৩. ক্ষমতার আসনে কংগ্রেস
১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইন অনুসারে সর্বপ্রথম যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কংগ্রেস তাতে বিরাটভাবে জয়লাভ করে। পাঁচটি বৃহদায়তন প্রদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং চারটি প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কংগ্রেসদল সারা ভারতে প্রাধান্যলাভ করে। কেবলমাত্র সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে এরা পুরোপুরি সাফল্যলাভ করতে পারেনি।
এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, প্রথমদিকে কংগ্রেস নির্বাচনে দাঁড়াবে না বলে স্থির করেছিল। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দিলেও মলমের ওপরে মাছির মতো একটি অনভিপ্রেত জিনিস রেখে দিয়েছিলো। এই অনভিপ্রেত জিনিসটি হলো প্রাদেশিক গভর্নরদের বিশেষ ক্ষমতা। এই বিশেষ ক্ষমতা বলে তারা যে-কোনো সময় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারতো। যে-কোনো গভর্নর এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে পারতো। এর অর্থ হলো, প্রাদেশিক গভর্নর যতোদিন ইচ্ছা করবে ততোদিনই শুধু প্রদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বজায় থাকবে; অর্থাৎ প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনকে সম্পূর্ণরূপে গভর্নরের মর্জির ওপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থা আরো খারাপ। সেখানে আবার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। প্রদেশসমূহে এই ব্যবস্থা ধিক্কৃত হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রে এই ব্যবস্থাই বজায় রাখা হয়েছিলো। এইরকম একটা অনভিপ্রেত ব্যবস্থার ফলে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় সরকার শুধু যে একটি দুর্বল ফেডারেশনে পরিণত হয়েছিলো তাই নয়, উপরন্তু দেশীয় রাজন্যবৃন্দ এবং কায়েমী স্বার্থের অধিকারীদের অহেতুকভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো। দেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে এরা ইংরেজ শাসকদের তাঁবেদার হয়ে থাকবে এই উদ্দেশেই এটি করা হয়েছিলো।
কংগ্রেস দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যই সংগ্রাম করে এসেছে। সুতরাং তার পক্ষে এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়েছিলো। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য প্রস্তাবিত ফেডারেশনকে কংগ্রেস সরাসরি বাতিল করে দেয়। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি দীর্ঘদিন যাবৎ প্রাদেশিক পরিকল্পনারও বিরোধী ছিলো। কংগ্রেসের একটি বড় অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও বিরোধী ছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার অভিমত ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। আমি যে অভিমত পোষণ করতাম তা হলো, নির্বাচন পরিহার করলে মহা ভুল করা হবে। কংগ্রেস যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে অনভিপ্রেত দলগুলি এগিয়ে এসে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইনসভাগুলো দখল করে নিজেদের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বলে জাহির করে ভারতীয় জনগণের নামে নিজেদের কথা বলতে থাকবে। এ ছাড়া নির্বাচন একটি বড় রকমের সুযোগও এনে দিয়েছিলো আমাদের সামনে। নির্বাচনী প্রচারের সময় আমরা জনসাধারণের কাছে ভারতীয় রাজনীতির মৌলিক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করবার সুযোগ পাবো। অবশেষে আমার অভিমতই মেনে নেওয়া হয় এবং কংগ্রেস নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ফলাফল কী হয়েছিলো সে কথা আগেই বলেছি।
এর পরেই দেখা দিলো আর এক সমস্যা। তা হলো কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে মতভেদ। নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে এক অংশ কংগ্রেসের মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা মন্ত্রিসভা গঠনের বিরোধিতা করতে থাকেন। এঁদের বক্তব্য হলো, আসল ক্ষমতা গভর্নরদের হাতে থাকায় প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। মন্ত্রীরা ততোদিনই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারবে যতোদিন গভর্নররা দয়া করে তাঁদের থাকতে দেবে। কংগ্রেস যদি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো কার্যকর করতে সচেষ্ট হয় তাহলে গভর্নরদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ অপরিহার্য হয়ে উঠবে। এঁরা তাই অভিমত প্রকাশ করেন, এ অবস্থায় কংগ্রেসের উচিত হবে আইনসভার ভেতরে থেকে ইংরেজ শাসকদের রচিত সংবিধানকে আঘাতের পর আঘাত হেনে ধ্বংস করে দেওয়া। এই ব্যাপারেও আমি ভিন্ন অভিমত পোষণ করি। আমি বলি, প্রাদেশিক সরকারগুলোকে যেটুকু ক্ষমতাই দেওয়া হোক না কেন, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। গভর্নরদের সঙ্গে যদি বিরোধ উপস্থিত হয় তাহলে অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। ক্ষমতা হাতে না নিলে কংগ্রেস তার পরিকল্পনাকে রূপ দিতে সক্ষম হবে না। অপরপক্ষে, কোনো জনপ্রিয় বিষয়কে রূপ দিতে গিয়ে মন্ত্রিসভাকে যদি বিদায় নিতে হয়, তাতে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে।
গভর্নররা কিন্তু কংগ্রেসের এইসব আলোচনা এবং তার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করলেন না। তাঁরা যখন দেখতে পেলেন, মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে কংগ্রেস দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব গ্রহণ করেছে তখন তাঁরা আইনসভার দ্বিতীয় বৃহত্তর দলগুলোকে আহ্বান জানালেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, এরকম দলকেও আহ্বান করা হলো। এর ফলে বিভিন্ন প্রদেশে অন্তর্বর্তীকালীন অ-কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। কোনো কোনো প্রদেশে কংগ্রেসের ঘোরতর বিরোধী দলও মন্ত্রিত্বের গদিতে আসীন হলো। মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে কংগ্রেসের দ্বিধাগ্রস্ত নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলো। শুধু তাই নয়, এর ফলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ লাভ করলো। তারা এই সুযোগে নির্বাচনে পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াবার জন্য সচেষ্ট হলো।
এদিকে ভাইসরয়ের সঙ্গে তখন সুদীর্ঘ আলোচনা চলছে কংগ্রেস নেতাদের। এই আলোচনার সময় ভাইসরয়ের কাছ থেকে এই মর্মে একটি আশ্বাস নেবার চেষ্টা চলছিলো, গভর্নররা মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। ভাইসরয় যখন বিষয়টা সুষ্ঠুভাবে ব্যাখ্যা করলেন তখন ওয়ার্কিং কমিটির কয়েকজন সদস্য তাঁদের পূর্ব অভিমত পরিবর্তন করে ক্ষমতাগ্রহণের পক্ষে, অর্থাৎ মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করলেন। কিন্তু ইতিপূর্বে কংগ্রেস যেভাবে জোরালো ভাষায় ভারত শাসন আইনের বিরুদ্ধে তার মতামত ব্যক্ত করেছিলো, তার ফলে পলিসি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলেও কোনো নেতাই তাঁর অভিমত জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। জওহরলাল তখন কংগ্রেসের সভাপতি। পূর্বে তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণের বিরুদ্ধে এমন সব উক্তি করেছিলেন যার ফলে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পক্ষে কোনোকিছু বলা অথবা এ ব্যাপারে কোনোরকম প্রস্তাব উত্থাপন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। এর কিছুদিন পরে ওয়ার্ধায় ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে। আমি তখন একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করি, কোনো সদস্যই বাস্তব ঘটনাবলীর মুখোমুখি দাঁড়াতে চাইছেন না। সদস্যদের এই ধরনের মনোভাব দেখে আমিই প্রথমে ক্ষমতাগ্রহণের পক্ষে সুস্পষ্ট ভাষায় অভিমত জ্ঞাপন করি। আমি এই অভিমত জ্ঞাপন করবার পর এ ব্যাপারে কিছুক্ষণ আলোচনা চলে। আলোচনার সময় গান্ধীজী আমার অভিমতটাই মেনে নেন। এর ফলে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে আর কোনো বাধাই রইলো না। কংগ্রেস তখন প্রাদেশিক স্তরে মন্ত্রিসভা গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। এটা একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, কারণ এতোদিন পর্যন্ত কংগ্রেস শুধু নেতিবাচক পন্থাই গ্রহণ করে এসেছে এবং ক্ষমতাগ্রহণের বিরুদ্ধেই অভিমত প্রকাশ করে এসেছে। এই প্রথম কংগ্রেস ইতিবাচক পন্থা গ্রহণ করলো এবং সরকারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে স্বীকৃত হলো।
এই সময় এমন একটি ঘটনা ঘটে যার ফলে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিগুলোর অভিমত সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস একটি অখণ্ড জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে উঠেছে এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের নেতৃত্ব করার সুযোগ দিয়ে এসেছে। বোম্বাইয়ে তখন প্রদেশ কমিটির স্বীকৃত নেতা ছিলেন মিঃ নরিম্যান। সুতরাং প্রচলিত ব্যবস্থা অনুসারে বোম্বাইয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব তাঁর ওপরেই দেবার কথা। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তা হলো না। সর্দার প্যাটেল এবং তাঁর অনুগামীরা মিঃ নরিম্যানকে পছন্দ করতেন না। তাঁরা তাই মিঃ বি. জি. খেরকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে পরামর্শ দিলেন এবং তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী হতে বললেন। ফলে মিঃ বি. জি. খেরই হলেন বোম্বাইয়ের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। মিঃ নরিম্যান পার্শী এবং মিঃ খের হিন্দু। এর ফলে জনসাধারণের মনে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হলো, মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়েই মিঃ নরিম্যানকে নস্যাৎ করা হয়েছে। এটা যদি সত্যি নাও হয় তবুও এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করা কঠিন।
এই সিদ্ধান্তের ফলে স্বাভাবিক কারণেই মিঃ নরিম্যান মুষড়ে পড়েন। তিনি এই বিষয়টি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কাছে উপস্থাপিত করেন। তখনো জওহরলালই কংগ্রেসের সভাপতি। তাই অনেকেই আশা করেছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়ই এই অবিচারের প্রতিকার করবেন। জওহরলাল সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন বলেই তারা এইরকম আশা করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, এটা হলো না। সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে জওহরলালের বহু বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও এই ব্যাপারে তিনি প্যাটেলের বিরোধিতা করলেন না। সর্দার প্যাটেল যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে এ কাজ করেছেন সে কথা তিনি মেনে নিলেন না। এ ব্যাপারে তিনি কিছুটা অবিবেচকের মতোই নরিম্যানের আপীলকে নস্যাৎ করে দিলেন।
জওহরলালের মনোভাব দেখে নরিম্যান রীতিমতো বিস্মিত হন। তিনি তখন গান্ধীজীর স্মরণাপন্ন হয়ে তাঁর কাছে সুবিচার প্রার্থনা করেন। গান্ধীজী ধীরভাবে তাঁর বক্তব্য শুনে নির্দেশ দেন, সর্দার প্যাটেলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি কোনো একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির দ্বারা তদন্ত করাতে হবে।
সর্দার প্যাটেল এবং তাঁর বন্ধুরা এই ব্যাপারেও তাঁদের অভিমত প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, মিঃ নরিম্যান, যেহেতু পার্শী সম্প্রদায়ভুক্ত সেইহেতু তাঁর অভিযোগের তদন্তভার একজন পার্শীর ওপরেই ন্যস্ত করা হোক। তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা আগে থেকেই এমনভাবে তৈরি করে রেখেছিলেন এবং মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন যাতে তদন্তের সময় সমস্ত বিষয়টাই ধোঁয়াটে বলে প্রতিপন্ন হয়। উপরন্তু তাঁরা বিভিন্নদিকে এমনভাবে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে তদন্ত শুরু হবার আগেই বেচারা নরিম্যানের মামলা ভণ্ডুল হয়ে যায়। যে-কোনো ভাবেই হোক, পার্শী বলেই যে মিঃ নরিম্যানের দাবি উপেক্ষিত হয়েছিলো, এটা প্রমাণ করা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিলো। অতএব শেষ পর্যন্ত এটাই সাব্যস্ত হলো, সর্দার প্যাটেলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। বেচারা নরিম্যান এই ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে মানসিক আঘাত পান। তাঁর রাজনৈতিক জীবনেরও এখানেই ইতি হয়ে যায়।
মিঃ নরিম্যানের প্রতি যেরকম ব্যবহার করা হয়েছিলো সে কথা বলতে গিয়ে আজ আমার মিঃ সি. আর. দাশের কথা মনে পড়ছে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি যেরকম বিস্ময়কর এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে কথা কোনোদিনই ভোলবার নয়। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। প্রতিটি বিষয়েই তাঁর ছিলো প্রখর দূরদৃষ্টি ও কল্পনার প্রসারতা। উপরন্তু তাঁর মনটা ছিলো সবদিক থেকেই বাস্তবধর্মী। এই বাস্তবধর্মী মানসিকতার জন্যই প্রতিটি বিষয় তিনি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করতেন। যে বিষয়কে তিনি ন্যায় ও সত্য বলে মনে করতেন তার জন্য তিনি অকুতোভয়ে নিজের মত প্রকাশ করতেন। ১৯২০ সনে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে গান্ধীজী যখন তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে উপস্থিত করেন তখন মিঃ দাশ তাঁর বিরোধিতা করেন। এর এক বছর বাদে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনের পরে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তখন তিনি সেই আন্দোলনে যোগ দেন। কলকাতা হাইকোর্টে মিঃ দাশ ছিলেন প্রথম সারির ব্যবহারজীবী। বিলাসিতার জন্যও তাঁর নাম তখন সর্বত্র পরিচিত ছিলো। কিন্তু সেই ভোগবিলাস এবং বিরাট আয়ের আইন ব্যবসায় পরিত্যাগ করে তিনি দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দামী পোশাক ছেড়ে খদ্দরের মোটা কাপড়-জামা পরে তিনি জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর সেই অনন্যসাধারণ ত্যাগের ফলে আমি বিশেষভাবে তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়ি।
আগেই বলেছি, মিঃ দাশের মনটা ছিলো বাস্তবানুগ এবং নমনীয়। রাজনীতি-সম্পর্কিত যে-কোনো প্রশ্ন তিনি তার সম্ভাব্য ফলাফল এবং প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে বিচার করতেন। তিনি বলতেন, আমাদের যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় তাহলে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে স্তরে স্তরে অগ্রগতির জন্য। স্বাধীনতা কখনো হঠাৎ এসে উপস্থিত হয় না; আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এগোতে থাকলে বিলম্ব অবশ্যম্ভাবী। তিনি আরো বলতেন, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম ধাপ হবে প্রাদেশিক স্তরে স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার অর্জন করা। সামান্যতম রাজনৈতিক অধিকারও যদি আমরা পাই, তাহলেও তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে, কারণ সামান্য রাজনৈতিক ক্ষমতাই পরবর্তীকালে বৃহত্তর ক্ষমতা অর্জনের পথ পরিষ্কার করে দেবে।
মিঃ দাশের এই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি যে কত প্রখর ছিলো তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তিনি তখন যে কথা বলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৩৫ সনে ভারত শাসন আইন বিধিবদ্ধ হওয়ায়। এই আইন বিধিবদ্ধ হয় তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ইংলণ্ডের তৎকালীন যুবরাজ (Prince of Wales) ভারত ভ্রমণে আসেন। তিনি এসেছিলেন মন্টেগু-চেমসফোর্ড পরিকল্পনাকে রূপদান করবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কংগ্রেস তাঁকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়। যুবরাজকে স্বাগত জানাবার যাবতীয় পরিকল্পনাও কংগ্রেস বয়কট করবে বলে স্থির করে। কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারত সরকার রীতিমতো বিব্রত হয়ে পড়ে। ভারতের ভাইসরয় ইংলণ্ডের কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, যুবরাজ ভারতে এলে ভারতের জনসাধারণ তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করবে। কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের ফলে তিনি তাই বিশেষভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তখন কংগ্রেসের বয়কট ব্যবস্থাকে বানচাল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টাই বিফল হয়ে যায়। যুবরাজ যেখানেই যান, সেখানেই তিনি জনগণের বিরূপ মনোভাব দেখতে পান। অবশেষে তিনি আসেন কলকাতায়। সে সময় কলকাতাই ছিলো ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হলেও বড়দিনের সময় ভাইসরয় এখানেই অবস্থান করতেন। সরকারী কর্তৃপক্ষ স্থির করেন, যুবরাজ কলকাতায় এসে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানের এক বিরাট প্রস্তুতিও নেওয়া হয় এই উদ্দেশে। আসলে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলতে সরকারী কর্তৃপক্ষ চেষ্টার কোনো ত্রুটিই করেননি।
আমরা সবাই তখন আলিপুর সেনট্রাল জেলে বন্দীজীবন যাপন করছি। আমাদের অনুপস্থিতিতে পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য কংগ্রেস এবং সরকারের মধ্যে একটা সমঝোতার জন্য চেষ্টা করছিলেন। এই ব্যাপারে ভাইসরয়ের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন। ভাইসরয়ের কথা শুনে তাঁর মনে হয়, আমরা যদি কলকাতায় যুবরাজকে বয়কট না করি তাহলে সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে মিটমাট করে নিতে প্রস্তুত আছে। তিনি তখন জেলখানায় এসে মিঃ দাশ এবং আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। ভাইসরয়ের বক্তব্যও তিনি আমাদের কাছে প্রকাশ করেন। ভাইসরয় তাঁকে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা হলো, ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য একটা গোলটেবিল বৈঠকের ব্যবস্থা করা হবে। মালব্যজীর মুখ থেকে এই কথা শোনবার পর আমরা তাঁকে বলি, এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের নিজেদের মধ্যে আগে আলোচনা করা দরকার। এই কথা বলে আমরা তাঁকে পরের দিন আবার আমাদের কাছে আসতে বলি। মিঃ দাশ এবং আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে যুবরাজকে বয়কট করার ফলেই সরকার এখন মিটমাটের কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা তাই গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবো বলেই স্থির করি। ভালো করেই জানতাম, প্রস্তাবিত বৈঠক হলেও আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাবো না। কিন্তু এটাও বুঝে নিয়েছিলাম, এতে আমাদের আন্দোলন অনেকখানি এগিয়ে যাবে।
সে সময় একমাত্র গান্ধীজী ছাড়া কংগ্রেসের সব নেতাই জেলে আবদ্ধ ছিলেন। আমরা তখন স্থির করি, ভাইসরয়ের প্রস্তাব আমরা মেনে নেবো তবে এ প্রস্তাব মেনে নেবার প্রথম শর্ত, গোলটেবিল বৈঠকের আগেই কংগ্রেস নেতাদের মুক্তি দিতে হবে।
পরদিন পণ্ডিত মালব্য আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলে আমরা তাঁকে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিই। তাকে আরো বলি, তিনি যেন গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা তাঁকে জানিয়ে দেন এবং এ ব্যাপারে তাঁর অভিমতটা জেনে নেন। পণ্ডিত মালব্য তখন ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে আমাদের বক্তব্য তাঁকে জানান এবং দুদিন পরে আবার আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আমাদের বলেন, আলোচনায় যেসব কংগ্রেস নেতা যোগদান করবেন তাঁদের সবাইকেই ভাইসরয় মুক্তি দেবেন। অর্থাৎ আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং আরো অনেক নেতাকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে স্থির হয়। আমরা তখন আমাদের সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করে একটি বিবৃতি লিখে সেটিকে মালব্যজীর হাতে দিয়ে বলি, তিনি যেন আমাদের ওই লেখা বিবৃতিটি গান্ধীজীকে দেখান।
আমাদের কথামতো মালব্যজী গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করে আমাদের লেখা বিবৃতিটি তাঁকে দেখতে দেন। গান্ধীজী কিন্তু আমাদের প্রস্তাব মেনে নেন না। তিনি বলেন, সব কংগ্রেস নেতাকে, বিশেষ করে আলী ভ্রাতৃদ্বয়কে সর্বাগ্রে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে হবে। তিনি আরো বলেন: নেতারা মুক্তি পাবার পরে আমরা গোলটেবিল বৈঠক সম্বন্ধে বিবেচনা করতে পারি। গান্ধীজীর এই বক্তব্য শুনে মিঃ দাশ এবং আমি মনে করি, তাঁর দাবিটা সঠিক নয়; সরকার যখন গোলটেবিল বৈঠকের আগেই নেতাদের মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে তখন এই ধরনের শর্ত আরোপ করার কোনো মানে হয় না। আমাদের অভিমত জেনে নেবার পর মালব্যজী আবার গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু এবারেও গান্ধীজী আমাদের প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মত হন না। এর ফলে ভাইসরয় এ ব্যাপারে আর কোনোরকম উচ্চবাচ্য করেন না। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো যুবরাজের কলকাতা সফর বয়কটকে পরিহার করা, কিন্তু গান্ধীজীর টালবাহনার ফলে এ ব্যাপারে কোনোরকম মিটমাট না হওয়ায় বয়কট ব্যবস্থা সম্বন্ধে কংগ্রেস কোনোরকম সিদ্ধান্তই নিতে পারে না। ফলে বয়কট পুরোপুরিভাবেই সাফল্যমণ্ডিত হয়। এইভাবেই আমরা একটা সুবর্ণ সুযোগ হারাই। মিঃ দাশ তখন রীতিমতো হতাশ হয়ে গান্ধীজীকেই এর জন্য দায়ী করেন।
এদিকে গান্ধীজী ভাইসরয়ের দিক থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজে থেকেই আবার এই বিষয়টা উত্থাপন করবার জন্য সচেষ্ট হলেন। তিনি মিঃ শঙ্করণ নায়ারকে সভাপতি করে বোম্বাইতে একটি সম্মেলনের অনুষ্ঠান করেন। উক্ত সম্মেলনে গান্ধীজী নিজেই একটি গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর সেই প্রস্তাবের সঙ্গে মালব্যজীর প্রস্তাবের বিশেষ কোনো প্রভেদ ছিলো না। কিন্তু ইতিমধ্যে যুবরাজ ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ায় সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে আর কোনো আগ্রহ দেখা গেলো না। ভাইসরয় তাই গান্ধীজীর প্রস্তাবকে আমলই দিলেন না। এই ব্যাপারে মিঃ দাশ ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে মন্তব্য করেন, গান্ধীজী একটা বিরাট ভুল করেছেন; তাঁর এই সিদ্ধান্তকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না।
এরপর চৌরি চৌরায় সংঘটিত একটি ঘটনার জন্য গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন। তাঁর এই কাজের জন্য সারা দেশজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেশবাসীর মনোবলও এর ফলে বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। সরকার এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। তারা গান্ধীজীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে বিচারের জন্য নিয়ে আসে। আদালতের বিচারে তিনি ছ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। গান্ধীজীর কারাদণ্ডের পর অসহযোগ আন্দোলন একেবারেই স্তব্ধ হয়ে যায়।
মিঃ দাশ তখন প্রায় প্রতিদিনই আমার সঙ্গে তৎকালীন পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করতেন। আলোচনার সময় তিনি একদিন বলেন, আন্দোলন বন্ধ করে দিয়ে গান্ধীজী একটা বিরাট ভুল করেছেন। তাঁর এই কাজের ফলে জনসাধারণের মনোবল এমনভাবে ভেঙে পড়েছে, পুনরায় তাদের আন্দোলনের সামিল করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। এই ক্ষত নিরাময় হতে অনেক বছর লাগবে। মিঃ দাশ আরো বলেন, গান্ধীজীর প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পুরোপুরি বানচাল হয়ে গেছে।
এরপর মিঃ দাশ জনসাধারণের মনোবলকে কিভাবে পুনরুজ্জীবন করা যায় সেই সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করেন। তিনি চুপচাপ বসে থাকতে প্রস্তুত ছিলেন না, বরং একটি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইছিলেন। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ পরিত্যাগ করে রাজনৈতিক সংগ্রামকে আইনসভার ভেতরে নিয়ে যেতে হবে। গান্ধীজীর পরামর্শে কংগ্রেস ১৯২১ সনের নির্বাচন বয়কট করেছিলো। মিঃ দাশ বলেন, ১৯২৪-এর নির্বাচনে কংগ্রেসকে আইনসভা দখল করতে হবে এবং আইনসভার ভেতরেই আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামকে রূপ দিতে হবে। তিনি মনে করতেন, কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারাও তাঁর অভিমত মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবেন। আমার কিন্তু মনে হয়, এ ব্যাপারে তিনি একটু বেশি আশা পোষণ করছেন। কিন্তু আমার মনের কথাটা তাঁর কাছে আমি প্রকাশ করিনি এবং তাঁর বিরোধিতাও করিনি। আমি শুধু তাঁকে এই কথাটাই বলেছিলাম, মুক্তি পাবার পর তিনি যেন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন।
গয়া কংগ্রেসের অব্যবহিত পূর্বে মিঃ দাশ মুক্তিলাভ করেন। এবং মুক্তিলাভের সঙ্গে সঙ্গেই অভ্যর্থনা সমিতি তাঁকে সভাপতির পদে বরণ করে। মিঃ দাশ মনে করেন, এই সুযোগে তিনি তাঁর পরিকল্পনাটা দেশবাসীর সামনে ব্যাখ্যা করে তাদের স্বমতে আনতে পারবেন। তিনি তখন হাকিম আজমল খাঁ, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু এবং বিঠলভাই প্যাটেলের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। ওঁরা তিনজনেই মিঃ দাশের পরিকল্পনা সমর্থন করবেন বলে কথা দেন। এঁদের সমর্থন লাভ করে মিঃ দাশ আশা করেন, পূর্ণ অধিবেশনের সময় তিনি তাঁর প্রস্তাবটি পাস করিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায়। গান্ধীজী তখন কারাগারে আবদ্ধ থাকায় তাঁর অনুগামী নেতারা তীব্রভাবে তাঁর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। যে সব নেতা তাঁর বিরোধিতা করেন তাঁদের মধ্যে রাজাগোপালাচারির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেসের একটি বড় অংশ মিঃ দাশের বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিহার করার অর্থ হবে গান্ধীজীর নেতৃত্ব অস্বীকার করা।
শ্রীরাজাগোপালাচারি এবং তাঁর অনুগামীদের এই ব্যাখ্যাকে আমি সঠিক বলে মেনে নিতে পারিনি। আমি মনে করি, মিঃ দাশ সরকারের সঙ্গে কোনোরকম মিটমাট করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, রাজনৈতিক সংগ্রামকে ভিন্ন পথে চালিত করতে। কিন্তু আমি তখন জেলে আবদ্ধ থাকায় এ ব্যাপারে কিছু বলবার সুযোগ আমার ছিলো না।
মিঃ দাশ তাঁর প্রস্তাবের সমর্থনে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপিত করলেও তিনি কংগ্রেসের সর্বস্তরের কর্মীদের স্বমতে আনতে পারেননি। শ্রীরাজাগোপালাচারি, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং আরো কয়েকজন নেতার বিরোধিতার ফলে তাঁর প্রস্তাবটি গৃহীত হয় না। এর ফলে কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। মিঃ দাশ তখন সভাপতির পদে ইস্তফা দিয়ে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন। পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, হাকিম আজমল খাঁ এবং বিঠলভাই প্যাটেলও কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে মিঃ দাশের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতি উপরোক্ত দুই দলের বাদানুবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই দল দুটিকে বলা হয় ‘নো-চেঞ্জার’ (রক্ষণশীল) এবং ‘প্রো-চেঞ্জার’ (সংস্কারবাদী)।
উপরোক্ত ঘটনার ছ মাস পরে আমি জেল থেকে মুক্তিলাভ করি। বাইরে বেরিয়ে এসেই আমি দেখতে পাই, কংগ্রেস এক বিরাট বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ইংরেজের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ পরিহার করে কংগ্রেস কর্মীরা তাঁদের মতবিরোধের ব্যাপারটাকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন। মিঃ দাশ, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু এবং হাকিম আজমল খাঁ সংস্কারবাদী শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তাঁদের বিরোধিতা করছেন রাজাজী, সর্দার প্যাটেল এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। আমি বেরিয়ে এলে উভয় দলই আমাকে তাদের স্বমতে আনতে সচেষ্ট হয়। আমি কিন্তু কোনো দলেই যোগ দিই না। আমি মনে করি, কংগ্রেসের এই আভ্যন্তরীণ বিরোধ গোটা প্রতিষ্ঠানকেই দুর্বল করে ফেলছে। আমার আরো মনে হয়, এই বিরোধের অবসান না হলে কংগ্রেসের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমি তাই উভয় দলের বাইরে থেকে আমাদের সংগ্রামকে পুনরায় রাজনৈতিক খাতে নিয়ে আসার জন্য সচেষ্ট হই। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সাফল্য অর্জন করেছিলাম। এর কিছুদিন পরেই দিল্লীতে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। সেই অধিবেশনে উভয় দলই আমাকে সভাপতির পদে নির্বাচিত করে।
দিল্লী কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে আমি বলি, আমাদের আসল উদ্দেশ্য হলো দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা। ১৯১৯ সন থেকে আমরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পন্থা অনুসরণ করে এসেছি যার ফলে বেশ কিছুটা সাফল্যও আমরা অর্জন করেছি, কিন্তু এখন যদি আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, রাজনৈতিক সংগ্রামকে আইনসভার ভেতরে নিয়ে যাওয়া দরকার, সেক্ষেত্রে আমাদের আগের পথ আঁকড়ে ধরে বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। আমাদের আসল উদ্দেশ্যের মধ্যে যখন কোনোরকম বিরোধিতা নেই, এ অবস্থায় প্রত্যেক দলই যাতে তাদের নিজস্ব পন্থায় কাজ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা দরকার। আমার মনে হয়, বর্তমান অবস্থায় এটিই হবে সর্বোত্তম পন্থা।
আমার বক্তব্যের অনুকূলেই কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্থির হয়, সংস্কারবাদী দল এবং রক্ষণশীল দল নিজ নিজ পন্থা অনুসরণ করে চলবে। এরপর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, শ্রীরাজাগোপালাচারি এবং তাঁদের সহকর্মীরা গঠনমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে মিঃ দাশ, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু তখন স্বরাজ দল গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে স্থির করেন। তাঁদের পরিকল্পনার ফলে দেশবাসীর মনে পুনরায় উৎসাহের সঞ্চার হয়, ফলে সমগ্র দেশ তাঁদের পেছনে এসে দাঁড়ায়। নির্বাচন পর্ব শেষ হলে দেখা যায়, স্বরাজ দল কেন্দ্রে ও প্রদেশসমূহে বিরাটভাবে সাফল্য অর্জন করেছে।
রক্ষণশীল দলের একটি প্রধান আপত্তি ছিলো, কাউন্সিলে প্রবেশ করলে গান্ধীজীর নেতৃত্বকে দুর্বল করা হবে; কিন্তু ঘটনাচক্রের ফলে প্রমাণিত হয়, তাঁদের সেই অভিমত সঠিক ছিলো না। কেন্দ্রীয় আইনসভায় স্বরাজ দল এক প্রস্তাব উত্থাপন করে, গান্ধীজীকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। এরপর দেখা যায়, প্রস্তাব পাস হবার আগেই সরকার গান্ধীজীকে মুক্তি দিয়েছে।
আগেই বলেছি, স্বরাজ দল কেন্দ্রীয় আইনসভায় এবং প্রাদেশিক আইনসভাগুলোতে বিপুল সংখ্যক আসন অধিকার করে। এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোতেও এই দল প্রার্থী দিয়েছিলো এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বরাজ দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিলো। এটা সম্ভব হয়েছিলো মিঃ দাশের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার জন্য। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে। এর মানে হলো, মুসলিম ভোটারদের ভোটেই মুসলিম প্রার্থীরা নির্বাচিত হবেন। মুসলিম এবং আরো কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দল তাই নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুসলমানদের মনে নানাভাবে ভীতির সঞ্চার করতে থাকে। এরা মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে কিছুটা সাফল্যও লাভ করে। তাদের প্রচারের ফলে তাদের মনোনীত কিছুসংখ্যক প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করে। কিন্তু বাংলায় এরা মোটেই পাত্তা পায় না। মিঃ দাশ বাংলার মুসলমানদের মন জয় করতে সক্ষম হন এবং বাংলার মুসলমানরা তাঁকেই একমাত্র নেতা বলে মেনে নেন। তিনি সেদিন যেভাবে বাংলার সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করেছিলেন, আজও তাঁর অনুসৃত সেই পথকেই সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ বলে আমি মনে করি।
বাংলায় মুসলমানরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু নানা কারণে তাঁরা শিক্ষা ও রাজনীতি ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ ছিলেন। জনসংখ্যার শতকরা পঞ্চান্ন ভাগের বেশি হওয়া সত্ত্বেও সরকারী চাকরিতে শতকরা ত্রিশভাগের বেশি মুসলমান কর্মচারী ছিলেন না। মিঃ দাশ তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির ফলে বুঝতে পেরেছিলেন, এটা একটা অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরো বুঝতে পেরেছিলেন, মুসলমানদের যদি আর্থনীতিক ব্যাপারে সাহায্য না করা হয় তাহলে তাঁরা খোলা মন নিয়ে কংগ্রেসে যোগদান করবেন না। তিনি তাই ঘোষণা করেন, কংগ্রেস যদি বাংলায় শাসনক্ষমতা লাভ করে তাহলে সরকারী চাকরির শতকরা ষাটটি পদে মুসলমানদের নিয়োগ করা হবে এবং যতোদিন পর্যন্ত জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারী চাকরিতে তাঁরা না আসেন, ততোদিন এই ব্যবস্থাই চলতে থাকবে। মিঃ দাশের সেই ঘোষণা শুধু যে বাংলার মুসলমানদেরই অনুপ্রাণিত করেছিলো তাই নয়, সারা ভারতের মুসলমানসমাজ তাঁর সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিলো। মিঃ দাশ এখানেই ক্ষান্ত হননি; তিনি স্থির করেন, কলকাতা কর্পোরেশনে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা আশীভাগ চাকরি মুসলমানদের দেওয়া হবে। তিনি বলেন, মুসলমানরা যতোদিন জনজীবনে এবং চাকরির ক্ষেত্রে যথোপযুক্তভাবে অংশগ্রহণ করতে না পারবেন ততোদিন বাংলায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। মুসলমানরা যখন সর্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হবেন, তারপর আর তাঁদের জন্য বিশেষ রক্ষাকবচের প্রয়োজন থাকবে না। তাঁরা তখন অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে একই নিয়মে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন।
মিঃ দাশের এই সাহসিক ঘোষণার ফলে বাংলার কংগ্রেসে এক বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসের অনেক নেতা প্রবলভাবে তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করেন। তাঁরা মিঃ দাশের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে জোরালো প্রচার চালাতে থাকেন। মিঃ দাশকে তাঁরা সুবিধাবাদী এবং মুসলিম তোষণকারী বলে অভিহিত করেন। কিন্তু শত বিরোধিতাও মিঃ দাশকে টলাতে পারে না। পর্বতের মতো অটল হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি সমস্তরকম বাধাবিপত্তির মোকাবিলা করতে থাকেন। তিনি তখন সারা বাংলা পরিভ্রমণ করে জনগণের সামনে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। মিঃ দাশের বক্তব্য বাংলার এবং বাংলার বাইরের মুসলমানদের মনে এক বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে। আমি বলতে চাই, তিনি যদি অকালে কালগ্রাসে পতিত না হতেন তাহলে সারা দেশে তিনি এক নতুন প্রাণবন্যার সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কয়েকজন সহকর্মী তাঁর সেই যুগান্তকারী ঘোষণাকে নস্যাৎ করে দেন। এর ফলে বাংলার মুসলমানরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যান এবং এইভাবেই দেশবিভাগের প্রথম বীজ রোপিত হয়।
এবার আমি আর একবার মিঃ নরিম্যানের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি, বোম্বাইয়ের প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি মিঃ নরিম্যানের নেতৃত্ব মেনে না নিয়ে ঠিক কাজ করেনি। ওয়ার্কিং কমিটিও এই অন্যায়ের প্রতিবিধান না করে ভুল করেছিলো। তবে শুধু এই ব্যাপারটা ছাড়া আর সব ক্ষেত্রেই কংগ্রেস তার কর্মসূচীকে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিলো। মন্ত্রিসভা গঠনের পরে সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্যও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিলো।
শাসনক্ষমতা হাতে নেবার পর কংগ্রেস এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এটা ছিলো একটা গুরুতর মামলার মতো ব্যাপার। জনসাধারণ তখন সব সময় কংগ্রেসের কাজকর্ম লক্ষ্য করে চলেছিলো। কংগ্রেস তার জাতীয় চরিত্রকে (National character) বজায় রাখতে পারে কি না, এর দিকে জনসাধারণ বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখছিলো। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রধান অভিযোগ ছিলো এই, কংগ্রেস শুধু নামেই ‘জাতীয়’, আসলে ওটা হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান। লীগের প্রধান প্রচারও ছিলো এটাই। কিন্তু এই প্রচারে বিশেষ কিছু সুবিধে করতে না পেরে মুসলিম লীগ কংগ্রেসকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নতুন এক প্রচার শুরু করে। তারা তখন বলতে শুরু করে, কংগ্রেসী মন্ত্রীরা সংখ্যালঘুদের ওপরে অত্যাচার আর অবিচার চালাচ্ছে। লীগ এই ব্যাপারে একটি কমিটিও নিয়োগ করে। কমিটি একটি রিপোর্টও দাখিল করে। রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়, কংগ্রেস মুসলমানদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি নানাভাবে অবিচার করে চলেছে। কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ওইসব অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন ছিলো। ভারতের ভাইসরয় এবং প্রাদেশিক গভর্নররাও একই অভিমত পোষণ করতেন। ফলে মুসলিম লীগের ওই রিপোর্ট সচেতন জনসাধারণের মনে আদৌ কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারেনি।
কংগ্রেস যখন শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে তখন মন্ত্রীদের কাজকর্ম লক্ষ্য করবার জন্য এবং কংগ্রেসের পলিসি সম্বন্ধে মন্ত্রীদের ওয়াকিবহাল রাখবার জন্য একটি পার্লামেন্টারী বোর্ড গঠন করা হয়। উক্ত বোর্ডে সদস্য হিসেবে যাঁদের নেওয়া হয় তারা হলেন সর্দার প্যাটেল, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং আমি। পার্লামেন্টারী বোর্ডের সদস্য হিসেবে আমি বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং সীমান্ত প্রদেশের পার্লামেন্টারী ব্যবস্থার তদারক করতে থাকি। এই সময় সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ই আমার সামনে উপস্থাপিত হতে থাকে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফলে যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়েই বলছি, মিঃ জিন্না এবং মুসলিম লীগ যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন সেগুলো ছিলো একেবারেই মিথ্যা। ওইসব অভিযোগের মধ্যে যদি সামান্যতম সত্যতাও থাকতো তাহলে আমি তা নিশ্চয়ই দেখতাম এবং সেগুলোর যথোপযুক্ত প্রতিবিধানও করতাম। সত্যিই যদি ওই ধরনের কোনো অত্যাচার বা অবিচার হতো তাহলে আমি আমার কাজে ইস্তফা দিতেও প্রস্তুত ছিলাম।
প্রায় দু বছর কংগ্রেসী মন্ত্রীরা দেশ শাসন করেন। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেন। এগুলোর মধ্যে জমিদারি এবং ভু-সম্পত্তি বিরোধ আইন, কৃষিঋণ মকুব, বয়স্কদের শিক্ষা এবং শিশুশিক্ষার ব্যাপক পরিকল্পনা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ এবং কৃষিঋণ মকুবের ব্যাপারটা খুব সহজে করা যায়নি। কায়েমী স্বার্থবাদীরা এই আইন দুটির তীব্র বিরোধিতা করে। কায়েমী স্বার্থবাদীরা তখন প্রতি পদক্ষেপে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই করে চলেছিলো। বিহারে ভূমিসংস্কারের ব্যাপারেও প্রবলভাবে এরা বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়, আমাকে ওই ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হয়। আমি জমিদারদের সঙ্গে আলোচনা করে অবশেষে একটা সমাধানের পথ বের করতে সক্ষম হই। আমার সেই সমাধানে জমিদার এবং কৃষক উভয় শ্রেণীই খুশী হয়।
আমার পক্ষে ওইসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছিলো, কারণ আমি কংগ্রেসের মধ্যে কোনো দল বা উপদলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করিনি। সংস্কারবাদী এবং রক্ষণশীল দলের মতবিরোধের সমস্যা আমি কিভাবে সমাধান করেছিলাম সে কথা আগেই বলা হয়েছে। ১৯২০ সনের সেই মতবিরোধের অবসান হলেও ত্রিশের দশকে কংগ্রেস আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়।
এবারে কংগ্রেসের মধ্যে দুরকম মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটিকে বলা হয় দক্ষিণপন্থী মতবাদ এবং অপরটিকে বলা হয় বামপন্থী মতবাদ। দক্ষিণপন্থীরা ছিলো কায়েমী স্বার্থের পক্ষে আর বামপন্থীরা ছিলো বৈপ্লবিক সংস্কারের পক্ষে। দক্ষিণপন্থীদের মানসিক ভীতিকে আমি যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিলেও বামপন্থীদের প্রতি আমার বেশি সহানুভূতি ছিলো। সংস্কারের ব্যাপারে তাঁরা যে মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন তাকেই আমি সঠিক বলে মনে করি। যাই হোক, আমি তখন কংগ্রেসের এই বিবদমান গোষ্ঠীদ্বয়ের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হই এবং দুই দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সমাধানের পথ বের করতে সক্ষম হই। সমাধানটি হলো, কংগ্রেস তার পরিকল্পনাগুলোকে যথোপযুক্তভাবে কার্যকর করবে এবং সে ব্যাপারে কোনোরকম বিরোধিতা করা হবে না।
কিন্তু ১৯৩৯ সনে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অবনতির জন্য কংগ্রেস তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর রূপদানের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন