জিন বিভ্রাটে

রাস্কিন বন্ড

জিন বিভ্রাটে

আমার বন্ধু জিমির একটাই হাত। পঁচিশ বছর বয়সে সে অন্যটি খুইয়েছে। তার এই ডান হাত হারানোর গল্প বিশ্বাস করা শক্ত, কিন্তু এর যে প্রতিটি বর্ণ সত্যি তা আমি হলফ করে বলতে পারি।

শুরুতেই বলে রাখি, এই জিমি আদপে কিন্তু একটি জিন এবং সে এখনও নিশ্চয়ই বহাল তবিয়তে আছে আর জিন আসলে মানুষের মতো কোনো প্রাণী নয়। তারা আত্মা টাইপের একধরনের বায়বীয় জীব যারা মানুষের রূপ ধরে গোটা জীবন কাটিয়ে দেয়। জিমি হল যাকে বলে সত্যিকারের জিন এবং জিনের সহজাত শক্তির সাহায্যে সে তার হাত ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নিতে পারে। বেশিরভাগ জিন তাদের হাত কুড়ি-ত্রিশ ফুট পর্যন্ত বাড়াতে পারে, সেখানে জিমি তা প্রায় চল্লিশ ফুট পর্যন্ত বাড়িয়ে নিতে পারে। সে শূন্যে বলো কিংবা উঁচু পাচিলের উপর কিংবা মাটির উপরে দুরন্ত সরীসৃপের মতো অবাধ বিচরণ তার হাতের।

আমি তাকে দেখেছি স্রেফ হাত বাড়িয়ে উঁচু উঁচু আমগাছের মগডাল থেকে দিব্যি পাকা আম পেড়ে আনতে। আম সে যে বেশ পছন্দ করে তা ভালো করেই জানতাম। আসলে জন্মগত পেটুক কিনা— আর এমনই এক ভয়ানক খিদের তাড়নায় একদিন তার অদ্ভুত ক্ষমতার ভুল প্রয়োগে সে নিজের জীবনে ডেকে আনল এক অভূতপূর্ব বিপদ।

উত্তর ভারতের হিল স্টেশনে থাকার সময় সে আমার স্কুলেই পড়ত, একই ক্লাসে। খেলার মধ্যে বিশেষ করে বাস্কেটবলটা দারুণ খেলত জিমি। তবে বেশ চালাক ছিল কিনা, খেলার সময় হাত কোনোদিনই বেমক্কা এত বড়ো করত না পাছে সে সবার কাছে ধরা পড়ে যায়। আবার বক্সিং রিং-এও জিমিই রাজা। প্রতিপক্ষ কোনোদিনই তার হাতের নাগালের বাইরে যেতে পারত না, টানা ঘুসিতে রক্তাক্ত নাকে নাজেহাল হয়ে বিপক্ষ রিং ছাড়লে তবে সে থামত।

এরপর হাফ-টার্ম পরীক্ষার সময় জিমির এই গোপন সত্যিটা আমি জানতে পারলাম। সেবার বীজগণিতের প্রশ্নপত্র বেশ কঠিন এল, কিন্তু আমি বেশ কিছু অঙ্কের ঠিক সমাধান করে ফেললাম। তখনই ঘটল ঘটনাটা। স্বভাবতই অঙ্ক কষতে কষতে অনেকগুলো পাতা ভরতি হয়ে গেলে পরে আমি আরেকটি পাতা নিতে যাব, ঠিক সেই সময় দেখি আমার ডেস্কের উপর কার যেন হাত। প্রথমে ভাবলাম ইনভিজিলেটর স্যার কি না। কিন্তু মাথা তুলে কাউকেই দেখলাম না। তবে কি আমার ঠিক পেছনে বসা ছেলেটির কীর্তি? নাহ! সে তো তার প্রশ্নপত্রেই ডুবে আছে আর হাতও নিজের দিকেই রাখা। এর মধ্যেই লক্ষ্য করলাম সেই রহস্যজনক হাত আমার উত্তরপত্র বাগিয়ে খুব সাবধানে তা সরিয়ে নিচ্ছে। একরাশ বিস্ময়ে কোথা থেকে এই হাত এসেছে খুঁজতে গিয়ে দেখি একটা বিশাল লম্বা, নমনীয় হাত বেঞ্চের তলা দিয়ে, মেঝের উপর দিয়ে নিঃসাড়ে এঁকেবেঁকে চলে এসেছে আমার দিকে, এখন আবার সেটা ছোটো হতে হতে সাধারণ হাতে পরিণত হল। আর সে-হাতের মালিক আর কেউ নয়, ক্লাসে যার কাছে বীজগণিত ছিল দুর্বোধ্য এক বিষয়।

যাই হোক, আবার নতুন করে অঙ্কগুলো আমায় করতে হল, কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ামাত্রই সটান জিমির কাছে গিয়ে কড়া সুরে জানিয়ে এলাম, এসব আমার একেবারেই পছন্দ নয় আর এবার সবার কাছে একথা ফাঁস করে দেব। সঙ্গেসঙ্গে জিমি কাকুতি মিনতি করে আমাকে অনুরোধ করল ঘটনাটা যেন পাঁচকান না করি, এও বলল, সে নিজেকে সামলাতে পারেনি, তবে এরপর থেকে আমি যদি চাই তবে সবসময় সে আমায় সাহায্য করবে। তাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়াটা বেশ লোভনীয়ও বটে, এর একটা কারণ তার লম্বা হাতের নাগাল। অগত্যা রাজি হলাম। কথামতো উত্তরপত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় তাকে মার্জনা করে দেওয়ায় দু-জনে তারপর থেকে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।

তবে দিন কয়েক যেতেই আমার কাছে গোটা ঘটনাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। জিমির এই আশ্চর্য ক্ষমতা উপকারের থেকে উৎপাতেই বেশি ব্যবহার হচ্ছিল, কারণ জিমির মস্তিষ্কে খুব একটা উন্নত চিন্তাভাবনা খেলত না। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষমতার ঠিক প্রয়োগ সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা ছিল না। তুচ্ছ, অকাজেই তার বেশি মন। খাবারের দোকান, ক্লাসঘর, হোস্টেল কিংবা সিনেমা হলে যাবার অনুমতি পেলে অন্ধকার সিনেমা হলেই তার হাতের কাজ শুরু হত।

এখন জিনদের নিয়ে মুশকিল হচ্ছে, তাদের প্রত্যেকেরই লম্বা কালো চুলের মেয়েদের প্রতি দুর্বলতা থাকে। যত লম্বা আর কালো হবে সে-চুল তত জিনদের পক্ষে ভালো। আর একবার যদি জিন তেমন পছন্দের কোনো মেয়ের শরীর দখল করতে পারে, তবে সে-মেয়েটি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, তার রূপ নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। একটা সময় তার সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যায়, পড়ে থাকে সেই সুন্দর চুলের গোছা।

এইভাবে নারী শরীর দখল করার বয়স জিমির তখনও হয়নি, কিন্তু সুযোগ পেলেই লম্বা কালো চুল ছোঁয়া কিংবা তাতে হাত বুলিয়ে দিতে ছাড়ত না। তার এই বিপজ্জনক ঝোঁকের জন্য সিনেমা হল ছিল প্রকৃষ্ট জায়গা। তার হাত ক্রমশ বড়ো হতে থাকত, আঙুলগুলি সারি সারি সিটের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেত, তারপর একসময় পথ বেয়ে পৌঁছে যেত নির্দিষ্ট সিটে বসে থাকা অভীষ্টের ঠিক পেছনে। এরপর খুব সন্তর্পণে মেয়েটির লম্বা কালো চুলে আলতো করে স্পর্শ করত আর যদি সেই মেয়েটি কোনোভাবে টের পেয়ে যেত তবে চট করে সেই সিটেরই পেছনে হাতটাকে লুকিয়ে ফেলত। এরপর সাপের ফণার মতো অসীম ধৈর্যে অপেক্ষা করত আবার কখন ছোবলটা মারা যায়।

কলেজে দু-তিন বছর বাদে তার আসল শিকার তার কাছে ধরা দিল। মেয়েটি ছিল ইকনমিক্সের লেকচারার, খুব সুশ্রী নয়, তবে তার আজানুলম্বিত কালো চুলের মোহময় আকর্ষণ উপেক্ষা করা কঠিন। সাধারণত সে সেই চুল খেঁাপা করেই রাখত, কিন্তু একদিন সকালে মাথা ধোয়ার পর যখন ওই দীর্ঘ চুলের গোছা মেলে দিয়ে খাটে শুয়ে ছিল তখন হয়তো জিমির তা নজরে পড়ে গিয়েছিল। সব দেখে নির্ঘাত জিমি নিজেকে আর সামলাতে পারেনি। সঙ্গেসঙ্গে তার সত্তা প্রবেশ করেছে মেয়েটির শরীরে আর পরের দিন থেকেই বেচারি কেমন একটা অপ্রকৃতিস্থ, জ্বরাক্রান্ত আর উন্মাদের আচরণ করতে লাগল। তার খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেল, প্রায় কোমায় চলে গেল, শরীর ক্ষয়ে যেতে যেতে কঙ্কালসার হয়ে গেল। যেদিন সে মারা গেল, শরীরে হাড় আর চামড়া বাদে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না— তবে আশ্চর্য ঘটনা এই, এত সবের পরেও তার দীর্ঘ, মোহময়ী চুলের আকর্ষণ একটুও ফিকে হয়ে যায়নি।

এমন দুঃখজনক ঘটনার পর থেকেই জিমিকে আমি এড়িয়ে চলতাম, মনে মনে একটা ব্যথা অনুভব করতাম যদিও। আমার হাতে কোনো প্রমাণ ছিল না যে ওই মেয়েটির এমন করুণ পরিণতির জন্য সে-ই দায়ী, কিন্তু অন্তরে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। এর একটাই কারণ, জিমির পরিচয় জানার পর থেকে জিন সম্বন্ধে প্রায় ডজনখানেক বই আমি পড়েছি এবং তাই তাদের কায়দা-কৌশল আমার অনেকটাই জানা ছিল।

তারপর বেশ কিছু বছর দু-জনের মধ্যে কোনো দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। গতবছর ছুটি কাটাতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম দু-জনে একই হোটেলে উঠেছি। স্বভাবতই তাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না। হোটেলের ঘরে বেশ কয়েক গ্লাস বিয়ার পানের পর মনে হল, হয়তো জিমিকে আমি ভুল বুঝেছি, যতটা ভেবেছিলাম ততটা দায়িত্বজ্ঞানহীন জিন নয় সে। হয়তো-বা কলেজের ওই লেকচারার মেয়েটি কোনো রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে, যে রোগ শুধু কলেজের শিক্ষকদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল— এই দুর্ঘটনায় জিমির সম্ভবত কোনো হাত নেই।

এরপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে কয়েক বোতল বিয়ার নিয়ে দু-জনে চলে এলাম উঁচু টিলাটায়, জায়গাটা সবুজ ঘাসে মোড়া, উপরে তাকালে সামনেই মোটর গাড়ি চলাচলের রাস্তা। এমনিই বিকেল হয়ে এসেছিল, তার উপরে বিয়ারের প্রভাব, ধীরে ধীরে চোখ জুড়িয়ে আসছিল, হঠাৎই জিমির উত্তেজিত গলায় তন্দ্রা ভাঙল...

‘কী হয়েছে,’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

‘ওপরে দেখ, পাইন গাছের নীচে,’ জিমি ব্যস্তভাবে বলে উঠল, ‘ওপরের রাস্তায়, আরে দেখতে পাচ্ছিস না?’

‘হ্যাঁ, দুটো মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি,’ আমি বললাম, ‘তাতে হয়েছেটা কী?’

‘বাঁ-দিকের জন, দেখ, চুলটা দেখেছিস?’

‘হ্যাঁ, বেশ লম্বা আর সুন্দর বটে— কিন্তু এখন নিজেকে সামলা দয়া করে’। কিন্তু আমার কথা শেষ হল না, ইতিমধ্যেই দেখলাম ইতিমধ্যেই তার হাত লম্বা হতে হতে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে, সেটা এখন পাহাড়ি রাস্তা বরাবর পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে।

কিছুক্ষণ বাদেই দেখলাম মেয়ে দুটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক পেছনের একটি ঝোপঝাড় থেকে একটা হাত বেরিয়ে আসছে, লক্ষ সামনের মেয়েটির কালো কুচকুচে বেণি। আচমকাই ঘটল মর্মান্তিক ঘটনাটা। জিমি তার খেলায় এতটাই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে রাস্তার বাঁকে যে বিপদ ধেয়ে আসছে তা টেরই পায়নি। তারস্বরে হর্ন দিতে দিতে তীব্রগতিতে এগিয়ে আসছিল একটা মার্সিডিজ বেঞ্জের ট্রাক। কিন্তু জিমির সেদিকে খেয়াল ছিল না।

যখন খেয়াল হল তখন আর কিছু করার ছিল না। ওই দীর্ঘ প্রসারিত হাত আবার গুটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার সময় পেল না জিমি। ফলে রাস্তার উপরে আড়াআড়ি ভাবে থাকা জিমির হাত পিষে বেরিয়ে গেল সেই ট্রাক। আর মুহূর্তের মধ্যে ভীষণভাবে আহত ময়াল সাপের মতো সেটা পাক দিতে দিতে মোচড়াতে লাগল।

সঙ্গেসঙ্গে আমি আর লরির চালক ছুটলাম ডাক্তার ডাকতে আর ততক্ষণে জিমির হাত বা বলা ভালো হাতের যেটুকু অংশ আস্ত ছিল তাকে সে গুটিয়ে স্বাভাবিক করে এনেছে। অবস্থা এতটাই সঙ্গিন ছিল যে ওকে তড়িঘড়ি হসপিটালে নিয়ে গেলাম, কিন্তু শেষমেষ সে-হাত কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না। আর বেচারা লরির চালক অনেকবার করে বোঝানোর চেষ্টা করল যে রাস্তার উপরে হাতটা প্রায় তিন ফুট লম্বা ছিল, কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হল না, পুলিশ তাকে মদ খেয়ে গাড়ি চালানোর অপরাধে গারদে পুরল।

এর বেশ কিছু সপ্তাহ পর জিমির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দেখলাম সে মনমরা হয়ে বসে আছে। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘আরে এত ভেঙে পড়ছিস কেন? তোর তো আরও একটা হাত আছে। নাকি ওটায় সেই বিশেষ গুণটা নেই?’

‘কোনোদিন পরীক্ষা করিনি, আর করতে চাইও না,’ ধীরে ধীরে সে বলল।

আমি জানি, এত সবের পরেও তার অন্তরে জিনের ধারা মোটেই মুছে যায়নি, হয়তো লম্বা কালো চুলের মেয়ে দেখলে এখনও সে আগের মতই প্রলুব্ধ হয়, তার বেঁচে যাওয়া হাত নিশপিশ করে সেই মেয়েটির মোহময়ী বেণি ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু সে জীবনে যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছে। আর আমিও সেদিনের পর থেকে টের পেয়েছি, হাজারটা গুণ নিয়ে জিন কিংবা জিনিয়াস হওয়ার চেয়ে নির্গুণ মানবশরীর ঢের ভালো বাপু।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন