৫। আমি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হলাম

৫. আমি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হলাম

ইয়োরোপে যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর। এরপর এক মাস পার হওয়ার আগেই পোল্যান্ডকে কুক্ষিগত করে নেয় জার্মান সমর নায়কেরা। ওদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আর এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় পোল্যান্ডের অধিবাসীরা। সোভিয়েত ইউনিয়ন হঠাৎ তেড়ে এসে পোল্যান্ডের পূর্বদিকের অর্ধেক অংশ দখল করে নেয়। পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বার পর সারা ইয়োরোপে এক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। জার্মান এবং ফরাসিরা নিজ নিজ সীমান্তের দুর্গপ্রাচীরের সামনে এসে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। তবে বড় রকমের কোনো সংঘর্ষ হয় না। সবারই মনে তখন ভীতি-মিশ্রিত অনিশ্চয়তার ভাব।

ভারতেও দেখা দেয় ভীতি ও অনিশ্চয়তার মনোভাব। এই অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক সময়ে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের পদটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পূর্ববর্তী বৎসর আমাকে যখন প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ জানানো হয় তখন আমি নানা কারণে তা প্রত্যাখ্যান করি; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মনোভাবের পরিবর্তন হয়। আমার মনে হয়, আমি যদি দায়িত্ব পরিহার করতে চাই তাহলে দেশের ও দশের প্রতি আমি ঠিকমতো আমার কর্তব্য পালন করতে পারব না। ভারতের এই যুদ্ধে শরিক হওয়ার ব্যাপারে গান্ধীজীর সঙ্গে আমার মতবিরোধের কথা আগেই বলা হয়েছে। মনে হয়, এবার যখন সত্যি সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তখন নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। ভারতকে অবশ্যই এবার গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো রকম দ্বিধা বা সংশয় থাকা উচিত হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারত যেখানে নিজেই পরাধীন, সে অবস্থায় সে অপরের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে কেমন করে? ইংরেজ সরকার যদি অচিরেই ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তাহলে ভারতবাসীর কর্তব্য হবে সর্বস্ব ত্যাগ করার সংকল্প গ্রহণ করা। আমার তাই ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে দায়িত্ব পরিহার করা উচিত হবে না। এরপর গান্ধীজী যখন আমাকে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হতে অনুরোধ করলেন, তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্মতি জানালাম।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তেমন কোনো বাধার সৃষ্টি হলো না। মিঃ এম. এন. রায় আমার বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। সেবার কংগ্রেসের অধিবেশন হয় রামগড়ে। সেখানে প্রেসিডেন্টের ভাষণে আমি যে অভিমত প্রকাশ করি সেই অভিমত অনুসারেই কংগ্রেস তার প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি এইরকম:

ইয়োরোপে যুদ্ধজনিত গুরুতর পরিস্থিতি এবং তৎসম্পর্কে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের অনুসৃত নীতি সম্বন্ধে গভীরভাবে বিবেচনা করে কংগ্রেস এ. আই. সি. সি. এবং ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবকে অনুমোদন করছে। কংগ্রেস মনে করে, ভারতের ইংরেজ সরকার যেভাবে ভারতবাসীর মতামত না নিয়ে ভারতকে যুদ্ধরত দেশ বলে ঘোষণা করেছেন এবং ভারতবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতের সম্পদকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করছেন, কোনো আত্মমর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন ভারতবাসীই তা মেনে নিতে পারে না। ইংরেজ সরকারের ঘোষণা থেকে জানা যাচ্ছে, বর্তমান যুদ্ধকে তাঁরা তাঁদের সাম্রাজ্য রক্ষা এবং তার আয়তন বর্ধিত করার উদ্দেশ্যেই চালিত করবেন বলে স্থির করেছেন। আরো বুঝতে পারা যাচ্ছে, ভারত তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে শোষণ করাই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই অবস্থায় কংগ্রেস কিছুতেই এই যুদ্ধের শামিল হতে পারে না, কারণ এর দ্বারা উক্ত শোষণ ব্যবস্থাকেই সমর্থন করা হবে। অতএব এই কংগ্রেস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে গ্রেট ব্রিটেনের স্বার্থে নিয়োজিত করার এবং ভারত থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং জনশক্তিকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করছে। ভারত থেকে যেভাবে সেনাবাহিনীতে লোক সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে সে ব্যবস্থাকে কখনো ভারতবাসীর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যবস্থা বলে মেনে নেওয়া চলে না। কংগ্রেসকর্মী এবং কংগ্রেসী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা ভারতের ধন, জন এবং অর্থকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করার ব্যাপারে কোনোক্রমে সহযোগিতা করতে পারে না।

কংগ্রেস এতদ্বারা পুনরায় ঘোষণা করছে, ভারতের জনগণ পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত অপর কোনো ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি নয়। এ সম্পর্কে আরো বলা হচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতাকে কোনোক্রমেই ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী অথবা ঔপনিবেশিক কাঠামোর অভ্যন্তরে রাখা চলবে না। অর্থাৎ একটা বিরাট জাতির মর্যাদা এবং সম্মানকে উপেক্ষা করে ভারতকে ইংরেজের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে টেনে আনা কিছুতেই চলবে না। ভারতের শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা ভারতবাসীরা নিজেরাই স্থির করবে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে তাও তারা নিজেরাই নিরূপণ করবে। এবং এটা করা হবে প্রাপ্তবয়স্কের ভোট দ্বারা নির্বাচিত একটি ‘কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’র মাধ্যমে।

ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতা এবং সমঝোতা সৃষ্টি করতে না পারলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাবে না; কংগ্রেস মনে করে, কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি এ ব্যাপারেও একটা সুষ্ঠু সমাধান করতে পারবে। কারণ উক্ত অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘু প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিই থাকবেন এবং এই প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে এবং প্রয়োজনবোধে সালিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ ব্যাপারে একটা মতৈক্যে আসবেন। এ ব্যাপারে অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হবে না। ভারতের সংবিধান অবশ্যই স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে রচিত হবে। কংগ্রেস তাই দেশবিভাগ অথবা জাতির অখণ্ডতা ব্যাহত করার যে-কোনো পরিকল্পনা এবং মতামতকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেস সব সময়ই বলে এসেছে এবং এখনো বলছে, ভারতে এমন এক সংবিধান রচিত হবে যাতে কোনো সম্প্রদায়, দল অথবা উপজাতির প্রতি কোনো রকম অবিচার হবে না, অর্থাৎ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের যে-কোনো সম্প্রদায়ের যে-কোনো ব্যক্তি সমান অধিকার লাভ করবে।

.

ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার বুঝে নেওয়ার পর আমার প্রথম কাজই হয় ওয়ার্কিং কমিটি পুনর্গঠন করা। পূর্ববর্তী কমিটির দশ জন সদস্যকে নবগঠিত কমিটিতে রাখা হয়। এঁরা হলেন:

শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, শেঠ যমুনালাল বাজাজ (কোষাধ্যক্ষ), শ্রী জে. বি. কৃপালনী (সাধারণ সম্পাদক), খান আবদুল গফফর খান, শ্রী ভুলাভাই দেশাই, শ্রী শঙ্কররাও দেও, ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং আমি নিজে।

ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের ওয়ার্কিং কমিটিতে জওহরলাল নেহরু ছিলেন না। সুভাষচন্দ্র বসু এবং গান্ধীজীর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় শ্রীবসু যখন কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের পদে ইস্তফা দেন, তখন থেকেই জওহরলাল নিজেকে আলাদা করে রাখেন। আমি জওহরলালকে ফিরিয়ে আনি। তাছাড়া শ্রী রাজাগোপালাচারী, ডঃ সৈয়দ মাহমুদ এবং মিঃ আসফ আলিকেও আমি ওয়ার্কিং কমিটিতে গ্রহণ করি। পঞ্চদশ সদস্যের নাম অঘোষিত রাখা হয়। আমি স্থির করি, এই নামটি পরে ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় না, কারণ কংগ্রেস অধিবেশনের অব্যবহিত পরেই আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। অতএব পঞ্চদশ সদস্যের স্থানটি শূন্যই থেকে যায়।

কংগ্রেস শিবিরে মতভেদ

কংগ্রেসের ইতিহাসে এই সময়টা ছিল বিশেষ সমস্যাসংকুল সময়। বিশ্ব-আন্দোলনকারী ঘটনাবলির সংঘাতে আমাদের মন সব সময় উদ্বিগ্ন ছিল। আরো একটি বাধা এই সময় দেখা দেয়। এটি হলো আমাদের মধ্যে মতবিরোধ। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি চাইছিলাম, একমাত্র স্বাধীন ভারতই বিশ্বের গণতান্ত্রিক শিবিরে অংশগ্রহণ করতে পারে। ভারতের মতামত সর্বদাই গণতন্ত্রের পক্ষে। কিন্তু এ ব্যাপারে একমাত্র বাধা ছিল ভারতের পরাধীনতা। গান্ধীজী কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করতেন। তাঁর মতে মূল বিষয় ছিল সমস্যাকে চাপা দেবার প্রবৃত্তি, ভারতের স্বাধীনতা নয়। আমি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলাম, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কখনো সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে চায় না, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো স্বাধীনতা অর্জন। অতএব, আমার মতে গান্ধীজীর অভিমত ছিল অবাস্তব।

গান্ধীজী কিন্তু তাঁর অভিমত পরিবর্তন করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর অভিমত ছিল, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ভারতের পক্ষে উচিত নয়। ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁকেও তিনি এই কথাই জানিয়ে দেন। তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে একখানা খোলা চিঠি লিখে তাতে মত প্রকাশ করেন, হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ইংরেজদের উচিত আধ্যাত্মিক দিক থেকে তাঁর বিরোধিতা করা। গান্ধীজীর এই আবেদন ইংরেজদের মনে এতটুকুও সাড়া জাগাতে পারে না। কারণ ইতিমধ্যেই ফ্রান্সের পতন হয়েছে এবং জার্মানশক্তি সদম্ভে আস্ফালন করে চলেছে।

গান্ধীজীর পক্ষে এই সময়টা ছিল অত্যন্ত কঠিন সময়। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, যুদ্ধ পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে চলেছে, অথচ এর প্রতিকারে তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না। তাঁর মানসিক অবস্থার এতটাই অবনতি ঘটেছিল, কয়েকবার তিনি আত্মহত্যার কথাও বলেছিলেন। ‘আমাকে বলেও ছিলেন, তাঁর যদি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তিনি নীরব দর্শক হয়ে থাকার চাইতে জীবন বিসর্জন দেওয়াটাই শ্রেয় মনে করেন। আমাকে তিনি বার বার তাঁর অভিমত গ্রহণ করবার জন্য চাপ দেন। আমি তাঁর অভিমত সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করি, কিন্তু কিছুতেই তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারি না। আমার মতে, অহিংসা আমাদের পথ হলেও একমাত্র এবং অবশ্যপালনীয় নীতি নয়। আমি যে মত পোষণ করতাম তা হলো, অন্য কোনো পন্থার সুবিধা না হলে অস্ত্রধারণের অধিকার ভারতের অবশ্যই আছে। তবে, শান্তিপূর্ণ পথে স্বাধীনতা অর্জন করাটাই সর্বোত্তম পথ, এবং এই ব্যাপারে গান্ধীজীর অভিমতই সঠিক ছিল।

এই বিষয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতেও মতবিভেদ দেখা দেয়। প্রথম দিকে জওহরলাল নেহরু, সর্দার প্যাটেল, শ্রী রাজাগোপালাচারী এবং খান আবদুল গফফর খান আমার দিকে ছিলেন। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, আচার্য কৃপালনী এবং শ্রী শঙ্কররাও দেও সর্বান্তঃকরণে গান্ধীজীর সমর্থক ছিলেন। গান্ধীজীর সঙ্গে একমত হয়ে তাঁরা বলতেন, একবার যদি স্বীকার করে নেওয়া হয় স্বাধীন ভারত যুদ্ধের শামিল হতে পারবে তাহলে অহিংস পন্থায় আন্দোলনের মূল কথাটাই অকেজো হয়ে যাবে। আমি কিন্তু তা মনে করতাম না। আমার মতে স্বাধীনতার জন্য আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাইরের সংগ্রাম মূলত আলাদা। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা এক জিনিস, এবং স্বাধীনতা পাওয়ার পর যুদ্ধ করা অন্য জিনিস। আমার মতে এ দুটো জিনিসকে একাকার করা ঠিক নয়।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে মতবিরোধ

পরিস্থিতি রীতিমতো জটিল হয়ে ওঠে ওয়ার্কিং কমিটির এবং ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে পুনেতে অনুষ্ঠিত এ. আই. সি. সি.র সভায়। রামগড় অধিবেশনের পরে এটিই ছিল নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির প্রথম সভা। উক্ত সভায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি আমার বক্তব্য পেশ করি। ঘটনাবলিকে আমি যেভাবে বিচার করেছিলাম, সেই কথাই আমি কমিটির সামনে বলি। কমিটি আমার বক্তব্য মেনে নেয়। এরপর দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংসাই প্রকৃত পথ, সুতরাং কংগ্রেস এ পথ থেকে বিচ্যুত হবে না; দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, নাৎসিবাদ এবং গণতন্ত্রের মধ্যে যুদ্ধে ভারত অবশ্যই গণতান্ত্রিক শিবিরে থাকবে; তবে যতদিন পর্যন্ত সে নিজে স্বাধীন না হতে পারছে ততদিন যুদ্ধের ব্যাপারে সে নিজেকে জড়িত করবে না। এই প্রস্তাব দুটি আমার তৈরি খসড়া অনুসারেই রচিত এবং শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়।

অহিংস সংগ্রামকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত পথ হিসেবে ঘোষণা করে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় গান্ধীজী খুবই খুশি হন। তিনি তখন আমার কাছে ধন্যবাদজ্ঞাপক একখানা টেলিগ্রাম করে জানান আভ্যন্তরীণ সংগ্রামে অহিংসার পথকে আমি যেভাবে সমর্থন করেছি তাতে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন। তিনি মনে করতেন, দেশের তৎকালীন মানসিকতায় এ. আই. সি. সি. সহজেই আমার প্রস্তাবটি মেনে নিতেন, ভারতের স্বাধীনতা স্বীকৃত হলে সে যুদ্ধে যোগদান করবে। তাঁর মনে তাই সন্দেহ ছিল, আভ্যন্তরীণ সংগ্রামের ব্যাপারে কমিটি কর্তৃক অহিংসার পথকে একমাত্র পথ বলে স্বীকার করিয়ে নিতে আমি হয়তো পারব না।

ওয়ার্কিং কমিটির সভ্যরা কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে ঐকমত হতে পারেন না। এ কথা তাঁরা ভুলতে পারেননি যে যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে গান্ধীজী পুরোপুরিভাবে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছিলেন। এও তাঁরা ভুলতে পারছিলেন না যে গান্ধীজীর নেতৃত্বেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বর্তমান পর্যায়ে আসতে পেরেছে। এই প্রথম তাঁরা একটি মূল প্রশ্নে গান্ধীজীর সঙ্গে একমত হতে পারছেন না, যার ফলে তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। এই চিন্তাধারার ফলে এবং বিশেষ করে অহিংসার প্রতি গান্ধীজীর পূর্ণ বিশ্বাসের কথা বিবেচনা করে তাঁদের বিচারবোধ প্রভাবিত হতে শুরু করে। এর ফলে পুনা সম্মেলনের এক মাস পরেই সর্দার প্যাটেল তাঁর মত পরিবর্তন করে গান্ধীজীর মতকে সমর্থন করেন। অন্যান্য সদস্যরাও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং আরো কয়েকজন সদস্য আমাকে এক পত্র লিখে জানান, যুদ্ধের ব্যাপারে গান্ধীজী যে অভিমত পোষণ করছেন তাঁরা তা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেন এবং গান্ধীজীর পন্থাই কংগ্রেসের একমাত্র পন্থা হওয়া উচিত এই মতও ব্যক্ত করেন। তাঁরা আরো বলেন, আমি যেহেতু ভিন্ন মত পোষণ করি এবং আমার সেই ভিন্ন মত এ. আই. সি. সি. র পুনা সম্মেলনে সমর্থিত হয়েছে, সেইহেতু তাঁদের পক্ষে ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকা সঙ্গত কিনা সে বিষয়ে তাঁদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করবার জন্যই তাদের ওয়ার্কিং কমিটিতে মনোনীত করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু প্রেসিডেন্টের মতামতের সঙ্গে তাঁদের মতামতের মৌলিক বিরোধ রয়েছে, সে অবস্থায় তাঁদের সদস্যপদ পরিত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও তাঁরা বলেছেন, আমাকে অসুবিধায় ফেলবার উদ্দেশ্য তাঁদের নেই; তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত হলো, কার্যক্ষেত্রে নীতি প্রয়োগের বেলায় যতদিন তাঁদের এই মতানৈক্য বাধা হয়ে না দাঁড়াবে ততদিন তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকতে রাজি আছেন। তবে ইংরেজ সরকার যদি আমার দাবি মেনে নেন এবং আমাদের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বার অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে তাঁদের সরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। সর্বশেষে তাঁরা বলেন, আমি যদি তাঁদের এই অভিমত মেনে নিই তাহলে তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকতে রাজি আছেন, অন্যথায় তাঁদের পত্রকে ইস্তফাপত্র হিসেবে গণ্য করতে হবে।

এই চিঠি পেয়ে আমি খুবই দুঃখিত হই। চিঠিতে জওহরলাল, রাজাগোপালাচারী, আসফ আলি এবং সৈয়দ মামুদ ছাড়া আর সকলেই সই করেছিলেন। এমনকি, খান আবদুল গফফর খান, যিনি কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন, তিনিও তার মত পরিবর্তন করেছেন দেখতে পাই। আমি আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে এই ধরনের চিঠি পাবো বলে ভাবতেও পারিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিঠির উত্তরও দিই। উত্তরে লিখি, তাদের মনোভাব আমি বুঝতে পেরেছি এবং তাদের বক্তব্য মেনে নিচ্ছি। বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে তাতে তারা যে ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেবে এমন কোনো আশা আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং ব্রিটিশদের এই মনোভাব যতদিন পরিবর্তিত না হচ্ছে ততদিন যুদ্ধে যোগদানের বিষয়টি একটি কেতাবি আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে; অতএব, আমি তাদের অনুরোধ করছি, তারা যেন ওয়ার্কিং কমিটিতে থেকে যান।

১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে ভাইসরয় আমাকে তার সঙ্গে আলোচনা করবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণপত্রে তিনি আলোচ্য বিষয়ের যে আভাস দেন তা হলো, কংগ্রেস যদি যুদ্ধের ব্যাপারে সহযোগিতা করে তাহলে তিনি তার এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের আয়তন বাড়াতে এবং সেই কাউন্সিলের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা দিতে রাজি আছেন। আমি এই আমন্ত্রণ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করি। এমনকি প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজনও বোধ করি না। আমার মতে কংগ্রেসের স্বাধীনতার দাবি এবং ভাইসরয়ের বর্ধিত এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। এমতাবস্থায় তার সঙ্গে দেখা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু দেখতে পাই, কংগ্রেসের অনেক কর্মী আমার এই সিদ্ধান্তকে খোলা মনে মেনে নিতে পারেননি। তাদের বক্তব্য হলো ভাইসরয়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করাটা উচিত হয়নি। ভাইসরয়ের সঙ্গে আমার দেখা করা উচিত ছিল। কিন্তু আজও আমি মনে করি যে ওই ব্যাপারে আমি সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিলাম।

এই ব্যাপারে গান্ধীজীর মতামত কিন্তু বেশিরভাগ কংগ্রেস কর্মীর মতামতের বিপক্ষে ছিল। তিনি আমাকে একটি চিঠি লিখে আমার কাজকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেন। তার মতে ভাইসরয়ের সঙ্গে আমার দেখা না করাটা ভগবানের আশীর্বাদের প্রতীক। ভারত যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ুক এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা নয়; তার মতে আমি যে ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করিনি তার প্রকৃত কারণ এইটিই। ঘটনাটির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে গান্ধীজীর মনে এ সন্দেহ থেকেই যায়, আমি যদি পরবর্তীকালে ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করি তাহলে হয়তো তার সঙ্গে একটা আপস করে নিয়ে ভারতকে যুদ্ধের ভেতরে টেনে আনবো।

এর কিছুদিন পরেই গান্ধীজী এক কাণ্ড করে বসলেন। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে এক খোলা চিঠি লিখে তিনি তাদের কাছে আবেদন জানালেন, হিটলারের মোকাবিলা করতে হলে অস্ত্র পরিত্যাগ করে আধ্যাত্মিক পন্থা গ্রহণ করা দরকার। এখানেই তিনি থামলেন না। এরপর তিনি লর্ড লিনলিথগোর সঙ্গে দেখা করে এই অভিনব পন্থাটি গ্রহণ করবার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন, এবং বললেন যে তিনি যেন তার (গান্ধীজীর) প্রস্তাবটি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে জানিয়ে দেন।

গান্ধীজীর প্রস্তাবে লর্ড লিনলিথগো এতটাই বিস্মিত হলেন যে তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হলো না। এর আগে গান্ধীজী যখন তার সঙ্গে দেখা করে আলাপ-আলোচনা করেছেন, তখন আলোচনা শেষে তিনি ঘণ্টা বাজিয়ে একজন এডিকংকে ডেকে এনে গান্ধীজীকে তার গাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে বলতেন। এবারে কিন্তু তিনি ঘণ্টাও বাজালেন না অথবা কোনো এডিকংকেও ডাকলেন না। গান্ধীজী তাই নিজেই তার গাড়ির কাছে ফিরে এলেন। এরপর আমার সঙ্গে যখন তার দেখা হয়, তখন ভাইসরয়ের এই ত্রুটির কথাটা তিনি আমাকে জানান। সব কথা শুনে আমি তাকে বলি, আপনার প্রস্তাবের অভিনবত্ব ভাইসরয়কে এতটাই বিস্মিত করে ফেলেছিল যে সাধারণ শিষ্টাচারের কথাও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। আমার কথায় গান্ধীজী হো হো করে হেসে ওঠেন।

এদিকে কংগ্রেসের মধ্যে তখনও অন্তর্দ্বন্দ্ব চলেছে। গান্ধীজীর মতে কংগ্রেস কোনোক্রমেই যুদ্ধে জড়াবে না। পক্ষান্তরে আমরা ছিলাম ভিন্ন মতের সমর্থক। আমাদের অভিমত ছিল বর্তমান অবস্থায় ভারত কখনোই যুদ্ধের ব্যাপারে কোনো সাহায্য করবে না। প্রকৃতপক্ষে আমার নীতি এবং গান্ধীজীর অভিমতের ভেতরে যে পার্থক্য তাকে বলা চলে তত্ত্বগত পার্থক্য। আসলে ব্রিটিশদের মতিগতি দেখে আমরা আমাদের মধ্যে তত্ত্বগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একতাবদ্ধ হতে পেরেছিলাম।

এরপর প্রশ্ন উঠলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের কী করা উচিত? রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে সে কিছুতেই নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। বিশেষ করে সারা পৃথিবী যখন ঘটনার আবর্তে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে তখন কংগ্রেসের পক্ষে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকা কোনোক্রমেই উচিত হবে না। গান্ধীজী কিন্তু প্রথম দিকে আন্দোলন করার বিরোধিতা করেন। তার মতে আন্দোলন মানেই স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন; কিন্তু ভারত যদি স্বাধীনতা পেয়ে যায় তাহলে সে নিশ্চয়ই যুদ্ধের মধ্যে জড়িত হয়ে পড়বে। কিন্তু দিল্লী এবং পুনায় সম্মেলনের পরেও ব্রিটিশরা যখন কংগ্রেসের সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তখন তিনি সীমিতভাবে আইন অমান্য আন্দোলনের কথা চিন্তা করতে থাকেন। তিনি প্রস্তাব দেন, ভারতকে যুদ্ধের ভেতরে টেনে আনার বিরুদ্ধে ভারতের নরনারীরা ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রতিবাদ জানাবে। তারা প্রকাশ্যে এই ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাবে এবং এর জন্য গ্রেপ্তার বরণ করবে। আমি এই সীমিত আন্দোলনের বিরোধী ছিলাম। আমার মতে যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনকে আরো ব্যাপক এবং আরো জোরদার করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু গান্ধীজী এতে সম্মত হন না। গান্ধীজী যখন কিছুতেই আর বেশি এগোতে চাইলেন না তখন আমিও অবশেষে তার প্রস্তাবিত সেই ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পক্ষে মত দিলাম।

প্রথম ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহী হিসেবে বিনোবা ভাবেকে নির্বাচিত করা হয়। ভাবের পরে পণ্ডিত নেহরু সত্যাগ্রহ করতে চান এবং গান্ধীজী তার প্রস্তাবে সম্মত হন। এরপর আরো অনেকে এগিয়ে আসেন এ ব্যাপারে। ফলে সারা দেশজুড়ে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ শুরু হয়ে যায়। আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এমন এক পর্যায়ে এসে যায় যে অহিংসার তত্ত্বে গান্ধীজীর সঙ্গে আমার প্রচণ্ড মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করার ব্যাপারে আমরা দুজনেই একমত হই।

এই ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ আন্দোলনের একটা প্রহসনের দিকও ছিল। সম্পূর্ণ সিং নামে একজন পাঞ্জাবী গান্ধীজীর অথবা ওয়ার্কিং কমিটির মত না নিয়েই সত্যাগ্রহ করতে এগিয়ে আসে। এরপর তাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে সে এমন সব বাতচিত ঝাড়তে থাকে যার সঙ্গে কংগ্রেসের পরিকল্পনার আদৌ কোনো মিল ছিল না। বিচারকারী ম্যাজিস্ট্রেট তাকে এক আনা জরিমানা করেন। সে তখন পকেট থেকে এক আনা পয়সা বের করে জরিমানা দিয়ে বেরিয়ে আসে। সম্পূর্ণ সিংয়ের এই অপকর্মের ফলে পাঞ্জাবের আন্দোলন এমনই হাস্যকর হয়ে ওঠে যে এর প্রতিবিধানের জন্য শেষ পর্যন্ত আমাকে সেখানে গিয়ে আন্দোলনকে সঠিক পথে আনতে হয়। পাঞ্জাব থেকে ফেরার পথে এলাহাবাদে আমি গ্রেপ্তার হই। আমার এই গ্রেপ্তারটাও বেশ কিছুটা হাস্যকর ছিল। আমি যখন সকালবেলা চা পানের জন্য রিফ্রেশমেন্ট রুমের দিকে যাচ্ছিলাম সেই সময় পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমার সামনে এগিয়ে এসে সবিনয়ে আমার গ্রেপ্তারী পরোয়ানাটা দেখান। ভদ্রলোকের বিনীত ভাব দেখে আমি গম্ভীরভাবে বলি:

আপনি যেভাবে আমার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন তাতে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমাকে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ করবার সুযোগ না দিয়েই আপনি আমাকে গ্রেপ্তার করলেন।

আমি দু বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে নৈনী জেলে স্থানলাভ করি। কিছুদিন পরে ডঃ কাটজুও সেখানে এসে আমার সঙ্গে মিলিত হন। আমাদের কিন্তু পুরো মেয়াদটা জেলে থাকতে হয় না, কারণ বিশ্ব আলোড়নকারী দুটি ঘটনার ফলে যুদ্ধের চেহারা তখন আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথম ঘটনাটা হলো ১৯৪১ সালে জুন মাসে জার্মানী কর্তৃক সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ এবং দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো জাপান কর্তৃক আমেরিকা অধিকৃত পার্ল হারবার আক্রমণ। এই আক্রমণ অনুষ্ঠিত হয় জার্মানী কর্তৃক সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের ছ মাসের মধ্যেই।

জার্মানী এবং জাপান কর্তৃক যথাক্রমে সোভিয়েত রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হবার ফলে যুদ্ধের পরিধি সারা বিশ্বে বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধটা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়। জার্মানী কর্তৃক সোভিয়েত রাশিয়া আক্রান্ত হবার আগে যুদ্ধটা পশ্চিম ইয়োরোপের দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু রাশিয়া আক্রান্ত হবার পরে যুদ্ধটা বিশাল ভূখণ্ডে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে এবং যেসব অঞ্চল যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে ছিল সেগুলোও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ইংলন্ডকে বিশেষভাবে সাহায্য করলেও সে ছিল যুদ্ধের ধরাছোঁয়ার বাইরে; কিন্তু জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সেও যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে, যার ফলে যুদ্ধটা প্রকৃত পক্ষে বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।

প্রাথমিক স্তরে জাপানের অভাবিত সাফল্যের ফলে যুদ্ধটা ভারতের একেবারে দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জাপান মালয় এবং সিঙ্গাপুর অধিকার করে নেয়। এরপর ব্রহ্মদেশও তারা অধিকার করে ফেলে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৩৭ সালের আগে পর্যন্ত ব্রহ্মদেশ ভারতেরই অংশ ছিল। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থায় এসে দাঁড়ায় যে ভারত আক্রান্ত হবার আশঙ্কাও দেখা দেয়। জাপানের যুদ্ধজাহাজগুলো বঙ্গোপসাগরে এসে উপস্থিত হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই জাপানী নৌবহর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়।

জাপান যুদ্ধে জড়িত হবার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি যুদ্ধের ভেতরে এসে যায়। ইতিপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশদের ভারতের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে বলেছিল। এবারে তারা এ ব্যাপারে রীতিমতো চাপ দিতে শুরু করে। তাদের বক্তব্য হলো, ব্রিটিশ সরকারকে অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে একটি মীমাংসা করে ভারতবাসীর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সহযোগিতা লাভ করা বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পরে জানা যায়, জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রান্ত হবার অব্যবহিত পরেই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন, ভারতের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করা দরকার। ব্রিটিশ সরকার তার এই অনুরোধ এড়াতে পারে না এবং এর ফলে তারা তাদের নীতি কিছুটা পরিবর্তন করবেন বলে স্থির করেন।

১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাইসরয় স্থির করেন জওহরলালকে এবং আমাকে মুক্তি দেওয়া হবে। এটা করা হয় কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করবার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ পরিবর্তিত অবস্থায় কংগ্রেস কী মনোভাব গ্রহণ করেছে বা করবে তা বোঝবার জন্যই ভাইসরয় আমাদের দুজনকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সরকারের আরো উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের দুজনের চালচলন লক্ষ্য করবার পর অন্যান্য নেতাদের মুক্তি দেবার কথা তারা বিবেচনা করবেন। যে-কোনো কারণেই হোক, আমাকে মুক্তি দেওয়াটা সরকারের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আমার অনুপস্থিতিতে ওয়ার্কিং কমিটির কোনো মিটিং হতে পারে না, সেইজন্যই আমাকে মুক্তি দেওয়াটা দরকার হয়ে পড়েছিল।

মুক্তির হুকুমনামা যখন আমার কাছে পৌঁছয় তখন আমার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিলাভের পরে আমি রীতিমতো অস্বস্তিবোধ করি। আগে যখন জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছি, সে মুক্তিকে তখন আংশিক সাফল্য বলেই মনে করেছি, কিন্তু এবারে মুক্তি পেয়ে আমার মনে হয়, দু বছর যাবৎ যুদ্ধ চলা সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতার জন্য আমরা বিশেষ কিছুই করতে পারিনি। আমরা যেন এতোদিন শুধু অবস্থার দাস হয়ে দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছি।

মুক্তিলাভ করবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বারদৌলীতে ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করি। গান্ধীজীও তখন ওখানেই ছিলেন এবং তার ইচ্ছানুসারেই বারদৌলীতে সভার স্থান নির্ধারণ করা হয়। আমি যখন গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করি তখন দেখি যে তিনি আরো দূরে সরে গেছেন। আগে আমাদের মধ্যে শুধুমাত্র নীতিগত প্রশ্নেই মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এখন দেখা গেলো, ঘটনাবলী বিশ্লেষণের ব্যাপারেও তার আর আমার মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। গান্ধীজীর মত হলো, ভারত যদি যুদ্ধের ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করতে সম্মত হয় তাহলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেবে। তিনি আরো বলেন, যদিও ব্রিটিশ সরকার এখন রক্ষণশীল দলের দ্বারা গঠিত এবং সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন মিঃ চার্চিল, তবুও যুদ্ধ-পরিস্থিতি এমন ঘোরালো হয়ে পড়েছে যে ভারতের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য তাকে স্বাধীনতা দেওয়া ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের অন্য কোনো পথ নেই। আমার বিশ্লেষণ কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। আমি মনে করতাম, ব্রিটিশ সরকার আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য উদগ্রীব হলেও ভারতকে তখনই স্বাধীনতা দিতে তারা প্রস্তুত নন। আমার দৃঢ় ধারণা, যুদ্ধ চলাকালে তারা বড়জোর একটা নতুন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করে কংগ্রেসের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা দিতে পারেন। এই বিষয়টি নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়, কিন্তু আমি তাকে আমার মতে আনতে সক্ষম হই না।

এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বলে রাখা দরকার, মুক্তিলাভের কয়েকদিন পরেই আমি কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করি। এই সম্মেলনে কোনো কোনো সাংবাদিক আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেন, যুদ্ধের ব্যাপারে কংগ্রেস তার নীতি পরিবর্তন করতে সম্মত আছে কিনা, তখন বলি, এটা সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ সরকারের মতিগতির ওপর নির্ভর করছে; সরকার যদি তার মতিগতি পরিবর্তন করেন তাহলে কংগ্রেস তা করবে। আমি পরিষ্কারভাবে তাদের বলি, যুদ্ধের প্রতি কংগ্রেস যে মনোভাব গ্রহণ করেছে তা অপরিবর্তনীয় মতান্ধতা কখনোই নয়। এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, জাপান যদি ভারত আক্রমণ করে তাহলে ভারত কী করবে? এর উত্তরে মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করেও আমি বলি, ভারতবাসী তার নিজের দেশকে রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ করতে দ্বিধা করবে না; তবে এ কথাও বলি, এ কাজ আমরা তখনই করতে পারি, যখন আমাদের হাত-পা থেকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করে দেওয়া হবে। পরাধীনতার শৃঙ্খলে যাদের হাত-পা বাঁধা তারা কী করে যুদ্ধ করতে পারে?

এই সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে লন্ডনের ‘টাইমস’ এবং ‘ডেলি নিউজ’ পত্রিকা মন্তব্য প্রকাশ করে। তারা বলে, আমার এই বক্তব্য থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে গান্ধীজীর সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্বের মতবৈষম্য ঘটেছে। গান্ধীজী যুদ্ধ সম্বন্ধে এমন এক অপরিবর্তনীয় নীতি পোষণ করেন যাতে পরবর্তী আলাপ-আলোচনার কোনো পথই আর খোলা থাকে না; কিন্তু কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকে জানা যায়, আপসের পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়নি।

ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গান্ধীজী বিলাতী পত্রিকায় এই মন্তব্যের কথা উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, এই মন্তব্য থেকে তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারছেন, কংগ্রেস যদি যুদ্ধের কাজে সহজে সহযোগিতা করতে সম্মত হয় তাহলে ব্রিটিশ সরকারও তার মতিগতি পরিবর্তন করবে। অতঃপর কংগ্রেসের কর্তব্য ও করণীয় নিয়ে পুরো দুদিন আলোচনা চলে; কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো মতৈক্য হয় না। গান্ধীজী তার অহিংসার নীতিকে আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং বলেন, কোনো অবস্থাতেই এ নীতিকে পরিত্যাগ করা চলবে না এবং এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ভারতের যুদ্ধে লিপ্ত হবার বিরুদ্ধে তিনি তার ঘোর আপত্তির কথা জানান। আমি তখন আমার আগের অভিমতের পুনরাবৃত্তি করে বলি, অহিংসাকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেয়ে ভারতের স্বাধীনতাই আমাদের বেশি কাম্য।

এই ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো-না-কোনো সমাধানের পথ বের করতে পারাটা গান্ধী-চরিত্রের একটি আশ্চর্যরকম বিশেষত্ব ছিল; তাই এবারেও তিনি উভয়পক্ষের গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানের পথ বের করতে সক্ষম হন। এছাড়া বিরোধীপক্ষের মতামত সুষ্ঠুভাবে অনুধাবন করবার একটি বিস্ময়কর ক্ষমতাও তার ছিল। তাই তিনি যখন যুদ্ধের ব্যাপারে আমার দৃঢ় মনোভাবের কথা বুঝতে পারলেন তখন তিনি আমার মত পরিবর্তনের জন্য আর কোনো চাপের সৃষ্টি করলেন না। অধিকন্তু ওয়ার্কিং কমিটির সামনে তিনি এমন এক খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপিত করলেন, যে প্রস্তাবে আমার অভিমতই প্রতিফলিত হয়।

এর কিছুদিন পরেই ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা দেয়। যুদ্ধের প্রথম থেকেই সুভাষচন্দ্র বসু যুদ্ধের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ করে আন্দোলন চালাতে থাকেন। এবং তার এই কার্যক্রমের ফলে শেষ পর্যন্ত তাকে বন্দী হতে হয়। কিন্তু বন্দী অবস্থায় তিনি যখন অনশন শুরু করেন তখন তাকে মুক্তি দিয়ে স্বগৃহে অন্তরীণ অবস্থায় রাখা হয়। ১৯৪১ সালের ২৬শে জানুয়ারি জানতে পারা যায় তিনি ভারত থেকে পালিয়ে গেছেন। এরপর দু বছর বা তারও কিছু বেশি সময় তার কোনো খবরই পাওয়া যায় না। তিনি জীবিত না মৃত সে কথা দেশবাসী জানতে পারে না। কিন্তু ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে সকল সন্দেহের নিরসন করে তিনি বার্লিন বেতারকেন্দ্র থেকে এক বক্তৃতা দেন। এ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায়, তিনি জার্মানীতে গিয়ে সেখানে একটি ব্রিটিশ-বিরোধী ফ্রন্ট গঠন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত অধিকার করে রাখার বিরুদ্ধে জাপানী প্রচারও যথেষ্ট সরব হয়ে ওঠে। জার্মানী এবং জাপান থেকে যুগপৎ এই ধরনের প্রচারে ভারতীয় জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশ রীতিমতো প্রভাবিত হয়ে পড়ে। অনেকেই এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে জাপান ভারতের স্বাধীনতা এবং এশিয়ার আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যই যুদ্ধ করছে। তাদের আরো ধারণা যে জাপানী আক্রমণ ব্রিটিশদের শক্তিকে খর্ব করছে বলে প্রকারান্তরে এটা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায় হয়েছে; সুতরাং এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করা আমাদের উচিত। এইরকম মনোভাবের ফলে ভারতের জনগণের একটা অংশ জাপানিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে পড়ে।

আরো একটি ব্যাপারে গান্ধীজীর সঙ্গে আমার মতবিরোধ ঘটে। গান্ধীজীর মনে ক্রমশ এই বিশ্বাস বেশি করে দানা বাঁধতে থাকে যে মিত্রপক্ষ জয়লাভ করতে পারবে না। তার আশঙ্কা হয়, শেষ পর্যন্ত হয়তো জার্মানী এবং জাপানই জয়লাভ করবে, অথবা এমনও হতে পারে, মিত্রপক্ষ স্ব-উদ্যোগে সৃষ্ট সংকটে ডুবে মরবে।

গান্ধীজী অবশ্য প্রকাশ্যে এইরকম কোনো মতামত কখনো ব্যক্ত করেননি, কিন্তু তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমি বুঝতে পারি, মিত্রপক্ষের জয় সম্বন্ধে তিনি রীতিমতো সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। আমি দেখতে পাই, সুভাষ বসুর জার্মানীতে উপস্থিত হওয়াটা তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। আগে তিনি সুভাষ বসুর অনেক কাজেরই বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু এখন এ ব্যাপারে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করি। আলোচনার সময় তিনি এমন সব মন্তব্য করেন যাতে বুঝতে পারা যায়, সুভাষ বসুর সাহস এবং কর্মধারাকে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখছেন। এখানে আরো একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সুভাষ বসুর প্রতি তার এই শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাবের ফলে যুদ্ধের প্রতি তার যে মনোভাব ছিল সে মনোভাব তার অজ্ঞাতসারেই বেশ কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

পরবর্তীকালে ক্রিপস মিশনের প্রতি তিনি যে মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন সেটাও সুভাষ বসুর প্রতি তার অনুকূল মনোভাবের কথা বুঝতে পারা যায়। ক্রিপসের প্রস্তাবটা কী ছিল এবং আমরা সে প্রস্তাব কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলাম সে কথা আমি পরবর্তী কোনো অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করব; এখানে শুধু সে সময়কার একটি রিপোর্ট সম্বন্ধে কিছু বলা হচ্ছে। সে সময় (অর্থাৎ ক্রিপস যখন ভারতে এসেছিলেন) হঠাৎ সংবাদপত্রে একটা খবর বের হয়, সুভাষ বসু বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সংবাদটা প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতে এক মহা আলোড়নের সৃষ্টি হয়। আর সকলের মতো গান্ধীজীও এ সংবাদে অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি তখন সুভাষ বসুর মায়ের কাছে একটি তারবার্তা প্রেরণ করেন। সেই তারবার্তায় তিনি সুভাষ বসুর দেশপ্রেমের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে জানা যায়, খবরটির কোনো ভিত্তি নেই।

সেই সময় ক্রিপস আমাকে বলেন, অহিংসার পূজারীর মনোভাব তাকে বিস্মিত করেছে। যে সুভাষ বসু অক্ষশক্তির পক্ষে যোগ দিয়েছেন এবং মিত্রপক্ষের পরাজয়ের জন্য প্রচণ্ডভাবে প্রচার শুরু করেছেন তার প্রতি গান্ধীজীর এইরকম শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব দেখে তিনি রীতিমতো বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছেন। এটা তিনি মোটেই আশা করেননি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন