম্যানের প্রতিভা। তিনি তাঁকে ওষুধ প্রস্তুত করবার অনুমতি দিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে রাজসভার চিকিৎসক হিসাবে মনোনীত করলেন।

১৮২২ সালে হ্যানিম্যান প্রকাশ করলেন প্রথম হোমিওপ্যাথিক পত্রিকা। এর কয়েক বছর পর হ্যানিম্যান প্রকাশ করলেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা Chronic disease: Their nature and Homoeopathic treatment অর্থাৎ পুরাতন রোগের চিকিৎসা সম্বন্ধীয় পুস্তক। চিকিৎসা জগতে এ এক যুগান্তকারী সংযোজন। পুরনো রোগের চিকিৎসা সম্বন্ধে এমন বই ইতিপূর্বে কোথাও রচিত হয়নি। তিনি বললেন, সোরা (Psory), সিফিলিশ (Syphislis) ও সাইকোসিস (Sycosis) মানবদেহের সর্ব রোগের কারণ। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকারক শক্তি হল সোরা।

তাঁর অভিমতের বিরুদ্ধে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হল। এমনকি হ্যানিম্যানের কিছু ছাত্র অনুগামীও তাঁর মতের বিরুদ্ধচারণ করে তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কে ছিন্ন করল। তা সত্ত্বেও বহু চিকিত্সক অনুভব করতে পারলেন হ্যানিম্যানের রচনার গুরুত্ব। কয়েকজন বিখ্যাত এলোপ্যাথিক চিকিৎসক হোমিওপ্যাথিক শিক্ষার জন্য হ্যানিম্যানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। আমেরিকা থেকে এলেন ডাঃ কন্সটেন্টাইন হেরিং, ইংলন্ড থেকে এলেন ডাক্তার কুইন। এঁরা সকলেই নিজের দেশে হোমিওপ্যাথির প্রচার-প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।

১৮৩০ সাল হ্যানিম্যানের স্ত্রী হেনরিয়েটা ৬৭ বছর বয়েসে মারা গেলেন। তিনি ১১টি সন্তানের জননী। সমস্ত জীবন হ্যানিম্যানের পাশে ছিলেন তার যোগ্য সহধর্মিণী। বাইবেল প্রতিকূলতার মাঝে হ্যানিম্যান যখন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন সংসার জীবনে তখন অফুরন্ত শক্তি সাহস ভালবাসায় পূর্ণ করে দিয়েছিলেন হেনরিয়েটা। হ্যানিম্যানের জীবনের অন্ধকারময় দিনগুলোতে হেনরিয়েটা ছিলেন তাঁর চলার সঙ্গী। হ্যানিম্যানের জীবনে যখন অন্ধকার দূর হয়ে আলোর আভা ফুটে উঠছিল, হেনরিয়েটা তখন চির অন্ধকারের জগতে হারিয়ে গেলেন।

স্ত্রী অভাব, কন্যাদের ভালবাসা আর যত্নে ভুলে গেলেন হ্যানিম্যান। হ্যানিম্যানের খ্যাতি প্রতিপত্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। রোগী দেখে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। এই সময় হ্যানিম্যানের জীবনে এল নতুন বসন্ত। তিনি তখন ৮০ বছরের বৃদ্ধ।

১৮৩৪ সালের ৮ অক্টোবর এক সুন্দরী যুবতী মাদাম মেলানি চর্মরোগের চিকিৎসার জন্য হ্যানিম্যানের কাছে এলেন। মেলালি ছিলেন ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও তৎকালীন আইনমন্ত্রীর পালিতা কন্যা। হ্যানিম্যানের সাথে সাক্ষাতের সময় তার বয়স ৩৫ বছর। মেলালি ছিলেন শিল্পী কবি। বয়েসের বিরাট ব্যবধান থাকা হয়ে গেল। মেলানি হ্যানিম্যানকে ফ্যান্সে নিয়ে গেলেন। সরকারিভাবে তাঁকে ডাক্তারি করবার অনুমতি দেওয়া হল।

জীবনের অন্তিমপর্বে এসে হ্যানিম্যান পেলেন জীবনব্যাপী সংগ্রামের পুরস্কার, খ্যাতি, সম্মান, যশ, সুনাম, আরাম, অর্থ, সাংসারিক সুখ।

ক্রমশই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। হ্যানিম্যানের জীবনকালেই ছয়টি হোমিওপ্যাথিক কলেজ গড়ে উঠেছিল। তার কয়েকজন ছাত্র প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হিসাবে সুনাম অর্জন করলেন।

৮৮ বছরে পা দিলেন হ্যানিম্যান। দেহের শক্তি কমে এসেছিল। কিন্তু মনের শক্তি এতটুকু হ্রাস পায়নি। সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, অবশেষে ১৮৪৩ সালের ২ জুলাই শেষরাতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন হোমিওপ্যাথিক জনক মহাত্মা হ্যানিম্যান।

সমস্ত জীবন হ্যানিম্যান নিজেকে মানব কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে ব্যাধির অভিশাপ থেকে মুক্ত করাই একজন চিকিৎসকের মহত্তম কর্তব্য। সেই কর্তব্য পথ থেকে কখনো তিনি নিজেকে বিচ্যুত করেননি।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সরল সাদাসিধা। কোন আড়ম্বর বিলাসিতা ছিল না তাঁর। তিনি বলতেন প্রকৃত মানবপ্রেমী কখনো নিজেকে প্রচার করে না। যদি অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয় তোমার পথই শ্রেষ্ঠ তবে তা মানব কল্যাণে নিয়োজিত কর আর সব খ্যাতি অর্পণ কর ঈশ্বরকে।

তিনি বিশ্বাস করতেন সব কল্যাণ সৎ মহত্ত্বতার মধ্যে ঈশ্বরের স্পর্শ আছে। তিনি জীবনের বৃহত্তর অংশ অতিবাহিত করেছেন অন্যের নিন্দা সমালোচনা শুনে, প্রতি পদক্ষেপ তাঁকে সইতে হয়েছে নির্যাতন, অপবাদ, মানুষ তাঁকে বারংবার ঘরছাড়া করেছে। সমস্ত জীবনে তিনি ৩৬ বার বাসা পরিবর্তন করেছেন। এমন বহু দিন গিয়েছে, জল ছাড়া কোন খাবার জোটেনি। সাবানের অভাবে আলু দিয়ে জামা-কাপড় পরিষ্কার করেছেন। কনকনে শীতের রাতে ঘরে আগুন জ্বালাবার মত একটুকরা কাঠ পাননি। একটা পাউরুটি দশ টুকরো করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিতরণ করেছেন তবুও তিনি কখনো ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীকে বলেছেন, আমি মানুষের জন্য যা কিছু করেছি সব ঈশ্বরের করুণা আর শক্তিতে। তাই সব কিছুর জন্যেই আমি তার কাছে ঋণী।

এই ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস। তাই মৃত্যুর পূর্বে নিজের সম্বন্ধে শেষ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, আমার জীবন ব্যর্থ হয়নি।

যথার্থই তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ সফলতা আর পূর্ণতার। সেই কারণেই তাঁর শিষ্য ব্রেডফোর্ড গুরুর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে লিখেছিলেন, তিনি ছিলেন এমন একজন বিদ্বান যাকে বিদগ্ধ জগৎ সমাদৃত করেছে। এমন একজন রসায়বিদ যিনি রসায়ন বিশেষজ্ঞদের শিক্ষা দিতেন। বহু ভাষায় এমন এক পণ্ডিত যাঁর অভিমতকে ভাষাতত্ত্ববিদরা খণ্ডন করতে সাহস পেত না। একজন দার্শনিক যার দৃঢ় মতবাদ থেকে কেউ বিচ্যুত করতে পারেনি।

সকল অধ্যায়

১. ১. বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) (৫৭০-৬৩২ খ্রি:)
২. ২. হযরত ঈসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ৬-৩০)
৩. ৩. হযরত মুসা (খ্রীষ্ট পূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী)
৪. ৪. ইমাম আবু হানিফা (রঃ) (৭০২–৭৭২ খ্রি:)
৫. ৫. জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৩ খ্রি:)
৬. ৬. ইমাম বোখারী (রঃ) (৮১০-৮৭০ খ্রি:)
৭. ৭. আল বাত্তানী (৮৫৮–৯২৯ খ্রি:)
৮. ৮. আল ফারাবী (৮৭০-৯৬৬ খ্রি:)
৯. ৯. মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪১–১০২০ খ্রি:)
১০. ১০. আল বেরুনী (৯৭৩–১০৪৮ খ্রি:)
১১. ১১. ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি:)
১২. ১২. ওমর খৈয়াম (১০৪৪-১১২৩ খ্রি:)
১৩. ১৩. ইমাম গাজ্জালী (রঃ) (১০৫৮–১১১১ খ্রি:)
১৪. ১৪. ইবনে রুশদ (১১২৬১১৯৯ খ্রি:)
১৫. ১৫. আল্লামা শেখ সা’দী (রঃ) (১১৭৫–১২৯৫ খ্রি:)
১৬. ১৬. মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রঃ) (১২০৭-১২৭৩ খ্রি:)
১৭. ১৭. ইবনুন নাফিস (১২০৮-১২৮৮ খ্রি:)
১৮. ১৮. ইবনে খালদুন (১৩২২–১৪০৬ খ্রীঃ)
১৯. ১৯. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রীঃ)
২০. ২০. মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)
২১. ২১. গৌতম বুদ্ধ (খ্রি: পূ: ৫৬৩ খ্রি: পূ: ৪৮৩)
২২. ২২. শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৩৩-১৮৮৬)
২৩. ২৩. শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩)
২৪. ২৪. স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)
২৫. ২৫. যোহান উলফগ্যঙ ভন গ্যেটে (১৭৪৯–১৮৩২)
২৬. ২৬. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১-১৯৫৫)
২৭. ২৭. ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২)
২৮. ২৮. ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়ভস্কি (১৮২১-১৮৮১)
২৯. ২৯. আলেকজান্ডার দি গ্রেট (৩৫৬ খ্রিস্ট পূর্ব-৩২৩ খ্রিস্ট পূর্ব)
৩০. ৩০. লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)
৩১. ৩১. মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬)
৩২. ৩২. কনফুসিয়াস (খ্রি: পূর্ব ৫৫১ খ্রি: পূর্ব ৪৭৯)
৩৩. ৩৩. বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
৩৪. ৩৪. পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩)
৩৫. ৩৫. ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬)
৩৬. ৩৬. হেলেন কেলার (১৮৮০-১৯৬৮)
৩৭. ৩৭. বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬-১৭৯০)
৩৮. ৩৮. কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)
৩৯. ৩৯. হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩)
৪০. ৪০. ত্যাগরাজ (১৭৬৭–১৮৪৭)
৪১. ৪১. নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১)
৪২. ৪২. ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫)
৪৩. ৪৩. পার্সি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)
৪৪. ৪৪. জোহন কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)
৪৫. ৪৫. জোহান্স গুটেনবার্গ (১৪০০–১৪৬৮)
৪৬. ৪৬ জুলিয়াস সিজার (খ্রি: পূ: ১০০খ্রি: পূ: ৪৪)
৪৭. ৪৭. গুলিয়েলমো মার্কোনি (১৮৭৪-১৯৩৭)
৪৮. ৪৮. রাণী এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩)
৪৯. ৪৯. জোসেফ স্টালিন (১৮৮২-১৯৫৩)
৫০. ৫০. ফ্রান্সিস বেকন (খ্রি: ১৫৬১ খ্রি: ১৬২৬)
৫১. ৫১. জেমস ওয়াট (১৭৩৬-১৮১৯)
৫২. ৫২. চেঙ্গিস খান (১১৬২–১২২৭)
৫৩. ৫৩. এডলফ হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫)
৫৪. ৫৪. লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)
৫৫. ৫৫. অশোক (আনুমানিক খ্রি: পূ: ৩০০–২৩২ খ্রি: পূর্ব)
৫৬. ৫৬. সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)
৫৭. ৫৭. আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল (১৮৪৭-১৯২২)
৫৮. ৫৮. যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ (১৬৮৫–১৭৫০)
৫৯. ৫৯. জন. এফ. কেনেডি (১৯১৭-১৯৬৩)
৬০. ৬০. গ্যালিলিও গ্যালিলাই (১৫৬৪-১৬৪২)
৬১. ৬১. হো চি মিন (১৮৯০–১৯৬৯)
৬২. ৬২. মহাত্মা গান্ধীজী (১৮৬৯-১৯৪৮)
৬৩. ৬৩. লেভ তলস্তয় (১৮২৮–১৯১০)
৬৪. ৬৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
৬৫. ৬৫. হিপোক্রেটস (৪৬০-৩৭০)
৬৬. ৬৬. জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮–১৯৩৭)
৬৭. ৬৭. আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫)
৬৮. ৬৮. উইলিয়ম শেকস্‌পীয়র (১৫৬৪-১৬১৬)
৬৯. ৬৯. জন মিলটন (১৬০৮–১৬৭৪)
৭০. ৭০. সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূ:)
৭১. ৭১. জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯)
৭২. ৭২. উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭)
৭৩. ৭৩. পিথাগোরাস (৫৮০–৫০০)
৭৪. ৭৪. ডেভিড লিভিংস্টোন (১৮১৩-১৮৭৩)
৭৫. ৭৫. লুই পাস্তুর (১৮২২-১৮৯৫)
৭৬. ৭৬. নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)
৭৭. ৭৭. এন্টনি লরেন্ট ল্যাভোশিঁয়ে (১৭৪৩-১৭৯৪)
৭৮. ৭৮. এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯–১৮২৩)
৭৯. ৭৯. ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল (১৮২০-১৯১০)
৮০. ৮০. হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬)
৮১. ৮১. টমাস আলভা এডিসন (১৮৪৭-১৯৩১)
৮২. ৮২. জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৬৫-১৯৫০)
৮৩. ৮৩. মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯–১৯৬৮)
৮৪. ৮৪. সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২)
৮৫. ৮৫. রম্যাঁ রোলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪)
৮৬. ৮৬. পাবলো নেরুদা (১৯০৪–১৯৭৩)
৮৭. ৮৭. আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২খৃ. অব্দ)
৮৮. ৮৮. অ্যারিস্টটল (৩৮৫-৩২২খৃ. পূ.)
৮৯. ৮৯. মেরি কুরি (১৮৬৭-১৯৩৪)
৯০. ৯০. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-১৮৭৯)
৯১. ৯১. চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)
৯২. ৯২. উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট (১৮৭১-১৯৪৮) (১৮৬৭-১৯১২)
৯৩. ৯৩. চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)
৯৪. ৯৪. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)
৯৫. ৯৫. ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩২)
৯৬. ৯৬. আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫)
৯৭. ৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)
৯৮. ৯৮. প্লেটো (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭-খ্রীস্টপূর্ব ৩৪)
৯৯. ৯৯. মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪)
১০০. ১০০. স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন