বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
সদাশিবের মোটর বাজারের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাজারে তিনি রোজ একবার করে যান, শুধু বাজার করবার জন্যেই নয়, বাজারের লোকদের খবর নেবার জন্যেও বটে। মাঝে কয়েকদিন যেতে পারেননি। সেদিন গিয়ে আবদুলকে দেখতে পেলেন না। শুনলেন তার জ্বর হয়েছে। তার জায়গায় জগদম্বা বসে মাছ বিক্রি করছে।
জগদম্বা মাছের ব্যবসা ছেড়ে চায়ের দোকান করেছিল, তার দোকানের বড় কাচের বোতলে রঙ্গীন মাছ ছিল, সিনেমা অভিনেত্রীদের ছবিও টাঙানো ছিল অনেকগুলো। চা বিক্রিও হত খুব। হঠাৎ সে আবার মাছ বিক্রি করতে বসল কেন? জগদম্বা বললে, লোকে ধারে চা আর পান খেয়ে খেয়ে দোকানটা তার উঠিয়ে দিলে। সে কাকে ‘না’ বলবে? বাবুভেইয়ারা পর্যন্ত ধারে নিতে আরম্ভ করেছিল। তার পুঁজি আর কতটুকু! সুতরাং দোকান তুলে দিতে হয়েছে। এখন সে আড়তদারের মাছ বিক্রি করে। যা লাভ হয় ভাগাভাগি করে নেয়।
ছিপলী তার কোণটিতে ঠিক বসে ছিল। তাঁকে দেখে মৃদু হেসে বললে যে তাঁর জন্যে সে সদ্য-ধরা টাটকা রুই মাছের পেটি খানিকটা রেখে দিয়েছে। আরও একটি সুখবর দিল সে। সেই গুণ্ডা ছোঁড়া তিনটিকে পুলিসে ধরে নিয়ে চালান দিয়েছে। তার কাছে ভগলু মহলদার বসে ছিল প্রকাণ্ড একটা চিতল মাছ নিয়ে। সদাশিব দেখলেন তার একটা চোখ বেশ ফুলে রয়েছে।
“চোখে কি হল ভগলু?”
ভগলু মৃদু হেসে চুপ করে রইল, তার ঝাঁকড়া গোঁফগুলো কম্পিত হতে লাগল শুধু।
“কি হল চোখে—”
চিতল মাছটাকে দেখিয়ে দিয়ে বললে— “ই শালা মারিস হ্যায়।”
চিতল মাছের ল্যাজের ঝাপটায় চোখটা জখম হয়েছে তার। সদাশিব চোখটা দেখলেন। তারপর বললেন, “বিশেষ কিছু হয়নি, সেক দিও। আর আমি ওষুধ একফোঁটা দিয়ে দেব চোখে।”
বাঁড়ুয্যে মশাই যথারীতি মাছ ঘাঁটছিলেন বসে।
“নমস্কার বাঁড়ুয্যে মশাই। ভালো আছেন? কদিন আসতে পারিনি।”
বাঁড়ুয্যে ঘাড় তুললেন না। হেঁটমুণ্ডেই উত্তর দিলেন, “নমস্কার। আপনি আমার ওখানে খাবেন বলেছিলেন, কই এলেন না তো!”
“নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। ভুলেই গেছি।”
“তা বুঝতে পেরেছি। গরীবের কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক।”
অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন সদাশিব।
“আচ্ছা, আজই যাব। বারোটা নাগাদ যাব আপনার বাসায়।”
“বেশ—”
হঠাৎ সরখেলের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। তাঁর বাঁ হাতে রুমালে বাঁধা কতকগুলি কুঁচো মাছ। চোখেমুখে একটা চাপা অপ্রসন্নতা ফুটে রয়েছে। দারিদ্র্য-জনিত যে অসন্তোষের আগুন তাঁর অন্তরে ধিকধিকি অহরহ জ্বলে তার শিখা তাঁর চোখেমুখে পরিস্ফুট। সৌভাগ্যবান লোকের সান্নিধ্য তিনি সহ্য করতে পারেন না। সদাশিকে পারতপক্ষে তিনি এড়িয়ে চলেন। বাজারের সেরা মাছ মাংস তাঁর বাড়িতে রোজ যায় এইটেই বরদাস্ত করতে পারেন না তিনি। সদাশিবকে দেখলেই তাঁর চোখেমুখে একটা উগ্রভাব দেখা দেয়। ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসেন অবশ্য, কিন্তু তা ঈর্যা-ক্লিষ্ট তিক্ত হাসি।
“নমস্কার। আপনার জন্যে তো রুই মাছের পেটি কেটে রেখেছে মেছুনীটা। আমিও নিতুম, কিন্তু একটু দোরসা মনে হল, তাই আর নিলাম না। খুব ‘রেয়ার’ জিনিস পেয়ে গেছি একটা—”
“কি–”
“টাকা ট্যাংরা মাছ। এ দেশে দুর্লভ—”
“তা বটে—”
নমস্কার করে সরখেল কেটে পড়লেন।
তারপর দেখা হল প্রফেসার জলধরবাবু সঙ্গে। থলথলে মোটা মানুষ। বাজারে কখনও আসেন না। ভিড়ে আর ঠেলাঠেলিতে বিব্রত হয়ে পড়েছেন।
“নমস্কার, নমস্কার, আপনি হঠাৎ বাজারে যে!”
“আর বলেন কেন। জামাই এসেছে।। গিন্নী বললেন তুমি নিজে গিয়ে রুই মাছের মুড়ো নিয়ে এস একটা। কিন্তু রুই মাছ তো নেই। সবই দেখছি আড়, শিলং আর বাঘাড়। এই ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে খোঁজাও তো মুশকিল”
“দাঁড়ান দেখছি—”
তিনি এগিয়ে গেলেন ছিপলীর কাছে।
“তুই যে রুই মাছটা কেটেছিলি তার মুড়োটা কোথা?”
“তোর বাস্তে রাখলি-–”
ছিপলি আলাদা করে রেখে দিয়েছিল মাছ আর মুড়ো পিছনের দিকে একটা ঝুড়িতে ন্যাকড়া চাপা দিয়ে।
“মুড়োটা প্রফেসার সাহেবকে দিয়ে দে। জলধরবাবু, মুড়ো পাওয়া গেছে একটা—”
জলধরবাবু আকর্ণ হাসি হেসে বললেন–“বাঁচালেন মশাই। মুড়ো না নিয়ে গেলে জামাইয়ের কাছে মান থাকত না। এর দাম–”
ছিপলী দাম নিতে চাইছিল না। সদাশিব ধমক দেওয়াতে নিলে।
জলধরবাবু একটু অবাক হলেন—“দাম নিতে চাইছে না কেন!”
“ও আমার বেটী কিনা। তাই আপনাকেও খাতির করছিল।” অনেক ধন্যবাদ দিয়ে জলধরবাবু চলে গেলেন।
সদাশিব চারদিকে একবার চেয়ে দেখলেন। পরিচিত সবাইকে দেখতে পেলেন। বাজারে এসে নিজের অজ্ঞাতসারেই অনেকে স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলেন। পবিত্রবাবু মাছের বাজারে ঘোরেন যেন তিনি নিজের জমিদারি পরিদর্শন করছেন। স্কুলমাস্টার শম্ভুবাবু সর্বদাই কুণ্ঠিত, ভিড়ের মধ্যে সাইকেল ঠেলে ঠেলে ঢোকেন, দেখা হলেই ঘাড়টি নুইয়ে নমস্কার করেন। তাঁর সাইকেলটি একটি জবড়জং ব্যাপার। সামনে পিছনে বেতের ঝুড়ি নানারকম জিনিসে ভরা। তরি-তরকারি, ওষুধ, কাপড়
শম্ভুবাবু ভোর সকালে টিউশনি করতে বেরোন। দুটো টিউশনি সেরে এসে বাজার করেন। তারপর বাড়ি গিয়ে স্নানাহার করেই স্কুলে ছোটেন। স্কুল থেকে আর বাড়ি ফেরেন না, টিউশনি করতে যান। রাত দশটা পর্যন্ত টিউশনি করেন। ঘানির বলদরাও বোধ হয় এত খাটে না। অথচ তাঁর মুখে কোন অসন্তোষ বা ক্ষোভের গ্লানি নেই। মিষ্টি হাসিটি লেগেই আছে।
ত্রৈলোক্যবাবুর স্বভাব কলহ করা। তিনি মাছ কিনবেন এক পো কি দেড়পো কিন্তু তার বায়নাক্কা অনেক। ওজনদাঁড়ির ‘পাষাণ’ দেখবেন, মাছ টাটকা কি বাসি দেখবেন, মাছের সঙ্গে ‘কানকো’ বা ফুলখারা দিচ্ছে কিনা দেখবেন, পরিশেষে দর নিয়ে কচলাকচলি করবেন। তাঁর মুখটা নাক-সর্বস্ব। খাঁড়ার মতো নাক। টকটকে ফরসা রং, কটা চোখ। মনে হয় কোন সাহেব যেন বাঙালী পোশাক পরেছে। জেলেরা তাঁর নাম দিয়েছে সাহেববাবু। তিনি মাছ কেনবার সময় এত হাঙ্গামা করেন, কিন্তু জেলেরা এতটুকু বিরক্ত হয় না। তাঁর এই সব অন্যায় আবদার হাসিমুখে সহ্য করে তারা।
কতরকম লোকই যে আসে বাজারে। একদল আসে তাদের ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। মুখের দর্পণে কোন ভাব প্রতিফলিত হয় না। বোদা চেহারা। ভিড়ের মধ্যেও যেমন, ফাঁকা জায়গাতেও তেমনি। কথা বলে না, গা বাঁচিয়ে চলে, টুক করে বাজারে ঢোকে, টুক করে বেরিয়ে যায়। অনেকটা শশক-প্রকৃতির।
হঠাৎ যোগেনবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি একজন খবরের কাগজের ঘুণ। দু’তিনটি কাগজ তন্ন তন্ন করে পড়েন এবং কারো সঙ্গে দেখা হলেই খবরের কাগজের খবর নিয়েই আলোচনা করেন।
“ডাক্তারবাবু নমস্কার। নেহেরুর কাণ্ডটা দেখেছেন? আমাদের অতখানি জায়গা পাকিস্তানকে দিয়ে দিলে! যেন ওর বাপের সম্পত্তি। ও যদি আর কিছুদিন প্রাইম মিনিস্টার থাকে আমাদের প্রত্যেকের ভিটেতে ঘুঘু চরিয়ে দেবে—”
“সদাশিব সাধারণত রাজনৈতিক তর্ক করেন না। মুচকি হাসলেন একটু। উত্তেজিত যোগেনবাবু বললেন, “আপনি কেন যে খদ্দর পরেন বুঝি না। ওই খদ্দরধারীরাই তো আমাদের দফা নিকেশ করে দিলে। বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে ওরা, দেখে নেবেন। দেখবেন ঠিক দেবে। গরীবের কথা বাসি হলে মিষ্টি হয়।”
যোগেনবাবুর ক্ষোভের কারণ আছে। তিনি রিটিয়ার করবার পর এটেনশন পাননি। তাঁর ধারণা বাঙালী বলেই পাননি। তাঁর ছেলে থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক, একবার ফেল করে আই. এ., দু’বার ফেল করে বি. এ. পাস করেছে। কোথাও তাকে ঢোকাতে পাচ্ছেন না। তাঁর ধারণা বাঙালী বলেই পাচ্ছেন না। আহা, আজ যদি হ্যামিলটন সাহেব থাকত তাহলে তাঁর ছেলের চাকরির ভাবনা। সেলাম করলেই চাকরি হত। বার বার এই কথাই বলেন।
যোগেনবাবু একটি সাংঘাতিক খবর দিলেন।
“মহেন্দ্রবাবুর খাবার আপনার বাড়ি থেকে যায় তো?”
“হ্যাঁ–”
“তাঁর খবর জানেন?”
“না। অনেকদিন দেখা হয়নি।”
“শুছে—”
“তাই না কি?”
“যান একবার দেখে আসুন।”
“শুষ্ছে? আমাকে তো কোন খবর দেননি।”
“খবর দিলে যদি খাওয়াটি বন্ধ করে দেন, সেই ভয়ে দেননি। রোজ রসগোল্লা কিনে খেতেন। আপনি নাকি খেতে বলেছিলেন।”
“না। আমি মিষ্টি খেতে বারণই করেছিলুম।”
“উনি এখন দোষটা আপনার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন। ওঁর খাওয়ার খরচটা তো আপনার ঘাড় দিয়ে চলে যেত, যা বাড়তি পয়সা হাতে থাকত তাই দিয়ে রসগোল্লা কিনতেন।”
সদাশিব গিয়ে দেখলেন মহেন্দ্রবাবু সত্যিই মরছেন। শেষ অবস্থা। আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছেন। অনেক ঠেলাঠেলির পর চোখ খুললেন।
“কে ডাক্তারবাবু। নমস্কার–”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, “অনেক করলেন আমার জন্যে। অনেক ধন্যবাদ। আপনার কথা একটাও শুনিনি। বাঁচতে চাই না। বেঁচে সুখ নেই—”
একটু পরেই মারা গেলেন।
শবদাহের ব্যবস্থা করে বাঁড়ুয্যে মশাইয়ের বাড়িতে আসতে প্রায় একটা বেজে গেল। বাঁড়ুয্যে মশাইদের বাড়ি বেশ বড়। কিন্তু পরিবার বড় বলে ভাগ ভাগ হয়ে গেছে। বাঁড়ুয্যে মশাইয়ের ভাগে দু’ খানি ঘর, একফালি বারান্দা, একফালি উঠোন, আর উঠোনের পাশে ছোট্ট রান্নাঘর। বাঁড়ুয্যে মশাইয়ের নাতিনীটি ছাড়া আর কেউ নেই। নাতনীটির চেহারা বীভৎস। মুখের আধখানা পোড়া। স্টোভে পুড়ে গিয়েছিল। সদাশিব গিয়ে দেখলেন বাঁড়ুয্যে মশাই নিজেই রাঁধছেন। শুধু গা, পরনে একটি গামছা। রান্নাঘর থেকে তিনি বললেন, “ওরে, ডাক্তারবাবুকে ঘরে বসিয়ে হাওয়া কর। একটু বসুন। বেগুন-চিংড়িটা নাতনীকে দিয়ে রাঁধিয়েছি, ওটা ওর স্পেশালিটি। আমি লাউঘণ্ট রাঁধছি, ওটা আমার স্পেশালিটি। খেয়ে দেখুন কেমন লাগে—”
সদাশিব ঘরের ভিতর গিয়ে বসলেন। নাতনী একটি ভাঙা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। ঘরের চারদিকেই দারিদ্র্যের ছাপ। দেওয়ালে বহুকাল চুনকাম করা হয়নি। দু’ এক জায়গায় নোনা ধরেছে। চেয়ার ভাঙা, নড়বড়ে, একটি হাতল নেই। বিছানার চাদর ময়লা। মাছি ভন ভন করছে চতুর্দিকে। পাশের নর্দমা থেকে দুর্গন্ধ উঠছে একটা।
সদাশিব কখনও বাঁড়ুয্যে মশাইয়ের বাড়িতে আসেননি। যখন হাসপাতালে সিভিল সার্জন ছিলেন তখন এই নাতনী স্টোভ জ্বালতে গিয়ে পুড়ে যায়। বাঁড়ুয্যে মশাই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন একে। বাঁচবার আশা ছিল না। অনেক চেষ্টা করবার পর বাঁচল বটে, কিন্তু মুখটা বীভৎস হয়ে রইল।
সদাশিবের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। তিনি যেন হঠাৎ একটা রূঢ় সত্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন। নিম্নমধ্যবিত্ত ভদ্র বাঙালী গৃহস্থের নগ্নরূপটা তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল এদের দশা কি হবে? এরা কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? কে বাঁচাবে এদের? ভারত স্বাধীন হয়ে এরাই তো সবচেয়ে বেশী বিপন্ন হয়েছে। উদ্বাস্তুদের কথা মনে পড়ল, তারা নাকি আরও বিপন্ন। শিয়ালদহ স্টেশনে তাদের যে চেহারা একবার দেখেছেন তা মর্মন্তদ। মানুষ নয়, যেন পশুর দল। তিন-চারজন নেতা মিলে দেশটাকে ভাগ করে দিলে ক্ষমতার লোভে। ভাঙা দেশ আবার কি জুড়বে? কতদিনে?
এই সব নানা চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন তিনি। বাঁড়ুযো মশাই এলেন একটু পরে। “হয়ে গেল, এইবাব খেতে বসুন। মুখপুড়ী জায়গা করে দে। কার্পেটের আসনটা বিছিয়ে দিস”
নাতনী বেরিয়ে গেল। বাঁড়ুয্যে মশাই আবার চেঁচিয়ে বললেন, “কাঁসার গেলাসটা মেজেছিস তো?”
“হ্যাঁ”—মৃদুস্বরে উত্তর এল বাইরে থেকে।
বাঁড়ুয্যে মশাই (তখনও গামছা-পরা) ঈষৎ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর তাঁর ভাবলেশহীন মুখে হাসির ছটা ছড়িয়ে পড়ল একটু।
বললেন, “ওর মা ওর নাম স্বর্ণলতা রেখেছিল। দেখতে স্বর্ণলতার মতো না হোক, তাম্রলতার মতো হয়েছিল। এখন ওকে মুখপুড়ী বলে ডাকি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ্যে ওর মুখ পুড়েছিল, তাই তো ও আমার কাছে আছে, আমাকে দুটো ভাত ফুটিয়ে দিচ্ছে। মুখ না পুড়লে তো এতদিন বিয়ে হয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যেত। বিয়ে দিতেই হত, ভদ্রাসনটুকু বিক্রি করেও দিতে হত। কিন্তু তা আর হল না, ভগবান আমার উপর দয়া করল, মুখটা ওর পুড়ে গেল—”
ভগবানের এই দয়ার জন্যে বাঁড়ুয্যে মশাই যে কৃতজ্ঞ তা কিন্তু মনে হল না। কারণ তাঁর একটি দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।
সদাশিব বললেন, “আমার একটু সংকোচ হচ্ছে। এমনভাবে বিব্রত করলুম—”
“কিছুমাত্র না। এ তো ভাগ্য, ভাগ্য, পরম ভাগ্য। বেশীদিনের কথা নয়, আমার ঠাকুরদার আমলেই আমাদের বাড়িতে দু’বেলায় পঞ্চাশজন লোকের পাতা পড়ত— পাড়ার লোক, বাইরের লোক, অতিথি বন্ধু আত্মীয় কেউ বাদ পড়ত না। আমাদের ঠাকুমারা রুপোর গয়না পরতেন, শাড়ির বাহার ছিল না, কিন্তু তাঁরা দশজনকে নিজে হাতে রেঁধে খাওয়াতেন, নিজেরাই পরিবেশনও করতেন। দাসী চাকরানীর মতো গজগজ করে করতেন না, হাসিমুখে করতেন। দেখতে দেখতে সব মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল। এক জীবনে কতোই না দেখলুম। চলুন—”
সদাশিব গিয়ে দেখলেন প্রচুর আয়োজন করেছেন বাঁড়ুয্যে মশাই। নানারকম তরকারি, নিরামিষই প্রায় আট-দশ রকম।
“করেছেন কি! এতো কি খেতে পারব?”
“আপনি পারবেন না তো পারবে কে। আপনি তো খাইয়ে লোক—”
“আপনি খাবেন না?”
“আমার দেরি আছে। স্নান করব, আহ্নিক করব, তবে খাব। ভাবছি একেবারে ওবেলায় খাব। একবেলাই খাই আমি। দু’বেলা খাওয়া সহ্য হয় না। আপনি বসে খান, আমি হাওয়া করি—”
“না না, আপনি হাওয়া করবেন কি–”
“যা মাছি, খেতে দোর না আপনাকে। ফিনাইল কিনেও কুল পাই না, তাই আজকাল কেনা ছেড়ে দিয়েছি—”
খেতে খেতে গল্প হতে লাগল।
সদাশিব জিগ্যেস করলেন, “আপনাদের পরিবার এককালে নিশ্চয়ই খুব বড় ছিল—”
“বড় বলে বড়, রাবণের গুষ্টি। বিষয় ভাগ করতে করতে প্রত্যেকের ভাগে চটকস্য মাংসও হয়নি। ও পাড়াটাই বলতে গেলে আমাদের। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে মকদ্দমা করছে ভেঙে টকরো টুকরো হয়ে গেল।”
“মকদ্দমা কেন–”
“মতিচ্ছন্ন আর কি! আমি নিজেই সাতবার মকদ্দমা করেছি। যা কিছু সঞ্চিত অর্থ ছিল ওতেই গেছে। এখন পেন্সনটির উপর ভরসা। বেগুন-চিংড়ি কেমন হয়েছে, বলুন “
“খাসা—”
“মুখপুড়ী ওটা রাঁধে ভালো—”
“আপনার লাউঘণ্টও চমৎকার হয়েছে। এমন ঘণ্টও বহুকাল খাইনি। আপনি এত চমৎকার রাঁধেন! বা: –
“ও রান্নাটি আমার স্ত্রীর কাছে শিখেছিলাম। তিনি শিখেছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। ওর একটু ট্রিকস্ আছে, সেটা সবাইকে শেখাই না।”
বাঁড়ুয্যে মশাইয়ের মুখে আবার একটু হাসির ছটা ছড়িয়ে পড়ল।
“এতো রকম করেছেন, আবার মাংস করতে গেলেন কেন?”
“আপনি যে রোজ মাংস খান। আমি সব খবর রাখি-”
খাওয়া শেষ করে সদাশিব যখন বিদায় নিচ্ছেন তখন বাঁড়ুয্যে মশাই হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত কাণ্ড করে বসলেন। ঝুঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন সদাশিবকে।
“আপনি যে গরীবের বাড়ি পাত পেড়ে দুটো খেয়ে গেলেন এতে কৃতার্থ হয়ে গেলাম আমি—”
টপ্ করে একফোঁটা চোখের জল পড়ল সদাশিবের পায়ের উপর। তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিলেন তিনি। বাঁড়ুয্যে মশাই ঘাড় ফিরিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেলেন! কয়েক মুহূর্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সদাশিব। তারপর গিয়ে মোটরে উঠলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন