রাস্কিন বন্ড
পুরোনো কাঠের সাঁকোটা আর অবশিষ্ট নেই, কালের আগ্রাসনে কবেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে— গঙ্গোত্রীর গভীর গিরিখাতের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা ভাগীরথী নদীর দুই পাড় যুক্ত করে এখন সেখানে ঝুলন্ত লোহার সাঁকো। গ্রামবাসীরা বলে, এখনও নাকি সেই সাঁকোর উপরে মাঝেমধ্যেই শোনা যায় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, প্রায় দেড়শো বছর আগে নিজের তৈরি করা ওই সাঁকোর উপর দিয়ে উইলসন সাহেব ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন। প্রথমটায় যখন সাঁকো তৈরি হয়েছিল, গ্রামের মানুষজন সাঁকোটার ওপর দিয়ে আসা-যাওয়া মোটেই নিরাপদ মনে করত না, তাই মোটের উপর এড়িয়েই চলতে শুরু করে একটা সময়। মরিয়া হয়ে সাহেব নিজেই বার বার ঘোড়া ছুটিয়ে যেতেন যাতে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারে সাঁকোর বাঁধন কত মজবুত। দূরে নদীর এক পারে সেই পুরোনো সাঁকোর কিছু অংশ এখনও রয়ে গেছে। উইলসন সাহেব আর তাঁর সুন্দরী বউ গুলাবির কথা এই এলাকায় লোকের মুখে মুখে ঘোরে।
আমরা একবার কয়েকজন বন্ধু মিলে ঘুরতে গিয়ে সেই নদীটার কাছাকাছি পুরোনো একটি বনবাংলোয় উঠলাম। বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সদ্যবিবাহিত রায়দম্পতি আর ছিলেন দত্তদম্পতি। দত্তদের অবিশ্যি বহুদিন হল বিয়ে হয়েছে। তরুণ রায়দম্পতির মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত আর তা নিয়ে দত্তদের মনে কোনো উদ্বেগ দেখিনি, বরং তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করতেন তাঁরা। এর মধ্যে আমি হলুম অবিবাহিত, তাই আমাকে নিয়ে কারোর তেমন মাথাব্যথা নেই। আর বিবাহিত জীবনের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মেটানোর ক্ষমতা আমার কোনোকালেই নেই।
তাই আর কী করা! সারাদিন নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরেই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম, পাহাড়ের ঢাল বরাবর ঘন দেবদারু আর ওকের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। এই সেই জঙ্গল যা উইলসন সাহেব আর তাঁর পৃষ্ঠপোষক তেহরির রাজার ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল। তাঁরা এই জঙ্গলকে সবরকম লাভজনক উপায়ে ব্যবহার করেছিলেন। বড়ো বড়ো কাঠের গুঁড়ি নদীতে ভাসিয়ে সমতলের কাঠগোলায় পাঠানো হত একসময়।
একদিন সন্ধ্যায় বনবাংলোয় ফিরছিলাম, সাঁকোর ওপর দিয়ে অর্ধেক পথ এসেছি তখন, দেখলাম কুয়াশার মধ্যে থেকে একটি অবয়ব ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম, সেটা একজন মহিলার শরীর, খুব সাধারণ পাহাড়ি ধুতি জাতীয় পোশাক পরা, খোলা চুল সারা কাঁধে ছড়িয়ে আছে। মনে হল আমাকে সে খেয়াল করেনি। দেখলাম, সাঁকোর রেলিং-এ ভর দিয়ে ঝুঁকে নীচে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে। আর ঠিক তারপরেই আমাকে চরম বিস্ময়ে ও ভয়ে হতবাক করে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই সে ওই রেলিং বেয়ে উঠে নদীতে ঝাঁপ দিল।
আমি আতঙ্কে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলাম, কিন্তু সেই রেলিং-এর সামনে যখন এলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তার ঘূর্ণায়মান দেহকে নীচে পড়তে দেখলাম, তারপরেই নদীর তীব্র স্রোতে পড়ে সেই দেহ নিমেষে তলিয়ে গেল।
ওয়াচম্যানের কেবিন সামনেই। হাঁফাতে হাঁফাতে সেখানে ছুটে এলাম। দরজা খোলাই ছিল। ওয়াচম্যান রাম সিং খাটে হেলান দিয়ে হুঁকো টানছিল।
‘কেউ একজন সাঁকো থেকে ঝাঁপ দিয়েছে,’ আমি হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম, ‘নদীর স্রোতে সে মহিলা তলিয়ে গেছে এতক্ষণে।’
শুনেও ওয়াচম্যানের কোনো ভাবান্তর হল না। ‘আবার গুলাবি,’ সে প্রায় বিড়বিড় করে বলল, তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি ওকে ঠিক দেখেছেন?’
‘একজন মহিলা, লম্বা খোলা চুল মাথায়, কিন্তু আমি তার মুখ ঠিক পরিষ্কার দেখতে পাইনি।’
‘ও গুলাবিই হবে। শুধুমাত্র একটা পেতনি, মাই ডিয়ার স্যার। অত ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এখনও মাঝে মাঝে তাকে ওইভাবেই জলে ঝাঁপ দিতে দেখা যায়, আপাতত এখানে বসুন তো,’ বলে সে একটা পুরোনো ভাঙাচোরা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসল, তারপর বলল, ‘আরাম করে বসুন, আমি সব বলছি।’
আরাম করে বসার অবস্থায় আমি ছিলাম না, কিন্তু রাম সিং গুলাবির আত্মহত্যার যে কাহিনি বলে গেল তা শুনলাম। তার আগে আমার জন্য এক গ্লাস গরম মিষ্টি চা বানিয়ে এনে জমিয়ে বসে অতৃপ্ত গুলাবির লম্বা কাহিনি শুরু করল— সেই কবে ভাগ্যান্বেষণে আসা ব্রিটিশ অভিযাত্রী উইলসন কীভাবে কস্তুরি হরিণ শিকার করতে এসে গ্রামের পথে গুলাবিকে দেখতে পান। মেয়েটির ধূসর-সবুজ চোখ, স্নিগ্ধ গোলাপি রঙা দেহ দেখে উইলসন তো প্রায় উন্মাদ হয়ে যান আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তিনি মেয়েটির বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে ছুটলেন। এখন প্রশ্ন হল, উনি কি সত্যিই মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলেন নাকি কেবল মেয়েটির সুন্দর কমনীয় রূপ দেখে তাঁর মাথা ঘুরে গিয়েছিল? যদিও কোনোদিনই এর উত্তর আমরা পাব না। অভিযান আর ভ্রমণের সময়ে তিনি এরকম বহু মেয়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন, কিন্তু আগুন রূপের বাইরেও গুলাবি ছিল সবার থেকে অন্যরকম— সাধাসিধে, শিশুসুলভ। দরিদ্র গ্রাম্য পরিবারের মেয়ে হওয়ায় এ বিয়েতে বাড়ির থেকেও কোনো আপত্তি রইল না। কিন্তু জীবজন্তু শিকার করে কি আর ভাগ্যের চাকা ঘোরানো যায়? উইলসন দেখলেন, তার থেকে এই বিস্তীর্ণ বনসম্পদকে কাজে লাগালে দারুণ লাভজনক হবে। পরিকল্পনামাফিক তিনি এরপর তিন তিনটে কাঠগোলা বানালেন, প্রথমটি হার্সিলে, দ্বিতীয়টি দেরাদুনে আর তৃতীয়টি মুসৌরিতে। সাহেবের ভাগ্য ফিরল। গুলাবির যা যা চাহিদা ছিল সবই সে পাচ্ছিল, বেশ স্বাস্থ্যবান দুটি বাচ্চাও হল। যখন সাহেব কাজের জন্য বাইরে যেত, গুলাবি বাচ্চাদের দেখাশোনা করত আর হার্সিলের আপেল বাগানের পরিচর্যা করত।
কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে গুলাবির জীবনে খারাপ অধ্যায় শুরু হল, যেদিন উইলসন সাহেবের সঙ্গে রুথ নামের এক ইংরেজ ভদ্রমহিলার পরিচয় হল। সাহেব আবার প্রেমে পড়লেন, এবার এই ইংরেজ মহিলার। ঠিক করলেন তাঁর এই প্রেয়সীকেও ভালোবাসা আর সম্পত্তির ভাগ দেবেন। তার জন্য একটা সুন্দর বাড়িও বানিয়ে দিলেন। সাহেব ক্রমে হার্সিলে গুলাবি আর বাচ্চাদের সঙ্গে থাকা প্রায় বন্ধই করে দিলেন। ব্যাবসা তাঁকে অনেক উঁচুতে পৌঁছে দিল! একসময় আস্ত একটি ব্যাঙ্কের মালিক হয়ে বসলেন সাহেব, পাহাড়ে দামি রিসর্ট কিনলেন, বন্ধুবান্ধব, ব্যাবসার পার্টনারদের ওই রিসর্টে নিয়ে যেতেন, হুল্লোড় চলত রাতভোর, দুনে আবার এর সঙ্গে প্রায়ই শিকার পার্টিও আয়োজন করতেন।
গুলাবি গ্রাম্য কায়দাতেই ওর বাচ্চাদের মানুষ করছিল। উইলসন সাহেবের সঙ্গে মুসৌরির ওই মহিলার পরকীয়ার কথা তার কানে গেছিল। মাঝেমধ্যে যখন সাহেব আসতেন, তখনই একদিন গুলাবি তাঁর মুখোমুখি হয়ে তার সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিল, চিৎকার করে বার বার বলল, যাতে ওই মহিলাকে সাহেব ছেড়ে দেন। তিনি গুলাবির কথায় পাত্তা দিলেন না, বরং বোঝালেন সে যেন ওইসব ফালতু রটনায় কান না দেয়। এরপরে ঘটল এক ভয়ংকর ঘটনা। যখন সাহেব পেছন ঘুরলেন তখনই গুলাবি বন্দুক রাখার টেবিল থেকে ফ্লিন্টলক পিস্তলটা নিয়ে তাঁর দিকে তাক করে ঘোড়া টেনে দিল। কিন্তু বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সামনের আয়নাটা চুরমার করে দিল। গুলাবি এরপর দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আপেল বাগান, বনবাদাড়ের মধ্য দিয়ে ছুটে দু-তিন-বছর আগে উইলসনেরই বানানো সাঁকোর দিকে যাওয়ার খাড়াই পথে এসে পড়ল। ওদিকে বিহ্বলতা কাটতেই সাহেব গুলাবির খোঁজে ঘোড়া ছোটালেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। সাহেব যতক্ষণে অকুস্থলে এসে পৌঁছেছেন ততক্ষণে গুলাবি সাঁকোর অনেক নীচে নদীর ঘূর্ণায়মান স্রোতে ঝাঁপ দিয়েছে। এক-দু-মাইল দূরে তার দেহ পাওয়া গিয়েছিল, কয়েকটা পাথরের খাঁজে আটকে ছিল।
এই হল আমাকে বলা রাম সিং-এর গল্প— স্বভাবতই সে নানাভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, নিজের কল্পনা মিশিয়ে বলেছে গল্পটা। আমি ভাবলাম সন্ধ্যায় বনবাংলোর সামনে আগুন জ্বেলে জমিয়ে এই গল্পই বন্ধুদের বলা যাবে, ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ্য হবে। হলও তাই। গল্পটি ওঁদের কাছে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক হল বলাই বাহুল্য। কিন্তু যখনই আমি বললাম, আমি নিজের চোখে গুলাবির প্রেতাত্মাকে দেখেছি, ওদের ধারণা হল আমি কিছুটা রং চড়িয়ে বলছি। মিসেস দত্তর কাছে গল্পটি নিতান্তই দুঃখজনক মনে হল। মিসেস রায়ের বয়স কম, তাঁর মতে, গুলাবি বোকার মতো কাজ করেছে। ‘খুব সরল সাদা মেয়ে তো,’ মিস্টার দত্ত বললেন, ‘তার যে পথ খোলা ছিল সেই পথই বেছে নিয়েছ।’
‘টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না,’ মিস্টার রায় মন্তব্য করলেন।
‘না,’ মিসেস দত্ত বললেন, ‘তবে তা দিয়ে ইচ্ছেমতো স্বাচ্ছন্দ্য কেনাই যায়।’
মিসেস রায় আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাই আমি বিষয়টা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলাম। একজন অবিবাহিত ছেলের পক্ষে দু-দুটি বিবাহিত দম্পতির সঙ্গে সন্ধ্যা কাটানো যে কী গোলমেলে ব্যাপার। সম্পর্কের মাঝে যে সর্বক্ষণ অতৃপ্তির একটি চোরাস্রোত বইতে থাকে, সেটি সে ভালোমতো জানলেও তার সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে থাকে না।
এর পরে ওই সাঁকোর উপর দিয়ে বেশ ক-বার হেঁটে যাতায়াত করেছি। দিনের বেলা লোকজন মোটামুটি চলাফেরা করলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গেসঙ্গেই তা কমতে শুরু করে, দু-একটা যানবাহন হয়তো চলাচল করে আর কদাচিৎ কোনো পথচারী। অনেক নীচের নদীখাত থেকে কুয়াশা কুণ্ডলী পাকিয়ে জমাট বেঁধে সাঁকোর শেষপ্রান্তটা আচ্ছন্ন করে রাখে। এই সন্ধ্যা বেলায় সাঁকোর উপর দিয়ে হাঁটতে আমার বেশ লাগত, আসলে মনে মনে একটু আশা ছিল, গুলাবির আত্মাকে কোনোভাবে আবার দেখা যায়। আসলে তার মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিল। এখনও সে কি গল্পের মতোই সুন্দর, আকর্ষণীয়া?
কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার আগের সন্ধ্যায় যা ঘটল তা আমাকে বহু বছর তাড়া করে বেড়িয়েছে।
ফিরে আসার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল সবার মধ্যেই একটা চঞ্চলতা দেখা দিল। রায়দের মধ্যে ঝগড়া বন্ধ হয়ে গেল, তবে তারা নিজেদের মধ্যে খুব কমই কথা বলত। মিস্টার দত্ত দিল্লিতে নিজের অফিসে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আর মিসেস দত্তর বাতের ব্যথা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। আমারও মনটা অস্থির লাগছিল, বার বার মুসৌরিতে আমার লেখার টেবিলের সামনে ফিরতে চাইছিল।
সেই অভিশপ্ত সন্ধ্যায় ভাবলাম, শেষবারের জন্য সাঁকোর উপরে একটু ঘোরাঘুরি করে আসি, পাহাড়ে গ্রীষ্মরাতের ঠান্ডা মনোরম বাতাস বইছিল। সেদিন চাঁদ ওঠেনি, ঘন অন্ধকার গিলে নিয়েছে চারপাশ। কিছু ক্ষীণ আলো আছে বটে সাঁকোর দু-প্রান্তে, যারা সাঁকো পার হবে তাদের যাতে কোনো অসুবিধে না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা।
আমি সাঁকোর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার সেখানে, শুধু নীচের খাত থেকে প্রচণ্ড নদীগর্জন শুনতে পাচ্ছি। ঠিক তখনই দেখলাম, ল্যাম্পের আলোর বৃত্তের মধ্য থেকে শাড়ি পরা কে একজন এগিয়ে এসে রেলিং এর দিকে এগোতে লাগল।
কিছু না ভেবেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘গুলাবি।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন