সহস্রাব্দের সেই রাত

রাস্কিন বন্ড

সহস্রাব্দের সেই রাত

বিষণ্ণ সুরে একটানা হুক্কা-হুয়া ডেকে চলেছে শিয়ালের দল, কসাইখানার নীচে ফেলে দেওয়া হাড়গোড়, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি অঁাতিপাঁতি করে খুঁজছে ওরা। পসন্দ অবিশ্যি ওইসব আওয়াজে বিচলিত হয় না। টেকনোলজিতে তুখোড়, বুদ্ধিমান, সঙ্গে একটি দেশীয় বহুজাতিক সংস্থার মালিক সে। তাই ওসব ভিত্তিহীন, কুসংস্কারগত ভয়-ডর তার মতো ক্ষমতাশালী মানুষের মনে আসে না, আর এ নিয়ে মনে মনে তার বেশ অহংকার। তার ডিকশনারি অনুযায়ী, যা এখনও আবিষ্কার হয়নি তা-ই আমাদের কাছে অজানা। এজন্য গভীর রাতে প্রাচীন কবরখানার পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াতে তার কোনোদিন অসোয়াস্তি হয়নি।

আজ মধ্যরাত সাক্ষী থাকবে এক নতুন সহস্রাব্দের। ২০০০ সালের প্রবেশ। এইসব পয়সাওয়ালা তরুণদের জন্য একঝাঁক আশা-উদ্দীপনা, ঝকঝকে ভবিষ্যৎ। আবার লক্ষ লক্ষ কিংবা অদূর ভবিষ্যতে কোটি কোটি এমন মানুষ থাকবে যারা তাদের নিজেদের টানাটানির সংসার বাঁচিয়ে গরম-ঘাম-ধুলো এক করে কেবল ভবিষ্যতের মাটি শক্ত করে যাবে। তাদের পরিবারের জন্য পাবলিক স্কুলের পড়াশুেনা নয়, গ্যারেজের তিনটে গাড়ি কিংবা বারমুডার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তাদের কপালে লেখা নেই। আহা! পসন্দের মতো মাথা আর ভাগ্য কি সবার হয়! আবার সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পারিবারিক সম্পত্তি তো আছেই। এ সব কিছুই ওর জীবনকে এত সুখের এবং সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। এমন এক শতাব্দী আসতে চলেছে যখন চটপটে, কেতাদুরস্ত আহাম্মকেরা সবার উপরে ছড়ি ঘোরাবে আর বাকি সব রকমের নির্বোধের দল মার খেতে খেতে একসময়ে অতলে ডুবে যাবে। তার দর্শন অনুযায়ী, এ সমাজের একজন অভিজাত শাসক প্রয়োজন, তবেই একমাত্র খেটে খাওয়া মানুষের উন্নতি সম্ভব।

সে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। সবে মধ্যরাত অতিক্রান্ত। খাওয়া-দাওয়া বেশ ভালোই হয়েছে, এই নির্জন আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে ভালোই লাগছিল তার, এই এলাকার বিখ্যাত, অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে এই রাস্তা— লাল, ব্যানার্জি, কাপুর, রামচন্দানির প্রাসাদোপম সব বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে— পসন্দ তাঁদের থেকে কম কিছু নয় কিংবা বলা যায়, তাঁদের থেকেও অবস্থাপন্ন সে। তার মনে হয়, যখন সে নিজের জীবনের এভারেস্টের চুড়ো লক্ষ করে এগিয়ে চলেছে, তখন অনেকেই নিজের জীবনের সে-উচ্চতায় পৌঁছে গেছে, বা চুড়োর ঠিক নীচের ধাপে আছে, এর পরেই দ্রুত ছুঁয়ে ফেলবে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য।

এই কবরখানার বেশিরভাগ কবরই বহু পু্রোনো, কিছু কিছুর বয়স তো দেড়শো পেরিয়েছে, সব ভেঙেচুরে পড়ে আছে— শক্তিশালী শাসকের এ এক করুণ পরিণতি, ধ্বংস হতে হতে ধুলোয় পরিণত হচ্ছে। এখানে শুয়ে আছে কত কত কর্নেল, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যবসায়ী, মেমসাহেব, ছোটো ছোটো শিশু; ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষ হয়ে গেছে কোনো অশান্ত সময়ে। পসন্দের কাছে তারা শুধু হেরে যাওয়া মানুষ, তারা সবাই। যারা ক্ষমতা ও খ্যাতিকে ছুঁয়ে দেখতে পারেনি তাদের জন্য তার মনে কোনো সমবেদনা নেই। পরাজিত সাম্রাজ্য তার জন্য নয়।

রাস্তার এদিকটা খুব অন্ধকার, উত্তর ঢালে এত নিবিড়ভাবে বেড়ে উঠেছে গাছগুলি। পসন্দের মনে একটু ভয় ভয় করছিল, পরক্ষণেই পকেটে মোবাইল ফোনের উপস্থিতি অনুভব করে আশ্বস্ত হল, যেকোনো সময়েই সে ড্রাইভার বা বন্দুক বাগানো দেহরক্ষীদের ডেকে নিতে পারে, তারাই ওকে নিয়ে যাবে।

নাগ পাহাড়ের উপরে আজ চাঁদ উঠেছে। আর টি-শার্ট, জিন্্স পরা আধুনিক যুগের এই বীর যোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার কায়দায় সার সার সমাধি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে গোরস্থানের সীমানার মধ্যেই হালকা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। ওর চামচাদের একজন খবর এনেছিল, এখানে নাকি এক মেয়েমানুষ থাকে, স্বামী মারা গেছে, ছোটো ছোটো বাচ্চা আছে। অভাবে তার শরীর পড়ে গেছে, কিন্তু যৌবনের চিহ্ন একেবারে মুছে যায়নি, মুখখানায় এখনও লাবণ্য উঁকি দিচ্ছে। শোনা যায়, টাকা খসাতে পারলে তারও প্রশ্রয়ে কার্পণ্য থাকে না। কারণ তার এই ক্ষুধার্ত পরিবারের জন্য অনেক টাকার দরকার।

আবার সবাই বলে, বউটা মানসিকভাবে সুস্থ নয়। ওর স্বামী এই কবরখানার কেয়ারটেকার ছিল, তাই কোয়ার্টার পেত। অদ্ভুত ব্যাপার হল, স্বামী মারা যাবার পরে সে এখনও সেটা পেলেও সেখানে না শুয়ে পুরোনো গম্বুজওয়ালা কবরগুলির ওপরে গিয়ে ঘুেমায়।

এসবে পসন্দের কিছু যায় আসে না। তার কেবল যৌনসুখ চাই, প্রেম নয়। এক্ষুনি তার কাউকে চাই যার উপর সে তার ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারবে, মেয়ে হলে বেশি ভালো, কারণ তাকে পুরুষত্বের প্রমাণ দিতে হবে যে। এতদিন পর্যন্ত অল্পবয়সি মেয়েরা তার উদ্ধত, কুৎসিত ভঙ্গির জন্য তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

এই মেয়েটি অল্পবয়স্ক নয়, চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন তাকে বুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার রহস্যময় চোখ আর বলিষ্ঠ দেহে সৌন্দর্যের চিহ্ন লেগে আছে এখনও। তার উন্মত্ত রক্তে এমন কিছু আছে যা তাকে মোহময়ী করে তুলেছে। রাতের অন্ধকারে তার ঝকঝকে দাঁত বার করে একগাল হেসে পসন্দকে তার কামরায় নিয়ে গেল— তার সব থেকে প্রিয় সেই বড়ো সমাধিটার ভেতর।

পসন্দের হাতে প্রেম প্রেম খেলার সময় ছিল না। মেয়েটি ওর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গেসঙ্গে ও পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটির স্তন খামচে ধরে, কিন্তু বুঝতে পারে ওর নিজের স্তনের থেকে সেগুলি খুব বেশি বড়ো নয়। তবুও সে মেয়েটার শতছিন্ন কাপড় পাগলের মতো টেনে আরও ছিঁড়ে ফেলে, বুভুক্ষুর মতো নিজের ঠোঁট চেপে ধরে তার শুকনো ঠোঁটে। মেয়েটা বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করে না। পসন্দ ইচ্ছেমতো তাকে ভোগ করল। এরপর যখন সে রতিক্লান্ত হয়ে বহুকাল আগে মৃত সৈনিকের দেহাংশ চাপা দেওয়া সমাধির ঠান্ডা, স্যাঁৎসেঁতে সেই স্ল্যাবের উপর শুয়ে পড়ল, তখন মেয়েটি তার উপর চড়ে বসল, তারপর মুখ নামিয়ে পসন্দের গালে, ঘাড়ে কামড়াতে লাগল।

পসন্দ যন্ত্রণায়, অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠে বসতে গেল। কিন্তু অনেকগুলি ছোটো ছো্টো কিন্তু শক্তিশালী হাত ওকে জোর করে সমাধিস্তম্ভের উপর চেপে ধরল। ছোটো ছোটো মুখ, ধারালো দাঁত ওর সারা দেহে বসে যেতে লাগল। কাদামাখা আঙুলগুলি ওর জামা কাপড় শতছিন্ন করে ফেলল নিমেষে। ওই দুধের দাঁতগুলি ওর মাংস কামড়ে ছিঁড়ে নিতে লাগল বার বার। সামনেই একদল শেয়াল ডেকে উঠল একসঙ্গে। পসন্দের মরণ আর্তনাদ মিশে গেল ওদের চিৎকারে।

‘আস্তে, ব্যস্ত হয় না, আমার সোনা বাছারা, আস্তে,’ করুণ সুরে মেয়েটি বলে উঠল, ‘তোদের সকলের হয়ে গিয়ে আরও পড়ে থাকবে রে।’

তাদের তৃপ্তির ভোজ চলতে থাকে।

সরু গলিটায় শেয়ালগুলো আবার চিৎকার করে ওঠে, এরপর তাদের পালা আসবে। হাড়গুলো তাদের ভোগে যাবে। শুধু মোবাইল ফোনটা পড়ে থাকবে শেষে, তাকে ভোগ করার যে কেউ থাকবে না আর।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন