পটমঞ্জরী – ১

অভীক সরকার

৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ৷ ইয়েদং উপত্যকা, দক্ষিণ তিব্বত৷

.

প্রবল তুষারঝড় চলছিল ইয়েদং উপত্যকা জুড়ে৷ তারই মধ্যে একটি মোটা কাপড়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঢেকে বরফে ঢাকা পাহাড়ি পথ পেরোবার চেষ্টা করছিলেন এক বৌদ্ধ শ্রমণ। সামনেই শিগাৎসে গ্রাম, রাত হওয়ার আগেই সেখানে পৌঁছতে হবে তাঁদের৷ তাঁদের বলতে তিনি, কামরূপ থেকে আসা গুপ্তপুরুষটি, আর একান্ত অনুগত শিষ্য সাংতোই নংগুয়াল কাগয়ু—নামান্তরে ‘কমলবুদ্ধি।’

কমলবুদ্ধির ওপর অগাধ আস্থা বৌদ্ধ শ্রমণের। এই অঞ্চলে এমন ধীমান এবং অনুগত শিষ্য পাওয়া বড়ই কঠিন৷ তাঁর প্রিয়তম ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম এই যুবক ইতিমধ্যেই নাগার্জুনের মূলমাধ্যমকারিকা থেকে শুরু করে শ্রুতমুচ্চয় অবধি কণ্ঠস্থ করে ফেলেছে৷ প্রতীত্যসমুৎপাদ নিয়ে এই তরুণ যুবকের আলোচনা শুনে সম্রাট মে অগছোম-এর রাজসভার অনেক চৈনিক পণ্ডিতের মুখ শুকিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। কিশোর রাজপুত্র ঠ্রিসং দেচেন সবার আড়ালে তাঁকে জানিয়েছেন—কমলবুদ্ধিকে নিয়ে অনেক আশা তাঁর।

চলতে চলতে ক্ষণিক থেমে গিয়ে পরম কারুণিক তথাগতের উদ্দেশে প্রণাম জানান তিনি। এই রুক্ষ পাহাড়ি দেশে আরও অনেক কমলবুদ্ধিকে চাই তাঁর। এদের মতো তথাগতপ্রাণ যুবকদের জন্যেই একদিন এই তিব্বতদেশে সদ্ধর্মের পতাকা উড়বেই উড়বে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই আচার্য শান্তরক্ষিত এই দেশে উপস্থিত হবেন, সেইরকমই কথা হয়ে আছে। একবার আসুন আচার্য, তারপর চীনাগত কুলাঙ্গার বৌদ্ধপণ্ডিতদের দেখে নেবেন! এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই এই দেশে এসেছেন এই বৌদ্ধ শ্রমণ৷ মহাযানপন্থার জয় হোক। গৌড়বঙ্গের জয় হোক। তিব্বতে ছড়িয়ে পড়ুক নালন্দার জ্ঞান, মেধা ও করুণার আনন্দরশ্মি।

গৌড়বঙ্গের কথা মনে পড়তেই তাঁর বক্ষের বামদিকটা সামান্য চিনচিন করে উঠল৷ তাঁর শৈশবের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বঙ্গদেশ, কৈশোরের শুভ্রজ্যোৎস্নাপুলকিত বঙ্গভূমি, তাঁর প্রথম যৌবনের ফুল্লকুসুমিত স্বদেশ। আজও, পরবাসে এতগুলো বছর কাটাবার পরেও, সেই কয়েকশো ক্রোশ দূরের শ্যামলবরণী কন্যাটির জন্যে তাঁর বড় মন কেমন করে।

আবার হাঁটা শুরু করার আগে পিছন ফিরে দেখে নিলেন তিনি৷ ওরা কেউ পিছু নেয়নি তো? একবার যদি ধরা পড়ে যান, তাহলে সমূহ সর্বনাশ হয়ে যাবে৷

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শ্রমণ। ভালো নেই তাঁর দেশ। আচার্য শান্তরক্ষিতের আদেশে যখন চলে আসেন এই প্রবাসে, তখনই তিনি দেখে এসেছেন—তীব্র অরাজকতা আর অপশাসনের কালো ছায়া ঘিরে ধরেছে তাঁর জন্মভূমিকে। এক উন্মাদ কামুক রানির অপশাসনে ছারেখারে গেছে সোনার বঙ্গদেশ৷ সর্বত্র ছোট ছোট ভূস্বামীরা নিজেরাই রাজা হয়ে বসেছেন, ন্যায়বিচার বলে আর কিছুই নেই দেশে৷ যে অঞ্চলে যার প্রতাপ বেশি, সে-ই রাজা৷ ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র, শ্রমণ থেকে গৃহী, কৃষক থেকে কুম্ভকার, তন্তুবায় থেকে জালিক, এই অরাজকতার করাল গ্রাস থেকে কেউ অব্যাহতি পায়নি৷ সামন্ত ও ভূস্বামীদের অত্যাচারে আর দরিদ্রের হাহাকারে আজ হিমালয়ের পাদদেশ থেকে পূর্ব-সমুদ্রের সুনীল জলধি অবধি প্রতিটি ভূমিকণা কম্পমান৷

হায় শশাঙ্ক, মহাসামন্ত শশাঙ্ক! পথ চলতে চলতে থেমে গিয়ে নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন শ্রমণ—যতদিন আপনি জীবিত ছিলেন—কোনও লুব্ধ কুলাঙ্গারের স্পর্ধা হয়নি এই সুরম্য স্বর্ণপ্রসূ দেশের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাবার। আপনি শৈব ছিলেন সত্য, বৌদ্ধদের প্রতি রাজনৈতিক কারণে বিদ্বিষ্ট ছিলেন—সে-কথাও মিথ্যা নয়। কিন্তু দেশে সুখ ছিল, সমৃদ্ধি ছিল, ন্যায়বিচার ছিল৷ এইরকম সর্বগ্রাসী, সর্বভুক, সর্ববিধ্বংসী অনাচার আর অরাজক অন্যায় নেমে আসেনি কারও ওপরেই।

যেদিন মহাবল শশাঙ্ক ত্যাগ করলেন তাঁর শেষ নিঃশ্বাস, সেইদিন থেকে গৌড়বঙ্গের পরিস্থিতি গভীর অরণ্যের মধ্যে বেপথুমতী অসহায়া কূলবধুর মতো৷ কখনও কনৌজপতি যশোবর্মা, কখনও কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য, কখনও কামরূপনরেশ ভাস্কর বর্মা—যে নৃশংসতার সঙ্গে এঁরা শোষণ ও লুণ্ঠন চালিয়ে গেছেন এই বঙ্গভূমে, তার কোনও তুলনাই হয় না৷

চলতে চলতে ক্ষণেক তিনি তাকালেন সামনের দিকে। তুষারঝড় ক্রমেই বেড়ে চলেছে, চতুর্দিকে দামাল হাওয়ার অবিরল মাতামাতি, শোঁ-শোঁ শব্দে কান পাতা দায়। এমন ঝড়ে এখানকার অধিবাসীরাও সচরাচর বাইরে বের হয় না। একদিক দিয়ে ভালোই, মনে মনে ভাবলেন তিনি। যে নিভৃত গোপন কাজে চলেছেন তিনি, তার জন্যে এইরকম ভীষণ প্রকৃতিই তাঁর চাই৷

চলতে চলতে ভাবছিলেন বৌদ্ধ শ্রমণটি। এখন এই দেশের রাজপ্রাসাদের মধ্যে যে ঝঞ্ঝা চলছে, সেও কি এই তুষারঝড়ের মতোই তীব্র নয়? যে লড়াই আসলে ছিল রাজসিংহাসনের অধিকার নিয়ে দুই রাজমহিষীর মধ্যে পারিবারিক বিবাদ, ধীরে ধীরে রাজনীতির জটিল আবর্তে জড়িয়ে তাই-ই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে চৈনিক বৌদ্ধ বা ‘তোনমুনপা’ আর ভারতীয় বৌদ্ধ বা ‘শ্চেনমিনপা’-র মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। দু’পক্ষই শ্বাস বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত চেপে দেখে যাচ্ছে—শেষ পর্যন্ত কে জেতে৷ শেষ পর্যন্ত কার স্বার্থ দেখবেন সম্রাট—মহাচীনের, নাকি লিচ্ছবী তথা ভারতভূমির?

সদ্ধর্মের আগমনের পূর্বে এই দেশের ধর্ম ছিল পোন ধর্ম। অবাধ যৌনাচার, নরবলি, অসভ্য ও কুৎসিত নাচগান—এই ছিল এদের ধর্মকৃত্য। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এদেশের সম্রাট মহামতি স্রোংচান গাম্পো সদ্ধর্মের সংস্পর্শে আসেন, বুদ্ধচরণে তাঁর মতি হয়। তাঁর দুই মহিষী, একজন মহাচীনের তাং রাজবংশের কন্যা রাজকুমারী ওয়েনচেং, আরেকজন লিচ্ছবী রাজদুহিতা রাজকন্যা ভ্রুকুটি৷ তাঁরাই বৌদ্ধধর্মকে ছড়িয়ে দেন এদেশের জনসাধারণের মধ্যে। তার কিছুদিন পর থেকেই দুই মহিষীর মধ্যে শুরু হয় অলক্ষ্য সংঘর্ষ। সেই সংঘাত একশো বছর পর এখন দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় গৃহযুদ্ধের রূপ নিয়েছে।

এই ধর্মীয় বিরোধ নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন না শ্রমণ। তাঁর মেধা ও পাণ্ডিত্যের প্রতি সম্রাট এবং যুবরাজ—দুজনেই যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। যুবরাজের সঙ্গেই তাঁর অধিকতর সখ্য যদিও, বোধহয় বয়সের ব্যবধান অনেকটা কম হওয়ার কারণেই। দিনের বেশ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটান তাঁরা, আলোচনা হয় বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে। যুবরাজের ইচ্ছা—এই দেশে নালন্দার আদলে একটি বৌদ্ধবিহার গড়ে তুলবেন৷ সেখানে বৌদ্ধশাস্ত্রগুলির যথাযথ অনুবাদের এবং সেই নিয়ে অধ্যয়ন ও আলোচনার সুব্যবস্থা থাকবে। তাঁরা দুজনে মিলে সেই পরিকল্পনার পথে অনেক এগিয়েও গিয়েছেন৷ যুবরাজের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে যাবে, এতটা ভাবার কোনও কারণই নেই। জাল ছড়াচ্ছে তারা, গোপন সূত্রে এ খবরও তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে। তবে তা নিয়ে বিশেষ ভাবেন না তিনি। তাঁর চিন্তা অন্য দিক থেকে।

কালই তাঁর কাছে খবর এসেছে যে, পোন ধর্মের মুখ্যপুরুষ প্রধানমন্ত্রী মাশাং—তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে পোন গুপ্তবাহিনীর গোপন গুহায় চুরি হওয়ার খবর৷ ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা৷ তাঁদের বেরোনোর কথা ছিল সন্ধের মুখে৷ কিন্তু এই খবর শোনামাত্র আর দেরি করেননি শ্রমণ, কমলবুদ্ধিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি৷

সর্বপ্রকার কদর্য আর বীভৎস কাজে সিদ্ধহস্ত এই পোন ধর্মের পুরোহিতরা৷ নরবলি, প্রকাশ্যে অবাধ যৌনতা, মাংসভক্ষণ ও মদ্যপান, এদের মুখ্য পূজার্চনা৷ শুধু তাই নয়, এদের আরাধ্য দেবদেবীদের মূর্তিও অতি ভয়ঙ্কর ও বীভৎস, পৃথিবীর যাবতীয় যক্ষ রক্ষ ভূত প্রেত এদের উপাস্য৷ যাদুবিদ্যা, অভিচার ক্রিয়া, প্রেত আরাধনা—এসব নিয়েই তৈরি এদের ধর্মাচরণ৷

জাদুবিদ্যায় এদের পারদর্শী হওয়ার কারণও আছে৷ বহু বছর ধরে এই দেশের বিচিত্র অস্ত্রশস্ত্র আর ওষধির ভাণ্ডার বানিয়েছে তারা৷ সেসবের কার্যকলাপ দেখলে কোনও জাদুকরের রচিত ইন্দ্রজাল বলে ভ্রম হওয়া বিচিত্র নয়৷ হিমালয়ের গোপন গিরিকন্দর, গহীন অরণ্য আর অন্ধকার উপত্যকা থেকে তিলে তিলে তারা সংগ্রহ করেছে অতি আশ্চর্যজনক ও বিরলচরিত্রের বস্তু৷ লোকে বলে যে, এদের গোপন সংগ্রহে আছে গরলভৈরবের বীজ যা নাকি পৃথিবীর তীব্রতম বিষের থেকেও ভয়ঙ্কর, আছে নিষেকবজ্রের লতা, যা থেকে নাকি প্রস্তুত করা যায় অমৃততুল্য সঞ্জীবনী ঔষধ। আছে কৃষ্ণকন্টকের বাকল, যার অতি সামান্য অংশও মুখে রাখলে শীত বা গ্রীষ্মের বোধ লুপ্ত হয়। আর আছে এক অত্যাশ্চর্য মৃগনাভির সম্ভার, যার গন্ধে নিতান্ত মরণাপন্ন রোগীর দেহেও প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব।

আর আছে চণ্ডবজ্র। পোনপুরোহিতদের গোপনতম, ভয়ঙ্করতম, অব্যর্থতম অস্ত্র। সাক্ষাৎ মৃত্যু।

তাই-ই চাই শ্রমণের৷ যে মৃত্যুবিষ একদিন এই তিব্বত থেকে পাড়ি দিয়ে ছারখার করে দিয়েছে তাঁর জন্মভূমি, তারই প্রতিষেধক নিয়ে আজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন তিনি৷ তাঁর মুখ চেয়ে অপেক্ষা করছেন আচার্য শান্তরক্ষিত, অপেক্ষা করছেন তাঁদের সঙ্গীরা, অপেক্ষা করছেন লোকেশ্বর স্বয়ং! দেশের খবর অতি গোপনে নিয়মিতই পৌঁছে দেওয়া হয় তাঁর কাছে৷ পৌঁছে যায় আচার্যের আদেশও৷

হাত দিয়ে একবার দেহের অংশটা দেখে নিলেন৷ নাহ, বটুয়াটি ঠিক জায়গাতেই আছে।

রাজকুমার ঠ্রিসং দেৎসেন তাঁকে একটি দীর্ঘ পত্রও দিয়েছেন। বলেছেন এটি লোকেশ্বর ব্যতীত আর কারও হাতে না দিতে। অবশ্য এই সতর্কতার প্রয়োজন ছিল না। এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মন্ত্রগুপ্তির ব্যাপারে সম্যক অবগত আছেন কমলশীল।

ফের হাঁটতে থাকেন দুজনে। চারিদিক প্রায় অদৃশ্য। অবিরল তুষারপাতে তাঁদের চারপাশে নেমে এসেছে সাদা পর্দার মতো এক পুরু আবরণ, তার বাইরে দৃষ্টি চলে না। প্রতিটি পদক্ষেপ অতি কষ্টে ফেলতে হচ্ছে। সূচীমুখ তুষারকণাগুলি এসে শরীরের অনাবৃত অংশে তীরের মতো বিঁধছে। হাত দুটি তুলে একবার দেখলেন তিনি, নীল হয়ে এসেছে আঙুলগুলি। ক্রমশই বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে উঠছে৷

একবার থেমে গিয়ে পেছনে তাকান তিনি, ‘কমলবুদ্ধি, আর কতদূরে আছেন তোমার সেই গুপ্তপুরুষ?’

‘আর বেশি দূরে নয়, ভন্তে। সামনের গিরিখাতটি পেরিয়ে বামদিকে একটি বাঁক আছে। সেই পথে কিছুটা নীচে নামলেই একটি গোপন গুহা, সেখানেই তাঁর অপেক্ষা করার কথা।’

‘এ বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত তুমি? সংবাদ যা পেয়েছ সব ঠিকঠাক? কোথাও আমাদের কোনও ত্রুটি হচ্ছে না তো?’

‘না ভন্তে। আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাবধানতা নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী মাশাং এ ব্যাপারে একেবারেই কিছু জানেন না। স্বয়ং সম্রাট আমাদের সহায়, তিনিই গোপনে চর পাঠিয়েছিলেন নালন্দা আর কামরূপে। আপনি তো জানেন, তিনিও যে-কোনও মূল্যে এই মন্ত্রী মাশাং আর পোন ধর্মের সামন্তদের দমন করতে চান৷’

‘তাঁর শাসন নিষ্কন্টক করতে গেলে এ ছাড়া আর উপায় কী কমলবুদ্ধি? আশা করি দ্রুত এ কাজে সফল হবেন তিনি৷ কিন্তু এই কাজে কারা কারা আছে, কোন কোন গুপ্তচরদের পাঠিয়েছি, সেসব গোপন করার ব্যবস্থা করেছ কি?’

অবশ্যই ভন্তে৷ আমি আর সম্রাট ছাড়া এঁদের পরিচয় আর কারও জানা নেই। আজকে যিনি এসেছেন আপনাকে নিরাপদে আপনার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, তিনি অতি বিশ্বস্ত পুরুষ৷ আচার্য শান্তরক্ষিত স্বয়ং তাঁকে এই কাজটির দায়িত্ব দিয়েছেন।’

‘কে ইনি? কিছু জানো তুমি কমলবুদ্ধি?’

‘শুনেছি কামরূপের ওড্ডীয়ান নগরের যুবরাজ। আপনি ওড্ডীয়ানের নাম শুনেছেন ভন্তে?’

শুনেছেন বইকি। এখানকার উচ্চারণে ওড্ডীয়ান হলেও এই রাজ্যের আসল নাম উদীয়ান। উদীয়ান হচ্ছে কামরূপের শ্রেষ্ঠতম তন্ত্রবেত্তা ইন্দ্রভূতির রাজ্য। যোগাচারবিজ্ঞানের অতুল বৈভব ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে সেখানে। মাথা তুলছে মহাযান বৌদ্ধধর্মের আরও একটি শাখা, মন্ত্রযান। রাজা ইন্দ্রভূতির সহোদরা লক্ষ্মীঙ্করা এবিষয়ে বিশেষ সিদ্ধি লাভ করেছেন বলে দেশে থাকতে থাকতেই সংবাদ পেয়েছিলেন তিনি। আচার্য শান্তরক্ষিত নিজে এবং তাঁর প্রিয় শিষ্যরাও এই নতুন সাধনপদ্ধতি নিয়ে খুবই উৎসাহী।

নালন্দার সহপাঠীদের কথা মনে পড়তে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল শ্রমণের। হরিভদ্র, শাক্যভদ্র, জ্ঞানপ্রভ…আহা—না জানি কেমন আছে তাঁর সতীর্থরা?

কমলবুদ্ধি তার এই শিক্ষকের মানসিক অবস্থা বুঝে উঠতে পারল না। সে বলে চলল, ‘শুনেছি ইনি নাকি অতুল যোগশক্তির অধিকারী। শিশুবয়স থেকেই অনেক আশ্চর্য কাহিনি ঘুরে বেড়ায় এঁকে নিয়ে। ইনি নাকি অযোনিজ স্বয়ম্ভূ পুরুষ, রাজা ইন্দ্রভূতির সামনে এক পদ্মের ওপর আবির্ভূত হয়েছিলেন। ইনি ধনুর্বাণে গাণ্ডীবধন্বা অর্জুনের সমকক্ষ, মল্লযুদ্ধে স্বয়ং বলরাম৷’

‘বলো কী হে?’

‘আজ্ঞে ভন্তে৷ তেরো বছর বয়স থেকেই ইনি তাঁর পিতাকেও রাজকার্যে সহায়তা করছেন। রাজা ইন্দ্রভূতি কোনও বিষয়ে যুবরাজের পরামর্শ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। লোকে তো এমনকি এও বলে যে, ইনি একবারমাত্র শ্বাস নিয়ে তিনবার পুরো ওড্ডীয়ান ঘুরে আসতে পারেন, ভূমিতে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ লাফিয়ে রাজপ্রাসাদের প্রাচীরের ওপরে উঠতে পারেন। দর্শন, শব্দবিদ্যা, ব্যাকরণাদি শাস্ত্র—সবই তাঁর অধিগত। এমনকী চিকিৎসাবিদ্যাতেও ইনি নাকি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী!’

শুনে চমৎকৃত হলেন শ্রমণ। যাক, উপযুক্ত লোকই বেছে নিয়েছেন আচার্য। তবুও আবছা সন্দেহ থেকে যায়!

‘ইনি যে অদ্ভুতকর্মা সে বুঝলাম৷ কিন্তু, ইনি বিশ্বস্ত তো? আমার দেশের ভবিষ্যৎ কিন্তু আজকে আমাদের হাতেই কমলবুদ্ধি৷ এই বটুয়াটির মধ্যেই আমাদের গোপন অভ্যুত্থানের প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে৷ আমার ফিরে যাওয়ার ওপরেই নির্ভর করছে তার সাফল্য৷’

‘হ্যাঁ ভন্তে। আপনি সর্বাংশে নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি জানি সেই উন্মাদ কামুক রানির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য…আঃ…’

কথা শেষ হওয়ার আগেই শ্রমণের কানের কাছে যেন একটি ছোটখাটো বিস্ফোরণ হল আর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল কমলবুদ্ধি। সেই শুনে পিছনে তাকাতেই পিছনের অবিরাম তুষারপাতের মধ্যে কয়েকটা ছায়া দেখতে পেলেন সেই বৌদ্ধ শ্রমণ৷ আতঙ্কের একটা ভয়াল স্রোত তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল।

তিনি জানেন ওরা কারা৷ তিনি জানেন ওরা কেন এসেছে৷

ওরা মাশাং-এর লোক!

.

অধ্যায় ১ / ২০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন