হাটে বাজারে – ৬

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

॥ ছয় ।।

সকাল নটা নাগাদ সদাশিবের মোটর যথারীতি বাজারের সামনে দাঁড়াল। সারি সারি মুরগীওলারা বসেছিল তাদের ঝাঁকা নিয়ে। তারা সাধারণত পথের ধারেই বসে। সদাশিবকে দেখে দু’একজন সেলাম করে উঠে দাঁড়াল।

সদাশিব আলীকে বললেন—“আলী, কয়েকটা ভালো মুরগী বেছে নাও তো।”

“বহুত খু”-

সদাশিব বাজারের ভিতরে ঢুকলেন।

আবদুলের মুখ উদ্ভাসিত, তার ছেলের জ্বর ছেড়ে গেছে। সে বললে কিছু বড় বড় মাগুর মাছ সে তাঁর জন্যে কিনে রেখেছে। চারটে মাগুর মাছের ওজন হয়েছে সওয়া সের।

“কোথা আছে সেগুলো—”

“আলাদা হাঁড়িতে করে গুদামে রেখে দিয়েছি—”  

“আমার গাড়িতে দিয়ে আয়।”

ঘাড় ফিরেই সদাশিবের দৃষ্টি পড়ল একটি নবাগত ভদ্রলোকের দিকে। অত্যন্ত মোটা। একটা হিপোপটেমাস যেন মনুষ্যমূর্তি ধারণ করেছে। তাঁর মাছ কেনবার ধরন দেখে বিস্মিত হলেন সদাশিব। এক মেছুনী কতকগুলো ছোট ছোট মাছ বিক্রি করছিল। তিনি মাছের স্তূপের ভিতর থেকে একটি ছোট মাছ লেজ ধরে তুললেন।

“এটার কত দাম নিবি? এক পয়সা?”

“ওই একটা মাছই নেবেন আপনি!”

মুচকি হেসে জিগ্যেস করলে মেছুনি। নাম ছিপলী। সদ্য যৌবনোদগম হয়েছে তার। কথায় কথায় হাসে।

হিপো বললেন—“হাঁ। একটাই নেব—”

“নিয়ে যান। ওর আর দাম দিতে হবে না।”

অম্লানবদনে তিনি মাছটি মাছের থলিতে পুরে ফেললেন। হেসে লুটিয়ে পড়ল মেছুনীটা। হিপো আর একটা মেছুনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সে-ও ছোট মাছ বেচছিল। সেখান থেকে একটি ছোট মাছ বেছে তুললেন তিনি।

“এটার দাম কত নিবি? এক পয়সা?”

এ মেছুনীটা বুড়ী। হিপোর কাণ্ড দেখে চটে গেল সে। বললে—“একটা মাছ আমি বেচব না। আধ পোয়া নিতে হবে অন্তত-

“কিন্তু তোমার সব মাছ তো টাটকা নয়। বাসী মাছও মিশিয়ে দিয়েছ অনেক ‘ বুড়ী চুপ করে রইল, কোন জবাব দিল না।

“আচ্ছা, দু’পয়সা দিচ্ছি, দিয়ে দে মাছটা।”

বুড়ীর চোখের দৃষ্টিতে আগুন জ্বলে উঠল। মাছটা ছুঁড়ে দিলে হিপোর দিকে। হিপো দুটো পয়সা দিয়ে গম্ভীরভাবে এগিয়ে গেলেন আর একা মাছের দোকানে। এ দোকানদারও একটা মাছ বেচতে রাজী হল না। ঝাঁকড়া-গোঁফ ভগলু মহলদার রসিক লোক। সে হাসিমুখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত হিপোর দিকে, তারপর দু’হাত তুলে নমস্কার করল।

“দিবি না মাছটা?”

“একটা মাছ বিক্রি করি না। আপনার মতো লোককে ভিক্ষে দিতেও সাহস পাচ্ছি না। কি করব ভাবছি।”

সদাশিব এগিয়ে গিয়ে চোখের ইঙ্গিত করতেই ভগলু মাছটা দিয়ে দিলে হিপোকে। ডাক্তারবাবুকে অমান্য করবার সাহস হল না তার। হিপো আর একটা দোকানে গিয়ে আর একটা ছোট মাছ চার পয়সা দিয়ে কিনলেন। এই মেছোটা মোচড় দিয়ে বেশী একটু দাম নিয়ে নিলে।

সদাশিব এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলেন ভদ্রলোকের সঙ্গে।

“নমস্কার। আপনাকে তো এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না—”  

“নমস্কার। আমি এখানে থাকি না। চেঞ্জে এসেছি –”

“ও। কোথায় আছেন?”

“ঘোষ-নিবাসে।”

“ও, তাহলে তো আমার বাড়ির কাছেই!”

“আপনার পরিচয়টা দিন—”

“আমি রিটায়ার্ড ডাক্তার একজন। এখানেই একটা বাড়ি কিনে বাস করছি—”

“ও তাহলে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে তো সুবিধেই হল। আমি ডায়াবিটিস্ রুগী মশাই। তার উপর বাত। ডাক্তার বলছে ছানা খেতে আর ছোট মাছ। ভাত রুটি বন্ধ—”  

“কিন্তু আপনি তো মাত্র চারটি ছোট মাছ কিনলেন—”

“বেশী নিয়ে কি করব। নিজে হাতে কুটতে হবে, নিজে হাতে রাঁধতে হবে। তাছাড়া একটু পচা বা দো-রসা হলে আর খেতে পারি না। তাই খুব বেছে বেছে কিনতে হয়—”

“আপনি একাই এসেছেন?”

“দোকা আর পাব কোথা! আমাকে ফেলে সবাই যমের বাড়ি চলে গেছে। বউ ছেলে মেয়ে সব—”

হিপোর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত তিনি নিষ্পলক হয়ে চেয়ে রইলেন সদাশিবের মুখের দিকে। অস্বস্তি ভোগ করতে লাগলেন তিনি। তারপর বললেন, “আচ্ছা, আমি আপনার টাটকা মাছের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এই ভগলু–”

ঝাঁকড়া গোঁফ ভগলু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলে–“জি হুজুর—”  

“এই বাবুর জন্যে রোজ চার-পাঁচটা টাটকা মাছ আলাদা করে রেখে দিও।”

‘চেষ্টা করব হুজুর। তবে আমি তো মাছ পাইকারদের কাছ থেকে কিনি, সব সময় টাটকা মাছ পাই না-

সেই হাসিমুখী তরুণী মেছুনীটি এগিয়ে এল। বললে—“আমি গঙ্গার ঘাট থেকে মাছ আনি। আমি রেখে দেব রোজ—”  

“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। নমস্কার।”

কোনক্রমে দেহভার বহন করে ভিড় ঠেলে ঠেলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন তিনি। “এই যে ডাক্তারবাবু! গুড মর্নিং। বাজারের সব মাছ কিনে ফেললেন নাকি! আমাদের জন্যে কিছু অবশিষ্ট আছে তো—”

পি. ডব্লিউ. ডি. আফিসের কেরানী খগেন সরখেল। হিংসুকে লোক। সদাশিব যে রোজ এত মাছমাংস কেনেন এটা বরদাস্ত করতে পারেন না। দেখা হলে প্রায়ই যে সব মন্তব্য করেন তাতে একটু খোঁচা থাকে। সদাশিব গ্রাহ্য করেন না এসব। প্রায়ই মুচকি হেসে তাঁর কথার জবাব দেন।

“কি মাছ কিনলেন আজ?”

“মাগুর।”

“মাগুর? কই, মাগুর তো কোথাও দেখলাম না! পেলে নিতাম কিছু।”

“নিন না। আমি যেগুলো নিয়েছি সেগুলো আপনিই নিয়ে যান। আমি অন্য মাছ নিচ্ছি। আবদুল, বাবুকে মাগুর মাছগুলো দিয়ে দাও।”

আবদুল বললে—“আচ্ছা। তিন টাকা করে সের। সওয়া সের আছে। আপনি কিসে করে নেবেন?”

অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন খগেন সরখেল।

“না না, আপনার মুখের গ্রাস আমি কাড়ব কেন। আপনিই নিয়ে যান। আমি আর একদিন কিনব।”

তাড়াতাড়ি ভিড়ের মধ্যে গা-ঢাকা দিলেন তিনি।

সদাশিব বেরিয়ে আসছিলেন এমন সময় সেই হাসিমুখী তরুণীটি অপাঙ্গে সলজ্জভাবে চাইলে তাঁর দিকে এবং মৃদুকণ্ঠে বললে—“বাবু—”

মনে পড়ে গেল সদাশিবের।

“হ্যাঁ, তোর জন্যে ওষুধ এনেছি। গাড়িতে আছে। চল দিয়ে দিচ্ছি—রোজ তিনটে করে খাবি।”

প্রতি মাসে ‘মাসিক’-এর সময় অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে সে। লজ্জায় অনেকদিন গোপন করে ছিল। কিন্তু শেষে আর পারেনি। অনেকদিন চোখ নিচু করে অনেকবার ঘাড় ফিরিয়ে ব্যক্ত করেছে সদাশিবের কাছে।

মাছের বাজার থেকে বেরোবার মুখেই আবার থমকে দাঁড়াতে হল সদাশিবকে। তিনি দেখলেন, জগদম্বা জেলে চায়ের দোকান করেছে। চেহারাই বদলে গেছে তার। মাথায় টেড়ি, কানে বিড়ি গোঁজা। পরনে হাওয়াই শার্ট। চায়ের দোকানে সিনেমা অভিনেত্রীদের ছবি। একটি বড় কাচের ‘জারে’ রঙিন মাছ রেখেছে।

“কিরে জগদম্বা, মাছের ব্যবসা ছেড়ে দিলি?”

“ওতে পোষায় না হুজুর। তাছাড়া বড় গন্দা (নোংরা) কাজ। রোজগার হয় না। সব লাভ পাইকার আর গুদামগুলা টেনে নেয়।”

আবদুল মাছের হাঁড়ি নিয়ে সঙ্গে আসছিল। সে মৃদুকণ্ঠে বলল—“জগদম্বা চিরকালই একটু শৌখিন। বেশী পয়সা থাকলে ও আতরের দোকান খুলত।”

জগদম্বা এতে চটল না। আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে চেয়ে রইল আবদুলের দিকে। জগদম্বার বয়স বেশী নয়, ত্রিশের মধ্যেই। সদাশিবের মনে পড়ল কিছুদিন আগে তার বউ বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল আর ফেরেনি। সদাশিবের একবার ইচ্ছে হল তার বউয়ের কথাটা জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু এত লোকের সামনে সেটা অশোভন হবে ভেবে আর করলেন না।

মোটরের কাছে কয়েকজন রোগী দাঁড়িয়ে ছিল। সদাশিব তাদের বললেন—“আজ বিকেলে হাটে যাব। সেইখানেই তোমরা যেও। এই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখতে পারব না তোমাদের। এই ছিপলী তোর ওষুধ নিয়ে যা—”  

সেই তরুণী মেয়েটি এসে ওষুধ নিয়ে গেল। মোটরের কাছে আরও চার-পাঁচটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। বয়স দশ থেকে বারোর মধ্যে। বাজারে ঝাঁকা-মুটের কাজ করে। তাদের গায়ের জামা কাপড় ফরসা, মাথার চুল আঁচড়ানো! ঝাঁকা-মুটেদের সাধারণত এরকম হয় না। তারা হাসিমুখে সবাই সদাশিবকে সেলাম করে ঘিরে দাঁড়াল।

“ও তোরা এসেছিস? বাঃ, কাপড় জামা তো বেশ পরিষ্কার হয়েছে! দেখ্‌ তো, সাজিমাটিতে কেমন সুন্দর পরিষ্কার হয়। দেখি তোর দাঁত?”

সবাই তাদের দাঁত দেখাল। সদাশিব তাদের চোখও দেখলেন।

“ঠিক আছে—”  

চারটি করে পয়সা দিলেন প্রত্যেককে। তাছাড়া হাট থেকে যে কেঁদ আর কাগজের পাখি কিনেছিলেন তা-ও উপহার দিলেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শেখাবার জন্য সদাশিব এই ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করেন মাঝে মাঝে। অতি সামান্যই খরচ হয় এতে; কিন্তু এর পরিবর্তে যে আনন্দ পান তা অসামান্য।

আলী এসে মৃদুকণ্ঠে বললে—“চারঠো মুরগি লিয়া হুজুর।”

“ভালো দেখে নিয়েছ তো?”

“জী হুজুর, সব তৈয়ারী পাঠা হ্যাঁয়।”

মুরগিওলা রহমান বললে—“পছছিম মু হোকে বোলতে হেঁ হুজুর, সব মুরগি আচ্ছা হ্যায়। খারাব হোনে সে জুতা মারিয়ে গা।”

সদাশিব হেসে বললেন—“যদি ঠকাও তোমার খোদাই তোমাকে জুতো মারবে। আমি কেন জুতো মারতে যাব তোমাকে শুধু শুধু—”

আলী বললে—“বেশক্‌।”

সদাশিব জিজ্ঞাসা করলেন—“মুরগির দাম কত?”

রহমান বললে সে পশ্চিমমুখে দাঁড়িয়ে ‘কসম্’ খেয়ে সত্যি কথা বলছে, সওয়া দু’টাকা করে খরিদ, এখন হুজুরের যা মরজি।

আবদুল মাছের হাঁড়ি গাড়িতে তুলে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল এক পাশে। সে আলীকে বললে, “ঘুরা দিজিয়ে মুরগি। দেড় দেড় রুপিয়া মে ইসে আচ্ছা মুরগি হাম লান্ দেঙ্গে।”

সদাশিব বললে,”না না, গরীব মানুষের আমি লোকসান করাতে চাই না। ওই বলুক না কি হলে ওর পোষায়।”

রহমান মাথা চুলকে বললে— “হুজুরকা যেইসে মেহেরবানী। আপকা বাত সে বাহার হাম নেহি যাঙ্গে—’

শেষকালে এক টাকা দশ আনায় রফা হল। রহমান দাম নিয়ে টাকাপয়সাগুলি তার কোমরে-বাঁধা গেঁজেতে পুরে শেষে বললে, মাই দুই থেকে তার ছোট ছেলের নাক দিয়ে রক্ত পড়ে, ডাক্তারবাবু, যদি কোন দাবাই দেন গরীবের উপকার হয়।

“কোথা বাড়ি তোমার?”

“হবিগঞ্জ।”

“আমি তো হবিগঞ্জের হাটে যাই। সেইখানেই নিয়ে এস তোমার ছেলেকে। নাকটা দেখে ওষুধ দেব।”

মুরগিওলা রহমান সেলাম করে বললে— “হুজুরকা মেহেরবানী। মুলাকাৎ করেঙ্গে হাটিয়ামে।”

সদাশিব বললেন—“আলী, চল এবার কমলবাবুর কারখানায়। কমলকে আজ খেতে বলব। আর গাড়ির কারবুরেটারটাও একবার দেখিয়ে নেব।”

“বহুত খু—”

.

কমলের কারখানায় ঢুকতেই কমলের উচ্চকণ্ঠ শোনা গেল। “পাগল করে দেবে আমাকে। এই মুন, আমার ড্রয়ার থেকে প্যাঁচকস্ কে নিয়েছে? কতবার মানা করেছি তোমাদের যে আমার ড্রয়ার থেকে প্যাঁচকস্ নিও না কেউ—”

সদাশিবকে দেখেই শান্ত হয়ে গেল কমল।

সদাশিব জিগ্যেস করলেন—“প্যাঁচকস্ হারালে নাকি—”  

“কেউ টপিয়ে দিয়েছে। আসল পাকা স্টীলের জিনিস—”

কমলরা বিহারে চার পুরুষ ধরে আছে। বিহারেই তার জন্ম। সুতরাং ভাষার মধ্যে অনেক হিন্দী কথা ঢুকে গেছে। তাই ‘হাতিয়েছে’ না বলে টপিয়ে দিয়েছে’ বললে।

“গাড়ি ঠিক চলছে তো?”

“মাঝে মাঝে হাঁচছে। তাই মনে হচ্ছে ‘কারবুরেটারে’ ময়লা জমেছে বোধ হয়। তোমার কি সময় আছে এখন? খুলে দেখবে কি?”

“হ্যাঁ। এখনি করে দিচ্ছি। এই ফালতু, ডাক্তারবাবুর গাড়ির ‘কারবুরেটার টা খোল–”

ফালতুর আসল নাম তমিজুদ্দিন। কমল ওর নামকরণ করেছে ‘ফালতু’, কারণ যখন ও অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে কারখানায় ঢুকেছিল তখন বাড়তি (extra) লোক হিসেব নিয়েছিল ওকে কমল। ফালতুর বয়স ষোল-সতেরো। খুব রোগা আর লম্বা। যদিও সর্বাঙ্গ কালিঝুলি মাখা, তবু বেশ বোঝা যায় যে ওর রং খুব ফরসা। মুখের মধ্যে একটা শিশু-সুলভ সারল্য, চোখ দুটিতে চাপা হাসি চিক্‌মিক্ করছে সর্বদা। সে সোৎসাহে কারবুরেটার খুলতে লাগল। সে জানে এর জন্যে ডাক্তারবাবু কোন-না-কোন সময়ে তাকে কিছু দেবেন। মাস দুই আগে একটা হাফপ্যান্ট কিনে দিয়েছেন।…. মুরগিগুলো ক্যাক্-ক্যাক্ করে ডেকে উঠল কেরিয়ারের মধ্যে।

কমল হেসে জিগ্যেস করল— “কত করে কিনলেন মুরগি—”  

“ওহো, বলতেই ভুলে গেছি। তুমি আজ রাত্রে খেও আমার ওখানে।”

“আচ্ছা। আমার কিন্তু আজ যেতে রাত হবে একটু। সাড়ে ন’টা—”

“বেশ—”

“বসুন–”

চেয়ার এগিয়ে দিলে কমল।

“কাজকর্ম কেমন চলছে—”

“ভালোই চলছে আপনার আশীর্বাদে—”

“হরেক রকমের গাড়ি তো অনেক জমিয়েছ দেখছি—”

“হ্যাঁ, তা জমেছে। কতকগুলো গাড়ি জমেই আছি। আর নড়ছে না—”

“কেন বল তো—”

কমল মুচকি হেসে চেয়ে রইল। তারপর হঠাৎ তত্ত্বকথা বলে ফেলল।

“গাড়ির পেছনে যে মানুষ আছে তারই উপর নির্ভর করে সেটা। তারা গাড়ি না নিয়ে গেলে গাড়ি যাবে কি করে।”

“নিচ্ছে না কেন—”

“ওই যে বড় বুইটা দেখছেন, ওই যে কোণে রয়েছে, মাডগার্ডটা টোল খাওয়া। ওর মালিকটি মাতাল চরিত্রহীন। তিনবার দেউলিয়া হয়েছে। গাড়ি চালিয়ে দুমকা থেকে আসছিল, একটা সাঁওতালকে ধাক্কা মেরে পালাচ্ছিল সেখান থেকে। পালাতে পালাতে আবার ধাক্কা খায় একটা গাছের সঙ্গে। তারপর রাত্তিরে আমার কাছে গাড়িটি রেখে সেই যে সরেছে আর পাত্তা নেই। কেউ বলছে বম্বে গেছে, কেউ বলছে দিল্লী। ওই যে ছোট্ট বেবি অস্টিনটা দেখছেন, ওটা মিস্ মরিসের। নিজেই ড্রাইভ করে আর সঙ্গে থাকে রোজ একজন করে নূতন বন্ধু। একদিন রাত্রে মদ খেয়ে এক মাঠে পড়ে ছিল সমস্ত রাত। সকালে উঠে দেখে গাড়ির চাকাসুদ্ধ দুটো টায়ার চুরি হয়ে গেছে। গাড়িটা গরুর গাড়িতে চড়িয়ে আমার এখানে দিয়ে গেছে মাস তিনেক আগে। আর তার পাত্তা নেই, শুনছি বেবি অস্টিনের ঢাকা এখন এখানে পাওয়া যাবে না। বিলেত থেকে আনাতে হবে। ততদিন ও গাড়ি এখানেই পড়ে থাকবে-

“আর ওই যে রং-ওঠা ঝরঝরে গাড়িটা রয়েছে, ওটা কে সারতে দিয়েছে? ওর তো কিছু‍ই নেই দেখছি–”

“ওটার ইনজিন ঠিক আছে। আমি আড়াইশো টাকায় কিনেছি। ভালো করে সারিয়ে রং করে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করব। তখন ওর চেহারা দেখলে আর চিনতেই পারবেন না। বেশভূষার চটকে বুড়ো মানুষকে ছোকরা বানিয়ে দেব—”

মুচকি হেসে চেয়ে রইল কমল। সে হা-হা করে হাসে না। মুচকি হাসে, কিন্তু বেশ বড় ‘মুচকি’, হাসিটা প্রায় কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে, সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটোও হাসতে থাকে।

ফালতু কারবুরেটার খুলে নিয়ে এল।

কমল কারবুরেটার নিয়ে পড়ল।

কারখানাতেও সদাশিবের রোগী জুটে গেল কয়েকটা। ইরিস্ মিস্ত্রীর পায়ের নীচে একটা কড়া হয়েছে, বসতে গেলে লাগে। একটা অ্যাপ্রেন্টিস্ ছোঁড়ার হাঁপানি হচ্ছে। ফালতুর কষের দাঁতে ব্যথা হয়। সদাশিব হাঁ করিয়ে দেখলেন, কেরিজ হয়েছে। বুড়ো জগন মিস্ত্রীর বাত হয়েছে। হাঁটুতে ব্যথা। সদাশিব ওষুধের বাক্স বার করে ওষুধ দিতে লাগলেন সকলকে।

….চতুর্দিক প্রকম্পিত করে একটা মোটর বাইক ঢুকল এসে। তার থেকে নামলেন একজন ‘খাকি’ হাফপ্যান্ট-পরা বেঁটে মোটা লোক। বুলডগের মতো মুখ, হিলারি গোঁফ। মুখে সিগার। মিস্টার পরসাদ। বড় গভর্নমেন্ট অফিসার একজন। নিরঙ্কুশ ব্যক্তি। প্রকাশ্যে ঘুষ নেন, প্রকাশ্যে অন্যায় কাজ করেন। এঁকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে পড়ল কমল।

বলল—“কল্ আপকা গাড়ি দে দেংগে। থোড়া কাম্ বাকি হ্যাঁ —”

আদেশের কণ্ঠে মিস্টার পরসাদ বললেন—“জলদি কিজিয়ে। বড়া মুশকিল মে হ্যাঁয়ে—”  

“কল্ জরুর হো যায়গা—”

এমন সময় মিস্টার পরসাদের দৃষ্টি পড়ল ডাক্তারবাবুর উপর।

“নমস্তে নমস্তে। ডাক্‌টর সাহেব, আপ য়ঁহা কৈসে পৌঁছ গ্যয়ে’

সদাশিব বাংলাতেই উত্তর দিলেন—“রিটায়ার করে’ এইখানেই আছি। আপনি কবে এলেন এখানে?

“এক মাহিনা—”

ওঁদের নিম্নলিখিতরূপ আলাপ হল। মিস্টার পরসাদের হিন্দীটা বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছি।

“আপনি এখানেই প্র্যাকটিস করছেন?”

“কি আর করি, কিছু তো একটা করতে হবে–

“আপনার ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না। ভাগ্যে আপনি ছিলেন তাই বেঁচে গিয়েছিলাম—”

“কি হয়েছিল আপনার বলুন তো, ঠিক মনে নেই”

“স্ট্র্যাংগুলেটেড্ হার্নিয়া। আপনি তখন ছাপরায়, আমিও ছাপরায়। আপনি না থাকলে আমি খতম হয়ে যেতাম। আপনি চলে আসবার পর ডক্টর ঘোষ এলেন। তিনি চৌবেজির হাইড্রোসিল অপারেশন করলেন। সেপটিক হয়ে মারা গেলেন ভদ্রলোক—”

“দেখুন বাঁচাবার বা মারবার মালিক আমরা নই। আমরা সকলকেই ভালো করবার চেষ্টা করি, কেউ হয়, কেউ হয় না। ওপরওলার মর্জিতে সব হয়—”

“সে কথা আমি মানব না। সব ডাক্তারের বিদ্যেও সমান নয়, সবাই সমান যত্নও নেয় না। আপনি এখানে আছেন জেনে নিশ্চিন্ত হলাম। কোথায় বাসা আপনার?”

“কমল আমার বাড়ি চেনে—”

“আচ্ছা, এখন চলি। এই রোদে মোটর বাইকে করে ঘুরতে হচ্ছে। চলি, নমস্কার–”

চলে গেলেন মিস্টার পরসাদ।।

উদ্ভাসিত মুখে এগিয়ে এল কমল।

“আপনার সঙ্গে খুব খাতির আছে দেখছি। আমার একটু উপকার করবেন?” “কি বল–”

“গভর্নমেন্টের কাছে আমার পনেরো হাজার টাকার বিল বাকি আছে। দু’বছর হয়ে গেল, কিছুতেই আদায় করতে পারছি না। চিঠি লিখে লিখে হয়রান হয়ে গেছি, উত্তর পাই না। আপিসে গিয়ে তদ্বির করলুম, দু’একটা ক্লার্ককে ঘুষও দিলুম, কিন্তু কিছু হচ্ছে না। কানাঘুষো শুনছি ওপরওলাকেও নাকি কিছু সেলামী দিতে হবে। মিস্টার পরসাদের খুব ইনফ্লুয়েন্স, উনি যদি চেষ্টা করেন এখনই পেয়ে যাব টাকাটা। এর আগে ওঁর গাড়ি একবার সারিয়ে দিয়েছি, একটি পয়সা চার্জ করিনি। এবারও করব না। এইবার ওঁকে বলব ভেবেছিলাম কথাটা। আপনি যদি বলে দেন তাহলে আরও ভালো হয়-

“আচ্ছা বলব—”

কমল যত্ন করে কারবুরেটারটা পরিষ্কার করে ফিট করে দিলে।

“আজ রাত্রে যেও মনে করে—

“যাব—”

সদাশিব নিজের হাতঘড়িটা দেখলেন। দেড়টা বেজে গেছে। বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন তিনি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন