রানিকে মারল কে?

রাস্কিন বন্ড

রানিকে মারল কে?

ইনস্পেকটর কিমাত লালকে প্রথম দেখি কিছু বছর আগে। তখন থাকি উত্তর ভারতের সমতলভূমি শহর শাহপুরে, ভয়ানক গরম আর কী অপরিচ্ছন্ন, শ্রীহীন সে-শহর তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। আমার ঠাকুরদা এককালে সে-শহরে একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন আর শহরের প্রান্তে তাঁর বেশ কিছু জমিজায়গাও ছিল। তাঁর চলে যাওয়ার পরে সেসমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়ে বসলাম আমিই। কিন্তু মুশকিল হল, শহরতলির সেই জমির দাম সেসময় পড়তির দিকে আর ওই বাড়ির উপরেও কোনো টান ছিল না আমার, তাই বিক্রি করব কি না তা নিয়ে বেশ ধন্দে পড়লাম। এরপর যা হয়, এলাকার কিছু দালাল হালকা উৎসাহ দেখাল, তাই দেখে ভাবলাম কয়েক মাস শাহপুরে থেকেই যাই।

কিমাত লাল ছিলেন সে-শহরের লোকাল থানার আইসি। বিশাল বপু, মন্থর গতি, যেন চলাফেরাতেই তাঁর খুব কষ্ট, অলস প্রকৃতির মানুষ যেমন হয় আর কি। কিন্তু এদিকে বেশির ভাগ অলস মানুষের মতো তিনি মাথায় বেশ বুদ্ধিও ধরেন। তবে তাঁর কর্মজীবনে ভদ্রলোক বিশেষ উন্নতি করতে পারেন নি, মোটামুটি ব্যর্থই বলা যায়। বহু বছর ধরে সেই ইনস্পেকটই রয়ে গেলেন, আর এখন তো প্রমোশনের সব আশা ছেড়ে দিয়ে মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলতেন, ভাগ্যদেবী সবসময়ই তাঁর প্রতি বিরূপ থেকেছেন। ভদ্রলোকের একটাই আক্ষেপ, তাঁর পুলিশ হওয়াটাই উচিত হয়নি। মকর রাশিতে জন্মেছেন কিনা, রেস্তরাঁর ব্যাবসাই খোলা উচিত ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বিলম্বে বোধোদয় যাকে বলে আর কি।

ইনস্পেকটর এবং আমার মধ্যে দৃশ্যত তেমন মিল ছিল না বললেই চলে। সেসময় ওঁর বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশের কোঠায় আর আমার সবে ত্রিশ। ভদ্রলোক কদাচিৎ বইপত্তর ঘাঁটাঘাটি করতেন, তাই আমার লেখা নিয়ে ওঁর বিশেষ কোনো উৎসাহ দেখিনি। কিন্তু আর পাঁচটা গ্রামের ছেলের মতো ছোটোবেলা থেকেই তিনি নানা রূপকথা বা উদ্ভট সব কল্পনার আবহে বেড়ে উঠেছেন। আর সেজন্যই বোধ হয় তিনি গল্প শুনতে যতটা পছন্দ করতেন ঠিক ততটাই পছন্দ করতেন মজার মজার গল্প শোনাতে।

আমরা দু-জনে পরস্পর মোটামুটি ইংরেজিতেই কথাবার্তা সারতাম, তবে শাহপুরে খুব বেশি লোকের পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না। সেইসঙ্গে আমরা দু-জনেই আবার বিয়ারের একনিষ্ঠ ভক্ত। কারণ সে শহরে বিনোদনের খুব একটা সুযোগ ছিল না আর আবহাওয়াও সাংঘাতিক গরম, পুব দিক থেকে পাক খেয়ে আসা ধুলোর ঝড়, তার সঙ্গে মশা, মাছির ভয়ানক উৎপাত আর চারপাশে যেদিকেই চোখ যায় শুধু একঘেয়ে জীবনপ্রবাহ—আসলে স্বাদহীন, বাসি লেবুর শরবতের চেয়ে তৃপ্ত মনে উদরপূর্তির জন্য ব্যাকুল হওয়াটা একজনের পক্ষে খুব স্বাভাবিক।

শাহপুরে তখন কিছু কিছু নিয়ম চালু ছিল, যেমন তুমি সবার সামনে পাবলিক প্লেসে ড্যাং ড্যাং করে মদ গিলতে পারবে না, খেতে হলে বাড়িতে বসে দরজা-জানালা এঁটে যত ইচ্ছে খাও, কেউ বারণ করবে না। এটাতে আবার কিমাত লালের একটু অসুবিধেই হত। কারণ তাঁর বউয়ের এই পানাসক্তিতে প্রবল আপত্তি, সটান জানিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে যেন একটা বোতল না ঢোকে। আবার একজন পুলিশ ইনস্পেকটর হয়ে বন্ধুবান্ধব, চেনাজানা মানুষজনের বাড়িতে গিয়ে মদ খেয়ে আসাটা মোটেই ভালো দেখায় না, তার উপরে সেই বন্ধুবান্ধবদের বেশিরভাগই ছিলেন লোকাল কাউন্সিলর বা ব্যবসায়ী যাঁরা নিজেরাই প্রায়ই নানান কেসে ফেঁসে থাকতেন। অগত্যা বাকি রইলাম আমি, নিতান্তই একজন বহিরাগত যার সঙ্গে শাহপুরের বিশেষ কোনো যোগাযোগ নেই আবার এলাকার কোনো ঝুটঝামেলাতেও আমি নেই।

এর সঙ্গে উপরি, আমার বাড়িটা শহরের একদম প্রান্তে, সেখানে তাঁকে চট করে বিরক্ত করারও কেউ নেই। সপ্তাহে দু–তিনদিন সন্ধ্যাবেলা, আকাশে মেটে রং ছড়িয়ে সূর্য যখন প্রায় ডুবতে বসে, উঁচু ছাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঠাণ্ডা ঘর থেকে যখন মোটামুটি নিরাপদে বেরিয়ে আসা যায়, ঠিক তখনই ইনস্পেকট কিমাত লালের আবির্ভাব হত আমার বাড়ির দরজার বাইরে। দরজায় টোকা পেলে তা খুললেই দেখব বাইরে একটা তোয়ালে দিয়ে ভদ্রলোক অবিরত মুখের ঘাম মুছে চলেছেন, রুমালের বদলে উনি ওটিই ব্যবহার করতেন কিনা। আর আমি ততক্ষণে দিনের দ্বিতীয়বার স্নান সেরে, পরিষ্কার একটা জামা গায়ে গলিয়ে বারান্দায় তাঁর সঙ্গে পানাহারে যোগ দিতাম। আমার একমাত্র চাকর, পুলিশের বড়োকর্তাকে সেবা করার আশায় যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে এক ছুটে দুটো গ্লাস, একটা বাকেট ভরতি বরফের কুচি আর বেশ ক-টা গোল্ডেন ইগল ব্র্যান্ডের বিয়ারের বোতল এনে হাজির করত।

এমন এক সন্ধ্যায় কিমাত যখন গোন্ডেন ইগলের চার নম্বর বোতলটি ধরেছেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই চাকরিজীবনে নিশ্চয়ই কিছু তো ইন্টারেস্টিং কেস পেয়েছেন, বড়োবাবু?’

‘বেশিরভাগই গড়পড়তা, বলার মতো নয়, মিস্টার বন্ড,’ তিনি বললেন, ‘আমি যেসব কেসে সাফল্য পেয়েছি সেগুলির কোনোটিই খুব উত্তেজক এটা বলতে পারি না। আর স্পর্শকাতর কেসগুলি সল্্ভই করা যায়নি নইলে অ্যাদ্দিনে সুপারিনটেন্ডেন্ট হয়ে যেতুম। লেখক তো, তাই বোধ করি তুমি খুনের কেসের ব্যাপারে জানতে চাইছ। আচ্ছা, তোমার মনে আছে ঘটনাটা, সেই যে নিজের ঘরেই এক মন্ত্রী খুন হয়ে গেলেন? আমি ওই তদন্তের দায়িত্বে ছিলুম। কিন্তু পলিটিকাল মার্ডার, যা হয়, কেসটার সুরাহা করা গেল না, শেষে ধামাচাপা পড়ে গেল।’

‘যে কেস সল্্ভ করেছেন তার সম্বন্ধেই বলুন না হয়, রোমাঞ্চকর কোনো,’ আমি বললাম। কিন্তু বড়োবাবু দেখলাম একটু অসোয়াস্তি বোধ করছেন। তাই আবার বললাম, ‘আপনার চিন্তার কিছু নেই বড়োবাবু, মদ খেলেও আমি এমনিতে খুব সতর্ক থাকি।’

‘কিন্তু তুমি এত সতর্ক থাকো কীভাবে? তুমি তো লেখক।’

আমি এর প্রতিবাদ করে বললাম, ‘লেখকরা এমনিতে সতর্ক এবং বিচক্ষণ স্বভাবেরই হয়। শুধু লেখার সময় তারা লোকজন এবং জায়গার নাম পরিবর্তন করে নেয়।’

বড়োবাবু একটু অবজ্ঞার হাসি হাসলেন। বললেন, ‘আচ্ছা ধরো, যদি এই আমাকেই তোমার বইয়ের চরিত্র বানাও তবে কীভাবে বর্ণনা করবে?’

‘ওহ, আপনি যেমন তেমনই রাখব,’ আমি হেসে বললাম, ‘যদিও আপনার কাজকম্মে কেউ বিশ্বাস করবে না।’

শুনি তিনি হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়েন আর কি, তারপর গ্লাসে আরও বিয়ার ঢাললেন।

‘নাম-টাম কিন্তু আমিও পরিবর্তন করে দিতে পারি... ঠিক আছে, আজ তোমাকে একটা দারুণ রোমাঞ্চকর কেসের ব্যাপারে বলব। এক্ষেত্রে শিকার যেমন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, শিকারিও তেমনি। সাধারণত শিকারের চরিত্র বা প্রকৃতিই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়ে থাকে। আর খুনি যেমন হয়, আর পাঁচজন মানুষের মতো, লোভী, হিংসুটে, প্রতিশোধপরায়ণ। কিন্তু তোমায় প্রতিজ্ঞা করতে হবে এ গল্প তুমি আর কাউকে বলবে না।’

‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি,’ জেনেশুনে মিথ্যে বললাম যদিও।

‘মুসৌরি চেনো?’

‘হিল-স্টেশন? হ্যাঁ, ছোটোবেলায় ওখানেই ছিলুম তো। ভালোমতোই চিনি।’

‘বেশ, এটা প্রায় তিনবছর আগের ঘটনা, তখন ওই মুসৌরিতে সবে এসেছি।’

এরপর প্রায় ঘণ্টা দুই ধরে অস্পষ্ট, দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে তিনি কেসটা বর্ণনা করলেন। আর মাঝে মধ্যেই চলতে লাগল দু-পক্ষের বিয়ারে চুমুক। শুনে আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই দারুণ রোমাঞ্চকর একটা গল্পই বটে, কারণ এ ঘটনায় কিমাত লালের চরিত্রের অনেক অজানা দিক সামনে বেরিয়ে এসেছিল।

 

ইনস্পেকটর কিমাত লালের তখন ডিউটি অফ। অর্থাৎ হিমালয়ের পাহাড়ি হোটেলের বারগুলিতে বেশ আরামেই তাঁর দিন কাটছে, কোনো ঝুটঝামেলা নেই, বেশ সন্ধ্যাবেলা হলেই টুক করে এসে হালকা জল মিশিয়ে ব্র্যান্ডিতে চুমুক। তাঁর মনে হল, সারাদিন যেভাবে একের পর এক খুচরো উৎপাত হয়েছে, তার প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে তাঁর তো অন্তত তিনটে ব্র্যান্ডির বোতল লাগবেই। এদিকে ট্রান্সফারের আবেদনও পত্রপাঠ খারিজ হয়েছে। প্রোমোশনের আশা তো ছেড়েই দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর বার বার মনে হয়, ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারগুলিতে যেসব উপরতলার কর্তারা আছেন তাঁরা তাঁকে এমন কোনো জেলায় পোস্টিং দেবেন যেখানে অন্তত কিছু তদন্তযোগ্য ঘটনা ঘটে। এটা সত্যি যে তিনি মুসৌরিতে তিন মাস ছিলেন, কিন্তু সেই তিন মাস যদি সমতলের ওইরকম বড়োসড় শহরে থাকতেন, তবে তার মধ্যেই অন্তত তিনটে খুন, ডজনখানেক ডাকাতি, কতকগুলি হামলা এবং বেশ ক-টি ৪২০ কেসের তদন্তে নামতে হত। শেষ যে অপকর্মটির কথা বললাম সেটা সম্বন্ধে জানিয়ে রাখি, বিভিন্ন ধরনের ঠগবাজি আর ছ্যঁাচড়ামিকে সবাই ‘৪২০’ বলে থাকে। আসলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ওই ধারাতেই এই ধরনের অপরাধের বিচার করা হয় কিনা।

কিন্তু এই অদ্ভুতুড়ে পাহাড়ি রিসর্ট, সি-লেভেল থেকে প্রায় ছ-হাজার ফুট উঁচুতে জায়গাটা—এই তিন মাসে সেখানে না কোনো খুন, না কোনো ডাকাতি, আর না আছে কোনো হামলার খবর, শুধু কয়েকটা হাতে গোনা চিটিংবাজির কেস।

তবে বেশ কয়েক জোড়া চুরির কেসও ছিল। সবচেয়ে মজাদার কেসের আসামি ছিল একজন ভবঘুরে হিপি, ব্যাটার নেশা ছিল ভিক্টোরিয়ান আমলের ‘চেম্বার পট’ (শোয়ার ঘরে রাখা শৌচকর্মের পোর্টেবল কমোড) চুরি করে বেড়ানো। তখনও মুসৌরির পুরোনো বাড়িগুলিতে ওই ধরনের পাত্র কিছু কিছু পাওয়া যেত। সে ওইগুলি চুরি করে নিজের লাভের অংশ রেখে দিল্লির এক অ্যান্টিক ডিলারের কাছে বেচে দিত।

ওহ! আরেকটা কাহিনি আছে বই কী, বইচোরের কাহিনি। কিমাত লালও প্রায় তাকে ভুলেই গিয়েছিলেন। অবিশ্যি মনে থাকার কথাও নয়, কারণ ঘটনাটা তিনি এ শহরে আসার আগের, আর সে-ব্যাপারে তাঁর তেমন কিছু করারও ছিল না। একবার হঠাৎই বইপড়ুয়া এক ভদ্রলোক এলাকার একেবারে অবহেলিত, অনেক পুরোনো লাইব্রেরিটিতে আসতে শুরু করলেন। সে লাইব্রেরির সাকুল্যে জনা পনেরো সদস্য, আবার তারাও কালেভদ্রে আসতেন সেখানে। হল কী, দুম করে সেই সংগ্রাহক ভদ্রলোক প্রায় এক-শোর উপরে বই নিয়ে মুসৌরি থেকে হাওয়া হয়ে গেলেন। সবাই অবাক! লোকটি এই না-পড়া, মূল্যহীন বইগুলি নিয়ে পালাল কেন? কীসের এত আগ্রহ? কিন্তু পরে পুরসভা কর্তৃপক্ষ সব দেখে প্রায় আঁতকে উঠলেন। বর্ষাকালের ঝিমুনি কাটিয়ে নড়েচড়ে উঠে তাঁরা আবিষ্কার করলেন, সেই বইচোর ‘প্লেইন টেলস ফ্রম দ্য হিলস’, টেনিসনের কবিতার সংকলন, ‘মেমরিজ অব ফ্যানি হিল’-এর গোড়ার দিকের পাইরেটেড সংস্করণ এবং অন্যান্য বিবিধ সাহিত্য সম্পদ লন্ডনের নিলামে বেচে প্রচুর টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। পুরসভা তখন বইচোরের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া বাকি বইয়গুলির কেমন কী মূল্য জানার জন্য আবার এক বই বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠালে। কিন্তু দেখা গেল, মুল্যবান যা কিছু ছিল সবই সে সংগ্রাহক ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই হাপিস করে দিয়েছিলেন।

কিমাত লাল গ্লাসটা খালি করে আরেকবার ব্র্যান্ডি আনতে বললেন। ওয়েটার ছেলেটি তা আনতে গেলে ইনস্পেকটর বিরস বদনে জানলার বাইরে চেয়ে রইলেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, তীব্র বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির ফোঁটা জানলার শার্সি ছুঁয়ে যাচ্ছিল। যদিও সেটা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়, তুষারপাতের আর সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু আবহাওয়া তখনও ভীষণ ঠান্ডা। তাই কিমাত লাল মাফলার আর উলের হাতমোজা আর খোলেননি। হোটেলের ‘কানাডিয়ান স্টোভ’-এর কল্যাণে ভালোই ঊষ্ণতা পাওয়া যাচ্ছিল। বাড়িতে থাকলে তো ওঁকে চারকোল ব্রেজিয়ারেই হাত গরম করতে হত আর উদরকে স্বস্তি দিতে ব্র্যান্ডিও মিলত না। এমনকি পাহাড়ের মাথায় গেলেও ওঁর বউ মদ ছুঁতে দেবেন না।

দ্বিতীয়বার ব্র্যান্ডি-তে চুমুক দিতে যাবেন এমন সময় কিমাত লাল লক্ষ করলেন, স্টুয়ার্ড খালি লাউঞ্জ পেরিয়ে তাঁর টেবিলের দিকেই আসছে। ব্যস হয়ে গেল! বিপদ আসন্ন। ভাবতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। ঘরে তো তিনি বাদে আর কেউই নেই। এপ্রিলের আগে মুসৌরিতে পর্যটকরা সাধারণত আসে না। তাই তিনি বুঝে গেলেন, তাঁর সুখের বারোটা বাজতে যাচ্ছে।

‘এক্সকিউজ মি, একটু বিরক্ত করছি,’ স্টুয়ার্ডটি এসে জানাল, বয়স বেশি না ছেলেটার, খবর দিল, ‘বাইরে একজন অপেক্ষা করছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’

‘তুমি তাকে বলেছ আমি এখানে আছি?’ কঠোর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন ইনস্পেকটর কিমাত লাল।

‘মনে হল, তিনি জানতেন যে আপনি এখানেই থাকবেন, স্যার।’

‘হোয়াই ডোন্ট ইউ টেল হিম টু গো টু হেল?’

‘আমি বলেছি, কিন্তু তিনি নাছোরবান্দা। রানিমার বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে মনে হয়।’

‘রানিমার বাড়ি? মুসৌরিতে কোনো রানিমা আছেন বলে তো আমার জানা নেই।’

‘তাঁকে সবাই চেনেন, স্যার।’

‘ও, বোধ হয় ওঁর চেম্বারপট খোয়া গেছে। গিয়ে বলো দোষীকে আমরা ধরেছি আর রানিমা খুব তাড়াতাড়ি ওঁর কমোড ফেরত পেয়ে যাবেন।’

‘স্যার, আমার মনে হয়, ঘটনাটি আরও গুরুতর। লোকটা বিড়বিড় করে কী যেন খুন, রক্তর কথা বলছিল। পুরোপুরি তার কথা বুঝতে না পারলেও বুঝলাম যে লোকটা বেশ ভয় পেয়ে আছে।’

কিমাত লাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে করুণ দৃষ্টিতে তাঁর ব্র্যান্ডির গ্লাসের দিকে একবার তাকালেন, তারপর ঢকঢক করে এক চুমুকে সেটা শেষ করে দিলেন। এরপর আস্তে আস্তে উঠে পড়লেন একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে, মন ভারী হয়ে এসেছে। দীর্ঘ দেহ তাঁর, দশাশই চেহারা, বেল্টের উপর ভুঁড়ি ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে— এরপর ধীরে ধীরে ভারী পদক্ষেপে হোটেলের মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন ইনস্পেকটর লাল।

দরজার সামনে আসতেই একদমক বরফঠান্ডা বাতাস তাঁর মাথার ছোট্টো উলের টুপিতে প্রবল ধাক্কা দিল, মনে হল মাথার চাঁদি জমে গেল সেই মুহূর্তে।

‘অ্যাই, কী হয়েছে?’ প্রচণ্ড রেগে কিমাত লাল জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর চোখ জ্বলছে। কালো চেহারার বুনোমতো একটা লোক সে মূর্তি দেখে ঠকঠক করে কাঁপছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

‘সেলাম। ইনস্পেকটর সাহেব। ওপরওয়ালা মাফ করবেন, এই সময়ে আপনাকে বিরক্ত করছি, কিন্তু ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। রানিমা খুন হয়েছেন। আমি নিজের চোখে তাঁর লাশ দেখেছি, তিনি আমাকে ময়দা আর চিনি আনতে বলেছিলেন, বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি সর্বনাশ হয়েছে।’

কিমাত লাল অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে ছিলেন। মুসৌরির আবহাওয়ার সঙ্গে এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ঠিক খাপ খায় না।

‘তুমি নিশ্চিত, তিনি মারা গেছেন?’

‘নিশ্চিত, হুজুর, এই আমি যেমন জ্যান্ত আছি, এটা যেমন জানি ঠিক তেমনি। কপালে কোপ দিয়েছে একেবারে, চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত।’

চিত্ত চঞ্চল হলে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না কিমাত লাল। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কতদূর তোমার রানিমার বাড়ি?’

‘আধ মাইলটাক তো হবেই।’

‘এসো আমার সঙ্গে। যা যা হয়েছে সব খুলে বলবে পথে। আপাতত বলো কেন খুন করলে তাঁকে?’

লোকটা সঙ্গেসঙ্গে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। অস্ফুটে তাঁর ঠোঁট নড়তে লাগল, দু-চোখে ভয়ের মেঘ ঘনিয়ে এল। কিমাত লাল দেখলেন, সে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে তাঁর হাতের উপর ঢলে পড়ে আর কি। তাই লোকটাকে অভয় দিয়ে বললেন,

‘আরে, কিছু মনে কোরো না, এমনি জিজ্ঞাসা করলাম, অবশ্যই তুমি কিছু করোনি। চলো এবার। তোমার নামটা যেন কী?’

‘ছোটে লাল, সাহেব। মা কসম, আমি রানিমাকে মারিনি।’

এবার বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হবে তাদের। এই প্রত্যন্ত এলাকায় গাড়ি নিয়ে চলাও মুশকিল। রাস্তা একেবারেই মোটর গাড়ি চলার উপযুক্ত নয়। থানায় একটা সাইকেল আছে বটে, কিন্তু সেটা নিয়েও মূল রাস্তা থেকে নির্দিষ্ট কিছুটা দূরত্ব অবধিই যাওয়া যায়, প্রত্যেক হিল স্টেশনে যাকে সবাই ‘মল’ বলে। একটা টাট্টু ঘোড়া নেওয়াই যেত, কিন্তু স্থানীয় টাট্টু বড়োবাবুকে নিয়ে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছোতে পারবে কি না খুব সন্দেহ। আর তিনি আবার ওই টাট্টুতে চড়তে স্বচ্ছন্দ নন একেবারেই। একটা ঘটনা বেশ মনে পড়ে। কিমাত তখন মুসৌরিতে প্রথম এসেছেন পোস্টিং নিয়ে। তা একদিন ওরকম একটি টাট্টুর পিঠে চেপে চলেছেন মলের দিকে। দেখে মনে হচ্ছিল সারা রাস্তা যেন জগিং করতে করতে যাচ্ছেন তিনি। বাজারের লোকজন মুখ চেপে হাসছিল কিন্তু ছেলেপিলের দল কি অত রাখঢাক করতে পারে? হো হো করে তাদের কী হাসি। এই দৃশ্য দেখে রাস্তায় যেন চাপা হুল্লোড় উঠল, কেউ আবার এর মধ্যে শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘ঘোড়ার পিঠে তরমুজ দেখেছ নাকি ভায়া কখনো?’

উদবিগ্ন , ভীত সংবাদদাতার সঙ্গে এক ছাতার তলায় হেঁটে কিমাত লাল পৌঁছোলেন থানায়, সেখানে টিমটিমে আলো জ্বলছে। নাইট ডিউটিতে দু-জন কনস্টেবল ছিল—শান্ত রাম আর গোবিন্দ সিং। দু-জনেই যখন চাকরিতে ঢুকেছে, তখন তাদের অভাবের সংসার, ধাপ কাটা ছোটো জমিতে চাষ করে তা আর চলছিল না। ইনস্পেকট দেখলেন, গোবিন্দ সিং ততক্ষণে খাটিয়ায় শুয়ে কম্বলের তলায় ঢুকে গেছে। শান্ত রাম ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে—ঢ্যাঙা বিবর্ণ চেহারা, বয়স আন্দাজ ত্রিশের কাছাকাছি, ফুটন্ত কেটলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

‘আরে, ইনস্পেকটর সাহেব,’ সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আসুন আসুন, এক কাপ চা খান।’ শুধু চা পেলে শান্ত রামের আর কোনো অভিযোগ নেই। কিমাত লালের আবার চায়ের অমন নেশা নেই।

‘চা-টা পরে হবে,’ কিমাত লাল বলেন, ‘এই মুহূর্তে তোমাকে আমার দরকার। রানির বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে। ছাতা নিয়ে আমার সঙ্গে এসো।’

‘হ্যাঁ স্যার,’ বলে শান্ত রাম কেটলির দিকে একবার বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তার মনে হচ্ছিল, সাহেব আর সে একসঙ্গে চা-টা খেয়ে বেরোলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত? এত তাড়া কীসের বাপু? মুসৌরিতে কেউ হুড়োতাড়া করে না। এমনকী মড়াও পোড়ানো হয় হাতে সময় নিয়ে হেলেদুলে, বিশেষত এই শীতকালে। আর এক গ্লাস মিষ্টি চা খেলে যেকোনো কাজের দক্ষতা কিংবা উৎসাহ বাড়ে বই কী। প্রতিদিন কমপক্ষে ছ-গ্লাস কড়া চা শান্ত রামের খেতেই হবে।

কিন্তু বড়োবাবু বাইরে বৃষ্টিতে অপেক্ষা করছেন, তাই তার যেতেই হবে এখন...

পথে কিমাত লাল আরেকবার থামলেন, ডাক্তার গুলাটির ক্লিনিক। পুলিশের যত ময়নাতদন্তের কাজ সব এই ডাক্তার গুলাটিই করে থাকেন। সেসময় তাঁর এক রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন, রোগীটি নিয়মিত আসেন তাঁর ক্লিনিকে। সব শুনে ডাক্তারবাবু কিমাতের সঙ্গে যাওয়ার জন্য সঙ্গেসঙ্গে প্রস্তুত হলেন। বেশ দৃঢ় মনোভাব আর একরোখা স্বভাব তাঁর। মুসৌরিতে বেশ ক-বছর আছেন। অনেক সময় তিন-চার মাইল দূরে রোগীদের বাড়িতে নিজেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন। কিমাত লালের সঙ্গে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন ডাক্তারবাবু।

চারজনে অন্ধকার পাথুরে পথ দিয়ে রানিমার বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন। একটা জোরালো বাতাস মাঝেমধ্যেই উঠছে আর বৃষ্টির ঝাপটা তাদের মুখে এসে লাগছে।

‘তিনি কীভাবে মারা গেলেন?’ ডাক্তার গুলাটি জিজ্ঞাসা করলেন। সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল টিম থেকে বছর পাঁচেক হল একরকম দুম করেই অবসর নিয়েছেন।

ইনস্পেকটর বললেন, ‘সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। দেহে এখনও প্রাণ থাকলে খুব অবাক হব না। এ লোকটা বলছে ও নাকি তাঁকে মেঝেতে মাথায় কোপ খাওয়া অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে।’

ডাক্তার গুলাটি তাঁর কোটের হাতাটা একটু টেনে ঘড়ির দিকে তাকালেন। তখন প্রায় ন-টা। একটা হাই তুলে তিনি বললেন, ‘আশা করি বেঁচেই আছে, তেমন কিছু হয়নি। ডিনারে আমার কিছু গেস্ট আসবে আবার।’

‘যা বলছেন, জ্বালাতনের শেষ নেই,’ কিমাত লাল বললেন, ‘কিন্তু ডাক্তারবাবু, আপনাকে দেখে খুব অবাক হয়েছেন বলে তো মনে হচ্ছে না। রানিমার কোনো শত্রু ছিল নাকি?’

‘শত্রু ছিল কি না বলতে পারি না, কিন্তু উনি খুব জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন না, এটুকু বলতে পারি।’

‘আপনি ওঁর ডাক্তার ছিলেন?’

‘একসময় ছিলাম। কিন্তু উনি একজন ডাক্তারে ভরসা রাখতে পারেন না, মাঝেমধ্যেই ডাক্তার পরিবর্তন করতেন। ওঁর মতো মহিলাকে সহজে সন্তুষ্ট করা যেত না। যদি রোগ নাও থাকে, আমাকে বলতে হবে রোগ আছে, নইলে খেপে যেতেন। ওঁর হার্ট সবসময়েই সুস্থ, কিন্তু সবাইকে বলে বেড়াতেন তা নাকি বেশ দুর্বল।’

‘এই রাজারাজড়ার পরিবার মানেই যাচ্ছেতাই সব ব্যাপার-স্যাপার,’ কিমাত লাল মন্তব্য করলেন।

‘আরে, উনি ওরকম কোনো রাজ্যের রানি ছিলেন না, কিন্তু নিজেকে সেরকমই দাবী করতেন। কোনো রাজপরিবারের সঙ্গে লতায়-পাতায় সম্পর্ক ছিল হয়ত, কিন্তু ভদ্রমহিলার পয়সা-কড়ি বিশেষ ছিল না বলেই মনে হয়। স্বামীটা অন্য মহিলাকে নিয়ে ভেগেছিল বছর আটেক আগে। যখন সেই লোক মারা গেল, তার টাকা-কড়ি, সম্পত্তি সবই পেল শেষমেশ ওই দ্বিতীয় স্ত্রী।’

অধ্যায় ১৯ / ১৯

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন