রাস্কিন বন্ড
আমাদের পাহাড়ি এলাকার বাজারে একটি দোকান ছিল, রাজ্যের আবর্জনা ডাঁই করা সেখানে। অন্ধকার, নোংরা, বিবর্ণ হয়ে আসা দোকানঘর, আমি মাঝেমধ্যে সেখানে যেতাম, এমনি বইপত্র যদি কিছু পাওয়া যায় বা ভিক্টোরিয়ান আমলের ভালো জিনিসপত্র খোঁজাখুজি করতাম। কেউ কেউ নাকি সে দোকানে ঘর-গেরস্থালির দরকারি জিনিসপত্রও পেয়ে যেত, কিন্তু আমি সেরকম কিছু দেখিনি কোনোদিন। তবে আমায় আকর্ষণ করেছিল দোকানের এক কোণে দাঁড় করানো একটা ঝাড়ু, পুরোনো বটে কিন্তু তখনও বেশ ঠিকঠাকই ছিল। ঠিক এই ধরনেরই লম্বা হাতলওয়ালা ঝাড়ু আমার খুব দরকার ছিল। আমার কোনো কাজের লোক নেই, তাই কটেজ ঝাঁট দেওয়ারও কেউ নেই। আর ওই সাধারণ ছোটো হাতলওয়ালা ঝাড়ু দিয়ে কোমর দ্বিগুণ বাঁকিয়ে ঝুঁকে ঝাঁট দেওয়া আমার মোটেই পছন্দের নয়।
কিন্তু দোকানি পু্রোনো ওই ঝাড়ুর দাম চাইল দশ টাকা। আমি ধুন্ধুমার দরাদরি করে সেটিকে পাঁচ টাকায় নামিয়ে আনলাম।
ঝাড়ুটা বেশ শক্তপোক্ত, দেখতেও মজবুত। প্রত্যেকদিন সকালে এটি দারুণ কাজ দিচ্ছিল। এখন এখানেই গল্পটা শেষ হতে পারত, বা গল্পটা শুরুই হত না যদি বাগানের পাঁচিলে একটা বড়োসড়ো কালো বেড়ালকে বসে থাকতে না দেখতাম।
উজ্জ্বল হলুদ রঙের চোখে তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, বেড়ালটা আমায় মাপছিল, যেন ঠিক কতটা সুযোগ-সুবিধা আমার থেকে আদায় করা যায় ইত্যাদি হিসেব-নিকেশ চলছিল তার মনে। আমার দিকে তাকিয়ে দু-একবার ম্যাও করে ডাকল বটে কিন্তু আমি পাত্তা দিলাম না। বেড়াল নামক প্রাণীটিকে আমি কোনোদিনই লাই দিই না বটে। কিন্তু এইবেলা দেখলাম ব্যাটা আমার পিছু পিছু আসছে, তারপর এসে ভাঁড়ার ঘরের দরজায় তীব্র আঁচড় কাটতে লাগল।
দেখে মনে হচ্ছিল, বেচারার খুব খিদে পেয়েছে, তাই কিছুটা দুধ এনে দিলাম।
দুধটা চেটেপুটে শেষ করার সময় বারকয়েক গররর আওয়াজ করল বেড়ালটা, তারপর এক লাফে কাবার্ডের উপর উঠে আয়েশ করে বসল।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও তার থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখলাম না। প্রাণীটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল ও-ই বাড়িটার মালিক আর নিতান্তই করুণা করে আমাকে ওর বাড়িতে মেনে নিচ্ছে। আরও অদ্ভুত, বেড়ালটার আমার থেকেও আমার ওই সদ্য কেনা ঝাড়ুতে বেশি আগ্রহ। আমি যখন ঘর ঝাঁট দেব তখন ওই ঝাড়ুটার চারদিকে নেচে বেড়াবে, উলটে শুয়ে পড়বে। আবার যখন ঝাড়ুটা দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা থাকবে, বেড়ালটা ওটির গা বেয়ে উঠে পড়ে হাতলে গা ঘষবে আর মুখ দিয়ে গর গর আওয়াজ করবে।
বেড়াল আর ঝাড়ু— এই সম্পর্ক শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইঙ্গিতবাহী এবং নানান সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। এই কটেজটি বহু পুরোনো, তা প্রায় এক-শো বছরের তো হবেই আর ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়, এই দীর্ঘ সময়ে কতরকম মানুষ এখানে বাস করে গেছে। আমি এ বাড়িতে আছি মাত্র এক বছর হল। হিমালয়ের কোলে ওক গাছের জঙ্গলে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে এই কটেজটি, কিন্তু কোনোদিনই ভূত বা প্রেতাত্মা জাতীয় কিছুর সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়নি।
জুলাইয়ের মধ্যিখানে মিস বেলোস এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি কটেজের বাইরে পাথুরে রাস্তায় তাঁর লাঠির ঠুকঠুক আওয়াজ পাচ্ছিলাম। সে-আওয়াজ থামল গেটের সামনে।
‘মিস্টার বন্ড!’ জাঁদরেল গলায় ডাকলেন, ‘আপনি কি বাড়ি আছেন?’
তখন বাগানে কিছু কাজ করছিলাম, মাথা তুলে দেখলাম বৃদ্ধ এক ইংরেজ মহিলা ঋজু শরীরে দাঁড়িয়ে, গেটের ওপার থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
হাতের নিড়ানিটা ফেলে বললাম, ‘গুড ইভনিং।’
‘আমার বিশ্বাস, আমার বেড়ালটা আপনার কাছেই আছে,’ মিস বেলোস বললেন।
ব্যাপার হল, আমি ভদ্রমহিলাকে এর আগে কোনোদিন দেখিনি, কিন্তু ওঁকে বিলক্ষণ চিনি, কারণ এই হিল স্টেশনের সবথেকে পুরোনো বাসিন্দা হিসেবে ওঁর বেশ নামডাক আছে।
‘আমার কাছে একটা বেড়াল আছে বটে,’ আমি বললাম, ‘যদিও ঠিকঠাক বলতে গেলে বেড়ালটার আশ্রয়েই আমি আছি। যদি ওটা আপনার বেড়াল হয়, তার কাছে আপনি আসবেন বই কী। আচ্ছা, আপনি ভেতরে আসছেন না কেন? আমি ততক্ষণে খুঁজে দেখি সে কোথায় গেল।’
মিস বেলোস ভেতরে এলেন। একখানা সেকেলে কালো পোশাক পরেছেন আর হাতে ওয়ালনাট কাঠের একটা লাঠি, সেটির দু-তিন জায়গায় বাঁকানো আর হাতলের বদলে লাঠির মাথাটা গোলমতো।
ভদ্রমহিলা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসলেন, আমি তখন বেড়ালটাকে খুঁজতে গেলাম। সে যথারীতি রহস্যজনকভাবে উধাও। আমি চেনা কায়দায় বার কয়েক ডাকলাম কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না। আমি জানি সে কাছেপিঠেই কোথাও আছে—কিন্তু বেড়াল প্রাণীটা এমনই, স্বেচ্ছাচারী, জেদি প্রাণী।
শেষমেষ যখন বসার ঘরে এলাম, দেখলাম বেড়ালটা মিস বেলোসের কোলে গুটি পাকিয়ে বসে আছে।
‘ও, পেয়ে গেছেন দেখছি, আচ্ছা, যাওয়ার আগে কি একটু চা খাওয়া যায়?’
‘না, ধন্যবাদ,’ মিস বেলোস বললেন, ‘আমি চা খাই না।’
‘তবে কড়া কিছু, একটু ব্রান্ডি?’
তিনি এবার কড়া চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি খানিকটা অপ্রতিভ হয়ে দ্রুত বললাম, ‘আমি যে খুব বেশিমাত্রায় পান করি তা নয়, তবে ওই আর কী, অল্পস্বল্প রাখা থাকে জরুরি কোনো দরকার হয়ে পড়লে। ঠান্ডা রুখতে দারুণ কার্যকরী। অসম্ভব শীতে এটা কিন্তু বেশ ভালো কাজ দেয়,’ আমি আমতা আমতা করে বললাম।
‘আপনার কেটলিতে জল ফুটছে দেখছি,’ উনি বললেন, ‘একটু গরম জল হবে?’
‘গরম জল? নিশ্চয়ই,’ আমি তখন কিঞ্চিৎ বিহ্বল। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই মিস বেলোসকে চটাতে চাইলাম না।
‘ধন্যবাদ, আর একটা গ্লাস।’
তিনি এবার গ্লাসটা নিলেন, আমি ওদিকে কেটলিটা আনতে গেলাম। খেয়াল করলাম, এবার তাঁর বিশাল পোশাকের একটা পকেট থেকে দুটি ছোট্ট ছোট্ট প্যাকেট বার করলেন, ওই অনেকটা কেমিস্টের পাউডার ভরা থাকে সেইরকম প্যাকেট। দুটো প্যাকেটই খুলে প্রথমে পার্পল রঙা এবং এর পরে ক্রিমসন রঙা পাউডার ওই গ্লাসে ঢাললেন। কিছুই হল না যদিও।
‘এবার জলটা দিন, দয়া করে,’ উনি বললেন।
‘গরম, ফুটন্ত কিন্তু!’
‘কোনো ব্যাপার না।’
আমি তখন ওই ফুটন্ত জল ওঁর গ্লাসে ঢাললাম। অবাক কাণ্ড! সঙ্গেসঙ্গে ভয়ানক সাঁ সাঁ শব্দ হতে লাগল আর হু-হু করে ফেনা উথলে উঠল... যেমন ফেনিল শূন্যগর্ভ এক সময়ে গোটা একটা চক্রে পরিণত হয়। তীব্র কটু গন্ধ ছড়িয়ে গেল চারপাশে। মিশ্রণটি এতটাই গরম হয়ে উঠেছিল আমি ভাবলাম এক্ষুনি গ্লাসটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। কিন্তু সেসব কিছু হওয়ার আগেই মিস বেলোস গ্লাসটি ঠোঁটে ছোঁয়ালেন আর সুড়ুৎ করে খেয়ে ফেললেন। সব দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
‘আমার মনে হয়, এবার যাওয়া উচিত,’ বলে তিনি গ্লাসটা রাখলেন আর ঠোঁটটা মুছে নিলেন। বেড়ালটা শূন্যে লেজ খাড়া করে আওয়াজ করে জানান দিল, সে প্রস্তুত। মিস বেলোস বললেন, ‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম, ইয়াং ম্যান।’
‘ডোন্ট মেনশন ইট,’ আমি গদগদ হয়ে বললাম, ‘অলয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন