হাটে বাজারে – ২

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। দুই।।

ডাক্তার সদাশিবের মতো লোক সাধারণত দেখা যায় না। কোনো ভালো জিনিসই সাধারণের পর্যায়ে পড়ে না। হীরা-মুক্তা খোলামকুচির মতো পড়ে থাকে না পথেঘাটে। খনির অন্ধকারে অথবা সমুদ্রের অতলে ওদের জন্ম হয়, রহস্যময় উপায়ে। প্রচণ্ড চাপে কয়লা হীরকে পরিণত হয়, ঝিনুকের ভিতর সূক্ষ্ম বালুকণা প্রবেশ করে সৃষ্টি করে মুক্তা। প্রচণ্ড চাপ অথবা বালুকণার প্রদাহ না থাকলে হীরা-মুক্তার জন্ম হত না। সদাশিবের জীবনেও চাপ এবং প্রদাহ এসেছিল, কিন্তু সে তো অনেকের জীবনেই আসে, সবাই কি সদাশিব হয়? সদাশিবের সদাশিবত্বের সম্ভাবনা নিগূঢ়ভাবে সুপ্ত ছিল তাঁর চরিত্রে, পরিবেশের প্রভাবে তা পরিস্ফুট হবার সুযোগ পেয়েছিল।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটা নিহিত কারণ থাকে পূর্বপুরুষদের জীবনধারায়। সদাশিবের পূর্বপুরুষদের সকলের খবর জানা নেই, কিন্তু সদাশিবের প্রপিতামহ সুরেশ্বর শর্মা একজন গৃহী সন্ন্যাসী ছিলেন একথা অনেকে জানে। রবীন্দ্রনাথের একজন পূর্বপুরুষ যেমন ‘ঠাকুর’ নামে খ্যাত ছিলেন, তেমনি ‘দেবতা’ বলে বিখ্যাত হয়েছিলেন সুরেশ্বর শর্মা। সবাই তাঁকে ‘দেবতা’ বলে ডাকত। বৈষ্ণব সাধু হয়েছিলেন তিনি। তাঁর কয়েকটা বিশেষত্ব ছিল। তাঁর নিজের খাবারটা তিনি বিতরণ করে দিতেন। তিনি সামান্য দুধ এবং ফল খেয়ে থাকতেন। সংসার থেকে তাঁকে যে খাবারটা দেওয়া হত সেটা তিনি পালা করে একজন গরীবকে ডেকে খাওয়াতেন। আর স্বহস্তে সেবা করতেন সেই গাভীটিকে যার দুধ খেতেন তিনি। যে গাছগুলি তাঁকে ফল দিত তাদেরও সেবা করতেন। গাইটিকে নিয়ে বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা বাগানে বাস করতেন তিনি। সেইখানেই দিবারাত্রির অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতেন সাধন ভজন করে। কিছু জমি ছিল তাতেই সংসার চলে যেত। উদরান্নের জন্য চাকরি বা ব্যবসা তাঁকে করতে হয়নি।

তাঁর ছেলে পীতাম্বরকে কিন্তু করতে হয়েছিল। তিনিই প্রথম গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যান একটা মার্চেন্ট আপিসের কেরানী হয়ে। প্রথমে দিনকতক একটা মেসে ছিলেন, তারপর বাগবাজারে গলির গলি তস্য গলির মধ্যে ছোট বাসা ভাড়া করেন একটা। সে বাসা আর তাঁরা ছাড়েননি। পুরুষানুক্রমে সেই বাসাতেই বাস করছেন।

সদাশিবের জন্ম ওই বাসাতেই হয়েছিল। কলকাতা শহরেই বাল্য ও যৌবন কেটেছিল তাঁর। ওইখানেই তিনি স্কুল আর কলেজের পড়া শেষ করে মেডিকেল কলেজে ঢোকেন। মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করার আগেই বিয়ে হয়েছিল সদাশিবের। যখন বিয়ে হয়েছিল তাঁর বয়স বাইশ আর স্ত্রী মনুর (মনোমোহিনী) বারো।

নববধূরা তখন পায়ে পায়জোর নুপুর আর মল পরত। ঝুমঝুম করে শব্দ হত যখন ঘুরে ফিরে বেড়াত তারা। গুরুজনদের দেখলে ঘোমটা টেনে দিত। পায়ে আলতা পরত, গোল খোঁপার মাঝখানে পরত সোনার চিরুনি, খোপাকে ঘিরে থাকত বাহারে ফুল-তোলা কাঁটা। খোঁপার বিনুনিই ছিল কত রকম! মনুর এই ছবিটা এখনও মনে পড়ে সদাশিবের। পাঁয়জোর আর মলের ঝুমঝুম শব্দ এখনও শুনতে পান তিনি। বিশেষ করে একটা ছবি তাঁর মনে অক্ষয় হয়ে আছে। মনু যখন রাত্রে শুতে আসত তখন তার মুখ অদ্ভুত একটা ভাব ফুটে উঠত। ঠিক সলজ্জ ভাব নয়, একটু লজ্জার আভাস থাকত অবশ্য, কিন্তু ভাবটা ঠিক সলজ্জ নয়, দুষ্টু-দুষ্টু। মাথার ঘোমটা সরে যেত তখন। উপরের দু-তিনটি দাঁত দিয়ে কামড়ে থাকত পানে-রাঙা নীচের ঠোঁটটি। ভ্রূযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত, চক্ষু আনত, আর সমস্ত মুখে চাপা হাসির আভাস। সদাশিব ডাকলে বাঁ হাতের ছোট্ট কিল তুলে দেখাত। এই ছবিটি অম্লান হয়ে আছে সদাশিবের মনে।

সদাশিব পাস করেই চাকরি পেয়েছিলেন। অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছিল তাঁকে। চাকরি- জীবনেরও অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি গাঁথা আছে তাঁর মনে। অনেক এবং বিচিত্র। সদাশিব রিটায়ার করেছিলেন বিহারেরই একটা শহরে। সেইখানেই বাড়ি কিনেছেন একটা। আশেপাশে কিছু জমিজমাও। ব্যাঙ্কে টাকাও জমিয়েছেন। জমানো টাকার যা সুদ পান তাতেই সংসার চলে যায় স্বচ্ছন্দে। সংসারে খাবার লোকও বিশেষ কেউ নেই। মনু যৌবনেই মারা গেছে। একটি মাত্র সন্তান হয়েছিল, মেয়ে। সোহাগিনী। সোহাগিনীর বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন আগে। জামাই সুজিত বড়লোকের ছেলে, বড় চাকরিও করে। বছরে দু’বার তারা সদাশিবের কাছে আসে কেবল। প্রকাণ্ড বাড়িটায় সদাশিব থাকেন তাঁর ভাইপো আর ভাইপো-বউকে নিয়ে।

ভাইপো চিরঞ্জীব কোন কাজকর্ম করে না। সদাশিবের জমিজমার তদারক করে সে, তাঁর নানারকম ফাইফরমাশও খাটে। এককথায় চিরঞ্জীব সদাশিবের প্রাইভেট সেক্রেটারি। সদাশিবের বৈষয়িক ঝামেলা এবং চারিত্রিক খামখেয়ালের সমস্ত ঝঞ্ঝাট সে-ই পোয়ায়। চিরঞ্জীবের বউ মালতীও নিঃসন্তানা। ঘরকন্নার ভার তার উপর। চাকর দাই রাঁধুনী সব আছে, কিন্তু কর্ত্রী সেই। মালতী মোটাসোটা কালো রং। চোখ দুটি বড় বড়। শরীর বেশ আঁটসাঁট। ঈষৎ স্থূলাঙ্গিনী, কিন্তু বেশী মোটা নয়। বেশ রাশভারী। চিরঞ্জীব তো বটেই, সদাশিবও ভয় করেন তাকে। সদাশিব আর একটা কারণেও তাকে সমীহ করেন—সে রাঁধে ভালো। নিরামিষ আমিষ দু’রকম রান্নাতেই সিদ্ধহস্ত। খাদ্যরসিক সদাশিব তার এ প্রতিভাকে খাতির না করে পারেন না। রোজ একটা তরকারি নিজের হাতে করে সে। বাকী রান্না ঠাকুরকে দিয়ে করায়। ঠাকুরকে দিয়ে করায় বটে, কিন্তু ঠাকুরের পিছনে সে দাঁড়িয়ে থাকে নিজে মহিষমর্দিনীর মতো, এক চুল এদিক ওদিক হবার উপায় থাকে না। মৈথিল ঠাকুর আজবলাল মালতীর তত্ত্বাবধানে থেকে প্রথম শ্রেণীর রাঁধিয়ে হয়েছে। সে-ও মালতীকে ভয় করে খুব। মুখে যদিও বলে ‘লছমি মাঈ’, কিন্তু মনে মনে জানে ও একটি বাঘিনী। একটু বেচাল হলেই প্রচণ্ড ধমক দেয়।

আজবলাল সদাশিবের কাছে অনেকদিন আছে। মনুর আমল থেকে। আট টাকা মাইনেতে বাহাল হয়েছিল। এখন তার সঙ্গে আর মাইনের সম্পর্ক নেই। ঘরের লোক হয়ে গেছে, যখন যা দরকার হয় নেয়। বিকেলের দিকে একটু সিদ্ধি খায় সে। ওইটুকুই তার বিলাস। বেশ তরিবৎ করে সিদ্ধির শরবৎটুকু খায়। সদাশিব আপত্তি করেননি। সিদ্ধি খেয়ে আজবলালই বিপদে পড়ে মাঝে মাঝে। কোন কোন দিন মনে হয় সে মালতীর চেয়ে অনেক বড়, প্রায় তার বাপের বয়সী, তার মেয়ে জানকী বেঁচে থাকলে অত বড়ই তো হত, সে কেন মালতীর ভয়ে গরুড়টি হয়ে থাকবে চিরকাল, মালতীরই বরং উচিত তাকে ভয় করা। মেয়েছেলের অমন খাণ্ডারনী হওয়া কি ভালো? তার উচিত মালতীকে বুঝিয়ে দেওয়া যে মেয়েমানুষের বেশী ‘তেজ’ হওয়া ঠিক নয়। সিদ্ধির ঝোঁকে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সে মালতীকে বোঝাতে যায় এবং বোঝাতে গিয়ে আরও বকুনি খায়। নিজেই শেষে সে বুঝতে পারে জল দিয়ে ধুয়ে লালজবাকে সাদাজবা করা যায় না।

.

কিছুদিন আগে সদাশিব যখন চাকরি থেকে অবসর নেন তখন তিনি অতীতের দিকে চেয়ে খোঁজবার চেষ্টা করেছিলেন জীবনে তাঁর এমন কোন প্রকৃত বন্ধু বা আত্মীয় আছে কিনা যার কাছে গিয়ে তিনি বাকী জীবনটা আনন্দে কাটাতে পারেন। যন্ত্রের ইঞ্জিন তেল, কয়লা বা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে। মানুষ ইঞ্জিনের সেটা দরকার, কিন্তু তার আর একটা জিনিস চাই, ভালোবাসা। কেবল টাকার জোরে সুখে থাকা যায় না। বেঁচে থাকবার প্রেরণা চাই একটা, সে প্রেরণার উৎস হওয়া চাই মহৎ কোন দার্শনিক জিজ্ঞাসা অথবা ভালোবাসা।

সদাশিবের জীবনে কোন দার্শনিক জিজ্ঞাসার টানে জোয়ার আসেনি কখনও। তিনি সারাজীবন চাকরি করেছেন এবং ডাক্তারি করেছেন। নামকরা ডাক্তার ছিলেন অবশ্য, যেখানেই গেছেন তাঁর পসারের ‘গর্জন’ শুনেছে সবাই। কিন্তু নামকরা ডাক্তাররা ঠিক বৈজ্ঞানিক নন। তাঁরা অপর বৈজ্ঞানিকদের আবিষ্কারকে প্রয়োগ করেন মাত্র। প্রয়োগ করে পয়সা রোজগার করেন। তাঁরা অনেকটা কেরানীর মতো। আবিষ্কর্তা বৈজ্ঞানিক যে প্রেরণার আনন্দে বিভোর হয়ে থাকেন, সে আনন্দে কখনও স্পর্শ করে না সাধারণ জেনারেল প্র্যাকটিশনার ডাক্তারের চিত্তকে। জেনারেল প্র্যাকটিশনারের একমাত্র লক্ষ্য জনপ্রিয় হওয়া এবং জনপ্রিয় হওয়ার উদ্দেশ্য উপার্জন। বৈজ্ঞানিকের লক্ষ্য সত্যের সন্ধান এবং প্রয়োজন হলে তার জন্যে দারিদ্র্য এবং অপমান বরণ করা।

এ প্রেরণা সদাশিবের জীবনে আসেনি কখনও। তিনি টাকা রোজগার করতেই চেয়েছিলেন এবং প্রচুর টাকা রোজগার করতে পেরেওছিলেন। কিন্তু টাকা রোজগার করতে করতে জীবনের শেষের দিকে এসে হঠাৎ তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে—এসব কিসের জন্যে করছি? কার জন্যে? মনু তো চলে গেছে অনেকদিন আগে, সোহাগেরও বিয়ে হয়ে গেছে—তবে? কিসের জন্যে এত পরিশ্রম, এত দুশ্চিন্তা? অতীতের দিকে ফিরে তিনি অনুভব করলেন ভালোবাসার মতো আর কেউ বেঁচে নেই। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব যারা বেঁচে আছে, তারা নামেই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব। প্রেম নেই কারো মনে। আছে হিংসা, পরশ্রীকাতরতা আর তার উপর একটা প্রেমের ভান। ঝুটো প্রেমের মেকি অভিনয়ে মন আরও বিষিয়ে ওঠে।

যে অদ্ভুত জীবন ডাক্তার সদাশিব আজকাল যাপন করেন—হাটে বাজারে ঘুরে বেড়ানো—সে জীবন আরম্ভ করবার আগে যে জীবন তিনি যাপন করতেন তার কিছু আস্বাদ না পেলে বর্তমান জীবনের সম্যক্ অর্থ বোঝা যাবে না। সে জীবনের কিছু আভাস পাওয়া যায় তাঁর ডায়েরিতে। স্থান এবং তারিখের উল্লেখ না করে তারই ঘটনাগুলি উদ্ধৃত করছি। ঘটনাগুলি একটানা ঘটেনি। মাঝে মাঝে সময়ের ব্যবধান আছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন