রাস্কিন বন্ড
প্রায় বছর পনেরো আগে এক কাঠফাটা গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুরটা আবিষ্কার করেছিলাম, জায়গাটা রাজপুরের কাছে। পাশাপাশি বেড়ে ওঠা শালগাছে ছায়াবৃত এলাকাটা ছিল বেশ ঠান্ডা, আকর্ষণীয়ও বটে। অগত্যা আর দেরি করা গেল না, জামা-কাপড় খুলে পুকুরপারে রেখে একেবারে ঝপাং।
তবে ঝাঁপটা দিয়েই বুঝলাম মস্ত ভুল করে ফেলেছি। জলটা এমন হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হবে আশা করিনি, একেবারে বরফের মতো কনকনে। মনে হয়, বহুকাল সূর্যের স্পর্শ পায়নি। সবলে সেই জল ঠেলে সাঁতরে ওপারে গিয়ে উঠলাম। পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি তখন।
আরও কিছুটা সাঁতার কাটার ইচ্ছে ছিল। তাই আবার দিলাম লাফ আর পুকুরের মধ্যিখানে এসে হালকা ব্রেস্টস্ট্রোক দিলাম। তখনই ঘটল রহস্যময় ঘটনাটা, সাঁতার কাটতে কাটতে টের পেলাম কিছু একটা আমার পায়ের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল। কেমন যেন নরম চটচটে মতো। তবে কিছুই দেখলাম না, কিছু শুনতেও পেলাম না। তবে পিচ্ছিল কিছু একটা জলের তলায় আমাকে অনুসরণ করছিল বেশ বুঝতে পারছিলাম। ব্যাপারটা মোটেই ভালো ঠেকল না। কিছু একটা ক্রমাগত পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। সেটি জলের তলার কোনো উদ্ভিদ যে নয় তা নিশ্চিত। সেটি কেবল আমার পায়ে মুখ লাগিয়ে থেকে থেকে শুষছিল। পায়ের গিঁটে একটা লম্বা জিভ ক্রমাগত শুষে চলেছে, ভেবেই অজানা আশঙ্কায় বুকটা একটু কেঁপে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে আমি জোরে একটা ঝাপটা দিলাম যাতে সঙ্গী প্রাণীটির থেকে দূরে সরে যেতে পারি। বুঝলাম প্রাণীটি একাই, ছায়ার আড়ালে যেন লুকিয়ে আমায় অনুসরণ করে চলেছে। তাকে এক ঝটকা দিয়ে, আমি দ্রুত সাঁতার কাটতে লাগলাম ভয় পাওয়া ডলফিনের মতো, জলের গভীরের অজানা এক আতঙ্ক আমায় চেপে ধরছে ক্রমশ।
নিরাপদে জল থেকে উঠে একটা রোদ ঝলমলে তপ্ত পাথরের উপরে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর জলের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
নাহ! কিছুই নড়ছে না। পুকুরের জলের উপরিতল একেবারে শান্ত, স্থির। শুধু কিছু শুকনো পাতা ভাসছে এদিক-ওদিক। কোনো ব্যাং, কোনো মাছ এমনকী কোনো জলচরা পাখিও চোখে পড়ছে না। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, অস্বাভাবিক।
কিন্তু কিছু তো একটা আছে এই পুকুরের জলে, আমি নিশ্চিত। কোনো একটা ঠান্ডা রক্তের প্রাণীই হয়তো, এই জলের থেকেও ঠান্ডা, আরও সিক্ত। কোনো মরদেহ জলের আগাছার সঙ্গে আটকে নেই তো? তবে আমার আর জানতে ইচ্ছা করছিল না, তাই জামা প্যান্ট পরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম ওই জায়গা থেকে।
এর কিছুদিন বাদে আমি দিল্লি চলে গেলাম। সেখানে একটি অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি নিলাম। সেখানে আমার কাজ ছিল লোকজনকে বোঝানো যে কীভাবে কোল্ড ড্রিঙ্ক পান করে এই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মোকাবিলা করা যায়। মজার ব্যাপার হল, এই কোল্ড ড্রিঙ্ক জিনিসটা বড়োই অদ্ভুত। এটা পান করলে তেষ্টা মেটার চেয়ে আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এসব ব্যস্ততার মাঝে শালবনের সেই পুকুরটার কথা মাথা থেকে একেবারেই বেরিয়ে গেছিল।
প্রায় দশ বছর বাদে কাজের সূত্রে আবার রাজপুর আসা হল। ছোটো হোটেলটা থেকে বেরিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি আবার সেই প্রাচীন শালবনের পথ ধরে হাঁটছি, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন তীব্রভাবে আমায় ওই পুকুরের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। সেইবার আমি সাঁতার শেষ করতে পারিনি। তবে এ নয় যে আবার সাঁতার কাটার জন্য আমি মুখিয়ে আছি। তবে খুব দেখার ইচ্ছা, সেই পুকুরটি এখনও সেস্থানে আছে কি না।
হ্যাঁ, দেখলাম আছে, যথাস্থানেই আছে। তবে তার চারপাশটায় বেশ পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন নির্মাণ হয়েছে, অনেক বাড়িঘর উঠেছে যেখানে আগেরবার এসে দেখেছি শুধু জনহীন অরণ্য। পুকুরের সামনে নানা ধরনের কাজকারবার চলছে।
শ্রমিকরা কাজ করছিল, বালতি, রাবার পাইপ ছড়ানো-ছিটোনো, পুকুর থেকে জল বের করা হচ্ছিল। সেখানে কায়দা করে মাটি উঁচু করে সেই জলটাকে অন্য পথে বইয়ে দেওয়া হচ্ছিল।
সাদা সাফারি সুট পরা একজন লোক পুরো ব্যাপারটা তদারকি করছিলেন। প্রথমে ভাবলাম উনি হয়তো মান্যগণ্য বন-অধিকর্তা, কিন্তু তারপর ভুল ভাঙল, ভদ্রলোক আসলে কাছে যে ইস্কুলটা হয়েছে তারই মালিক।
আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি রাজপুরেই থাকেন নাকি?’
‘ওই একসময়ে ছিলুম আর কি... আপনি এই পুকুরটার জল বের করে নিচ্ছেন কেন?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘সমস্যায় পড়েছি বুঝলেন,’ উনি বলতে লাগলেন, ‘আমার স্কুলের দুটি ছেলে ক-দিন আগে ডুবে মারা গেছে। বড়ো বড়ো ছাত্র দু-জন। নিশ্চয়ই বিনা অনুমতিতে এ পুকুরে সাঁতার কাটতে আসেনি, ওদের নাগালের বাইরে এটি। কিন্তু আপনি তো জানেন, ছেলেপিলে কেমন হয়, আপনি একটা নিয়ম বানাবেন আর ওদের পরম কর্তব্য সেটিকে যেনতেনপ্রকারেণ ভাঙা।’
ভদ্রলোকের নাম জানলাম। এরপর মিস্টার কাপুর আমাকে খাতির করে ওঁর বাড়ি নিয়ে এলেন। নতুন তৈরি একটা বাংলো, লাগোয়া চওড়া বারান্দাটি বেশ ঠান্ডা। ওঁর চাকর আমাদের জন্য দুটি গ্লাসে শরবত নিয়ে এল। দুটি বেতের চেয়ারে আমরা বসেছিলাম, সামনেই সেই পুকুর আর বিস্তৃত বনভূমি।
‘আচ্ছা, ছেলে দুটি কী একই সময়ে ওখানে গিয়েছিল?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘হ্যাঁ, ওরা দু-জন ভালো বন্ধু ছিল। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোনো প্রাণী ওদের আক্রমণ করেছিল। হাত পা মোচড়ানো, সারা শরীর একদম গুঁড়ো গুঁড়ো, বিকৃত মুখ চেনা যাচ্ছে না। কিন্ত ডাক্তার বললেন, জলে ডুবেই মৃত্যু হয়েছে ওদের।’
আমরা সামনে পুকুরে ফিট করা শ্যালো মেশিনগুলির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ওখানে তখনও কিছু লোক কাজ করছিল, বাকিরা দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিল।
আমি বললাম, ‘মনে হয় জায়গাটা না ঘঁাটানোই ভালো, বরং ওটির চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া লাগিয়ে দিন আর ছেলেদের বলুন কাছে না ঘেঁষতে। হাজার বছর আগে এই এলাকায় ছিল অন্তর্দেশীয় সাগর, তারপর এখন এই অল্প কিছু পুকুর আর জলাশয় বেঁচে আছে।’
‘আমি তো পুকুরটা ভরাট করে কিছু একটা তৈরি করতে চাই, একটা ওপেন এয়ার থিয়েটার মতো। কৃত্রিম পুকুর তো যখন তখন কোথাও একটা খোঁড়াই যায়।’
এখন দেখছি একটাই লোক দাঁড়িয়ে আছে পুকুরে, কাদাজলে তার হাঁটু অবধি ডুবে আছে। এরপর যা ঘটল তার সাক্ষী রইলাম আমি আর মিস্টার কাপুর দু-জনেই।
কিছুক্ষণ ধরেই মনে হচ্ছিল, জলের তলা থেকে কিছু যেন একটা উঠে আসছে, ক্রমে বুঝলাম সেটা বিশাল শামুকের মতো বীভৎস কিম্ভূতকিমাকার একটা জীব, মাথার দিক কিছুটা মানুষের মতো, আর দেহটা অক্টোপাসের মতো, যেন প্রকাণ্ড চেহারার ভয়ানক এক শাকুবাস*। দেখতে দেখতে পুকুরে দাঁড়ানো লোকটার মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেল। নরম, চটচটে একটা প্রাণী, সেই আদিম অতীত থেকে রয়ে গেছে এই পৃথিবীতে।
এরপরেই সে নিমেষে লোকটাকে শুষে নিল মুখের ভিতর, লোকটা অসহায়ভাবে হাত-পা ছুড়ছিল, সেইসময় শুধু তার হাত-পাগুলোই প্রাণীটার মুখের বাইরে বেরিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাকুবাসটা ওকে টেনে জলের তলায় নিয়ে গেল।
এমন অভাবনীয় দৃশ্যে হতচকিত হয়ে কাপুর আর আমি বারান্দা থেকে দৌড়ে পুকুরপাড়ের দিকে গেলাম। দেখলাম, জলের উপরের দিকের সবুজ শ্যাওলায় বুড়বুড়ি কাটছে। ততক্ষণে আবার সব শান্ত, নিস্তব্ধ। আর তার ঠিক পরেই বাচ্চারা যেমন বাবলগাম চিবিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় ঠিক তেমনি সেই লোকটার ছিন্নভিন্ন দেহ আচমকা জল থেকে ছিটকে উঠল, তারপর ঘুরপাক খেয়ে আমাদের সামনে এসে পড়ল।
লোকটার দেহে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই, সারা শরীর জলে চুপচুপ করছে কিন্তু শরীরের ভেতরের সমস্ত রস যেন কেউ শুষে দেহটাকে ছিবড়ে করে দিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই পুকুরের কাজ এরপর বন্ধ হয়ে গেল। এরকম একটা গল্প খাড়া করা হল যে, লোকটা কাজ করতে করতে হঠাৎ পিছলে পাথরের উপর পড়ে গেছিল আর তাতেই তার মৃত্যু হয়। কাপুর আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন যে এই ঘটনা কোনোদিন কাউকে বলব না। তাঁর ইস্কুলের পাশেই যদি এরকম পর পর ডুবে যাওয়া বা দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে তবে সেই ইস্কুল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তিনি এরপর তাঁর সম্পত্তির সীমানা বরাবর পুকুরের চারদিকে বিশাল পাঁচিল তুলে দিলেন, তাতে পুকুরে নামার আর উপায় রইল না। এখন পুকুরটা ঘন শালবন আর ঝোপঝাড়ে ঢেকে যাওয়ায় সেটি আর দেখা যায় না।
এরপরে বর্ষাকাল এলে পুকুরটি আবার জলে ভরে গেল।
এবার কথা হচ্ছে, কীভাবে ওই জায়গায় পৌঁছোনো যায় সেটি আপনাদের বলতেই পারি, কিন্তু সে-পুকুরে সাঁতার কাটার উপদেশ? নৈব নৈব চ!
……
* উপকথায় বর্ণিত একটি দৈত্য
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন