রাস্কিন বন্ড
তখন উত্তরপ্রদেশের শাহগঞ্জ জেলা থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরের একটি গ্রামে আমি। যাতায়াতের মাধ্যম বলতে শুধু একটি সাইকেল। শাহগঞ্জে পৌঁছোতে কোনো সহৃদয় চাষির গোরুর গাড়িতে উঠে পড়াই যেত, কিন্তু আমি দেখলাম সাইকেলে ব্যাপারটা একটু তাড়াতাড়ি মিটে যাচ্ছে, যদিও রাস্তার অবস্থা ভয়ানক আর সাইকেল চালানোয় আমি একেবারেই আনাড়ি। আমি প্রায় প্রতিদিনই শাহগঞ্জ যেতাম, চিঠিগুলো সংগ্রহ করতাম, একটা খবরের কাগজ কিনতাম, কাপের পর কাপ গরম চা খেতে খেতে খেতে দোকানদারদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা, এই ছিল আমার রুটিন। তারপর সন্ধে ছ-টার দিকে শান্ত, নির্জন বনের পথ ধরে ফেরা। শীতকালে সন্ধে ছ-টা মানেই অন্ধকারে ডুবে যেত চারিদিক, তখন সাইকেলের সঙ্গে একটা লন্ঠন বেঁধে নিতাম।
এরকম এক সন্ধেয়, আমি তখন গ্রামের দিকে প্রায় অর্ধেক রাস্তা পার হয়ে এসেছি, হঠাৎ দেখলাম পথ রোধ করে রাস্তার ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে। আশ্চর্য! দিনের এই সময়ে বনের মধ্যে কোনো বাচ্চা ছেলের থাকার তো কথা নয়, এখানে নেকড়ে, হায়না হামেশাই ঘুরে বেড়ায়। আমি সাইকেল থেকে নেমে ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু ছেলেটি যেন আমায় দেখেও দেখল না।
‘একা একা এখানে কী করছ তুমি?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘অপেক্ষা করছি,’ আমার দিকে না তাকিয়েই সে উত্তর দিল।
‘কাদের জন্য অপেক্ষা করছ? তোমার বাবা-মা?’
‘না, আমার বোন।’
‘আচ্ছা, আসার পথে তাকে দেখিনি কিন্তু,’ আমি বললাম, ‘তবে হয়তো তোমার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ভালো হয়, তুমি আমার সঙ্গে এসো, আমরা খুব তাড়াতাড়িই তাকে পেয়ে যাব।’
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে নিঃশব্দে আমার সামনে সাইকেলের রডে বসে পড়ল। সে কেমন দেখতে ছিল, বলতে পারব না। ইতিমধ্যেই অন্ধকার নেমে এসেছিল আর ছেলেটা সবসময় আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে ছিল।
আমাদের উলটোদিক থেকে বাতাস বইছিল। আর যত সাইকেল চালাচ্ছি, ততই ঠান্ডা হাওয়ায় সারা গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছিল, কিন্তু কী আশ্চর্য, ছেলেটি দিব্যি বসে, মনে হচ্ছিল ঠান্ডার কোনো অনুভূতিই নেই ওর। খুব বেশিদূর যাইনি, এমন সময় সাইকেলে বাঁধা লন্ঠনের আলোতে স্পষ্ট দেখলাম সামনেই রাস্তার ধারে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে। এবার একটি মেয়ে। ছেলেটির থেকে বয়সে একটু বড়ো, মাথার লম্বা চুল বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো হয়ে সারা মুখ ঢেকে গেছে।
‘এই যে তোমার বোন। ওকে আমাদের সঙ্গেই নিয়ে চলো,’ আমি বললাম।
মেয়েটি আমার হাসির উত্তরে কিছুই বলল না, শুধু গম্ভীর মুখে মাথা নাড়িয়ে আমার সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠে বসল। আমি আবার প্যাডেল শুরু করলাম। আমি আলাপ জমাতে ওদের কিছু কিছু প্রশ্ন করছিলাম, কিন্তু ওরা দু-একটি শব্দে সব উত্তর দিচ্ছিল। হয়তো আমি অচেনা, তাই এই সাবধানতা। তা যাই হোক, আমি ঠিক করলাম, গ্রামে পৌঁছে মোড়লের হাতে তুলে দেব বাচ্চা ছেলে মেয়ে দুটোকে, তারপর উনি নিশ্চয়ই এদের বাবা মাকে চিনতে পারবেন।
সমান রাস্তা, কিন্তু আমার কেবলই মনে হতে লাগল যেন উপরের দিকে উঠে যাচ্ছি। আর তখনই লক্ষ্য করলাম ছেলেটার মাথাটা আমার মুখের খুব কাছে চলে এসেছে আর পেছনে বসা মেয়েটি যেন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, ভারী নিশ্বাস ছাড়ছে, যেন সাইকেলটা এক অপার্থিব শক্তিতে সেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই তীব্র শীতের মধ্যেও প্রচণ্ড গরম লাগছে, দম বন্ধ হয়ে আসছিল ক্রমশ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন