হাটে বাজারে – ৩

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। তিন।। 

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিলাম তাঁর স্ত্রীকে দেখতে। আমি ভেবেছিলাম বাড়াবাড়ি কোনও অসুখ বুঝি। কিন্তু গিয়ে দেখলাম তিনি বেশ সেজেগুজে সোফায় ঠেস দিয়ে বসে আছেন। বললেন সকালের দিকে তাঁর মাথাটা বড্ড ধরে। আর কনের ডগা দিয়ে আগুনের হল্কা বের হয়। প্যাপিটেশনও আছে। শিরদাঁড়ার কাছটা শিরশির করে মাঝে মাঝে। সব বলবার পর হেসে বললেন, চিকিৎসার কোনও ত্রুটি করিনি। কলকাতার সব বড় বড় ডাক্তাররা দেখেছেন। ইলেকট্রোকার্ডিয়োগ্রাম, এক্সরে, অপারেশন সব হয়ে গেছে। একজন বড় ডাক্তারের নাম করে বললেন— তাঁরই চিকিৎসায় আছি এখন। একগাদা রিপোর্ট আর প্রেস্কৃপসন বার করলেন আর সেগুলো এমনভাবে দেখাতে লাগলেন যেন গয়না দেখাচ্ছেন এবং দেখিয়ে গর্ব অনুভব করছেন। 

আমার মনে হল তিনি আমাকে চিকিৎসা করাবার জন্য ডাকেননি, তিনি যে বড় বড় ডাক্তার দেখাতে পারেন এবং হামেশাই দেখিয়ে থাকেন, এইটে সাড়ম্বরে আমার কাছে আস্ফালন করবার জন্যেই আমাকে ডেকেছেন। 

ভদ্রমহিলার সন্তান হয়নি। হবার সম্ভাবনাও নেই। বয়স ত্রিশের কোঠায় মনে হল, যদিও আমাকে বললেন পঁচিশ। দেখলুম নানারকম কমপ্লেক্স জট পাকানো রয়েছে মনে। অকারণে বাপের বাড়ির গল্প করলেন খানিক। তাঁর কোন্ ভাই কবে বিলেত গেছেন তা বললেন। তাঁর যে ভাই এ. পি., সে যে বিলেত থেকে মেম বিয়ে করে ফিরেছে তা-ও কথায় কথায় জানিয়ে দিলেন। আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন মাঝে মাঝে গিয়ে খবর নি তাঁর। বললেন-‘একা এই জংগুলে দেশে পড়ে আছি, একটা কথা বলবার লোক পর্যন্ত নেই। উনি তো সমস্ত দিন বাইরে বাইরে থাকেন। আয়া, বেয়ারা আর চাপরাসী নিয়ে কতক্ষণ আর কাটানো যায় বলুন। বই-টই পড়ি। কিন্তু বই সব সময়ে ভালো লাগে না। আপনি দয়া করে আসবেন মাঝে মাঝে। এই ইন্‌জেক্‌শনগুলো কি নেব?’ একজন নামজাদা ডাক্তারের প্রেস্কৃসন্, সুতরাং ‘না’ বলতে পারলুম না। বললাম, নিন। ‘আপনি তাহলে দয়া করে এসে দিয়ে যাবেন। যাবেন তো?’ এবারও ‘না’ বলতে পারলাম না। যদিও বুঝলাম ও ইন্‌জেকশন নিয়ে তাঁর অসুখ সারবে না। অসুখ সারত একটি ছেলে হলে। কিন্তু হবে না, গত বছরই ইউটেরাসটি কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। টিউমার হয়েছিল নাকি। উনি নিজেও মনে মনে জানেন যে ইনজেক্‌শন নিয়ে কিছু হবে না। আমাকে ডাকছেন আমার সঙ্গ কামনায়। আমাকে সামনে বসিয়ে বক্‌বক্ করে বকে যাবেন খালি, নিজের অন্তর্নিহিত নিদারুণ বেদনাটাকে চাপা দিয়ে বাহাদুরির ফুলঝুরি কেটে চেষ্টা করবেন নিজেকে এবং আমাকে ভোলাতে। আমাকে চাইছেন উনি ডাক্তার হিসাবে নয়, শ্রোতা হিসেবে। আমার চিকিৎসানৈপুণ্যে ওঁর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। একটা সাদা পট না থাকলে সিনেমার ছায়াছবি দেখানো যায় না। আমাকে উনি সেই সাদা পটের মতো ব্যবহার করতে চান। 

.

মনুকে আজ খুব বকেছি। একটা তরকারী নুনে পোড়া, মাংসটা আলুনি। রাঁধুনী রয়েছে তবু বাহাদুরি করে নিজে রাঁধতে যাওয়া চাই।…..সমস্ত দিন মনু আজ কেঁদেছে। আসল কারণ অবশ্য ওর পিসেমশাই নিতাইবাবু। ভদ্রলোককে ইতিপূর্বে দেখিনি কখনও। উনি এসে থেকে আমাদের গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ। বারবার বলছেন কলিযুগে আমাদের মতো দম্পতি নাকি বিরল। হর-গৌরী আখ্যা দিয়েছেন আমাদের। মনু যখন রাঁধছিল তখন রান্নাঘরে গিয়েছিলেন তিনি। মনুকে রান্না শেখাচ্ছিলেন। মাংসে নুন না দেওয়াটাই বোধ হয় নূতনত্ব। 

উনি কেন যে এসেছেন আমাদের কাছে আর কেনই বা আছেন এতদিন ধরে তা বুঝতে পারিনি আগে। আজ বিকেলে বুঝতে পারলুম। ভেবেছিলুম মনুর প্রতি স্নেহবশত এসেছেন বুঝি। কিন্তু দেখলাম তা নয়। পাওনাদারকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছেন। কালো কুচকুচে তাঁর পাওনাদারটি খুঁজে খুঁজে আজ এসে ধরেছিলেন তাঁকে। দুশমনের মতো চেহারাটা লোকটার। যদিও বাঙালী কিন্তু কথাবার্তার ধরন থেকে মনে হল কাবুলির বেহদ্দ। প্রথমেই এসে ‘শালা’ সম্বোধন করলেন পিসেমশাইকে। তারপর গলায় গামছা দিয়ে টানাটানি করতে লাগলেন। এই নাটকীয় কাণ্ড ঘটতে লাগল আমার বৈঠকখানার বারান্দায়। বাধ্য হয়ে শেষে আমাকে বন্দুক বার করতে হল। 

পৃথিবীতে সবাই শক্তের ভক্ত, পাওনাদার মশাইও অবিলম্বে আমার ভক্ত হয়ে পড়লেন। শেষে বার করলেন তাঁর ন্যায্য পাওনার দলিলখানা। দেখলাম সুদে-আসলে তিনি পিসেমশায়ের কাছে পাঁচশ টাকা পাবেন। আর একটা নাটকীয় কাণ্ড ঘটল। পিসেমশাই হঠাৎ আমার পা ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, তুমি আমাকে এখন ওই কশাইটার হাত থেকে বাঁচাও বাবা, আমি ফিরে গিয়েই টাকাটা তোমাকে পাঠিয়ে দেব। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখি মনু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনুর এই নিদারুণ অপমানে আমিও যেন অপমানিত বোধ করতে লাগলাম। অনুভব করলাম টাকাটা দিয়ে দিতে হবে। ড্রয়ার থেকে টাকাটা বার করে বাইরে গেলাম। পাওনাদারের হঠাৎ একটা অন্য চেহারা বেরিয়ে পড়ল। সে বলল–টাকাটা দিচ্ছেন দিন, আমার ভালোই হল, কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলে দিচ্ছি। নিতাইবাবুর কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না। ও আপনাকে টাকা দেবে বলছে কিন্তু দেবে না। ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আমাকে আজ দু’বছর ধরে ঘোরাচ্ছে। আপনি অন্তত একটা হ্যাণ্ডনোট লিখিয়ে নিন ওর কাছে। তা না হলে টাকাটা মারা যাবে। 

আমি জবাব দিলাম, সবাই তোমার মতো কশাই নয়। মুখে বললাম বটে, কিন্তু মনে মনে তারিফ করলাম লোকটার। 

পিসেমশাই সেইদিন রাত্রেই উধাও হলেন। যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে কিংবা মনুর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করে গেলেন না। উনি চলে যাবার পর মনু আর একটা কথা বললে। ‘জান? উনি আমার বিয়ের সময় বাগড়া লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন? বেনামী চিঠি লিখে দু’এক জায়গায় বিয়ে ভেঙেও দিয়েছেন।’ এরাই কি আমার আত্মীয়? আশ্চর্য! 

.

বিধুবাবুর ছেলের টাইফয়েড হয়েছে। প্রথমত প্রতিবেশী, দ্বিতীয়ত গরীব মানুষ। ফি না নিয়েই চিকিৎসা করছিলাম। দুবেলা তো যেতামই, কোন কোন দিন তিনবারও গেছি। আজ সকালে গিয়ে দেখি একটি ফরসা ছোকরা বসে আছে। বেশ ফিটফাট ছিমছাম। চোখে প্যাশনে, পরনে আদ্দি, পায়ে পেটেণ্ট লেদারের ‘শু’। আমি ঘরে ঢুকতে বিধুবাবু দাঁড়ালেন, কিন্তু সেই ছোকরা দাঁড়াল না। বিধুবাবু বললেন, ইনিই আমাদের প্রতিবেশী ডাক্তার সদাশিববাবু। পটলার চিকিৎসা ইনিই করছেন। আমি ডাক্তার শুনে ছোকরা এমনভাবে আমাদের দিকে চাইলে যেন সে কোন অদ্ভুত জীব দেখছে। তারপর বাঁ হাতটা তুলে কপালে ঠেকিয়ে বললে-অ, আপনি এর চিকিৎসা করছেন। বসুন, বসুন, আপনাকে অনেক কথা বলবার আছে। বিধুবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম—ইনি কে? বিধুবাবু হাত কচলে উত্তর দিলেন—এ আমার ভাগ্নে, বিলাস। মেডিকেল কলেজে ফোর্থ ইয়ারে পড়ে। ছুটিতে এখানে বেড়াতে এসেছে। পটলের প্রেসনের ও কিছু অদলবদল করতে চায়। ও বলছে আজকাল মেডিকেল কলেজে না কি…..। থামিয়ে দিলুম বিধুবাবুকে। বললুম–আপনার ভাগ্নে এখনও ডাক্তার হননি। আমি অনেক দিন ধরে ডাক্তারী করছি। মেডিকেল কলেজে আজকাল কি ধরনের চিকিৎসা হচ্ছে তা আমিও জানি। আপনার ভাগ্নের মারফত সেটা আমার জানবার দরকার নেই। বিধুবাবু একটু হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, হ্যাঁ, তাতো বটেই। তবে ও কি বলছে সেটা একবার শুনলে হত না? আমি উত্তর দিলাম, না, যে এখনও ডাক্তারি পাস করেনি তার সঙ্গে আমি চিকিৎসা-বিষয়ে কোন কথা বলব না। আপনারা ওকে দিয়েই চিকিৎসা করান, আমি চললুম। 

বাঙালীর ভদ্রতাবোধ কি একবারে চলে গেছে? বিধুবাবু কেন আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করলেন তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে বাহাদুরি দেখাবার জন্যেই এটা করলেন উনি। উনি বোধহয় অজ্ঞাতসারেই আমার কাছে জাহির করতে চাইলেন-দেখ হে, আমিও নেহাত কেউ-কেটা নই। আমার ভাগ্নেও মেডিকেল কলেজে পড়ে, দুদিন পরে তোমার মতোই ডাক্তার হবে। সত্যি, আমরা চাষা হয়ে গেছি। যে শিক্ষার প্রধান লক্ষণ বিনয়, সেই শিক্ষা লোপ পেয়ে গেছে আমাদের ভিতর থেকে। ছি, ছি। 

.

রঘুবাবু ছেলের বিয়ে দিলেন খুব ধুমধাম করে। বড়লোক কুটুম হয়েছে। কলকাতা থেকে রাঁধুনী এসেছিল, কাশী থেকে সানাই। শহরের অনেক লোককে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বেশীর ভাগই অফিসার। হাসপাতালের ডাক্তার হিসাবে আমারও নিমন্ত্রণ ছিল। গিয়েছিলাম আমি। গিয়ে দেখলাম আয়োজনের কোনও ত্রুটি নেই! চর্ব্য চূষ্য লেহ্য পেয় সব রকম ব্যবস্থাই আছে। মদের ব্যবস্থাও ছিল। পরের পয়সায় মদ খাওয়ার সুযোগ যারা ছাড়ে না, বাড়িতে যাদের জোলো চা ছাড়া অন্য কোন প্রকার পান-বিলাস নেই, তাদের অনেককেই দেখলাম দাঁত বার করে গিয়ে আসর জমিয়েছে মদের টেবিলের ধারে আর উচ্চকণ্ঠে গুণগান করছে রঘুবাবুর কাচারের। রঘুবাবু নিজে দেখলাম ব্যস্ত আছেন বড় বড় অফিসারদের নিয়ে। কমিশনার সাহেব, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আর পুলিস সাহেব—এই তিনজন সাহেবকে বসিয়ে ছিলেন তিনি একটি বিশেষভাবে সজ্জিত টেবিলে এবং সেইখানেই সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে হেঁ হেঁ করছিলেন। আমাদের কাছে একবারও আসেননি। আমাদের অভ্যর্থনা করছিল তাঁর একজন মুহুরি। 

.

ওভারশিয়ার সুরথবাবুর চরিত্রের একটা দিক সহসা উদ্ঘাটিত হল আজ আমার কাছে। তাঁকে সাধারণ ঘুষখোর ওভারশিয়ার বলেই জানতাম। কিন্তু তিনি যে মানব-চরিত্রের গহনে সন্ধানীআলো নিক্ষেপ করতে সক্ষম, তা জানতাম না। এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার গগন বসু প্রবীণ লোক, মাথার চুলে পাক ধরেছে। সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। 

সুরথবাবু কিছুদিন আগে আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁর বগলে একটা দাদ আছে, সেইটের জন্যে মাঝে মাঝে মলম নিতে আসেন আমার কাছে। কথায় কথায় সেদিন গগনবাবুর কথা উঠল। আমি বললাম, আপনাদের খুব ভাগ্য যে গগনবাবুর মতো পণ্ডিত চরিত্রবান লোক আপনাদের স্কুলের হেডমাস্টার। সুরথবাবুর চোখে-মুখে একটা কুটিল হাসির চমক খেলে গেল। তারপর বললেন, ভাগ্যই বটে। বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। আমি একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম— অমন করে হাসছেন যে। সুরথবাবু একটু দুলে মাথা নেড়ে বললেন, হাসি পেল বলেই হাসছি। আপনারা সাদাসিধে মানুষ, সকলের ওপরটা দেখেই মুগ্ধ হয়ে যান। আমরা সব জানি কিনা তাই অত সহজে মুগ্ধ হতে পারি না। জিগ্যেস করলাম, কি জানেন? তিনি একটু মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, সব কথা কি বলা যায়! বলেই রহস্যময় হাসি হাসতে হাসতে চলে গেলেন। 

আজ যোগেন এসেছিল। যোগেন আমার বাল্যবন্ধু। সে হেসে আমাকে বললে—‘কি রে, তুই আজকাল ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস নাকি?’ ‘কি রকম?’—আকাশ থেকে পড়লাম আমি। তখন যোগেন বললে—সে ট্রেনে যে কামরায় ছিল সেই কামরায় সুরথবাবু নামে একজন ওভারশিয়ার ছিলেন। তিনি তাঁর ইয়ারবক্সিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলেন। একজন তোর প্রশংসা করাতে সুরথবাবু বললেন-’তোমরা ওপরটা দেখেই গদগদ হয়ে পড়। কিন্তু আমি পারি না, কারণ আমি ভিতরের অনেক খবর জানি যে। কিন্তু সে সব কথা বলে আর লাভ কি। তবে এটা জেনে রাখ উনি ডুবে ডুবে জল খান।’ আমি যে এতবড় একজন ডুবুরী তা আমার নিজেরই জানা ছিল না! দুনিয়ায় কত রকম মানুষই যে আছে! 

.

বাড়িতে মহা হুলুস্থুল পড়ে গেছে। অনেকদিন পরে আমার এক বোন আমার কাছে চেঞ্জে এসেছে। তার অসুখবিসুখ কিছু নেই। কিন্তু কলকাতার লোকেদের চেঞ্জে যাওয়া একটা বাতিক। বিশেষত কোথাও বিনা পয়সায় থাকবার খাওয়ার জায়গা যদি থাকে তাহলে তো কথাই নেই, কোন রকমে থার্ড ক্লাসের ভাড়াটা যোগাড় করে ছুটবে সেখানে। আমার আপন বোন নয়, পিসতুতো বোন। সে আসছে বলে আমি যে অসন্তুষ্ট হয়েছি তা নয়, কিন্তু সে আসাতে আমার ভীষণ অসুবিধের সৃষ্টি হয়েছে। 

আমার বোনের ছেলেমেয়েগুলো ভারি অসভ্য। পাঁচটা ছেলে, পাঁচটাই বর্বর। এসেই আমার ঘরের দামী পর্দাগুলো ধরে দুলতে লাগল সবাই। একটা পর্দা ছিঁড়ে গেছে। ধমক দিলে শোনে না। আমার বোন ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের মানা করে বটে কিন্তু ছেলেগুলো তার কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করে না। বোনের বকুনিটাও বকুনির মতো শোনায় না, মনে হয় মানা করতে হয় তাই করছে, কিন্তু কণ্ঠস্বরে ভর্ৎসনার সুরটা ঠিক ফুটছে না। বড় ছেলেটা, এসেই আমার রেডিওটা খারাপ করে দিয়েছে। এই মফঃস্বল শহরে সারানো মুশকিল। ক্রিকেট ম্যাচের খবর শুনতে পাচ্ছি না। মেজাজটা বিগড়ে গেছে। ফুলবাগানটা তছনছ করে দিলে। পটাপট করে ফুলগুলো তো তুলছেই, গাছের ডালও ভাঙছে। আমার স্প্যানিয়েল কুকুরটাকে তো অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কেউ তার কান টানছে, কেউ ল্যাজ, কেউ তার পিঠে চড়ে ধামসাচ্ছে। ভালো জাতের ভালো কুকুর তাই কিছু বলে না, আভিজাত্য একটু কম থাকলে কামড়ে দিত। আমার শখের বাইনকুলারটা তাক থেকে পেড়ে নিয়ে কাড়াকাড়ি করে দেখছে সবাই মিলে। তার ধরনধারণ দেখে মনে হয় এসব যেন তাদের বার্থরাইট। মামার বাইনকুলার নিয়ে দেখবে না তো কার বাইনকুলার নিয়ে দেখবে? 

একজন ছুতোর মিস্ত্রী কিছুদিন আগে আমার রোগী হয়েছিল। তার স্ত্রীর কুষ্ঠের চিকিৎসা করেছিলাম, কিছু চাইনি। সে একটা ড্রেসিং টেবিল উপহার দিয়েছে আমাকে। চমৎকার একটি আয়না ‘ফিট’ করা আছে তাতে। আমার বোন সেটা দেখে বললে দাদা, আমাকে ওটা দাও না। তোমার তো আর একটা রয়েছে। বললাম—তুই একটা কিনে নিস, আমি দাম দিয়ে দেব। এখান থেকে ওটা নিয়ে যেতে হলে ভেঙে যাবে, তাছাড়া একজনের দেওয়া উপহার, নিজের কাছেই রাখা উচিত। 

বোনের মুখভাব দেখে বুঝলাম আমার কথায় সন্তুষ্ট হল না। মনু তাকে অনেকগুলো শাড়ি দিয়েছে, কিন্তু দেখলাম মনুর বাটিকের শাড়িটার উপর তার লোভ খুব। মনুকে বলেছি ওটা দিয়ে দিতে, আমি আবার তাকে কিনে দেব। মনু মুখে বললে, আচ্ছা। কিন্তু তার গম্ভীর মুখ দেখে বুঝলাম সে মনে মনে পছন্দ করেনি প্রস্তাবটা। 

কিন্তু মনু সবচেয়ে চটেছে আর একটা ব্যাপারে। আমার বোনের বড় ছেলে টুলটুল আমার মেয়ে সোহাগের গালে কামড়ে দিয়েছে। সোহাগের বয়স পাঁচ বৎসর, টুলটুলের দশ। আমার বোন জিগ্যেস করল, ও কি রে, ওর গালে অমন করে কামড়ে দিলি কেন? টুলটুল হেসে উত্তর দিলে-গালটা ঠিক টমাটোর মতো যে! আমি আর আত্মসম্বরণ করতে পারলাম না, হান্টার বার করে খুব চাবকেছি ছেলেটাকে। ভেবেছিলাম লাঠৌষধি পড়েছে, এইবার ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু হল না। আজ সকালে চাকরগুলো হৈ হৈ করে ওঠাতে বেরিয়ে দেখলাম আমার বোনের মেজ ছেলে একটা হাঁসের গলা টিপে ধরেছে। পাতিহাঁস। নিখুঁত সাদা রং বলে কিনেছিলাম একজোড়া। তারই একটার গলা টিপে ধরেছে ছেলেটা। আর একটু হলে মরে যেত।…ভাবছি কবে এই সব পাপ দূর হবে বাড়ি থেকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথাও মনে হচ্ছে, এদের দূর করতে চাইছি কেন! এরাই তো আমার আত্মীয়! 

.

বিধুবাবুর ছেলে পটল কাল রাত্রে মারা গেছে। মেডিকেল কলেজের আপ-টু-ডেট্ ছাত্র বিলাস তাকে বাঁচাতে পারেনি। আমি তার চিকিৎসা আর করছিলাম না। করলেই বাঁচত কি? 

.

রোগী আসে, রোগী যায়। কেউ বাঁচে, কেউ মরে। কিন্তু মনের উপর কেউতো দাগ রেখে যায় না। আমার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কিছু বাড়ে শুধু। মনটা যেন নির্মম আয়নার মতো! কোনও ছবিই ধরে রাখে না। যদি ক্যামেরার মতো হত তাহলে কি ভালো হত? অত ছবি রাখতাম কোথায়? মনের চিত্রশালায় অত জায়গা কি আছে? হঠাৎ মনে হল আছে বই কি। অনেক জায়গা আছে। কিন্তু রাখবার মতো ছবি একটাও পেয়েছি কি? 

.

আজ লক্ষ্মীবাজারে রোগী দেখতে গিয়ে অদ্ভুত জিনিস দেখে এসেছি একটা। লক্ষ্মীবাজার এখান থেকে প্রায় কুড়ি মাইল দূরে। লক্ষ্মীবাজারের প্রসিদ্ধি তার বাজারের জন্য নয়, তার গড়ের জন্য। প্রায় আধ মাইলব্যাপী বিরাট বিরাট অট্টালিকার ধ্বংসস্তূপ আছে সেখানে। প্রবাদ, বহুকাল আগে সেখানে এক রাজবংশ বাস করতেন। তাঁদের উপাধি ছিল চৌধুরী। চৌধুরী বংশের এক রাজা লক্ষ্মী চৌধুরী (যাঁর নামের স্মৃতি বহন করছে লক্ষ্মীবাজার গ্রাম) তাঁর যৌবনকালে নব-বিবাহিতা পত্নীকে নিয়ে সহসা অর্ন্তধান করেন। কোথায় গেলেন, কেন গেলেন তা কেউ জানে না। তিনি আর ফেরেননি। কেউ বলে সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন, কেউ বলে মারা গেছেন, কারও মতে তিনি পোর্তুগীজ বম্বেটেদের হাতে পড়েছিলেন, তারা তাঁকে আর তাঁর স্ত্রীকে আরবদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এই ধরনের নানা জনশ্রুতি আছে তাঁর সম্বন্ধে। মোট কথা তিনি আর ফেরেননি। কোন খবরও পাঠাননি। তিনি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য অত বড় চৌধুরী গড় খালি হয়ে যায়নি। তাঁদের বংশের অনেকেই বেঁচে ছিলেন সেখানে অনেকদিন ধরে। কিন্তু কালক্রমে ক্রমশ সব খালি হয়ে গেল। বংশে ছেলে হল না কারও, মৃত্যুর করালগ্রাসে অবলুপ্ত হয়ে গেল অত বড় বংশ। বংশের শেষ প্রদীপ (কমলাপতি চৌধুরী) নির্বাপিত হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। তারপর থেকে প্রেতপুরীর মতো পড়ে আছে অতবড় গড়টা। চারদিকে বনজঙ্গল গজিয়েছে, বড় বড় অশ্বত্থ বট বিদীর্ণ করেছে বিশাল অট্টালিকার পঞ্জরকে। জঙ্গলে সাপ আর শেয়ালের আড্ডা, গাছের মাথায় মাথায় শকুনদের। বাড়িটার ভাঙা ঘরগুলোর মধ্যে ভীষণ-দর্শন প্যাঁচাও আছে নাকি। দিনের বেলাতেও চৌধুরী গড়ের জঙ্গলে যায় না কেউ। কিছুদিন আগে এক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মালমসলা সংগ্রহ করতে এসেছিলেন। সর্পাঘাতে মারা গেছেন। এ ঘটনার পর থেকে আর কেউ ওদিক মাড়ায় না। 

আজ কিন্তু দেখে এলাম সেখানে লোকে লোকারণ্য, এক মহাসমারোহ পড়ে গেছে। দীর্ঘকায় এক কাবুলী ঘোড়সোয়ার এসে হাজির হয়েছে সেখানে। সে আকারে ও ভাষা কাবুলী বটে, কিন্তু তার পোশাকটা প্রায় বাঙালীরই মতো। তার ঘোড়াটাও প্রকাণ্ড। অত বড় ঘোড়া আমি অন্তত দেখিনি। সে নিজের নাম বলেছে, অ্যাচুঅ্যাণ্ড। পরে বোঝা গেল ওটা অচ্যুতানন্দের কাবুলী সংস্করণ। তার ভাষা কেউ বুঝতে পারছিল না। পাশের গ্রামের আগা সাহেব এসে তার বক্তব্যের মর্মোদ্ধার করেছেন। আগন্তুক পোস্ত ভাষায় আগা সাহেবকে যা বলেছে তাও বিস্ময়কর। সে বলেছে যে সে গৃহত্যাগী রাজা লক্ষ্মী চৌধুরীর বংশধর। লক্ষ্মী চৌধুরী কেন গৃহত্যাগ করেছিলেন তারই বিবরণ নিয়ে সে লক্ষ্মীবাজারে এসেছে। ‘ল্যাখি চোরি’কে সে নিজে কখনও দেখেনি। তার জন্মের বহুপূর্বে তিনি মারা গেেেছন। তিনি ছিলেন তার ঠাকুরদার ঠাকুরদা। তিনি তাঁর গৃহত্যাগের বিবরণ একটি খাতায় লিখে রেখেছিলেন এবং মৃত্যুকালে বলে গিয়েছিলেন খাতাটি যেন লক্ষ্মীবাজারে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু এই সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এখানে আসা এর আগে সম্ভবপর হয়নি এতদিন। তারপর বললে—“হঠাৎ আমরা একদিন লক্ষ্য করলাম যে খাতার কাগজ মলিন এবং ভঙ্গুর হয়ে গেছে। হাত দিলে ভাজা পাঁপড়ের মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। তখন মনে হল, আর দেরি করা উচিত নয়, আর দেরি করলে তাঁর শেষ ইচ্ছা আমরা পূর্ণ করতে পারব না। তাই আমি এই খাতা নিয়ে এসেছি। ঘোড়াটি শোনপুরের মেলায় কিনেছি। ইচ্ছে আছে, ফিরবার সময় ট্রেনে যাব না, ঘোড়ার পিঠেই যাব।”

লক্ষ্মী চৌধুরীর লিখিত বিবরণের অধিকাংশই প্রায় পড়া যায়নি। লেখা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেটুকু পড়া গেছে সেটুকু প্রণিধানযোগ্য। তার মর্ম এই—“আমি এটা মৰ্মে মর্মে অনুভব করেছি যে আমাদের কেউ ভালবাসে না। আমরা প্রতিপত্তিশালী, আমরা ধনী, তাই সকলে বাধ্য হয়ে আমাদের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকে। সেবা করে অর্থের বিনিময়ে, স্বার্থসিদ্ধির জন্য অথবা ভয়ে। কারও মনে আমরা প্রেম সঞ্চার করতে পারিনি। এই সকল প্রভুত্বের সিংহাসনে বসে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সুখ পেয়েছেন, কিন্তু আমি পাচ্ছি না। আমার প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে আমি যেন পাশবিক শক্তিবলে দুর্বলদের পীড়ন করছি। এ আমার পক্ষে অসহ্য। এখানে থেকে আমার সমস্ত সম্পত্তি যদি বিলিয়ে দিই তাহলেও আমার কাম্য সুখ আমি পাব না। কারণ এতদিন যেরূপে সকলে আমাকে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছে, সে অভ্যাসের মোহ তারা কিছুতেই ত্যাগ করতে পারবে না। আমি এমন কোন অপরিচিত স্থানে যেতে চাই যেখানে আমার কৌলীন্যের পরিচয় অর্থ বা প্রতিপত্তি দিয়ে কেউ মাপবে না, আমার চারিত্রিক মহত্ত্ব দিয়ে মাপবে। যে সমাজে আমি অপরিচিত অচেনা আগন্তুক সেই সমাজে গিয়েই আমি নূতন রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমার পূর্বপুরুষদের অর্জিত সম্পত্তি তাই আমি ত্যাগ করে চলে যাচ্ছি। আমার বংশের অন্যান্য শরিকরা অথবা গ্রামবাসীরা যে সম্পত্তির যে-কোনও রূপ সৎব্যবস্থা করতে পারেন করুন, আমার আপত্তি নেই। পৈতৃক সম্পত্তির উপর আমার সমস্ত দাবি আমি ত্যাগ করলাম।”

রাজা লক্ষ্মী চৌধুারী যা যা বলেছেন তা কি সকলের সম্বন্ধেই সত্য নয়? আমাদের দেশে এরকম মহাপুরুষ আরও অনেক আবির্ভূত হয়েছেন, কিন্তু আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই আছি। 

.

প্রাণ-পতি সাধু নাম। সুদখোর বেনে। কারও প্রাণ-পতি হতে পারেনি, ধন-পতি হয়েছে অনেকের। অনেকের সম্পত্তি নিলাম করিয়েছে। সাধুও নয়, অসাধু। জাল দলিল বার করে সর্বনাশ করেছে অনেকের। আমি তার বাড়িতে চিকিৎসা করেছিলাম কিছুদিন। অনেক ফি বাকি আছে। ‘রাজ দেবে কাল দেব করছে। এখনও দেয়নি। ওষুধের দামও বাকি আছে অনেক। আজ সকালে এসে বলেছিল সে নাগেদের দোকানে জিগ্যেস করে দেখেছে ওষুধের দাম নাকি আমি অনেক বেশি নিয়েছি। অর্ধেক হওয়া উচিত। দারোয়ান দিয়ে দূর করে দিলুম লোকটাকে। দারোয়ান যখন তার হাত ধরে টেনে বারান্দা থেকে নামিয়ে দিলে, তখন ভেবেছিলুম একটা প্রতিবাদ অন্তত করবে। কিন্তু কিছু করল না, সুট সুট করে চলে গেল। অথচ শুনেছি ওর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স নাকি লক্ষ টাকার উপর। 

.

রায়সাহেব উপাধি দিয়ে গভর্নমেন্ট অকস্মাৎ আমাকে বিব্রত করেছেন। আমি এর জন্যে কিছুমাত্র চেষ্টা করিনি, পাবার জন্য বিন্দুমাত্র লালায়িতও ছিলাম না। কমিশনার সাহেবের হাইড্রোসিলটি ভালো করে অপারেশন করে দিয়েছিলাম বলেই সম্ভবত এই অযাচিত পুরস্কারটি পেলাম। এ যেন সাপের ছুঁচো-গেলা হয়েছে। গিলতেও পারছি না, ফেলতেও পারছি না। আমার চেনা-শোনা অনেকেই কিন্তু গদগদ হয়ে পড়েছেন দেখছি। রোজই অভিনন্দন জানিয়ে পত্র আসছে। আমার শালী ‘রায়সাহেব ডকটর সদাশিব ভট্টাচার্য এম্-বি’ ইংরেজী হরপে ছাপিয়ে লেটার প্যাড করিয়ে পাঠিয়েছে জলন্ধর থেকে। আমার যে বন্ধুর সঙ্গে কোনকালে বন্ধুত্ব ছিল না, যিনি বহুকাল আগে কিছুদিনের জন্য আমার সহপাঠী ছিলেন মাত্র, তিনি সন্দেশ খাওয়াবার দাবি জানিয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন। হে সদাশয় কমিশনার সাহেব, এ কি বিপদে ফেললে আমাকে! 

আজ আমার ডিসপেনসারির সামনে বেশ একটা মজার দৃশ্য দেখলাম। উচ্চকণ্ঠে কলরব শুনে রাস্তার দিকে চেয়ে দেখি একদল হাফপ্যান্টপরা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে উত্তেজিত হয়ে। কথাবার্তাও উত্তেজিত। কারণটাও চোখে পড়ল। হ্যাফপ্যান্টপরা ছেলেগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করলাম একজন আড়ময়লা খাকি একটা ফুলপ্যান্ট পরে আছে। তার হাতে একটা এয়ারগান। আর একটা ছেলের হাতে একটা মরা পায়রা। বুঝলাম ‘এয়ারগান’টিই ওই হতভাগ্য জীবের ভবলীলার অবসান ঘটিয়েছে। ফুলপ্যান্টপরা ছেলেটার মুখের গর্বিত ভাব লক্ষ্য করে অনুমান করলাম সে-ই বোধ হয় শিকারী। একটা রোগাগোছের ছেলে চীৎকার করে বলছে—আমিই তো দেখিয়ে দিয়েছিলাম পায়রাটাকে। মোটা বেঁটে চশমাপরা আর একটা ছেলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল—মিথ্যুক কোথাকার। তুমি দেখিয়ে দিয়েছিলে, না আমি? পাশেই ছেঁড়া-কেড্‌স্-পরা ট্যারা যে ছেলেটি দাঁড়িয়েছিল সে রুখে এগিয়ে এল। বেঁটে ছেলেটাকে কনুই দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুলপ্যান্টপরা ছেলেটাকে সম্বোধন করে বললে— তুমিই বল না। এই ফ্লাওয়ার মিলের ফোকরে যে পায়রা থাকে, তা আমিই তোমাকে প্রথমে বলিনি? আর একজন ছেলে বলে উঠল—মাইরি আর কি! বুঝলাম ওই বারো-চোদ্দটা ছেলেই প্রত্যেকেই ওই মৃত পায়রাটির উপর অধিকার সাব্যস্ত করবার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকেরই চোখের দৃষ্টি লোলুপ। কিন্তু হায়, পায়রা যে মাত্র একটি। 

.

এখানে কাল শখের থিয়েটারে ‘কর্ণার্জুন’ হয়েছিল। আমি যেতে পারিনি। মনু গিয়েছিল। মোটরে তাকে পৌঁছে দিয়ে আমি ‘কলে’ বেরিয়ে গিয়েছিলাম। কথা ছিল ফেরবার সময়ে তাকে তুলে নিয়ে যাব। কিন্তু ফেরবার সময় রাস্তায় মোটরটা গেল বিগড়ে। ঠিক করতে বেশ দেরি হয়ে গেল। মনুকে হেঁটেই ফিরতে হয়েছিল। মনু বললে—ফেরবার সময় দেখলুম মণিবাবু মোটরে করে যাচ্ছেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও রয়েছে। আমাকে দেখে গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন—গাড়ি কোথায়? বললাম, আসবার কথা ছিল, কি জানি কেন আসেনি। শুনে মণিবাবু মুচকি হেসে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন। তাঁর এটুকু ভদ্রতা হল না যে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেন! 

শহরের লোকে জানে মণিমোহন বসু আমার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু!….একটু পরে সুবলবাবু এলেন। তিনি আমার এবং মণিমোহন উভয়েরই বন্ধু। ইংরেজীতে যাকে ‘কমন ফ্রেণ্ড’ বলে তাই। তাঁকে মণিবাবুর ব্যবহারের কথাটা বললুম। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, এতেই আশ্চর্য হচ্ছেন? ওর বাড়ির উঠোনে একটা পেয়ারা গাছ আছে। তার ফল কখনও খেয়েছেন একটাও? প্রত্যেকটি পেয়ারা বিক্রি করে। কখনও হাত তুলে কাউকে কিছু দিতে জানে না। হাড় চামার। আমার ধারণা ছিল মণিবাবু সুবলবাবুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু! কিন্তু বন্ধুত্বের নীচে যে এমন বিষ-ফল্গু বহমান তা জানতাম না। 

.

আজ আমার বাগানের ক্রোটন গাছ দুটোর শ্রী দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রাণের প্রাচুর্য যেন উথলে উঠেছে রঙে, রূপে, লাবণ্যে। তার পরই মনে পড়ল রাজেনবাবুর কথা। তিনিই এই ক্রোটনের ডাল দুটো এনে পুঁতে দিয়েছিলেন। আমি বাগান ভালোবাসি, রাজেনবাবু আমাকে ভালোবাসতেন। এই দুই ভালোবাসার মণিকাঞ্চন যোগ হয়েছে ওই ক্রোটন গাছ দুটিতে। রাজেনবাবু আজ কোথায় জানি না, তাঁর যে দান সামান্য বলে মনে হয়েছিল, তাই আজ অসামান্য হয়ে উঠেছে। আজ মনে হচ্ছে মানবতার নিগূঢ় মহত্ত্ব যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে ওই গাছ দুটিতে। ঝারিতে করে জল এনে নিজে হাতে গাছ দুটিকে স্নান করালাম। মালীটা অবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল না যে আমি বাইরে গাছকে স্নান করাচ্ছি বটে, কিন্তু মনে মনে অভিষিক্ত করছি রাজেনবাবুকে কৃতজ্ঞতা দিয়ে। আজ এটা আমার জীবনের পরম দিন। 

.

সুরেন বকসি তাঁর বড় জুরি গাড়ি হাঁকিয়ে আজ এসেছিলেন। তাঁর শৌখিন স্প্যানিয়েলটার কানে ঘা হয়েছে তাই দেখাবার জন্যে। এ অঞ্চলে পশু-চিকিৎসক নেই বলে দরকার হলে পশুদের চিকিৎসা আমিই করি। আমি ঘায়ে লাগাবার একটা ওষুধ আমার ডিসপেনসারি থেকেই দিলাম আর একটা ইনজেকশনের কথাও বললাম। বললাম, ওটা ওখানে কোথাও পাবেন না, কলকাতা থেকে আনাতে হবে। দামী ওষুধ। সুরেন বকসি একটু দম্ভভরেই উত্তর দিলেন, দামের জন্য আমি পরোয়া করি না, আপনি আমার নামে ভি. পি. করতে লিখে দিন। লিখে দিলাম। তারপর তাঁকে বিদায় দেবার জন্যে বাইরে এসে একটা মজার জিনিস চোখে পড়ল। দেখলাম, তাঁর সহিসের বাঁ কানে একটা ঘা হয়ে কানটা বেঁকে গেছে। সহিসটি আমাকে দেখে সেলাম করলে। বক্‌সিমশায়ের বাড়িতে অনেকদিন ধরে আছে লোকটি। বক্‌সিমশাই কুকুরের কান সম্বন্ধে এত সচেতন, অথচ সহিসের কান সম্বন্ধে এত উদাসীন কেন বুঝতে পারলাম না। একবার মনে হল সহিসের কানের দিকে ওঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আবার তখনই মনে হল না থাক, কি দরকার আমার। এ কথা কেন মনে হল কে জানে। এখন মনে হচ্ছে সুরেন বকসি তো অদ্ভুত লোক বটেনই, আমিও কম অদ্ভুত নই। 

.

সোহাগের বিয়ে খুব ধুমধাম করে হয়ে গেল। আমার একমাত্র মা-মরা মেয়েটিকে যে সৎপাত্রের হাতে সম্প্রদান করতে পেরেছি, এতে আমার আনন্দিত হওয়া উচিত। আনন্দিত যে হইনি তা নয় কিন্তু আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের ব্যবহারে ক্ষুণ্ণও হয়েছি। যদিও মুখে দেঁতো হাসি সবাই বললেন—বাঃ, চমৎকার হয়েছে, খুব আনন্দের কথা। কিন্তু সবাই যে আনন্দিত হননি, অনেকেই যে ঈর্ষা-ক্লিষ্ট হয়েছেন তা বোঝা গেল তাঁদের মুখের ভাব-ভঙ্গীতে। পরশ্রীকাতরতা জিনিসটা বিষ্ঠার মতো, ফুল দিয়ে চাপা দিলেও তার দুর্গন্ধটা গোপন করা যায় না। সেটা প্রকাশ হয়ে পড়েই। সরলতা এবং মহত্ত্ব যেমন চোখে মুখে স্বতঃস্ফূর্ত হয়, কুটিলতা এবং নীচতাও তেমনি হয়। প্রকাশ্যভাবে খুঁতও ধরেছেন অনেকে। অনেককে নাকি ছাপা নিমন্ত্রণ-পত্র পাঠানো হয়নি, অনেককে নাকি দেরিতে পাঠানো হয়েছে। হয়তো আমার অজ্ঞাতসারে এসব ত্রুটি ঘটেছে কিন্তু যাঁরা সত্যিই আমার আত্মীয় বা বন্ধু, তাঁরা এসব ত্রুটি নিয়ে মাথা ঘামাবেন কেন? বিনা-নিমন্ত্রণেই তো তাঁদের আমার বাড়িতে আসবার অধিকার আছে, এসেছেনও কতবার, থেকে গেছেন, খেয়ে গেছেন। যাঁরা দূরে আছেন তাঁদের সকলকেই আমি চিঠি লিখেছিলাম, বিয়ের কথা সকলেই জানতেন। ছাপা নিমন্ত্রণপত্রটার জন্যে তাঁরা অপেক্ষা করে ছিলেন কেন বুঝতে পারছি না। 

এই শহরেও আমার দুই একজন তথাকথিত ঘনিষ্ঠ বন্ধুও নিমন্ত্রণ-না-পাওয়ার ছুতো করে সরে ছিলেন। একজন বললেন—বরবধূকে উপহার দেওয়াটা এড়াবার জন্যেই আসেননি। এ কথাটা বিশ্বাস হয় না। একটা ঝুটো আত্মসম্মানের কবলে পড়েছেন তাঁরা। আমাকে সত্যি যদি ভালোবাসতেন, বিনা-নিমন্ত্রণেই আসতেন। ভালোবাসা জিনিসটা সত্যই বড় দুর্লভ। 

এ বিয়ে উপলক্ষে আরও যে দু’ একটা ঘটনা ঘটেছে তা আরও মর্মান্তিক। বাড়িতে ভিয়ান বসিয়ে অনেক মিষ্টান্ন করিয়েছিলাম। মিষ্টান্নের তদারক করার ভার ছিল গোপীনাথের উপর। লোকটি অনেকদিনের বিশ্বাসী চাকর, সোহাগকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে। সে যা বললে তা শুনে চক্ষুস্থির হয়ে গেছে আমার। সে বললে, সোনাপুকুরের বৌদি এবং তার ছেলে-মেয়েরা নাকি মিষ্টান্নের ভাঁড়ারে ঢুকে মিষ্টান্ন চুরি করত। বাতি বাতি পানতোয়া, রসগোল্লা, মিহিদানা সরিয়েছে। যদি খেত কষ্ট হত না, কিন্তু খায়নি, সব ফেলে দিয়েছে পাঁদাড়ে। আমাকে অপ্রস্তুত করবার চেষ্টা। তারা যে ফেলে দিচ্ছে এ কথা গোপীনাথ প্রথমে বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারামাত্রই আর কাউকে ঢুকতে দেয়নি সে। এতে নাকি অনেক আত্মীয়-আত্মীয়া অপমানিত বোধ করেছেন। এধরনের আত্মীয়-আত্মীয়াদের কবল থেকে কবে আমরা পরিত্রাণ পাব। 

আমার একদল আত্মীয় চিঠি লিখেছেন তাঁদের আসবার খুবই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু অনিবার্য ‘কারণ’বশতঃ আসতে পারেননি। পরে জানলাম অনিবার্য কারণটা আর্থিক। নিমন্ত্রণ-পত্রের সঙ্গে আমার নাকি গাড়িভাড়াটাও পাঠানো উচিত ছিল। গাড়িভাড়া আমি দিতাম কিন্তু নিমন্ত্রণ-পত্রের সঙ্গে সেটা পাঠানো কি শোভন হত! সে কথার উল্লেখ করাও যে অশোভন। এই আমাদের সমাজ, এই আমাদের আত্মীয়-বন্ধুদের নমুনা! একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল। যিনি গাড়িভাড়ার জন্য আসেননি, তাঁর ছেলের বিয়েতে আমি সপরিবারে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তো আমাকে গাড়িভাড়া দেননি, দেবার প্রস্তাবও করেননি। অথচ তিনি যে খুব গরীব লোক তা-ও নন, ছেলের বিয়েতে নগদ মোটা পণও নিয়েছিলেন। 

.

আজ হঠাৎ নুটবিহারীবাবুর সঙ্গে দেখা হল। মুনসেফ ছিলেন ভদ্রলোক, সাবজাজ হয়ে রিটায়ার করেছেন। যখন সাবজজ্ ছিলেন তখন মোটর ছিল, চাপরাসী ছিল, স্যুট পরতেন, হাকিমি গাম্ভীর্যে বিচরণ করতেন বাছা বাছা অফিসারদের সমাজে। আজ হঠাৎ তাঁকে দেখলাম রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন সাধারণ বাঙালী পোশাক পরে। আধময়লা ধুতি, আধময়লা শার্ট, পায়ে হতশ্রী একজোড়া অ্যালবার্ট শু, হাতে বাজারের থলি। মুখে বার্ধক্যের চিহ্ন, চুলে পাক ধরেছে, সামনের দাঁত নেই। তিনি যে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তা বুঝতে পারিনি। আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, দেখে মনে হল আমাকে বোধহয় চিনতে পারেননি। বললাম—“নুটবিহারীবাবু যে। নমস্কার। চিনতে পারছেন?” মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেল তাঁর। 

“কে, ও, ডাক্তারবাবু! আজকাল এখানেই আছেন নাকি?”

“হ্যাঁ, মাস দুই হল বদলি হয়ে এসেছি। 

“প্রমোশন হল?”

“মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছেছি ”

“সিভিল সার্জন হয়েছেন তাহলে। ভালো—”

“আপনিও বদলি হয়ে এসেছেন না কি এখানে?”

“আমি রিটায়ার করেছি। এখানেই আছি একটা বাড়িভাড়া করে—”

“কোথায় আছেন?”

ঠিকানাটা জেনে নিলাম। সন্ধ্যার পর গেলাম তাঁর কাছে। অনেকদিন এক ডিস্ট্রিক্‌টে একসঙ্গে ছিলাম। গিয়ে দেখলাম একটা আড়ময়লা লুঙ্গী পরে একটা ভাঙা বেতের চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে নিজেই আর একটা চেয়ার টেনে বার করে আনলেন। সেটাও খুব মজবুত বলে মনে হল না। বসলুম। এক কাপ চা-ও খাওয়ালেন। ময়লা পেয়ালায় অতি জোলো চা। গল্প হল খানিকক্ষণ। তাঁর চাকুরী জীবনেরই গল্প। কবে কোন্ সাহেব তাঁকে কি বলেছিল, কার কার চক্রান্তে তাঁর আশানুরূপ উন্নতি হল না—এই কথা খালি। সারাক্ষণ যেন হায় হায় করে গেলেন। চুপ করে শুনলাম সব। ভালো লাগছিল না, তবু শুনলাম। শেষে জিজ্ঞাসা করলাম— “এখন কি করেন?”

“বাজার করি আর বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলোকে সামলাই। আর সময় পেলে অঙ্ক কষি কি করে আমার পেন্সন দিয়ে সংসার চালাব। সকালবেলা অবশ্য পূজো করি খানিকক্ষণ, স্বামী জীবনানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়েছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পণ্ডিচেরিতে শ্রীঅরবিন্দের আশ্রমে চলে যাই। চিঠিপত্র লেখালিখি করছি—”

নুটবিহারীর সম্বন্ধে একটা খবর জানি। ছাত্রজীবনে তিনি ইংরেজি সাহিত্য ভালো করে পড়েছিলেন। ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণীর এম-এ। সেপীয়র আর ব্রাউনিং সম্বন্ধে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তাঁর নিজের জীবনে কিন্তু সেপীয়র বা ব্রাউনিংয়ের চিহ্নমাত্র দেখলাম মা। তাঁদের পরীক্ষার খাতায় ফেলে এসেছেন, সঙ্গে করে আনতে পারেননি। সাধারণ লোকের মতোই হায় হায় করছেন। 

.

তপেনবাবু আমার প্রতিবেশী। এখন এক আফিসে কেরানীগিরি করেন। বিয়ে করেননি। বলেন চাকরির উন্নতি না হলে বিয়ে করবেন না। 

তপেনবাবুর বাড়িতে কিন্তু তপেনবাবুর চেয়ে অনেক বড় আসন তপেনবাবুর বোন রঙ্গনার। তাকে ঘিরেই বাড়িতে সর্বদাই আসর সরগরম। মেয়েটি রূপসী নয়, রং কালোই। কিন্তু হাবভাব মুগ্ধ করে দেয়। চোখের দৃষ্টিতে এবং যৌবনের সাবলীলতায় আগুন আছে। সেই আগুনে পুড়ে মরবার জন্যে একদল পুং-পতঙ্গ প্রায়ই সন্ধ্যের সময় ভিড় করে। মেয়েটি নাচ গান অভিনয় সব বিষয়েই পটীয়সী। তবলা আর ঘুঙুরের আওয়াজ প্রায়ই শুনতে পাই। তপেনবাবুর আফিসের যিনি হর্তাকর্তা বিধাতা, তিনি প্রবীণ লোক। তিনিও রোজ আসেন সন্ধ্যেবেলায়। সুতরাং মনে হচ্ছে এবার তপেনবাবুর চাকরির উন্নতি হবেই। 

দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক মহাভারতের আমলেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু আগে সমাজে তাদের স্থান ছিল একটা বিশেষ পল্লীতে বিশেষ সীমার মধ্যে। গৃহস্থের অঙ্গনে তাদের বসতি ছিল না। এখন আমাদের সমাজ ভেঙে যাচ্ছে, তাই সব সীমারেখাও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। পুরনারীদের মধ্যে কে বরনারী, কে বারাঙ্গনা তা এখন ঠিক করা মুশকিল। মালা ভ্রমে সাপকে গলায় দুলিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। এ দেশেও ফরাসী সমাজ গজিয়ে উঠল। 

.

একটা নূতন ফেরিওলা এসেছিল। এ শহরের প্রায় সব ফেরিওলাকেই চিনি আমি। এ লোকটি অচেনা। তার কাছ থেকে একটা ছুরি কিনলাম। তারপর জিগ্যেস করলাম—এখানে কোথায় আছ? সে বললে, ধরমশালায় আছি। কোথাও আমি বেশীদিন থাকি না। এক সপ্তাহের বেশী কোথাও থাকিনি। ভারতবর্ষের সব শহরেই দু চারদিন করে থাকবার ইচ্ছে আছে তার। তার জীবনে বেড়ানোটাই লক্ষ্য, ফেরি করাটা উপলক্ষ মাত্র। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এক শহরে বেশীদিন থাক না কেন? সে হেসে বললে, বেশীদিন থাকলে মন খারাপ হয়ে যায় বাবু। বেশী মাখামাখি করলে মানুষের চক্‌চকে ভাবটা আর থাকে না, গিল্টি বেরিয়ে পড়ে, মন খারাপ হয়ে যায়। 

তার কথা শুনে চমৎকৃত হয়ে গেলাম। এরকম দার্শনিক ফেরিওলা আগে কখনও দেখিনি। ফেরিওলার কথা শুনে নবকিশোরের কথা মনে পড়ল। লোকটাকে দেবতা মনে করেছিলাম। তার চেহারায় কথাবার্তায় সত্যিই একটা দেবত্ব ছিল। কিন্তু বেশী মাখামাখি করবার পর গিলি বেরিয়ে পড়ল। একদিন সকালে দেখি সে উধাও হয়েছে। আর উধাও হয়েছে আমার ক্যাশবাক্সটা। তাতে আড়াই শ টাকা, দুটো গিনি এবং সোনার ঘড়িটা ছিল। 

.

এখান থেকে কিছুদূরে বড় রাস্তার উপর যে পুলটি ছিল সেটি ভেঙে গেছে। পুল ভেঙে যাওয়া আশ্চর্য নয়, কিন্তু আশ্চর্য হলুম স্বয়ং একজিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার সেটির তদারক করতে এসেছেন দেখে। মফঃস্বলের এক পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় পুল ভেঙেছে তার জন্যে স্বয়ং একজিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার এসেছেন, এ যে মশা মারতে কামান দাগা। সাধারণত সাব-ওভারশিয়ার বা বড়জোর ওভারশিয়ার এসব ছোটখাটো ব্যাপারে আসেন এবং তাঁরা যা রিপোর্ট দেন তদনুসারেই গভর্নমেন্ট টাকা খরচ করেন; একজিকিউটিভ ইন্জিনিয়ারের আবির্ভাব একটু অস্বাভাবিক বলে ঠেকল। 

তাব পরদিন ভদ্রলোক নিজেই এলেন আমার ডিপেন্‌সারিতে এক শিশি কার্মিনেটিভ মিশ্চার নিতে। বললেন—“ওটা আমি সর্বদা সঙ্গে রাখি এবং দুবার করে খাই। খেলে ভালো থাকি। এক শিশি আমাকে করে দিন।” করে দিলাম। তারপর আলাপ হল তাঁর সঙ্গে। দেখলাম নগেনবাবু বেশ সদাশয় এবং রসিক। বিলেত-ফেরত, বড় চাকরি করেন, কিন্তু অহংকারের লেশমাত্র নেই। চমৎকার হাসিখুশী লোক। খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করতেই বললেন—“ও, তাহলে তো বেঁচে যাই মশাই। চাপরাসীর হাতের রান্না খেতে খেতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেছে। পেঁয়াজ আর লঙ্কা ছাড়া তৃতীয় কোন মসলা জানা নেই মহাপ্রভুদের কিছু যদি মনে না করেন, একটা অনুরোধ করবো?” “কি বলুন–।” “একটু শুক্তো করাবেন। মুখটা বদলে নেব।” বললাম, “বেশ তো, বেশ তো—এ আর বেশী কথা কি।” আলাপ ঘনিষ্ঠতর হতে জিগ্যেস করলুম—“আচ্ছা এই অজ পাড়াগাঁয়ের পুল দেখতে আপনি এসেছেন কেন বুঝতে পারছি না।” একটু হেসে বললেন—“ওভারশিয়ার চক্রবর্তী আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছে।”

জিগ্যেস করলাম “কে তিনি?”

হেসে বললেন—“তিনি একজন পুরানো পাপী। এখন রিটায়ার করেছেন। এরকম ধুর্ত লোক আমি আর জীবনে কখনও দেখিনি। কালো বামুন। কুচকুচে কালো রং। চোখমুখে একটা শেয়াল-শেয়াল ভাব। প্রতিবছরই সে একটা পুরানো পুলের মেরামতি বাবদ একটা বিল করত। আমি আসবার আগে থেকেই করত। আমার আগে অন্তত পাঁচজন একজিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার তার এ বিল পাস করেছে। আমিও করে দিতাম। পুলটি ছিল একটি পাড়াগাঁয়ের রাস্তায়। সেখান থেকে রেলোয়ে স্টেশন কুড়ি মাইল দূরে। স্টেশন থেকে গরুর গাড়ি করে কিংবা বাইকে করে কিংবা হেঁটে সে জায়গায় পৌঁছাতে হয়। এ কষ্ট স্বীকার করে কোনও একজিকিউটিভ ইন্জিনিয়ার সে পুল দেখতে যায়নি। আমিও যাইনি। রিপেয়ারের বিল প্রতি বছর পাস হয়ে যেত কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। স্টেশন থেকে ওই কুড়ি মাইল রাস্তা, জঘন্য ছিল সেটা। পাবলিকে অনেকদিন থেকে ওটা পাকা রাস্তা করে দেবার জন্যে আন্দোলন করছিল। হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল ওটা পাকা করা হবে। আমাকে যেতে হল সেখানে। ঠিক তার আগেই ওভারশিয়ার চক্রবর্তী ওখানকার পুল রিপেয়ারের জন্য টাকা চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম—‘পুলটা একবার দেখব। তারপর তোমার বিল স্যাংশন করব।’ গিয়ে কি দেখলুম জানেন?” “কি?” “কোনও পুল নেই! Non-existent পুলের রিপেয়ার খরচ বছরের পর বছর নিয়ে যাচ্ছে চক্রবর্তী!”

“বলেন কি। কি করলেন?”

“তারপর একটা নাটকীয় কাণ্ড করল চক্রবর্তী! আমার পায়ে পড়ে পা জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। শৃগালের চোখে কুমীরের অশ্রু ঝরনার মতো পড়তে লাগল। কিছুতেই পা ছাড়ে না। শেষটা তাকে বলতে হল-’আচ্ছা, এবার তোমায় মাপ করলুম, কিন্তু আর এরকম যেন না হয়।’ পরের বছর দেখি আবার চক্রবর্তী সেই পুল রিপেয়ারের বিল এসেছে! তার দিকে চাইতেই সে বললে—‘আমার কথাটা শুনুন আগে সার। বিল এনেছি, কারণ বিল না দিলে অডিট্ ধরবে না? যে পুল গত দশ বছর ধরে বছর-বছর মেরামত হচ্ছে, এবার সে সম্বন্ধে কোন উল্লেখ না থাকলে সন্দেহ হবে না তাদের? এবার বিলটা পাস করে দিন, আর সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজটা ভেঙে ফেলবার একটা অর্ডার আর এস্টিমেটও দিয়ে দিন। তারপর থেকে আর বিল আনব না।” হো হো করে হেসে উঠলেন নগেনবাবু। তারপর বললেন, “সেই থেকে কোনও পুল ভাঙলে তা সে যত ছোটই হোক, নিজের চোখে দেখে আসি।”

.

কাল রাত্রি এগারোটার সময় বিপিন কাকা কোন খবর না দিয়ে এসে উপস্থিত তাঁর বিধবা মেয়েটিকে নিয়ে। বিপিন কাকার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই। বাবাকে উনি দাদা বলতেন বলে আমরা ওঁকে কাকা বলি। এসেই একটি মিথ্যে কথা বললেন—চিঠি দিয়েছিলাম, পাওনি? চিঠি হারানো যে অসম্ভব তা নয়, কিন্তু সাধারণত আমার চিঠি হারায় না। তাছাড়া তাঁর চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছিল তিনি মিথ্যে কথা বলছেন। বিপিন কাকা ধার্মিক মানুষ। রাত এগারোটার সময় এসে তিনি গরম জলে স্নান করলেন। তারপর পুজো করলেন একঘণ্টা ধরে। তারপর চা খেয়ে গল্প করলেন একটু। মনু অত রাত্রে উনুন নিবিয়ে শুদ্ধাচারে তাঁর মেয়ের জন্য লুচি, বেগুন ভাজা, আলুর দম করে দিলে। জিগ্যেস করলাম— “বিপিন কাকা, হঠাৎ এসে পড়লেন যে। কখনও তো খবর নেন না—”

একমুখ হেসে বিপিন কাকা বললেন, “তোমার জন্যে মনটা বড় উতলা হয়ে উঠলো। অনেকদিন দেখিনি তো—”

“আপনার মেয়েকে সঙ্গে এনেছেন কেন—”

“টুপিকে? পাশের গাঁয়েই ওর শ্বশুরবাড়ি যে। তোমার মোটরটা নিয়ে কালই ওকে পৌঁছে দিয়ে আসব–”

বুঝলাম উতলা হওয়ার কথাটাও সর্বৈব মিথ্যে। 

.

শীতলবাবুর বক্তৃতা শুধু যে শোনবার মতো তা নয়, দেখবার মতোও। তিনি বক্তৃতা দিতে দিতে নানারকম অঙ্গভঙ্গী করেন। তাঁর নিজের জীবনের ঘটনাবলীই তাঁর বক্তৃতার উৎস। তিনি প্রায়ই বক্তৃতা করেন, আজকাল ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়ে কোন লাভ নেই। লেখাপড়া শিখে আর কটাকা রোজগার করবে? দলে দলে বি-এ, এম-এ, এম-বি ফ্যা ফ্যা করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কথাটা মিথ্যে নয়, শীতলবাবুর বলবার ভঙ্গীও ওজস্বিনী। কিন্তু তাঁর বক্তৃতাটা সার্থক হত যদি তিনি নিজের ছেলেদের লেখাপড়া শেখাবার জন্যে আধুনিক ভাষায় যাকে বলে ‘আপ্রাণ’ চেষ্টা—তা না করতেন। চেষ্টা সত্ত্বেও কিন্তু তাঁর চারটি ছেলেই বখা হয়েছে, নানারকম শৌখিন বেশভূষা করে পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা মেরে বেড়ানোই তাদের কাজ। যাদের ছেলেরা লেখাপড়ায় ভালো শীতলবাবু সাধারণত তাদেরই শুনিয়ে শুনিয়ে উক্ত বক্তৃতা অঙ্গভঙ্গী সহকারে করে থাকেন। তাঁর নিজের পুত্রবধূ সুন্দরী হয়নি, তাঁর বন্ধু বগলাবাবুর পুত্রবধূটি হয়েছে। শীতলবাবু বগলাবাবুকে বলেছিলেন—বউ সুন্দরী হয়ে কি তোমার চারটে হাত-পা বেরিয়েছে? বউ সুন্দরী হওয়া ভালো নয়। পাঁচজনে নজর দেবে, বখা ছেলেরা বাড়িতে উৎপাত করবে। বগলাবাবু বন্ধুকে চিনতেন, মুচকি হেসে চলে গেলেন। তিনি চলে যাবার পর শীতলবাবু বললেন—সুন্দরী না হাতি! ঢিবির মতো কপাল, ছোট ছোট চোখ, মুখের হাঁ ইয়া বড়। অঙ্গভঙ্গী করে দেখালেন সব।

.

আধুনিক বাংলা উপন্যাস পড়লাম সেদিন একখানা। ইনিয়ে বিনিয়ে কেবল মেয়েমানুষের কথা। কেবল Sex, Sex আর Sex–ও ছাড়া অন্য প্রসঙ্গই নেই। ওর কথাই নানা রঙে ফেনিয়ে নানা ঢঙে বলবার চেষ্টা করেছেন ভদ্রলোক। আমার মনে হল ভদ্রলোক Sex starved : মনে হল গল্পলেখার ছুতোয় তারিয়ে তারিয়ে কামরসটা নিজেই তিনি যেন উপভোগ করছেন। অপরের পক্ষে যা বীভৎস ও ন্যক্কারজনক তাঁর পক্ষে তাই স্বাভাবিক। আমি ক্ষুধার্ত লোককে নর্দমা থেকে ভাত তুলে তুলে খেতে দেখেছি। কোনও নৈতিক বক্তৃতা দিয়ে এদের সংশোধন করা যাবে না। আসল কারণটা সম্ভবত অর্থনৈতিক। জীবনকে ভোগ করবার সামর্থ্য নেই, কিন্তু লোভ আছে প্রচুর। 

.

কাল রাত্রে আমার জীবনে একটি মহা লাভ হয়েছে। পরম প্রাপ্তি। একটি অকৃত্রিম ভক্তের দেখা পেয়েছি। কৃত্রিম ভক্ত জীবনে অনেক জুটেছে। বস্তুত তাদের জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি। তাঁরা যখন আমার প্রশংসার তোড়ে আমাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেন, তখন মনে হয় যেন মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তা-ধোওয়া হোজ পাইপের সামনে পড়ে নাকানি-চোকানি খাচ্ছি। 

কারো মুখের সামনে তার অজস্র প্রশংসা করা যে নিন্দা করার চেয়েও বেশী অশোভন এবং গর্হিত, এ জ্ঞান অনেকের থাকে না। থাকে না, কারণ তাঁরা প্রশংসা করেন কোনও মতলবের তাগিদে। মতলবের তাড়ায় মানুষের শোভন-অশোভন জ্ঞান লোপ পায়। তাঁরা তখন বানরকে কন্দর্পকান্তি এবং ভীরু দুর্বলকে বীরেন্দ্র বলতেও ইতস্তত করেন না। আমার জীবনে এরকম মতলববাজ লোকের দেখা অনেক পেয়েছি। 

কিন্তু কাল রাত্রে যে লোকটি বৃষ্টিতে ভিজে রাত বারোটায় স্টেশনে আমার জন্যে দাঁড়িয়েছিল সে অন্য জাতের। আমি কাল রাত্রে সপরিবারে প্রচুর মালপত্র নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরেছি। আমার ড্রাইভারকে এবং চাপরাসীকে খবর দেওয়া ছিল, কিন্তু তারা কেউ স্টেশনে আসেনি। এসেছিল ওই লোকটি। জিতু জেলে। বাজারে মাছ বিক্রি করে। হাসপাতালে অনেকদিন আগে তার এক যক্ষ্মাগ্রস্ত আত্মীয়কে নিয়ে এসেছিল, আমি তাকে স্যানাটোরিয়মে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিই। কর্তব্য হিসাবেই করেছিলাম, কোনও প্রতিদান প্রত্যাশা করিনি। কথাটা মনেও ছিল না আমার। স্টেশনে গাড়ি থামতেই জিতু এগিয়ে এল, আমি প্রথমটা চিনতেই পারিনি তাকে। তার মাথায় পাগড়ি বাঁধা ছিল। আমাকে প্রণাম করে বললে সে তার সেই আত্মীয়টির খবর দিতে আমার বাসায় আজ গিয়েছিল। গিয়ে দেখল ড্রাইভার আলি মদ খেয়ে বেহোঁশ হয়ে পড়ে আছে, আমার চাপরাসী শিউরামের জ্বর হয়েছে খুব। সে-ও প্রায় বেহোঁশ। জিতু ঝড় জল মাথায় করে নিজে তাই স্টেশনে এসেছে যাতে আমার কোনও কষ্ট না হয়। কুলি ডেকে আনলে, নিজেও কয়েকটা জিনিস নামালে, একটা গাড়ি আগে থাকতেই ঠিক করে রেখেছিল। জিতুর মুখভাবে একটা অসাধারণ ভাব ফুটে উঠেছে দেখলাম। অন্তর্নিহিত শ্রদ্ধার আলোকে তার চোখমুখ প্রদীপ্ত। মুগ্ধ হলাম। 

মুগ্ধ হলাম বললেও সবটা ঠিক বলা হয় না, বলতে হয় কৃতার্থ হলাম। তারপরেই বিস্মিত হলাম মনে মনে। আমার মধ্যে কি এমন আছে যা দেখে ও এমন ভক্তি-গদগদ হয়ে পড়েছে। আমি তো অতি সামান্য লোক। ওর ভক্তিভাজা হবার যোগ্যতা কি আছে আমার? পুরাণের সেই গল্পটা মনে পড়ল। এক ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রহ্মচর্য আশ্রম থেকে বাড়ি ফিরেছে। গুরু তাকে সংসার আশ্রমে প্রবেশ করবার অনুমতি দিয়েছেন। ছেলেটি বাড়িতে এসে কপাটে ধাক্কা দিতেই তার মা কপাট খুলে দিলেন। ছেলে মাকে প্রণাম করল। তারপর জিজ্ঞাসা করল—বাবা কোথায়? মা বললেন, ভিতরে আছেন, এস। ভিতরে এসে কিন্তু তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। শুধু দেখা গেল খিড়কির দুয়ারটি খোলা রয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর পাওয়া গেল না তাঁকে। তিনি ফিরলেন এক বছর পরে। 

ছেলে জিজ্ঞাসা করল, “বাবা, তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে?”

বাবা উত্তর দিলেন, “বনে। তপস্যা করবার জন্যে।”

বিস্মিত হয়ে গেল ছেলে। প্রশ্ন করল— “হঠাৎ এ ইচ্ছা হল কেন?”

বাবা উত্তর দিলেন—”তুমি যখন ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে ফিরে এসে তোমার মাকে প্রণাম করছিলে তখন আমি তোমাকে উঠোন থেকে দেখতে পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম তোমার ললাটে তপস্যা-লব্ধ জ্যোতি জ্বলজ্বল করছে। দেখে আমার মনে হল—আমি কি ওর প্রণাম নেবার যোগ্য? সংসারের সংঘর্ষে আমার চরিত্র যে মলিন হয়ে গেছে! তাই আমি খিড়কির দরজা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বনে চলে গিয়েছিলাম তপস্যা করতে, মলিন চরিত্রকে উজ্জ্বল করতে। এক বৎসর অধ্যবসায়ের ফলে আমার সে সাধনা সিদ্ধ হয়েছে। এখন তুমি আমাকে প্রণাম করতে পার।”

আমার মনে হচ্ছে আমি কি জিতু জেলের ভক্তিভাজন হবার উপযুক্ত? আর একটা কথাও মনে হচ্ছে, ও যদি জেলে না হয়ে কালচার্ড ভদ্রলোক হত তাহলে কি রাতদুপুরে বৃষ্টিতে ভিজে সামান্য উপকারের ঋণ শোধ করবার জন্য আসত? আমার বিশ্বাস আসত না। আজকাল ‘কালচার্ড’ মানেই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক। 

.

কানাই মাড়োয়ারির ব্যবহারে সেদিন হৃদয়ঙ্গম করলুম কেন ওরা ব্যবসায়ী হিসাবে এত উন্নত। আমার এক ভাইঝি প্রসব হবার জন্য আমার কাছে এসেছিল। হাসপাতালের নার্স লুইসাকে সেজন্য মেহনত করতে হয়েছিল খুব। উপর্যুপরি দু’দিন রাত জেগেছিল, প্রায় এক মাস রোজ দু’বার করে এসে ‘ড্রেস’ করে দিয়ে গিয়েছিল। অন্য কোন জায়গায় হলে অন্তত সে দেড়শ টাকা রোজগার করত। কিন্তু আমার কাছে ‘ফী’ চাইতে পারে না। তাই ঠিক করলুম ওকে একখানা ভালো শাড়ি কিনে দেব। কানাই মাড়োয়ারির দোকান থেকে ভালো শাড়ি নিয়ে এলাম একখানা। হালকা হলুদ রঙের শাড়ি। মনু বললে—কাল যেটেরা পুজো। কালই ওকে দিও শাড়িখানা। সন্ধ্যের সময় লুইসা এলে তাকে দেখানো হল শাড়িটা। রং পছন্দ হয়েছে কিনা। লুইসা দক্ষিণ-বাসিনী। খ্রীষ্টধর্ম বরণ করেছে বটে, কিন্তু তামিল রক্ত ওর ধমনীতে বহমান। লুইসা হেসে বললে—আমার ডগমগে গাঢ় রং পছন্দ। ‘I prefer deep colour’! 

তার পরদিন ভোরে উঠেই গেলাম কানাইয়ের দোকানে। কানাই বললে —আজ রবিবার, আমার দোকান বন্ধ। আর আমার সেল্সম্যান মহাদেবের কাছে দোকানের চাবি থাকে। তার বাড়ি মাইল দুই দুরে। কাল যদি শাড়িখানা বদলে দি, হবে না? বললাম, কিন্তু আজ যে যেটেরা পুজো। ওই সঙ্গেই শাড়ি দেওয়া নিয়ম আমার স্ত্রী বলছে। বেশ, তোমার যদি অসুবিধা হয়, কালই বদলে দিও। শাড়িটা তার কাছে রেখে এলাম। 

ঘণ্টা দুই পরে দেখি মহাদেব রিক্শা করে এসে হাজির। রিক্শায় প্রকাণ্ড একটা কাপড়ের বস্তা! মহাদেব বললে—কানাই নিজে সাইকেল করে আমার বাড়ি গিয়েছিল, তার কথামত আমি ব্যাঙ্গালোর শাড়ি দোকানে যতগুলো ছিল সব আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। আপনার যে রংটা পছন্দ বেছে নিন। কানাইয়ের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। 

এ কাহিনীর আর একটা চমৎকার ভাষ্য করেছেন আমার বাঙালী বন্ধুরা। হাসপাতালের যুবতী নার্স লুইসার শাড়ির জন্য আমি দোকানে ছুটোছুটি করছি—এর একটি অর্থই তাঁদের চিত্তে প্রতিভাত হয়েছে এবং সেটা তাঁরা ফুসফুস গুজগুজ করে আলোচনা করছেন! 

.

বাংলার বাইরে এই শহরে কিছুদিন থেকে এসেছি। এখানকার যে বাঙালী সমাজ নিজেদের ‘প্রবাসী’ বলে চিহ্নিত করে রেখেছেন তাঁদের দুরবস্থা দেখলে সত্যিই বড় হতাশ হয়ে পড়তে হয়।

এককালে বাংলা দেশের কৃতী-সন্তানরা এখানে এসে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেদের। সকলে তাঁদের খাতির করত, তাঁরা খাতিরের উপযুক্তও ছিলেন। তাঁরা অর্থোপার্জন করেছিলেন প্রচুর, এখানকার জনহিতকর কাজে ব্যয়ও করেছেন প্রচুর। এখানকার স্কুল, হাসপাতাল, কলেজ তাঁদের নামের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের নিজেদেরও প্রত্যেকের প্রাসাদোপম বাড়ি আছে এখানে। জমিজমাও আছে। জমিদারিও ছিল কারো কারো। 

কিন্তু তাঁদের বংশধরদের দেখে হতাশ হতে হয়। গরুড়ের বংশে এরকম চামচিকেদের জন্ম হল কি করে। ছেলেদের মধ্যে অধিকাংশই লেখাপড়ায় খুব খারাপ। সবই প্রায় থার্ড ডিভিসন। গুণ্ডামিও করতে পারে না ভালো করে, ছোঁচামি করে। প্রতি বাড়িতেই বড় বড় মেয়ে, অনেকেরই বিয়ে হয়নি, অনেকেই ব্যভিচারিণী হয়ে পড়েছে, অনেক সময় প্রকাশ্যেও। এদের দুর্গাপূজার তিন চারটে দল, লাইব্রেরীও একাধিক, কোনটাই ভালোভাবে চলে না, প্রত্যেকটাতেই দলাদলি আর ঘোঁট। ভাগ্যে রবীন্দ্রনাথ এদেশে জন্মেছিলেন, তাই তাঁর নামে ‘জয়ন্তী’ মাঝে মাঝে হয়। পঁচিশে বৈশাখটা তো একটা পর্বের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা নিজেদের বাপ-মায়ের জন্মদিন কবে তা জানে না, তারা কবির জন্ম-উৎসবে নাচতে, গাইতে বা বক্তৃতা করতে আসে। উৎসবের নামে কি যে প্রহসন হয় তা বোঝবার ক্ষমতাও এদের নেই। বিহারীদের নিন্দায় এরা পঞ্চমুখ। কিন্তু আমার মনে হয় মানুষ হিসাবে বিহারীরা এদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক বেশী ভদ্র। 

বাঙালীর ছেলেরা চাকরি পায় না তার একটা বড় কারণ এখানকার অধিকাংশ বাঙালী ছেলেই চাকরি পাওয়ার যোগ্য নয়। আমি অমুক বাবুর নাতি বা দৌহিত্র—এ বললে তো আর চাকরি মিলবে না। যোগ্য বাঙালীরা চাকরি পায়নি এরকম দৃষ্টান্তও আছে। এই নিয়ে অনেকে গলাবাজি করে চীৎকার করেন। তাঁরা ভুলে যান যে চাকরির ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বত্রই পক্ষপাতিত্ব আছে। নিজেদের লোককে সবাই চাকরি দিতে চায়। এরাও চায়। 

এ বিষয়ে কিন্তু বাঙালীরা ব্যতিক্রম, বাঙালী বড় চাকুরেরা সাধারণত বাঙালীদের প্রতি কোন আগ্রহ প্রকাশ করেন না—এইরূপ জনশ্রুতি। যোগ্য বাঙালী চাকুরী প্রার্থী বাঙালী অফিসার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এরকম একাধিক খবর আমি জানি। এত কথা লিখলাম মনের দুঃখে। 

একটা খবর পেয়ে দুঃখটা নতুন করে অনুভব করলাম। জগদীশবাবু মারা গেছেন। তিনি পোস্টাফিসে কাজ করতেন। অনেকদিন আগে রিটায়ার করেছেন। পাড়ার ছেলেরা আমার কাছে চাঁদা চাইতে এসেছিল শবদাহের ব্যবস্থা করবার জন্যে। তাঁর পরিবার নাকি কপর্দকশূন্য। 

অতীতের গর্ব আঁকড়ে ধরে আমরা বেঁচে আছি ভবিষ্যতের আশায়, এ কথা অনেকে বলেন। কিন্তু সেটা কি সত্যি? একজন বাঙালীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন বাঙালীদের ইতিহাসের খবর সে রাখে কি না। দেখবেন কিচ্ছু রাখে না। নিজের বংশেরই পুরো খবর রাখে না। দেখবেন কিচ্ছু রাখে না। নিজের বংশেরই পুরো খবর রাখে না। আস্ফালন করবার বেলায় কেবল বলে, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, আমাদের বিবেকানন্দ, আমাদের অরবিন্দ। কিন্তু একটু চেপে ধরুন, দেখবেন রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-অরবিন্দের সম্বন্ধেও বিশেষ কিছু জানে না সে। নামগুলো জানে শুধু। আর সেইগুলোকে মূলধন করে মাঝে মাঝে নাচ-গান-বক্তৃতার মজলিস বসায় নিজেকে জাহির করবার জন্যে। হায় ভগবান, কোথায় চলেছি আমরা? সমূলে ধ্বংস হওয়াটাই কি এ জাতির অনিবার্য পরিণাম? 

.

কাল মনের দুঃখে বাঙালীদের সম্বন্ধে যা লিখেছিলাম আজ নিজেই তার প্রতিবাদ করেছি, কারণ আজ অরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছে। অরুণ বসুকে আগে কখনও দেখিনি। তার মায়ের অসুখের জন্যে আমাকে ডাকতে এসেছিল। পিতৃহীন অরুণ নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে। অর্থাভাবে লেখাপড়া বিশেষ হয়নি, কিন্তু সে মানুষ হয়েছে। পৈতৃক সম্পত্তি সে তিন বিঘে জমি পেয়েছিল। একা নিজের হাতে চাষ করে সে তিন বিঘে জমিতে শাকসব্জির বাগান করেছে। পৈতৃক বাড়ি ছিল একখানা। কিন্তু মেরামতের অভাবে পড়ে গিয়েছিল সেটা। অরুণ নিজের হাতে মাটির দেওয়াল দিয়ে ছোট বাড়ি করছে আবার। চমৎকার তক্তকে ঝক্‌ঝকে বাড়ি। বাড়িটা তার বাগানের মধ্যেই। কারও সাহায্য না নিয়ে নিজের হাতে করেছে বাড়িখানা। বাড়িতে লোক বেশী নেই, সে আর তার মা। মাকে পরম সুখে রেখেছে দেখলাম। একটি গাই আছে, সেইটি নিয়ে থাকেন তিনি। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। 

তার মায়ের ম্যালেরিয়া হয়েছে। একটু খারাপ ধরনের ম্যালেরিয়া, সারতে একটু সময় নেবে। আমি ফী নিতে চাইনি। কিন্তু অরুণ বললে, আপনি ফী না নিলে স্বস্তি পাব না। মনে হবে গরীব বলে আপনি আমার উপর দয়া করলেন। কিন্তু আমি গরীব নই, আমার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স প্রায় আড়াইশো টাকা। 

অরুণের মতো ছেলে বাঙালী জাতির গৌরব। জানি না এরকম ছেলে বাঙালীদের মধ্যে আরও আছে কিনা, যদি থাকে তাহলে বাঙালীরা আবার গৌরবের শিখরে আরোহণ করবে। অরুণ শহর থেকে অনেক দূরে থাকে বলে তাকে চিনতাম না। শহরের তথাকথিত অভিজাত বাঙালীদের সঙ্গে তার নিজের কোন যোগাযোগ নেই। 

.

এক রিকশাওলার মুখে এক ভদ্রলোকের কথা শুনলাম। যখন ফরসা জামা-কাপড় পরেন, ঘন ঘন সিগারেট খান, পুলিসে চাকরি করেন—তখন তাঁকে ‘ভদ্রলোক’ বলতেই হবে। কিন্তু মনে মনে ভাবছি—তাঁকে ‘মাল’ বলব না ‘চী’ বলব, না স্যাম্পল বলব! কোটা ঠিক মানাবে ওই পুলিসপুঙ্গবকে? ঘটনাটা এই। পুলিস-অফিসারটি উক্ত রিকশাওলার রিক্শায় চড়ে প্রায় মাইল দুই গেলেন দুপুর রোদে। গলদঘর্ম রিকশাওলা কপালের ঘাম মুছে যখন ভাড়া চাইলে তখন অবাক হয়ে গেলেন। 

ভাড়া! ভাড়া চাইছে তাঁর কাছে?

বললেন, “আমি কে চেন?”

“না হুজুর—”

“আমি দারোগা। তোমার রিক্শার নম্বর কত দেখি। ও, ১৭৫। আচ্ছা। কত ভাড়া চাই তোমার—”

ঘাবড়ে গেল রিকশাওলা। বললে,”মাপ করবেন, আমি চিনতে পারিনি। মেহেরবানি করে আমার নামে রিপোর্ট করবেন না, হুজুর।”

হুজুর বললেন,”কিন্তু তোমার নম্বরটা যে কাঁটার মতো বিধে গেল মনে। সে কি অমনিতে উঠবে?”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল রিকশাওলা। 

“ও কাঁটা তুলতে হলে কিছু সেলামী লাগবে।”

“কত হুজুর”

“অন্তত এক টাকা”

টাকাটা দিয়ে সেলাম করলে রিকশাওলা, তার পর ছুটে পালিয়ে গেল সেখান থেকে। রিকশাওলাটা আমার কাছে এসেছিল তার ছেলের ওষুধ নিতে। 

“আমি আপনার পুরো ফী দিতে পারব না। কিছু মাপ করুন, পুলিসের জ্বালায় আমরা মারা যেতে বসেছি”

বলে, ওই কাহিনীটি আমাকে বললে। 

আমি বললাম, “তোমাদের তো ইউনিয়ন আছে। তোমরা এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই পার—”

সে বললে, “ইউনিয়ন? ছিল বটে আগে একটা। এখন সেটা উঠে গেছে—”

“কেন”

“আমরা চাঁদা দিয়ে যে টাকাটা জমিয়েছিলাম আমাদের প্রেসিডেন্ট সেটা মেরে দিয়ে সরে পড়েছেন। শুনছি নাকি বোম্বাই গেছেন।”

“কে ছিলেন প্রেসিডেন্ট?”

যার নাম করলে সে মোটেই শ্রমিক নয়, এক বড়লোকের কথা ছেলে।

ভাবছি—গরীবগুলোর উপায় কি তাহলে? 

.

মনুর জ্বরটা কাল থেকে স্পষ্ট ধরা পড়েছে। অর্থাৎ তাকে বিছানা নিতে হয়েছে। অনেকদিন থেকেই না কি একটু একটু জ্বর রোজই হত, আমার কাছে গোপন করে ছিল। কেন করেছিল জানি না। মনুর স্বভাবের মধ্যে কেমন যেন একটা গোপনতা আছে। তার অন্তরলোকে আমার অবাধ গতি, কিন্তু তবু মনে হয় ওর নিজস্ব আর একটা জগৎ আছে যেখানে ও একাকিনী। অসুখে পড়ে ও যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। অপরাধী ধরা পড়ে গেলে যেমন হয়, অনেকটা তেমনি। আজবলাল আমার চেয়েও বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চিরঞ্জীব আর মালতীকে টেলিগ্রাম করলুম। ওরা এখানে এসে থাকুক যতদিন না মনু সেরে উঠছে। সারতে দেরি হবে, টাইফয়েড বলে মনে হচ্ছে। 

.

আমার এক ভাগনে এসেছিল আমার কাছে। তার পরীক্ষা হয়ে গেছে, সে এসেছিল আমার কাছে একখানা চিঠি নিতে। চিঠি নিয়ে সে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবে চাকরির জন্য। বন্ধুটি ইচ্ছে করলে নাকি চাকরি জুটিয়ে দিতে পারে একটা। চিঠিখানা নিয়েই সে চলে গেল, মনুর অসুখের জন্য তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখলাম না। এসেই চলে গেল। যেন পোস্টাফিসে চিঠি ফেলতে এসেছিল।….. সোহাগকে আজ টেলিগ্রাম করলাম আসবার জন্য। মনুর টাইফয়েডই হয়েছে। আগেই আন্দাজ করেছিলাম। এখন রক্ত পরীক্ষা করে নিঃসন্দেহ হয়েছি। 

মনুর অসুখে বাড়িতে যেন একটা সাড়া পড়ে গেছে। দু’বেলায় অন্তত পঞ্চাশ কাপ চা হচ্ছে, বৈঠকখানায় বারান্দায় লোকের ভিড়। আমার সহকর্মী ডাক্তাররা সবাই আসছেন, তাছাড়া আসছেন এখানকার প্রতিবেশীরা। আমার রোগীর আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ও কম নয়, তারা সবাই রোজ খবর নিতে আসে। এরা গরীব, এরা অনাত্মীয়, কিন্তু এদের উৎকণ্ঠা দেখে মনে হয় এদের চেয়ে বড় আত্মীয় আমার কেউ নেই। আমার রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়েরা এখনও কেউ আসেননি। দু’চারজন পোস্টকার্ড-যোগে খবর নিতে চেষ্টা করেছেন। আমি বড় ভীত হয়ে পড়েছি। সোহাগ দিনরাত কাঁদছে। মনুর জ্ঞান নাই। 

.

মনুর অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপের দিকে যাচ্ছে। কলকাতার একজন বড় ডাক্তারকে আসবার জন্য ‘তার’ করেছি। এর মধ্যেও ‘কলে’ বেরুতে হয়েছে আমাকে। রোগীদের বাড়ির বিপদের দিকটাও তুচ্ছ করতে পারি না। তিনটে টাইফয়েড রুগী আমার চিকিৎসায় আছে। আমার উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। সুতরাং আমাকে যেতেই হচ্ছে। 

আবার এই সব করুণ রসের মধ্যেও হাস্যরসের খোরাক পেয়ে যাচ্ছি মাঝে মাঝে। মহাকাল যেন জীবন-মরণের একঘেয়েমি নষ্ট করবার জন্যে মাঝে মাঝে চাটনির ব্যবস্থা করছেন। 

একটি বাড়ির কর্তা টাইফয়েডে মরণাপন্ন হয়ে আছেন। আজ তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখি একটি লোক বাইরের বারান্দায় বসে হাউ হাউ করে কাঁদছে। লোকটির এক মুখ কাঁচা-পাকা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, ভুরুও কাঁচা-পাকা, ভুরু দুটি ঝুলে পড়েছে চোখের উপর। চোখের জলে নাকের জলে এই মুখ পরিপ্লাবিত। আমি ভাবলুম কোন আত্মীয় বুঝি। পরে জানতে পেরেছি, আত্মীয় নয়—পাওনাদার। যিনি রুগী তিনি অসুখে পড়বার ঠিক আগেই ওর কাছ থেকে চড়া সুদে হাজার তিনেক টাকা ধার নিয়েছিলেন। বলেছিলেন হ্যাণ্ডনোটটা কাল লিখে দেব। কিন্তু সেইদিন রাত্রেই তিনি জ্বরে পড়েন, আর লিখতে পারেননি! 

.

কুলগুরু এসেছেন। তিনি দক্ষিণাকালীর পূজা করছেন। তারস্বরে পাঠ করছেন দক্ষিণাকালীর স্তব। “করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং” যদি দয়া করে মনুকে ফিরিয়ে দেন। বলিদানের ছাগ-শিশুটা আর্তরব করছে। পূজার হট্টগোল ঘণ্টা কাসরে প্রকম্পিত হচ্ছে বাড়িটা। এত গোলমাল আমি কখনও বরদাস্ত করতে পারি না। কিন্তু এখন করছি। কিছু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। একটি কথাই কেবল মনে কাঁটার মতো বিঁধে আছে—মনুর জীবন-সংশয়— হেমারেজ হচ্ছে। যে কোনও উপায়ে হোক ওকে বাঁচাতেই হবে তা সে উপায় যতই হাস্যকর, যতই অদ্ভুত হোক না কেন। এই আগ্রহের কাছে সমস্ত যুক্তি মাথা নত করেছে। 

কলকাতায় যে ডাক্তারকে টেলিগ্রাম করেছিলাম তিনি দুঃখিত হয়ে টেলিগ্রাম করেছেন যে সাতদিনের আগে আসতে পারবেন না। হেভিলি এনগেজ্‌ড্। ওর সঙ্গে একসঙ্গে পড়েছিলাম আমি। আমার চেয়ে ও সব বিষয়েই খারাপ ছিল। ফেল করেছিল দুবার। কিন্তু তার বাবা ছিলেন কলকাতার একজন যশস্বী ডাক্তার। টাকার অভাব ছিল না। ছেলেকে বিলেত পাঠালেন এবং সেখানে সে বারকয়েক ফেল করে অবশেষে একটা বিলিতী ডিগ্রি নিয়ে এল। এসে বসতে লাগল বাবারই ডিসপেন্সারিতে। বছর দশেক সেখানে টিকে রইল কোনক্রমে। তারপর তার প্র্যাকটিস জমল। দশ বছর পরে কলকাতার রুগীরা বুঝতে পারল ও একজন দিগ্‌গজ ডাক্তার। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় এই যে আমারও ধারণা হল ও সত্যিই বড় ডাক্তার। মনে হল মনুর চিকিৎসা ও আমার চেয়ে ভালো করে করতে পারবে। টাকার জোরে বারাঙ্গনারাও আজকাল ‘দেবী’, তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরাও প্রথম শ্রেণীর প্রথম সারে দেদীপ্যমান। টাকার জৌলুস সকলেরই বুদ্ধিভ্রংশ করে দেয়।

আমি ভাবতাম আমার বুদ্ধি এসব মেকি জিনিসে অভিভূত হয় না। কিন্তু এখন দেখছি হয়। এখন মনে হচ্ছে কোন্‌টা মেকি কোন্‌টা খাঁটি তা ধরাও শক্ত। হাঁসেদের মধ্যে কোনও বক যদি দীর্ঘকাল বাস করতে পারে, তাহলে সবাই তাকেও হাঁসের মর্যাদা দেবে—হাঁসেরা না দিক, মানুষেরা দেবে। অদ্ভুত জীব এই সামাজিক মানুষরা!

.

আজবলালকে আর সামলানো যাচ্ছে না। সে মাথা খুঁড়ছে, চুল ছিঁড়ছে, পাগলের মতো হয়ে গেছে। সোহাগের ফিট হচ্ছে বারবার। একমাত্র মালতীই দৃঢ়হস্তে এই বিপর্যস্ত নৌকোটার হাল ধরে বসে আছে। চিরঞ্জীব নির্বাক হয়ে গেছে। আমার অবস্থা অবর্ণনীয়। মনু কাল চলে গেছে।

.

দিন কয়েক হল বদলি হয়ে এসেছি। বদলি হওয়ার যে কি ঝঞ্ঝাট তা আর ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। গভর্নমেন্টের বাড়ি, গভর্নমেন্টের চাকর-চাপরাসী, যাওয়ার খরচও গভর্নমেন্টের, কিন্তু তবু মনে হয় যেন কি একটা লোকসান হচ্ছে। অর্থের দিক থেকে লোকসান হয় না, কারণ মাইনে যা পাবার ঠিক পাই, নতুন জায়গায় কলও অনেক আসে। কিন্তু তবু মনে হয় লোকসান হল। মনে হয় পুরানো জায়গায় আমার কিছু অংশ যেন ফেলে এলাম, তা উদ্ধার করা যাবে না, হারিয়ে যাবে।

এখানে এসে ক’দিন খুব ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আমার আগে যিনি ছিলেন তিনি অসুস্থ হয়ে আমার বাড়িতেই রইলেন ক’দিন। তাঁর কলগুলো আমাকে সামলাতে হল। অফিসের কাজকর্মও অগোছালো অবস্থায় পেয়েছি, ঠিক করে নিতে হচ্ছে সেগুলো। হাসপাতালে সার্জিকাল কেসের ভিড় খুব। তিন-চারটে বড় অপারেশন রোজই করতে হয়। তাছাড়া পুলিস কেস আর পোস্টমর্টেম।

কাল একটা পোস্টমর্টেম করে মন বিকল হয়ে গেছে। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে? বিশেষ করে মেয়েমানুষ? সতীনের ছেলের মাথায় হাতুড়ি ঠুকে তাকে মেরে ফেলেছে একটা উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে। ছেলেটার বয়স মাত্র দশ বছর। মেয়ের আত্মীয়স্বজনেরা প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে যে মেয়েটা পাগল। তাই ওকে under observation রেখেছি। আমার পাগল বলে মনে হয় না। খাচ্ছে দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। দেখে মনে হয় খুব নিশ্চিন্ত ঘুম। যেন ও জীবনের একটিমাত্র কর্তব্য শেষ করে এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। এর পর যাই হোক ও তার তোয়াক্কা করে না।

হঠাৎ মনে হল প্রায় সাত দিন মনুর কথা একবারও মনে পড়েনি। কাজের তোড়ে এই স্মৃতি রঙীন পালকটা ভেসে চলে গেল না কি! লজ্জিত হলাম।

জিতু জেলে ক’দিন আগে এসেছে একটি রোগী নিয়ে। অতদূর থেকে ট্রেনভাড়া খরচ করে এসেছে। বিনা পয়সার রোগী নয়, আমাকে রীতিমত ফী দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে। এখানে একটা ঘর ভাড়া করেছে।

জিতুকে বললাম—“ওর চিকিৎসা তো ওখানেই হতে পারত। এখানে ওকে এত খরচ করিয়ে নিয়ে এলে কেন?”

জিতু বললে—“আপনার উপর আমাদের বিশ্বাস বেশী। অন্য কোথাও চিকিৎসা করিয়ে ভরসা হয় না।”

মালতী বলছিল জিতু প্রায়ই বাড়ির ভিতরে এসে কাঁদে। মনুর জন্য। আমার সামনে কিন্তু সে শোক প্রকাশ করেনি একদিনও। মালতীর কাছে প্রকাশ করেছে লুকিয়ে। মালতীকে বলেওছে আমাকে একথা যেন না জানানো হয়। আমার মনে তাহলে দুঃখ হবে। মালতী কিন্তু কথাটা আমাকে বলে দিয়েছে।

.

ডায়াবিটস্ সম্বন্ধে একজন ডাক্তার গড়গড় করে অনেক নূতন কথা বলে আমাকে সেদিন তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এত কথা আমি জানতাম না। নবতম সংস্করণের যে বইটা কিছুদিন আগে কিনেছি, তাতেও এসব কথা নেই। শ্রদ্ধা হল ডাক্তারটির উপর। দিন দুই পরে শ্রদ্ধা কিন্তু আর রইল না। আমার নামেও বিদেশী এক কোম্পানির বিজ্ঞাপনের প্যামফ্লেটটা এল। তাতে দেখলাম ওই সব কথাই লেখা আছে। গান্ধিজীর সেই কথাটা মনে পড়ল—এখনকার ডাক্তাররা বিদেশী ঔষধ ব্যবসায়ীদের দালাল মাত্র।

এসব অবশ্য সত্য যে বিদেশীরাই চিকিৎসাশাস্ত্রে বহুরকম গবেষণা করছেন, তাঁদের গবেষণা ডাক্তারি শাস্ত্রে সত্য বলে স্বীকৃতও হচ্ছে, কিন্তু একথা সমান সত্য যে আমরা মাছি-মারা কেরানীর দল, বিদেশী প্যামফ্লেটে যা কিছু লেখা থাকে তা নির্বিচারে সত্য বলে বিশ্বাস করি এবং রোগীদের তা কিনতে বাধ্য করি। অনেক সময় রোগীরা এতে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সেদিকে লক্ষ্য থাকে না। আমরা আপ-টু-ডেট চিকিৎসা করে গর্ব অনুভব করি।

.

একটা আশ্চর্য লোক দেখলাম আজ। ‘কল’ থেকে ফিরছিলাম। এমন সময় টক্ করে একটা পাথর এসে আমার গাড়িতে লাগল। আর একটু হলে জানালার কাচ ভেঙে যেত। গাড়ি থামালাম। দেখি কালো লম্বা শুঁটকো একটা লোক প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গোঁফ দাড়ি মাথার চুল লম্বা লম্বা, অনেকদিন তেল পড়েনি বলে কটা হয়ে গেছে। কোমরে একটা ন্যাকড়া জড়ানো। উরুর অর্ধেকও ঢাকা পড়েনি তাতে। আমার ড্রাইভার আলী নেমে গিয়ে তাকে জিগ্যেস করলে কেন সে ঢিল ছুঁড়েছিল।

নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কেবল তার গোঁফের জঙ্গলে একটা শিহরণ বয়ে গেল দেখলুম। তার চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হল ক্ষমতা থাকলে আমার মোটরটাকে সে ভস্মীভূত করে দিত। কিন্তু কোন কথা বললে না সে।

পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় মোটর দাঁড়ালেই ছেলের দল এসে দাঁড়ায় আশেপাশে। তাদের একজন বললে—ও লোকটা চিড়ি-মার। চিড়িয়া অর্থাৎ পাখি মারে। তীর দিয়ে বা বন্দুকে দিয়ে নয়। ঢিল ছুঁড়ে। গুলতি দিয়ে ঢিল ছোঁড়ে না, হাত দিয়ে ছোঁড়ে। হাতের লক্ষ্য অব্যর্থ। চড়ুই, শালিক, কাক, বক— যা সামনে পায় তাই মারে। মেরে পুড়িয়ে খায়। এক জায়গায় দেখলাম কতকগুলো ইঁট স্তূপীকৃত করা রয়েছে। আর তার কাছেই পোড়াবার সরঞ্জাম। দু’খানা দাঁড়-করানো ইঁটের মাঝখানে কয়লা। কয়লা সে কেনেনি, শুকনো ডালপালা পুড়িয়ে করছে।

সুসভ্য বিংশ শতাব্দীতে প্রাগৈতিহাসিক বন্যযুগের নমুনা দেখে বিস্মিত হলাম।

.

কাল মনুর বার্ষিক শ্রাদ্ধ হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজনরা কেউ আসেনি।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল এদেশের লোকেরা, যাদের আমরা মূর্খ ছোটলোক বলি, তারা আত্মীয়ের আত্মীয়েরও মৃত্যু হলে সবাই মাথা কামায়। গ্রামসম্পর্কের মৃত আত্মীয়দের সম্মান জানায় এই ভাবে। আমরা সভ্য কিনা, ওদের কাণ্ড দেখে হাসি। এমন বাঙালী বাবুরও খবর জানি যিনি মায়ের মৃত্যুতেও মাথা কামাননি। পুরোহিতকে মূল্য ধরে দিয়েছেন। স্যুটের সঙ্গে ন্যাড়া মাথা নাকি নিতান্ত বেমানান। সুরুচিতে বাধে।

মনুর শ্রাদ্ধে একটি পেশাদার লোভী পুরোহিতকে ডেকে কাজ করালাম এবং দ্বাদশজন ব্রাহ্মণ নামধেয় অব্রাহ্মণকে ভোজন করালাম এবং তথাকথিত বন্ধুবান্ধব, যাদের পোলাও মাংস খাইয়ে শতাধিক টাকা ব্যয় করলাম তাঁরা আমার কেহই বন্ধু নন। মনে পড়ল মনু একটা পা-কাটা খোঁড়াকে খাওয়াতে ভালবাসত। কিন্তু সে তো থাকে একশ মাইল দুরে!

চাপরাসীকে বললাম—শহরে যত খোঁড়া ভিখারী আছে ডেকে নিয়ে এস। তাদের খাওয়াব। চাপরাসী ফিরে এসে বললে খোঁড়া ভিখারী একটাও নেই। কানা আর নুলো আছে। কম্পাউণ্ডার শোভনলাল বললে শিবমন্দিরে এক খোঁড়া সাধু থাকে। বলেন তো তাকে ডেকে আনি।

বললাম, আনো। একটু পরেই আবক্ষদাড়ি এক লাল সন্ন্যাসী ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে এসে হাজির। মনে হল সোবিয়েত রাশিয়া থেকে এল নাকি! কারণ তার সব লাল। দাড়ি লাল, মাথার পাগড়ি লাল, জামা জুতো এমন কি ছাতা পর্যন্ত লাল। সে বললে সে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ খাবে না, তার গুরুজীর বারণ আছে। তবে আমি যদি তাকে কিছু টাকা দি তাহলে সে শিউজির ভোগ চড়িয়ে প্রসাদ পেতে পারে।

জিজ্ঞাসা করলাম, কত টাকা চাই?

সে আমার পিছন দিকে চেয়ে বললে, দশ টাকা। আমিও সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম শোভনলাল দু’হাতে দশটা আঙুল তাকে দেখাচ্ছে। দূর করে দিলাম লোকটাকে। জিতু জেলেকে আজ দশ টাকা পাঠিয়ে দেব মনুর সেই খোঁড়াকে ভালো করে খাইয়ে দেবার জন্য।

.

তৃপ্তি-অতৃপ্তির রহস্য ভেদ করা শক্ত। কাল মালতী সামান্য বেগুন বড়ি আর উচ্ছে দিয়ে শুক্তো রেঁধেছিল। এত ভালো লেগেছিল। আজ সেই মালতীই অনেক রকম মসলা দিয়ে মাংসের কোর্মা রেঁধেছে, রান্না ভালোই হয়েছে, চিরঞ্জীব তো বললে চমৎকার, কিন্তু খেয়ে আমার তেমন তৃপ্তি হল না। কালকের শুক্তোটাই বেশী ভালো লেগেছিল। অথচ আগে এই মালতীরই রান্না কোর্মা কত তারিফ করে খেয়েছি।

মালতীর রান্না ঠিক আছে। আমিই বদলাচ্ছি। ওস্তাদী গানের চেয়ে সাদাসিধে রামপ্রসাদী গানই বেশী ভালো লাগে আজকাল।

.

কম্পাউণ্ডার শোভনলাল আজ চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। এক পাউণ্ড কুইনিন সরিয়েছিল। যে বাড়ি থেকে কুইনিন উদ্ধার হয়েছে, সকলের ধারণা ছিল সেটা ওরই বাড়ি এবং বাড়ির কর্ত্রী ওর বউ। এখন শুনছি অন্যরকম। বাড়িটি বেশ্যাবাড়ি এবং ওই মেয়েটি ওর রক্ষিতা। আরও শুনছি হাসপাতালের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনটি—যিনি চন্দনফোঁটায় চিতেবাঘটি সেজে রোজ হাসপাতালে আসেন তিনি নাকি ওর প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনিই পুলিসে খবর দিয়ে শোভন লালকে এই খপ্পরে ফেলেছেন।

আমি পক্ষপাতহীন থাকবার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার মনে মনে ইচ্ছেটা শোভনলাল ছাড়া পাক আর ওই চিতেবাঘটা ফাঁদে পড়ুক। এরকম অবৈধ ইচ্ছে মনে জাগা উচিত নয়, কিন্তু জাগছে। বাইরে কিন্তু একটা ন্যায়পরতার মুখোশ পরে আছি। আশ্চর্য!

.

দুর্গাপুরের দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় গাড়ির টায়ার ফাটল! আলী বললে, “কুছ ফিকির নেই হুজুর, আভি হাম সব ঠিক কর দেঁতে হেঁ। স্টেনি ঠিক হ্যায়।”

কিন্তু দেখা গেল স্টেনিও ঠিক নেই। এতেও দমল না আলী। বললে—“কুছ ফিকির নেই হুজুর, আভি বানা লেঙ্গে। আপ পেড়কা ঠাণ্ডে মে মজেসে বৈঠ যাইয়ে—”

কাছেই একটা প্রকাণ্ড গাছের ছায়া ছিল। আলী সেখানে আমার বিছানা করে দিলে একটা। আমি ছায়ায় বসে বসে তার চাকা বদলানো দেখতে লাগলাম।

চাকা-বদলানো কাজটা নিতান্ত সহজ নয়। প্রথমে সে স্টেনির ভিতর থেকে টিউবটা বার করলে। তারপর যেখানে যেখানে ছ্যাঁদা হয়েছে সেগুলো সলিউশন দিয়ে জুড়ে আবার টিউবটাকে তার ভিতরে পুরে পাম্প করতে লাগল। পাম্প হয়ে গেলে সে বেরুলো ইঁট খুঁজতে। কাছে-পিঠে কোথাও ইট ছিল না। সে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ। তপ্ত ‘লু’ বইছে। আলী নির্বিকার। জঙ্গল থেকে খুঁজে ইট নিয়ে এল। তারপর ‘জক’ ফিট্ করে ফাটা টায়ারটা বার করলে। সেটাকে সরিয়ে দিয়ে স্টেনিটা ফিট্ করতে লাগল।

আমি আলীর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। রোগা লোকটা, বয়স হয়েছে, মুখে জরার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওর জীবনচরিতও কিছু কিছু জানি। ও সব রকম কাজ করেছে। রিকশা চালিয়েছে, টমটম চালিয়েছে, একটা ঘোড়া-গাড়ির কোচোয়ানও ছিল কিছুদিন, মুটেগিরি পর্যন্ত করেছে। বহু জায়গায় ঘুরেছে। বহু মনিবের কাছে মোটরের ড্রাইভারি করেছে। মিলিটারিতে ছিল, দেশ-বিদেশেও ঘুরেছে অনেক। হঠাৎ মনে হল অ্যাব্রাহাম লিংকনের মতোই ওর জীবন। কিন্তু ও আব্রাহাম্ লিংকন হয়নি কেন? ওর দুটো সাংঘাতিক দোষের কথা জানি। প্রথমত, ভয়ানক মিথ্যে কথা বলে। দ্বিতীয়ত, সুযোগ পেলেই মদ খায়। চাকা ফিট্ করে আলী বললে—“আইয়ে হুজুর, গাড়ি তৈয়ার হ্যায়।” গাড়িতে বসে আলীকে জিগ্যেস করলাম— “আলী, তুম্ ঝুট বাত বোলা হ্যায়—”

“কভি নেহি হুজুর—”

“কভি নেহি বোলো।”

“বহুত খু”—

“দারু পিতে হো?”

“কভি নেহি হুজুর।”

“কভি নেহি পিও।”

“বহুত খু—”

হঠাৎ এই মিথ্যেবাদী মাতালটাকে ভালো লেগে গেল। আব্রাহাম্ লিংকনের চেয়েও!

.

এই পৃথিবীতেই কি স্বর্গ নরক আছে? মহাপ্রভু সিং এই জীবনেই নরক-যন্ত্রণা ভোগ করছে দেখতে পাচ্ছি। কিছুদিন আগে যখন জরিপ হয়েছিল তখন মহাপ্রভু সিং আমিনকে মোটা ঘুষ খাইয়ে গঙ্গার ধারের প্রায় তিন চার-মাইল-ব্যাপী জমি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিল। তার মধ্যে অনেক বিধবার, অনেক নাবালকের, অনেক গরীব ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের জমিও ছিল। জমির দখল নিয়ে মকদ্দমা করবার সামর্থ্য ছিল না বেচারীদের। তাদের নীরবে অশ্রুপাত করে নিরস্ত হতে হয়েছিল। মহাপ্রভু সিং সাড়ম্বরে জমিগুলো ভোগ করছিল। গঙ্গার ধারে বিরাট বাড়ি করিয়েছিল, বাড়ির চারদিকে চমৎকার বাগান। শোনা যায় বাগান আর বাড়ি করতে তার হাজার পঁচিশেক টাকা খরচ হয়েছিল। বাড়িটি যেই শেষ হল অমনি কিন্তু এক অপ্রত্যাশিত প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হতে হল তাকে। প্রতিদ্বন্দ্বী না বলে অপ্রতিদ্বন্দ্বিনী বলাই উচিত। স্বয়ং মা গঙ্গা এসে হাজির হলেন তার বাড়ির সামনে এবং দিন সাতেকের মধ্যে বাড়ি-বাগান সব গ্রাস করলেন।

মহাপ্রভু সিংয়ের টাকা ছিল, সুতরাং রোখ চড়ে গেল। আর একটা বাড়ি করালো, সেটাও কেটে গেল। উপর্যুপরি পাঁচটি বাড়ি কেটে গেছে তার। শেষ বাড়িটি করিয়েছিল গঙ্গার ধার থেকে তিন মাইল দূরে। কিন্তু মা গঙ্গা তাকেও রেহাই দেননি, সেখানেও গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আমিনকে ঘুষ দিয়ে যে-সব জমি সে দখল করেছিল, সব গঙ্গাগর্ভে গেছে। মহাপ্রভু সিং এখন একটা খোড়ো ভাড়াটে ঘরে বাস করে। পাঁচ ছেলে ছিল, সব মারা গেছে একে একে। চোখে দেখতে পায় না। একটা পুরনো চাকর তাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে বেড়ায়। কাল আমার কাছে এসেছিল চিকিৎসা করবার জন্যে। তার সর্বাঙ্গে কি যেন বেরিয়েছে। দেখলাম, কুষ্ঠ হয়েছে। কথাটা শুনে থর্ থর্ করে কাঁপতে লাগল। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেল। নরক কি এর চেয়েও বেশী ভয়ংকর?

.

আমার এখানে প্র্যাকটিস বেড়েছে বলে অনেকের রাত্রে ঘুম নেই, অনেকের টনক নড়েছে, অনেকের চোখ টাটিয়েছে। শুনছি আমার বিরুদ্ধে একটা দরখাস্ত গেছে উপরওয়ালার কাছে। আমি নাকি হাসপাতালের কাজ ফাঁকি দিয়ে কেবল প্র্যাকটিস করে বেড়াই। আমি নাকি নিজে বাড়িতে ওষুধ রেখে তা বিক্রি করি।

যে ওষুধ হাসপাতালে নেই বা বাজারে সহজে পাওয়া যায় না, কিংবা যে-সব ওষুধ ইমার্জেন্সীর জন্য হঠাৎ দরকার হয় তা নিজের কাছে রাখবার অনুমতি আমি অনেক আগেই নিয়ে রেখেছি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। আমি হাসপাতালের কাজ ফাঁকি দিয়ে প্র্যাকটিস করছি এ অপবাদও টিকবে না, কারণ আমি এখানে এসে যতগুলো অপারেশন করেছি এবং রোজ করি, তত আমার আগে কেউ করেননি। সুতরাং ওই দরখাস্ত আমার কেশস্পর্শ করতে পারবে না। হৃদয় স্পর্শ করেছে কিন্তু। দরখাস্তকারীদের নাম জানতে পেরে প্রাণে বড় ব্যথা পেয়েছি। সবই প্রায় বাঙালী এবং অনেকেই আমার কাছে উপকৃত।

ব্যাঙ্কের খাতাটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই আজ আলমারির ড্রয়ারগুলো খুঁজছিলাম।

অনেক চিঠি আর পুরনো কাগজপত্রের ভিড়ে যেন দিশেহারা হয়ে পড়লাম। অতীতের পুরানো বন্ধুরা যেন ঘিরে দাঁড়ালো আমাকে একসঙ্গে। যারা একদিন কত আত্মীয় ছিল আজ তারা কে কোথায় আছে জানি না। কয়েকজনের মৃত্যু-সংবাদ পেয়েছি। অন্যদের কোন খবরই জানি না। যখন ভাগলপুরে ছিলাম তখন আমার ধোপার নাম ছিল কারু। ছোট একখানা খাতার উপর মনুর হাতের লেখা আছে দেখছি—কারুর হিসাবের খাতা।

মনুর একটা চিঠিও পেলাম। মনু লিখেছে, “তোমার জন্যে আমার বড় ভাবনা হয়। তুমি শরীরের যত্ন কোরো। আজবলালকে বোলো যেন তোমার মোটরের টিফিন কেরিয়ারে রোজ লুচি, তরকারি আর ডিমের ওমলেট করে দেয়। থারমসে ঠাণ্ডা জলও ভরিয়ে নিও। ঠাকুরপো চিঠি লিখেছে তুমি নাকি সকালে খালি পেটে চা খেয়ে বেরিয়ে যাও, আর ফেরো বেলা দেড়টা দুটোর সময়। অতক্ষণ খালি পেটে থাকলে পিত্তি পড়বে না? আজবলালকে দিয়ে খাবার করিয়ে সঙ্গে নিয়ে যেও। বাবা আমাকে যেতে দিচ্ছেন না এখন, তাই আটকে পড়েছি। কিন্তু তুমি যদি শরীরের উপর অত অত্যাচার কর তাহলে আমাকে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হবে। আমার জন্যে ভেবো না। আমার শরীর বেশ ভালো আছে। আমি মরব না। এদেশে মেয়েরা অমর। আমার আশেপাশে রোজ যতগুলি মেয়ে দেখি তাদের অধিকাংশই বিধবা। আমার কিছু হবে না, তুমি ভেবো না। নিজের শরীরের যত্ন কোরো তুমি। আমি বোধ হয় দিন পনেরো পরে যাব। এই সপ্তাহেই যেতাম, কিন্তু বাবা ছাড়ছেন না……।”

মানুষ যখন ভবিষ্যদ্বাণী করে তখন তার আত্মপ্রত্যয়ের সীমা থাকে না। কিন্তু মহাকালের বিচারে সব ভবিষ্যদ্বাণী বুদ্বুদের মতো ফেটে যায়। মনু আজ কোথায়? শুধু সে যে সশরীরে বেঁচে নেই তা নয়, আমার মনের ভিতরও নেই। তার স্মৃতি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। আজকাল ক্বচিৎ তাকে মনে পড়ে।

.

রেভারেণ্ড টমসনের সঙ্গে আজ দেখা হল। দেখা হয়ে কৃতার্থ হয়ে গেলাম। অত বড় বিদ্বান্, অমন শান্ত, অমন নিরহংকার পরোপকারী লোক আমি আর দেখিনি। এক অখ্যাত পল্লীর একপ্রান্তে বাস করেন তিনি একটা মাটির খোড়ো ঘরে। সামনে সামান্য একটু জমি আছে। তারই একাংশ কঞ্চি দিয়ে ঘিরে সামনে একটু শাকসবৃদ্ধির বাগান তাঁর। নিজেই তার দেখা-শোনা করেন। স্বপাক খান। অতি সাধারণ খাওয়া। ওই শাকসব্জি, ভাত আর একটু দুধ। একটু কথা কয়ে বুঝলাম জ্ঞানের সমুদ্র। ডাক্তারি শাস্ত্রেও আমার চেয়ে বেশী পণ্ডিত বলে মনে হল। ক্যানসার সম্বন্ধে ফরাসী ভাষায় লেখা একটা বই দেখালেন আমাকে।

আমি তাঁকে বললুম ফরাসী ভাষা আমি জানি না।

তখন তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে করে কিছু পড়ে শোনালেন। অত বড় পণ্ডিত লোক, কিন্তু কথায় ব্যবহারে বিনয় যেন বিকীর্ণ হচ্ছে আলোর মতো। আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা কইলেন যেন আমি তাঁর গুরু। তাঁর শোবার ঘরে দেখলাম একটি বড় ক্রশ রয়েছে। তার সামনে বসেই তিনি সকাল-বিকেল প্রার্থনা করেন। কাউকে কখনও ক্রিশ্চান হতে বলেন না, বলেন, ভালো হও। তাঁর কাজ হচ্ছে সেবা। অনেকগুলি ছোট ছেলেকে বিনাপয়সায় পড়ান রোজ। কারো অসুখ হলে শুশ্রূষা করেন। সাধারণ ওষুধ বিতরণ করেন বিনামূল্যে। কাছে একটা জঙ্গল আছে সেখানে রোজ যান সকালে। নিজের রান্নার জন্যে সংগ্রহ করে আনেন শুকনো ডালপালা আর সংগ্রহ করেন বটানিক্যাল গবেষণার জন্য নানারকম নমুনা। একটি ছোটখাটো ল্যাবরেটরি আর মাইক্রোসকোপও আছে তাঁর। আর কাছে অসংখ্য ভক্ত যারা তাঁকে সাহায্য করবার জন্যে ব্যগ্র, কিন্তু তাদের সাহায্য তিনি কদাচিৎ নেন। তাঁর প্যান্টে আর জুতোয় দেখলাম নানারঙের তালি। আসবাবের মধ্যে দুটি কেরোসিন কাঠের টেবিল, গুটি চারেক মোড়া, একটি তক্তাপোশ।

এই সামান্য উপকরণেই তাঁর জীবনে সমৃদ্ধ, পরম আনন্দে বাস করছেন মহর্ষির মতো। শুনেছি কোনো এক বিলিতী মিশনারি ফাণ্ড থেকে তিনি মাসিক পঞ্চাশ টাকা পান। তা দিয়ে প্রতিমাসে ওষুধ কেনেন প্রায় কুড়ি টাকার। কুইনিন, অ্যাস্পিরিন, সাফা ড্রাগস্‌, আইওডিন, স্পিরিট আর ওইজাতীয় সস্তা সাধারণ ওষুধ

আমাকে ডেকেছিলেন নিজের দাঁত তোলাবার জন্য। আমি ফী নিতে চাইলাম না। তখন তিনি বললেন—তাহলে আপনার নামে ৫.০০ টাকা আমি ডোনেশনস্বরূপ নিচ্ছি। ডোনেশনের রসিদ একটা দিলেন আমাকে। একাধারে এত গুণের শোভন সমন্বয় আমি আর দেখিনি।

.

প্রত্যেক লোকই একটা না একটা কিছু অবলম্বন করে টিকে থাকেন। বাইরের অবলম্বন নয়, মনের অবলম্বন। এই অবলম্বন না থাকলে মানুষ নোঙ্গরহীন নৌকার মতো সংসার-সাগরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়। এই অবলম্বনই তাঁর শক্তির উৎস, ব্যক্তিত্বের কেন্দ্র। এই অবলম্বনেরই বোধ হয় অপর নাম অহংবোধ বা অহংকার। কারও জ্ঞানের অহংকার, কারও ধর্মের অহংকার, কারও যশের অহংকার, কারও বা টাকার অহংকার। এই সব নোঙ্গরের সহায়তায় আমরা নিজেদের জীবনকে স্থির রাখবার চেষ্টা করি। যিনি ধার্মিক তিনি ধর্মকে আঁকড়ে থাকেন, যিনি জ্ঞানী তিনি জ্ঞানকে। যিনি ধনী তিনি মনে করেন টাকার জোরেই তিনি টিকে থাকবেন। আজ কিন্তু নেকিচাঁদকে দেখে মনে হল ধনের নোঙ্গরটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশী অপলকা। একটা বড় ব্যাঙ্ক ফেল হয়েছে, নেকিরাম ভিখারীর মতো হাহাকার করে বেড়াচ্ছে। টাকাই তার সর্বস্ব ছিল, এখন সে নিঃস্ব।

আর মাস দুই পরেই আমাকে রিটায়ার করতে হবে। রিটায়ার করে কোথায় যাব? কি করব? আমাদের সমসাময়িক অনেকেই রিটায়ার করে প্র্যাকটিস করতে বসেছেন। এঁদের অনেকের সঙ্গে আলাপ করবার সুযোগ হয়েছিল। আলাপ করে হতাশ হয়েছি। প্রত্যেকেই দেখলাম আত্মম্ভরিতায় পরিপূর্ণ, অনেকে আবার বিষকুম্ভ পয়োমুখ। কেউ সুখী নয়। অনেকের ধারণা শহরের লোকেরা তাঁদের যথোচিত মর্যাদা দেয়নি, অনেকের বিশ্বাস তাঁরা জ্ঞানে বুদ্ধিতে এত অধিক উচ্চস্তরের যে সাধারণ লোক তাঁদের নাগাল পায় না। সুতরাং যতটা প্র্যাকটিস হবে তাঁরা আশা করেছিলেন ততটা হয়নি এবং সেজন্য তাঁরা মনে মনে ক্ষুব্ধ, যদিও বাইরে একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব ফুটিয়ে রেখেছেন। শহরের অন্য ডাক্তারদের প্রতি অসীম অবজ্ঞা তাঁদের।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এরকম একটা ভণ্ডামির মুখোশ পরবার ইচ্ছে নেই। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টাকার জন্যে হায় হায় করবারও প্রবৃত্তি নেই আমার। দরকারও নেই। যা রোজগার করেছি তাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু করব কি? চুপ করে তো বসে থাকা যাবে না। কিছু একটা করতেই হবে। অনেকের বুড়ো বয়সে ধর্মে মতি হয়। আমার কিন্তু সে মতি এখনও হয়নি। জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তি। ডাক্তারি ছাড়া আর কিছুতে প্রবৃত্তি নেই। আর কিছু জানিও না। কিন্তু কোথায় ডাক্তারি করব! যারা মিথ্যে সার্টিফিকেট লিখে, অ্যাবর্শন করিয়ে, দালালকে কমিশন দিয়ে প্র্যাকটিস জমায়, তাদের দলে ভিড়ে গিয়ে গুঁতোগুঁতি করতে হবে শেষে? ওদের চেয়েও respectable তথাকথিত অনেস্ট ডাক্তারও যে নেই তা নয়, কিন্তু তাদের সবজান্তা ভাব, তাদের আত্মম্ভরিতা, তাদের আন্তরিকতার অভাব, তাদের মেকি হাসি এবং লেফাপাদুরস্ত ভদ্রতা আরও অসহ্য মনে হয় আমার কাছে।

মনে আর একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। জীবনের শেষে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে গিয়ে বাস করব, তাদের নিয়েই থাকব। কিন্তু এখন অনুভব করছি আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ আমার আত্মীয় নয়। অধিকাংশই শত্রু। হয় প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে, না হয় মনে মনে বিরুদ্ধভাব পোষণ করে। কাউকে আমি আপন করতে পারিনি। হয়তো এটা আমার নিজেরই দোষ, কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে বুঝেছি যে ওদের সঙ্গে বাস করা যাবে না। কি করব তাহলে? কোন্ তীর্থে গিয়ে থাকব? দু’একটা তীর্থস্থানে ইতিপূর্বে বেড়াতে গেছি। ভালো লাগেনি। সমস্যায় পড়েছি কি করব।

এইখানেই একটা বাড়ি কিনে ফেললাম। বাড়িটার অসুবিধা অনেক। শহর থেকে দূরে। পাড়াটাও ভালো নয়। কিন্তু প্রকাণ্ড হাতা আছে বাড়িটার চারধারে। হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারব। শহরের মাঝখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে পারি না আমি। কলকাতায় ওই জন্যেই গেলাম না। সেখানে গিয়ে কিই বা করতুম? তাস খেলা, আড্ডা দেওয়া বা পার্কে চক্কোর দিয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি করার বাতিক আমার নেই। কলকাতা একটা সমুদ্র বিশেষ। তার মধ্যে সাপ -হাঙরও আছে, আবার মণি-মাণিক্যও আছে।

অনেকদিন কলকাতায় বাস করলে মনের মতো সঙ্গী হয়তো পেতে পারতুম। কিন্তু এতদিন পরে হঠাৎ গিয়ে তা পাব না। কিছুদিন আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম। দেখলাম সব অচেনা। চেনা লোকেরও অচেনা হয়ে গেছে। সবাই নিজের নিজের ঘানিতে বাঁধা, অপরের দিকে তাকাবার কারও অবসর নেই। দেখা হলেই মুচকি হাসিটা আর নমস্কারটাও যেন বাঁধা ফরমূলার মতো যন্ত্রচালিতবৎ। প্রাণ নেই, আন্তরিকতার অভাব। এরকম মরুভূমিতে টেকা যাবে না। তাই এখানে থাকাই স্থির করলাম। এখানে অনেককেই চিনি, অনেকে আমাকেও চেনে। এদের মধ্যে থেকেই বাকি জীবনটা কাটাব। পুরাতন উপকরণ দিয়েই নূতন জীবনের রাস্তা একটা তৈরি করতে হবে ভেবে-চিন্তে। দেখা যাক কি করতে পারি।

এখানকার স্বরূপ পাণ্ডের ছেলে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাকে কাঁকে নিয়ে যেতে বলেছিলুম, কিন্তু নিয়ে যায়নি। নিয়ে গিয়েছিল এক দেহাতী কবিরাজ বজ্রংগী মিশিরের কাছে। বজ্রংগী মিশির বেশ কৃতবিদ্য কবিরাজ। কাশীতে অনেকদিন পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু তিনি কবিরাজী প্র্যাকটিস করেন না, করেন চাষবাস। স্বরূপ পাণ্ডের সঙ্গে তাঁর নিম্নলিখিতরূপ কথাবার্তা হয়েছিল। স্বরূপ পাণ্ডেকে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন–”কে আপনি, কি চান?”

“আমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে”

“তা আমি কি করব—”  

“আপনার কাছে চিকিৎসার জন্যে এনেছি–”

“আমি চিকিৎসা করি না। তাছাড়া এখন আমার ফুরসত নেই, আমার গম দৌনি হচ্ছে-“যদি দয়া করে একবার দেখেন ওকে—”

“আমি দয়া করলে কিচ্ছু হবে না। মহাপাপ না করলে লোকে পাগল হয় না। ভগবান দয়া করলে কিছু হতে পারে। আমি দয়া করলে কিছু হবে না।”

“না, তবু কিছু ওষুধ বলে দিন”

“পাপের ওষুধ প্রায়শ্চিত্ত। তাই কর গিয়ে—”

স্বরূপ পাণ্ডে বিব্রত হয়ে পড়লেন।

তারপর বললেন—“আপনার উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস। আপনার নাম শুনে এসেছি। এমন করে তাড়িয়ে দেবেন না।”

“ও আমার উপর বিশ্বাস আছে না কি? আচ্ছা, তাহলে এক কাজ কর। ওই যে কুয়োটা দেখছ ওর জল তুলে ওকে খাওয়াও আর ওই জলে ওকে চান করাও—”

“আর কোন ওষুধ দেবেন না?”

“ওই ওষুধ।”

এই বলে মিশিরজী তাঁর ছাতা আর লাঠি নিয়ে মাঠের দিকে চলে গেলেন। মিশিরজীর বাড়ির চাকর দীনু বললে—“উনি যা বললেন তাই এখন করুন কয়েকদিন। যদি ওই করে কয়েকদিন টিকে থাকতে পারেন তাহলে উনি ভালো করে দেখে ওষুধ দেবেন।”

সাত দিন পরে মিশিরজী বললেন—“আচ্ছা, এবার ওকে আন দেখি।”

প্রায় আধঘণ্টা নাড়ী ধরে বসে রইলেন। তারপর ওষুধ দিলেন। স্বরূপ পাণ্ডের ছেলে ভালো হয়ে ফিরে এসেছে।

.

আমার প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। খুব বড় একটা স্টেশন ওয়াগন কিনলাম। তাতে শোবার জায়গা, রাঁধবার জায়গা, এমন কি ছোটখাটো একটা ড্রইংরুমের মতোও আছে। শতকরা আশীটা অসুখ যে সব সাধারণ ওষুধ দিয়ে সারে সেগুলোও অনায়াসে রাখা যাবে ওতে। প্রচুর জায়গা আছে গাড়িটাতে। ভ্রাম্যমাণ ডাক্তার হব ঠিক করেছি। গ্রামে গ্রামে হাটে বাজারে ঘুরব। চিকিৎসা করব সাধারণ লোকদের। চিকিৎসা করব পয়সা রোজগার করবার জন্য নয়, নিজের তাগিদে। কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা না করলে হতাশাব কবলে পড়তে হবে না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন