হাটে বাজারে – ১৯

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। উনিশ।।

সদাশিব অনুভব করলেন তিনি যেন কার কোলের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন।

তিনি জিগ্যেস করলেন—“কে—”

“আমি ছিপলী—”

ছিপলীই তাঁর মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছিল।

“এখনও কি রাত পোহায়নি?”

গীতিয়া বললে “অনেকক্ষণ সকাল হয়ে গেছে।”

“কই, আমি তো আলো দেখতে পাচ্ছি না—”

সদাশিবের চোখের ভিতর হেমারেজ হয়েছিল। তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

শহর থেকে একজন ডাক্তার এসেছিলেন। তিনি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেন।

সদাশিব যেতে চাইলেন না।

আস্তে আস্তে বললেন, “আমি এখান থেকে কোথাও যাব না।”

.

খবরটা ছড়িয়ে পড়ল দেখতে দেখতে।

হাটের লোক, বাজারের লোক ভেঙে পড়ল ছিপলীর বাড়িতে।

বাঙালীরা কেউ যাননি। তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল অবশ্য। কেউ বললেন, লোকটা একসেন্‌ট্রিক, কেউ বললেন, বাহাদুরি করতে গিয়েই মৃত্যু হল লোকটার, কারও মতে আসলে উনি চরিত্রহীন লোক ছিলেন, হাটে-বাজারে যুবতী মেয়েদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াতেন। এর নজীরস্বরূপ তিনি হ্যাভলক এলিস, ফ্রয়েড থেকে বচন উদ্ধৃত করলেন। বাঁড়ুয্যে মশাই-ই নাকি কেবল বলেছিলেন—”উনি নররূপী দেবতা ছিলেন।” ডি. আই. জি. ছিপলীর বাড়ির চারদিকে সশস্ত্র পুলিস মোতায়েন করে দিয়েছিলেন। আলী হাউ হাউ করে কাঁদছিল কেবল। গীতিয়া, কেব্‌লী, নারাণও কাঁদছিল। সবারই চোখে জল।

.

আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিলেন সদাশিব। মাঝে মাঝে প্রলাপ বকছিলেন।

“কে আবদুল, জ্বর ছেড়েছে? এখন বাজারে যেও না, দু’দিন বিশ্রাম নাও”

“ফালতু তোর কামিজটা তো ঠিক ফিট্ করেনি। রমজান দরজির কাছে যাস, সে মাপ নিয়ে নেবে একটা—”

“না, মঙ্গলদাস, নুনটা তুমি ছেড়েই দাও। নুন খাচ্ছ বলেই পা দুটো ফুলছে। নুন ছেড়ে দাও। দুধ-ভাত খাও—”  

“কে, আবদুলের মা? নানি তোর চোখ ঠিক করে দিতে পারলাম না। আমি অন্ধ হয়ে গেলাম।”

“নারাণ নাকি, কেব্‌লী বলেছে ভালোভাবে থাকবে এবার।”

“ও কে? সরখেল মশাই, ইলিশ মাছ পেয়েছেন? বা:-

“আজবলাল এসেছে? আজ ফিস্ট লাগাও একটা। সবাই খাক। ভালো মাছ মাংস পাঠিয়ে দিচ্ছি”

“মহেন্দ্রবাবু নাকি? সেরে গেছেন? রসগোল্লা খেয়ে সেরে গেলেন? এ তো বড় আশ্চর্য! রোগা হয়ে গেছেন দেখছি। আমার মনে হয় কিন্তু রসগোল্লাটা বেশী না খাওয়াই ভালো—”

“মালতী? কেদার-বদরি ঘুরে এলি? বাঃ, কাশ্মীর কেমন লাগল? ভালো তো লাগবেই, ভূ-স্বর্গ ওর নাম। এইবার দাক্ষিণাত্যে বেড়িয়ে আয়। কন্যাকুমারী শুনেছি অপূর্ব”

কে ভগলু মহলদার? সন্দেশ এনেছ? তোমার বেটীর সাদি হয়ে গেল। বাঃ বাঃ। থাক আর প্রণাম করতে হবে না।”

“ছিপলী আমার রিভলবারটা তুই রেখে দে। তোর নামে লাইসেন্স করিয়ে দেব। ওটা সঙ্গে থাকলে কেউ আর কিছু বলতে পারবে না।”

“গীতিয়ার স্কুলটাকে আরও বড় করতে হবে। গীতিয়া পারবি তো? তুইও পড়, প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাস করে ফেল—”

“মনু? ওই দেখ, তোমার জন্যে জর্দা আনতে ভুলে গেলাম। তোমার কাশীর জর্দার কৌটোটা আলমারির মধ্যে আছে। ভেবেছিলাম নিয়ে আসব। সোহাগ বিলেতে চলে গেছে, সেখানেই বাড়ি করেছে, সুখে আছে—”  

ক্রমশ প্রলাপও বন্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট দুটো নড়ত খালি, কি বলতেন কিছু বোঝা যেত না।

দিন দুই পরে তাঁর মৃত্যু হল।

মালতী বা সোহাগকে খবর দিতে পারা যায়নি। ছিপলীই তাঁর মুখাগ্নি করল।

***

অধ্যায় ১৯ / ১৯

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন