১৩. মন্ত্রিমিশন
১৯৪৬ সালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে বসে আমি দেখতে পাই দেশের অবস্থা তখন সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। সম্পূর্ণ নতুন এক ভারতবর্ষের জন্ম হয়েছে তখন। সরকারী, বে-সরকারী নির্বিশেষে ভারতের জনসাধারণ স্বাধীনতার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। ইংরেজদের মনোভাবেও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রথম দিকে যা ভাবা গিয়েছিলো, ইংলন্ডের শ্রমিক সরকার সেই পথেই চলেছে দেখা গেলো। তারা তখন সঠিক পথেই ভারতের পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা করছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার অব্যবহিত পরেই ওরা এক পার্লামেন্টারী ডেলিগেশন ভারতে পাঠায়। এই ডেলিগেশন ভারতে আসে ১৯৪৫-৪৬-এর শীতকালে। ডেলিগেশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি বুঝতে পারি ভারতীয়দের মনোভাব তাঁরা সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছেন। তাঁরা নিশ্চিতরূপেই বুঝতে পেরেছেন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেবার ব্যাপারটাকে আর বেশিদিন ঝুলিয়ে রাখা চলবে না। ইংলন্ডের সরকারের কাছেও সেইরকম রিপোর্টই তারা দেন। ওঁদের সেই রিপোর্ট হস্তগত হবার পরেই শ্রমিক মন্ত্রিসভা স্থির করেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতের সমস্যাটির একটি সুষ্ঠু সমাধান করতে হবে।
১৯৪৬-এর ১৭ই ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে নটায় আমি রেডিওতে ইংরেজ সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের সংবাদ শুনতে পাই। সংবাদে বলা হয়, লর্ড পেথিক লরেন্স পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছেন ইংরেজ সরকার ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটি আলোচনা করবার জন্য মন্ত্রীপর্যায়ের একটি মিশনকে ভারতে পাঠাবেন বলে স্থির করেছে। একই দিনে ভারতের ভাইসরয়ও ওই কথাই ঘোষণা করেন। মন্ত্রিমিশনের সদস্য হিসেবে কে কে আসছেন তাঁদের নামও ঘোষণা করা হয়। এঁরা হলেন ভারত-সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, বোর্ড অব ট্রেডের প্রেসিডেন্ট স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং ফার্স্ট লর্ড অব অ্যাডমিরালিটি মিঃ এ. ভি. আলেকজান্ডার। রেডিওতে এই ঘোষণাবাণী প্রচারিত হবার আধ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের একজন প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
আমি তাঁকে বলি, শ্রমিক সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে আমি খুশী হয়েছি। আমি আরো খুশী হয়েছি মন্ত্রিমিশনের সদস্যদের মধ্যে আমাদের পুরনো বন্ধু স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসও থাকছেন জেনে। স্যার স্ট্যাফোর্ড আগেও একবার ভারতে এসে এখানকার সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে গেছেন।
আমি আরো বলি, একটি বিষয় আমার কাছে খুবই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে যে ইংলন্ডের নতুন সরকার ভারতের সমস্যাকে আর ঝুলিয়ে রাখতে চায় না। তারা যেভাবে সাহসের সঙ্গে এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে তাকে অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।
১৯৪৬-এর ১৫ই মার্চ ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী মিঃ অ্যাটলি কমনস সভায় ভারতীয় পরিস্থিতি সম্বন্ধে এক বিবৃতি দেন। ইঙ্গ-ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে সেটি এক অভূতপূর্ব ঘটনা। তিনি অকপটে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকার করেন, পরিস্থিতি বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এ ব্যাপারে অগ্রসর হবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, পুরনো পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে থাকলে কোনো সমাধান তো হবেই না, উপরন্তু আর একবার অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে; আর তা যদি হয় তাহলে ভারতবর্ষে এক অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
মিঃ অ্যাটলির সেই বিবৃতির কিছু কিছু অংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, উভয়পক্ষেই কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটি ছিলো; সুতরাং আগের দিনের সেসব কথাকে পুরোপুরিভাবে পরিহার করে এবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে গেলে মোটেই ভালো ফল পাওয়া যাবে না; কারণ ১৯৪৬-এর মেজাজ ১৯২০, ১৯৩০ এবং ১৯৪২-এর মেজাজ অপেক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি আরো বলেন, ভারতীয়দের মধ্যে মতভেদের ব্যাপারে তিনি জোর দেবেন না। কারণ মতভেদ যতই থাক না কেন, ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁরা সবাই একমত। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয়দের একই দাবি – ভারতের স্বাধীনতা। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, মারাঠী প্রভৃতি সবাই চায় ভারতকে স্বাধীনতা দিতে হবে। এমন কী সরকারী কর্মচারীরাও এই কথাই বলেন। মিঃ অ্যাটলি অকপটভাবে স্বীকার করেন ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ এখন এমন এক পর্যায়ে এসে গেছে যে সেনাবাহিনীর মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের যে সেনাবাহিনী যুদ্ধের সময় চমৎকারভাবে কাজ করেছে তারাও আজ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ। মিঃ অ্যাটলির মতে ভারতীয়দের ভেতর যেসব সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিদ্যমান রয়েছে সেগুলো তারা নিজেরাই সমাধান করবে। অবশেষে তিনি এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন, মন্ত্রিমিশন একটি সুনির্দিষ্ট মনোভাব নিয়ে ভারতে যাচ্ছে এবং তিনি আশা করেন মিশন সর্বতোভাবে সাফল্য অর্জন করবে।
মন্ত্রিমিশনের সদস্যরা ভারতে আসেন ২৩শে মার্চ। আগের বারে যখন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসেছিলেন তখন বাংলার কংগ্রেস নেতা মিঃ জে. সি. গুপ্ত তাঁর আপ্যায়নের ভার নিয়েছিলেন। এবারও মিঃ গুপ্ত আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য তিনি দিল্লী যাচ্ছেন। আমি তখন স্যার স্ট্যাফোর্ডকে পুনরায় ভারতে আসার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি লিখে মিঃ গুপ্তর হাতে দিই।
আমি দিল্লীতে পৌঁছাই ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দের ২রা এপ্রিল। আমার মনে হয়, এবারের আলোচনায় রাজনৈতিক সমস্যার চেয়ে সাম্প্রদায়িক সমস্যাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। সিমলা কনফারেন্সের সময়ই আমি স্থিরনিশ্চয় হই, রাজনৈতিক প্রশ্ন সমাধানের স্তরে এসে গেছে কিন্তু সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনোই সমাধান হয়নি। একটা কথা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না, সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরা তাঁদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে খুবই উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। এটাও সত্যি, কোনো কোনো প্রদেশে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; সুতরাং প্রাদেশিক স্তরে তাঁদের মনে কোনোরকম আশঙ্কা নেই। কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাঁরা সংখ্যালঘিষ্ঠ বলেই তাঁদের ভয় যে স্বাধীন ভারতে তাঁরা যথোপযুক্ত স্থান পাবেন না।
এই বিষয়টি নিয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি। সারা পৃথিবীতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা নিয়ে আলোচনা চলছে। ভারতের মতো বিরাট দেশে, যেখানকার জনগণ বিভিন্ন ভাষাভাষী এবং যেখানকার ভৌগোলিক অবস্থাও একরকম নয়, সেখানে সর্বক্ষমতাসম্পন্ন একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার উপযুক্ত হবে না। তাছাড়া ফেডারেল গভর্নমেন্টে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কাও বিদূরিত হবে। এইসব কথা চিন্তা করে অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি, ভারতের সংবিধান হবে ফেডারেল ধরনের এবং তাতে যথাসম্ভব বেশি করে প্রদেশগুলোর হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে। তবে জাতীয় সংহতি বজায় রেখেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এবং এটা করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন এবং কেন্দ্রের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের সম্পর্কের ব্যাপারে একটি সুচিন্তিত ফর্মুলা বের করতে হবে। কতকগুলো বিভাগ এবং ক্ষমতা অবশ্যই কেন্দ্রের হাতে থাকবে এবং কতকগুলো অবশ্যই প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। এছাড়া আরো কিছু বিভাগ থাকবে যেগুলো উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে কেন্দ্র অথবা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে। তবে এ ব্যাপারে প্রথমেই স্থির করতে হবে কেন্দ্রের হাতে ন্যূনপক্ষে কী কী ক্ষমতা থাকবে যেগুলো অবশ্যই কেন্দ্রের হাতে রাখতে হবে। এছাড়া আরো কতকগুলো বিষয়ের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে যেগুলো প্রদেশের সম্মতিক্রমে কেন্দ্র কর্তৃক পরিচালিত হবে। তালিকাভুক্ত এইসব বিষয় হবে স্বেচ্ছাধীন, অর্থাৎ যেকোনো প্রদেশ তার ইচ্ছানুসারে এগুলোকে সার্বিকভাবে অথবা আংশিকভাবে কেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দিতে পারে।
একটি বিষয় সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাই, প্রতিরক্ষা, চলাচল ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পররাষ্ট্র-বিষয়ক ক্ষমতা অবশ্যই কেন্দ্রের হাতে থাকবে, কারণ এগুলো সবাই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এগুলোর মধ্যে যেকোনো একটিও যদি প্রদেশের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সমস্ত উদ্দেশ্যই বিঘ্নিত হবে এবং ফেডারেল গভর্নমেন্টের ভিত্তিমূলেই আঘাত করবে। তবে কোনো কোনো বিষয় অবশ্যই প্রদেশের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এছাড়া একটি তৃতীয় তালিকাও থাকবে যে তালিকাভুক্ত বিষয়গুলো প্রদেশের হাতে থাকবে অথবা কেন্দ্রের হাতে থাকবে তা স্থিরীকৃত হবে প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর দ্বারা।
এইসব বিষয় নিয়ে আমি যতোই চিন্তা করতে থাকি ততোই আমার কাছে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, ভারতের সমস্যাবলী সমাধানের অন্য কোনো পথ নেই। সংবিধানে যদি এইসব বিষয় অঙ্গীভূত হয় তাহলে মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলো উপরোক্ত তিনটি বিষয় বাদে আর সব ক্ষমতাই নিজেদের হাতে রাখতে পারবে। এবং এতে মুসলমানদের মন থেকে হিন্দুভীতি, অর্থাৎ হিন্দুদের দ্বারা শাসিত হবার ভীতিও দূর হবে। একবার যদি এই ভীতি দূর হয় তাহলে প্রদেশসমূহ স্বেচ্ছাক্রমেই অনেক বিষয়ের ভার কেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দেবে। আমি আরো বুঝতে পারি, সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন বাদেও ভারতের মতো একটি দেশে এটাই হবে সর্বোত্তম রাজনৈতিক সমাধান। ভারতবর্ষ একটি বিরাট দেশ এবং এদেশ ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ দ্বারা বহুধা-বিভক্ত। সুতরাং এই বিবিধের মাঝে মিলনসেতু স্থাপন করতে হলে প্রদেশসমূহের হাতে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার ছেড়ে দিতে হবে।
আমার মনে ক্রমে ক্রমে এই চিত্রটি আরো সুপরিস্ফুট হয়ে ওঠে মন্ত্রিমিশনের ভারত আগমনে। তবে এই প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে বলে রাখা দরকার, আমার এই চিন্তাধারা সম্বন্ধে তখনো আমি আমার সহকর্মীদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা করিনি। আমি মনে মনে স্থির করেছিলাম, এসব বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করবো।
মন্ত্রিমিশনের সদস্যদের সঙ্গে সর্বপ্রথম আমি দেখা করি ১৯৪৬-এর ৬ই এপ্রিল। মিশন তাঁদের আলোচনার জন্য কতকগুলো প্রশ্ন আগে থেকেই স্থির করে রেখেছিলেন। প্রথম প্রশ্নটি ছিলো ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সম্বন্ধে। মিশন যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান আমি কীভাবে করতে চাই, তার উত্তরে আমি আমার পূর্ব অভিমতেরই পুনরুক্তি করি। এরপর আমি যখন বলি, কেন্দ্রের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়গুলোর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট এবং একটি স্বেচ্ছাধীন তালিকা থাকবে তখন লর্ড পেথিক লরেন্স বলেন, “আপনি সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য এক নতুনতর পথের কথা বলছেন।”
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস আমার এই প্রস্তাবটিতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে এ বিষয়ে আমাকে জেরা করতে শুরু করেন। অবশেষে তিনিও আমার এই নতুন প্রস্তাবে রীতিমতো খুশি হন।
এরপর ১২ই এপ্রিল যখন ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন শুরু হয় তখন আমি মন্ত্রিমিশনের সঙ্গে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু কমিটির কাছে প্রকাশ করি। সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানকল্পে আমি যে অভিমত প্রকাশ করেছিলাম তা আরো বিশদভাবে আমি ব্যাখ্যা করি। এই প্রথমবার গান্ধীজী এবং আমার সহকর্মীরা আমার পরিকল্পনা সম্বন্ধে আলোচনা করবার সুযোগ পান। ওয়ার্কিং কমিটি প্রথমদিকে এ বিষয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব গ্রহণ করেন যার ফলে কমিটির সদস্যরা নানারকম সন্দেহের কথা ব্যক্ত করে বাধার সৃষ্টি করতে থাকেন। আমি তাঁদের সমস্ত সন্দেহের নিরসন করে তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর দিয়ে তাঁদের আপত্তি খণ্ডন করতে সক্ষম হই। অবশেষে ওয়ার্কিং কমিটি আমার প্রস্তাবের সারবত্তা হৃদয়ঙ্গম করেন। গান্ধীজীও আমার প্রস্তাবে পূর্ণ সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
গান্ধীজী এই বলে আমাকে অভিনন্দন জানান, এ যাবৎ যে সমস্যা নিয়ে সবাই বিব্রত হয়েছিলেন আমি সেই সমস্যার একটি সুষ্ঠু সমাধানের পথ বের করেছি। তিনি আরো বলেন আমার এই সমাধান গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলিম লীগপন্থীদের মন থেকেও সবরকম ভয় দূর করতে সক্ষম হবে এবং এর ফলে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তে জাতীয় মনোভাবের সৃষ্টি হবে। গান্ধীজীও সুস্পষ্টভাবে বলেন, ভারতের মতো একটি দেশের পক্ষে ফেডারেল গঠনতন্ত্রই সর্বোত্তম। তিনি তাই আমার সমাধানের পন্থাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, যদিও এটা কোনো নতুন পন্থা নয়, তবুও ভারতীয় ফেডারেশনের ব্যাপারে এটি অবশ্যই একটি সুচিন্তিত পথ।
সর্দার প্যাটেল আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা শুধু তিনটিমাত্র বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে কি না। তিনি বলেন, এই তিনটি বিষয় ছাড়া কারেন্সি এবং আর্থিক বিষয়ও কেন্দ্রের এখতিয়ারে থাকা দরকার। তিনি আরো বলেন, ব্যবসায় এবং শিল্পকে সর্বভারতীয় পর্যায়ে উন্নত করতে হলে ও দুটি ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের আধিপত্য থাকা দরকার এবং ব্যবসায়-সংক্রান্ত নীতিও এইভাবেই নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।
তাঁর এইসব আপত্তির উত্তর আমাকে আর দিতে হয় না। গান্ধীজী নিজেই আমার অভিমত গ্রহণ করে সর্দার প্যাটেলের প্রশ্নাবলীর উত্তর দেন। তিনি বলেন, এ কথা মনে করবার কোনোই কারণ নেই যে কারেন্সী এবং শুল্ক ইত্যাদির ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করবে। তাদের নিজেদের স্বার্থেই এ ব্যাপারে তারা একটি ঐক্যবদ্ধ নীতি গ্রহণ করবে। সুতরাং কারেন্সী অথবা আর্থিক বিষয় সুনির্দিষ্ট তালিকার অঙ্গীভূত করবার কোনো কারণ নেই।
মুসলিম লীগ তার লাহোর প্রস্তাবে ভারত বিভাগের কথা বলে। পরবর্তীকালে এই প্রস্তাবটি ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে আখ্যাত হয়। মুসলিম লীগের আশঙ্কা দূর করবার উদ্দেশ্যেই আমি আমার ওই সমাধান প্রস্তাব এনেছিলাম। প্রস্তাবটি নিয়ে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে এবং মন্ত্রিমিশনের সঙ্গে আলোচনা করবার পরে আমার মনে হয়, বিষয়টি এবার দেশবাসীকে জানানো দরকার। এই কথা মনে হতেই আমি ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল এক বিবৃতি মারফত আমার প্রস্তাবের বিষয়বস্তু প্রচার করি। এখন (অর্থাৎ এই গ্রন্থ রচনাকালে-অনুবাদক) ভারত বিভাগ নির্ধারিত হয়ে গেলেও এবং (পূর্বোক্ত প্রস্তাবের পরে) দশ বছর পার হয়ে গেলেও আমি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি, আমার সেই বিবৃতিতে যে কথা তখন বলেছিলাম সেই কথাই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। উক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় সমস্যার সমাধান সম্পর্কে আমার সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশিত হয়েছিলো বলে বিবৃতিটিকে এখানে উদ্ধৃত করা হলো:
আমি মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব সম্পর্কে নানা দিক থেকে বিচার-বিবেচনা করে দেখেছি। একজন ভারতবাসী হিসেবে ভবিষ্যৎ ভারতে এর প্রতিক্রিয়ার প্রশ্নও আমি বিশেষভাবে পরীক্ষা করেছি। আবার একজন মুসলমান হিসেবে মুসলমানদের ভাগ্যের ওপরে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে কথাও বিচার-বিবেচনা করে দেখেছি।
প্রস্তাবটির সব দিক বিচার-বিবেচনা করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি এটা ভারতের পক্ষে বিপজ্জনক তো বটেই, মুসলমানদের পক্ষেও এটা বিপজ্জনক। প্রকৃতপক্ষে এর ফলে আরো অনেকরকম সমস্যার সৃষ্টি হবে।
আমি অকপটে স্বীকার করছি, ‘পাকিস্তান’ কথাটাই আমার বিবেকের বিরুদ্ধাচরণ করছে। এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে পৃথিবীর কিছু অংশ পবিত্র বা খাঁটি এবং বাকি অংশ অপবিত্র বা মেকি। এইভাবে, অর্থাৎ ‘পবিত্র’ এবং ‘অপবিত্র’ (অর্থাৎ ‘খাঁটি’ এবং ‘মেকি’) হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলকে বিভক্ত করার প্রস্তাবটা ইসলাম-বিরোধী; ইসলামের অন্তর্নিহিত ঔদার্য এর দ্বারা বিঘ্নিত হচ্ছে। ইসলাম এ ধরনের কোনো বিভাগ স্বীকার করে না। ইসলাম ধর্মের রসুল বলেছেন – ‘আল্লাহ সমগ্র পৃথিবীকে আমার জন্য একটি মসজিদে পরিণত করেছেন।’
উপরন্তু পাকিস্তান পরিকল্পনাটি একটি পরাজয়সুলভ মনোবৃত্তির ফলে উদ্ভূত হয়েছে। ইহুদীরা যেভাবে তাদের জন্য বাসভূমির দাবী করছে, এটাও ঠিক সেইরকমই একটি দাবী। এই প্রস্তাব দ্বারা এটা স্বীকার করা হয়েছে, ভারতীয় মুসলমানরা সামগ্রিকভাবে ভারতে বাস করার পরিবর্তে তাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে গিয়ে বাস করতে চায়।
ইহুদীদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি লোকের সহানুভূতি আছে, কারণ তারা যাযাবরের মতো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। তাদের কোনো নিজস্ব বাসভূমি নেই যেখানে তারা নিজেদের সরকার গঠন করে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।* কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। সংখ্যার দিক থেকে ন কোটিরও বেশী হওয়ায় ভারতের জনজীবনে এরা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন এবং সংখ্যাগত ও গুণগত দিক থেকে যেকোনো শাসনতান্ত্রিক অথবা নীতিনির্ধারণের ব্যাপারেও এঁরা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে প্রকৃতিও তাদের সাহায্য করেছে। কারণ মুসলমানরা কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলেই অধিক সংখ্যায় বাস করছেন।
[* এই বিবৃতি যখন প্রচারিত হয়েছিলো তখন পর্যন্ত ইজরায়েল রাষ্ট্র স্থাপিত হয়নি। — অনুবাদক।]
এই সব কথা বিবেচনা করলে স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারা যায়, পাকিস্তান-দাবীর কোনো অন্তর্নিহিত শক্তি নেই। একজন মুসলমান হিসেবে আমি এক মুহূর্তের জন্যও সমগ্র ভারতের ওপর আমার দাবী তথা সমগ্র ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে আমার অংশকে পরিহার করতে আমি প্রস্তুত নই। আমার কাছে এটা ভীরুতা ছাড়া আর কিছু নয়।
সকলেই জানেন, মিঃ জিন্নাহর পাকিস্তান পরিকল্পনা দ্বি-জাতি তত্ত্বের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর তত্ত্ব হলো, ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী বিভিন্ন জাতি বাস করে এবং ওইসব জাতির ধর্মবিশ্বাসও আলাদা। এইসব জাতির মধ্যে প্রধান দুটি জাতি হলো হিন্দু আর মুসলমান। সুতরাং এই দুটি প্রধান জাতির জন্য দুটি আলাদা রাষ্ট্র অবশ্যই প্রয়োজন।
ডঃ এডোয়ার্ড টমসন একদা মিঃ জিন্নাহকে বলেছিলেন, হিন্দু মুসলমান সহস্রাধিক বৎসর যাবৎ হাজার হাজার শহরে, গ্রামে ও পল্লীতে একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করছে। তার উত্তরে মিঃ জিন্নাহ বলেন, এর দ্বারা তাদের আলাদা জাতিত্ব বিঘ্নিত হয় না। মিঃ জিন্নাহর মতে উভয় জাতির লোকেরা গ্রাম, শহর ও বিভিন্ন অঞ্চলে পাশাপাশি বাস করলেও পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিরোধী মনোভাব পোষণ করে এবং এই কারণেই তাদের উভয়ের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজন।
আমি বিভিন্ন সমস্যার কথা বাদ দিয়ে এখানে শুধু মুসলমানদের স্বার্থের কথাটাই আগে বিচার করছি। আমি এ বিষয়ে আরো অগ্রসর হয়ে বলতে চাই, আমাকে যদি বুঝিয়ে দেওয়া যায় পাকিস্তান পরিকল্পনার দ্বারা মুসলমানদের সত্যিই কোনো মঙ্গল হবে তাহলে আমিই সর্বাগ্রে এই নীতিকে মেনে নেবো এবং অপরেও যাতে মেনে নেয় তার জন্য কাজ করে যাবো। কিন্তু প্রকৃত কথা হলো, আমি যদি এই পরিকল্পনাকে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের দিক থেকে বিচার করি তাহলেও আমি বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্তে আসি যে এর দ্বারা তাঁদের (মুসলমানদের) কোনোই সুরাহা হবে না এবং তাঁদের মন থেকে ভীতিও দূর হবে না।
এবার নিরপেক্ষভাবে পাকিস্তান পরিকল্পনার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে বিচার-বিবেচনা করা যাক। ধরে নেওয়া গেলো, ভারতবর্ষ দুটি আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে; একটি রাষ্ট্রে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অপর রাষ্ট্রে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু হিন্দুস্থান রাষ্ট্রে সাড়ে তিন কোটি মুসলমান ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বাস করবেন। উত্তরপ্রদেশে শতকরা ১৭, বিহারে শতকরা ১২ এবং মাদ্রাজে শতকরা ১ জন মাত্র মুসলমান হওয়ায় এঁরা বর্তমানে যেভাবে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে বাস করছেন, তার চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে যাবেন। হাজার বছরেরও বেশি এরা এইসব অঞ্চলে বাড়ি-ঘর করে বাস করছেন এবং বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম সংস্কৃতি ও মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্র স্থাপন করেছেন।
হঠাৎ একদিন নিশি ভোর হলে তাঁরা সবিস্ময়ে দেখতে পাবেন, নিজ বাসভূমিতে তাঁরা বিদেশী হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। শিল্প, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক দিকে পশ্চাৎপদ হওয়ায় তাঁরা হিন্দুদের দয়ার ওপরে বসবাস করতে বাধ্য হবেন, যার ফলে ওইসব অঞ্চলে নির্ভেজাল ‘হিন্দ-রাজ’-এর সৃষ্টি হবে।
অপর পক্ষে, পাকিস্তান রাষ্ট্রেও তাঁদের অবস্থা মোটেই সুখকর হবে না। পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই মুসলমানরা এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, যেরকম সংখ্যাগরিষ্ঠতা হিন্দুস্থান রাষ্ট্রে হিন্দুরা পাবেন।
প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও উভয়ের সংখ্যার ব্যবধান হবে খুবই কম। কিন্তু ওইসব অঞ্চলে অমুসলমানরা অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক দিকে যেরকম প্রাধান্য নিয়ে বাস করছেন তাতে সবকিছুই বানচাল হয়ে যেতে পারে। এরকম যদি নাও হয় এবং পাকিস্তানে যদি মুসলমানরা বিরাটভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তাহলেও হিন্দুস্থানের মুসলমানদের কোনো সমস্যাই এঁরা সমাধান করতে পারবেন না।
দুটি রাষ্ট্র যদি বিবদমান হয় তাহলে একে অপরের সংখ্যালঘুদের সমস্যার সমাধান তো করতে পারবেই না, উপরন্তু উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সঞ্চাত হবার ফলে পারস্পরিক শত্রুতারই সৃষ্টি করবে। অতএব পাকিস্তান পরিকল্পনার দ্বারা মুসলমানদের কোনো রকম সমস্যারই সমাধান হবে না। যেখানে তারা সংখ্যালঘু সেখানেও তাদের স্বার্থরক্ষা করতে পারবে না, কিংবা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে ভারত অথবা পৃথিবীর কোনো ব্যাপারেই তাঁরা নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না, অথচ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁরা একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের সুযোগ পাবেন।
এখানে তর্ক উঠতে পারে, পাকিস্তান যদি মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থীই হবে তাহলে বিরাটসংখ্যক মুসলমান এর জন্য এতোটা লালায়িত হয়ে উঠেছেন কেন? এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে কয়েকজন গোঁড়া হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীর মনোভাব দেখে। মুসলিম লীগ যখন পাকিস্তানের কথা বলতে শুরু করে, এরা তখন পাকিস্তান পরিকল্পনার মধ্যে মুসলিম জগতের এক ষড়যন্ত্র দেখতে পান এবং ভারতীয় মুসলমানদের আন্তর্ভারতীয় মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির কথা মনে করে ভীত হয়ে এর বিরুদ্ধতা করতে থাকেন।
এঁদের এই বিরোধিতার ফলে লীগের সুবিধাই হয়। হিন্দুদের এই বিরোধিতাকে লীগ নেতারা হিন্দুদের মুসলিম-বিরোধিতার নজীর হিসেবে প্রকাশ করতে থাকেন। এই চিন্তাধারার ফলে তাঁরা বলতে থাকেন, হিন্দুদের কর্তৃক পাকিস্তানের এইরকম বিরোধিতার ফলে এটিই প্রমাণিত হচ্ছে পাকিস্তান মুসলমানদের সুবিধে করবে। এই ব্যাপারে তাঁরা এতো বেশি সোচ্চার হয়ে ওঠেন যার ফলে এমন এক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়, যাতে স্থির মস্তিষ্কে কোনো বিষয় চিন্তা না করে সাম্প্রদায়িকতার পথে দ্রুত ধাবিত হন। যুব সম্প্রদায়ই এ ব্যাপারে বেশি করে অগ্রসর হন। আমার মনে তাই কোনো রকম সন্দেহই থাকে না যে রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক উত্তাপ যখন আর থাকবে না এবং সমগ্র বিষয়টি নিয়ে যখন স্থিরমস্তিষ্কে চিন্তা করা যাবে তখন আজ যারা পাকিস্তানের সমর্থনে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তাঁরাই এটাকে মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী এবং ক্ষতিকর পরিকল্পনা বলে বর্ণনা করবেন।
আমি যে সমাধান মেনে নেবার জন্য কংগ্রেসকে সম্মত করতে সক্ষম হয়েছি তাতে পাকিস্তান পরিকল্পনার অবাঞ্ছিত বিষয়গুলো থাকবে না, অথচ পাকিস্তানের মূলকথা তাতে অবশ্যই থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারে হিন্দুদের প্রাধান্য থাকবে বলে মুসলমানদের মনে এই ভয়টা ঢুকে গেছে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশেও কেন্দ্রীয় সরকার অশুভ প্রভাব বিস্তার করে মুসলমানদের স্বার্থকে পদদলিত করবে। এই ভয় থেকেই পাকিস্তান পরিকল্পনা উদ্ভূত হয়েছে। মুসলমানদের এই ভীতি নিরসন করবার জন্য কংগ্রেস প্রাদেশিক স্তরে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকার দিতে সম্মত হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কী কী বিষয় থাকবে সে সম্বন্ধেও কংগ্রেস দুটি তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকা দুটির একটি হলো আবশ্যিক এবং অপরটি হলো স্বেচ্ছাধীন। এই স্বেচ্ছাধীন বিষয়গুলো প্রাদেশিক সরকারসমূহ ইচ্ছা করলে কেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দিতে পারে কিংবা নিজেদের হাতেও রাখতে পারে। কংগ্রেসের এই পরিকল্পনা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর উন্নতির পথে কোনো রকম বাধার সৃষ্টি তো করবেই না, উপরন্তু প্রদেশগুলোকে প্রায় স্বাধীনভাবে চলবার সুযোগ দিয়েছে। এই পরিকল্পনা যদি কার্যকর হয়, তাহলে প্রদেশসমূহ সব সময়ই কেন্দ্রের ওপরে তাদের প্রভাব বিস্তার করবার সুযোগ পাবে।
ভারতবর্ষের পরিস্থিতি এমনই যাতে সর্বক্ষমতাযুক্ত কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে চেষ্টা করা হলে সে প্রচেষ্টা বিফল হতে বাধ্য। আবার ভারত বিভাগের প্রচেষ্টাও, অর্থাৎ ভারতকে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করবার প্রচেষ্টাও বিপর্যয় ডেকে আনবে। এইসব প্রশ্ন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই, কংগ্রেসের পরিকল্পনাটাই সর্বোত্তম পন্থা, কারণ এই পরিকল্পনায় কেন্দ্র এবং প্রদেশসমূহের মধ্যে একটা সুষ্ঠু সমঝোতার সৃষ্টি হবে। কংগ্রেসের এই পরিকল্পনা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে বস্তুতপক্ষে পাকিস্তান পরিকল্পনারই সামিল হবে। অপরপক্ষে পাকিস্তান পরিকল্পনায় যেসব অসুবিধে রয়েছে সেগুলোও এতে থাকবে না। অর্থাৎ এই পরিকল্পনায় মুসলমান সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশসমূহে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার ভয়ও মুসলমানদের থাকবে না। আমি তাঁদেরই মধ্যে একজন যারা বর্তমান সাম্প্রদায়িক তিক্ততার অধ্যায়কে ভারতীয় জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে মনে করেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভারত তার নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করবার অধিকার পাবার সঙ্গে সঙ্গেই এ সমস্যা আর থাকবে না। এই প্রসঙ্গে গ্ল্যাডস্টোনের একটি মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, জল দেখে যারা ভয় পায় তাদের মন থেকে জল-ভীতি দূর করবার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো তাদের জলের ভেতরে নিক্ষেপ করা। ঠিক এইভাবে সন্দেহবাদীদের মন থেকে সমস্ত সন্দেহ এবং ভীতি নিরসন করবার আগেই ভারতকে তার নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করবার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
ভারত যখন তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার লাভ করবে তখনই সে বর্তমান সাম্প্রদায়িক সন্দেহ ও বিরোধের অধ্যায়কে ভুলে গিয়ে যাবতীয় সমস্যাগুলোকে আধুনিক জীবনধারা অনুসারে সমাধান করতে সচেষ্ট হবে। মতভেদ এবং বৈষম্য তখনও যে থাকবে না তা নয়, তবে সেগুলো হবে অর্থনৈতিক অসাম্য, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য কদাচ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপ তখনও চলতে থাকবে। কিন্তু সেসব কার্যকলাপ ধর্মের ভিত্তিতে না হয়ে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভিত্তিতে চলবে। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সম্প্রদায়ের পরিবর্তে শ্রেণীই বেশি করে প্রাধান্য অর্জন করবে। তর্কের খাতিরে যদি বলা হয় এটা একটা বিশ্বাস মাত্র এবং বাস্তবক্ষেত্রে এটা অকার্যকর বলে প্রমাণিত হবে, তাহলে আমি বলবো, ভারতের ৯ কোটি মুসলমান এমন এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করবেন যা কোনো অবস্থাকেই কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। নিজেদের স্বার্থরক্ষা করবার এবং নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবার মতো যথেষ্ট শক্তি তাঁদের আছে।
মুসলিম লীগ তার লাহোর প্রস্তাবের পরে ভারত বিভাগের পরিকল্পনা নিয়ে আরো এগিয়ে এসেছে। তবে লীগ যে আসলে কী চায় তা সে কোনো সময়েই সুস্পষ্ট করে বলেনি। লীগের প্রতিটি প্রস্তাবের ভাষাই প্রায় অর্থহীন এবং কখনো কখনো দ্ব্যর্থবোধক। তবে প্রস্তাবের ভাষা যাই হোক না কেন, একটি বিষয় তাতে খুবই স্পষ্ট ছিলো। মুসলিম লীগ আগে দাবী করছিলো, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকার দিতে হবে। এই প্রস্তাব সিকান্দার হায়াত খানও সমর্থন করেন। কিন্তু বর্তমানে লীগ নেতারা তাঁদের দাবীর বহর আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা এখন প্রায়ই ভারত বিভাগের কথা এবং মুসলমান-প্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে একটি আলাদা স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলতে শুরু করেছেন। মন্ত্রিমিশন কিন্তু এই দাবী মেনে নিতে সম্মত নন। তাঁরা আমার পরিকল্পনাটিকেই সমস্যা সমাধানের প্রকৃষ্ট পন্থা বলে মনে করতে থাকেন।
এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত আলোচনা চলে। এই আলোচনার সময় অনেকবার মিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়েছে এবং মিশনও অনেকবার তাঁদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন। এই সময় মিশন কিছুদিনের ছুটি নিয়ে কাশ্মীরে বেড়াতে যান। গ্রীষ্মকাল এসে পড়ায় দিল্লী তখন দিনের পর দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আমিও এই সময় কয়েকদিন বিশ্রাম নেবার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়ি। প্রথম দিকে মনে মনে স্থির করি আমি কাশ্মীরে যাবো। এই চিন্তা করে কাশ্মীরের বন্ধুদের কাছে আমি চিঠিও লিখি। কিন্তু যখন আমি জানতে পারলাম মন্ত্রিমিশনের সদস্যরা কাশ্মীরে যাচ্ছেন, আমি তখন আমার পূর্বসিদ্ধান্ত বাতিল করি। আমার মনে হয়, আমি যদি এই সময় কাশ্মীরে থাকি তাহলে অনেকে হয়তো ব্যাপারটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করবেন। তাঁরা হয়তো বলবেন, মিশনের সদস্যদের প্রভাবিত করবার উদ্দেশ্যেই আমি কাশ্মীরে গেছি। সুতরাং আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মুসুরী যাবো বলে স্থির করি।
আমি আগেই বলেছি, ক্রিপস মিশন বিফল হবার পরে শ্রীরাজাগোপালাচারী প্রচার শুরু করেন কংগ্রেসের পক্ষে মুসলিম লীগের দাবী মেনে নেওয়া উচিত। ভারত বিভাগের কথাও তিনি নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিলেন। এইরকম প্রচার ও মতবাদের ফলে তিনি ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বেরিয়ে যান এবং কংগ্রেসীদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা হারান। গান্ধীজীও রাজাজীর কার্যকলাপকে সমর্থন করেননি। রাজাজীকে তিনি মাদ্রাজেই থাকতে বলেন। রাজাজী এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তবে ক্ষুব্ধ হলেও কিছুদিন চুপ করে থাকেন। আমি যখন বিশ্রামের জন্য মুসুরীতে ছিলাম তখন রাজাজী’র কাছ থেকে আমি একটি চিঠি পাই। সেই চিঠি থেকে আমি সর্বপ্রথম জানতে পারি গান্ধীজী তাকে দিল্লীতে আসতে নিষেধ করেছেন। আমার তখন মনে হয় গান্ধীজী হয়তো এখনও রাজাজীর দিল্লীতে আসাটা চান না। আমি তাই গান্ধীজীর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনোরকম পরামর্শ না করে নিজের দায়িত্বেই রাজাজীকে লিখি – তিনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে দিল্লীতে আসতে পারেন। আমার চিঠি পেয়েই তিনি দিল্লীতে চলে আসেন। গান্ধীজী এতে একটু বিরক্ত হন। কিন্তু আমি তাঁকে বলি, আমার চিঠি পেয়েই রাজাজী দিল্লীতে এসেছেন। আমি গান্ধীজীকে আরো বলি, রাজাজীকে দিল্লীতে আসতে বাধা দেওয়াটা আমি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করিনি।
২৪শে এপ্রিল মিশন পুনরায় দিল্লীতে ফিরে আসেন এবং ফিরে এসেই ভাইসরয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন। বারকয়েক আলোচনার পরে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস সেইসব আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন। ২৭শে এপ্রিল মিশন এক বিবৃতি প্রচার করেন। বিবৃতির মাধ্যমে তাঁরা বলেন, দুই প্রধান দলের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য আরো আলোচনার প্রয়োজন আছে। মিশনের সদস্যরা এরপর কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টদ্বয়কে নিজ নিজ দল থেকে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করতে অনুরোধ করেন। মিশন আরো বলেন, ওই দুটি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরাই সিমলাতে মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এই ব্যাপারে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি আমাকে কয়েকজন প্রতিনিধি মনোনীত করবার দায়িত্ব দেন। আমি তখন জওহরলাল এবং সর্দার প্যাটেলকে আমার সহকর্মী হিসেবে মনোনীত করি। স্থির হয় যে তিনজনের এই প্রতিনিধি সভাই কংগ্রেসের তরফ থেকে আলোচনা চালাবে। গভর্নমেন্ট আমাদের সিমলায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। গান্ধীজী যদিও আলোচনা সভার সদস্য ছিলেন না, তবুও মিশন তাঁকে সিমলায় আসতে অনুরোধ করেন। প্রয়োজন হলে তাঁর সঙ্গেও যাতে আলোচনা করা যায় সেই উদ্দেশ্যেই মিশন তাঁকে সিমলায় আসতে অনুরোধ করেন। মিশনের এই অনুরোধ তিনি মেনে নেন এবং সিমলায় এসে ম্যানর ভিলায় বাস করতে থাকেন। ওখানে ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় এবং গান্ধীজী সে সভায় অংশগ্রহণ করেন।
সিমলাতে আলোচনা শুরু হয় ২রা মে এবং সে আলোচনা চলে ১২ই মে পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে সরকারীভাবে আলোচনা করা ছাড়াও আমরা বেসরকারীভাবে মিশনের সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা করি। আমি তখন ‘রিট্রিটে’ বাস করছিলাম। মিশনের সদস্যরা ওখানে এসেও কয়েকবার আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমিও কয়েকবার তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যাই এবং কয়েকবার এককভাবে এবং কয়েকবার যৌথভাবে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করি। এই আলোচনার সময় আসফ আলী এবং হুমায়ুন কবিরও আমার সঙ্গে থাকতেন।
প্রায় দু’সপ্তাহ পরে আমরা দিল্লীতে ফিরে আসি। ওখানে এসে মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁদের নিজেদের মধ্যে আরো আলোচনা করে তাঁদের প্রস্তাব তৈরি করেন। তাঁদের সেই প্রস্তাব মিঃ অ্যাটলি কর্তৃক ১৬ই মে বিলাতের কমনস সভায় বিবৃত হয়। পরিকল্পনার বিষয়বস্তু নিয়ে একটি শ্বেতপত্রও রচিত হয়। শ্বেতপত্রে বলা হয়, মন্ত্রিমিশন তাঁদের সেই প্রস্তাবকেই ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের সর্বোত্তম প্রস্তাব বলে বিবেচনা করেন। মন্ত্রিমিশনের এই প্রস্তাব এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে উদ্ধৃত করা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকরা উক্ত প্রস্তাব এবং আমার ১৫ই এপ্রিলের পরিকল্পনা তুলনামূলকভাবে পড়ে দেখতে পারেন।
সিমলাতে যে আলোচনা হয়েছিলো তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আরো আলোচনার পক্ষপাতী ছিলাম। আমি তাই লর্ড ওয়াভেলকে বলি, দিল্লীর উত্তপ্ত আবহাওয়ার মধ্যে আলোচনা না করে সিমলার শীতল আবহাওয়াতেই আলোচনার সমাপ্তি হলে ভালো হয়। এর উত্তরে লর্ড ওয়াভেল আমাকে বলেন, তিনি যদি খুব বেশিদিন দিল্লীর বাইরে থাকেন তাহলে সরকারী কাজে অসুবিধে হবে। আমি এ ব্যাপারে মন্তব্য করি, দিল্লীর বড়লাটভবন শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তাঁর পক্ষে এখানে থাকা অসুবিধেজনক না হলেও মন্ত্রিমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং আমাদের পক্ষে এখানে থাকা রীতিমতো কষ্টকর এবং দিল্লীর জ্বলন্ত চুল্লীর মধ্যে বসে ঠাণ্ডা মাথায় আলোচনা করা অত্যন্ত অসুবিধেজনক। লর্ড ওয়াভেল বলেন, এটা মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো, মে মাসের বাকি দিনগুলো এবং পুরো জুন মাস আমাদের দিল্লীতে থাকতে হলো। এ বছর আবহাওয়া ছিলো অস্বাভাবিক রকমে উত্তপ্ত। মন্ত্রিমিশনের সদস্যরাও এটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ গরম সহ্য করতে না পেরে লর্ড পেথিক লরেন্স একদিন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। ভাইসরয় আমার জন্য একটি শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে আমার পক্ষে কিছুটা সুবিধে হলেও সকলেই চাইছিলেন আলোচনাটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মতানৈক্যের কিছুতেই সমাধান করা গেলো না; ফলে আলোচনা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হলো না।
মন্ত্রিমিশন এবং তাঁদের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা যখন মাথা ঘামাচ্ছিলাম, সেই সময় কাশ্মীরে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো, যা আমাদের আলোচনার অঙ্গীভূত হয়। কাশ্মীরের জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য সেখানকার ন্যাশনাল কনফারেন্স শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মন্ত্রিমিশন ভারতে আসবার পর তিনি তাঁর দাবিকে আরো জোরদার করবার জন্য ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ ধ্বনি তুলে মন্ত্রিমিশনের কাছে তাঁর দাবি পেশ করেন। তাঁর দাবি ছিল, কাশ্মীরের মহারাজাকে তাঁর স্বেচ্ছাচারতন্ত্র পরিহার করে জনগণের হাতে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে। মহারাজার সরকার এর উত্তর দেয় শেখ আবদুল্লা এবং তাঁর সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন আগে ন্যাশনাল কনফারেন্সের একজন প্রতিনিধিকে সরকারের ভেতর স্থান দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে আশা করা গিয়েছিল, ওখানকার সমস্যার একটা সমাধান হয়তো হবে। কিন্তু শেখ আবদুল্লা এবং তাঁর সহকর্মীদের গ্রেপ্তারে সমাধানের আশা সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে।
জওহরলাল কাশ্মীরের রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতি সব সময়ই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি চাইতেন ওখানে জনপ্রতিনিধিমূলক সরকার গঠিত হোক। তাই ওখানে যখন এইরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন তিনি কাশ্মীরে যাবেন বলে স্থির করেন। ন্যাশনাল কনফারেন্সের যেসব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, আদালতে তাঁরা যাতে ভালোভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন, তার জন্য আইনগত সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজনও অনুভূত হয়েছিল। আমি আসফ আলীকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছিলাম। জওহরলাল বলেন, তিনিও আসফ আলীর সঙ্গে যাবেন। এর পরেই তাঁরা দুজনে কাশ্মীরে রওনা হন। মহারাজার সরকার আমাদের এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয় এবং এঁদের কাশ্মীরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এক আদেশ জারি করে। ফলে ওঁরা যখন রাওলপিণ্ডি পরিত্যাগ করে কাশ্মীর সীমান্তে উপস্থিত হন, তখন উরিতে তাঁদের গতিরোধ করা হয়। ওঁরা রাজাদেশ মানতে অস্বীকার করেন, ফলে কাশ্মীর সরকার ওঁদের গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনার ফলে সারা দেশে এক বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হয়।
এইরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় আমি মোটেই খুশি হতে পারিনি। আমি তাই কাশ্মীর সরকারের কার্যকলাপের প্রতি ধিক্কার জানালেও এটা মনে করি যে এই সময় কাশ্মীরের ব্যাপার নিয়ে একটা নতুন বিবাদের সৃষ্টি করা উচিত হয়নি। আমি তাই ভাইসরয়কে বলি, ভারত সরকার যদি আমাকে জওহরলালের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবার সুযোগ করে দেয়, তাহলে আমি বাধিত হবো। তাঁকে (জওহরলালকে) একটি ডাকবাংলোতে রাখা হয়েছিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সেখানকার সঙ্গে টেলিফোন-সংযোগ পেয়ে যাই। ফোনে আমি জওহরলালকে বলি, আমার মতে এক্ষুনি তাঁর দিল্লিতে ফিরে আসা দরকার। বর্তমান সময়ে তাঁর পক্ষে কাশ্মীরে প্রবেশ করবার জন্য পীড়াপীড়ি করা ঠিক হবে না। কাশ্মীরের ব্যাপারে আমি তাঁকে বলি, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ ব্যাপারে যা করণীয়, তা আমিই করব। শেখ আবদুল্লা এবং তাঁর সহকর্মীদের মুক্তির জন্য আমি চেষ্টা করব। কিন্তু জওহরলালের এখুনি ফিরে আসা দরকার।
প্রথমে জওহরলাল এতে আপত্তি জানান, কিন্তু পরবর্তী আলোচনার ফলে এবং বিশেষ করে আমি যখন বলি কাশ্মীরের বিষয়টি আমি নিজেই দেখব, তখন তিনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হন। আমি তখন জওহরলাল এবং আসফ আলীকে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বিমানের ব্যবস্থা করে দিতে লর্ড ওয়াভেলকে অনুরোধ জানাই। সন্ধ্যা প্রায় সাতটার সময় আমি ভাইসরয়কে উপরোক্ত অনুরোধ করি। তিনি সেই রাত্রেই একটি বিমান পাঠিয়ে দেন। রাত প্রায় দশটার সময় বিমান শ্রীনগরে পৌঁছায় এবং রাত প্রায় দুটোর সময় জওহরলাল এবং আসফ আলীকে নিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসে। এ ব্যাপারে লর্ড ওয়াভেল প্রথম থেকেই বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর সেই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের কথা আমি কোনোদিনই ভুলব না।
আমি আগেই বলেছি, ১৫ই মে মন্ত্রিমিশন তাঁদের পরিকল্পনাটি প্রকাশ করেছিলেন। এই পরিকল্পনাটি মূলত আমার ১৫ই এপ্রিলের প্রস্তাবের অনুরূপ ছিল। মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয় যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বাধ্যতামূলকভাবে থাকবে মাত্র তিনটি বিষয়। এই তিনটি বিষয় হলো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিভাগ এবং যোগাযোগ বিভাগ। আমার প্রস্তাবেও এই কথাই আমি বলেছিলাম। মিশন আর একটি নতুন বিষয় তাঁদের পরিকল্পনায় জুড়ে দেন। এটি হলো সমগ্র দেশকে ক, খ এবং গ এই তিনটি এলাকায় বিভক্তকরণ। মিশন মনে করেছিলেন এতে সংখ্যালঘুদের মনে আস্থার ভাব ফিরে আসবে। পরিকল্পিত ‘খ’ এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছিল পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ বেলুচিস্তান। এটি মুসলমান-প্রধান অঞ্চল। ‘গ’ এলাকায় দেখানো হয়েছিল বাংলা এবং আসামকে। এই এলাকায় মুসলমানেরা সংখ্যায় সামান্য কিছু বেশি ছিলেন। মন্ত্রিমিশন মনে করেছিলেন, এই ব্যবস্থায় মুসলিম সংখ্যালঘুদের পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে এবং মুসলিম লীগের আশঙ্কাও দূর হবে।
মিশন আমার আরো একটি প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। এটি হলো সরকারের বেশিরভাগ বিষয়ই প্রদেশগুলোর কর্তৃত্বাধীন থাকবে। এই হিসেবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করবে। মাত্র কয়েকটি স্বীকৃত বিষয় শুধু কেন্দ্র অথবা প্রদেশগুলোর অধীনে থাকবে। এ ক্ষেত্রেও ‘খ’ এবং ‘গ’ এলাকার মুসলমানেরা প্রাধান্য অর্জন করতে পারবেন এবং নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিজেরাই পূরণ করতে পারবেন। কেন্দ্রের হাতে থাকছে তিনটি মাত্র বিষয়। এই বিষয়গুলো প্রদেশসমূহের হাতে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। মন্ত্রিমিশনের এই পরিকল্পনা মূলগতভাবে আমার প্রস্তাবের অনুরূপ হওয়ায় এবং মাত্র একটি নতুন বিষয় (অর্থাৎ এলাকার ভিত্তিতে দেশ বিভক্তকরণ) ওতে যুক্ত হওয়ায় আমার মনে হয়, পরিকল্পনাটা গ্রহণ করা চলতে পারে।
মি. জিন্না প্রথম দিকে এই পরিকল্পনার ঘোর বিরোধিতা করেন। মুসলিম লীগ তার স্বাধীন পাকিস্তানের দাবি নিয়ে তখন এতটাই অগ্রসর হয়েছিল যে তাদের পক্ষে সেখান থেকে পেছনে সরে আসা রীতিমতো কঠিন ছিল। মিশন সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন যে দেশ বিভাগ করে নতুন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য তারা ইংরেজ সরকারকে কিছুতেই বলবেন না। লর্ড পেথিক লরেন্স এবং স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস বারবার বলেছিলেন, মুসলিম লীগের পরিকল্পিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা একটি অবাস্তব পরিকল্পনা। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, আমার পরিকল্পনাটিই ছিল সব দিক থেকে ভালো, কারণ তাতে প্রদেশসমূহের হাতে সর্বাধিক ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রের হাতে শুধু তিনটি মাত্র বিষয় রাখবার কথা বলা হয়েছিল। লর্ড পেথিক লরেন্স একাধিকবার বলেছিলেন, এই সমাধানসূত্র গ্রহণ করবার ফলে মুসলমান-প্রধান প্রদেশসমূহ প্রথম দিকে তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দেবে, যার ফলে ওইসব প্রদেশের মুসলমানেরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করবেন। হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ আরো কয়েকটি বিষয় স্বেচ্ছায় কেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দেবে বলে স্থির হয়। মন্ত্রিমিশন মনে করেন, এতে কোনোরকম অন্যায় বা জবরদস্তির ব্যাপার নেই। একটি প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রে, কেন্দ্রের এক্তিয়ারে কোন কোন বিষয় থাকবে তা স্থির করবার স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ রাজ্যসমূহের থাকা দরকার।
তিনদিন আলোচনা করবার পর মুসলিম লীগ কাউন্সিল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শেষদিনে জিন্না স্বীকার করেন, সংখ্যালঘুদের সমস্যা সমাধানকল্পে মন্ত্রিমিশন যে পরিকল্পনা উপস্থাপিত করেছেন, তার চেয়ে ভালো সমাধান আর কিছু হতে পারে না। এছাড়া আর কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। লীগ কাউন্সিলকে তিনি বলেন, মন্ত্রিমিশন যে পরিকল্পনা উপস্থাপিত করেছেন, তার চেয়ে বেশি কিছু তিনিও করতে পারতেন না। তিনি তাই কাউন্সিলকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গ্রহণের পক্ষে ভোট দিতে বলেন।
আমি যখন মুসৌরিতে ছিলাম, সেই সময় মুসলিম লীগের কয়েকজন সদস্য আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বিস্ময় ও অসন্তুষ্টির কথা আমার কাছে ব্যক্ত করেন। তাঁরা বলেন, মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাই যখন লীগ কর্তৃক গৃহীত হলো, তখন স্বাধীন রাষ্ট্রের জিগির তোলা হয়েছিল কেন? আমি তাঁদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করি। অবশেষে তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হন, মুসলিম লীগ যাই বলুক না কেন, ভারতের মুসলমানদের কাছে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।
ওয়ার্কিং কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হয়, তখন আমি বলি, কংগ্রেস যে পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিল, মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটিও মূলত সেই অনুসারেই রচিত হয়েছে। সুতরাং ওয়ার্কিং কমিটি একরকম বিনা দ্বিধায়ই পরিকল্পনাটিকে মূলগতভাবে গ্রহণ করেন। তবে আলোচনার সময় ভারতের সঙ্গে কমনওয়েলথের সম্পর্কের কথাটাও উত্থাপিত হয়। আমি মন্ত্রিমিশনকে এ বিষয়টি ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে বলি। আমি মনে করেছিলাম, এইভাবেই বিষয়টির সুসমাধান করা সম্ভব হবে। আমি আরো বলেছিলাম যে বিষয়টি যদি ভারতের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভারত হয়তো কমনওয়েলথের মধ্যে থাকার জন্যই তার রায় দেবে। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসও এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হন। সুতরাং মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনায় এই বিষয়টিকে ভারতের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথাই উক্ত হয়। এর ফলে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা আমাদের পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে। অবশেষে আরো আলোচনার পরে ওয়ার্কিং কমিটি তাঁদের ২৬শে জুনের প্রস্তাবে মিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ভবিষ্যৎ ভারতের পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্বন্ধে মিশন যে প্রস্তাব রেখেছিলেন, তা ওয়ার্কিং কমিটি গ্রহণ করতে পারে না।
এই বিষয়ে আমি মন্ত্রিমিশনকে আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাতে চাই। তাঁরা যেভাবে সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠুভাবে বিচার-বিবেচনা করেছেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। মিশনের সদস্যদের মধ্যে স্যার স্ট্যাফোর্ড ছিলেন আমাদের পুরোনো বন্ধু। তাঁর সম্বন্ধে আমি আগেই আমার অভিমত জানিয়েছি। তবে লর্ড পেথিক লরেন্স এবং মি. আলেকজান্দারের সঙ্গে আগে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের সম্বন্ধে আমি উচ্চ ধারণা পোষণ করি। বিশেষ করে লর্ড পেথিক লরেন্স যেরকম সহানুভূতিসূচক মনোভাব প্রদর্শন করেন, তাতে আমি অত্যন্ত আনন্দলাভ করি। বয়সে তিনি বৃদ্ধ হলেও কর্মশক্তিতে তিনি ছিলেন যুবকের মতো। তাঁর স্বচ্ছ মনোভাব, ভারতের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা এবং মৌলিক অসুবিধাগুলো সম্বন্ধে দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার জন্য আমরা তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা পোষণ করেছি। মি. আলেকজান্দার বেশি কথা বলতেন না। কিন্তু যখনই তিনি কিছু বলেছেন, তাতে তাঁর কূট রাজনীতি জ্ঞানেরই পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ কর্তৃক মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করাটা একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে ভারতের স্বাধীনতা ব্যাপারে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি বিরোধ এবং হিংসার পদ্ধতির মাধ্যমে সমাধান না হয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা সম্ভব হয়। এর ফলে আরো দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক অসুবিধাগুলোও পরিহার করা সম্ভব হয়েছে। এই পরিকল্পনা গৃহীত হবার পরে সারা দেশের ওপর দিয়ে এক আনন্দের স্রোত বইতে থাকে এবং দেশবাসীরা তাঁদের স্বাধীনতার দাবিতে একতাবদ্ধ হন। আমরাও এতে আনন্দিত হই। কিন্তু তখনো আমরা জানতাম না এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী এবং ভবিষ্যতে এক মহা অমঙ্গল এবং অনর্থ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন