ইমানুল হক
ক।।
ইংরেজি ‘মিথ’ আর বাংলা ‘মিথ্যা’ শব্দের অদ্ভুত মিল আছে।
মিথ তো গড়ে ওঠে অল্প বিস্তর মিথ্যা এবং কল্পিত কাহিনির ওপর।
আবার এই মিথ্যা নির্মাণের পিছনে থাকে এক সচেতন প্রয়াস। কখনো কখনো ইতিহাসের অচেতন অস্ত্র হিসেবে তা প্রযুক্ত হয়। কিন্তু মিথ্যার নির্মাণ এক জাগতিক প্রক্রিয়া। সেই নির্মাণে থাকে অভিপ্রায়, বাসনা, বিদ্বেষ বা আত্মরক্ষার প্রাণপণ প্রয়াস।
‘মহাভারতে’ দ্রোণকে হত্যার জন্য যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, অশ্বত্থামা হত ইতি গজ। অশ্বত্থামা একটি হাতির নাম। আবার দ্রোণ পুত্রও অশ্বত্থামা। দ্রোণ হত্যার পর অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, অতি অল্পকাল রাজ্যভোগের জন্য আপনি এত বড় মহাপাপ করলেন!
মিথ্যা খারাপ, অর্ধসত্য ভয়ংকর। এই মহাসত্য যেন মনে করিয়ে দেয় অর্জুনের ভর্ৎসনা।
খ।।
মিথ্যার জন্মের পিছনে থাকে নানা কারণ। ভিন্ন ভিন্ন সে উচ্চারণ। তবে সবের পিছনে থাকে প্রয়োজন, উদ্দেশ্য, স্বার্থসিদ্ধি। অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্য মিথ্যার উচ্চারণে দোষ নেই—এমন কথা নানা ধর্মগ্রন্থেও আছে।
মিথ্যা পরিচালনা করে ভুলপথে। দায়হীন তার উচ্চারণ। মিথ্যার আরেক প্রতিশব্দ ‘মিছা’।
‘মিছা’ শব্দের অর্থ কলিম খান আর রবি চক্রবর্তীর বই অনুযায়ী—অকারণ, অনর্থক, অমূলক।
‘মিথ্যা’ শব্দের অর্থ—অলীক, ভ্রমমূলক, সব্যাজ, অসত্যপ্রতীয়মান, অধর্মপত্নী।
শেষ শব্দটি খুব মারাত্মক। যেন মিথ্যার সঙ্গে নারীর যোগ বেশি!
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, মিথ্যা মানে অলীক, অসত্য, ভ্রমমূলক, অসত্যপ্রতীয়মান, নিরর্থক, নিষ্ফল। (বঙ্গীয় শব্দকোষ, সাহিত্য অকাদেমি, পৃষ্ঠা-১৭৮৮)।
এখানেই আছে একটি শব্দবন্ধ ‘মিথ্যার জাহাজ’। মিথ্যা কমবেশি সবাইকে কোনো না কোনো সময় বলতে হয়েছে। সে ছেলেমেয়ে ভুলাতে হোক বা কারো মন জোগাতে বা নিরুপায় হয়ে।
‘মিথ্যা’র কতকগুলো চালু শব্দ আছে। হরিচরণ বা কলিম খান-রা যা লেখেননি।
ঢপ, ভাট, হ্যাজানো, গ্যাঁজা, গ্যাঁজানো, গুল, রং। পূর্ব বাংলায় ভুয়া। সাহিত্যের ভাষায় ‘আপন মনের মাধুরী’, ‘গুঞ্জরিত অলি’।
এছাড়া আছে কত পার্সেন্ট, কতটা জল, কত নম্বর ইত্যাদি।
—ঢপ দিও না গুরু, আর নিতে পারছি না।
—খুব ভাটাচ্ছিস, আর ভাটাস না।
—বকোয়াস বন্ধ কর।
—গুল মারছিস। গুলজারিলাল নন্দ ও এভাবে ভাবতেন না।
দেশের প্রাক্তন এক প্রধানমন্ত্রী ‘গুল’ দিতেন এমন কথা কেউ বলেননি, কিন্তু ‘গুলু’বাবু বা ‘গুলবদন’ বিবিদের জন্য বদনামের পাত্র হতে হচ্ছে তাঁদের। গুলবদন বেগম একজন ইতিহাসের চরিত্র। হুমায়ূনের বোন। মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের জীবনগাথার অনেক খানি আমরা জানতে বিদুষী গুলবদন বেগমের সৌজন্যে।
আর ‘রঙ চড়ানো’ তো খবরের কাগজের কল্যাণে কোনো বিষয়ই নয়। ‘আপন মনের মাধুরী’ মিশিয়ে সত্য বা অসত্যের নিয়ত নির্মাণ চলে প্রচার মাধ্যমে। চলে ‘গুঞ্জরিত অলি’র পক্ষ বিস্তার।
হিন্দি ‘বকোয়াস’ আজকাল বাংলা আড্ডায় চালু শব্দ। (আড্ডা কি আর তেমন আছে! পটলডাঙ্গার টেনিদারা পটল তুলেছেন রকের অবসানে এবং রক গানের রকম সকমে)।
আমাদের ছাত্র জীবনে, আশির দশকের শুরুতে, একজন ছিল যার নামই ছিল হ্যাজানোদা। মেয়েদের নয়নের মণি। একটু ‘ফপিস টাইপ’। সাজুগুজু বাইকবাবু। সে কথায় বলত, হেভ্ভি হাজিয়েছি।
পরে দেখলাম হাজানোটা হেভ্ভি চালু হয়ে গেছে।
এছাড়া কারো কথা বিশ্বাস না হলে বলা হতো বা হয়—কত পার্সেন্ট দিলি?
কিংবা—ওর কথা ৫০০% জল বাদ দিয়ে শুনবেন।
‘জল’ মিথ্যার এক অসামান্য প্রতিশব্দ। ‘রঙিন জল’ মদ। কিন্তু যদি বলা হয়, জল মেশাস না, এটা শুধু গয়লার দুধে জল মেশানোর প্রসঙ্গ বোঝায় না। বোঝায় মিথ্যা আছে। কতটা জল? বা—কতটা জল দিলে বস?
সে হয়তো উত্তরে বলল—মাইরি বলছি।
এই ‘মাইরি’ বলামাত্রই যেটুকু প্রত্যয় হয়েছিল, তা উধাও হয়ে গেল। মা মেরি যদি জানতেন, তাঁর নামের অপভ্রংশের কী দশা, যীশুকে আরেকবার পাঠাতেন, শব্দটা মুছে ফেলার জন্য।
মা কালীর অবস্থা আরেক রকম। মা কালীর দিব্যি—আর ১০০% মিথ্যা বন্ধুমহলে প্রায় সমার্থক। আর মুসলমানদের একই নম্বর পাবে—’আল্লার কিরে’। মানে আল্লার শপথ।
প্রথমত, সব ধর্মেই ঈশ্বর বা দেবতার নামে শপথ নেওয়া পাপ।
অথচ আদালতে তাই চলে।
—আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়া বলিতেছি যে, সত্য বই মিথ্যা বলিব না।
দুর্মুখেরা বলেন, হওয়া উচিত ছিল, মিথ্যা বই সত্য বলিব না।
গ।।
আমাদের ছোটবেলায় একজন ছিলেন, যিনি ছিলেন আমাদের খুব প্রিয়। খুব রং চড়িয়ে গল্প করতে পারতেন। তাঁর আসল নাম বদলে গিয়ে হয়েছিল—ভজুভাই বা ভজাভাই। মানে মিথ্যাদাদা। মিথ্যার আরেকটা প্রতিশব্দ ‘ভজা’। তবে ‘ভজা’ আর ‘ভজানো’ কিন্তু এক নয়।
ঘ।।
ছাত্র-ছাত্রীরা কীভাবে মিথ্যা বলে, জানতে চেয়েছিলাম।
বন্ধু বা বান্ধবির সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেলে, অজুহাত, ক্লাস ছিল।
—এক্সট্রা ক্লাস ছিল মা।
—লাইব্রেরিতে একটা ভালো বই পেলাম, পড়তে পড়তে দেরি হয়ে গেল।
কিংবা—জেরক্সের দোকানে গেলাম, বিরাট লাইন।
আগে প্রেম করার সময় মাসির বাড়ি বা পিসির বাড়ি বলত, এখন নোটস আনতে যাওয়া বা একসঙ্গে একটু কনসাল্টেশান।
সারাদিনের জন্য বের হতে হলে :
—বন্ধুরা মিলে এট্টু ঘুরতে যাচ্ছি।
পয়সার দরকার হলে :
—বন্ধুর বার্থডে পার্টি আছে গিফট কিনতে হবে।
টিউশনের স্যার ডেকেছেন তো কমন অজুহাত।
কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হলে—বাড়ির পছন্দের বা প্রিয় কোনো স্যারের নাম করে—আজ স্যার একদম ছাড়লেন না, যত বলি দেরি হয়ে যাবে, দু-দুটো এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে ছাড়লেন। কোনো মানে হয় বলো মা!
ছদ্ম কোপ!
অন্যত্র কর্মরত বা কর্মরতারা তো মুন্ডু চেবান বসের। সব দোষ তাঁর। খুব একপ্রস্থ বসের নামে বলে চালিয়ে দিয়ে বলেন—এখানে কাজ করা যায়! যত বলি বাড়িতে কাজ আছে, শোনেই না।
ঙ।।
লেখকেরা বলেন, লেখাটা হয়ে গেছে আর একটু বাকি।
আর ‘একটু’টা আর শেষ হয় না। সম্পাদক বা প্রকাশকের মাথায় হাত।
কিংবা মেইল করব নেটটা কাজ করছে না।
সে যে কবে ঠিক হবে কে জানে!
চ।।
মোবাইলের ভাষা : মোবাইল মিথ্যা বলার অভ্যাস একটু বাড়িয়ে দিয়েছে। সুবিধাও করে দিয়েছে। কেউ আছে গড়িয়াহাটে। বলল, আছি শ্যামবাজারে।
আবার বিপদ বাড়িওয়েছে।
কীসের আওয়াজ আসছে? ট্রেনের না বাসের? নাকি ঘরের ফ্যানের? কৈফিয়ৎ দিতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। আগে অনেক সময় পেতেন, ধীরে সুস্থে বানানোর। এখন উপায়হীন। চটজলদি উত্তর চাই। তার জন্যও রাস্তা খোলা। ব্যাটারির চার্জ কম। শুনতে পাচ্ছি না। পরে করছি।
ফোন না ধরার অনেক অজুহাত।
—বাসে ভিড় ছিল। যা আওয়াজ! শুনতে পাইনি।
(বাড়িতে হলে)
—চার্জে বসিয়েছিলাম।
—বাথরুম/ওয়াশরুমে ছিলাম/খাচ্ছিলাম—ইত্যাদি নানা বাহানা।
টয়লেট আজকাল কমে আসছে। তার জায়গা নিচ্ছে ওয়াশরুম। কবে এটা ধুয়ে যাবে কে জানে! এ নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ছে সত্তর দশকের।
এক ভদ্রলোক একজনের বাড়ি গেছেন। বাড়িতে বয়স্ক কেউ নেই। ছোট মেয়েকে জিগ্যেস করেছেন, তোমাদের টয়লেটটা কোনদিকে?
সে উত্তর দিল—টয়লেট। সে তো জ্যেঠু নিয়ে চলে গেছে।
সে ভেবেছে টয়লেট মানে মোপেড। মোপেড নামে একটা বাইক ধরনের দু-চাকা যান বেশ কিছুদিন চলেছিল বাংলায়।
ছ।।
মিথ্যা কত রকম?
কম করে ৩৩ রকম।
দেখা যাক। এক এক করে।
১। ভুল বিশ্বাস (ব্যাড ফেথ) : যে মিথ্যা মানুষ নিজেকে বলে।
—আমিই বাংলার সেরা লেখক।
—আমার মতো পণ্ডিত আর কেউ নেই।
২। নগ্ন মিথ্যা (বেয়ার ফেসেড লাই) : যে মিথ্যা সহজেই অন্যের কানে ধরা পড়ে।
—পদ্মায় ভাগ ছিল বুঝলে!
—মারাদোনার সঙ্গে খেলেছি ভাই!
৩। বড় মিথ্যা (বিগ লাই) : যে মিথ্যা অন্যের ক্ষতি করে।
—নিজের চোখে দেখলাম তুমি টাকাটা সরালে ব্যাগ থেকে।
৪। প্রতারণামূলক মিথ্যা (ব্লাফিং) : যে মিথ্যা প্রতারণার উদ্দেশ্যে বলা হয়।
—চাকরিটা তোমার হবে, পাঁচ লাখ ছাড়তে হবে।
৫। বাগাড়ম্বর, বাজে কথা, বৃথা বাক্য (বুলশিট)—সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। বাড়িয়ে বলা।
—দেশের সব লোক তার জন্য পাগল।
ব্যক্তি বাগাড়ম্বর আমরা বুঝতে পারি, আনন্দিত সংবাদ হজম করি, অক্লেশে। বাগাড়ম্বর বলে ভাবি না।
৬। খানসামা মিথ্যা (বাটলার লাই) : এই শব্দবন্ধটি এখনো বাংলায় তেমন চালু নেই।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ মাধ্যম গবেষণাগার এই শব্দবন্ধটি নির্মাণ করেছে। এই মিথ্যার ব্যবহার বেশি এসএমএস বা মেইলে। নিজে নেই রেস্তোরাঁয়, সামনে নেই খানসামা বা ওয়েটার বা খানসামা তবু মিথ্যা টেক্সট পাঠানো, ‘সামনে ওয়েটার, পরে কথা বলি ভাই’।
৭। প্রাসঙ্গিক মিথ্যা (কন্টেক্সচুয়াল লাই) : শ্লেষ বক্রোক্তি হিসেবে অনেক সময় ব্যবহৃত হয়।
—এক কিলো মাংস একাই খেয়েছি, বলছি তো!
বাড়ির গিন্নিদের মুখে এটা প্রায় শোনার সৌভাগ্য হবে অনেকের।
৮। কথা ঢাকা মিথ্যা (কভার লাই) : নিজের বা অন্যের কোনো ভুল ঢাকার জন্য এই সব মিথ্যার ব্যবহার।
৯। মানহানিকর মিথ্যা (ডিফামেশন লাই) : অন্যের জাত ধর্ম জাতি রাষ্ট্র সরকার বা দল সম্পর্কে যে মিথ্যা বলে ক্ষতি করা হয়।
—দেশটাই সন্ত্রাসীদের আঁতুড়ঘর। (গোটা দেশের মানুষ কখনো সন্ত্রাসী হতে পারে কি?)
—ওদের ধর্মটাই অমন, কী আর বলবেন! (কোনো ধর্মের সব লোক ভালো বা খারাপ হয় কি?)
—চোরের দল, দেখছেন না কী করছে! (দলের সবাই কি চোর হতে পারে? তবু বলি)
১০। বিচ্যুত মিথ্যা ( ডিফ্লেক্টিং লাই) : ইচ্ছা করে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়া।
১১। অস্বীকারমূলক মিথ্যা ( ডিসমিসাল লাই)
১২। সত্য কমিয়ে বলা
১৩। অতিরঞ্জন
১৪। বানানো
১৫। গুল বা অসত্য বর্ণনা (ফিব)
১৬। জালিয়াতি
১৭। অর্ধ-সত্য : এটা সবচেয়ে বিপজ্জনক। কথায় আছে মিথ্যা খারাপ, অর্ধ-সত্য ভয়ংকর।
১৮। সৎ মিথ্যা : যা না জেনে বলা হয়।
১৯। রসিকতাপূর্ণ মিথ্যা (জোকস) : মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সংলাপ স্মরণীয়।
—সত্য সেটাই যা আমি কখনো বলিনি।
২০। শিশুদের কাছে বলা মিথ্যা : জুজুবুড়ি আসছে, ভূত আসছে ঘুমোও।
২১। ভুলে গিয়ে মিথ্যা বলা
২২। বাণিজ্যিক মিথ্যা : দোকানদাররা প্রায়-ই এটা করেন, টাকা বা মাল বা দাঁড়িপাল্লা ছুঁয়ে বলেন, বিশ্বাস করেন, এক পয়সা লাভ রাখছি না।
২৩। কম করে বলা : যেটা বন্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সরকার পক্ষ করে থাকে।
২৪। বিপথে চালিত করার জন্য : এটা খুব মারাত্মক।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক—
আর্যরা ভারতে আগমন করেছে, মুসলমানরা ভারত আক্রমণ করেছে, আর ইংরেজরা ভারত শাসন করেছে।
আর্য একটা জাতি (রেস)। মুসলমান একটা ধর্ম (রিলিজিয়ন), ইংরেজ একটা জাতি (নেশন)। তিন অর্থে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হল। আর্যদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা হল। মুসলমানরা যে সবাই এক নয়, মুঘলরা যে এদেশে রাজত্ব কায়েম করেছিল আরেক মুসলমান ইব্রাহিম লোদিদের হারিয়ে সে কথা অগ্রাহ্য করা হল। শতকের পর শতক পাঠান আফগান মুঘল তুর্কিরা নিজেদের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াই লড়েছে—তা অস্বীকার করা হল। আর ইংরেজদের বেলায় ইউরোপিয়ান বা খ্রিস্টান বলা হল না। ‘আক্রমণ’ শব্দটাও প্রযুক্ত হল না। ‘শাসন’ শব্দের মধ্য দিয়ে ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা হল। যেন এদেশে শাসন ছিল না।
২৫। মহৎ মিথ্যা।
২৬। ভুলে যাওয়া থেকে মিথ্যা।
২৭। প্যাথোলজিক্যাল লাই বা মিথ্যা : এক ধরনের লোক আছে যাঁরা মিথ্যা না বলে পারেন না। বিশেষ করে রাজনীতিতে এটা দেখা যায়।
যেমন—সুদিন আসছে (বা এসে গেছে)। ৫১০% কাজ করেছি।
২৮। আগাম সিদ্ধান্ত থেকে মিথ্যা (প্রিজুরি লাই) : বিচার ব্যবস্থায় এটা খুব দেখা যায়। ওকে ফাঁসি দিতে হবে, অতএব সাজাও মামলা। বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল প্রাচ্য-র ‘দায় আমাদেরও’ নাটকটা দেখতে পারেন।
২৯। ভদ্র মিথ্যা : আসতে পারবেন না, তবু চাপে হ্যাঁ বললেন।
৩০। ফুঁ মিথ্যে : সবচেয়ে কম দামে সবচেয়ে ভালো জিনিস।
৩১। বেজি মিথ্যা : নরম করে মিথ্যা। বউকে বলা—তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসিনি।
৩২। সাদা মিথ্যা : ক্ষতি না করে নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যা বলা।
৩৩। লাই ডিটেকটর যন্ত্রের সামনে মিথ্যা : এ নিয়ে বলে মরি আর কি! (ঋণ: উইকিপিডিয়া)
জ।।
এবার আসব একটি অতি অপ্রিয় প্রসঙ্গে। ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’ নিয়ে। লক্ষ্মণের গণ্ডি ব্যাপারটা মূল রামায়ণে নেই। তবু আমরা বহুকাল ধরে বলে আসছি। পড়ুন। লক্ষ্মণের গণ্ডি কেটে যাওয়াটা একটি গল্প মাত্র। মূল রামায়ণে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং সীতা এবং লক্ষ্মণ রাম মারীচ তথা স্বর্ণমৃগ ধরতে যাওয়ার পর মারীচের গলায় রামের আর্তনাদ শোনার পর পরস্পরকে বহু কটু বাক্য বলেছেন। সীতার বাক্যগুলি জানা, লক্ষ্মণের গুলি একটু শোনা যেতে পারে—স্ত্রীগণ প্রায় চঞ্চলচিত্তা, ধর্মত্যাগিনী, উগ্রস্বভাবা ও পুত্র ভ্রাতাদিগের সঙ্গে বিভেদকারিণী হয়ে থাকে…আমি গুরু রামের আদেশ পালনে প্রবৃত্ত রয়েছি, আপনি যখন স্ত্রীগণের দুষ্ট স্বভাবানুসারে আমাকে এরূপ আশঙ্কা করছেন, তখন আজ নিশ্চয়ই বিনষ্ট হবেন। আপনাকে ধিক! ‘ধিক ত্বামদ্য বিনশ্যন্তীং যন্মামেব বিশঙ্কসে’। (অরণ্যকাণ্ডম, পঞ্চচত্বারিংশ সর্গঃ শ্লোক ৩০-৩৩ দ্রষ্টব্য)।
আর ক্ষুণ্ণ লক্ষ্মণ কিঞ্চিৎ নমস্কার করে চলে গেলে, এলেন বেশভূষায় ‘মহাত্মা রাবণ’ [মূল রামায়ণে আছে ‘রাবণেন মহাত্মনা’(অরণ্যকাণ্ডম, সপ্তচত্বারিংশ সর্গঃ শ্লোক ৩২ দ্রষ্টব্য)। পরিব্রাজক বেশধারী রাবণের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন সীতা। হরণের আগে রাবণকে সীতা পাদ্য ও ভোজ্য দিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছেন। তার আগে রাবণের মুখে শুনেছেন ১৯ পংক্তি জুড়ে তাঁর অনুপম সৌন্দর্যের প্রশংসা। (অরণ্যকাণ্ডম, ষটচত্বারিংশ সর্গঃ শ্লোক ১৬-২৪)। সীতার লক্ষ্মণরেখা পার হওয়ার বৃত্তান্তটি আগেই বলেছি আদতে গল্প। মূল রামায়ণে সীতা রাবণকে নিমন্ত্রণ করেছেন। রাবণের সামনে শ্বশুর দশরথের নিন্দা করেছেন—কামপীড়িত মহারাজ পিতা দশরথ কৈকয়ীর প্রিয়কামের জন্য রামকে অভিষিক্ত করলেন না।
কামার্তশ্চ মহারাজঃ পিতা দশরথঃ স্বয়ম।।
কৈকয্যাঃ প্রিয়কামার্থং তং রামং নাভ্যষেচৎ।
আর এর পাশাপাশি বলেছেন—
আমার স্বামী এখনই অরণ্যজাত প্রচুর ফলমূল এবং অনেক রুরু, গোধা এবং বরাহশিকার করে প্রচুর মাংস নিয়ে আসবেন। ‘রূরুন গোধান বরাহাংশ্চ হত্বাদায়ামিষং বহু’ (অরণ্যকাণ্ডম, সপ্তচত্বারিংশ সর্গঃ শ্লোক ২৩ দ্রষ্টব্য)।
সীতাকে রাবণ হরণ করে যাওয়ার পর রাম ঘরে ফিরছেন মৃগ মাংস হাতেই।
ঝ।।
একটা খুব চালু সাম্প্রদায়িক কথা আছে। ক অক্ষর গো-মাংস। আরে পূজনীয় রাম সীতা গো-মাংস খেতেন। তো গো-মাংস এমন অচ্ছুৎ হবে কেন? মূল রামায়ণ পড়ুন।
অযোধ্যা ত্যাগ করে রাম বনবাসে গেলে গুহ আনীত বটবৃক্ষের ক্ষীর আনার পর তা চুলে লাগিয়ে জটা নির্মাণের পর ঋষিবেশ ধারণের পর নৌকাযোগে গঙ্গা পার হয়ে বৎস দেশে গিয়ে কী দিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃতি নিবারণ করলেন? সেসব জানার আগে জেনে নেওয়া যাক—সীতা কী প্রতিশ্রুতি দিলেন পতিতপাপনাশিনী গঙ্গাকে?
ব্রাহ্মণদের বস্ত্র ও শতসহস্রধেনু, বিবিধ বস্ত্র আর গঙ্গাকে সহস্রসংখ্যক সুরার ঘট ও মাংসমিশ্রিত অন্ন দেবেন। কী সেই মাংস? ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা-র ‘হিন্দু সত্তায় গো-মাংস’ বইটি মনস্ক পাঠক পড়তে পারেন। উদ্ধৃত করা যাক মূল রামায়ণের অংশটি—‘সুরাঘটসহস্রেণ মাংসভূতৌ দনেন চ’। আর এর আগে ‘গবাং শতশহস্র’ শব্দের উল্লেখ লক্ষণীয়। (অযোধ্যাকাণ্ডম, দ্বিপঞ্চাশঃ সর্গ, শ্লোক ৮৯)।
কী খেলেন সন্ধ্যায়? ‘বরাহমৃশ্যং পৃষতং মহারুরুম’ (অযোধ্যাকাণ্ডম, দ্বিপঞ্চাশঃ সর্গ, শ্লোক ১০২)। বরাহ, ঋষ্য, পৃষত এবং রুরু-র মাংস। সংঘীদের জন্য জানান যেতে পারে, বৈদিক সংস্কৃতে ‘মৃগ’ মানে শুধু হরিণ বোঝাত না, অন্য পশুও বোঝাত। বরাহ বা শুয়োর বাল্মীকির ভাষায়—মহামৃগ।
এরপর চিত্রকূট যাওয়ার আগে গঙ্গা–যমুনার সঙ্গমস্থলে ভরদ্বাজমুনির আশ্রমে পৌঁছালেন রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা। তাঁদের ভরদ্বাজ মুনি কী আহার করতে দিয়েছিলেন তাঁর আশ্রমে? ‘উপানায়ত ধর্মাত্মা গামর্ঘ্যমুদকং ততঃ’ (অযোধ্যাকাণ্ডম, চতুঃপঞ্চাশঃ সর্গ, শ্লোক ৮৯)। তিনজনের জন্য গো (মাংস), উদক এবং অর্ঘ্য দিলেন। সঙ্গে ফলমূল। মূল রামায়ণ থেকে এই উদ্ধৃতি। আমার কথায় সংশয় হলে পড়ুন পুণ্যধাম বারাণসী থেকে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আর এল মিত্রের ‘ইন্দো-এরিয়ানস : কন্ট্রিবিউশন্স টু দ্য এলুসিডেশন অফ এনশিয়েন্ট অ্যান্ড মেডিয়াভ্যাল হিস্ট্রি’ গ্রন্থের ৩৯৬ পাতা। এটি উদ্ধৃত করেছেন ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা। আন্তর্জালেও লেখাটি লভ্য। প্রেসিডেন্সি কলেজে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক সুশোভনচন্দ্র সরকার স্মারক বক্তৃতায় লেখাটি পাঠ করেন। বাংলা অনুবাদও পাওয়া যায়।
রাম না পড়েই অনেকে রাম ভক্ত। বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ আমার অত্যন্ত প্রিয় গ্রন্থ। আমি বহু বার এটি পাঠ করেছি। সেকালের সমাজ রাজনীতি মনস্তত্ত্ব বুঝতে গ্রন্থটি খুব কাজের। অনেকে মূল রামায়ণ ছুঁয়েও দেখেননি। কিছু গল্পগাথা শুনেছেন বা অন্যের লেখা পড়েছেন। তাঁদের কাছে অনুরোধ মূল রামায়ণ পড়ুন।
যাজ্ঞবল্ক্যের গল্পটি রুচিশীল সব মানুষের জানা। সুপক্ব নরম গো-মাংস খেতে তাঁর আগ্রহের কথা। গো-মাংস ভক্ষণ নিয়ে বশিষ্ঠ ও বাল্মীকি সংলাপ পণ্ডিতজনের দৃষ্টি অগোচর নয়। সংস্কৃতে ‘অতিথি’ শব্দের প্রতিশব্দ ‘গোঘ্ন’—গো হনন করা হয় যার জন্য। অতিথিদের জন্য গো-বধ করতেন এক বৈদিক বীর, তাঁর নাম ‘অতিথিগ্ব’। অর্থ—অতিথিদের জন্য গরু বধ’। ঋকবেদে ইন্দ্র বলছেন, ‘তারা আমার জন্য কুড়িটি অপেক্ষাও পনেরোটি বলীবর্দ রান্না করে’। অগ্নিদেবতার প্রিয় খাদ্য ঋকবেদ অনুযায়ী বলদ ও বন্ধ্যা গাভী। মহাভারতে রাজা রন্তিদেবের পাকশালায় দৈনিক এক হাজার গরুর মাংস রান্না করে বিতরণ করা হতো।
ঞ।।
‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’-এর মতো অসাধারণ মহাকাব্য ভারতে কম লেখা হয়েছে। ‘রামায়ণ’ আগে লেখা, ‘মহাভারত’ পরে। ‘মহাভারত’-এ ‘রামায়ণে’র বহু প্রসঙ্গ এসেছে। ‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’-এর দর্শনগত প্রভেদও আছে কিছু। ‘রামায়ণে’ বলা হয়েছে ‘রাজা যেমন প্রজা তেমন’, ‘মহাভারত’-এ বিদুরের মত ভিন্ন—‘প্রজা যেমন রাজা তেমন’।
‘রামায়ণ’ আর ‘মহাভারত’-এর মিলও কম নেই। দরিদ্র আর আজকের বিচারে ‘নিম্নবর্গ’-দের সঙ্গে বিচারে রাম ‘অনার্য’ শম্বুক-কে হত্যা করেছেন, শম্বুক বেদ পাঠ করেছেন বলে। আর ‘মহাভারত’-এর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এবং তাঁর চার ভাই বারণাবতে তাঁদের গৃহ (জতুগৃহ)-এ রাতে আশ্রয় নেওয়া এক নিষাদ স্ত্রী এবং তাঁর পাঁচ পুত্রকে আগুন লাগিয়ে হত্যা করেছেন। এই নিষাদ স্ত্রী বোঝাই যায় পতিহীনা, নিরাশ্রয়া। কুন্তীও তো পতিহীনা। তিনিও সায় দিলেন, এই অন্যায় হত্যায়। নিষাদ স্ত্রী ও তার পাঁচ পুত্র এসেছিলেন খাবার পাবেন বলে। খাবার পেলেন। সঙ্গে দেওয়া হল মদ। সেই মদ পান করে মৃতপ্রায় হয়ে গৃহমধ্যেই নিদ্রামগ্ন হল। সকলে সুষুপ্ত হলে ভীম পুরোচনের শয়নগৃহে, জতুগৃহের দ্বারে এবং চতুর্দিকে আগুন লাগিয়ে দিলেন। (মহাভারত, অনুবাদ : রাজশেখর বসু, এম সি সরকার, ১৪১৮, পৃ.-৬৫)। দুঃখের ব্যাপার এই, ওই নিষাদ বা ব্যাধ নারী আর তাঁর পাঁচ পুত্রের অপরাধ কী? না, তাঁরা রাজ্যের যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের গৃহে খেতে এসেছিলেন। নিমন্ত্রক কে? না কুন্তী। সতী কুন্তীর নিজের পুত্ররা পুত্র—ব্যাধের সন্তানরা সন্তান নয়, মানুষ নয়? প্রশ্ন উঠতে পারে, দুর্যোধন তো আগুন লাগিয়ে মারতে চেয়েছিলেন, পাণ্ডবদের। তো পাণ্ডবরা কী করবেন? ভালো করে ‘মহাভারত’ পড়ুন, পুরো এক বছর বাস করেছেন, বারণাবতে। আর বারণাবতে পাণ্ডবরা এসেছেন স্বেচ্ছায়, খানিকটা অসহায়ত্ব ও আছে, ধৃতরাষ্ট্র চেয়েছেন, পাণ্ডবরা বারণাবত যান, যুধিষ্ঠির না বলেন কী করে?
প্রশ্ন উঠতে পারে, দুর্যোধনের আজ্ঞায় পুরোচন তো পুড়িয়ে মারতে পারত ওদের। মহাভারতে আছে, ‘সকলে সুষুপ্ত হলে’। পুরোচনও তো নিদ্রামগ্ন, না হলে তিনি পুড়ে মরলেন কী করে? তাঁকেও তো মদই দেওয়া হয়েছিল। কারণ, কুন্তী নিমন্ত্রণ তো সকলকেই করেছেন।
রাজশেখর বসু অনুবাদ করছেন,যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, এখন আমাদের পলায়নের সময় এসেছে, আমরা অন্ধকারে আগুন দিয়ে পুরোচনকে দগ্ধ করব এবং অন্য ছ’জনকে রেখে চলে যাব।
কী মিথ্যা নিমন্ত্রণ?
একদিন কুন্তী ব্রাহ্মণ ভোজন করালেন, অনেক স্ত্রীলোকও এল, তারা যথেচ্ছ পানভোজন করে রাত্রিতে চলে গেল। (রাজশেখর বসু পৃ:-৬৫)
রয়ে গেল কারা? গরিব আশ্রয়হীন হত দরিদ্র ব্যাধ নারী আর তাঁর পাঁচপুত্র। তাঁরা এসেছিল আমন্ত্রণে। তাঁদের ঘরেই শুতে দেওয়া হয়েছিল। প্রচুর মদ্যপান করিয়ে মৃতপ্রায় করিয়ে হত্যার আয়োজন। কই কেউ তো এই নৃশংস নারী হত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলি না? আর পাঁচ পুত্র হত্যা নিয়ে? সেকি তাঁরা অন্ত্যজ আর গরিব বলে? দ্রৌপদী-র বস্ত্রহরণ নিঃসন্দেহে জঘন্য নিন্দনীয় কাজ, কিন্তু অসহায় ঘুমন্ত আশ্রয়প্রার্থীকে হত্যা কোন ধরণের ভালো কাজ? ওই নারী গরিব বলে কি তাঁর প্রাণের কোনও দাম নেই? আর তাঁর পাঁচ পুত্রের? কী বিচার বোধ আমাদের আর কী ভীষণ ন্যায়পরায়ণতা? বস্ত্রের চেয়ে প্রাণ কি কম মূল্যবান?
ট।।
শুধু এখানেই নয়, মহাভারতে নিম্নবর্গের প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষের বহু নজির আছে। আর কারা করছেন সেগুলি? যুবরাজ ক্ষত্রিয় যুধিষ্ঠির অথবা তাঁর শিক্ষক ব্রাহ্মণকৃপাচার্য বা দ্রোণাচার্য।
কোন কৃপাচার্য? যার মা নেই, আছেন শুধু পিতা। পিতা শরদ্বান মহর্ষি গৌতমের শিষ্য। ধনুর্বেদে পারঙ্গম এই শরদ্বানের তপস্যায় ভয় পেয়ে যান ইন্দ্র। আর চিরকাল যা অস্ত্র, নারী। নারীর যৌন আবেদন। এমনই এক অপ্সরা জানপদীকে পাঠানো হল শরদ্বানের কাছে, ধ্যান ভঙ্গ করাতে। (নারীবাদীরা কই এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না? দেবতাদের নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে পাঠিয়ে কারো ধ্যান ভঙ্গের প্রচেষ্টা কি নিন্দনীয় কাজ নয়? একি নারীর সম্মানরক্ষার মহান দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?) যাক, সে সব কথা। আসা যাক, কৃপাচার্যের জন্ম বৃত্তান্তে। জানপদীকে দেখে ‘শরদ্বানের হাত থেকে ধনুর্বাণ পড়ে গেল এবং রেতঃপাত হল। সে রেতঃ একটি শরস্তবে পড়ে দু-ভাগ হল, তা থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করলে’। রাজা শান্তনু তাঁদের গৃহে এনে বালকের নাম দিলেন কৃপ আর বালিকার নাম কৃপী। (অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৫৩)
এই কৃপাচার্য বাধা দিয়েছেন কর্ণকে। অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনীর দিন রঙ্গভূমিতে কর্ণকে ভয় পেয়ে অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে দিচ্ছেন না। অস্ত্র করছেন জন্ম আর জাতি পরিচয়কে। কর্ণ যখন অর্জুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলেন, তাঁকে কৃপাচার্য নিরস্ত করছেন এই বলে, ‘মহাবাহু কর্ণ, তুমি তোমার মাতা পিতার কুল বল, কোন রাজবংশের তুমি ভূষণ? তোমার পরিচয় পেলে বা না পেলে অর্জুন যুদ্ধ করা বা না করা স্থির করবেন, রাজপুত্রেরা তুচ্ছকুলশীল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না।’ (অনু : রাজশেখর বসু, পৃ.-৫৯)।
অন্যের মুখ ম্লান করায় সুখ শুধু জীবনানন্দের বিশ শতকে ছিল না, মহাভারতের যুগেও ছিল। আর সেই প্রাচীন গৌরব কি খুব গর্বের? কুন্তী চিনতে পেরেছেন কর্ণকে। মূর্চ্ছা গেছেন কর্ণকে দেখে। বুঝেছেন কৃপাচার্যও। চিনেই তাঁর জন্ম পরিচয় জিজ্ঞাসা। আর আমাদের আদরের ভীম, কর্ণের পালক পিতাকে দেখে কী করছেন, ব্যঙ্গ করছেন কর্ণকে। বলছেন, ‘তুমি কশাহাতে নিয়ে কুলধর্ম পালন করো, কুকুর যজ্ঞের পুরোডাশ খেতে পারে না, তুমিও অঙ্গরাজ্য ভোগ করতে পার না।’ (অনু : রাজশেখর বসু, পৃ.-৬০)।
আর যাঁকে আমরা নিন্দা করতে অভ্যস্ত, সেই দুর্যোধন কী বললেন— ‘ভীম, এমন কথা বলা তোমার উচিত হয়নি। দ্রোণাচার্য কলস থেকে আর কৃপাচার্য শরস্তব থেকে জন্মেছিলেন, আর তোমাদের জন্মবৃত্তান্তও আমার জানা আছে। কবচকুণ্ডলধারী সর্বলক্ষণযুক্ত কর্ণ নীচ বংশে জন্মাতেই পারেন না। কেবল অঙ্গরাজ্য নয়, সমগ্র পৃথিবীই ইনি ভোগ করবার যোগ্য।’ (মহাভারত, অনুঃ রাজশেখর বসু, পৃ.-৬০)।
প্রসঙ্গত, এর একটু আগেই কর্ণকে অঙ্গরাজ্য দান করেছেন দুর্যোধন। ‘পাপাত্মা’ দুর্যোধন গুণীর কদর করতে পারেন, মহামতি পাণ্ডবরা বিমুখ কেন? অন্যকে হীনভাবে হারানো বা তাঁর সঙ্গে লড়াই এড়িয়ে যাওয়া কি ধর্মের জয়? না অ-ধর্মের?
দ্রোণ-এর জন্ম বৃত্তান্ত একটু শুনে নেওয়া যাক।
দ্রোণেরও মাতা নেই। শুধু পিতা আছেন। পিতা ঋষি ভরদ্বাজ। ঋষি ভরদ্বাজ গঙ্গোত্তরী প্রদেশে বাস করতেন। একদিন স্নানকালে ঘৃতাচী অপসরাকে দেখে তাঁর শুক্রপাত হয়। সেই শুক্র তিনি কলসের মধ্যে রাখেন তা থেকে দ্রোণ জন্মগ্রহণ করেন। (মহাভারত, অনু : রাজশেখর বসু, পৃ.-৫৪)।
[কেউ বা টেস্ট টিউব বেবির ইতিহাসের গন্ধ পেয়ে আমোদিত হবেন হয়তো!]
এই দ্রোণ কী করেছেন? কেটে নিয়েছেন নিষাদ বা ব্যাধপুত্র একলব্যের বুড়ো আঙুল। একলব্য কিন্তু জাতকুলহীন নন। রাজার পুত্র। নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর একমাত্র পুত্র।
মহাভারতকার মৎস্যজীবী তথা জেলের মেয়ে সত্যবতীর পুত্র ব্যাসদেব লিখেছেন, নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর একমাত্র পুত্র একলব্য দ্রোণের কাছে শিক্ষার জন্য এলেন, কিন্তু নীচজাতি বলে দ্রোণ তাকে নিলেন না। (মহাভারত, অনু : রাজশেখর বসু, পৃ.-৫৬)।
নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর একমাত্র পুত্র একলব্য কী করলেন? দ্রোণকে প্রণাম করে চলে গেলেন। তারপর তাঁর একটি মাটির মূর্তি গড়ে অস্ত্রবিদ্যা অভ্যাস করতে লাগলেন। কেমন সে শিক্ষা? কুকুরের মুখে সাতটি বাণ মেরে মুখে পুরে দিলেন। সে দেখে দ্রোণ শিষ্য অর্জুনের অভিমান হল। অর্জুন দ্রোণকে গোপনে জিগ্যেস করলেন, আপনি প্রীত হয়ে বলেছিলেন আপনার কোনও শিষ্য আমার থেকে শ্রেষ্ঠ হবে না, কিন্তু একলব্য আমাকে অতিক্রম করল কেন?
যেমন শিষ্য তেমন গুরু। গুরু চাইলেন দক্ষিণা। মিথ্যা নয়? কার কাছ থেকে? যাঁকে তিনি নীচ জাতি বলে কিছুই শেখাননি তাঁর কাছে থেকে? কী দক্ষিণা? একলব্যের বুড়ো আঙুল। যে আঙুল ধনুর্বিদ্যায় অবশ্য জরুরি। কী আশ্চর্য, আমাদের দেশের সেরা প্রশিক্ষককে দেওয়া হয়,দ্রোণাচার্য পুরস্কার। তবে দ্রোণাচার্য প্রকৃত দক্ষিণাও পেয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী দক্ষিণা। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ‘ন্যায়নিষ্ঠ’ ধর্ম রাজ্যস্থাপনকারী কৃষ্ণের ‘উপদেশে’ গুরুকে প্রাণাধিক পুত্রের মৃত্যু মিথ্যা সংবাদ দিচ্ছেন। আর গুরুদেব দ্রোণের হাত থেকে অস্ত্র খসে পড়লে তাঁকে হত্যা করছেন পাণ্ডবকুলতিলকরা। নিরস্ত্রকে হত্যা—কোন ধর্মাচরণ কৃষ্ণই জানেন!
কৃষ্ণ কী বলেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে?
‘তোমরা এখন ধর্মের দিকে মন না দিয়ে জয়ের উপায় স্থির কর, নতুবা দ্রোণই তোমাদের সকলকে বধ করবেন। আমার মনে হয়, অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ পেলে উনি আর যুদ্ধ করবেন না, অতএব কেউ ওকে বলুক অশ্বত্থামা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন’। (মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৫)।
মিথ্যার কী অপূর্ব ভাষ্য।
যুধিষ্ঠির নিতান্ত অনিচ্ছায় সম্মতি দিলে ভীম দিলেন অশ্বত্থামার মৃত্যুর সংবাদ। বিশ্বাস হল না গুরুর। জিগ্যেস করলেন যুধিষ্ঠিরকে। কেন যুধিষ্ঠিরকে? অর্জুনকে নয় কেন? কারণ ‘দ্রোণের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ত্রিলোকের ঐশ্বর্যের জন্যও যুধিষ্ঠির মিথ্যা বলবেন না’। (মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৫)।
কিন্তু যুধিষ্ঠির বললেন। বললেন কৃষ্ণের প্ররোচনা আর ‘জয়লাভের আগ্রহে’ (মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৬)। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, দ্রোণ যদি আর অর্ধদিন যুদ্ধ করেন তবে আপনার সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হবে। (মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৫)।
দ্রোণ অস্ত্র ত্যাগ করলেন। প্রিয় পুত্রের মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ শুনলেন প্রাণাধিক যুধিষ্ঠিরের মুখে। (মহাভারত, অনুঃ রাজশেখর বসু, পৃঃ-৪৫৬)। যোগ সাধনায় নিমগ্ন দ্রোণকে হত্যা করলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। কার প্ররোচনা কৃষ্ণ, ভীম আর যুধিষ্ঠিরের মিথ্যা ভাষণের সাহায্য নিয়ে। কীভাবে হত্যা? মুন্ডুকেটে। সে মুন্ডু কেটে ছুড়ে দেওয়া হল কৌরব সৈন্যদের দিকে। (মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৭)। আর কখন এই কাজ, যখন দ্রোণ আর অর্ধ দিন যুদ্ধ করলে কৌরবদের জয় নিশ্চিত।
দ্রোণ হত্যার আগের দিন দ্রোণ কী করেছেন? পাণ্ডবদের পূর্ণ বিশ্রামের সুযোগ দিয়েছেন। আর তার প্রতিদান মিথ্যা উত্তর দিয়ে অস্ত্র ত্যাগ করিয়ে পুত্রের মৃত্যু সংবাদে শোকাতুর বৃদ্ধ পক্বকেশ শিক্ষাগুরুকে হত্যা করে তাঁর ছিন্ন মুন্ডু তাঁরই সৈন্যদের দিকে ছুড়ে দেওয়া। শুধু ঔরংজেব তাহলে একা দায়ী নন, এ কাজ ধর্মপুত্র ও নারায়ণ করেছেন! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ জয় ধর্মের জয়ই বটে!
একলব্যের আঙুল কেটে নেওয়া দ্রোণের মৃত্যুতে কে চোখের জল ফেললেন? ‘পাপাত্মা’ দুর্যোধন। মহাত্মা কৃষ্ণ বা যুধিষ্ঠির নয়। যুধিষ্ঠির শাস্তি পেলেন সামান্য। রথের চাকা আগে সত্য বলার জন্য মাটি থেকে চার আঙুল উপরে থাকত এখন মাটিতে নেমে এল। ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রাণহীন দ্রোণের মাথার চুল ধরে টেনে এনেছেন, কেশাকর্ষণ ছিল অতীব নিন্দার বিষয়। আর তাই অশ্বত্থামা খেদ প্রকাশ করে বলছেন, ‘আমার পিতা অস্ত্র ত্যাগ করার পর নীচাশয় পাণ্ডবগণ যেভাবে তাঁকে বধ করেছে এবং ধর্মধ্বজী নৃশংস অনার্য যুধিষ্ঠির যে পাপকর্ম করেছে তা শুনলাম। ন্যায়যুদ্ধে নিহত হওয়া দুঃখজনক নয়, কিন্তু সকল সৈন্যের সম্মুখে পিতার কেশাকর্ষণ করা হয়েছে এতেই আমি মর্মান্তিক কষ্ট পাচ্ছি।’ (মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৭)।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, পাণ্ডবপক্ষে দ্রোণকে অন্যায় ভাবে হত্যার জন্য একজনই বিলাপ করেছেন, তিনি অর্জুন। কিন্তু তিনিও গুরু দ্রোণকে রক্ষার চেষ্টা করেননি। ধৃষ্টদ্যুম্নকে তিনি জীবিত হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু হত্যায় বাধা দেননি। অর্জুন প্রাণের ভয় দেখালে ধৃষ্টদ্যুম্নের সাহস হত না দ্রোণকে বধ করার। অর্জুন দ্রোণহত্যা প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন, যা আজকের বিচারেও খুব প্রাসঙ্গিক। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বলছেন—
যিনি স্নেহের জন্য এবং ধর্মত পিতার তুল্য ছিলেন, অল্পকাল রাজ্যভোগের লোভে তাঁকে আমরা হত্যা করিয়েছি।
(মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৭)।
আজও তো অল্পকাল রাজ্যভোগের জন্য মানুষ কত মিথ্যা বলে মানুষ হত্যার আয়োজন করে।
আর ধৃষ্টদ্যুম্ন অর্জুন কর্তৃক তিরস্কৃত হয়ে অর্জুনকে শুনিয়ে দিয়েছে,
‘জয়দ্রথকে হত্যার পর তার মুণ্ড কিরাতের দেশে নিক্ষেপ করেছিলে, ভীষ্মকে বধ করলে যদি অধর্ম না হয়, তবে দ্রোণের বধে অধর্ম হবে কেন?’ (মহাভারত, অনু: রাজশেখর বসু, পৃ.-৪৫৭)।
ঠ।।
বেশি কথা আর বাড়াব না। আসি ধর্মরাজ্যস্থাপনের সংকল্পকারী কৃষ্ণের প্রসঙ্গে। কৃষ্ণ বলেছিলেন, যুদ্ধে তিনি নির্লিপ্ত থাকবেন। দেখে নেওয়া যাক মহাভারতের পাতা।
প্রথমত, কুরুক্ষত্রের যুদ্ধের আগে কৃষ্ণের সাহায্য লাভের আশায় এসেছেন দুর্যোধন আর অর্জুন। কৃষ্ণের ঘরে আগে আসা দুর্যোধন এবং পরে আসা অর্জুন—দুজনেই পদপ্রান্তে বসেছেন। কিন্তু কৃষ্ণ দুর্যোধনকে দেখে চক্ষু মুদেছেন। তারপর অর্জুন এলে চক্ষু খুলে বলেছেন, দুর্যোধন আগে এলেও তিনি যেহেতু অর্জুনকে আগে দেখেছেন, অতএব অর্জুনের বাসনা আগে পূর্ণ করবেন। পরে দুর্যোধনের। কৃষ্ণ দুর্যোধনের সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি যুদ্ধ করবেন না। নির্লিপ্ত ও শস্ত্রহীন থাকবেন। (সুখময় ভট্টাচার্য, মহাভারতের চরিতাবলী, আনন্দ, ১৪১৬, পৃ.-২৭৫)।
দ্বিতীয়ত, যুধিষ্ঠির যখন যুদ্ধ করতে চাননি, তখন তাঁকে যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করেছেন কৃষ্ণ। এই কি নির্লিপ্তির নমুনা?
ন চাপি বয়মত্যর্থং পরিত্যাগেন কর্হিচিৎ।
কৌরবৈঃ শমচ্ছিামস্তত্র যুদ্ধমনন্তরম। উ ১৫৩/১৫
(ন্যায্য প্রাপ্যকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করিয়া কৌরবদের সহিত শান্তি স্থাপন করিবার কথা আমি কিছুতেই বলিতে পারি না। আমার মতে এই অবস্থায় যুদ্ধ করাই উচিত। অনু: সুখময় ভট্টাচার্য)
তৃতীয়ত, যুদ্ধ স্থির হয়ে যাওয়ায় কর্ণকে কৃষ্ণ পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করেছেন কৌরবপক্ষ ত্যাগ করে পাণ্ডব পক্ষে যোগ দেওয়ার জন্য। কর্ণকে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত বলেছেন কৃষ্ণ। লোভ দেখিয়েছেন পাণ্ডুরাজার সিংহাসনে বসানো হবে কর্ণকে। দ্রৌপদীও তাঁকে পতিরূপে গ্রহণ করবেন। (সুখময় ভট্টাচার্য, মহাভারতের চরিত্রাবলী, আনন্দ, ১৪১৬, পৃ.-২৮৩)। রাজ্য, নারী, প্রভুত্ব—সবকিছুর লোভ কর্ণকে দেখিয়েছেন কৃষ্ণ। এই কি নির্লিপ্তির নমুনা?
চতুর্থত, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দিন স্থির করেছেন কৃষ্ণই। কর্ণকে বলেছেন, হে বীর তুমি নগরে প্রবেশ করিয়া ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপকে বলিবে, এই মাস যুদ্ধের পক্ষে প্রশস্ত, সাতদিন পর অমাবস্যা তিথি। সেইদিনেই সংগ্রাম আরম্ভ হউক।’ (সুখময় ভট্টাচার্য, মহাভারতের চরিতাবলী, আনন্দ, ১৪১৬, পৃ.-২৮৩)। এই কি নির্লিপ্তির নমুনা? মিথ্যা প্রতিশ্রুতি নয়?
পঞ্চমত, ভীষ্মের কাছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশম দিবসে রাতে ভীষ্মের কাছে কৃষ্ণ নিয়ে গেছেন অর্জুনকে। কেন? না ভীষ্ম বধের উপায় জানতে। এটা নির্লিপ্তি না অন্যায় আবদার? বিপক্ষের সেনাপতি বলে দেবেন তাঁর নিজের মৃত্যুর উপায়। ন্যায় যুদ্ধ জয় না হলে ‘ন্যায়’ হবে কী করে? ভীষ্মও তো ঠিক করেননি, যুদ্ধের মাঝে বিপক্ষের সেনাপতি ও পরামর্শদাতাকে নিজের মৃত্যুর উপায় বলে। এটা কার্যত প্রবঞ্চনা। শিখণ্ডী নারী, আর তাই তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রপ্রয়োগ করবেন না জানিয়েছেন। আর শিখণ্ডীর আড়ালে কৃষ্ণের পরামর্শে তির ছুড়ছেন কে? অর্জুন—বীর অর্জুন। ন্যায়যুদ্ধ? একি চরম প্রবঞ্চনা নয়? ভীষ্মের ‘ইচ্ছামৃত্যু’ বলে একে আড়াল করা কেন? মিথ্যা ভাষণ নয়?
ভীষ্ম তো মারা গিয়েছিলেন যুদ্ধ শেষের ৫৮ দিন পর। আর যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে পরামর্শের জন্য গিয়েছিলেন ২৯ দিনের মাথায়। ভীষ্ম যুদ্ধে অস্ত্র হাতেও অস্ত্রহীন, তাঁকে হত্যা ন্যায়? কে হত্যা করছেন? অর্জুন। কাকে? না যিনি ছোটবেলায় কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন। কেন? না অর্জুনের ভাষায় ‘অল্পদিন রাজ্যভোগের জন্য?’ ভাবী প্রজন্ম কী শিখবে বড়দের সম্মানের বিষয়ে? ক্ষমতার জন্য সব অন্যায় করা যায়? এটা প্রাণ বাঁচানো না ক্ষমতার লোভ? যশলোভের চেয়ে, মদ-নারী-অর্থের চেয়েও ক্ষমতার লোভ বড় ভয়ংকর।
ষষ্ঠত, শ্রীকৃষ্ণ রাক্ষসদের ‘পাপাত্মা’-কে বলেছেন, কর্ণের হাতে ঘটোৎকচ নিহত হলে উন্মাদের মতো আনন্দে নৃত্য করেছেন। বলছেন, কর্ণের হাতে ঘটোৎকচ নিহত না হলে আমিই তাকে বধ করতাম। কেন? না, ঘটোৎকচ রাক্ষসীর গর্ভজাত বলে ‘পাপাত্মা’! ভাবা যায়, কী যুক্তি!
আর কী বলছেন কৃষ্ণ—জরাসন্ধ, শিশুপাল নিষাদবীর একলব্য প্রমুখ বীরগণের বধের উপায় না করিলে এখন বিশেষ বিপদে পড়িতে হইত। ইহারাও পাপাত্মা ছিলেন। ইহাদেরও দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিবারই বিশেষ আশঙ্কা ছিল।
(সুখময় ভট্টাচার্য, মহাভারতের চরিতাবলী, আনন্দ, ১৪১৬, পৃ.-২৮৭)
নিম্নবর্গ, দলিত মানেই তাহলে পাপাত্মা? এই তাহলে ধর্মরাজ্যের মূল কথা? জনসংখ্যার ৮৭ ভাগ ‘পাপাত্মা’। আর ক্ষমতাধররা ‘পুণ্যাত্মা’—যাঁরা নিজের স্ত্রীকে বন্ধক রেখে জুয়া খেলে, পিতামহ, শিক্ষাগুরুকে অন্যায় যুদ্ধে হত্যা করে? তাঁরা পুণ্যাত্মা? ‘মহাভারত’ খুঁটিয়ে পড়লে দেখবেন দুর্যোধনকে অন্যায় ভাবে কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম বধ করলে কৃষ্ণের দাদা বলরাম ক্ষিপ্ত হয়ে ভীমকে আক্রমণ করতে গেছেন।
আর দুর্যোধনের মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছেন দেব আর গন্ধর্বরা। দুর্যোধন ও তাঁর শত ভাইয়ের স্বর্গলাভ হয়েছে। যা দেখে স্বর্গে গিয়েও ক্রোধ সংবরণ করতে পারেননি পুণ্যাত্মা যুধিষ্ঠির।
সপ্তমত, যে কর্ণকে যুদ্ধ শুরুর আগে এবং যুদ্ধ শুরুর প্রাক্-মুহূর্তে কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষে, নিদেনপক্ষে ভীষ্মের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিতে অনুরোধ করেছেন, সেই কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে গেলে, অর্জুন তির ছুড়তে বিরত হয়েছেন, কর্ণের কথায়। কৃষ্ণ অর্জুনকে উত্তেজিত করেছেন হত্যার জন্য। দুর্যোধন পক্ষ অবলম্বন করায় কর্ণকে দোষী করেছেন। বলেছেন, কর্ণকে এমত অবস্থায় হত্যা পাপ নয়। যুদ্ধে নিরস্ত্র বা রথের চাকা বসে যাওয়া ব্যক্তিকে হত্যা সেকালে অন্যায় বলে মনে করা হতো।
আচ্ছা, কর্ণ যদি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিতেন, তাহলেই তাঁর কোনো দোষ দেখতে পেতেন না যদুপতি?
যে যার পক্ষে সে ঠিক, যে বিপক্ষে সে অন্যায়কারী। সাম্রাজ্যবাদী বুশের এই নীতির অনুসরণ বহু আগেই।
মিথ্যার এক অপূর্ব নির্মাণ—সমাজে সাহিত্যে রাজনীতিতে জীবনে।
যা আমাদের দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন