বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
খুব সকালে গীতিয়া এসেছিল। আর তার সঙ্গে এসেছিল একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে।
“এরা সব কে—”
“আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়ে। সব চোখ উঠেছে। আপনি তো আমাদের পাড়ায় অনেকদিন যাননি, তাই ডেকে নিয়ে এলাম। নিজেদেরই তো গরজ।”
গীতিয়ার কণ্ঠস্বর একটু অভিমানের সুর। সে যে ডাক্তারবাবুর বিশেষ স্নেহাস্পদা একথা সে পাঁচজনের কাছে খুব বড় গলা করে বলে বেড়ায়, ডাক্তারবাবু অত টাকা দিয়ে তাদের মহাজনের কবল মুক্ত করেছেন, কিন্তু সদাশিবের উদাসীন ব্যবহারে সে যেন একটু নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে ইদানীং। সদাশিব যদি তাকে স্নেহের চক্ষে দেখতেন তাহলে একমাসের মধ্যে একবারও কি খবর নিতেন না? আজবলাল চলে যাওয়ার পর সে সেখানে এসে থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু উনি রাজী হননি। সদাশিবের একটু স্নেহ পেলে সে কৃতার্থ হয়ে যায়। এর মধ্যে কোনও খারাপ ভাব নেই, খারাপ ভাব যে থাকতে পারে, তা তার চিন্তারও অতীত। সে সদাশিবের কাছে কন্যা-স্নেহ প্রত্যাশা করে। সদাশিব হয়তো তাকে স্নেহও করেন, কিন্তু তার কোনও বহিঃপ্রকাশ নেই। গীতিয়ার তাই অভিমান হয়েছে একটু।
সদাশিব ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকের চোখে ওষুধ দিয়ে দিলেন। একটা শিশি করে কিছু ওষুধ আর একটা ড্রপারও দিলেন।
“রোজ সকাল-বিকেল দিয়ে দিস–”
গীতিয়া তখন আঁচল থেকে খুলে খানকয়েক নোট সদাশিবের হাতে দিয়ে বললে, “এইটে রাখুন—’
“কি এটা—”
“দু’ জনে খেটে কিছু টাকা জমিয়েছি, ধারে সেটা শোধ করে নিন–”
“ঘুঁটে আর দুধ দিয়ে শোধ করবার কথা ছিল। নগদ টাকা কেন? কোথা পেলি নগদ টাকা? কারো কাছে ধার করেছিস নাকি?”
চুপ করে রইল গীতিয়া। তারপর বলল, “টাকা যে অনেক। ঘুঁটে আর দুধ দিয়ে ও-টাকা জন্মে শোধ হবে না—”
“তুই টাকা কোথা পেলি বল না—”
গীতিয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “ছবিলাল মোড়লের বাড়ি গিল্লা নোরি’তে বাহাল হয়েছি। খাওয়া-পরা দেবে, তাছাড়া ২৫ টাকা মাইনে দেবে। ওঁকেও কংগ্রেস আপিসে একটা চাকরি করে দিয়েছে, মাইনে ৪৫ টাকা, পিওনের কাজ করতে হয়। এ মাসে পঞ্চাশ টাকা জমাতে পেরেছি, সেটা দিয়ে গেলাম। ঘুঁটে আর দুধে টাকা তিরিশেক শোধ হবে—’
সদাশিব টাকাগুলি পকেটে রেখে দিলেন। তারপর বললেন, “ছবিলাল লোকটা পাজি শুনেছি—”
“খুব পাজি। কিন্তু কি করব, ভালো লোকে না রাখলে পাজি লোকের কাছেই যেতে হবে—”
গীতিয়ার চোখে এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে গেল।
চুপ করে রইলেন সদাশিব, কি আর বলবেন। সেই পুরাতন সত্যটাই উপলব্ধি করলেন, অসাধু লোকেদের হাতে ক্ষমতা এসেছে, সাধুদের এখন পরিত্রাণ নেই। ছলে বলে কৌশলে ওরাই এখন ভোগদখল করবে।
প্রশ্ন করলেন, “ছবিলাল মোড়লের ছেলেটাকে তো পুলিসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল—”
“ছাড়া পেয়ে গেছে। ওদের টাকার জোর আছে, কংগ্রেস ওদের সহায়, ওদের কি কেউ আটকে রাখতে পারে?”
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন সদাশিব। মনে হল তিনি হেরে গেলেন। আর একটা কথাও মনে হল—গীতিয়ার মতো মেয়ে এইবার ওর লম্পট ছেলেটার কবলে পড়বে। একটা ছবি ফুটে উঠল মনে—হরিণী যেন ময়াল সাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
“আমি যাই তাহলে-
গীতিয়া প্রণাম করে কিছুদূর চলে গেল।
“গীতিয়া, শোন—”
“কি–”
“ও চাকরি ছেড়ে দে তুই—”
সোৎসুক হয়ে উঠল গীতিয়ার চোখের দৃষ্টি। নির্বাক আগ্রহে সে চেয়ে রইল সদাশিবের দিকে। সদাশিব কোন কথা কইলেন না। তখন গীতিয়া জিগ্যেস করল, “চাকরি ছেড়ে দিলে আমাদের চলবে কি করে?”
“তোরা স্বামী-স্ত্রী আমার এখানে এসেই থাক। তুই তো লেখাপড়া জানিস, আমার বাড়ির ‘আউট হাউসে’ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল কর একটা। আর তোর স্বামী আমার গরু-বাছুর ঘর-দোর দেখাশোনা করুক। দুটো গাই এবার বিয়োবে। দু’জনে আমার এখানেই খাবি-দাবি থাকবি। তোদের আর যা যা দরকার হয় তা-ও পাবি।”
গীতিয়া হাতে যেন স্বর্গ পেল।
উদ্ভাসিত মুখে বলল, “এই তো আমি চাইছিলুম। যাই ওকে বলে আসি—”
“এগুলো নিয়ে যা-
“কি—”
“টাকাগুলো নিয়ে যা—”
“ও নিয়ে আমি কি করব?”
“পোস্টাফিসে একটা পাস বুক করে জমা করে রাখ—”
“কিন্তু”
“আর কিন্তু শুনতে চাই না। যত শিগ্গির পার এখানে এসে পড়—”
গীতিয়া একছুটে বেরিয়ে গেল। ছেলেমেয়েগুলোও ছুটতে লাগল তার পিছু-পিছু।
রামলক্ষ্মণ ঠাকুর এসে বলল, “চাল ডাল নুন তেল সব ফুরিয়ে গেছে।” সদাশিব বললেন, “আচ্ছা, স্লিপ লিখে দিচ্ছি, দোকান থেকে আনিয়ে নাও।” সদাশিব আজকাল বাইরে বাইরে খান। কিন্তু বাড়িতে অনেক লোক খায়, অনেক গরীবদুঃখী।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন