শিস

রাস্কিন বন্ড

শিস

আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে, সামনেই পূর্ণিমা বোধ হয়। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় পথে আলোর বন্যা। কিন্তু এর মধ্যেই আমায় নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছে গাছের ছায়ারা, ওক গাছের আঁকাবাঁকা ডালগুলি যেন আমায় ছুঁতে চাইছিল, কোনো কোনোটার ভাবগতিক দেখে ভয় হয়, আবার কেউ এমন যেন আমার বন্ধু হতে চায়।

একসময় আমি স্বপ্ন দেখতাম গাছেরা সব হেঁটে বেড়াচ্ছে, এমন চাঁদনি রাতে কিছুক্ষণের জন্য নিজেরাই নিজেদের শিকড় উপড়ে উঠে আসছে, পড়শি-স্বজন-বান্ধবদের সঙ্গে মোলাকাত করছে, বাক্যালাপ চলছে, পুরোনো দিনের নানান কথাবার্তায় সরগরম গোটা মহল্লা— যুগ যুগ ধরে কতই না মানুষজন দেখেছে তারা, কত ঘটনা, বিশেষ করে পুরোনো আমলের। তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই ঠিক টুক করে চলে আসছে যে যার জায়গায়, অদৃষ্টের লিখন যার যেখানে। রাতের নিঃসঙ্গ প্রহরী তারা। তাদের হাঁটাচলার জন্য দুর্দান্ত এই রাত, আসতে আসতে এমনই ভাবছিলাম। তারা যেন সেই আশাতেই মুখিয়ে আছে, তারা হাঁটতে চায়, শুনতে পাচ্ছিলাম অশান্ত মর্মর ধ্বনি, ডালে ডালে তীব্র ঘর্ষণের কিরকির আওয়াজ, কেবল তাদের অন্তরের এই শব্দেই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল।

রাতের অন্ধকারে পথে দু-একবার কিছু লোকজন যেতে দেখলাম। এমন কিছু দেরি হয়নি তখনও, ঘড়িতে সবে আটটা বাজে। কিছু মানুষজন এর মধ্যেই বাড়ির পথ ধরেছে। আবার কেউ কেউ শহরের দিকে যাচ্ছে। রাত নামলেই চারিদিকে ঝলমলে আলো, সারি সারি দোকান-রেস্তরাঁ জেগে ওঠে— তার আলাদা টান। এ রাস্তায় আবার আলো নেই, বুঝতে পারলাম না কারা? তারাও আমায় দেখতে পেল না। অনেককাল আগের একটা গান মনে পড়ে গেল, ছোটোবেলায় খুব শুনতাম। সুরটা মৃদুস্বরে গুনগুন করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে কথাগুলো মনে পড়ে গেল,

 

আমরা তিনজন

আমরা একা নই

আমরা তো বন্ধু নই

আমার প্রতিধ্বনি

আমার ছায়া

এবং আমি...

 

আমি মাথা নীচু করে আমার ছায়ার দিকে তাকালাম, নিঃশব্দে সে আমার পাশে পাশে চলেছে। আমরা তো ধরেই নিয়েছি সে এইভাবেই চলতে থাকবে, ভুল বললাম কিছু? জীবনের প্রতি মুহূর্তেই ছায়ারা আমাদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী, কিন্তু কোনো কিছু নিয়েই তাদের কোনোরকম অভিযোগ নেই, নির্বাক, মুখে কুলুপ এঁটে আমাদের যত কাজকর্ম, ঠিক-ভুলের নীরব সাক্ষী তারা। এই উজ্জ্বল জ্যোৎস্নারাতে তোর দিকে না তাকিয়ে পারছি না যে, ছায়া। আমার খুব দুঃখ হয়, ভাবি, তোকে আমার এমন এমন কাজকম্মো দেখতে হয় যার জন্য লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়া উচিত, আবার আনন্দও যে হয় যখন দেখি আমার ছোটো ছোটো জয়ের মুহূর্তেও তুই আমায় ছেড়ে যাসনি, পাশেই আছিস। আর আমার প্রতিধ্বনির কী হল? একবার ভাবলাম চেঁচিয়ে দেখি, সে ফেরত আসে কি না। কিন্ত শেষমেষ তা আর করলাম না, আসলে পর্বতশ্রেণির এই নিগূঢ় নিস্তব্ধতা বা গাছেদের একান্ত আলাপে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না।

পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা পাক খেতে খেতে উঠে সেই চুড়োয় গিয়ে মিশেছে, ঠিক যেন মনে হচ্ছে লম্বা লম্বা দেবদারু গাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে চাঁদের আলোর ফিতে সারা পাহাড়ের গায়ে জড়ানো। একটা উড়ুক্কু কাঠবেড়ালি এর মধ্যেই রাস্তা কেটে উড়ে গেল, এক গাছ থেকে অন্য গাছে। কোনো এক রাতচরা পাখি ডেকে উঠল। বাকি সব শান্ত, নিঝুম।

ধীরে ধীরে পুরোনো গোরস্থানটি চোখের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। সেখানে সার সার প্রাচীন কবর, কিছু কিছু বেশ বড়ো, নির্দিষ্ট স্মারক বয়ে চলেছে, আবার কিছু নতুন কবরও আছে, কারণ গোরস্থানটি এখনও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোনোটার উপর হয়তো কিছু ফুল ছড়ানো, শুকিয়ে আসা ডালিয়া বা বেগুনি রঙের সালভিয়া। আর গোরস্থানের চারিদিক ঘিরে থাকা পাঁচিল, তার একটা অংশ গত বছরের প্রবল বর্ষায় পুরোটাই ধসে গেছে। কবরগুলির উপরকার কিছু কিছু স্মৃতিস্তম্ভও দেওয়ালের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। একটি কবর খোলা আকাশের নীচে পড়ে আছে, পাথরের ঢাকাটা নেই। মানুষটা তো আমার তোমার মতো বেঁচে ছিল এককালে, তাকে কেউ ভালোবেসেছিল, কিন্তু নিয়তির কী খেলা দেখো, হতভাগ্য সেই মানুষটার শেষ চিহ্ন বলতে শুধু একটা নষ্ট হয়ে আসা কফিন আর কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাড়গোড়।

কিছু কিছু সমাধিপ্রস্তর রাস্তার ধারে পড়ে আছে, ওপরের লেখাগুলি যদিও কালের নিয়মে মিলিয়ে গেছে। বিষণ্ণতা আমায় খুব একটা গ্রাস করে না কোনোদিনই, তবু কিছুটা এগিয়েও কী মনে হল থামলাম, তারপর মাটি থেকে একটা মসৃণ গোলমতো হাড় কুড়িয়ে নিলাম, মনে হয় খুলির কোনো একটা অংশ। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড! হাতের মুঠোয় ভালো করে নিতেই আপনা-আপনিই সেটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে সারা ঘাসে ছড়িয়ে পড়ল। ধুলো, সব ধুলো হয়ে যায়।

আর তখনই কানে এল শব্দটা, খুব দূরে নয়, কোথা থেকে যেন ভেসে ভেসে আসছে, কেউ যেন শিস দিচ্ছে এমন।

প্রথমে মনে হল, কেউ বুঝি আমার মতোই ভরসন্ধেবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে, আমি যেমন গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে চলেছি সেও তেমনি আপনমনে শিস দিতে দিতে চলেছে। কিন্তু সে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে বুঝতে পারছিলাম, ক্রমশ শিসের আওয়াজ জোরালো হচ্ছে, মনের আনন্দে সে সুর তুলেছে। হঠাৎ দেখি তীব্র গতিতে একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল। মনে হল তাকে আমি এক পলক দেখলাম, তারপরেই রাস্তার অন্ধকারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। আর দেখতে পেলাম না।

কিন্তু কয়েক মিনিট বাদে সে আবার ফিরে এল। এইবার আমার থেকে কয়েক ফুট দূরে সাইকেল থামাল। দেখি আমার দিকে তাকিয়ে সে মিটিমিটি হাসছে, যেন ব্যঙ্গ করছে। চোদ্দো-পনেরো বছরের ঈষৎ শ্যামবর্ণ একটি ছেলে, গায়ে স্কুলের কোট, গলায় হলুদ স্কার্ফ জড়ানো, চোখে যেন জ্যোৎস্না টলটল করছে।

‘তোমার সাইকেলে বেল নেই?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

সে নিরুত্তর, শুধু এক পাশে মাথা হালকা হেলিয়ে একটু হাসল। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম সামনে, ভাবলাম সে বুঝি হাত মেলাবে। কিন্তু হঠাৎ দেখি, সে আবার খোশমেজাজে শিস দিতে দিতে হাওয়া হয়ে গেল, তবে এবারে তাতে কোনো সুর খুঁজে পেলাম না। নিতান্তই এক ইস্কুল বালক, শিস দিতে দিতে চলেছে। তবে এই সময়ে এই বয়সের কোনো ছেলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে মানে এখুনি সে বেশ স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছে।

ক্রমে শিসের আওয়াজ ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে গেল। এক অতি গভীর নিস্তব্ধতা সারা বন জুড়ে চেপে বসল। শব্দের প্রবেশ যেন সেখানে নিষেধ। আমি আর আমার ছায়া হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে বাড়ি ফিরলাম।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল এক অন্যরকম শিসের শব্দে, জানলার বাইরে থেকে থ্রাশ পাখির অপূর্ব সুরেলা ডাক ভেসে আসছিল।

সে এক চমৎকার দিন বটে, উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় ঘর ভেসে যাচ্ছে, দারুণ এক অনুভূতি। মনে হচ্ছিল, সারাদিন এই খোলা জানলার ধারে বসে থাকি। কিন্তু আমার আবার অনেক কাজ পড়ে, একগাদা প্রুফ চেক করতে হবে, কিছু চিঠিপত্তর লিখতে হবে। তাই সেদিনের মতো নিরস্ত করলাম নিজেকে। এর বেশ কিছুদিন বাদে আবার গিয়েছিলাম সেই পাহাড়চুড়োয়, দেবদারু গাছের নীচে সেই শান্ত, নির্জন স্থানে যেখানে সবাই চিরশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! বরফে ঢাকা উজ্জ্বল পাহাড়চূড়ার অপূর্ব দৃশ্য যাদের খুব কাছ থেকে দেখতে পাওয়ার কথা আজ তারাই মাটির কত গভীরে শুয়ে আছে।

গোরস্থান সংস্কারের কাজ চলছিল সেদিন। পাঁচিলের বাকি যে অংশ এখনও দাঁড়িয়ে আছে তাকেই কোনোরকমে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। তবে ওভারশিয়ার ভদ্রলোক বললেন, নষ্ট যাওয়া কবরগুলি সারানো সম্ভব নয়, অত টাকার জোগান নেই এখন। এরপর চৌকিদারের সাহায্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাড়গোড়গুলো সব জড়ো করে ওই ভেঙে যাওয়া সমাধির মধ্যেকার অগভীর ফাঁকা অংশে দিয়ে দিলাম, তারপর লোকটাকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, ভাঙা সমাধিটা যেন তাড়াতাড়ি সারিয়ে দেয়। সমাধি পাথরের উপর নামটা লেখা ছিল, তা প্রায় উঠেই গেছে। তবে অনেক কষ্টে তারিখটা পড়া গেল, ১৯৫০ সালের ২০ নভেম্বর, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার...কিন্তু সমাধি-পাথরে খোদাই করা লেখা এত তাড়াতাড়ি উঠে যেতে দেখিনি কখনো।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন