হাটে বাজারে – ১১

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)

।। এগারো।।

খুব ভোরে সদাশিব বাড়ির সামনে ‘লনে’ চুপ করে বসে থাকেন। কিছু করেন না, কেবল পা দোলান আর বসে বসে চেয়ে দেখেন চারদিকে। পাখি, ফল, গাছ, আকাশ, চিরপুরাতন তাঁর এই সঙ্গীরা নিত্য-নূতন আনন্দ দেয় তাঁকে। লনে বসেই চা খান এবং চা খাওয়ার পরও চুপ করে বসে থাকেন তাঁর ড্রাইভার আলী যতক্ষণ না আসে। আলী এলেই বেরিয়ে যান তিনি।

সেদিন ভোরে ছিপলী এসেছিল, কিছু মাছ আর তার স্বামীকে নিয়ে। সদাশিব দেখলেন ছিপলীর স্বামীর হুকওয়ার্মের চিকিৎসা করে স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়েছে। আগে চোখ মুখ বিবৰ্ণ ছিল, এখন একটু রক্তের আভাস দেখা দিয়েছে। ছিপলী কিন্তু বললে ওর ‘তাগত’ নেই কিছু। হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন সদাশিব। ছিপলীকে বললেন, “তুই মাছগুলো নিয়ে বাড়ির ভেতর যা। আমি দেখছি একে। আজবলালের কাছ থেকে বঁটি নিয়ে মাছগুলো বেছে দিগে যা।”

ছিপলীর স্বামীকে মৃদুকণ্ঠে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন সদাশিব! ছিপলীর স্বামী অপ্রতিভ মুখে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর সত্য কথা বলল। লোকটা পারুষ্য-হীন। পূর্ণ যুবতী হাস্যমুখী ছিপলীর ঢলঢলে চেহারাটা ফুটে উঠল সদাশিবের মানসপটে।

“নাম কি তোমার–”

“জিতু—”

“তোমার যে অসুখ হয়েছে তা তো বাপু চট্‌ করে সারবে না। এর জন্যে যে-সব ইনজেকশন নিতে হবে তার দামও অনেক। তুমি কি পারবে?

“ঘটি বাটি বন্ধক দিয়ে টাকা যোগাড় করতে হবে। কত টাকা লাগবে —?”

“আমি ওষুধের নাম লিখে দেব। তুমি দোকানে গিয়ে খোঁজ কর কত দাম লাগবে—”

“আচ্ছা, যদি অসুখ সেরে যায় তাহলে আমি যেমন করে হোক ওষুধের দাম জোটাব—”

“আচ্ছা তুমি বস। আমি ওষুধের নাম লিখে দিচ্ছি। ছিপলী আসুক—”

জিতু একধারে বিমর্ষ মুখে বসে রইল। সদাশিবও একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় এ অসুখ প্রায় দুরারোগ্য। ওষুধও দুর্মূল্য। এ অবস্থায় এই গরীব লোকটাকে কি এত খরচের মধ্যে ফেলা উচিত হবে?

ছিপলী একটু পরে বেরিয়ে এল।

তাকে স্পষ্ট কথাই বললেন সদাশিব—“তোর স্বামীর যা হয়েছে তা প্রায় সারে না। একরকম ইনজেক্‌শন আছে, তাতে কিছু উপকার হতেও পারে, না-ও হতে পারে। তোমরা যদি সে ইন্‌জেক্‌শন কিনতে পারো, তাহলে উলফৎ সে ইন্‌জেক্শন দিয়ে দেবে, পয়সা নেবে না। ওষুধটা কিন্তু কিনতে হবে। আমার কাছে নেই—”

“বেশ, লিখে দিন কিনে নেব–”

ওষুধের প্রেসকৃপশন নিয়ে ছিপলী আর তার স্বামী চলে গেল।

ওরা চলে যাবার পর সদাশিব ভাবতে লাগলেন। জিতুর অসুখ যদি না সারে, তাহলে কি হবে? আইনত ছিপলী তার স্বামীকে ত্যাগ করে অন্য বিবাহ করতে পারে। কিন্তু ছিপলী কি তা করবে? মনে হয় ওর স্বামীকে ও ভালোবাসে। দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে বলেই সব ভালোবাসা উবে যাবে? কেবল আইন বা শাস্ত্র মেনে চললেই কি মানুষ সুখী হয়? কি জানি ওর কিসে সুখ হবে।

বহুদিন আগেকার একটা কথা মনে পড়ল। ভবদেববাবুর স্ত্রী সাবিত্রীর কথা। ভবদেববাবুরও কোনও পারুষ্য ছিল না। সাবিত্রী দেবী সাবিত্রী নামের মর্যাদা রাখতে পারেননি। অনেক প্ৰণয়ী ছিল তাঁর। ভবদেববাবুও জানতেন একথা, কিন্তু কিছু বলতেন না। স্ত্রীকে ভয় করতেন তিনি, সর্বদাই যেন তাঁর কাছে অপরাধী হয়ে থাকতেন। আড়ালে সকলেই ভবদেববাবুকে নিয়ে পরিহাস করতেন। নিজেকে এরকম হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলার চেয়ে বিবাহ-বন্ধন ছিন্ন করা ঢের ভালো।

আজবলাল চা নিয়ে এল।

চায়ের টেবিল সাজিয়ে দিয়ে সে কুণ্ঠিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল একধারে।

“তুমি যাও, আমি নিজে ছেঁকে নেব–”

“একটা কথা ছিল বাবু। আমি মাসখানেকের জন্যে বাড়ি যেতে চাই। দেশে আমাদের কিছু জমি আছে, আমার ভাইপোটাই এতদিন সব দেখাশোনা করত। কিন্তু সে পুলিসের চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেছে, বাড়িতে কেউ নেই, আমি একবার বাড়ি না গেলে সব বরবাদ হয়ে যাবে। আমি রামলক্ষ্মণ ঠাকুরকে বলেছি, এখানে এসে কাজ করবে।”

“এখান থেকে যদি কিছু টাকা পাঠিয়ে দাও কোনও ব্যবস্থা হতে পারে না?”

“শুধু টাকা পাঠালে কিছু হবে না। আমাকে নিজে যেতে হবে। জমিগুলো ভাগে বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসব। যাবার সময় আমাকে কিছু টাকাও নিয়ে যেতে হবে।”

সদাশিব কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন।

তারপর বললেন, “বেশ—”  

চা খেয়ে সদাশিব চুপ করে বসে রইলেন। কাগজওলা কাগজ দিয়ে গেল। আলী এসে সেলাম করে গাড়ির চাবি নিয়ে গাড়ি বার করল। সদাশিব চুপ করে বসে বইলেন। সোহাগ গেছে, মালতী গেছে, আজ আজবলালও চলল। ও বলছে বটে ফিরে আসবে, কিন্তু সম্ভবত ফিরবে না। দেশে ওর ভাইপো ছিল বলেই এতদিন ও একটানা এখানে থাকতে পেরেছিল। আর থাকবে না। হঠাৎ যেন তিনি চমকে উঠলেন। মনে হল মনু সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। পরমুহূর্তেই কিন্তু আর দেখতে পেলেন না। চোখের ভুল? কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে! অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলেন তিনি। তারপর তাঁর সমস্ত হৃদয় অদ্ভুত একটা সান্ত্বনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তাঁর বিশ্বাস হল আর কেউ না থাক মনু তাঁর কাছাকাছি আছে এবং চিরকাল থাকবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন