প্রেত পাহাড়ের বাতাস

রাস্কিন বন্ড

প্রেত পাহাড়ের বাতাস

হু-হুউউ-হুউউউউ— একটানা আর্তনাদ করে বাতাস বয়ে চলেছে, হিমালয়ের কোলে তুষারপাত শুরু হয়েছে। পাহাড়ের উপর দিয়ে বাতাসের বেগ বাড়ছে, উঁচু উঁচু পাইন দেবদারু বনে তার একটানা গুনগুন ধ্বনি উঠছে, চাপা গোঙানি ছড়িয়ে পড়ছে অরণ্যের আনাচেকানাচে।

প্রেত পাহাড়ের মাথায় বাতাসকে বাধা দেবার মতো কেউ নেই বললেই চলে— থাকবার মধ্যে আছে কয়েকটা খর্বকায় গাছ, ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ঝোপঝাড় আর কিছু ধ্বংসাবশেষ, এককালে সেখানে ছোটোখাটো কোনো বসতি ছিল।

ঠিক পরের পাহাড়টির ঢালে রয়েছে একটা ছোট্ট গ্রাম। সেখানকার মানুষজন তাদের টিনের ছাদের উপর বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই ফেলে রাখে যাতে হাওয়ার চোটে সে টিনের চাল উড়ে চলে না যায়। প্রায় প্রতি মুহূর্তেই এই অঞ্চলে হাওয়ার দাপট টের পাওয়া যায়। এমনকী রোদ-ঝলমলে দিনগুলিতেও দরজা-জানালা খটখট করে ওঠে, চিমনিগুলো আটকে যায়, জামাকাপড় উড়ে যায়।

তিনটে বাচ্চা নীচু পাথরের দেওয়ালের ধারে দাঁড়িয়ে ভিজে জামাকাপড় পেতে দিয়েছিল শুকোনোর জন্য। প্রত্যেকটির উপর একটি করে পাথরের টুকরো রেখে দিয়েছিল। কিন্তু তাও সেগুলি ছোটো ছোটো পতাকার মতো পতপত করে উড়ছিল।

দাদামশাইয়ের লম্বা ঝুলের ঢিলেঢালা জামাটা সামলাতে ঊষা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিল। এগারো কি বারো বছরের একরত্তি মেয়ে সে, মাথায় কাজল কালো চুল, টুকটুকে গোলাপের মতো নরম গাল। তার একটা ভাই আছে, নাম সুরেশ, সে বিছানার চাদরটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছিল আর তাদের থেকে বয়সে সামান্য বড়ো বিন্যা, সে ঊষার বন্ধু এবং প্রতিবেশি ও বটে, জামাকাপড়গুলো এক এক করে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছিল।

একদিন তারা দেওয়ালের উপর জামাকাপড়গুলো পেতে তার উপর পাথরের টুকরো চাপা দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত মনে চ্যাপটা পাথরগুলোর উপর বসে রোদ পোয়াচ্ছিল, হাওয়াও দিচ্ছিল বেশ ফুরফুর করে। তিনজনে চুপচাপ মাঠ পেরিয়ে সামনে প্রেত পাহাড়ের গায়ে ধ্বংসাবশেষের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

‘আমায় আজ বাজারে যেতেই হবে,’ ঊষা বলে উঠল।

‘ইস, আমিও যদি আসতে পারতাম। কিন্তু বাড়িতে মেলা কাজ পড়ে আছে, গোরুর কাজ, ঘরের কাজ, মায়ের আবার শরীরটা ভালো না যে,’ বিন্যা মন খারাপের সুরে কথাগুলি বলল।

‘আমি যাব, আমি যাব,’ সুরেশ লাফিয়ে উঠল। বাজারে যাবার নাম শুনলেই সে এক পায়ে খাড়া। প্রেত পাহাড়ের ওপাশটায় তিন মাইলটাক গেলেই বাজার।

‘না, তুই যাবি না,’ ঊষা ধমক দিল, ‘দাদামশাই কাঠগুলো কাটবে, তাকে সাহায্য করবি।’

ওদের বাবা আছে সেনাবাহিনীতে, দেশের কোন প্রান্তে বহুদূরে তার পোস্টিং। বাড়িতে পুরুষমানুষ সে আর তার দাদামশাই। সুরেশের বয়স আট পেরিয়েছে, নাদুসনুদুস চেহারা, পটলচেরা চোখ।

‘একা একা ফিরবে, ভয় করবে না?’ সে জিজ্ঞাসা করল।

‘ভয় করবে কেন?’

‘ওই পাহাড়ে ভূতেরা থাকে।’

‘আমি জানি, কিন্তু অন্ধকার নামার আগেই আমি ফিরে আসব,’ ঊষা বলল, ‘আর ভূতেরা দিনের আলোয় বেরোয় না।’

‘ওই ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর মধ্যে কি অনেক ভূত আছে?’ বিন্যা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল।

‘দাদামশাই তো তাই বলে। অনেক অনেক বছর আগে— প্রায় এক-শো বছরেরও বেশিই হবে— ওই পাহাড়ে ইংরেজরা থাকত। কিন্তু জায়গাটা ছিল বড্ড বাজে, বৃষ্টি হলেই শুধু বাজ পড়ত। তাই ওরা এ পাহাড় ছেড়ে অন্য পাহাড়ে গিয়ে বাড়ি-টাড়ি করল শেষমেষ।’

‘যদি ওরা চলেই গিয়ে থাকে, তবে সেখানে কোনো ভূত থাকবে কেন?’

‘কারণ, দাদামশাই বলছিল, একবার এক ঝড়ের রাতে বাজ পড়ে ওখানকার একটি বাড়ির সব্বাই মরে গেল, সব্বাই, এমনকী বাচ্চাগুলোও।’

‘ওই বাড়িতে কি অনেকগুলো বাচ্চা ছিল?’

‘শুধুমাত্র ভাই-বোন দু-জন। রাতের বেলা ওই ভাঙা বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে ফেরার সময় দাদামশাই অনেকবার দেখেছে ওদের, আমাকে সে বলেছে একথা, চাঁদের আলোয় ভাই-বোন নাকি এখনও খেলা করে।’

‘দাদু দেখে ভয় পায়নি বুঝি?’

‘না, বুড়ো মানুষরা ভূতে ডরায় না।’

দুপুর গড়ালে বেলা দুটোর দিকে ঊষা বাজারের দিকে রওনা দিল। সামনে প্রায় এক ঘণ্টার পথ। সরষে ফুলের হলুদ চাদর বিছোনো খেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে এগিয়ে চলল, সামনেই পাহাড়। এরপর পাহাড়ের পিঠ বেয়ে উঠতে লাগল, আরেকটু উঠলেই সেই অভিশপ্ত ধ্বংসাবশেষ।

এই পথ সোজা চলে গিয়েছে ওই ভগ্নাবশেষের মধ্যে দিয়ে, ঊষা এটা জানত ভালো করেই। মাঝেমধ্যে সপ্তাহের বাজার সারতে কিংবা শহরে মাসির বাড়ি যেতে সে এই পথেই যাতায়াত করত।

ভাঙা দেওয়ালগুলির মাঝে মাঝে বুনো ফুল ফুটে আছে, একদা যেটি ছিল বিশাল হল ঘর তার মেঝে ফুঁড়ে উঠে গেছে এক বুনো কুল গাছ। সাদা সাদা নরম ফুল ঝরে পড়ছে সে-গাছ থেকে। পাথরের গা বেয়ে একটা টিকটিকি দ্রুত সরে গেল। ঠিক তখনই শিস দিতে দিতে একটা থ্রাশপাখি শিকভাঙা জানালায় এসে বসল, সূর্যের আলোয় তার বেগুনি রঙের পালক ঝলমলিয়ে উঠল, তারপরেই শুরু হল তার হৃদয় উজাড় করা সংগীত।

আপন মনে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ছোট্ট ছোট্ট লাফে এগিয়ে চলে ঊষা। অচিরেই পেছনে পড়ে থাকে সেই ধ্বংসাবশেষ। সামনে পথ খাড়া হয়ে নেমে গেছে উপত্যকায়, সেখানেই রয়েছে একটি ছোটো শহর আর তার একটু দূরেই বিচ্ছিন্ন সেই বাজার।

ঊষা বাজারে কাটাল বেশ কিছু সময়। সেখান থেকে টুকিটাকি যেমন সাবান, দেশলাই, মশলা, চিনি (গ্রামে দোকানপাট নেই, তাই এসব পাওয়াও যায় না) আর ঠাকুরদার হুঁকোর নল এবং সুরেশের জন্য অঙ্কের খাতা। তারপর কী মনে হল, সে ক-টা মার্বেল কিনে গেল মুচির দোকানে, তার মায়ের চটিটা সারাই করতে হবে। মুচি তখন খুব ব্যস্ত, তাই চটিজোড়া তার কাছে দিয়ে সে বলে গেল, আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসে তা নিয়ে যাবে।

সবশেষে ঊষা দেখল দু-টাকা তখনও বেঁচে। বাজারের একদম শেষপ্রান্তে এক বুড়ি তিব্বতি মহিলা তার ছোট্ট দোকানে বসে জপের মালা, পুঁতির হার, তাবিজ, কবচ ইত্যাদি নানা মনিহারি জিনিসপত্র বিক্রি করে। সেই বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে ওই মহিলার থেকে সে নিজের জন্য একখানা হলদে রঙের পুঁতির মালা কিনল।

এরপর পথেই দেখা লক্ষ্মীমাসির সঙ্গে। সে আবার তাকে তার বাড়িতে নিয়ে বসিয়ে চা খাওয়ালে।

ঊষা প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিল দোকানগুলির ওপরে লক্ষ্মীমাসির ছোট্ট ঘরটায়। মাসি তাকে তার বাঁ-কাঁধের যন্ত্রণার কথা, গাঁটের ব্যথার কথা শোনাল। এরপর দু-কাপ গরম গরম মিষ্টি চা খেতে খেতেই তার চোখ পড়ল জানালার বাইরে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দূরের পাহাড়ের উপর ধীরে ধীরে কালো মেঘ জমছে।

ঊষা তখন ছুট দিল মুচির কাছে, সেখান থেকে মায়ের চটিজোড়া নিয়ে দেখল বাজারের ব্যাগ ভরতি হয়ে গেছে। তাই সেটাকে এবার কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে হাঁটা দিল গ্রামের দিকে।

আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। গাছগুলো সব স্থির দাঁড়িয়ে, একটা পাতাও নড়ছে না। ঘাসের মধ্যে ঝিঁঝিপোকাগুলো এক লহমায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কতকগুলো কাক আকাশে পাক খেতে খেতে নেমে এল একটা ওক গাছের ডালে, ওখানেই রাত কাটবে তাদের।

‘আমায় অন্ধকার হবার আগেই বাড়ি পৌঁছোতে হবে,’ আপনমনে বলতে বলতে ঊষা দ্রুত পা চালাল। কিন্তু ততক্ষণে আকাশ কালো হয়ে এসেছিল। ঘন কৃষ্ণকায় মেঘপুঞ্জ, দেখলেই মনে ভয় জাগে, ছেয়ে ফেলেছে প্রেত পাহাড়কে। ঠিক তখুনি ঊষা টের পেল, ওর গালে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটি আঘাত হানল।

সঙ্গে তো কোনো ছাতাও নেই; এই ক-ঘণ্টা আগেই আবহাওয়াটা কত সুন্দর ছিল। এখন উপায় পুরোনো স্কার্ফটা মাথায় ভালো করে পেঁচিয়ে নেওয়া আর শালটাকে কাঁধের উপর ফেলে কষে বেঁধে দেওয়া। বাজারের ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে ধরে হাঁটার বেগ বাড়াল ঊষা। এখন সে আর হাঁটছে না, প্রায় দৌড়োচ্ছে বলা যায়। কিন্তু তার হাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির বেগও বাড়তে লাগল। এবারে বড়ো বড়ো ভারী ফোঁটা পড়া শুরু হল।

অকস্মাৎ চোখ ধাঁধিয়ে পাহাড়ের উপর বিদ্যুতের ঝলকানি। পলকের জন্য সামনে স্পষ্ট ফুটে উঠল সেই ধ্বংসাবশেষ। তারপর আবার ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল চারপাশ। রাত্রি নেমেছে।

‘ঝড় শুরু হবার আগে বোধ হয় বাড়ি পৌঁছোতে পারব না,’ চিন্তা করল ঊষা, ‘আমাকে ওই ভাঙা বাড়ির মধ্যেই আশ্রয় নিতে হবে।’ যদিও সামনে কয়েক ফুট অবধিই দেখা যাচ্ছিল, তবুও এ রাস্তা তার ভালো করেই চেনা, তাই সে দৌড়োতে শুরু করল শেষমেষ।

আচমকা, জোরে বাতাস বইতে লাগল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগল ঊষার মুখে-চোখে। কী কনকনে ঠান্ডা সে-জল, বাপ রে! সে চোখ খুলতেই পারছিল না।

বাতাসের বেগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। তার সঙ্গে সঙ্গে একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ উঠল আর সঙ্গে যেন সেই বাতাসের চাপা নিশ্বাসের শব্দ। ঊষাকে আর এর সঙ্গে লড়তে হল না। ততক্ষণে সে ওই বাতাস পিছনে রেখে তরতর করে এই খাড়া পাহাড়ে উঠতে লাগল।

আবার বিদুতের চমক, আর তার পরে উচ্চনাদে বজ্রপাত। তার চোখের সামনে জেগে উঠল সেই ধ্বংসস্তূপ, কেমন যেন বিকট আর ভয়ানক দেখাচ্ছে, দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে।

সে জানত, বাড়ির একটা কোনায় এখনও পুরোনো ছাদের কিছু অংশ টিকে আছে। একটা আশ্রয় তো হবে। এই মুহূর্তে আর এগোনোর থেকে এটাই বরং ভালো। এই অন্ধকারে, হাওয়ার গর্জনের মধ্যে এগোতে গেলে পথভ্রষ্ট হয়ে খাড়া পাহাড়ের কিনারায় চলে যাবার প্রবল সম্ভাবনা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন