বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
নবীপুর হাটে সদাশিব সেদিন একটা নাটকীয় কাণ্ড করে বসলেন। ডাক্তারি-বিদ্যার প্রয়োগ হিসাবে তাতে অসাধারণত্ব কিছুই ছিল না। কিন্তু হাটসুদ্ধ লোক চমৎকৃত হয়ে গেল, হাট ভেঙে যাবার উপক্রম হল প্রায়। সবাই রাধাকিষুণ বাবাজিকে ঘিরে দাঁড়াল এসে। লোকটির নাম রাধাকিষুণ নয়, মঙ্গলদাস। কিন্তু সকলেই তাকে রাধাকিষুণ বলে ডাকে, কারণ রাধাকিষুণ বললে সে ক্ষেপে যায়। প্রকাণ্ড একটা টিকি আছে মঙ্গলদাসের। রাস্তায় বেরুলেই ছেলের দল তার পিছনে লাগে—’টিকি মে রাধাকিষুণ’, ‘টিকি মে রাধাকিষুণ’–বলতে বলতে ছোটে পিছু-পিছু। মঙ্গলদাস দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে যায় তাদের। তারা হৈ হৈ করে হাসতে হাসতে দুড়দাড় করে ছুটে পালায়। এ খেলা অনেকদিন থেকে চলছে। অনেকে বলে, ওই তেড়ে যাওয়াটা মঙ্গলদাসের মেকি রাগ-দেখানো, আসলে ও ছেলেদের মুখে রাধাকিষুণ নামটা শুনতেই চায় বার বার। বাইরে সে কালীসাধক। টিকিতে জবাফুল বাঁধা থাকে। কপালে রক্তচন্দনের ত্রিপুণ্ড্রক। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। লোকে বলে মঙ্গলদাস খুব চালাক লোক। বাইরে সে কালীপূজা করে, আবার ছেলেদের মুখ থেকে রাধাকৃষ্ণের নামটাও শুনে নেয়। গাছেরও খায় তলারও কুড়োয়।
ইদানীং কিছুদিন থেকে মঙ্গলদাসকে আর পথে-ঘাটে দেখা যাচ্ছিল না। কারণ সে একটি সাধক-সঙ্গিনী জুটিয়ে কামরূপে গিয়ে সাধনা করছিল নাকি। কিন্তু সেখানে আর একটি বেশী শক্তিশালী সাধক ছিলেন। মঙ্গলদাসের সাধন-সঙ্গিনী তাঁর খপ্পরে গিয়ে পড়ল। মঙ্গলদাস হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে দিনকয়েক আগে। শুধু যে সাধক-সঙ্গিনীকে হারিয়েছে তা নয়, স্বাস্থ্যটিকেও হারিয়েছে। অতিরিক্ত ‘কারণ’ পান করার ফলে লিভারটি গেছে। প্রকাণ্ড উদরী হয়েছে এখন। সদাশিবের কাছে মঙ্গলদাস এসেছিল কয়েকদিন আগে। সদাশিব বলেছিলেন, এ রোগ সারবে না। তবে পেটের জলটা বার করে দিলে কিছুদিন আরামে থাকবে। নবীপুরে মঙ্গলদাসের বাড়ি। সদাশিব হাটে এসে দেখলেন বিরাট পেট নিয়ে মঙ্গলদাস বসে আছে।
“পানি নিকাল দিজিয়ে হুজুর। জান যা রহা হ্যায়।”
সদাশিব বললেন, “আচ্ছা, একটা বালতি আনাও। কত জল বেরুবে সেটা দেখতে হবে।”
বালতি যোগাড় হয়ে গেল একটা। তারপর সদাশিব তার ব্লাডপ্রেসার আর নাড়ী দেখলেন। ধী-বিশাল পাণ্ডের দোকানে বড় চৌকো-গোছের টুল ছিল একটা। সেইটের উপর বসালেন মঙ্গলদাসকে। তারপর পেটের নিচের দিকে একটা ইনজেকশন দিয়ে অসাড় করে দিলেন জায়গাটাকে। তারপর পট্ করে মোটা একটা ট্রোকার দিয়ে ছ্যাঁদা করে দিলেন। পিচকিরির মতো জল বেরুতে লাগল আর পড়তে লাগল বালতিতে। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল চারদিকে। সে এক হৈ-হৈ কাণ্ড!
মঙ্গলদাস চোখ বুজে বসে ছিল।
হঠাৎ সে চোখ খুলে বললে—“নাম শুনাও। বিরিঞ্চয়াকে খবর দেও।”
একটু পরে বিরিঞ্চিয়ার দলবল খোল মাদল আর খঞ্জন নিয়ে এসে হাজির হয়ে নাম শোনাতে লাগল মঙ্গলদাসকে। “জে জে রাধা, জে জে কিষুণ, জে জে রাধা, জে জে কিষুণ”— জে জে মানে জয় জয়। সদাশিব বাধা দিলেন না, উপভোগ করতে লাগলেন।
সদাশিবের একটু পরে চোখে পড়ল ভিড়ের মধ্যে ছিপলীও দাঁড়িয়ে আছে। আর ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে তিনটে বখা গোছের ছোঁড়া। প্রত্যেকেরই মাথায় বাহারে তেড়ি, চোকে রঙীন চশমা, পরনে হাওয়াই শার্ট আর ঢিলে পা-জামা। কথায় কথায় ক্যাক্ ক্যাক্ করে হাসছে।
ওদের মধ্যে দু’জনকে চিনতে পারলেন সদাশিব।
একজন স্থানীয় এক ডাক্তারের ছেলে। জাতে সোনার বেনে। ঠাকুদা তেজারতি করে বড়লোক। জমিদারি কিনেছে। এ ছোকার কলেজে নাম লেখানো আছে। প্রফেসারদের ঘুষ দিয়ে কিংবা হুমকি দিয়ে পরীক্ষা পাস করে যায়। সেদিন দলবল নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা দোকান লুঠ করেছে। পুলিস এদের কিচ্ছু বলে না। সবাই টাকার বশীভূত।
দ্বিতীয় ছোকরা ছবিলাল মোড়লের ছেলে। ছবিলাল একজন কংগ্রেস-অনুগৃহীত ব্যক্তি। সুতরাং ছেলেটি একটি অকুতোভয় গুণ্ডা। এর প্রধান কাজ হচ্ছে পরের পাঁঠা চুরি করে খাওয়া। গরীব মানুষেরা প্রায়ই ছাগল পোষে, ছাগলের বাচ্চা এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। এ ছোকরা সুবিধে পেলেই গ্রাস করে সেগুলি। ওদের পাড়ার গরীব লোকেরা অস্থির হয়ে উঠেছে ওর জ্বালায়। অথচ ভয়ে মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারে না। পুলিস ওদের সহায়।
তৃতীয় ছোকরাটিকে সদাশিব চিনতে পারলেন না।
ওরা খুব সম্ভবত ছিপলীকে নিয়েই হাসাহাসি করছিল। ছিপলীর কুঞ্চিত ভূ এবং অগ্নিগর্ভ দৃষ্টি দেখে তাই অনুমান করলেন সদাশিব। ছিপলী ভিড় ঠেলে ঠেলে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল, শেষে তাঁর চেয়ারের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল। হো হো করে হেসে উঠল ছোকরা তিনটে।
একজন বলে বসল— “বড়টার কাছে গিয়ে কি মজা পাবে সহেলি!”
ছিপলীর মুখ লাল হয়ে উঠল। সদাশিব গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। তারপর উঠে মঙ্গলদাসের কাছে গেলেন। অনেক জল বেরিয়েছিল। ট্রোকারের ক্যানুলাটা বার করে নিয়ে বেন্জাইন্ দিয়ে সিল করে দিলেন জায়গাটা।
সেই ছোকরা তিনজন এগিয়ে এল এবং ছিপলীর উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে সদাশিবকে বাংলায় জিগ্যেস করতে লাগল—“শিলাই করে দিলেন না কি–”
সদাশিব আর আত্মসংবরণ করতে পারলেন না।
“নিকল যাও হিয়াঁসে—”
“নিক যায়েঙ্গে! হাটিয়ামে তো সব কোইকো equal right হ্যায়–”
সদাশিব জনতার দিকে চেয়ে বললেন—“নিকল দেও এই তিন ছোক্বা কো-
সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে উঠল সবাই এবং ‘মার’ ‘মার’ শব্দে তেড়ে গেল তাদের। দেখতে দেখতে দাঙ্গা বেধে গেল একটা। প্রচণ্ড মার খেলে ছোকরা তিনটি। চুলের ঝুঁটি ধরে টানতে টানতে বার করে দিল তাদের হাট থেকে। ধী-বিশাল পাণ্ডে একটু ভয় পেয়ে গেল। সদাশিবকে বললে, “ও তিনটেই হারামি ডাক্তারবাবু। ওদের ঘেঁটিয়ে ভালো করলেন না। আমার দোকানেই ব্যাপারটা ঘটল, হয়তো কোনদিন আমাকে এসে বে-ইজ্জৎ করবে! লুটও করতে পারে—”
“কোনও ভয় নেই। কি করবে ওরা। আমি এখনই থানায় ডায়েরি করে দিচ্ছি। মঙ্গলদাস তুমি শুয়ে পড় এবার। কেমন লাগছে—”
“অনেক হাল্কা লাগছে। বিরিঞ্চ ভাই, আউর থোড়া নাম শুনাও—”
দাঙ্গার গোলমালে কীর্তন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবার শুরু হয়ে গেল— “জে জে রাধা, জে জে কিষুণ—”
ধী-বিশাল পাণ্ডের ‘ধী’ কতটা বিশাল তা বলা শক্ত কিন্তু দেহটি যে বিশাল তাতে সন্দেহ নেই। বৃহৎ একটা ষাঁড়ের মতো চেহারা তার। সে নিজেই দোকানের বড় বড় চাল-ভরতি বোরাগুলোকে তুলে তুলে ভিতরের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। দুটো উদ্দেশ্য। প্রথম, এইখানে খাটিয়া বিছিয়ে মঙ্গলদাসের জন্য বিছানা করে দেওয়া। দ্বিতীয়, চালের বোরাগুলোকে ভিতরে সরিয়ে রাখা। কি জানি যদি ও গুণ্ডার দল এসে পড়ে তাহলে চালের বোরা পেলে নয়-ছয় করে দেবে সব। চালের বোরাগুলি ভিতরের ঘরে পুরে তাতে তালা লাগিয়ে ধী-বিশাল একটা দড়ির খাটিয়া নিয়ে এল পিছন দিক থেকে। একটা ডগমগে রঙের শতরঞ্চি বিছালো তার উপর। তারপর বালিশ আনল একটি। বালিশটির বিশেষত্ব, খুব ছোট এবং টাইট্। মনে হয় দম বন্ধ করে আছে, এখনি বুঝি ফেটে তুলো বেরিয়ে পড়বে।
“ডাক্তারবাবু, মঙ্গলদাসজী এখানে কতক্ষণ থাকবে—”
“আজ দিনভোর থাক। সন্ধ্যের পর আস্তে আস্তে বাড়ি চলে যাবে গাড়ি করে।”
বিরিঞ্চ আর ধী-বিশাল মঙ্গলদাসকে ধরে আস্তে আস্তে খাটিয়ায় শুইয়ে দিলে। মঙ্গলদাসের সঙ্গে বিরিঞ্চ বা ধী-বিশালের রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু যারা একথা জানে না, তাদের মনে হবে ওরাই এর পরমাত্মীয়।
সদাশিব নবীপুরের হাট থেকে সোজা থানায় চলে গেলেন। যাবার সময় ছিপলীকেও নিয়ে গেলেন সঙ্গে করে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন