হাটে বাজারে – ১৭

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। সতেরো।।

নবীপুরের হাটে দেখা হল কেব্‌লী আর কেব্‌লীর স্বামী নারাণের সঙ্গে। কেব্‌লী একটি নূতন শাড়ি হলুদ রঙে ছুপিয়ে পরেছে, নারাণের পরনেও একটি গোলাপী রঙের ধুতি। নারাণ এগিয়ে এসে প্রণাম করল সদাশিবকে। কেব্‌লী তার পিছনে দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।

“কি নারাণ, কি খবর, হঠাৎ প্রণামের ধুম কেন?”

“সাধি ভে গেলে হুজুর”

কেব্‌লী মুখে কাপড় দিয়ে খুব হাসতে লাগল। নারাণের দ্বিতীয়পক্ষে বিয়ে হওয়াতে সে যে দুঃখিত হয়েছে তা মনে হল না।

ধী-বিশালের দোকানের দিকে গেলেন সদাশিব। মঙ্গলদাসের খবর নিলেন। মঙ্গলদাস ভালো আছে। কিন্তু আবার জল জমেছে পেটে।

“ও তো জমবেই। ও অসুখ সারবে না। বেশী জল জমলে আবার বার করে দিতে হবে। এইভাবে যে কদিন চলে।”

ধী-বিশাল বললে মঙ্গলদাসও সে কথা বুঝেছে। তার বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা নাম-সংকীর্তন হচ্ছে। তারপর ধী-বিশাল নিম্নকণ্ঠে বললে, সেই বদমাস ছোকরা তিনটে পুলিসের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে। কাল সন্ধ্যের সময় তার দোকানের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ধী-বিশাল ভয় খেয়ে তিনজন তীরন্দাজ সাঁওতাল বাহাল করেছে দোকান পাহারা দেবার জন্যে।

“তুমি থানাতেও একটা ডায়েরি করিয়ে দাও—”

“আচ্ছা–”

হাটে অনেক রোগী অপেক্ষা করছিল মোটরের আশেপাশে। সদাশিব সেইদিকে গেলেন। ভিড়ের মধ্যে দেখলেন, কেব্‌লী দাঁড়িয়ে আছে, নারাণ সঙ্গে নেই।

ভিড় কমে যাবার পর কেব্‌লী কাছে এসে ফিসফিস করে বললে, দু’ নৌকোয় পা দিয়ে নারাণ এখন মহাবিপদে পড়েছে। নারাণের মা ওই কানী বিধবাকে ঘরে নিতে চাইছে না। আর ওই কানীর বাবা যে জমি দেবে বলেছিল সে জমিও দেয়নি। সে বলেছে আগে দেখি আমার মেয়ের সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করে, তবে জমি লিখে দেব।

“তোকে তো জমি দেবে বলেছিল, তাও দেয়নি?”

“না—”

“তুই কিছু বললি না?”

“কানী হামরা মারে লে দৌগেছে। বড় বরিয়ার ছে। হাম্ ভাগীকে চললো আইলি। বড় মারখুণ্ডা ছে। ওকরো ভী মারেলা দৌগেছে—”

“কানী বিধবাকে বিয়ে করে নারাণ তো তাহলে মহাবিপদে পড়েছে। কোথায় আছে এখন ও?” “হিয়াঁই। কাঁহা যাইতে—

মুখ ফিরিয়ে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কেব্‌লী হাসতে লাগল। তারপর সে আসল কথাটি ভাঙল। আবার পঞ্চ ডাকা হয়েছে। কেব্‌লীর প্রাপ্য জমি তাকে দেওয়া হবে কিনা সেই ‘পঞ্চ’ঠিক করবে। সেই পঞ্চের দু’ জন মাতব্বর লোক সদাশিবকে খুব খাতির করে। তাদের কঠিন কঠিন অসুখ সদাশিবই নাকি একদিন সারিয়েছিলেন। তারা আবার ওষুধ নিতে সদাশিবের কাছে আসবে। তখন সদাশিব যদি তাদের একটু বলে দেন তাহলে কেব্‌লী জমিটা পেয়ে যাবে।

সদাশিব বললেন, “কবে কার অসুখ সারিয়েছি আমার তো কিছু মনে নেই!”

কেব্‌লী মনে করিয়ে দিলে তিনি তখন সরকারী কাজ করতেন। একজনের ‘পোতা’ (হাইড্রোসিল) আর একজনের ‘গুরা’ (ফোড়া) কেটেছিলেন। সদাশিবের মনে পড়ল না। বললেন, “আচ্ছা আমার কাছে আসে তো বলব। নারাণ আর একটা বিয়ে করেছে বলে তোর দুঃখ হয়নি একটুও—”

“দুঃখ করি কে কি করবো। ওই সেই ওকরো মতি-গতি আর হম্বা কপার

কেব্‌লী খানিকক্ষণ ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ল, তারপর চলে গেল।

তারপর এল কয়েকটা ছোট ছেলে। ফরসা জামা-কাপড় পরা। সদাশিব তাদের চোখ দেখলেন, দাঁত দেখলেন, খুশী হলেন খুব।

“আলী, এদের প্রত্যেককে দুটো করে সন্দেশ দাও –”

আসবার সময় দীনু হালুয়াইদের দোকান থেকে সের দুই সন্দেশ কিনে এনেছিলেন। তারা সন্দেশ নিয়ে কলরব করতে করতে চলে গেল।

“আলী—”

“হজৌর–”

আলী এসে সামনে দাঁড়াল।

“তুমি সন্দেশ খেয়েছ?”

আলীর মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে সে মৃদুকণ্ঠে বলে—“হুজুর হুকুম নেহি দেনে সে কৈসে খায়েঙ্গে?”

“খাও চারটে সন্দেশ। আজ আমাদের রান্নার ব্যবস্থা কি করেছ? হাটে মাছ তেমন পেলে কি?”

“নেই হুজুর। মুরগী লেয়া দোঠো।”

“মুরগির ঝোল আর ভাত বানাও আজকে।”

“বহুত খু—”

“বেশী মসলা দিও না। সাদা ঝোল বানাও—”

“বহুত খু—”

“কোথায় রাঁধবে আজ? ওই বড় তালাওটার ধারে চল—”  

“বহুত খু—”

আলী কয়েক মুহূর্ত ঘাড়টা একদিকে বেঁকিয়ে এবং দুটি আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে রইল, যেন সমস্ত ব্যাপারটা প্রণিধান করে ফেলল। তারপর মোটরের পিছনে চলে গেল।

সদাশিব উঠতে যাবেন এমন সময় দেখতে পেলেন নারাণ আসছে। একা আসছে। সঙ্গে কেব্‌লী নেই।

“কি নারাণ, আবার এলে যে—”  

নারাণ একটু চুপ করে রইল, তারপর বললে—গোপনে সে তাঁকে একটা কথা বলতে চায়। এতক্ষণ সে হাটে অপেক্ষা করছিল। রোগীর ভিড় কমে যাবার পর এসেছে।

“কি কথা—”

নারাণ হিন্দীতে বললে—“আপনি কেব্‌লীকে একটু শাসন করে দিন। ও একটা সিপাহীর সঙ্গে বড্ড বেশী মাখামাখি করছে। ভেবেছিলাম ‘দোসরা’ একটা ‘সাধি’ করে আমি আলাদা সরে থাকব, ও যা খুশী করুক। কিন্তু আমার মা ওই কানী বিধবাকে কিছুতেই ঘরে নিতে চাইছে না। আমাকে বাধ্য হয়ে কেব্‌লীর কাছে ফিরে আসতে হয়েছে। কিন্তু কেব্‌লী যদি একটা সিপাহীর সঙ্গে লপট্ করে তাহলে তো বরদাস্ত করতে পারি না। শেষকালে একটা খুনোখুনি কাণ্ড হয়ে যাবে একদিন।”

সদাশিব প্রশ্ন করলেন, “এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি? ও তোমাদের ঘরোয়া ব্যাপার, তোমরাই ঠিক কর—’’

হঠাৎ নারাণ সদাশিবের পা জড়িয়ে ধরল—

“আপ একদফে কহ্ দেনে সে সব ঠিক হো যায়ে গা। উ আপকো বাপকো এইসা মানতা

হয়।”

হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল নারাণ।

সদাশিব বললেন, “ওকে যদি চরিত্রহীন বলে মনে হয়, ছেড়ে দাও না ওকে—”  

নারাণ বললে কেব্‌লীকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না।

“আবার বিয়ে তো করতে গেছলে—”

নারাণ নিজেই নিজের দুকান মলে গালে ঠাস ঠাস করে চড়াতে লাগল।

“কসুর হো গিয়া হুজুর। কসুর হো গিয়া—”

সদাশিব বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। শেষে বললেন, “আচ্ছা, আমি শাসন করে দেব। কিন্তু আমার কথা শুনবে কি?”

“জরুর শুনে গা, জরুর শুনে গা, উস্‌কো বাপ শুনে গা—”  

একটু পরেই রাস্তায় কেব্‌লীর সঙ্গে দেখা হল। সে একাই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল হাট থেকে কিছু তরি-তরকারি কিনে। সদাশিব মোটর থামালেন। নামলেন মোটর থেকে। কেব্‌লীকে ডেকে নিয়ে গেলেন একটু দূরে।

“শুনছি তুই কোন্ এক সিপাহীর সঙ্গে লপ লাগিয়েছিস্?”

কেব্‌লী ঘাড় ফিরিয়ে একটু বেঁকে দাঁড়িয়ে রইল মুখে আধঘোমটা টেনে।

সদাশিব সংক্ষেপে বললেন “ফের যদি শুনি চাবকে তোর পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে ফেলব। মনে থাকে যেন; কথাটা মনে থাকবে তো?”

কেব্‌লী সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাৎ করে জানাল, থাকবে।

সদাশিব ফের এসে মোটরে উঠলেন।

হঠাৎ একটা নির্মল আনন্দে তাঁর সমস্ত মন ভরে গেল যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি এদের যথার্থ আত্মীয় হতে পেরেছেন—এই উপলব্ধিতে তন্ময় হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন