হাটে বাজারে – ১৪

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। চৌদ্দ।।

জিরাফ-প্রতিম সিংহেশ্বর সিং দারোগা সোচ্ছ্বাসে সংবর্ধনা করলেন সদাশিবকে।

“আইয়ে আইয়ে ডাক্‌টার সাহেব, কেয়া সৌভাগ্য। পধারিয়ে। আপকা ‘কিরপা’সে মুন্না তো একদম cured হো গয়া। আরে মুন্না, ডাক্টার সাহেবকো প্রণাম কর—”

একটা ফরসা কিশোর এসে লজ্জিতভাবে প্রণাম করল।

“ডাটার সাহেবকো কুছ্ নাশ্তা (জলখাবার) লা দেও–”

সদাশিব বললেন, “না, আমি এখন কিছু খাব না—”

“চায়?”

“না। আমি যেজন্য এসেছি তা শুনুন।”

নবীপুর হাটের ঘটনা সব খুলে বললেন তাঁকে। তারপর বললেন, “ওই তিন ছোক্বার বিরুদ্ধে ডায়েরিতে লিখে নিন। এই ছিপলী মেয়েটাকে ওরা হাটে জ্বালাতন করছিল, হাটের সবাই দেখেছে। ওকে যা জিগ্যেস করতে চান করুন—”

সিংহেশ্বর গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর হিন্দীতে যা বললেন তার মর্ম হচ্ছে, “ও ছোকরা তিনটে যে পাজি তা তো সুবিদিত। কিন্তু ওরা আঁটঘাট বেঁধে এমনভাবে বদমায়েশী করে যে ওদের ধরা-ছোঁয়া যায় না। আমরা যদি কিছু করতে যাই আমরাই বিপদে পড়ে যাব। কারণ যাদের অধীনে আমরা চাকরি করি, যাদের হুকুম অনুসারে আমাদের চলতে হয়, তারা ওদের সপক্ষে। তবে আপনি যখন বলছেন তখন আমি ডায়েরিতে লিখে নিচ্ছি। আপনি ব্যাপারটা এস. পি. এবং ডি. আই. জি-র কানেও তুলে দিন। ওঁরা বড় অফিসার, ওঁরা ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারেন।” তারপর হেসে বললেন—“যা জমানা’ (দিনকাল) পড়েছে তাতে ওঁরাও পারেন কিনা সন্দেহ। চাকরির মায়া তো সকলেরই আছে।”

দারোগা সাহেব ছিপলীকে আপিস-ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন। তারপর যথারীতি ডায়েরিটা লিখে নিলেন।

….. ছিপলিকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে সদাশিব গেলেন ডি. আই. জি-র কাছে। যেতে যেতে তাঁর মনে হতে লাগল তিনি ডাক্তার, ডাক্তারি ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছুতেই মাথা-গলাতে যাওয়াটা কি তাঁর উচিত হচ্ছে? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে গেলেন নিজের মনের ভিতর থেকেই। বহুকাল আগে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের একটা লেখা পড়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন যে, কেমিস্ট হয়েও তিনি কেন দেশের কাজে নেমেছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, বিখ্যাত ফরাসী রসায়নবিদ Henry Moissau এর একমাত্র পুত্র Louis বিশ্বমহাযুদ্ধে যোগ দিয়ে মারা যান। তিনিও একজন রসায়নবিদ্ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র Laski-র বিখ্যাত প্রবন্ধ— The Danger of Obedience থেকে কিছু উদ্ধৃত করেছিলেন। সেই কথাগুলো সদাশিবের মনে পড়ল। Men who insist that some particular injustice is not their responsibility sooner or later become unable to resent any injustice. Tyranny depends upon nothing so much as the lethargy of a people. Autocracy is born above all of the experience that it need not expect active resentment against injustice. This is the inner truth of Thoreau’s famous sentence that ‘under a government which imprisons any unjustly the true place for a just man is also a prison’.

আরও খানিকটা কি ছিল কিন্তু সদাশিবের তা মনে পড়ল না। তবে তাঁর মনের সংশয় কেটে গেল। অন্যায় অসভ্য অসুন্দরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা প্রত্যেক নাগরিকেরই কর্তব্য। ডাক্তার হয়েছেন বলেই তিনি এ কর্তব্যের দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। দেশ এখন স্বাধীন বলেই এ দায়িত্ব আরও প্রবল হয়েছে। বহুকালের পরাধীনতা আর অশিক্ষার ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষই স্বার্থপর পশুতে পরিণত হয়েছে, তাদের মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক সময় লাগবে। বর্তমান সমাজের ও শাসনব্যবস্থার ভয়াবহ চেহারা দেখে ভয় পেলে চলবে না, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রামে সদ্বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা যদি প্রাণপণে লেগে না থাকেন তাহলেই ভয়ের কথা। এই সব ভাবতে ভাবতে সদাশিব ডি. আই. জি-র বাংলোয় পৌঁছলেন।

.

ডি. আই. জি. অফিসে কাজ করছিলেন। সেখানেই সদাশিবকে ডেকে পাঠালেন।

“নমস্কার। আসুন, আমিই আপনার ওখানে যাব ভেবেছিলাম।”

“কেন বলুন তো?”

“সিরোসিস্ অব্ লিভার সারে কি?”

“সেটা নির্ভর করে লিভারটা কতটা খারাপ হয়েছে তার উপর। কেন, কার হয়েছে সিরোসিস্ অব্ লিভার—”

“আমার। পাপী লোক তো! কতটা খারাপ হয়েছে তা কি পেট টিপে বুঝতে পারবেন?”

“খানিকটা পারব। তবে ভালো করে জানতে হলে কতগুলো ল্যাবরেটরি টেস্ট আছে তা করতে হবে। তা এখানে হবে না, কোলকাতায় যেতে হবে—”

“তাই যাব। তবে, কোলকাতার ব্যাপার কি জানেন, কে ভালো ডাক্তার, কে রিলায়েবল্, কে নয়, তা ঠিক করা বড় শক্ত। অনেক ডিগ্রীধারী জুয়াচোর ফাঁদ পেতে বসে আছে তো, প্রত্যেকের টাউও ঘুরছে বাজারে। আপনি যদি কোন ভালো লোকের কাছে পাঠিয়ে দেন সেইখানেই যাব—”

“কি কষ্ট হয় আপনার?”

“ডিপেসিয়া। অম্বলে বুক জ্বালা করে বিকেলের দিকে—”

“সেটা সিরোসিস অব্ লিভারের জন্য না-ও হতে পারে।”

“মদ খাই যে। গিলটি কশেন্‌স তো। এখন যিনি সিভিল সার্জন আছেন তিনি ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন। ইন্‌জেক্‌শনও দিয়ে যাচ্ছেন রোজ একটা করে। কিচ্ছু ফল হচ্ছে না। তাই ভাবছিলাম আপনাকে একবার কন্সালট করব।”

“মদ খেলে যে সিরোসিস্ হবেই এমন কোনও কথা নেই। হিন্দু বিধবাদেরও সিরোসিস্ হতে দেখেছি। তারা মদ খায় না, ঝাল খায়, আর প্রোটিন নামমাত্র খায়। অনেকের মতে প্রোটিন ফুডের অভাবই সিরোসিসের একটা কারণ।”

“আমি তো রোজ দুটো করে মুরগি খাই।”

“আপনি এক কাজ করুন, খাবার পর ফোঁটা-কয়েক অ্যাসিড খেয়ে দেখুন না, আপনার কষ্ট কমে কিনা।”

“বেশ, লিখে দিন প্রেস্কৃপশন্ একটা।”

কাগজ আর কলম এগিয়ে দিলেন। প্রেস্কৃপশন লিখে বললেন,”আমার মোটরেই ওষুধ আছে। বলেন তো দিয়ে দি।”

“দিন–”

সদাশিব বেরিয়ে গেলেন এবং একটু পরেই ফিরে এলেন একটা ছোট শিশি আর একটা ড্রপার নিয়ে।

এটা অ্যাসিড হাইড্রোক্লোরিক ডিল। এর দশ ফোঁটা খাবেন একটু জলের সঙ্গে মিশিয়ে, খাবার পরই দু’বেলা। আউন্সখানেক জল দেবেন, বেশ টক।”

“থ্যাঙ্কিয়ু। এর দাম-টাম—”

“দাম অতি সামান্য, তা আর দিতে হবে না। তবে আমি একটা কাজের জন্যে এসেছি, যদি একটু সাহায্য করেন উপকৃত হব।”

“কি বলুন। আপনার সে লোকটা তো ছাড়া পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই—

“হ্যাঁ। এ একটা অন্য ব্যাপার–”

সব বললেন খুলে।

ডি. আই. জি. একটু চুপ করে থেকে বললেন, “থানায় ডায়েরি করিয়ে ভালোই করেছেন। আমি দেখব। ওই ছিপলীর সঙ্গে আপনার আলাপ হল কি করে?”

“ওদের বাড়িতে আমি চিকিৎসা করি। ওরা ঘরের লোকের মতো হয়ে গেছে।”

“ও, আচ্ছা আমি দেখব।”

তারপর হেসে বললেন, “আপনি যদি আপত্তি না করেন একটা হুইস্কি সোডা অর্ডার করি—”

“না না, আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই। আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে আপনার সিরোসিস্ হয়েছে।”

টং করে ঘণ্টা টিপতেই এক আরদালী এল।

“হুইস্কি সোডা—”

হুইস্কি-সোডায় এক চুমুক দিয়ে বললেন, “আপনার রিভলবার আছে?”

“আছে।”

“সঙ্গে থাকে তো?”

“না।”

“সঙ্গে রাখবেন। যে গুণ্ডা তিনটির নাম করলেন তারা সাংঘাতিক লোক। ওদের কথা আমি শুনেছি। ওদের গায়ে হাত দেওয়া শক্ত। ওদের খুঁটির জোর আছে। অবশ্য আমি কিছু কেয়ার করি না। আমার রিটায়ার করবার সময় হয়ে এসেছে, ওরা আমার বেশী কিছু করতে পারবে না। তবে আপনি একটু সাবধানে থাকবেন—”

“স্বাধীনতা হওয়ার পর থেকে ছেলেদের উচ্ছৃঙ্খলতাটা একটু বেড়েছে—”  

“বাড়বেই তো। আমি তো ইংরেজ আমলের লোক, এদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। খদ্দর পরে যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেমেছিল তাদের মধ্যে ওয়ান পারসেন্ট লোক ভালো ছিল কিনা সন্দেহ। তাদের হাতেই রাজত্ব গেছে, তারা লুটেপুটে খাচ্ছে। সেদিন এক গ্রামে এক বড় গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি হয়ে গেছে, গ্রামের লোক তাড়া করাতে ডাকাতগুলো পালিয়েছিল। কিন্তু তারা যে জীপটায় এসেছিল সেটা নিয়ে যেতে পারেনি। দেখা গেল যে জীপটা একজন হোমরাচোমরা রাজপুরুষের—”

“কি করলেন আপনারা—”  

“কি আর করব। তিনি বললেন, তাঁর জীপটাও ডাকাতরা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা ধামা-চাপা পড়ে গেল। দুরাত্মার পিছনে যদি রাজবল থাকে তাহলে সে দিন-দুপুরে হাতে মাথা কাটবে—”

“এর প্রতিকার কি?”

“প্রতিকার? It will come in time! ফ্রেঞ্চ রেভলিউশনের ইতিহাস পড়েছেন?”

“ভালো করে পড়িনি।”

“পড়ে দেখবেন। ওর মধ্যে অনেক শিক্ষাপ্রদ জিনিস আছে।”

ডি. আই. জি. হাসিমুখে হুইস্কি-সোডা সিপ করতে লাগলেন।

“আচ্ছা, এবার উঠি আমি।”

“আচ্ছা। নমস্কার। দিন আষ্টেক পরে খবর পাঠাব কেমন আছি। নমস্কার।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন