হাটে বাজারে – ৭

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। সাত।।

সদাশিব ডাক্তারের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল একটা প্রকাণ্ড মাঠের মাঝখানে, প্রকাণ্ড একটা গাছের ছায়ায়। এখান থেকে মাইলখানেক দূরে হাজিপুর হাট। বেলা দুটো বেজেছে। হাট তিনটের আগে বসে না। সদাশিব নির্জনে একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছেন। নির্জন প্রকৃতির কোলে মাঝে মাঝে একা বসে থাকতে ভালোবাসেন তিনি।

আলীকে পাঠিয়েছেন গ্রামের ভিতর একটু টাটকা দুধ সংগ্রহ করবার জন্য। সঙ্গে কনডেন্সড মিল্‌ক্ ছিল, তবু পাঠিয়েছেন। আসল উদ্দেশ্য আলীকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। কাছে কোন লোক থাকলে তাঁর চিন্তা বিঘ্নিত হয়। স্রোতে লোকে যেমন নৌকো ছেড়ে দেয়, তাঁর মনকেও তেমনি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নানা জায়গায় ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। সামনে কয়েকটা খঞ্জন ল্যাজ দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা নীলকণ্ঠ ছোট্ট একটা গাছের ডালে বসে টক্’ টক্’ শব্দ করছে মাঝে মাঝে। একটু দূরে গরু ভেড়া ছাগল চরছে। একটা গরুর পিঠে ফিঙে পাখি বসে আছে। লঘু সাদা মেঘ ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। এলোমেলো হাওয়া বইছে। দোয়েল পাখীর তীক্ষ্ণ মধুর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। সদাশিব উঠে নিজের ডায়েরীটা বার করে আনলেন। তারপর ফোলডিং টেবিল চেয়ারটাও বার করে পাতলেন। একটু ভেবে লিখতে শুরু করলেন তিনি।

“দেখতে দেখতে এখানে অনেকদিন কেটে গেল। দিন কত শীঘ্র কেটে যায়। মনে হচ্ছে এই সেদিন এসেছি। সকালের পর সন্ধ্যা, তারপর আবার সকাল। কালের প্রবাহ বয়ে চলেছে অবিরাম গতিতে। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেল।

“প্রথমে যখন এখানে জীবন আরম্ভ করেছিলাম তখন আশঙ্কা হয়েছিল সময় কাটবে কিনা, মনের অবলম্বন পাব কিনা, মনের মধ্যে যে স্নেহের কাঙাল ক্ষুধিত হয়ে বসে আছে সে তার আকাঙ্ক্ষিত সুধা পাবে কিনা। আজ নিঃসংশয়ে বলতে পারি আমার সে আশঙ্কা অপনোদিত হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার অবসর নেই। মনের যে অবলম্বন পেয়েছি তার চেয়ে বড় অবলম্বন আমার পক্ষে পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি প্রচলিত অর্থে ‘ধার্মিক’ হইনি, রাজনীতি বা সমাজনীতি আলোচনার ছুতোয় পরনিন্দা করিনি, লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট কুড়িয়ে ‘নেতা’ হইনি, আমি যা ছিলাম তাই আছি, যে পথে এতদিন চলে এসেছি সেই পথই ধরে আছি। তার থেকে বিচ্যুত হইনি। বরাবর ডাক্তারি করছি, এখনও তাই করছি। অন্য কিছু হবার শখ হয়নি আমার। সাধ্যও নেই। এক হিসাবে গীতার নির্দেশই পালন করেছি, ‘স্বধর্ম’কেই আঁকড়ে আছি। স্নেহের কাঙাল আমার মনও পরিতৃপ্ত হয়েছে। যে অপরিমেয় সুধা সে পেয়েছে তা তার কল্পনার অতীত ছিল। আমি মহাপুরুষ নই, অত্যন্ত সাধারণ লোক আমি। আমি কি করে লোকের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ আকর্ষণ করতে পেরেছি? ভাবলেও অবাক লাগে।

“অনেকে হয়তো মনে করবেন আমি অসুখে বিসুখে ওদের চিকিৎসা করি বলেই ওরা আমাকে ভালোবাসে। বাইরে থেকে বিচার করলে তাই মনে হয়, কিন্তু আসল কারণ বোধ হয় তা নয়। এখানকার দাতব্য চিকিৎসালয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়, জমিদারবাবু নওলকিশোর প্রতি রবিবারে ভিখারীদের চাল দেন, বেঙ্কট শর্মার ঠাকুরবাড়িতে প্রত্যহ তৃষিতদের জল আর ছোলা-গুড় দেওয়া হয়। জনসাধারণ কি এদের ভালোবাসে? কেউ কেউ হয়তো শ্রদ্ধা করে, কিন্তু আমার বিশ্বাস ভালবাসে না। ঘনিষ্ঠ না হলে ভালোবাসা যায় না। আমরা পোষা কুকুর বিড়ালকে যত ভালবাসি, দূরবর্তী মহৎ লোককেও ততটা বাসি না। আমি ওদের উপকার করেছি বলেই যে ওরা আমাকে ভালোবাসে তা নয়, আমি ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি বলেই ভালোবাসে। আমার যারা রক্তসম্পর্কিত, সমাজের খাতায় যারা আমার আত্মীয় বলে চিহ্নিত, তাদের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক নেই, কারণ তারা দূরে থাকে, ক্বচিৎ তাদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা পর হয়ে গেছে। আবদুল, আলী, ভগলু, কেব্‌লী, ফালতু, রহমান, কমল, জগদম্বা, সুখিয়া, বিলাতী সাহ এবং আরও অনেক নগণ্য লোক আজ আত্মীয় হয়েছে আমার। ওদের সুখদুঃখের সঙ্গে আমি জড়িত, তাই আমাকে ওরা আপন লোক মনে করে। আমি পরম সুখে আছি।

“কেবল একটা ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়েছি একটু। মালতীর হিস্টিরিয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে ফিট্ হচ্ছে। একদিন বাড়ি ফিরে দেখি কাঁদছে। কেন কাঁদছে তা বললে না। আমাকে দেখে চোখ মুছে অন্য ঘরে চলে গেল। আজবলাল বলছিল প্রায় নাকি অকারণে কাঁদে। অকারণে চটেও যায়। আজবলাল ওর নাম দিয়েছে পাগলী। আমি কিন্তু বুঝতে পারছি কি হয়েছে। বাঁজা মেয়েদের এরকম হয়। সন্তান পালনের অন্তর্নিহিত কামনা স্বাভাবিক পথে চরিতার্থ না হলে নানা অস্বাভাবিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ওকে একটা কাবুলী বিড়াল, একটা টিয়াপাখি, একজোড়া খরগোশ কিনে দিয়েছি। কিন্তু দুধের সাধ কি ঘোলে মেটে? ওর যদি একটা ছেলে হত!”

এই পর্যন্ত লিখেই বন্ধ করতে হল সদাশিবকে। কারণ তিনি দেখতে পেলেন আলী একটা বাছুরের দড়ি বেঁধে টানতে টানতে আনছে আর তার পিছনে আসছে একটা গাই আর তার পিছনে হলদে-শাড়ি-পরা একটা মেয়ে। কাছে আসতেই গীতাকে চিনতে পারলেন তিনি। গোয়ালার মেয়ে। বাপ-মা নাম রেখেছিল গিতিয়া। কিন্তু কাছেই যে মিশনারী স্কুলটা আছে তাতে গিতিয়া পড়েছিল ছেলেবেলায়। সেই স্কুলের মেমসাহেব তার নাম গিতিয়া বদলে গীতা করে দিয়েছেন। গীতা স্কুলে আর পড়ে না। অনেকদিন হল বিয়ে হয়ে গেছে তার। যখন তার দশ বছর বয়স তখনই। সম্প্রতি দ্বিরাগমন হয়েছে। চমৎকার বাংলা নাম বলতে পারে গীতা।

“গীতা, কবে শ্বশুরবাড়ি থেকে এলি?”

“পরশু—”

“আমার জন্যে সামান্য দুধ দিলেই তো হত। একটু চায়ের জন্যে দরকার খালি। তুই একেবারে গাই নিয়ে হাজির হলি কেন?”

“আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে—”

চমৎকার চকচকে একটি কাঁসার ঘটিও এনেছিল সে। তাইতে নিজেই দুধ দুয়ে আলীর হাতে দিতেই আলী হাতের তর্জনী উত্তোলন করে বললে—“ঠহর যাও এক মিনিট” কেরিয়ার থেকে বার করলে সে অ্যালুমিনিয়মের একটা মুখ-ঢাকা হাঁড়ি। তাইতেই দুধটা ঢেলে নিয়ে সদাশিবের দিকে একটু ঝুঁকে মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করলে—”চায় কা পানি চঢ়া দেঁ হুজুর?”

“দাও। গীতা চা খাবি?”

গীতা লজ্জিত হল।

“আলী, গাড়িতে বেশী গ্লাস আছে?”

“জী হুজুর, হ্যায়। মগর থোড়া সা চকা হুয়া—”  

আলী তর্জনী আর অঙ্গুষ্ঠের একটি ছোট মুদ্রা করে জানিয়ে দিলে গ্লাসটা সামান্য ফাটা।

“ওতেই গীতাকে চা দাও। তুমি এক কাপ চা বানাও নিজের জন্যে।”

“বহুত খু—”

মাঠের মধ্যে স্টোভ জ্বালা সহজসাধ্য নয়। এলোমেলো হাওয়ার জন্যে সহজে ধরতে চায় না। কিন্তু সদাশিবের মোটরে সব ব্যবস্থা আছে। বড় বড় টিনের পাত দিয়ে ছোট একটা টিনের ঘর মতো করে নিলে আলী। তার ভিতর স্টোভটা ঢুকিয়ে জ্বালতে লাগল।

গীতা সদাশিবের কাছে সরে এসে মৃদুকণ্ঠে তার দুঃখের কাহিনী বলতে লাগল। গীতা শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। তার স্বামী দুশ্চরিত্র, মাতাল। শাশুড়ী দজ্জাল। তিনটি ননদ আছে, তিনটিই হাড়-জ্বালানী। কেউ শ্বশুরঘর করে না। সব মায়ের কাছে আছে। শুধু তারা নয়, তাদের স্বামীরা এবং ছেলেপিলেরাও। গীতাকেই সকলের সেবা করতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই মারধোর করে। একদিন এমন ইট ছুঁড়েছিল যে মাথা কেটে গিয়েছিল তার। তাছাড়া তাকে তার স্বামীর মালিকের বাড়িতেও কাজ করতে হয়।

“তোর স্বামী কি করে?”

“একজন বাভনের জমি চষে। এক পয়সা মাইনে পায় না। কবে নাকি দু’শো টাকা ধার নিয়েছিল তারই সুদের সুদ জমেছে। খেটে শোধ করতে হবে।”

‘তোদের চলে কি করে?”

“ওই জমি থেকে যা ফসল হয় তাই দেয় আমাদের খাবার মতো। তার দামও হিসেব করে ধারে জমা করে। ও ধার জীবনে কখনও শোধ হবে না—”

এই একই কাহিনী সদাশিব অনেকের মুখ থেকে শুনেছেন। বার বার অনুভব করেছেন, যে দাসত্ব-প্রথা এখনও লোপ পায়নি। কেবল তার বাইরের রূপটা বদলেছে মাত্র। দাস-দাসী বিক্রয়ের আলাদা হাট-বাজার নেই আজকাল। সমাজের বুকের উপরই ঘরে ঘরে সে হাট বসেছে। ধূর্ত ধনীর কাছে অসহায় দুর্বলরা স্বেচ্ছায় আত্মবিক্রয় করছে। না করে উপায় নেই তাদের।

সদাশিব জিগ্যেস করলেন-“আমি কি করতে পারি—”

গীতা বললে—“দু’-একদিন পরে আমার স্বামী আমাকে নিতে আসবে। আমি যদি যেতে না চাই আমাকে সেই বাভন লোকজন পাঠিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাবে। এখন ছোলা উঠেছে, আমাকে দিয়ে সেই ছোলা মণ মণ পেষাবে আর ছাতু করাবে। আমি তা পারব না। আমার স্বামী এলেই আমি আপনার কাছে পালিয়ে যাব। আপনি বলবেন আমি ওকে চাকরানী রেখেছি, ওকে যেতে দেব না।”

একটু ইতস্তত করে সদাশিব বললেন, “সেটা কি ঠিক হবে? কারও স্ত্রীকে কি তার স্বামীর কাছ থেকে কেউ জোর করে সরিয়ে আনতে পারে? সেটা বে-আইনী হবে। তুমি যদি তোমার স্বামীর কাছে না থাকতে চাও, তাহলে আদালতের সাহায্যে বিয়ে ভেঙে দিতে হবে। সে অনেক ঝঞ্ঝাট। তাঁর চেয়ে এক কাজ কর, তোমার স্বামীকেও এই শহরে এনে কোন রোজগারের কাজে লাগিয়ে দাও, তুমিও কাজ কর।”

“কিন্তু সেই বাভন তার টাকা ছাড়বে কেন? নালিশ করবে—”

“তার টাকা শোধ করে দাও। সে নালিশ করুক, আদালতের বিচারে তার যে টাকা পাওনা হবে তা আমরা দিয়ে দেব।”

“কিন্তু কি করে দেব অত টাকা। আপনি তো জানেন আমরা কত গরীব। বাবা অন্ধ, মা শুষছে, ভাইটা তাড়িখোর, সপ্তাহের মধ্যে তিনদিন কাজ করে না। আমরা কি করে অত টাকা শোধ করব?”

“আচ্ছা সে একটা ব্যবস্থা হবে খন।”

“হবে?”

উৎসুক দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল গীতা সদাশিবের মুখের দিকে। সে জানে সদাশিব যদি ভরসা দেন তাহলে হবেই একটা কিছু।

“হবে, তোর স্বামী এলে নিয়ে আসিস তাকে আমার কাছে—”

গীতা হঠাৎ হাঁটু গেড়ে প্রণাম করলে সদাশিবকে। তারপর মোটরের পিছনে বসে চা খেয়ে গরু নিয়ে চলে গেল। মনের ভার হাল্কা হয়ে গেল তার।

.

হাজিপুর হাটের কাছে সেই গাছের ছায়ায় বসে সদাশিব যথারীতি রোগী দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন ভিড়ের মধ্যে কেব্‌লী দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি শঙ্কিত।

“কি হল কেব্‌লী? নারাণ ছাড়া পেয়েছে?

“না বাবু। তাকে জেলে আটকে রেখেছে। আমি কাল দেখতে গিয়েছিলাম, অমন জোয়ান মরদ, মেয়েমানুষের মতো হাউ হাউ করে কাঁদছে। আপনি একটা ব্যবস্থা করুন ডাক্তারবাবু। আপনিই তো আমাদের মা-বাপ।”

কেব্‌লীর ছেকা-ছেনি হিন্দীতে উক্ত উক্তিটি শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন সদাশিব।

“আচ্ছা তুই যা, দেখি কি করতে পারি।”

কেব্‌লী ময়লা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। সদাশিব রোগী দেখতে লাগলেন।

ভিড়ের পিছনদিকে একটা কলরব উঠল। সদাশিব দেখলেন শুকুর কশাই তার ছেলে সিদ্দিককে টানতে টানতে নিয়ে আসছে।

“আদাব। বংগট্ কো পকড়কে লায়ে হ্যাঁয়, ডাক্টার সাব।”

বংগট্ মানে পাজি।

সদাশিব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন এবং সিদ্দিকের গালে ঠাস্ ঠাস্ করে দুটো চড় মারলেন জোরে!

শুকুর চীৎকার করে উঠল-”আউর মারিয়ে, আউর মারিয়ে

সদাশিব কিন্তু আর মারলেন না, চেয়ারে এসে বসলেন। তারপর বললেন—“উসকো বৈঠাকে রাখো, সুই দেঙ্গে—”

সিদ্দিকের বয়স সতরো-আঠারো বছর! গনোরিয়া হয়েছে। শুকুর তাকে সদাশিবের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু সিদ্দিকে রাজী হয়নি। সে বলেছিল উনি তো ‘ভিক্‌-মাংগা’-দের (ভিখারীদের) ডাক্তার। উনি আবার চিকিৎসার জানেন কি? শুকুরের কিন্তু সদাশিবের উপর অগাধ বিশ্বাস। তার সিফিলিস সদাশিবই সারিয়েছেন। শুকুর এসে সদাশিবকে জানিয়েছিল তার কুপুত্র সিদ্দিক সদাশিবের সম্বন্ধে কি অভদ্র উক্তি করেছে। সদাশিব প্রথমে কোন উত্তরই দেননি। কিন্তু শুকুর না-ছোড়।

“অব্ কুছ রাস্তা বালাইয়ে হুজুর। ক্যা কিয়া যায়?”

“ওকে এখানে ধরে নিয়ে এস। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

দুটি প্রচণ্ড চড় খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল সিদ্দিক। সদাশিব যখন তাকে ইনজেকশন দিলেন তখন আর আপত্তি করল না সে। সদাশিব বললেন— “এ ইনজেক্‌শন রোজ নিতে হবে। দশ দিন। আর এ ওষুধ খাও। রোজ তিনটে করে ট্যাবলেট—”

শুকুর বললে—“কাল বাজারেই কি ইন্জেকশন দেবেন?”

“তা দিতে পারি। ভোর ৭টার আগে যদি আমার বাড়িতে আসে তাহলে বাড়িতেও দিতে পারি।”

শুকুর আদাব করে সিদ্দিককে নিয়ে চলে গেল।

সদাশিব অন্যান্য রোগীদের ব্যবস্থা করে দিয়ে হাটে ঢুকলেন। কিছু কিনলেন। সেই কুমড়ো-উলী বুড়ী বসে ছিল। তার পাশে বসে ছিল তার নাতনী রৌশন। বিয়ে হয়ে তার চেহারাই বদলে গেছে। সে উঠে এসে সদাশিবকে প্রণাম করল। সদাশিব তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন একটু। তারপর এগিয়ে গেলেন বিলাতী সাহের দোকানের দিকে

“দু’ ম। কাতারনী চাল আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। খুব ভালো চাল—”

“দাম কত—”

“আমি বিয়াল্লিশ টাকা মণ খরিদ করেছি। এখন আপনি যা দেন—”

এবড়োখেবড়ো হলদে দাঁত বার করে হাসলে বিলাতী সাহ।

“বেশী ভণিতা কোরো না। কত দেবো বল—”

“এক টাকা মণ লাভ দিন।”

“আমার গাড়ির কাছে চল্, চেক্‌ দিয়ে দিচ্ছি।”

“চেক্ ভাঙানো বড় হাঙ্গামা ডাক্তারবাবু। আমি পরে গিয়ে আপনার বাড়ি থেকে দাম নিয়ে আসব।”

“বেশ।”

গাড়ির কাছে এসে দেখলেন একটা জেলে একটা রুই মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“আমার ছেলে ভালো হয়ে গেছে বাবু। আপনাকে তো কিছু দিতে পারিনি, তাই এই মাছটা—”

“ভালো হয়ে গেছে? বাঃ! আমাকে কিছু দিতে হবে না। এই মাছটা বেচে তোর ছেলেকে একটা তাগদের ওষুধ খাওয়া। আমি লিখে দিচ্ছি—”

একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিলেন তিনি। জেলেটা তবু কুণ্ঠিত মনে দাঁড়িয়ে রইল। “কি রে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন”

“এ মাছটা আপনি নিয়ে যান। আপনার নাম করে এনেছি। এ আমি বেচব না। আমার ছেলেকে তাগদের দাবাই আমি কিনে দেব-

বোমার মতো ফেটে পড়লেন সদাশিব।

“এই নবাবী আর লৌকিকতা করেই উচ্ছন্ন গেছ তোমরা। দাও, তোমাকে আর ওষুধ কিনতে হবে না। আমিই এনে দেব।”

তার হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে মোটরে উঠে পড়লেন সদাশিব। আলী গোপনে মাছটি ‘কেরিয়ারে’ রেখে দিলে। জেলেটা সদাশিবকে কি বলতে যাচ্ছিল। আলী ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ইশারায় জানিয়ে দিলে—একটি কথা বোলো না এখন।

.

হাজিপুরের হাট থেকে সদাশিব সোজা চলে গেলেন ডি. আই. জি. অব পুলিসের বাড়িতে। যিনি এখন এই পদে অধিষ্ঠিত তাঁর সঙ্গে সদাশিবের আলাপ ছিল চাকরিজীবনে। তখন তিনি এস. পি. ছিলেন। সদাশিব এখন পারতপক্ষে অফিসারদের এড়িয়ে চলেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল ইনি তাঁকে চিনতে পারবেন কিনা। প্রায় দশ বছর পরে দেখা হচ্ছে। যদি চিনতে না পারেন, যদি তাঁর কথা না রাখেন, তাহলে বড়ই মর্মান্তিক ব্যাপার হবে। তবু গেলেন তিনি। কেব্‌লীর অশ্রুপ্লাবিত মুখটা বড়ই পীড়া দিচ্ছিল তাঁকে।…..

ডি. আই. জি. প্রথমে তাঁকে সত্যিই চিনতে পারেননি। কিন্তু পরিচয় দিতেই চিনতে পারলেন এবং সাদর অভ্যর্থনা করে বসালেন।

“বসুন, বসুন। আপনার চেহারাটা একটু বদলে গেছে। তাই চিনতে দেরি হল! রিটায়ার করে এখানে প্র্যাকটিস করছেন?”

“হ্যাঁ”

“কই আপনার কথা শুনিনি তো—”

“আমি যাদের মধ্যে প্র্যাকটিস্ করি তারা আপনার কাছে আসতে পারে না। ইতর লোকেদের ডাক্তার আমি–”

“ওরাই তো এখন দেশের মালিক সার। ওদের এখন আর অবজ্ঞা করবার জো নেই।”

“কিন্তু তবু ওদের সম্বন্ধে এখনও আপনারা সুবিচার করছেন না। ওদেরই একজনের জন্য আজ আপনার কাছে দরবার করতে এসেছি।”

“কি ব্যাপার!”

সদাশিব খুলে বললেন সব।

“ও, এই! আচ্ছা, আজই ছাড়া পেয়ে যাবে। আমি এখনই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

ফোন তুলে তিনি এস. পিকে বললেন ব্যাপারটা। এস. পি. কি বলছিলেন তা শুনতে পেলেন না সদাশিব। ডি. আই. জি. বললেন, “যেমন করে হোক ওকে ছেড়ে দিতে হবে। ছবিলালবাবুর চক্রান্তে নির্দোষ বেচারা কষ্ট পাচ্ছে। ওকে আজই ছেড়ে দিন। আচ্ছা, আচ্ছা-

ডি. আই. জি. সদাশিবের দিকে চেয়ে বললেন-“আজই ছাড়া পাবে। আজ না পায়, কাল পাবেই। বয়—”

লিভেরি-পরা ‘বয়’ দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন—“হুইস্কি-সোডা।”

তারপর সদাশিবের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন।

“আপনার চলবে কি?”

“না, আমি ও-রসে বঞ্চিত।”

ডি. আই. জি. আর একবার হাসলেন।

“আপনার খদ্দর দেখে আমার বোঝা উচিত ছিল। যদিও আজকাল অনেক খদ্দরধারীরাও এ-রসের রসিক হয়েছেন—”

“তা জানি। খদ্দর আজকাল অনেক পাজি লোকদের ইউনিফর্ম হয়েছে।”

“তবে পরেন কেন?”

“ওর পিছনে একটা বড় আদর্শ আছে বলে। পাজিরা ভাত খায় জুতো পরে বলে তো ভাত খাওয়া জুতো পরা ছাড়তে পারি না—”

হা হা করে হেসে উঠলেন ডি. আই. জি.।

“ওয়েল সেড়। আসবেন মাঝে মাঝে। নমস্কার।” “নমস্কার।”

সদাশিব বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু ফিরে এলেন আবার।

“একটা যদি প্রস্তাব করি, রাগ করবেন?”

“কি বলুন—”

“একটু আগেই আমার এক জেলে রুগী বড় একটা রুই মাছ উপহার দিয়েছে। মাছটা নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। আমি বিপত্নীক। বাড়িতে খাবার লোক বেশী নেই। ঠাকুরটা অসুখে পড়েছে। এই অসময়ে যদি মাছ নিয়ে যাই আমার ভাইপো-বউ মালতী চটে যাবে। মাছটা যদি আপনাকে দিয়ে যাই, কেমন হয়?”

“এককালে ঘুষ নিতাম, এখন আর নিই না। তবে এতে যদি আপনার সমস্যার সমাধান হয় দিয়ে যেতে পারেন।”

আবার উচ্চকণ্ঠে হাসলেন তিনি।

তাঁকে মাছটা দিয়ে চলে গেলেন সদাশিব।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন