বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
সেদিন বাজারে ঢুকেই সদাশিব দেখলেন বাঁড়ুয্যে মশাই একগাদা ছোট মাছের সামনে বসে সেই গাদার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কুঁচো-চিংড়ি বাছছেন! বাঁড়ুয্যে মশায়ের বয়স কত তা বলা শক্ত। জরাজীর্ণ চেহারা। মাথায় চুল প্রায় নেই, যে ক’গাছি আছে তা পাকা। ঝোলা গোঁফ, তাও পাকা। রোগা সরু মুখ। চক্ষু কোটরগত, দৃষ্টি নিষ্প্রভ। ডান দিকের পাকা ভুরুর মাঝখানে একটা কালো আঁচিল তাঁর জরালাঞ্ছিত মুখের মধ্যে নির্জর হয়ে আছে। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। নিকেলের, একধারে সুতো দিয়ে বাঁধা! বাঁড়ুয্যে মশাই কারো দিকে তাকান না, তন্ময় হয়ে মাছ ঘাঁটেন। চারদিকে জল, কাদা প্যাঁচপ্যাঁচ করছে, লোকের ভিড় গিজ গিজ করছে, কিন্তু সেদিকে বাঁড়ুয্যে মশায়ের লক্ষ্য নেই। তিনি ওই জলকাদার উপর উবু হয়ে বসে বহু লোকের পায়ের এবং হাঁটুর গুঁতো সহ্য করে কুঁচো-চিংড়ি সংগ্রহ করছেন। আধপোয়ার বেশী কিনবেন না, কিন্তু মাছ ঘাঁটবেন অনেকক্ষণ ধরে। ওতেই আনন্দ।
“নমস্কার বাঁড়ুয্যে মশাই। কি মাছ কিনছেন—”
বাঁড়ুয্যে মশাই ঘাড় তুললেন না। স্বর শুনেই সদাশিবকে চিনতে পারলেন।
“কে, ডাক্তারবাবু, নমস্কার। কুঁচো-চিংড়ি কিনছি। বেগুনও কিনেছি কিছু। নাতনী বলেছে বেগুন দিয়ে কুঁচো-চিংড়ি রেঁধে দেবে। বেশ রাঁধে।”
“কত করে দর—”
“এক টাকা। এই পোকার মতো মাছ বলে কিনা এক টাকা! বাজারে কোন জিনিসে কি হাত দেবার জো আছে! সব আগুন!”
ঘাড় না তুলেই কথাগুলি বলে গেলেন।
বাঁড়ুয্যে মশাই রোজ বাজারে আসেন। রোজ ওই ছোট ছোট মাছের স্তূপের ভিতর হাত চালিয়ে চালিয়ে নিজের পছন্দমত মাছ বার করেন। কোনদিন কুঁচো-চিংড়ি, কোনদিন মৌরলা, কোনদিন খয়রা, কোনদিন ছোট পুঁটি। আধপোর বেশী কেনেন না কোনদিন। কোন্ মাছের সঙ্গে কোন্ মসলা দিলে মুখরোচক তরকারি হয় তা তাঁর নখদর্পণে। এঁকে দেখলেই সদাশিবের মনে হয় নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের প্রতীক ইনি। খাদ্য-রসিক, কিন্তু দারিদ্র্যপীড়িত। আত্মসম্মানবোধ খুব প্রবল। কারো কাছে মাথা নত করতে চান না, কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার তাড়নায় মাঝে মাঝে করতে হয় বলে মরমে মরে থাকেন।
জেলেরা ওঁকে খুব খাতির করে। উনি এখানকার স্কুলে অনেকদিন শিক্ষকতা করে এখন রিটায়ার করেছেন। একমাত্র পুত্রটি অকালে মারা গেছে। তারই মেয়ে ওঁর দেখাশোনা করে। পুত্রবধূও নেই।
“আপনার নাতনীর রান্নার সুখ্যাতি আমিও শুনেছি। একদিন গিয়ে তার হাতের বেগুন-চিংড়ি খেয়ে আসব—”
“যাবেন, যাবেন। সে তো আমার পরম সৌভাগ্য—”
সদাশিব মাংসের দোকানের দিকে গেলেন। আগের দিন রহমন কশাই খবর দিয়ে গিয়েছিল যে সে ভালো ভেড়া কাটবে একটা। ভেড়ার মাংস এ অঞ্চলে দুর্লভ। ছাগলই বেশী পছন্দ করে এদেশের লোক। কশাইরা সবাই জানে ডাক্তারবাবু ভেড়ার মাংস ভালবাসেন, তাই ভেড়া কাটলেই খবর দিয়ে আসে তাঁকে।
রহমনের কাছে যেতেই রহমন তাঁকে বলল—“হুজুরের জন্য একটা ‘লেগ’ আলাদা করে রেখেছি—”
“ওজন কর—”
ওজনে আড়াই সের হল। বেশ চর্বিদার ‘মাটন’, দেখে খুশী হলেন সদাশিব। ভালো রোস্ট হবে। তিনি দামটা মিটিয়ে দিয়ে ফিরেই দেখতে পেলেন খগেন সরখেলকে। লুব্ধদৃষ্টিতে ‘মাটন-লেগ’-টার দিকে চেয়ে আছেন।
“আপনি কিনলেন বুঝি ওটা? বড্ড বেশী চর্বি। তা না হলে আমি নিতুম সের দুই। আপনি পুরো ‘লেগ’-টাই নিলেন? আপনার এ বয়সে অত চর্বি খাওয়া কি ভালো?” পরমুহূর্তেই অপ্রস্তুত মুখে বললেন—“ও আপনি তো নিজেই ডাক্তার।” বলেই সুট করে চলে গেলেন তিনি মাছের বাজারের দিকে।
“সেলাম হুজুর–”
সদাশিব ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন সিতাবী মেথর। তিনি যখন হাসপাতালে চাকরি করতেন তখন এ-ও ছিল সেখানে। এখনও আছে। সিতাবী এক সের মাটন’ কিনলে। সদাশিব আন্দাজ করলেন আজ সন্ধ্যায় ওদের তাড়ির আসর ভালো করে জমবে। আর একটা কথাও সঙ্গে সঙ্গে মনে হল তাঁর। এই মেথররা খায় ভালো। কারণ মেথরদের প্রত্যেকেই কাজ করে। সিতাবীর পরিবারে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে পাঁচ-ছ’জন লোক। সকলেই রোজগার করে। ওদের সকলের আয় যোগ করলে মাসে আড়াইশ’-তিনশ’ টাকা হবে। সদাশিব ভাবলেন, তাই সিতাবী স্বচ্ছন্দে তিন টাকা খরচ করে মাটন কিনতে পারল। কিন্তু খগেন সরখেল পারলেন না। তাঁর মাইনে মাত্র একশ টাকা। একঘর ছেলে-মেয়ে। দু’টি মেয়ে বিবাহযোগ্যা। মেয়েরা কলেজে পড়ে। ছেলেরা স্কুলে। খগেনের একশ টাকাতে কুলোয় না। সকাল-বিকেল টিউশনিও করতে হয়।
হঠাৎ সদাশিবের মনে হল খগেন যদি সিতাবী হত তাহলে কি ঠিক হত? কথাটা মনে হতেই শিউরে উঠলেন তিনি। সিতাবী অশিক্ষিত মাতাল, তার বউও তাই। দুজনেই সিফিলিসগ্রস্ত। ওর ছেলেমেয়েগুলোও কেউ সুস্থ নয়। মাঝে মাঝে ডগমগে রঙিন কাপড় পরে বটে, কিন্তু খুব নোংরা। সিতাবীর জোয়ান মেয়ে-দুটোও পাজি, নানারকম বদনাম ওদের সম্বন্ধে। আর খগেন সরখেল শিক্ষিত ভদ্রলোক। সাহিত্য-প্রীতি আছে, সংগীতানুরাগ আছে। ভালো বেহালা বাজাতে পারেন, যথাসাধ্য সামাজিক শালীনতা বজায় রেখে চলবার চেষ্টা করেন—উনি সিতাবীর স্তরে নেমে যাবেন এটা ভাবাও যায় না। খগেন সরখেলদের জীবনের ট্রাজেডি এঁরা আশানুরূপ উপার্জন করতে পারেন না। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কি?
স্বাধীনতা হওয়ার পর থেকে এদের সমস্যা তো উত্তরোত্তর জটিলতর হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে এদের, চারদিকে নানা বিধিনিষেধের প্রাচীর তুলে এদের নিশ্চিহ্ন করবার চেষ্টা করছেন সরকার। এদের বাঁচবার উপায় কি? বিদ্রোহ? এরা কি বিদ্রোহ করতে পারবে? গান্ধিজীর একটা উক্তি তাঁর মনে পড়ল— ‘In Satyagraha, it is never the number that counts….Indeed one perfect civil register is enough to win the battle of Right against Wrong—অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজনও বিশুদ্ধ-চরিত্র যোদ্ধা যদি মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলেই যুদ্ধজয় হবে। এ যুদ্ধে সৈনিকের সংখ্যা বেশী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কোথায় সেই একজন বিশুদ্ধ-চরিত্র ‘perfect’ সৈনিক? এদের মধ্যে আছে কি একজনও? একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন সদাশিব। ছিপলী যে তাঁর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে তা দেখতে পাননি। হঠাৎ দেখতে পেলেন।
“কি ছিপলী? তোর পেটের ব্যথা কেমন আছে?”
“ভালো হয়ে গেছে। আপনি ওঁকে একবার দেখুন। দিন দিন কমজোর হয়ে যাচ্ছে—”
ছিপলীর স্বামী কাঁচুমাঁচু মুখে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ছোঁড়া একটা। ছিপলীর চেয়ে বয়স কম বলে মনে হয়। পাণ্ডুর রক্তহীন চেহারা। সদাশিব ওই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই তার চোখ দেখলেন, জিব দেখলেন। তাঁর সন্দেহ হল পেটে ‘হুকওয়ার্ম’ আছে। বললেন, “মোটরের কাছে গিয়ে দাঁড়া, ওষুধ দিচ্ছি।” চলে গেল তারা।
তারপর তিনি তাঁর অন্যান্য রোগীদেরও খোঁজ নিলেন। আবদুলের ছেলের আর জ্বর হয়নি। কয়লার চোখ-ওঠা অনেকটা কমেছে। ভগলুর নাতির খোসও প্রায় ভালো হয়ে গেছে। সুখনের ছেলের টাইফয়েড হয়েছে। তার জ্বরটা ছাড়েনি এখনও। দামী বিলিতী ওষুধ দিয়েছেন সদাশিব, তবু ছাড়েনি।
হঠাৎ কেব্লীর সঙ্গে দেখা হল। দত্ত বিকশিত করে একটু হেসে আধঘোমটা দিয়ে সরে দাঁড়াল সে। তার স্বামী নারাণ কয়েকদিন আগে ছাড়া পেয়েছে। কেব্লী তার জন্যেই পাঁঠার ‘কলিজা’ (মেটে) কিনতে এসেছিল। কয়েকদিন জেলে থেকে নাকি কমজোর হয়ে গেছে নারাণ।
বাইরে এসে সদাশিব দেখলেন মোটরের কাছেও বেশ ভিড় আর একদল ঝাঁকামুটে ছোঁড়া দাঁড়িয়ে ছিল ফরসা কাপড় পরে। যথারীতি সদাশিব সকলের চোখ দেখলেন, দাঁত দেখলেন, চারটে করে পয়সা দিলেন। পাশেই যে দোকানটা ছিল তাকে বললেন-এদের প্রত্যেককে একটা করে লজেন্স্ দিতে। বারোজন ছিল, বারোটা লজেন্সের দাম দিয়ে দিলেন। ওদের মধ্যে একটা ছেলে বলল, “ডাক্তারবাবু, যোগীয়া আপনাকে ঠকিয়েছে। ও নিজে কাপড় পরিষ্কার করেনি, আর একজনের পরিষ্কার কাপড় পরে এসেছে।” সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া বেধে গেল। ঝগড়া মেটাতে দেরি হয়ে গেল সদাশিবের। যোগীয়া সত্যিই প্রতারণা করেছিল। ধরা পড়ে গিয়ে কাঁদতে লাগল খুব। শেষকালে তাকে আর একটা লজেন্স্ দিয়ে থামাতে হল। তারপর ছিপলীর স্বামীকে ওষুধ দিলেন তিনি। আরও কয়েকজনকে দিলেন। গাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময়ে বাঁড়ুয্যে মশায়ের গলা শুনে দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাঁকে।
“ডাক্তারবাবু, আপনার জন্যেও কিছু কুঁচো-চিংড়ি বাছলুম। বাড়িতে বেগুন আছে তো? না থাকে তো আধসেরটাক কিনে নিয়ে যান। বেগুন-চিংড়ি করে দিতে বলবেন আপনার রাঁধুনীকে। মসলা কিছুই নয়। পেঁয়াজের ফোড়ন দিতে হবে বেশী করে। আর মাছগুলো যেন বেশ লাল করে ভেজে নয়। বেগুন ও পেঁয়াজের সঙ্গে বেশ করে ভাজতে হবে। রুটি বা লুচি দিয়ে খেলে সুখ পাবেন—”
“আপনার মাছগুলোই আমাকে দিয়ে দিলেন নাকি—”
“না, অতটা নিঃস্বার্থপর আমি নই। নিজেরটা রেখে তবে আপনাকে দিয়েছি—”
বাঁড়ুয্যে মশাই বেঁটে লোক। সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে থাকেন। মুখে ভাবের অভিব্যক্তি বড় একটা হয় না। কিন্তু সদাশিব লক্ষ্য করলেন তাঁর মুখে একটা মৃদু হাসির আভা ছড়িয়ে পড়েছে।
“অনেক ধন্যবাদ। আপনার নাতনীর হাতের রান্না খেতে একদিন যাব কিন্তু “
“নিশ্চয়, নিশ্চয়। যেদিন খুশী। কমল সেদিন বলছিল, আপনি খুব খাইয়েছেন তাকে। আমার তো হজমশক্তি নেই, থাকলে আমিও একদিন আপনার সঙ্গে খেয়ে আসতুম–”
“আসুন না একদিন। আপনার হজমশক্তির মতোই ব্যবস্থা করা যাবে—’
বাঁড়ুয্যে মশাই নমস্কার করলেন।
“না, ও কথা ঠাট্টা করে বললাম। আমি কোথাও নিমন্ত্রণ খাই না। গুরুদেবের বারণ—”
কমলের কথায় সদাশিবের মনে পড়ল মিস্টার পরসাদের কথা। কমলের কথা তো তাঁকে বলা হয়নি। কমল হয়তো আশা করে আছে। তখুনি মিস্টার পরসাদের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন