হাটে বাজারে – ১২

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। বারো।।

নবীগঞ্জের হাটের কাছে সেই বড় দীঘিটার ধারে চেয়ার টেবিল পেতে বসেছিলেন সদাশিব। দীঘির ধারে জগদীশ কুঁজড়ার বাড়ি। অপারেশন করবার পর জগদীশ ভালো হয়ে গেছে। আজবলাল চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি দুপুরে আর বাড়িতে খেতে যান না। আলীর সহায়তায় বাইরের কোথাও না কোথাও রান্না করে নেন। আলীও রাঁধে ভালো। তাছাড়া যেখানে রান্না করা হয় সেখানে আশেপাশে তাঁর চেনা রোগী থাকেই। তারাও এসে আলীকে সাহায্য করে। সেদিন জগদীশের বউ ছেলেমেয়েরা আলীর সহকারী হয়েছিল। কেউ মসলা বেটে দিচ্ছে, কেউ জল তুলে আনছে, কেউ তরকারি কুটে দিচ্ছে। নতুন ধরনের এক যাযাবর জীবন যাপন করছেন সদাশিব। রোজই কোথাও না কোথাও যেন পিকনিক্ হচ্ছে।

সদাশিব ডায়েরি লিখছিলেন।

“আজবলাল আর ফেরেনি। লিখেছে তার জমি নিয়ে বড্ড বেশী জড়িয়ে পড়েছে, তার এক জ্ঞাতি নাকি তার সঙ্গে মকদ্দমা করছে জমির মালিকানা স্বত্ব নিয়ে। লিখেছে মকদ্দমা শেষ হলেই ফিরে আসবে। আমি জানি আসবে না। জমির মকদ্দমা সহজে মেটে না।

“মালতীর খবরও পাই মাঝে মাঝে। উত্তরপ্রদেশের তীর্থগুলি একে একে দেখে বেড়াচ্ছে। কোন কোন জায়গায় থেকেও যাচ্ছে বেশ কিছুদিন। চিরঞ্জীব লিখেছে মালতী অনেক ভালো আছে। ‘ফিট্’ আর হয়নি। মালতী নাকি প্রত্যেক তীর্থস্থানে গিয়ে মন্দিরেই অধিকাংশ সময় কাটায়। চিরঞ্জীবই একটু মুশকিলে পড়েছে। তার ধর্মে তেমন মতি নেই। লিখেছে শেপীয়রের নাটকগুলো আবার পড়তে শুরু করেছি। আরও লিখেছে—টাকা যদি বাঁচে কাশ্মীরটা দেখে আসবার ইচ্ছে আছে। আমি তাকে লিখে দিলাম টাকার জন্যে ভেবো না, কাশ্মীর বেড়িয়ে এস। যারা যেখানে থেকে সুখী থাকে থাক। আমার জন্যে কেউ যেন কষ্ট না পায়।

“সোহাগরাও বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বিলেতেই থাকবে! লিখেছে বছরে একবার আমার সঙ্গে এসে দেখা করে যাবে। প্লেনে আসতে যেতে বেশী সময় লাগবে না। আসে যদি ভালোই, না-ও যদি আসে তাতেই বা ক্ষতি কি! কারো জন্যে কিছু আটকায় না। ছেলেবেলার একটা কথা মনে পড়ছে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা ঝুমকোলতা ছিল। বাঁশের একটা মাচার উপর ভর করে অজস্র ফুল ফোটাত সে। একদিন ঝড় হয়ে তার মাচাটা পড়ে গেল। নূতন মাচা আর কেউ দিলে না তাকে। লতাটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে রইল দু’চারদিন। পাশেই ঝোপঝাড় ছিল কতকগুলো বুনো গাছের। লতাটা ক্রমশ সেই দিকে তার ডালপালা বিস্তার করতে লাগল। বছরখানেক পরে কলেজের একটা ছুটিতে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম, দেখি ভাঙা মাচাটা অন্তর্ধান করেছে, কিন্তু ঝুমকোলতাটা সগৌরবে বেঁচে আছে তখনও। পাশের ঝোপটা আশ্রয় করেই অজস্র ফুল ফোটাচ্ছে। ঝোপেঝাড়ে খ্যাতিহীন অন্য ফুলও ফুটেছে অনেক। অনেক বুনো-লতাও জড়িয়ে গেছে ঝুমকোলতাটার সঙ্গে। তাদেরও ফুল ফুটেছে। তাদের দলে ঝুমকোলতাকে কিছু বেমানান মনে হয়নি। মাচার আশ্রয় হারিয়ে ঝুমকোলতা মরে যায়নি, নূতন আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে, সেইখানেই সার্থক করেছে নিজেকে।

“আমার জীবনের মাচাও বার বার বদলেছে। বার বার বদলির চাকরি করেছি, আজ-এখানে-কাল-ওখানে করেই কেটেছে জীবনের বেশীর ভাগ। পুরাতনকে ছেড়ে নূতনের কাছে বার বার গেছি, তার সঙ্গে নূতন বন্ধনে বাঁধা পড়েছি, পুরাতন বিস্মৃতির তলায় চাপা পড়েছে। সেই নূতনও পুরাতনে বিলীন হয়েছে আবার, তাকে আঁকড়ে বেশী দিন থাকতে পারিনি। এর নামই জীবন। আমার জীবনের মঞ্চে যাদের স্থায়ী সম্পদ বলে মনে হয়েছিল আজ দেখছি তারাও একে একে সরে গেছে। চিরঞ্জীব, মালতী, সোহাগ আজ কোথায়? মনু অনেক আগেই চলে গেছে। সেদিন সকালে তার যে আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেটা বোধ হয় আমার অবচেতন মনেরই সৃষ্টি। আমার যে কামনা মনের নিগূঢ় লোকে বসে তাকে চাইছে, সেই কামনাই হয়তো মূর্তি পরিগ্রহ করেছিল সেদিন। কই, আর তো তাকে কোনদিন দেখিনি। ওদের চিন্তা, ওদের সুখদুঃখ আগে আমাকে বিচলিত করত, এখন তো আর করে না। আমার গাড়ি ওদের স্টেশন ছেড়ে চলে এসেছে। এখন নূতন স্টেশনে নূতন লোকের ভিড়। মন তাদের নিয়েই ব্যাপৃত আছে। আজ কেব্‌লী, ছিপলী, গীতা, জগদীশ এদের সুখদুঃখেই আমি বেশী আন্দোলিত।

“কেব্‌লীর স্বামী নারাণ আমাকে এড়িয়ে চলছে। দেখা হবেই কোথাও-না-কোথাও আলীকে বলেছি তাকে খবর দিতে। ছিপলীর স্বামী জিতু ইনজেকশন নিয়ে ভালো আছে বলছে। আমার কিন্তু মনে হয় না ও সেরে যাবে। যদি কিছু উপকার হয়ে থাকে সেটা সাময়িক। ছিপলীর হাতে রুপোর খাড়ু ছিল, এখন সেগুলো নেই দেখছি। সম্ভবত ওষুধ কেনবার জন্য সেগুলো বেচে দিয়েছে। আমি ওকে বলেছিলাম আমি ওষুধ কিনে দিচ্ছি, তুই পরে টাকা দিয়ে দিস। কিন্তু ছিপলী তাতে রাজী হয়নি। বলেছিল, টাকার বন্দোবস্ত আমরা করেছি।

“আশ্চর্য মেয়ে এই ছিপলী। সদা হাস্যমুখী, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। চালচলন দেখে মনে হয় ভ্রষ্টা নয়। ওর সঙ্গে হাসিঠাট্টা অনেকে করে বটে, কিন্তু মনে হয় তার বেশী আর কেউ অগ্রসর হতে পারে না। ছবিলাল মোড়লের ছেলে একদিন বাজারে ওকে কি একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করেছিল। ছিপলী বঁটি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল তাকে। বলেছিল, তোর নাক কেটে দেব। তা ও পারে।

“গীতার সেই বাভন মহাজন সেদিন এসেছিল তার দলিলপত্র নিয়ে। দেখলুম গীতার স্বামী জিতু বহুদিন আগে দু’শ টাকা নিয়েছিল। দু’বছর ধরে ওরা স্বামী-স্ত্রী ওর বাড়িতে বিনা বেতনে খেটেছে, কিন্তু ধার এখনও শোধ হয়নি। বাভন বলছে এখনও দেড়শ টাকা বাকি আছে। আমি আর ও নিয়ে কচলাকচলি না করে টাকাটা দিয়ে দিয়েছি ওকে।

“গীতা বলেছে দুধ দিয়ে আর ঘুঁটে দিয়ে টাকাটা শোধ করে দেবে। আমি তাতেই রাজী হয়েছি। আর একটা প্রস্তাব করেছিল গীতা, তাতে আমি রাজী হইনি। সে বলেছিল, মালতী দিদি তো এখন নেই, তিনি যতদিন না আসবেন আমি আপনার বাড়িতে কাজকর্ম করে দেব। বাড়িতে কোনও মেয়েছেলে নেই, আপনার হয়তো কষ্ট হচ্ছে। এ প্রস্তাবে রাজী হইনি আমি। এমনই তো আমার নামে নানারকম নিন্দা রটিয়ে থাকেন আমার তথাকথিত বন্ধুরা। গীতার মতো এক রূপসী যুবতী যদি আমার বাড়িতে ঘুরঘুর করে তাহলে তো খই ফুটবে সকলের মুখে।

“…এদের কেন্দ্র করেই নুতন জীবন গড়ে উঠেছে আবার। বাঁচবই বা আর ক’দিন? শমনের নোটিশ এসে গেছে। ইউরিনে অ্যালবুমেন দেখা দিয়েছে, ব্লাডপ্রেসার বেড়েছে। এর চিকিৎসা হচ্ছে সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে হিন্দুবিধবার আহার খেয়ে জড়ভরতের মতো পড়ে থাকা। তা আমি পারব না। জীবস্মৃত হয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। মরে না গিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকলে অবশ্য শোচনীয় ব্যাপার হবে সেটা। কিন্তু যারা খুব নিয়মে থেকেছে এরকম লোকেরও তো পক্ষাঘাত হতে দেখেছি…”

সদাশিবের লেখায় বাধা পড়ল।

জগদীশের ছোট মেয়ে ফুদিয়া ছুটে এসে জিগ্যেস করলে, “মা ঠেকুয়া বানিয়েছে, খাবেন?”

“নিশ্চয় খাব। তবে একটার বেশী নয়–”

সুসংবাদ বহন করে ছুটে চলে গেল ফুদিয়া।

ডাক্তারবাবু তাদের বাড়ির তৈরি ঠেকুয়া খাবেন এটা যেন একটা আশাতীত ব্যাপার। আলী এসে চুপি চুপি বললে—“হুজুর, খানা তো পক্ গিয়া। আভি খাইয়ে গা?”

“একটু পরে খাব—”

“তব্ হম্ নারাণকো পকড়কে লে আঁবে?”

“নারাণকো কোথা পাবে এখানে?”

“বহু দেখিয়ে, খাপরা ছা রহা হ্যায়—”

আলী একটু ঝুঁকে ডানহাতের তর্জনী-মধ্যমা একত্র করে দুটো গাছের ফাঁকের ভিতর দিয়ে দেখাতে লাগল। সদাশিব দেখতে পেলেন একটা খাপরার ঘর ছাওয়া হচ্ছে।

“ডেকে নিয়ে এস—”

আলী চলে গেল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাইক করে এসে হাজির হল ফালতু।

কমলের কারখানার অ্যাপ্রেন্টিস্।

“হুজর, মুর্গ মসল্লম্ ভেজ দিহিন কমলবাবু—”

কমলের একটা চিঠিও ছিল।

“ডাক্তারবাবু, আপনার জন্যে একটা মুর্গ মসল্লম্ পাঠালাম। আপনি খেলে বিশেষ আনন্দিত হব। ফালতুকে বলেছি আপনি যেখানেই থাকুন সে আপনাকে খুঁজে গিয়ে দিয়ে আসবে”

“তুই কি করে খোঁজ পেলি যে আমি এখানে আছি?”

“উলফ‍ বললে–”

ফালতুর বুদ্ধি দেখে প্রীত হলেন সদাশিব। তাঁর দৈনন্দিন গতিবিধি যে উলফৎই জানে একথা ফালতু কি করে জানল? খুশী হলেন সদাশিব। ফরসা লম্বা কিশোর ছেলেটির মুখের দিকে হাসিমুখে চেয়ে রইলেন। ফালতুরও চোখের দৃষ্টি হাস্য-প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। সদাশিব পকেট থেকে একটা টাকা বার করে দিতে গেলেন তাকে।

“নেহি হুজুর—”

সেলাম করে সরে দাঁড়াল সে মুচকি হাসতে হাসতে। তারপর গাড়িটার কাছে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।

“পিছেকা চাক্কা মে হাওয়া নেহি হ্যায়!”

“পাম্প করে দাও”

“আলী কাঁহা?”

“সে আসছে এখুনি। সে এসে পাম্প বের করে দেবে। তুই এখানেই খেয়ে যা—”

ফালতু হেসে একবার চাইলে তাঁর দিকে, যেন এমনই একটা প্রত্যাশা করছিল সে। তারপর সে গাড়িটাকেই প্রদক্ষিণ করে ঘুরতে লাগল যদি আরও কিছু গলদ চোখে পড়ে। হঠাৎ সদাশিব লক্ষ্য করলেন তার কামিজটা বড্ড ছেঁড়া। পিঠের মাঝামাঝি লম্বালম্বি ছিঁড়ে গেছে। তিনি একটা কাগজে একটা চিঠি লিখে ফালতুকে বললেন-“তুই যখন ফিরে যাবি তখন বাজারে হরিকিষুণবাবুর দোকানে এই চিঠিটা দিয়ে দিস”

“কাড়াকা দোকান যিকা হ্যায়?”

“হাঁ–”

সদাশিব হরিকিষুণবাবুকে লিখে দিয়েছিলেন ফালতুকে ফালতুর গায়ের মাপে একটা কামিজ তিনি যেন দিয়ে দেন। তিনি দাম পরে পাঠিয়ে দেবেন। ফালতুকে সে কথা আর বললেন না। যদি না নেয়? ওদের আত্মসম্মানজ্ঞান খুব বেশী।

একটু পরেই আলীর সঙ্গে নারাণ এসে হাজির হল। নারাণের রং নিকষ-কৃষ্ণ, শরীর বেশ বলিষ্ঠ। মনে হয় কষ্টিপাথর কুঁদে কোনও শিল্পী যেন সৃষ্টি করেছে ওকে। যেন একটা কাফ্রী অসুর। তার চলনে এবং দৃষ্টিতে একটা মার্জার-সুলভ ভাব আছে। এদিক-ওদিক চেয়ে ঈষৎ হেলে-দুলে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলাফেরা করে, দেখলেই চোর বা ডাকাত বলে সন্দেহ হয়।’

“কি নারাণ, শুনছি তুমি বিয়ে করতে চাইছ আবার—”

“জি হুজুর–”

নারাণ বেশ সপ্রতিভভাবেই উত্তর দিলে।

“কেব্‌লী তো আছে, আবার বিয়ে কেন–”

“ভিতর মে বাত্ ছে হুজুর—”

ছেকা-ছিনি ভাষায় আলাপ হল। তার মর্মার্থ এই–

“ভিতরে আবার কি কথা আছে?”

“কেব্‌লীর যে ছেলেপিলে হয়নি। আমার বংশ লোপ পেয়ে যাবে যে—”

“কিন্তু এতে কেব্‌লীর মনে কষ্ট হবে না?—”

“দুদিন কষ্ট হবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সমাজে তো এরকম আখছার হচ্ছে। তাছাড়া আর একটা কথা আছে। আমি যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি সে বিধবা। তার আগেরকার স্বামীর জমি ও পেয়েছে। তাই ওর বাবা বলেছে যে কেব্‌লীকে ও দু’বিঘে জমি লেখাপড়া করে দিয়ে দেবে। এতে কেব্‌লীর আখেরে সুবিধে হবে কত।”

“কিন্তু তোমার বদলে দু’বিঘে জমি পেলে কি কেব্‌লী সুখী হবে? হবে না। ও তোমাকে খুব ভালবাসে। এটা জেনে রেখ ওর জন্যেই তুমি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছ। ওর মনে কষ্ট দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? আর ছেলে না-হওয়ার কারণ যদি তোমার মধ্যে থাকে, তাহলে হাজারটা বিয়ে করলেও তোমার ছেলে হবে না-

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল নারাণ।

তারপর বলল, “আচ্ছা, আমি ভেবে দেখব—”

“হ্যাঁ, আর একটা কথা শোন। কেব্‌লীকে তুমি মারধোর করেছ কেন?”

নারাণের চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল।

“না, মারব কেন। মারিনি তো। আমি কিচ্ছু করিনি।”

“কিন্তু ওর মাথায় রক্ত দেখলাম যে—”

“ও মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেই রক্ত বার করেছে কপাল থেকে আমি কি করব!” “তাই নাকি!”

কেব্‌লী-চরিত্রের আর একটা দিক সহসা প্রতিভাত হল সদাশিবের কাছে। তিনি নিঃসংশয়ে বুঝতে পারলেন কেব্‌লী নারাণকে কতটা ভালবাসে। তাঁর ভয় হল নারাণ বিয়ে করলে কেব্‌লী আত্মহত্যা করে বসবে না তো?

“আমি এবার কাজে যাই হুজুর?”

“যাও। কথাটা ভেবে দেখো-

“জি হুজুর।”

কিন্তু নারাণের মুখভাব দেখে সদাশিবের মনে হল ও বিয়ে করবেই।

“খানা ঠাণ্ডা হো রহা হুজুর —”

ফিসফিস করে আলী এসে বললে।

“হ্যাঁ, এবার খেতে দাও–”

আলী প্লেটে সাজাতে লাগল।

জগদীশের দুই ছেলে এক মেয়েও খেতে বসল। ফালতুও। একটু পরে জগদীশ এসে বসল একধারে।

“আমাকে আর কতদিন ঘরে বসিয়ে রাখবেন ডাক্তারবাবু, আমি তো ভালো হয়ে গেছি। হাটে না গেলে পেট চালাব কি করে?”

“তোমার বউ হাটে যাক না—”  

“ও বড় সরমিলা (লাজুক), কোথাও যেতে চায় না। যাওয়াও মুশকিল। আজকালকার ছোঁড়াগুলো বড় পাজি। রাস্তায় জোয়ান মেয়ে দেখলেই পিছু নেয়—”

“আর সাতটা দিন কোনরকম করে কাটিয়ে দাও। অতবড় অপারেশন হয়েছে, ভারী ভারী মোট তোলা এখন চলবে না-

জগদীশ চুপ করে রইল।

“আর কাউকে বলো না, তোমার তরি-তরকারিগুলো নিয়ে বেচে দিক—”

“বিরজু নিয়ে যায়। কিন্তু হিসেব ঠিক দেয় না। সেদিন কুড়িটা কদ্দু (লাউ) বিক্রি করে মাত্র আড়াই টাকা এনেছে। চার আনার কম কি কোন কদ্দূ বিক্রি হয়? অথচ ওকে কিছু বলা যায় না, গোতিয়া (জ্ঞাতি)—”

“আর সাতটা দিন কাটিয়ে দাও কোনরকমে।”

সদাশিব যে এখানে এসে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তার একটা কারণ, তিনি এখানে খেলে ওরাও খেতে পাবে। সে কথাটা প্রকাশ্যে ওদের বলেননি। কিন্তু আলীকে গোপনে বলে দিয়েছেন। আলী বেশী বেশী করে রান্না করেছে। পাছে ছোঁয়া যায় বলে ভাত-ডালটা জগদীশের বউই নামিয়ে দিয়েছে। কিছু নটে শাক সে সকালবেলাই তুলে রেখেছিল তাই ভেজেছে, আর লাউয়ের তরকারি করেছে একটা। ডাল আর আচার সহযোগে এই এদের কাছে রাজভোগ। ডাল-ভাতই প্রচুর পরিমাণে জোটানো শক্ত, রোজ জোটে না। সদাশিব ক’দিন থেকে এখানে খাচ্ছেন বলে পেট ভরে খেতে পাচ্ছে ওরা।

….খাওয়া-দাওয়ার পর গাছতলায় ইজিচেয়ারটা পেতে শুয়ে পড়লেন সদাশিব। বরাবর দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তাঁর শোয়া অভ্যাস। এই সেদিন পর্যন্ত পালঙ্কের উপর শুভ্র বিছানায় ইলেকট্রিক পাখার তলায় ঘুমিয়েছেন। ইচ্ছে করলে এখনও ঘুমুতে পারেন। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করে না। গাছতলায় খোলা হাওয়ায় ফোল্ডিং ক্যাম্প-চেয়ারে শুয়েই বেশী আনন্দ পান এখন। দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলেন মনু এসেছে। হেসে বলছে, কাশী গিয়েছিলাম, খুব ভালো জর্দা এনেছি। ঘুমটা ভেঙে গেল। মনু যে জর্দা খেত একথা তাঁর মনেই ছিল না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন