রাস্কিন বন্ড
আমার দিদা শেষমেষ তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন যে এ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ওঠা হবে।
কিছুই না, এসব বিড়ম্বনার জন্য দায়ী এক দুষ্টু ভূত যে বর্তমানে বাড়ির প্রত্যেকের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছিল।
ভূতেরা সাধারণ, পিপুল গাছে থাকতে ভালোবাসে, আর আমাদের বাড়ির ক্ষেত্রেও প্রথমটায় তাই হল। উঠোনের চারিদিকে যে পাঁচিল তারই গা ঘেঁষে আছে বহু পুরোনো এক পিপুল গাছ, পাঁচিলের এপাশটায় আমাদের বাগানের উপর আর ওইপাশে রাস্তার উপরে অনেকটা জায়গা জুড়ে সে ডালপালা বিস্তার করেছে।
বহু বছর ধরেই ভূতটা সেই গাছের উপরেই থাকত, অ্যাদ্দিন সে কাউকেই বিরক্ত করেনি। মনে হয়, রাস্তার গাড়িঘোড়া, মানুষজন নিয়েই মেতে ছিল। এই যেমন, রাস্তা দিয়ে হয়তো টাঙ্গা চলেছে, তখন দিলে সেই টাট্টুটাকে ভয় দেখিয়ে। ব্যস, টাট্টু বেচারা ভয়ের চোটে দিগ্বদিক শূন্য হয়ে এমন ছুট দিল যে টাঙ্গা প্রায় উলটে যায় যায়। মাঝে মাঝে বাস বা অন্যান্য গাড়ির ইঞ্জিনের ভেতরে সেঁধিয়ে যাবে আর কিছুক্ষণ বাদে সেই ইঞ্জিন বিকল করে ছাড়বে। আবার কোনো সময় সে সাহেবদের মাথা থেকে শোলাটুপি উড়িয়ে নিয়ে যেত। সাহেবরা তখন দেদার শাপশাপান্ত করছে আর অবাক হয়ে ভাবছে বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে আচমকা কোথা থেকে এমন বাতাস এল, আবার নিমেষে মিলিয়েও গেল। তবে ভূতটার উপস্থিতি সেসময় আমরা টের পেলেও বা মাঝেমধ্যে তার শব্দ-টব্দ পেলেও কোনোদিন তাকে চোখে দেখতে পাইনি।
রাতের বেলা মানুষজন পিপুল গাছের তলাটা এড়িয়ে যেত। লোকে বলত, যদি তুমি পিপুল গাছটার তলা দিয়ে যেতে যেতে হাই তোলো তবে সেই ভূতটা লাফ দিয়ে নিমেষে তোমার গলার মধ্যে ঢুকে পেটের গণ্ডগোল বাধিয়ে ছাড়বে। আমাদের মালী মনফুল প্রায়ই শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে ছুটি নিত আর তার পেটের গণ্ডগোলের সমস্ত দায় চাপাত ওই ভূতটার উপর। কোনো সময় হাই তোলার মুহূর্তে মনফুল হয়তো হাত দিয়ে মুখ চাপতে ভুলে গেছে, ব্যাস ভূতটা নাকি দিব্যি টুক করে মুখের ভেতর ঢুকে পেটে গিয়ে সেঁধিয়েছে।
কিন্তু ব্যাটা সেসময় আমাদের কোনো অনিষ্ট করত না, কিন্তু যেদিন পিপুল গাছটা কেটে ফেলা হল, সেদিন থেকেই শুরু হল তার দৌরাত্ম্য।
দোষটা আমাদের ছিল না একেবারেই; হ্যাঁ, এটা অবিশ্যি ঠিক, দাদু পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট বা পিডব্লিউডি-কে গাছটি কাটার অনুমতি দিয়েছিলেন, কারণ সেটি আমাদের জমির উপরেই ছিল। ওঁরা রাস্তাটা চওড়া করবেন, তাই যেহেতু গাছ আর আমাদের পাঁচিলের কিছুটা সে রাস্তার উপরেই পড়ে যাচ্ছিল তাই সেগুলিকে সরাতেই হত। যাই হয়ে থাক, এমনকি ভূতেরও পিডব্লিউডি-র সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা নেই।
কিন্তু তার পরে এক দিনও কাটেনি, আমরা আবিষ্কার করলাম ভূতবাবাজি তার গাছবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে আমাদের বাংলোয় ঠাঁই নিয়েছে।
আর একটি ভালো ভূতকেও তার অস্তিত্ব জানান দিতে দুষ্টু হতেই হয় কিনা, তাই এর কয়েকদিনের মধ্যেই টের পেলাম, অপদেবতাটি বাড়িতে ঢুকেই সব ধরনের অপকর্ম শুরু করেছে। যেই দিদা চশমাটা খুলে কোথাও রাখলেন, অমনি সে সেটা হাওয়া করে দিচ্ছে। না পেয়ে বিরক্ত হয়ে দিদা বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘ওটা ড্রেসিং টেবিলের উপরেই রেখেছিলাম, আমার বেশ মনে আছে।’
কিছুক্ষণ বাদেই দেখা গেল বারান্দার দেওয়ালে শোভিত স্টাফ করা বুনো শুয়োরের ছুঁচলো নাকের ডগায় চশমাটা বিপজ্জনক ভাবে আটকে আছে। বাড়িতে বাচ্চা ছেলে বলতে আমি একাই, তাই আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হল সেদিনের মতো। কিন্তু দু-এক দিন বাদে আবার যখন সেই চশমা হারিয়ে গেল আর বিস্তর খোঁজার পর শেষমেষ দেখা গেল সেটি টিয়াপাখির খাঁচার শিকে দোল খাচ্ছে, তখন সবাই মেনে নিলেন, বাড়িতে নির্ঘাত আরও একজন কেউ আছে যে এই কাণ্ডগুলি ঘটাচ্ছে।
এরপরে শুরু হল দাদুর দুর্ভোগ। একদিন সাতসকালে বাগানে গিয়ে আবিষ্কার করলেন, তাঁর সাধের সুইটপি ফুল কেউ ছিড়ে কুটি কুটি করে মাটিতে ছড়িয়ে রেখেছে। কেন মামা বললেন, বুলবুলিতে ফুল তছনছ করেছে, কিন্তু আমাদের কারোরই মনে হল না যে অত সকালে বুলবুলির দল এসে এমন নির্মমভাবে সমস্ত কুড়ি নষ্ট করে গেছে।
এবার কেন মামার ভোগান্তি শুরু হল। মামা রাতে অঘোরে ঘুমোন। আর একবার বিছানায় গেলে, তারপর ঘুম থেকে উঠতে গেলেই তাঁর মহা বিরক্তি। তাই সেদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে তিনি আসতেই যখন দেখলাম তাঁর অবস্থা শোচনীয়, চোখ প্রায় টেনে মেলতে পারছেন না, আমরা জানতে চাইলাম তাঁর শরীর-টরির সব ঠিকঠাক কি না।
‘আমি কাল সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি,’ তিনি অভিযোগ করলেন, ‘যখনই ঘুমটা আসছে, বিছানার চাদরটা যেন কেউ টেনে নিচ্ছে। কতবার যে জেগে উঠে শুধু মেঝে থেকে চাদরটা তুলে আনতে হয়েছে ইয়ত্তা নেই!’ তারপর আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে ছোকরা, কাল রাতে তুমি কোথায় ঘুমিয়েছ অ্যাঁ?’
‘দাদুর ঘরে,’ আমি বললাম।
‘ঠিকই,’ দাদু বললেন, ‘আর আমার ঘুম পাতলা। ও যদি ঘুমের মধ্যে হাঁটত আমি ঠিকই জেগে যেতাম।’
‘এটা ওই পিপুল গাছের ভূতটার কান্ড,’ দিদা স্পষ্ট বললেন, ‘ব্যাটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেছে। প্রথমে আমার চশমা, তারপর সুইটপি ফুল আর এখন কেনের বিছানার চাদর। এরপরে সে যে কী ঘটাবে, আমি ভেবে উঠতে পারছি না!’
আর বেশিদিন অবিশ্যি ভাবতে হল না আমাদের। এক সপ্তাহ কাটল নানান দুর্বিপাকে। ফুলদানি টেবিল থেকে পড়ে যাচ্ছে, দেওয়ালে টাঙানো ফটো দুম করে পড়ে যাচ্ছে, টি-পটে টিয়াপাখির পালক ভেসে উঠছে, মাঝরাত্তিরে সেই টিয়া আবার রেগেমেগে কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠছে, আবার বলা কওয়া নেই, বন্ধ জানালা খুলে যাচ্ছে আপনা-আপনি, আবার খোলা জানলা একা একাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে— সে বিশ্রী কাণ্ড বটে। সেদিন আবার কেন মামা দেখলেন তাঁর বিছানায় কাকের বাসা পড়ে আছে, তারপর যেই না সেটা নিয়ে জানালার বাইরে ফেলতে গেছেন অমনি কোথা থেকে দুটো কাক এসে তাঁকে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করল।
এরপর যেদিন ম্যাবেল মাসি থাকতে এলেন, অবস্থা আরো গুরুতর হল। ভূতটার বোধ হয় ওঁকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়নি। ভদ্রমহিলা সবসময়ই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকেন আর থেকে থেকেই অযথা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আর দুষ্টু ভূতগুলোর এমন শিকারই পছন্দ, একেবারে ঠিকঠাক। দেখা গেল তাঁর টুথপেস্টের টিউবের সঙ্গে দাদুর দাড়ি কাটার ক্রিমের টিউবের অদলবদল হয়ে গেছে। এরপর মাসি যখন মুখ ভরতি ফেনা নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন আমরা পালিয়ে বাঁচি আর কি। দাদু চেঁচিয়ে উঠলেন যে নির্ঘাত মাসিকে পাগলা কুকুরে কামড়েছে।
দু-দিন যেতে না যেতেই মাসি এসে অভিযোগ করলেন তাঁর নাকে কে যেন মুসুম্বি লেবু ছুড়ে মেরেছে। লেবুটা ছিল রান্নাঘরের তাকে, সেখান থেকে কীভাবে যেন ছুটে এসে ঘর পার করে সোজা মাসির নাকেই ঢুঁস দিয়েছে। সে-নাকে কালশিটে পড়ে ফুলে উঠেছে, অর্থাৎ অভিযোগ মিথ্যে নয়।
‘আমাদের এ বাড়ি ছাড়তেই হবে,’ দিদা চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘বেশিদিন যদি এখানে থাকি তবে কেন আর ম্যাবেলের মাথার ব্যামো দেখা দেবে আমি নিশ্চিত।’
‘আমার তো মনে হয় ম্যাবেল মাসির সেটা অনেক দিন আগে থেকেই দেখা দিয়েছে,’ আমি বললাম।
‘গুরুজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভ্যাসটা তোমার গেল না দেখছি,’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে মাসি পাশ থেকে বললেন।
‘যাই হোক, বাড়ি পালটানোর প্রস্তাবে আমার আপত্তি নেই,’ আমি মৃদু সুরে বললাম। ‘হোম-ওয়ার্কও তো করতে পারছি না আমি। কালির বোতল সবসময়ই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে যে।’
সঙ্গেসঙ্গে কেন মামা চেঁচিয়ে উঠে অভিযোগ করলেন, ‘আরে, গতরাতে আমার সুপে দেখি কালি ভাসছে।’
‘আমাদের অন্যত্র যেতেই হবে মনে হচ্ছে,’ দাদু বলে উঠলেন, ‘কয়েক মাস গেলেই ভূতটাও ততদিনে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। বার্লোগঞ্জে আমার ভাইয়ের বাড়ি। আগামী কয়েক মাস সে ওই বাড়িতে থাকবে না। তাই সামনের সপ্তাহে সে-বাড়িতেই উঠব আমরা।’
অগত্যা আমরা গৃহত্যাগের প্রস্তুতি শুরু করলাম, এর মধ্যেই কেটে গেছে আরও কয়েকটা দিন আর ঘটে গেছে কিছু আকস্মিক দুর্বিপাক।
যে গোরুর গাড়িতে খাটপত্তর ও অন্যান্য আসবাব কিংবা ভারী মালপত্তর ছিল সেটাকে সবার প্রথমে রাখা হল। ওদিকে আমাদের পুরোনো ফোর্ড গাড়িটার মাথায় স্তূপীকৃত হয়ে আছে ভারী ভারী ব্যাগ আর রান্নার বাসন-কোসন— আর দাদু স্টিয়ারিং ধরলেন।
তখন গাড়িতে বসে সবে গেট পার করেছি কি করিনি, অকস্মাৎ একটা অদ্ভুত আওয়াজ পেলাম, আওয়াজটা আসছে গাড়ির মাথা থেকেই। কেউ যেন আপন মনে খিল খিল করে হাসছে আর কথা বলছে।
‘টিয়াপাখিটা কি মালপত্তরের রাকে নাকি হে?’ দাদু শুধোলেন।
‘না তো,’ ঠাকুমা বললেন, ‘ও তো মনফুলের সঙ্গে গোরুর গাড়িতে আছে।’
সন্দেহ হওয়াতে দাদু গাড়ি থামিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে আসলেন, তারপর গাড়ির ছাদে শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলেন।
‘কই কিচ্ছু নেই তো এখানে,’ বলে তিনি আবার গাড়িতে ঢুকে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন, ‘আমার মনে হল যেন, টিয়াপাখিটা কথা বলছে।’
গাড়ি তখন বিশ গজ রাস্তা পেরিয়েছে, এমন সময় গাড়ির মাথায় আবার শুরু হল সেই খলখল হাসির শব্দ, আর তারপরেই স্পষ্ট শুনতে পেলাম শুদ্ধ হিন্দিতে কেউ খুব ক্ষীণ স্বরে কিচমিচ করে কথা বলে চলেছে। আমরা সবাই শুনতে পেলাম সেই কথা, আর তখুনি জলের মত সব পরিষ্কার হয়ে গেল আমাদের কাছে। সেই বদমাশ ভূতটা গাড়ির ছাদে আপন মনে বকবক করছে। উত্তেজনায় সহর্ষে সে বলছে,
‘চলো, নতুন ঘর, নতুন বাড়ি! আহা কী আনন্দ! কী মজা হবে!’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন