পুরস্কার

রাস্কিন বন্ড

পুরস্কার

তখন ঘড়িতে প্রায় রাত একটা। ওল্ড রিটজ বারে তুমুল মদ্যপানের পর অবশেষে তারা একে একে উঠল। সবারই প্রায় বেসামাল অবস্থা। গণেশ ওর নীল রঙের মারুতি জেনটা নিয়ে এদিক-ওদিক এঁকেবেঁকে বাড়ির দিকে রওনা দিল। ভিক্টর ওর আদ্দিকালের মরিস মাইনরে স্টার্ট দিয়ে কিছুটা এগোতেই গাড়ি গেল বসে, শেষে ট্যাক্সি ডাকতে বাধ্য হল। দোকানদার নন্দু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার ছোট্ট কটেজের দিকে গেল। পায়ের পাতায় মাঝেমধ্যেই একটা ব্যথা উঠছে, মনে হচ্ছে আবার একটা গোদের আক্রমণ সইতে হবে। বেগম তারা, গোড়ার দিকে প্রায় শ-খানেক ছবিতে দাপিয়ে অভিনয় করেছে, একটা সাইকেল রিকশায় উঠে বসল। কিন্তু রিকশাওয়ালার দেখা নেই। তাতে অভিনেত্রীর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, কারণ রিকশায় উঠে ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বারটেন্ডার রাতের অন্ধকারে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। শুধু এক তরুণ উপন্যাস-লিখিয়ে রাহুল হল ঘরে পড়ে আছে, চারিদিক দেখে সে মারাত্মক অবাক হয়েছে, কোথায় গেল সব? তাকে একা ফেলে রেখে সব চলে গেলই-বা কোন আক্কেলে?

হোটেলটা পুরো ভরতি, এমনকী কোনো স্পেয়ার বেডও নেই হোটেলে। কারণ এই সময়টাকে বলে ‘হাইট অফ দ্য সিজন’ আর পাহাড়ের সব হোটেলগুলিতে ভিড় উপচে পড়ছে। রুম বয় আর রান্নার লোকেরা তাদের কোয়ার্টারে ফিরে গেছে। মাঝেমধ্যে শুধু রাতের চৌকিদারের বাঁশি শোনা যাচ্ছে কারণ রিটায়ার্ড হাবিলদার এ সময়টায় পুরো চত্বর ঘুরে ঘুরে টহল দেয়।

তরুণ সেই লেখকের মনে হতে লাগল তাকে অন্যায়ভাবে ফেলে রেখে গেছে সবাই, অথবা বলা ভালো, তার প্রতি একটু যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে বাকিরা। কারণ সে-ই তো ছিল পার্টির মধ্যমণি, আবার এটাও কারণ হতে পারে যে সে সবাইকে বলে দিয়েছে তার এক্কেবারে নতুন বইটার জন্য পাওয়া মোটা অঙ্কের অগ্রিম রয়ালটির কথা এবং বইটি যে বুকার পুরস্কার পাচ্ছে এটা একপ্রকার নিশ্চিত। সে বোধ হয় দেখেনি, সবাই উদাসীন ভঙ্গিতে হাই তুলছিল সেই সময় অথবা যদি দেখেও থাকে ভেবে নিয়েছে বারের মধ্যে অক্সিজেনের অভাব, তাই হাই উঠছে। আগের এক মালিক এর নাম রেখেছিল ‘হরাইজেন্টাল বার’ কারণ কোনো কোনো মক্কেলকে বেসামাল অবস্থায় এই কার্পেটের উপর টেনে ঘুম দিতে দেখা গিয়েছিল। এই সেই কার্পেট যার ওপরে শুয়ে ঠিক এক-শো বছর আগে ডিউক অব স্যাভয় ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন।

তবে এই মেঝেতে শুয়ে রাহুলের এখনই সে মায়া ত্যাগ করার কোনো ইচ্ছেই নেই। তবে কোথায় আপাতত শরীর ফেলা যায় সেটাই এখন প্রশ্ন। একটা বিলিয়ার্ড টেবিল হলে মন্দ হত না, কিন্তু বিলিয়ার্ড ঘরটা তালাবন্ধ। তখন সে টেনে টেনে করিডোর দিয়ে এগোল... নাহ সোফা, ইজিচেয়ার কিছুই তো চোখে পড়ছে না। শেষে একটা দরজা নজরে এল, হাট করে খোলা, দরজার ওপাশে বিশাল ফাঁকা ডাইনিং রুম, টিমটিম করে একটা ইলেকট্রিক বাল্‌ব জ্বলছে।

আদ্দিকালের একটা পিয়ানো আছে, কিন্তু তার উপর কি আর শোয়া যায়? তবে লম্বা ডাইনিং টেবিলটা মোটামুটি ফাঁকাই আছে। শুধু ওপরে বেছানো একটা টেবিল কভার, ঝোল-তরকারির দাগ লেগে আছে তাতে, পরের দিনের সকালের ব্রেকফাস্টের সময় আবার তার কাজ শুরু হবে। রাহুল কোনোরকমে টেবিলের উপর উঠে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। বেশ শক্ত কষ্টদায়ক একটা শোবার বিছানা হল, এর মধ্যে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা পাউরুটির গুঁড়ো ওর নরম চামড়ায় খোঁচা দিচ্ছে, তবে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে এখন সেসব থোড়াই কেয়ার। বাল্্বের আলোটা ঠিক ওর মুখের উপর পড়ছে, কিন্তু তাতে রাহুলের বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে বলে মনে হল না। আশ্চর্য এই যে, ঘরের মধ্যে কোনো বাতাস নেই, অথচ বাল্্বটা খুব ধীরে ধীরে দুলছে, যেন কোনো অদৃশ্য হাত সেটিকে মাঝেমধ্যে মৃদু নাড়িয়ে দিচ্ছে।

ঘণ্টাখানেক বোধ হয় সে ঘুমিয়েছিল, একেবারে গভীর স্বপ্নহীন ঘুম যাকে বলে। তারপর হঠাৎ জেগে উঠলে চারপাশে অস্পষ্টভাবে গান বাজনা, কথাবার্তা, হাসিঠাট্টার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ একজন পিয়ানো বাজাচ্ছিল। চেয়ারগুলো টেনে পেছনের দিকে নেওয়া হয়েছে। গ্লাসের টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। ছুরি আর কাঁটাচামচের সঙ্গে প্লেটের সংঘর্ষে বিচিত্র আওয়াজ হচ্ছে।

চোখ মেলে রাহুল দেখল তার চারপাশে এক মহাভোজনের আয়োজন চলছে। আর যে টেবিলে সে শুয়ে আছে সেই টেবিল জুড়ে তার চারপাশে বড়ো বড়ো পাত্রে রাশি রাশি খাবার সাজানো। যারা এই ডিনার পার্টিতে এসেছে তারা যেন তাকে লক্ষই করছে না। লোকগুলি বড়োই অদ্ভুত, যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে, আদ্দিকালের কোট-জামা পড়েছে, সেই পুরোনো আমলের টাই আর উঁচু কলারের জামা আর মহিলারা সেই আমলের জামাকাপড় পড়েছে, শক্ত করে কাঁচুলি বেঁধেছে, তাতে বুকের সামনেটা অনেকটাই অনাবৃত হয়ে উঠেছে, এতে আবার বেশ নজর কাড়া যায়। দীর্ঘকালের অভ্যাসবশত রাহুল হাত বাড়িয়ে সবথেকে কাছে যে অনাবৃত বুক তাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাইল, তবে ভাগ্য ভালো যে কোনো চড়-থাবড়া খেল না। এর একটাই সহজ কারণ, হাতটা তার হলেও তাকে নাড়ানোর সাধ্যি রাহুলের তখন আর ছিল না।

‘রোস্ট পিগ,’ কেউ একজন উল্লসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমি তো এটাই খুঁজছিলাম,’ বলেই ছুরি আর কাঁটাচামচ দিয়ে রাহুলের ঊরুতে খোঁচাতে লাগল।

রাহুল তখন প্রচণ্ড চেঁচিয়ে উঠল, অথবা বলা ভালো, চেঁচাতে গেল, কিন্তু কেউ তার গলা শুনতে পেল না। ও নিজেই তা শুনতে পেল না। তবে দেখল, ও মাথা তুলতে পারছে, এরপর একটু সোজা হয়ে বসে নিজের শরীরটার দিকে তাকাতেই সারা গায়ে শিহরন খেলে গেল। দেখল, ওর কোমর থেকে পা অবধি শরীরটা আর মানুষের নেই, তার বদলে পুরোটাই শুয়োরের পা হয়ে গেছে।

এর মধ্যে কেউ একজন ওকে উলটে দিয়ে নিতম্বের অংশ থেকে একটু মাংস কেটে নিল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন