বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
সদাশিব ডায়েরি লিখছিলেন।
“মালতীকে নিয়ে বেশ একটু চিন্তায় পড়েছি। আজকাল তার বড় ঘন ঘন ‘ফিট’ হচ্ছে। ‘ফিট’-এর ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাল রাত্রে হঠাৎ যা কানে এল তাতে একটু বিব্রত বোধ করছি। কাল রাত্রে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার ঘুম আসছিল না। বারান্দায় গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে ছিলাম। বারান্দার ঠিক পাশেই মালতীর শোবার ঘর। মালতীর সঙ্গে চিরঞ্জীবের কথোপকথন আমার কানে গেল। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ সম্ভাবনাটা আমার মনে একদিনও উদয় হয়নি।
মালতী বলছিল, ‘আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। বেঁচে আমার সুখ কি! তোমার কাকার সংসারে রাঁধুনীবৃত্তি করতে করতে তো হাড় কালি হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে ইস্তক তো ওই কাজই করছি। উনি বাহাদুরি করে রাজ্যের লোককে নিমন্ত্রণ করবেন, আর আমাকে তাদের জন্যে কাঁড়ি কাঁড়ি রাঁধতে হবে। সকাল থেকে রাত্তির এগারোটা পর্যন্ত ওই আজবলালের টিকি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অসহ্য হয়েছে আমার পক্ষে। আমি আর পারছি না, পারছি না—’
মালতী কান্নায় ভেঙে পড়ল। চিরঞ্জীব নিম্নকণ্ঠে কি বললে ঠিক শুনতে পেলাম না। সম্ভবত সান্ত্বনা দিতে লাগল।
মালতীর যেটা দুঃখের কারণ—বন্ধ্যাত্ব-তা কেউ ঘোচাতে পারবে না। ওরই দু’চারটে ছেলে-মেয়ে হলে ওর অন্যরকম চেহারা হত। কিন্তু আমি ওর দুঃখের নিমিত্ত হয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছে ওকে আমার গৃহস্থালিতে কর্ত্রীপদে বরণ করে হয়তো ভুল করেছি।
চিরঞ্জীব এক অজ পাড়াগাঁয়ে একশ টাকা বেতনে স্কুলমাস্টারি করত। খুব কষ্টে ছিল। প্রায়ই ম্যালেরিয়ায় ভুগত। তাই আমি ওকে নিয়ে এসেছিলাম। যে একশ টাকা ওখানে মাইনে পেত সে একশ টাকা আমি ওকে মাসে মাসে হাত খরচস্বরূপ দিই। ওরা এখানে যে স্টাইলে থাকে সে স্টাইলে ওরা মাসে পাঁচশ টাকা রোজগার করলেও থাকতে পারত না। মালতীর শাড়ি-গয়নার অভাব রাখিনি। ওর যে-কোনও শখ বলবামাত্রই মিটিয়ে দিয়েছি। বাড়িতে খরগোশ, কাবুলী বিড়াল, কুকুর, পায়রা, নানারকম পাখি—সব ওর জন্যই। তবু দেখছি ও সুখী নয়। আমার সংসারকে ও নিজের সংসার করে নিতে পারেনি। ওর সর্বদাই মনে হচ্ছে—এটা কাকার সংসার। কিন্তু আমার সংসারে ওরাই তো সর্বেসর্বা।
সোহাগ তার স্বামীর সঙ্গে বিলেত চলে গেছে। কন্টিনেন্ট টুর করছে। সোহাগের স্বামী বিলেতেই একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। বাড়িও কিনেছে লণ্ডনের কাছাকাছি একটা জায়গায়। হয়তো ওইখানেই শেষ পর্যন্ত বসবাস করবে। অর্থাৎ ওদের সঙ্গেও আমার সম্বন্ধ ছিন্ন হল যদি না আমিও ওদের সঙ্গে গিয়ে বাস করি। সোহাগ লিখেওছে যেতে। অনেক শিক্ষিত লোক নাকি এদেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিলেতে বা আমেরিকায় গিয়ে বাস করছে। সেখানে নাকি সবরকম সুবিধা। হোক সুবিধা, আমি বিদেশে যেতে পারব না। লক্ষ্য করছি সব সময় সব ব্যাপার নিজের সুবিধার মানদণ্ডে মাপতে গিয়ে অনেক লোক পশুর স্তরে নেমে যাচ্ছে। স্বদেশের ঠাকুরকে অবহেলা করে বিদেশের কুকুরদের আদর করার জন্য কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আমাদের গাল দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁর গালাগাল গায়ে মাখিনি। সাহেবরা এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের বিদেশী-প্রীতি যেন হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এটা দুর্লক্ষণ। সাহেবদের অনেক সদ্গুণ আছে স্বীকার করি, সেই সদ্গুণগুলি আমরা স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করতে পারি, কারণ সদ্গুণ কোনও বিশেষ দেশের বিশেষ মানুষদের সম্পত্তি নয়। সেগুলি আয়ত্ত করবার জন্যে প্যান্ট নেকটাই পরবার বা গরু খাবার দরকার নেই, তার জন্যে দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়াও অনাবশ্যক।
এক বিলেত-ফেরত ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন—“বিলেতে সাহেবরা সামনাসামনি আমাদের সঙ্গে যত ভদ্রতাই করুক, আড়ালে আমরা তাদের চোখে ‘ব্রাউনি’, একটা অদৃশ্য সীমারেখা টেনে মনে মনে ওরা আমাদের সর্বদাই তফাত করে রাখে। নিজেদের মধ্যে হয়তো আমাদের নিয়ে হাসাহাসিও করে। রবীন্দ্রনাথের মতো লোকের সম্বন্ধেও একজন বিখ্যাত লেখকের যে-সব প্রাইভেট চিঠিপত্র বেরিয়েছিল তা পড়বার পর আর ওদেশে যেতে ইচ্ছে করে না। রবীন্দ্রনাথকে তো আমেরিকার লোকেরাও ভারতীয় বলে অপমান করেছিল। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে চলে আসেন। আমার মেয়ে-জামাই সেই বিদেশে গিয়ে থাকবে ঠিক করেছে। করুক, আমি যাব না। এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরব।”
সদাশিব একটা বড় দীঘির ধারে চেয়ার টেবিল পেতে লিখছিলেন। দীঘির ধারে ‘কুঁজড়া’ (যারা তরকারি ফলিয়ে বিক্রি করে) জগদীশের ঘর। জগদীশ নবীগঞ্জের হাটে তরকারি বেচে। বুড়ো মানুষ। তার স্ট্র্যাংগুলেটেড্ হার্নিয়া হয়ে মর মর হয়েছিল। খবর পেয়ে সদাশিব এসে সেটা অপারেশন করেছেন। দুঃসাধ্য কাজ। উলফৎ কম্পাউণ্ডার এবং ড্রাইভার আলীর সহায়তায় এটি করেছেন তিনি। সকাল থেকে এইখানেই বসে আছেন। কম্পাউণ্ডার উলফকে বসিয়ে রেখেছেন জগদীশের কাছে। জগদীশের জ্ঞান হয়েছে। তবু বসিয়ে রেখেছেন উলফৎকে। আরও ঘণ্টাখানেক পরে ছুটি দেবেন। উলফ বুড়ো অভিজ্ঞ কম্পাউণ্ডার। সদাশিব যখন চাকরি করতেন তখন হাসপাতালে ছিল। এখন সেও রিটায়ার করেছে। সদাশিব বাইরে যখন অপারেশন করেন, উলফকে ডাকেন।
জগদীশের মেয়ে এসে বললে—“বাবুজি ভালো আছে। হাসছে—”
“আমার জন্যে একগ্লাস শরবত করে নিয়ে আয়। আমার গাড়ি থেকে গ্লাস নিয়ে যা—”
মেয়েটা দৌড়ে চলে গেল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন