বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
ভোর পাঁচটা। সদাশিব বাইরে ‘লনে’ চুপ করে বসে আছেন একা একটা ক্যাম্প-চেয়ারে। দুটো কোকিল ডাকাডাকি করছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাকছে আরও কয়েকটা পাখি। দুটো হাঁড়িচাচা মিষ্টিসুরে কথাবার্তা কইছে পরস্পরের সঙ্গে। মনে হচ্ছে যেন বলছে ‘খুকু নেই’, ‘খুকু নেই’। টংক্ টংক্ টংক্ একঘেয়ে সুরে ডেকে চলেছে স্যাকরা পাখি। কয়েকটা দুর্গাটুনটুনী উড়ে বেড়াচ্ছে কলকে ফুলের ঝাড়ে। কল্কে ফুলের ভিতর ঠোট চালিয়ে মধু খাচ্ছে আর কিচকিচ্ কিচকিচ্ চরচর্ করে শব্দ করছে। সদাশিবের স্প্যানিয়েল কুকুর ‘লোমেশ’ সামনে বসে আছে থাবার উপর মুখ রেখে। উৎসুকদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সদাশিবের মুখের দিকে। সদাশিব যে আজ বিশেষরকম অন্যমনস্ক তা যেন সে বুঝতে পেরেছে। বাড়ির চাকরটা একটা চৌকো টুল রেখে গেল সামনে। তারপর একটা ট্রের উপরে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসে রাখল তার উপর।
“চা কি ছেঁকে দেব—”
“থাক্। আর একটু ভিজুক—”
সদাশিব অন্যমনস্কভাবে পাখিদের গান শুনতে লাগলেন পা দোলাতে দোলাতে। চায়ের দিকে তেমন মনোযোগ দিলেন না। হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল গোমেশ উৎসুকদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাঁর দিকে আর আস্তে আস্তে ল্যাজ নাড়ছে। তিনি ট্রের উপর থেকে একটা বিস্কুট ছুঁড়ে দিলেন তার দিকে। লোমেশ সেটাকে আর মাটিতে পড়বার অবসর দিলে না, শূন্য থেকেই লুফে নিলে সেটাকে মুখ দিয়ে। একটা বিস্কুট খেয়ে উৎসাহভরে উঠে পড়ল এবং একটু এগিয়ে এসে ঘন ঘন ল্যাজ নাড়তে লাগল। আর একটা বিস্কুট দিলেন তাকে, তারপর আর একটা।
“আরও বিস্কুট এনে দেব—”
সদাশিব ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন আজবলাল দাঁড়িয়ে আছে। সে যে কখন এসেছে তা টের পাননি তিনি। সদাশিব দেখলেন তার চোখে-মুখে একটা কুণ্ঠিত স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে— সদাশিব যেন ক্রীড়ারত শিশু একটা—ক্রীড়াচ্ছলে দামী বিস্কুটগুলো কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন। তাঁর উদারতায় সে মুগ্ধ হয়েছে, কিন্তু অপচয়শীলতায় ক্ষুব্ধও কম হয়নি। তার মনে হচ্ছে মালতী থাকলে তাঁকে হয়তো শাসন করত, কিন্তু সে তাঁকে শাসন করতে পারে না। মনিব যে!
“না, আমার আর বিস্কুট চাই না।”
“চা-টা ছেঁকে দেব? ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“দাও—”
আজবলাল চা ছাঁকতে লাগল।
মালতীকে নিয়ে চিরঞ্জীব কাল চলে গেল কাশ্মীর। সদাশিব জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন তাদের।
তাঁর মনে হয়েছে বাইরে একটু বেড়িয়ে এলে হয়তো মালতীর মনটা ভালো হবে।
প্রস্তাবটা শুনে চিরঞ্জীব আশ্চর্য হয়েছিল প্রথমটা।
“কাশ্মীর? সেখানে গিয়ে কি হবে!”
“ওর মনটা ভালো হবে। একঘেয়ে জীবন থেকে একটু ছাড়া পেয়ে বাঁচবে। ওকে কিছুদিন নানা জায়গায় নিয়ে ঘুরে বেড়াও। দিল্লী, আগ্রা, কাশী, হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন—যেখানে ও যেতে চায় নিয়ে যাও ওকে। এতে একটু উপকার হবে মনে হয়। টাকার জন্যে ভেবো না, সে আমি ব্যবস্থা করব—”
চিরঞ্জীব স্বল্পভাষী, কিছু বলল না। কিন্তু সে মনে মনে বুঝল সদাশিব মালতীর পরিবর্তিত মনোভাবের আভাস পেয়েছেন। এজন্য নিজেই সে মনে মনে কুণ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে সে-ও যেন বাঁচল। এতে মালতীর উপকার হবে কিনা সে জানত না, কিন্তু মালতীকে যে কাকার কাছ থেকে সে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারছে, এতেই সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। তার ভয় ছিল মালতী কোনদিন প্রকাশ্যে কোনও কেলেঙ্কারি করে না বসে।
মালতী কাল চলে গেছে। যদিও বাড়িতে চাকরবাকরদের অভাব নেই, তবু যেন বাড়িটা খালি খালি মনে হচ্ছে সদাশিবের। মালতী যে বাড়িটার অনেকখানি পূর্ণ করে থাকত। তার চীৎকার চেঁচামেচি, চাকর-ঠাকুরের উপর তার দোর্দণ্ড প্রতাপ, বাড়ির সমস্ত আবহাওয়া সরগরম করে রাখত। হঠাৎ সব যেন নিঝঝুম হয়ে গেছে।
সদাশিব চা খেয়ে চুপ করে বসে রইলেন আরও খানিকক্ষণ। খবরের কাগজওলা এসে কাগজ দিয়ে গেল। সদাশিব খবরের কাগজ কেনেন কিন্তু পড়েন না। চিরঞ্জীবই কাগজ পড়ে দরকারী খবর মাঝে মাঝে শোনাত তাঁকে। কাগজটা দেখে আর একবার চিরঞ্জীবের কথা মনে পড়ল।
একটু পরেই গেটের কাছে মোটর এসে দাঁড়াল একটা। কমল নেমে এল মোটর থেকে।
“কি খবর কমল, এত সকালে হঠাৎ?”
“কাল জগদীশপুর হাটে গিয়েছিলাম। এস. ডি. ও. সাহেবের গাড়ি খারাপ হয়েছিল সেখানে। হাটে দেখলাম, বেশ সস্তায় মুরগি বিক্রি হচ্ছে। কিনে নিয়ে এসেছি গোটা ছয়েক মালতীদি-কে বলুন ভালো করে রান্না করতে। রাত্রে এসে খাব। আমার জন্যে যেন রুটি করেন।”
“মালতী কাশ্মীরে বেড়াতে গেছে। যাক্, তার জন্যে আটকাবে না—এই আলী—”
“হজৌর—”
আলী সেলাম করে এসে দাঁড়াল।
“বাবুর্চি গোলাম রসুলকে খবর দাও, আজ এখানে এসে রাঁধবে।”
“বহুত খু-–”
“আমি তো এখুনি বেরুব। তখনই যাবার পথে বলে যাব তাকে—”
“বহুত খু—”
মুরগিগুলো নাবিয়ে রেখে দাও –”
“বহুত্ খু—”
আলী চলে গেল। সদাশিব কমলকে জিগ্যেস করলেন, “তোমার বিল আদায় হল?”
“হয়েছে। মিস্টার পরসাদ এমন জোর কলমে লিখলেন যে বাপ বাপ করে টাকা দিয়ে গেলেন। তাই না মবলগ দশ টাকা খরচ করে মুরগি কিনলাম কাল!”
সদাশিব হাসলেন। একবার ইচ্ছে হল তাকে মিতব্যয়ী হতে উপদেশ দেন। কিন্তু নিজের কথা ভেবে তা আর দিলেন না।
“আচ্ছা চলি এখন। একটা মোটর ‘চুর’ হয়ে এসেছে কারখানায়। অ্যাসিডেন্ট করে এসেছে। গাড়ির ভিতর রক্তও রয়েছে। ওরা বলছে রক্ত মানুষের নয়, ওরা কোথায় যেন পুজো দিয়ে পাঁঠা বলি দিয়েছিল, সেই কাটা পাঁঠাটা গাড়িতে ছিল, তারই রক্ত—”
“চেনা গাড়ি?—
“না বাইরের গাড়ি। মোটরের নম্বর রাঁচির। কি করব বলুন তো?”
“পুলিসে খবর দাও। পুলিস এসে দেখে যাক্, তারপর গাড়িতে হাত দিও। তা না হলে ফ্যাসাদে পড়ে যেতে পার।”
“তাই করি তাহলে।”
কমল চলে গেল।
তারপর সদাশিবের মনে পড়ল বনুর ওখানে যেতে হবে। বনু কয়লা-গুদামের কুলি। কাল থেকে তার মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে। বনু কয়লা-গুদামেরই একধারে থাকে। তার দেশ কোথায় কেউ জানে না, তাকে সবাই চিরকাল কয়লা বইতে দেখেছে। ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা, কুচকুচে কালো। ঘাড়টা একধারে একটু বেঁকা। গলার স্বর ঝাপসা। কাল যখন সদাশিব বাজারে গিয়েছিলেন তখন তাঁর সামনেই বনু কয়লার বোঝাসুদ্ধ রাস্তায় পড়ে যায়। তারপর তার মুখ থেকে রক্ত উঠতে থাকে। সদাশিব তাকে গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু বনু যেতে চাইলো না। বললে, ওখানে গেলেই পয়সা চাইবে। আমার পয়সা নেই। আমাকে ওই গুদামেই নিয়ে চলুন। গুদামের মালিক সৌখা মাড়োয়ারী একটা ঘর খালি করিয়ে দিয়েছেন। ঠিক পাশেই যে কয়লার গুদাম আছে সেখানে একটা ভালো ঘর ছিল; কিন্তু সে গুদামের মালিক বাঙালী সর্বেশ্বরবাবু। তিনি সর্ববিষয়ে গা বাঁচিয়ে হিসাব করে চলেন, তাই সে ঘরে টি. বি. রোগীকে ঢুকতে দেননি। বনুর টি. বি. হয়েছে কিনা তা সদাশিব এখনও ঠিক করতে পারেননি, কিন্তু সর্বেশ্বর এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ।
সদাশিব উঠতে যাবেন এমন সময়ে আধঘোমটা দিয়ে কেব্লী এসে দাঁড়াল।
“কি খবর কেব্লী?”
কেব্লী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
“কি ব্যাপার, কি হয়েছে—”
কেব্লী কাঁদতেই লাগল। তারপর অশ্রুজড়িত কণ্ঠে থেমে থেমে বলল যে নারাণ তাকে কাল মেরেছে। তার মাথা ফেটে গেছে।
“সে কি!”
“দেখো নি” (দেখ না)
মাথার কাপড় তুলে সে দেখাল। সামনের চুলগুলো শুকনো রক্তের চাপে জড়িয়ে গেছে। সদাশিব তার চেহারা দেখে ভয় পেলেন। চোখে অশ্রু লেগে আছে বটে কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে বিদ্যুৎ, যেন সর্পিণী ফণা তুলেছে। কিছুদিন আগে এইরকম এক স্বামী-লাঞ্ছিতা কাহারনী তার স্বামীকে দা দিয়ে কেটে ফেলেছিল। ঘটনাটা হঠাৎ মনে পড়ল।
“কেন মারলে কেন তোকে—”
তখন কেব্লী আসল কারণটি বিবৃত করল। নারাণ আবার একটি বিয়ে করতে চায়। কেব্লী বাঁজা। সুতরাং নারাণের দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে চাইছে তার ভাই। তার মায়ের—মানে কেব্লীর শাশুড়ীর এতে মত নেই।
“নারাণের মা বেঁচে আছে নাকি এখনও?”
“হ্যাঁ। দেহাতে সে জমিতে কাজ করে—”
“কোথায় নারাণের বিয়ে ঠিক হয়েছে?’
“ওই দেহাতেই। একটা কানী বিধবা ওকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে। কে ভালো মেয়ে দেবে ওই বুড়োকে—”
“এ মেয়েটার বয়স কত—”
“তা জোয়ান আছে—”
“তোকে মারতে গেল কেন শুধু শুধু—”
“বাঃ, আমার মত না পেলে তো বিয়েই হবে না। আমাদের সমাজের নিয়ম যে ‘পন্চ’-এর (সমাজের মোড়লদের) সামনে আমি যতক্ষণ না বলব যে আমার বিয়েতে মত আছে, ততক্ষণ ওকে কেউ মেয়ে দিতে পারবে না। আমার সেই মত নেবার জন্যে আমাকে মারধোর শুরু করেছে—”
কেব্লীরা জাতে মুচি। তাদের সমাজে এরকম নিয়ম আছে শুনে সদাশিব বিস্মিত হলেন। “এ ব্যাপারে আমি কি করব বল—”
“আপনি দারোগা সাহেবকে বলে আবার ওকে জেলে পুরে দিন। ওরকম মারখুণ্ডা শন্কাহা মানুষের জেলে থাকাই উচিত— “
সদাশিব হেসে ফেললেন।
“সে কি হয়। আচ্ছা তুই বাড়ি যা। নারাণের সঙ্গে দেখা হলে তাকে বলব আমি—”
কেব্লী চলে গেল।
.
সদাশিবের গাড়ি যখন কয়লা-গুদামের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তখন সেখানে কেউ ছিল না। গুদামের মালিকরা কেউ আসেননি তখনও, কুলিরাও কেউ আসেনি। বনুকে কাল যে ঘরটায় সদাশিব রেখে গিয়েছিলেন সে ঘরের কপাট দুটো খোলা। সদাশিব মোটর থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়লেন ক্ষণকালের জন্য। কয়লার স্তূপগুলোর দিকে চেয়ে রইলেন। মনে হল যেন শ্মশানে দাঁড়িয়ে আছেন। ‘কয়লাগুলো তো মৃত অরণ্যের কঙ্কাল, মাটির তলা থেকে খুঁড়ে আবার সেগুলো পোড়াচ্ছি আমরা’—এই দার্শনিক চিন্তা ক্ষণিকের জন্যে অন্যমনস্ক করে দিল তাঁকে। তারপর তিন এগিয়ে গেলেন বনুর ঘরটার দিকে। গিয়ে দেখলেন বনু মুখ গুঁজড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, আর ঘরের কোণে বসে আছে একটা লোম-ওঠা রাস্তার কুকুর। বনু যখন দুপুরে ছাতু খেত এই কুকুরটাকে ছাতুর গুলি পাকিয়ে পাকিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিত। সেই কুকুরটা বসে আছে চুপ করে। আর একফালি রোদ বনুর মাথায় পিঠে সোনালী চাদরের মতো বিছানো রয়েছে। সদাশিব পরীক্ষা করে দেখলেন বনু মারা গেছে। নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ।
অনেকদিন আগেকার ছবি ফুটে উঠল তাঁর মনে। সেদিন রবিবার। সব কয়লার দোকান বন্ধ। তার উপর বৃষ্টি পড়ছে। সেদিন বাড়িতে তিনি কয়েকজনকে খেতে বলেছেন। মালতী খেয়াল করেনি যে আগের দিন রাত্রেই কয়লা ফুরিয়ে গেছে। সকালবেলা চাকর বাজার থেকে ফিরে এসে বলল, সব দোকান বন্ধ, কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না। সঙীন পরিস্থিতি। সদাশিব নিজে বেরুলেন শেষকালে। বৃষ্টি পড়ছিল খুব। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা। মাছের দোকানের গলিটার সামনে এসে দেখলেন বনু রাস্তার ধারে মাথায় বোরা-ঢাকা দিয়ে বসে আছে। নেমে পড়লেন তিনি গাড়ি থেকে। তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়াল বনু। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। বাঁকা ঘাড়টা আর একটু বেঁকিয়ে সেলাম করল তাঁকে।
“বনু, মহা মুশকিলে পড়েছি…”
সকল কথা বললেন বনুকে।
বনু ঝাপসা গলায় ভরসা দিল।
“আপনি বাড়ি যান, কয়লা পৌঁছে দিচ্ছি আমি–”
“সব দোকান তো বন্ধ, কোথায় পাবে তুমি—”
কোথায় পাব তা সে বলেনি। কেবল বলেছিল, ‘পাব’।
“দামটা নাও তাহলে—”
একটা পাঁচটাকার নোট বার করে দিয়েছিলেন সদাশিব।
“ভাঙানি তো নেই। দাম আমি পরে নিয়ে নেব–”
এক ঘণ্টা পরেই বনু ভিজতে ভিজতে কয়লা দিয়ে গিয়েছিল। এতদিন পরে সদাশিব মনে করতে পারলেন না, বনু কয়লার দামটা চেয়ে নিয়েছিল কিনা। কারণ তারপর বর সঙ্গে আর তাঁর দেখাই হয়নি অনেকদিন। মালতী হয়তো দিয়ে থাকবে–এই ভেবে সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করলেন তিনি। অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন সদাশিব। ভাবতে লাগলেন এই আত্মীয়-স্বজনহীন লোকটার এখন আর কি করতে পারেন তিনি। এখন তো ও চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে। সেদিনের সেই কথাটা স্মরণ করে তিনি অনুভব করলেন আজও তিনি বনুর কাছে ঋণী আছেন। কি করে এ ঋণ শোধ করা যায়? কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন আরও, তার পর বুঝতে পারলেন এ ঋণ শোধ করা যাবে না। সব ঋণ শোধ করা যায় না।
“রাম রাম ডাক্টার সাহেব। বনু কেমন আসে?”
সদাশিব ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, সৌখী মাড়োয়ারী এসে তাঁর আপিসের চাবি খুলছেন।
“বনু মারা গেছে—”
“মরিয়ে গেলো? সরবোনাস্ হল তাহলে। ও মুরদাকে এখন ফেক্বে কে?—”
বিদ্যুৎ-চমকের মতো একটা কথা মনে হল সদাশিবের। বললেন, “সে ব্যবস্থা আমি করছি-
“আপনি কোরবেন? কম সে কম দশ পন্দরহ্ টাকা খরচা হইয়ে যাবে—”
“দেখি—”
তখনি মোটরে করে বেরিয়ে গেলেন সদাশিব। বনুকে বাজারে সবাই চিনত। লোক সংগ্রহ করতে বিলম্ব হল না। সদাশিব খাটিয়া, শালু আর ফুল কিনে দিলেন। বাজারে যত ফুল পাওয়া গেল সব কিনলেন। ছিপলী, আবদুল আর ঝকমুও যোগাড় করে নিয়ে এল কিছু ফুল। একদল কীর্তনীয়াও জুটে গেল। বেশ বড় শোভাযাত্রা করে মহাসমারোহে বনু চলে গেল মহাপ্রস্থানের পথে। সদাশিব লক্ষ্য করলেন শোভাযাত্রার পিছন পিছন সেই লোম-ওঠা কুকুরটাও চলেছে। সদাশিবের সবসুদ্ধ খরচ হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ টাকা। এত কম টাকার বিনিময়ে এমন প্রচুর আনন্দ তিনি জীবনে আর কখনও পাননি। অনেকদিন পরে তাঁর মন অনাবিল তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। একটু দূরে দূরে তিনিও শবানুগমন করতে লাগলেন তাঁর মোটরে।
“রাম রাম ডাক্টার সাহেব—”
সৌখী মাড়োয়ারীকে দেখে গাড়ি থামালেন সদাশিব। “হামার বড় তাজ্জুব লাগছে। আপনে এক কুলিকে লিয়ে কাহে এনা রুপিয়া খরচ কর ডালা হমরা সমঝমে নেহি আতা হ্যায়”
সদাশিব দেখলেন এর আধ্যাত্মিক দিকটা সৌখী মাড়োয়ারীকে বোঝাতে অনেক সময় লাগবে। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বললেন—-”বনুর কিছু টাকা আমার কাছে জমা ছিল। সে টাকাই লাগিয়ে দিলাম এতে।”
“ও আব্ সমঝা। ভালো করিয়েসেন—রাম রাম।”
সৌখী মাড়োয়ারী চলে গেলেন।
আলী আবার স্টার্ট দিলে মোটরে।
“আস্তে আস্তে চল-–”
কিছুদূর যাবার পর একটা খুব রঙচঙে রিক্শা সামনে এসে দাঁড়াল। রিক্শার পিছনে একটি উন্মুক্ত-বক্ষা অত্যাধুনিকা অভিনেত্রীর ছবি রয়েছে। রিকশার গদি লাল সাটিনের, হুডটা সবুজ রঙের। হুডের চারিধারে চমৎকার ঝালর দেওয়া। সাইকেলের হাতলে একরাশ সোঁদাল ফুল। রিক্শাচালক নেমে খুব ঝুঁকে সেলাম করলে সদাশিবকে। শুকুরের ছেলে সিদ্দিক। একেই তিনি কিছুদিন আগে হাটে চড় মেরেছিলেন। গনোরিয়া হয়েছিল ছোকরার।
“কৈসা হ্যায়—”
“ছুট্ গিয়া হুজুর। আওর কি সুই লেনা পড়েগা?”
“কল্ পেসাব লে কর্ আও, দেখেঙ্গে—”
শোভাযাত্রার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সিদ্দিক আলীকে জিগ্যেস করলে, “ইয়ে জুলুস কিস্কা হ্যায়—”
আলী তখন তাকে বললে যে বনু মরে গেছে, তাকেই শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছে সবাই।
“ম্যয় ভি যাউঙ্গা-–”
সিদ্দিক তার রঙীন রিকশা চালিয়ে চলে গেল ভিড়ের মধ্যে সাইকেলের ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে।
.
শ্মশান থেকে সদাশিব গিয়েছিলেন তিরমোহানীর হাটে। সেখানে অনেকগুলি রোগীর আসার কথা ছিল। সেখানে দেখা হল গীতার সঙ্গে। গীতা সেখানে মহুয়া দই বিক্রি করছিল। সে উদ্ভাসিত মুখে সদাশিবের দিকে চেয়ে মাথার কাপড়টা টেনে দিল একটু। তারপর তার পাশেই যে বলিষ্ঠ গুঁপো লোকটি বসে ছিল তাকে ফিসফিস করে কি বললে। নমস্কার করে উঠে দাঁড়াল লোকটি।
“কে তুমি, চিনতে পারছি না তো
“শকলদীপ—”
পাশের একজন পরিচয় করিয়ে দিলে শকলদীপ গীতার স্বামী। শকলদীপ আহীর গোয়ালাদের মিষ্টি ভাষায় মৃদুকণ্ঠে বলল যে সে তাঁরই ভরসায় গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে। একদিন সে তাঁর কাছে যাবে।
“যেও—”
সদাশিব হাটে ঘুরতে লাগলেন। তিরমোহানীর হাটে ভালো পেঁপে পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। সেদিন কিন্তু পেঁপে দেখতে পেলেন না। অন্যান্য তরকারিওলার কাছে খবর পেলাম শিবুর একমাত্র ছেলেটি নাকি মারা গেছে দুদিন আগে। শিবুই হাটে পেঁপে আনত।
“কি হয়েছিল তার ছেলের?’
“মেয়াদী বোখার—”
টাইফয়েড জাতীয় কোন জ্বর হয়েছিল সদাশিবের মনে হল।
“কে দেখছিল?”
“বিলাতী ডাক্টার দৎ সাহেব—”
সদাশিবের আত্মসম্মানে যেন একটু আঘাত লাগল। শিবুর বাড়ির অনেক অসুখ তিনি সারিয়েছেন। আজ শিবু বিলাতী ডাক্তার দৎ সাহেবের কাছে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছে শুনে তাঁর খারাপ লাগল।
দৎ সাহেবের বয়স বেশী নয়, বিলেত থেকে সম্প্রতি ডি. টি. এম. পাস করে এসেছেন। লোকটির চিকিৎসা-নৈপুণ্য আছে কিনা তা এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ, কিন্তু ব্যবসায়-নৈপুণ্য যে আছে তা ইতিমধ্যেই বেশ বোঝা গেছে। অনেক দালাল লাগিয়েছেন, তারা রোগীপিছু কমিশন পায়। তাদের আরও একটা কাজ হচ্ছে আকারে-ইঙ্গিতে প্রচার করা যে সদাশিবকে দিয়ে চিকিৎসা করানো নিরাপদ নয়। তিনি বুড়ো হয়েছে, সেকেলে মতে চিকিৎসা করেন, অনেক কিছু ভুলেও গেছেন। এবং এই কারণেই ‘ফি’ নেন না, ওষুধের দামও দাবি করেন না। এই প্রচারে সদাশিবের অবশ্য ক্ষতি হয়নি, কারণ তিনি লাভের আশায় প্র্যাকটিস্ করতেন না। কিন্তু মাঝে মাঝে কষ্ট হয় তাঁর। মানুষের মনের বিচিত্র মতিগতি দেখে কৌতুকও অনুভব করেন।
…হাট থেকে যখন ফিরলেন তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। প্রায় দুটো। এসে দেখেন দ্বিজেনবাবু বসে আছেন একটা নীল চশমা পরে। দ্বিজেনবাবু একজন মোক্তার। সদাশিবেব সঙ্গে তাঁর ক্বচিৎ দেখা হয়। প্রোটিন খাদ্যের মহার্ঘতা সম্বন্ধে আলোচনা করেন-“আজকাল পাকা রুই সাড়ে তিন টাকা সের, মাংসও তাই। ভালো ডিম এক টাকায় সাতটা বা বড়জোর আটটা। দুধ টাকায় পাঁচপো। তাই কিনে খাই, কি আর করব। যা রোজগার করি খাওয়াতেই যায়। ভিটামিনের জন্য ফলও খেতে হয় কিছু—লেবু, বেদানা এই সব। শসা-টসা আমার রোচে না। খেয়েই সর্বস্বান্ত হলাম মশাই”—বলেই অধরোষ্ঠের সহযোগে আক্ষেপসুচক ‘মছ’-গোছের একটা শব্দ করেন। তার চেহারাটি কিন্তু খাদ্যপুষ্ট নয়। চোখের কোল বসা, গালের হাড় উঁচু, নাকটা খাঁড়ার মতো। দেখলেই মনে হয় বুভুক্ষা যেন মূর্তিমতী হয়ে রয়েছে তাঁর চেহারায়।
“নমস্কার ডাক্তারবাবু, অনেকক্ষণ থেকে বসে আছি আপনার অপেক্ষায়—”
“নমস্কার। হঠাৎ এ সময়ে কেন?”
“চোখটাতে ভালো দেখতে পাচ্ছি না কদিন থেকে। নতুন বিলেতফেরত ডাক্তারটার কাছে গিয়েছিলাম, এক কাঁড়ি টাকা খরচ হল খালি, চোখের তো কোনও উপকার দেখছি না।”
“বসুন দেখছি।”
তখনই ভালো করে পরীক্ষা করলেন চোখটা। দেখে তাঁর যা মনে হল তা বলতে পারলেন না তিনি দ্বিজেনবাবুকে। যে ব্যক্তি বরাবর বড়াই করে এসেছেন যে ভালো ভালো খাবার খেয়েই তিনি সর্বস্বান্ত তাঁকে কি করে বলা যায় যে ভালো খাদ্যের অভাবেই তাঁর চোখের এই দশা হয়েছে। তাঁর মনে পড়ল তাঁর এক বন্ধু জ্ঞানবাবুর কথা। জ্ঞানবাবু একবার বলেছিলেন-“এটা সার জেনে রেখো পেট না মারলে মধ্যবিত্ত বাঙালীর পক্ষে পয়সা জমানো অসম্ভব। যারা মুখে বলে হাতি খাচ্ছি ঘোড়া খাচ্ছি তারা জেনো বাহাদুরি করছে। ছেলে পড়িয়ে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে, বাড়িভাড়া গুনে আর লোক-লৌকিকতা করে কটা পয়সা বাঁচে যে খাবে? জান, অনেক বাড়িতেই দাই চাকর নেই, অনেক বাড়িতেই দুবেলা রান্না হয় না। সব জানা আছে আমার। সুতরাং পয়সা যদি বাঁচাতে চাও নোলাটি কমাও।”
জ্ঞানবাবুর এ সারগর্ভ উপদেশ সদাশিব পালন করেননি। দ্বিজেনবাবুর চোখ দেখে জ্ঞানবাবুর কথাগুলো অনেকদিন পরে মনে পড়ল। হয়তো এতদিন লোকটা মিথ্যে বাহাদুরি করে এসেছে।
“কি দেখলেন চোখে?”
“হ্যাঁ, একটু খারাপ হয়েছে। আপনি ডিম আর দুধ কি ভাবে খান?”
“দুধের ক্ষীর আর ডিমের ডালনা।”
“এফ্লিপ্ করে খাবেন। আধকাপ দুধে একটা কাঁচা ডিম মিশিয়ে তাই ঢক করে খেয়ে ফেলবেন রোজ সকালে–”
“আঁশটে গন্ধ ছাড়বে যে—”
“নাক টিপে ওষুধের মতো খেয়ে নেবেন।”
“ওষুধ দেবেন না কিছু?”
“দিচ্ছি—”
সদাশিবের কাছে ভিটামিনের স্যাম্পল ছিল নানারকম। সেইগুলোই দিয়ে দিলেন।
“আপাতত এইগুলো খেয়ে দেখুন। যদি না কমে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে
“আপনার ফি— আর ওষুধের দাম—”
“না, ওসব দিতে হবে না। এখন আমি কেবল ডাক্তারি করি, ডাক্তারি ব্যবসা অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি—”
“আচ্ছা, তাহলে চলি। অনেক ধন্যবাদ। নমস্কার।”
দ্বিজেনবাবু চলে গেলেন।
আজবলাল আড়ালে এতক্ষণ ‘টাইম-বমে’র মতো চুপ করে ছিল। দ্বিজেনবাবু চলে যাবার পর বিস্ফোরণ হল।
“মালতী দিদি চলে যাবার পর থেকে আপনি বাবু শরীরের উপর বড়ই জুলুম লাগিয়েছেন। আমাকে শেষে জবাবদিহিতে পড়তে হবে।”
“দাও, খাবার দাও—”
“চান করবেন না? গরম জল তৈরি আছে—”
“না থাক।”
এতে অসন্তুষ্ট হল আজবলাল। তার চোখ-দুটো ঈষৎ বিস্ফারিত হল। এই না-চান-করাটাও সে শরীরের উপর আর একটা জুলুম বলে গণ্য করলে। কিন্তু কিছু বলতে সাহস করলে না আর। হন হন করে ভিতরের দিকে চলে গেল।
খেতে বসে সদাশিব তাই লক্ষ্য করলেন, মালতী চলে যাওয়ার পর থেকে যা রোজই লক্ষ্য করছেন। আজবলাল অনেকরকম রান্না করেছে,— মাছ, মাংস, লাউ, কুমড়ো, আলুর দম, শুক্তো, চচ্চড়ি, ডালনা, অম্বল কিচ্ছু বাদ দেয়নি। তার চেষ্টা মালতীর অভাবে তিনি যেন কষ্ট না পান। আজবলাল রাঁধে ভালো, কেবল তার মসলার হাতটা একটু বেশী। সে আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করে কোন্ তরকারিটা কেমন হয়েছে।
“মাংসা সিদ্ধ হয়েছে তো বাবু? আজ মাংসটা খুব কচি ছিল না।”
“বেশ হয়েছে মাংস। খুব নরম হয়ে গেছে—”
“মাছের ঝালটা দেখুন তো, দিদিমণির মতো পেরেছি কি—”
“চমৎকার হয়েছে…”
প্রতিটি জিনিসের প্রশংসা না করলে আজবলাল মনে মনে দুঃখিত হয়। একবার খুব ঝাল হয়েছিল বলে মাংসের বাটিটা সদাশিব ঠেলে দিয়েছিলেন, খাননি। আজবলালও খায়নি সেদিন। শুধু তাই নয়, তার পরদিন এসে বলেছিল— “আমি বুড়ো হয়েছি বাবু, সত্যিই আর রাঁধতে পারি না। আমাকে এবার ছুটি দিন।”
সদাশিব শুধু একটা কথা বলেছিলেন—“মালতী চলে গেছে, সোহাগ চলে গেছে, তুমি যাবে? যেতে চাও যাও। ওদের আটকাইনি, তোমাকেও আটকাব না।”
আজবলাল আর যায়নি। শুধু যে যায় নাই তাই নয়, তারপর থেকে অপ্রত্যাশিত একটা পরিবর্তন ঘটেছে তার চরিত্রে। বহুদিনের কু-সংস্কার সে বর্জন করেছে। আজবলাল মুরগির মাংস ছুঁতো না। মুরগির মাংস মালতী রাঁধত আলাদা উনুনে। মালতী চলে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে বাবুর্চি আনিয়ে সদাশিব মুরগি রান্না করেছেন। হঠাৎ আজবলাল একদিন বললে–“বাবুর্চিকে ডাকবার দরকার নেই। আমিই পাখি রেঁধে দেব। রেঁধে না হয় চনে করে নেব। রোজ রোজ আপনার খাসির মাংস খাওয়ার দরকার নেই। মুরগি খেলে যখন ভালো থাকেন, আমি রেঁধে দেব”
তারপর থেকে আজবলাল রোজ মুরগি রাঁধছে।
খেতে খেতে সদাশিব জিগ্যেস করলেন, “মহেন্দ্রবাবুর খাবার রোজ পাঠাচ্ছ তো?”
“হ্যাঁ। ছানা পাঠাই রোজ আধসের দুধের। উনি বলে পাঠিয়েছেন ওঁর জন্যে আলাদা করে ছোট মাছ পাঠাবার দরকার নেই। বাড়িতে যা রান্না হয় তাই পাঠালেই চলবে। ওঁকে মাছ মাংস সবই দিই—”
মহেন্দ্রবাবু মানে সেই ‘হিপো’ যাঁকে একদিন সদাশিব বেছে বেছে চারটি ছোট ছোট মাছ কিনতে দেখেছিলেন। এখন তিনি সদাশিবের চিকিৎসাধীন আছেন। সদাশিব তাঁকে আর বাজার করতে দেন না, আজবলালকে বলে দিয়েছেন তাঁকে যেন খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সদাশিবের মনে হল অনেকদিন তাঁর খবর নেওয়া হয়নি। কেমন আছেন ভদ্রলোক কে জানে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন