পরিত্যক্ত

রাস্কিন বন্ড

পরিত্যক্ত

আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই ফলের বাগানটা— পেয়ারা, লিচু, পেঁপে গাছগুলো দু-তিনটে লম্বা লম্বা আম গাছের সঙ্গে মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছে। পেয়ারা গাছগুলি খুব একটা উঁচু নয়। লিচু গাছগুলি বেশ বড়ো বড়ো, চারিদিকে ডালপালা মেলে বিস্তৃত ছায়াঘন করে তুলেছে জায়গাটা, এর সঙ্গে গরমকালে উপরি পাওনা বড়ো বড়ো সুস্বাদু লিচু। বসন্তকালে আম গাছগুলি হয় দেখবার মতো, সম্পূর্ণ গাছ জুড়ে মুকুল প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে, চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে মনমাতানো সৌরভ।

তবে পাঁচিলের গায়ে যেখানে বৃদ্ধ আম গাছটি আছে সেখানে কেউ যায় না, এমনকী দুখীমালিও সে-পথ মাড়ানোর কথা স্বপ্নেও ভাবে না।

দুখীকে জিজ্ঞাসা করাতে সাফাই দিল, ও গাছে নাকি ফল ধরে না, বুড়ো গাছ, তাই যাবার প্রয়োজন হয় না।

‘তবে ওটা কেটে কেন ফেলছ না?’

‘ফেলব, যেদিন তোমার দিদার ইচ্ছে হবে।’

কেউ যায় না বলেই ওই কোণটাতে আগাছা বেড়ে উঠেছে। দুখীর নির্মম নিড়ানির আগা থেকে তারা জব্বর বেঁচেছে।

‘বাগানের ওই কোনায় কেউ যায় না কেন বলতে পারো?’ এবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম মিস কেলনারকে, ভদ্রমহিলা পঙ্গু, বয়স অনেক, সেই মেয়েবেলা থেকে এই দেহরাতে রয়েছেন।

কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী হলেন না। আঙ্কল কেনের সামনে একথা উত্থাপন করলে তিনিও একথা সেকথা বলে এড়িয়ে গেলেন।

তাই আমি একা একাই বাগানে ঘুরে বেড়াতাম এদিক-ওদিক আর সুযোগ পেলেই ওই পরিত্যক্ত এবং নিষিদ্ধ কোনাটার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতাম আর তখনই পেছন থেকে হাঁক পাড়ত দুখীমালি।

‘ওখানে যেয়ো না বাবা,’ সতর্ক করে বলত সে, ‘ও জায়গাটা অভিশপ্ত।’

দিদাকেও জিজ্ঞাসা করেছি অনেকবার, ‘আচ্ছা ওই বুড়ো আমগাছটার সামনে কেউ যায় না কেন?’

তিনি কেবল মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতেন। কিছু তো আছেই, যেটা আমাকে কেউই জানাতে চায় না। অগত্যা তাদের উপেক্ষা আর অবহেলা করা ছাড়া উপায় থাকল না আর তাই পড়ন্ত বিকেলে যখন সবাই খাওয়া-দাওয়া করে দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন আমি বেরিয়ে পড়লাম বাগানের শেষ প্রান্তে ওই রহস্যময় প্রাচীন আমগাছটার উদ্দেশে।

জায়গাটা বেশ ঠান্ডা, ছায়াচ্ছন্ন, ভালোই জমবে মনে হচ্ছে। কিন্তু গাছে কোনো পাখির চিহ্ন নেই, না আছে কোনো কাঠবেড়ালি, ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। যাই হোক, গাছের গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে ঘাসের উপর বসে আধবোজা চোখে তাকিয়ে রইলাম সামনের অস্তগামী সূর্যের আলোয় হলুদ হয়ে ওঠা বাড়ি আর বাগানের দিকে। এমন সময় দিনশেষের আলোয় আবছা হয়ে আসা দৃশ্যপটে হঠাৎ কাউকে যেন গাছটার দিকে আসতে দেখলাম, কিন্তু সে যে দুখী বা আমার চেনা কেউ নয়, আমি নিশ্চিত।

সেদিন বেশ গরম পড়েছিল, কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, ওই গরমেও আমার যেন শীত শীত করতে লাগল, তারপর এক মুহূর্তে আবিষ্কার করলাম আমি ঠকঠক করে কাঁপতে আরম্ভ করেছি— যেন হঠাৎ আমার ধুম জ্বর এসেছে। কী ভাবতেই আমি মাথা তুলে আমগাছটার শাখাপ্রশাখার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আর তখনই চোখে পড়ল এক অদ্ভুত ঘটনা— সেসময় কোথাও কোনো বাতাসের চিহ্নমাত্র নেই, আশপাশের গাছের ডাল-পাতাও নড়ছে না, কিন্তু এই গাছের ডালপালা যেন নড়তে শুরু করছে, হালকা দুলছে মনে হল।

কী হচ্ছে এগুলো? আমার মনে হল এখুনি এই অদ্ভুত ঠান্ডা লাগা থেকে মুক্তি পেতে হবে, কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ হবে না। তাই ঘাসের উপর হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেলাম যেখানে সূর্যের আলো এখনও অবশিষ্ট আছে। আশ্চর্য! কাঁপুনিটা তৎক্ষণাৎ উধাও হয়ে গেল আর আমি পেছনের দিকে আর না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে এক ছুটে বারান্দায় উঠে তবে থামলাম।

মিস কেলনারকে আমার এই অদ্ভুতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা সব খুলে বললাম।

‘তুমি ভয় পেয়েছ নাকি?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ, তা তো একটু পেয়েছি বই কী,’ আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম।

‘আর তুমি কি কিছু দেখতে পেয়েছ?’

‘হ্যাঁ...হ্যাঁ...গাছের কয়েকটা ডাল নড়ছিল, আমার খুব শীত করছিল, কিন্তু কোনো বাতাস ছিল না।’

‘আর কিছু শুনেছ?’

‘হ্যাঁ, চাপা একটা আর্তনাদ।’

‘বুড়ো গাছ কিনা, যখনই তার মনে পড়ে যে বয়স হয়েছে তখনই সে কাতর আর্তনাদ করে ওঠে, যেমনটা আমি করে থাকি আর কি।’

এরপরে বেশ কিছুদিন আর সেই আমগাছের দিকে যাইনি। আর এ বিষয়টা দিদা বা আঙ্কল কেনের সামনে তুলিনি কারণ এখন বুঝে গেছি পুরো ব্যাপারটাই তাদের কাছে একটি নিষিদ্ধ বিষয়।

 

ছেলেবেলায় আমার নেশাই ছিল নির্জন জায়গাগুলিতে ঘুরে বেড়ানো— অনাদৃত বাগান বিশেষ করে ফলের বাগান, পরিত্যক্ত বাড়ি, ছোটো ছোটো পতিত জমি, শহরের বাইরে মাঠ-ঘাট কিংবা বন-জঙ্গলের একেবারে প্রান্তে চলে যেতাম মাঝে মাঝেই। এরকমই একদিন বাংলোর পেছনে ঘুরতে ঘুরতে হঠাতই পুটুস গাছের ঝোপটার মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটা চ্যাপটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গোড়ালি মচকে ফেললাম। গোড়ালিটা ডলতে গিয়ে কিছু মুহূর্তের জন্য ঘাসের উপর বসে পড়লাম। যখন ব্যথাটা অনেকটা কমে এল, মাটি থেকে বেরিয়ে থাকা পাথরটা ভালো করে দেখতে গেলাম। আরে! এ যে একটা সমাধি পাথর। পুরো পাথরটাই আইভি নামক উজ্জ্বল সবুজ লতায় ঢাকা পড়ে আছে তাই প্রথমে নজর এড়িয়ে গেছিল, আসলে বহু বছর এপাশটায় কেউ আসে না কিনা— পাথরটাকে ভালো করে দেখব বলে লতাগুলি টানতেই কতকগুলি ছিঁড়ে আমার হাতে চলে এল। সমাধির উপর ঘাস আর শ্যাওলায় ঢাকা একটা আবছা লেখা দেখতে পাচ্ছি, যেটুকু পড়া যাচ্ছে তাতে বুঝলাম মাটির নীচে যে শুয়ে আছে তার নাম রোজ— আরও কিছুটা ছিল কিন্তু প্রায় মুছে গেছে।

আমি আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইলাম— এই সদ্য আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরছিল, কিছুটা দূর গেলেই যখন গোরস্থান তবে সেখানে না গিয়ে রোজ নামক মহিলাকে বাড়ির এই নির্জনতম প্রান্তে কেন গোর করা হল? কেনই-বা তাকে বাড়ির বাকি সদস্যদের পাশে গোর দেওয়া হল না? এ কি একান্তই তার ইচ্ছেয় হয়েছে? কিন্তু কেন?

আমার মনে হল একমাত্র মিস কেলনারই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন— তাই তাঁর কাছেই যাওয়াই আপাতত আমার উদ্দেশ্য। যখন তাঁর কাছে গেলাম, দেখলাম তিনি একটা বাতাবি লেবুর গাছের নীচে আরামকেদারায় গা এলিয়ে শুয়ে আছেন— এই আরামকেদারা থেকে নামা-ওঠা করার ক্ষমতা তাঁর নেই, কেবল আয়া বা রিকশাওয়ালা কয়েকটা ছেলে মাঝেমধ্যে তাঁকে সাবধানে তুলে বিছানা কিংবা বাথরুমে নিয়ে যায়। আমি এই খোঁড়া মিস কেলনারকে জীবনেও ভুলতে পারব না— দেখতাম শান্ত মনে একগাদা জীর্ণ তাস নিয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু যখনই তাঁর খেলার বারোটা বাজিয়ে নানারকম প্রশ্ন নিয়ে হাজির হতাম উনি মাথা ঠান্ডা রেখে সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন, কোনোদিন দেখিনি একটুও বিরক্ত হয়েছেন। সে কতরকম প্রশ্ন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি কিংবা তাঁর নিজের জীবনেরই ইতিহাস। ছেলেবেলা থেকেই অতীত জিনিসটা আমায় ভাবিয়েছে। না না, আমি দেশ-জাতির ইতিহাস নিয়ে চিন্তিত নই একেবারেই, আমার ঝোঁক ব্যক্তিগত ইতিহাসের দিকে, মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সুখ-দুঃখের গল্প কিংবা যে সমস্ত ভয়ানক কাজ মানুষ মাঝেমধ্যে করে থাকে যার পিছনে আপাতদৃষ্টিতে কোনো যুক্তি বা বিচারবুদ্ধির লেশমাত্র থাকে না।

‘মিস কেলনার,’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ওটা কার কবর গো?’

প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা তাঁর প্যাঁশনে চশমার মধ্য দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘ওরে ছেলে, আমি এটা জানব ভাবছ কেন? আমাকে দেখে কি মনে হয় পাঁচিল ডিঙিয়ে পুরোনো সমাধি দেখতে যাব? তোমার দিদার কাছেই তো জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারো।’

‘দিদা আমাকে কিচ্ছু বলবে না। আর আঙ্কল কেন কিছুই জানেন না, কিন্তু সব জানার ভান করে থাকেন।’

‘তা আমিই-বা কীভাবে জানব?’

‘তুমি তো এখানে বহুদিন ধরে আছ।’

‘মাত্র কুড়ি বছর— আমি এ বাড়ি আসার আগে ওসব ঘটনা ঘটেছিল।’

‘কী ঘটেছিল?’

‘উফ! বেশ নাছোড়বান্দা ছেলে তো! তোমায় সব কিছু জানতে হবে?’

‘না জানার থেকে তো অন্তত ভালো।’

‘তুমি ঠিক বলছ? কোনো কোনো সময় কিছু জিনিস না জানাই বরং ভালো।’

‘কোনো কোনো সময়ে হয়ত – কিন্তু আমার জানতেই হবে, এই রোজ কে ছিল?’

‘তোমার দাদুর প্রথমা স্ত্রী।’

‘ওহো! কী কাণ্ড! এটা আশা করিনি। আমি তো জানতামই না দাদুর আবার প্রথম বিয়েও ছিল। কিন্তু মেয়েটিকে এমন নিরালা জায়গায় কেন গোর দেওয়া হয়েছিল যেখানে সামনেই একটা গোরস্থান রয়েছে।’

‘কারণ সে আত্মহত্যা করেছিল আর তখনকার দিনে আত্মহত্যা করলে সেই মৃতদেহ গোরস্থানে সমাধিস্থ করতে দেওয়া হত না। এবার শান্তি?’

কিন্তু আরও আরও জানার জন্য যে আমার মন ছটফট করছে। প্রশ্ন করলাম, ‘কিন্তু সে আত্মহত্যা করতেই-বা গেল কেন?’

‘শোনো হে, আমি সত্যিই জানি না আর। কী আর হবে, কেন লোকে আত্মহত্যা করে? নিশ্চয়ই সে জীবনে অসুখী ছিল, হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে ছিল।’

 

‘তুমি জীবনে কোনোদিন ক্লান্তি অনুভব করনি— এই যে তুমি হাঁটতে পারো না, আঙুলগুলো সবকটাই এমন বাঁকা বাঁকা?’

‘এরকম খারাপভাবে বলবে না একদম, তাহলে আমার রান্নাঘরে কোনো মিষ্টি পাবে না এর পর থেকে। লেখার জন্য কিংবা বাচ্চাদের পাঁজরের খোঁচা দেবার জন্য আমার আঙুল যথেষ্ট ভালো,’ বলেই আমার পাঁজরে এমন খোঁচা দিলেন যে আমি ‘আঁক’ করে চেঁচিয়ে উঠলাম। তারপর আবার বললেন, ‘আমার জীবন নিয়ে কোনো ক্লান্তি নেই— এখনও পর্যন্ত তো নেই— কিন্তু সব মানুষ তো সমান হয় না, নিশ্চয়ই জানো। আর তোমার দাদু কোনোদিনই আমাদের বলতে চাননি যে আসলে কী হয়েছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক, তিনি আবার বিয়ে করেছিলেন— মানে তোমার দিদাকে।’

‘ইনি কি ওই প্রথমজনের কথা জানতেন?’

‘আমার সেটা মনে হয় না। এ ঘটনার অনেক পরে তাঁর সঙ্গে তোমার দাদুর পরিচয়। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে কোনোদিন তাঁর আগ্রহ দেখিনি।’

‘আর রোজ কীভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন?’

‘সেটা আমার জানা নেই।’

‘অবশ্যই তুমি জানো, মিস কেলনার। আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। তুমি সব জানো।’

আমি এখানে ছিলাম না, তোমায় বলেছি একবার।’

‘কিন্তু তুমি সব শুনেছ। এবং আমি জানি তিনি কীভাবে নিজেকে শেষ করেছিলেন। তিনি ওই আমগাছটিতেই গলায় দড়ি দিয়েছিলেন— পাঁচিলের কোণের ওই আমগাছটা যাকে সবাই এড়িয়ে চলে। তোমায় বলেইছি, আমি গাছটার তলায় একদিন গিয়েছিলাম, কী অসম্ভব ঠান্ডা সেখানে, কী নির্জন— আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তুমি তো সব জানো।’

‘হুম,’ মিস কেলনার আনমনে বললেন, ‘হয়তো সে অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল, বেচারা! মাথার ঠিক ছিল না শেষদিকে, তেমনটাই শুনেছি। একা একাই ঘুরে বেড়াত উদ্ভ্রান্তের মতো, বুনোফুল ছিড়ত, আবার কোনো সময় গান করত আপনমনে, হুটহাট হারিয়ে যেত বাড়ি থেকে, আবার ফিরেও আসত, তার সময়ের কোনো ঠিক থাকত না। এই পুরোনো গানটা শোনো তো—‘লোনলি অ্যাজ দ্য ডেজার্ট ব্রিজ’...দাঁড়কাকের মতো অমন হেঁড়ে গলায় একটা পুরোনো ব্যালাডের শেষ লাইনগুলি গুনগুনিয়ে আবার ফিরে এলেন প্রসঙ্গে, ‘তোমার দাদু তাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি মোটেই মানুষ হিসেবে নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন না। স্ত্রীর কার্যকলাপ এতটাই সহ্য করতেন যে প্রশংসা না করে পারা যায় না। কিন্তু কোনো কোনো সময়ে মেজাজ হারিয়ে প্রচণ্ড বকাবকি করতেন, এক-দু-বার তো ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। তাতে আবার হিতে বিপরীত হত, রোজ ভয়ানক চেঁচামেচি শুরু করে দিত। এই তালাবন্ধ করে রাখাটাই হল সবথেকে বড়ো ভুল— কাউকে কোনোদিন এভাবে আটকে রেখো না হে ছোঁড়া... কী যেন একটা তার ভেতরে ভর করত হঠাৎ হঠাৎ আর সঙ্গেসঙ্গে হিংস্র হয়ে সে এমন সব কাণ্ড করে বসত।’

‘এতসব কথা কীভাবে জানলে গো তুমি?’ আমি মিস কেলনারকে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘তোমার দাদু আগে মাঝেমধ্যে আসতেন, তাঁর নানা সমস্যার কথা বলতেন। আমি তখন অন্য আরেকটি বাড়িতে থাকতাম, এই সামনের রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে। বেচারা, রোজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে খুব চেষ্টা করছিলেন। একসময় তো তাকে রাঁচির মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর চিন্তাভাবনাও করেছিলেন। তারপর একদিন কাকডাকা ভোরে আবিষ্কার করলেন, স্ত্রী সেই আমগাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে। হতভাগ্য মেয়েটির দেহ থেকে তার প্রাণপাখি উড়ে গেছে, ঠিক যেমন সে মাঝে মাঝে নীলপাখি হয়ে ডানা মেলতে চাইত।’

তারপর থেকে আমি আর ওই আমগাছের ধারেকাছে যাইনি। আসলে জায়গাটিতে যেতে আমার বেশ ভয় ভয়ই করত, মনে হত যেন গাছটা কোনো একটা পাপ কাজে অংশ নিয়েছে। বেচারা, নির্দোষ গাছ, বিকৃতমস্তিষ্ক মানুষজনের প্রবল আবেগের দায় তার ঘাড়ে চেপেছে আর কি। কিন্তু আমি ওই উপেক্ষিত সমাধির সামনে যেতাম, আগাছা পরিষ্কার করতাম নিয়মিত যাতে সমাধিতে খোদাই করা লেখাগুলি জ্বলজ্বল করে জেগে ওঠে— ‘রোজ, হেনরির প্রিয়তমা স্ত্রীর উদ্দেশে’ (আমার দাদুর পদবি তার পরে লেখা)। আর মাঝেমধ্যে দুখীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাগান থেকে লাল গোলাপ তুলে সেই সমাধির উপর রেখে দিয়ে আসতাম।

এক বিকেলে দেখলাম দিদা তাসে ব্যস্ত, আঙ্কল কেন হাঁটতে বেরিয়েছেন। আমি টুক করে পেছনের বারান্দার লাগোয়া ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম সব কিছু— ডায়েরি, বিভিন্ন পত্রিকার পাতা উলটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আরম্ভ করলাম, এমন সময়ে স্তূপাকৃত বইয়ের পেছনে আবিষ্কার করলাম পুরোনো দিনের একটা গ্রামাফোন, একতাড়া গ্রামাফোন রেকর্ড আর একটি সুচের বাক্স। সেগুলিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বাকি অংশে তল্লাশি চালাতে লাগলাম। কিন্তু এবার বেরোল ফেলে আসা বছরের একগাদা গানের রেকর্ড, তার মধ্যে আছে রোমান্টিক ব্যালাড, বিশ-ত্রিশ দশকের জনপ্রিয় সব গান সেসব রেকর্ডে। দিদাকে গান-বাজনা শুনতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না, আর দেখে মনে হচ্ছে গ্রামাফোনটি বহু বছর মনুষ্যস্পর্শ পায়নি। সেটিতে রেকর্ড লাগিয়ে চালিয়ে দিলাম— মুহূর্তের মধ্যেই প্রথমবারের জন্য দীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত ঘরটা অপূর্ব সংগীত মূর্ছনায় ভরে উঠল।

 

শুধু একটি গোলাপ

তোমায় দেবার ছিল

শুধু একটি গান

সে তো মিলিয়ে যাবে

হাসি তো থেকেই যাবে

স্মৃতির সরণি বেয়ে

 

রেকর্ডে মিষ্টি প্রেমের গান বেজে উঠতেই সারা ঘরে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ করলাম।

সুরের তালে তালে আমার চারপাশটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এল। অন্ধকার গাঢ় হতেই দেখলাম ঘরটা গোলাপি আভায় ভরে উঠেছে আর সেই দীপ্তিতে এক মহিলার অবয়ব ফুটে উঠল, সাদা শাড়ি পরিহিত সেই মূর্তির ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। আড়ষ্ট হয়ে দেখলাম সে হাঁটছে না, বরং বাতাসে ভেসে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

এমন সময় গান শেষ হলে দেখি ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি গ্রামাফোনটা সযত্নে রেখে দিলাম-- নাহ! আমি ভয় পাচ্ছি না, আমার মধ্যে কেমন অসোয়াস্তি হচ্ছে, মনের মধ্যে একটা বিশ্রী অনুভূতি হতে লাগল— আমি অতীতের স্মৃতির ভার আর বইতে পারছি না।

কিন্তু সেদিন রাতে আবার স্বপ্নে দেখলাম সেই সুন্দরী নারীমূর্তিকে— সেই ছায়ামুর্তি নাচতে নাচতে এগিয়ে যাচ্ছে বাগানের দিকে, কোনো সময় একা একা, আবার কোনো সময় আরও বেশ ক-জন অশরীরী নাচিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। রহস্যময়ী যেন আমায় ডাকছে, তাদের সঙ্গে যোগ দিতে আহ্বান জানাচ্ছে; কিন্তু আমি বারান্দার সিঁড়িতেই ঠায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি সেই অভাবনীয় দৃশ্যের দিকে— ওরা চলে যাচ্ছে, দূরে, আরও দূরে, দেখতে দেখতে বাতাসে মিলিয়ে গেল ছায়াময় নৃত্যশিল্পীর দল।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আশ্চর্য এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম— চোখ মেলে পাশ ফিরতেই দেখলাম শিশির মাখা একটা টকটকে লাল গোলাপ উঁকি দিচ্ছে আমার বালিশের ঠিক পাশে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন