রাস্কিন বন্ড
হোটেলের লবিতে অস্পষ্ট আলোয় লম্বা কালো কোট পরে ও কাকে দেখল বারটেন্ডার রাম সিং? অতৃপ্ত আত্মা? কার? আবার পলকের মধ্যেই ভোজবাজির মতো লাউঞ্জের ছায়ায় মিলিয়ে গেল সে। সঙ্গেসঙ্গেই রাম সিং তার পিছু নিল, কিন্তু লাউঞ্জে তো কেউ নেই! এমন কোনো জানলা বা দরজাও নেই যা দিয়ে ওই লোকটি (যদি আদৌ সে লোক হয়) পালাতে পারে।
রাম সিং-এর পানদোষ নেই, এরকমটাই তার দাবি। আবার তার মন যে কল্পনাপ্রবণ তাও বলতে পারি না।
‘লোকটিকে— মানে এই প্রেতাত্মাটিকে আগে কোনোদিন দেখা গেছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘হ্যাঁ, গত শীতে, আমি সেদিন বলরুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ শুনলাম কেউ যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে। ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখি বলরুমের দরজায় তালা ঝুলছে, তবে কীভাবে কেউ ভেতরে ঢুকবে, বলুন? অগত্যা আমি দেওয়ালের গায়ে লাগানো কাঠের পাটাতনে পা দিয়ে উঠে ঘাড় উঁচু করে একটা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি সেই লোকটা— মাথা ঢাকা টুপি, আমার পিঠ ফেরানো থাকায় মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না, পিয়ানোর টুলে বসে আছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম সেই পিয়ানোয় সুর উঠছে, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বেসামাল হয়ে আমি ফট করে জানালায় টোকা দিয়ে ফেললাম আর সে আমার দিকে মুখ ঘোরালে যা দেখলাম আতঙ্কে শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেল। সেই টুপির মধ্যে যে কোনো মুখ নেই, শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার, মনুষ্যমুন্ডুহীন শুধু টুপিটা যেন আমার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রয়েছে। এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে আমি আর সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না, প্রাণপণে ছুটে একেবারে নিজের ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিলাম। আমাদের ওই পিয়ানোটা এবার বিক্রি করে দেওয়া উচিত, স্যার। এখানে ওই ভূতটা ছাড়া কেউ পিয়ানো বাজানোর নেই।’
মুসৌরির প্রত্যেকটা পুরোনো হোটেলেই এরকম কিছু গপ্পো থাকবেই যার অনেকটাই উদ্ভট আর অবিশ্বাস্য, সে যতই তার অকাট্য প্রমাণ থাকুক। হোটেলের আগের যে মালিক মিস্টার ম্যাকক্লিনটক, নন্দু মাঝেমধ্যেই বলে, তাঁর নাকি একটা নকল নাক ছিল, যদিও সে ওটা কোনোদিনই চোখে দেখেনি পর্যন্ত। তাই হোটেলের বৃদ্ধ কর্মী নেগির কাছে শুধোলাম পুরো ব্যাপারটা। সে সেই ১৯৩২ সাল নাগাদ (বহু বছর হল, তখন আমার জন্মও হয়নি) এ হোটেলে প্রথমে রুম বয় হিসেবে কাজ করতে ঢোকে। এখন দুই বউ নিয়ে তার বয়স প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই আর হোটেলের ফ্রন্ট অফিসটা দেখাশোনা করে। তবে সে জবাব দিল, ঘটনাটা সত্যি।
‘আমি প্রতিদিন ক্লিনটক সাহেবের ঘরে কোকো নিয়ে যেতাম, রাতে ঘুমোবার আগে তিনি ওটি খেতেন কিনা। তারপর ঘর থেকে বেরিয়েই দ্রুত চলে যেতাম তাঁর ঘরেরই একটি জানালার পাশে আর তাঁর ঘুমোতে যাওয়া অবধি লুকিয়ে নজর রাখতাম। আলো নেভানোর আগে শেষ যে কাজটি সাহেব করতেন তা হল, ওই নকল নাকটিকে খুলে তিনি বিছানার পাশের টেবিলে রেখে দিতেন। কোনোদিনই নকল নাক নিয়ে তাঁকে শুতে দেখিনি। বোধ হয় ঘুমোনোর সময় যখন পাশ ফিরতেন কিংবা উপুড় হয়ে শোবার সময় সেটি অসুবিধে সৃষ্টি করত। সকালে উঠেই চা খাবার আগে তিনি আবারও সেই নাকটা লাগিয়ে নিতেন। মস্ত মানুষ ছিলেন এই ম্যাকক্লিনটক সাহেব।’
‘কিন্তু আসল নাকটাই-বা তিনি হারালেন কীভাবে?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
নন্দু বললে, ‘ওঁর বউ কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছিল।’
‘না স্যর,’ নেগি প্রতিবাদ করে উঠল, এই লোকটা আবার প্রবাদপ্রতিম সত্যবাদী, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বুলেটে তাঁর নাক উড়ে গিয়েছিল। পরে তো তাই নাকের বদলে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেলেন, লুপ্ত নাসিকার খেসারত আর কি।’
‘আর যখন মারা যান, তখনও কি ওটা পরেছিলেন?’ আমি কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হলাম।
‘না স্যার,’ নেগি তার গল্পের শেষটা আরও মশলাদার করে তুলল, ‘এক সকালে তাঁর ঘরে চা দিতে গিয়ে দেখি সাহেব মরে কাঠ, নাকটা সেই পাশের টেবিলেই রাখা। একবার মনে হল, ওটা ওখানেই থাক; কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম ম্যাকক্লিনটক সাহেব মানুষটা ভালো ছিলেন, তাঁর নকল নাকের ব্যাপারটা রাষ্ট্র হয়ে যাক, এটা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই সেটাকে আবার তাঁর মুখে যথাস্থানে বসিয়ে ছুটলাম ম্যানেজারকে খবর দিতে। স্বাভাবিক মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু তিনি তাঁর নাকসুদ্ধু যাতে কফিনে যেতে পারেন তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করেছিলাম।’
মানতে দ্বিধা নেই, নেগি লোকটা সত্যিই ভালো এবং সংকটকালে পাশে এমন মানুষই তো দরকার।
ম্যাকক্লিনটকের অশরীরী আত্মাই তবে হোটেলের করিডোরে ঘুরে বেড়ায়, যদিও এখনও পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়নি। সেই প্রেতাত্মা কি এখনও নকল নাক পরে থাকে? বৃদ্ধ নেগি অবিশ্যি তার সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন, হয়তো নকল নাকটা মানুষের বানানো, তাই। তবে তিনিও সেই অশরীরীকে কোনোদিন কাছ থেকে দেখেননি, শুধু হোটেলের বিয়ার গার্ডেনের একেবারে প্রান্তে দুটো অতিকায় দেবদারু গাছের মধ্যিখানে দেখেছিলেন বারকয়েক।
রাইটার্স বারে এমন প্রচুর লোক আসে যারা বহুকাল আগেই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে এবং কিছু কিছু সময়ে জীবিত ও মৃতর পার্থক্য বোঝা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। তবে মানতেই হবে, ভূত তো আসলে তারাই যারা মদ খেয়ে টাকা না মিটিয়েই লোকজনের ভিড়ে স্যাঁত করে সটকে পড়ে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন