৭. ক্রিপস দৌত্য
যুদ্ধ যতই বিস্তৃত হতে লাগল ভারতের জনগণও ততই আশা করতে লাগল, এবার হয়তো ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে। জনগণের সেই আশাই অবশেষে রূপ পরিগ্রহ করল। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের একটি প্রস্তাব নিয়ে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসে হাজির হলেন। (ইতিহাসে এটাকেই বলা হয় ক্রিপস মিশন বা ক্রিপস দৌত্য।) তবে ক্রিপস দৌত্য সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করার আগে কিছু পূর্বকথা আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি।
যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন পরে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস আরো একবার ভারতে এসেছিলেন। সে সময় আমার সঙ্গে তিনি অনেকবার আলোচনা করেন। তখন ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন হয়। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসও তখন ওয়ার্ধায়। ওখানেও আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। সে আলোচনায় ভারতের যুদ্ধে যোগদানের কথাই প্রাধান্য লাভ করে।
আলোচনার সময় স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস একাধিকবার গান্ধীজীর মতামত সম্পর্কে মন্তব্য করেন। গান্ধীজীর যুদ্ধ-বিরোধী মনোভাবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে গান্ধীজী যেরকম দৃঢ় মনোভাব পোষণ করছেন তাতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে ভারতের কোনো রকম আপস-ই সম্ভব নয়। তবে ও ব্যাপারে আমি যে অভিমত ব্যক্ত করি তাতে পরবর্তী আলোচনার দরজা সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ হয় না। স্যার ক্রিপস তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যদি ভারতবাসীর স্বাধীনতার দাবি মেনে নেয় তাহলে ভারতের জনসাধারণ আমার কথা মেনে নেবে কিনা। এর উত্তরে আমি বলি, গান্ধীজীকে আমরা যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি এবং তাঁর মতামতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিই, তবে এই বিশেষ ব্যাপারটিতে কংগ্রেসের বেশিরভাগ লোক তথা সারা দেশই আমার পিছনে দাঁড়াবে। আমি তাঁকে আরো বলি, ভারত যদি স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে ভারতের জনসাধারণ সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে।
আমার কথায় খুশি হয়ে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস তখন আরো একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিল, ভারত থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্য সংগ্রহ করা যাবে কিনা।
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলি, যুদ্ধের ব্যাপারে আমরা সর্বতোভাবেই সহায়তা করব এবং ভারতের সহযোগিতা যাতে সর্বাত্মক হয় তা আমরা দেখব।
স্যার স্ট্যাফোর্ড তখন তাঁর রচিত একটি খসড়া প্রস্তাব আমাকে দেখতে দেন। এই প্রস্তাবে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট এবং ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে কীভাবে একটা আপস হতে পারে তার একটা পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবে তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট অবিলম্বে এক ঘোষণাবাণীর মাধ্যমে জানিয়ে দেবে যে যুদ্ধ শেষ হলেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষিত হবে। উক্ত ঘোষণাবাণীতে আরো উল্লিখিত থাকবে যে, স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষ ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরে থাকবে কিনা তা সে নিজেই স্থির করবে। অবিলম্বে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তা হলো, যুদ্ধ চলাকালে ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিল নতুন করে গঠন করা হবে এবং কাউন্সিলের সদস্যরা মন্ত্রীদের মতোই কাজ করবেন। ভাইসরয় থাকবেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে। এতে আইনসম্মতভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত না হলেও প্রকৃতপক্ষে একে ক্ষমতা হস্তান্তরই বলা চলে। আইনসঙ্গতভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে যুদ্ধ শেষ হবার পরে।
স্যার স্ট্যাফোর্ড তাঁর এই প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার মতামত জানতে চান। আমি তাঁকে বলি, এইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হঠাৎ কোনো রকম মন্তব্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি তাঁকে জানিয়ে দিই, ভারতের জনসাধারণ যদি বুঝতে পারে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সত্যি সত্যিই ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিচ্ছে তাহলে আমাদের ভেতরের সবরকম মতবিরোধের অবসান ঘটাবার পথ আমরা নিশ্চয়ই বের করব।
ভারত থেকে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস বে-সরকারি পরিদর্শক (non-official visitor) হিসেবে রাশিয়ায় যান। এর অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাকে রাশিয়ায় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের দূত হিসেবে নিযুক্ত করে। স্যার স্ট্যাফোর্ডের তখন বৃহস্পতির দশা চলছে। ভারতে তাঁর দৌত্যকার্যের সাফল্য সম্বন্ধে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এমন সব কথা প্রচারিত হতে থাকে যে অচিরেই তাঁর খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি রাশিয়ায় ব্রিটিশ দূত নিযুক্ত হবার পরেও এমন সব খবর প্রচার হতে থাকে, যেন তাঁর দৌত্যের ফলেই রাশিয়া মিত্রপক্ষের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েছে। হিটলার আর স্তালিনের মধ্যে যে বৈরীভাব সৃষ্টি হয়েছিল তার পেছনেও স্যার স্ট্যাফোর্ডের কৃতিত্ব ছিল বলে জোরালো প্রচার চলে। এইসব প্রচারের ফলে বিশ্ববাসী তাকে প্রথম শ্রেণির কূটনীতিবিশারদ বলে মনে করতে থাকে। কিন্তু সংবাদপত্রে তাঁর সম্বন্ধে বড় বড় কথা প্রচারিত হলেও রাশিয়ায় গিয়ে সোভিয়েট নীতিকে তিনি সত্যিই প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতামত যাই হোক না কেন, তাঁর খ্যাতি যে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল তাতে কোনোই ভুল নেই। এরপর তিনি যখন ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন তখন ইংল্যান্ডের জনসাধারণ এমন কথাও মনে করতে থাকে যে মিঃ চার্চিলের পরে তিনিই হবেন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।
ইতিপূর্বে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সম্বন্ধে আলোচনার সময় আমি বলেছি, ভারতের সঙ্গে একটা মিটমাট করে নেবার জন্য তিনি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে চাপ দিয়েছিলেন। এরপর জাপান যখন পার্ল হারবার আক্রমণ করল তখন যুদ্ধের ব্যাপারে ভারতের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য লাভের জন্য মার্কিন জনমত রীতিমতো সোচ্চার হয়ে ওঠে। এমন কি, মিঃ চার্চিলও একসময় মনে করেন, এ ব্যাপারে অবিলম্বে কিছু করা দরকার। তিনি তাই ভারত সম্বন্ধে এক নতুন নীতি গ্রহণ করেন এবং তাঁর সেই নীতিকে ভারতীয় নেতাদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে মনোনীত করেন।
আগেই বলেছি, স্যার স্ট্যাফোর্ড রাশিয়া থেকে ইংল্যান্ডে ফেরবার পরে ইংল্যান্ডের জনসাধারণ তাঁর সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করতে থাকে। তাদের মনে এইরকম একটা ধারণার সৃষ্টি হয় স্যার স্ট্যাফোর্ডের দৌত্যের ফলেই ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তথা মিত্রপক্ষ মস্কোতে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। এছাড়া ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্যও তিনি অনেকদিন থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করে আসছিলেন। আমার মনে হয় ওয়ার্ধায় থাকাকালে তিনি যে বিবৃতিটি রচনা করেছিলেন তা তিনি মিঃ চার্চিলকে দেখিয়েছিলেন। আমার আরো মনে হয়, মিঃ চার্চিল তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, মিঃ ক্রিপসের মনে এইরকম একটা ধারণা বদ্ধমূল হয় যে চার্চিল তাঁর পরিকল্পনা মেনে নেবেন। এবং এই কারণেই মিঃ চার্চিল যখন তাকে একটি রাজনৈতিক মিশনের প্রধান হিসেবে ভারতে যাবার জন্য অনুরোধ করেন, তিনি তখন সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ চার্চিলের অনুরোধ রক্ষা করতে স্বীকৃত হয়ে ভারতে আসতে সম্মত হন। তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল আগের বার আমার সঙ্গে তাঁর যেসব আলোচনা হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বর্তমান প্রস্তাবটি কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত হবে।
এর কয়েকদিন পরে ক্রিপস মিশন সম্বন্ধে বি. বি. সি. কর্তৃক একটি ঘোষণা প্রচারিত হয়। বি. বি. সি. কর্তৃক প্রচারিত উক্ত ঘোষণাটি ভারতে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সেই ঘোষণার বিষয়বস্তু নিয়ে ভারতের জনগণের মধ্যে নানারকম ধারণার সৃষ্টি হয়, কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট কী প্রস্তাবসহ ক্রিপস মিশনকে ভারতে পাঠাচ্ছেন তা জানতে না পারায় সমগ্র বিষয়টা একটা আন্দাজের মধ্যেই থেকে যায়। বি. বি. সি.-র সেই ঘোষণাটি ভারতে শুনতে পাওয়া যায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ রাত ৮টায়। এই ঘোষণা প্রচারিত হবার এক ঘণ্টার মধ্যেই সাংবাদিকরা আমার সঙ্গে দেখা করে এ সম্বন্ধে আমার মতামত জানতে চান। আমি তাঁদের বলি:
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস কী প্রস্তাব নিয়ে আসছেন তা না জানা পর্যন্ত এবং প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে না দেখা পর্যন্ত এ বিষয়ে আমি কোনো মতামত দিতে পারি না। তবে একটা কথা আপনারা জেনে নিতে পারেন, স্যার স্ট্যাফোর্ডকে আমি আমার পুরনো বন্ধু হিসেবে স্বাগত জানাবো এবং তাঁর মতামত গ্রহণ করতে চেষ্টা করব।
এরপরও সাংবাদিকরা আমার মতামত জানবার জন্য বিশেষভাবে চাপ দিতে থাকেন, কিন্তু তাঁদের চাপ সত্ত্বেও আমি ও ব্যাপারে আর কিছু বলতে সম্মত হইনি।
আমি যখন ওয়ার্ধায় ছিলাম সেই সময় ভাইসরয় আমার কাছে একটি টেলিগ্রাম করে তাতে জানিয়ে দেন ইংল্যান্ডের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে একটি মিশনসহ ভারতে পাঠাবেন বলে স্থির করেছেন। ভারতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি যে প্রস্তাব নিয়ে আসছেন সে সম্বন্ধে আলোচনা করবার জন্য আমার দিল্লিতে আসা দরকার। ভাইসরয়ের আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করি এবং সে কথা তাঁকে জানিয়ে দিই।
ভারতে আসবার আগে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভাইসরয়কে একটি চিঠি লিখে জানিয়ে দেন, ভারতের সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পার্টির নেতাদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করতে চান। কোন কোন নেতার সঙ্গে তিনি দেখা করবেন তার একটি তালিকা ভারত সরকার আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিলেন। উক্ত তালিকায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল তাঁদের সবাইকে দিল্লিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য, কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ছাড়া মুসলিম লীগ এবং হিন্দুমহাসভার নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। এছাড়া দেশীয় রাজন্যবৃন্দ এবং পাঞ্জাবের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খান বাহাদুর আল্লা বক্সকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। খান বাহাদুর আল্লা বক্স কয়েক মাস আগে দিল্লিতে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের এক সম্মেলনে নেতৃত্ব করেছিলেন বলে রাজনীতিক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন। আমি ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করলেও সম্মেলনের সাফল্যের জন্য উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সাহায্য করেছিলাম। সারা ভারত থেকে ১৪০০ প্রতিনিধি উক্ত সম্মেলনে যোগদান করার জন্য দিল্লিতে এসেছিলেন। বিরাট উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মধ্যে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের চেহারা দেখে ইংরেজ পরিচালিত সংবাদপত্রগুলোও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের বক্তব্য এবং ভারতের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকাকে ছোট করে দেখাতে সাহস পায়নি। তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয় ভারতের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং সে ভূমিকা কোনোক্রমেই উপেক্ষণীয় নয়।
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস দিল্লিতে পদার্পণ করার অব্যবহিত পরেই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমাদের মধ্যে সাক্ষাৎকার হয় ১৯৪২ সালের ২১শে মার্চ বিকেল তিনটায়। তখনই স্যার স্ট্যাফোর্ড তাঁর প্রস্তাব সংবলিত একটি বিবৃতির খসড়া আমাকে দেখতে দেন। তিনি বলেন, বিবৃতিতে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সেসব সম্বন্ধে আলোচনা করতে এবং দরকার হলে ব্যাখ্যা করতে তিনি প্রস্তুত আছেন। (পাঠকদের অবগতির জন্য স্যার স্ট্যাফোর্ডের সেই বিবৃতিটি এই গ্রন্থেও পরিশিষ্ট অংশে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।)
বিবৃতিটি পড়বার পরে আমি দেখতে পাই তাতে একটি নতুন একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। নতুন কাউন্সিল সম্বন্ধে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী কাউন্সিলের সদস্যরা তাঁদের সদস্যপদ পরিত্যাগ করবেন এবং তাঁদের জায়গায় কংগ্রেস ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিমূলক রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন কাউন্সিলের জন্য তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে অনুরোধ করা হবে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নতুন কাউন্সিল যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল পর্যন্ত কাজ করবে। আরো বলা হয়, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট একটি ঘোষণাবাণীর মাধ্যমে জানিয়ে দেবে যে যুদ্ধ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচিত হবে। অর্থাৎ, স্যার স্ট্যাফোর্ডের প্রস্তাবের মোদ্দা কথাটা হলো, ইংরেজ সংখ্যাগরিষ্ঠ একজিকিউটিভ কাউন্সিলের পরিবর্তে ভারতীয় সদস্য নিয়ে কাউন্সিল গঠিত হবে এবং পূর্ববর্তী ইংরেজ সদস্যরা সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করবেন। গভর্নমেন্ট যেমন আছে তেমনই থাকবে।
স্যার স্ট্যাফোর্ডকে আমি জিজ্ঞেস করি, এই কাউন্সিলে ভাইসরয়ের অবস্থানটা কিরকম হবে? আমার প্রশ্নের উত্তরে স্যার স্ট্যাফোর্ড বলেন, ভাইসরয় ওখানে ইংল্যান্ডের রাজার মতো নিয়মতান্ত্রিক প্রধান রূপে অবস্থান করবেন। বিষয়টাকে পরিষ্কার করে নেবার উদ্দেশ্যে আমি জানতে চাই, ভাইসরয় কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন কি না। এর উত্তরে স্যার স্ট্যাফোর্ড বলেন, এইরকমই তিনি মনে করেন। এরপর আমি জানতে চাই, আসল ক্ষমতা কার হাতে থাকবে,–কাউন্সিলের হাতে, না, ভাইসরয়ের হাতে? স্যার স্ট্যাফোর্ড বলেন, ক্ষমতা কাউন্সিলের হাতেই থাকবে, কারণ কাউন্সিল এখানে অনেকটা ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের মতো কাজ করবে। এরপর আমি ‘ইন্ডিয়া অফিসের’ প্রশ্ন তুলি। ইন্ডিয়া অফিসের কী হবে সে সম্বন্ধে আমি তাঁর ব্যাখ্যা দাবি করি। আমার প্রশ্নের উত্তরে স্যার স্ট্যাফোর্ড প্রথমে বলেন, এ বিষয়টা নিয়ে তিনি এখনো কিছু চিন্তা করেননি। পরে তিনি একটু চিন্তা করে বলেন, ইন্ডিয়া অফিস যেমন আছে তেমনই থাকবে এবং ভারতসচিবও থাকবেন। তবে ভারতসচিবের কাজ হবে ডোমিনিয়ন সেক্রেটারীর মতো। অন্যান্য ডোমিনিয়নের ক্ষেত্রে ডোমিনিয়ন সেক্রেটারি যেভাবে কাজ করেন ভারতের ক্ষেত্রে ভারতসচিব সেইভাবেই কাজ করবেন।
আমি তখন বিস্তারিতভাবে আমাদের পূর্ববর্তী প্রস্তাবসমূহের উল্লেখ করে তাঁকে বলি, যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই ভারত বারবার বলে এসেছে যে তাকে যদি স্বাধীনতা দেওয়া হয় তাহলে সে নিশ্চয়ই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতের প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি; সুতরাং যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টই দায়ী। স্যার স্ট্যাফোর্ড তখন বারবার এজন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আগে যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু এবার তিনি স্থিরনিশ্চয় হয়েছেন ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বর্তমান প্রস্তাবটি গৃহীত হলে সমস্ত রকম মতবিরোধেরই অবসান হবে। (… he felt convinced that all this would now end and if the offer he had brought on behalf of the British Cabinet was accepted.)
এইভাবেই মতবিনিময়ের ভেতর দিয়ে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎকার সমাপ্ত হয়।
এই সাক্ষাৎকারের অব্যবহিত পরেই ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করা হয়। সভার অধিবেশন ২৯শে মার্চ থেকে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত চলে। এরকম দীর্ঘস্থায়ী অধিবেশন এর আগে আর হয়নি। যেরকম আশা করা গিয়েছিল, সভায় ঠিক সেইরকমই দেখা গেলো। স্যার স্ট্যাফোর্ডের প্রস্তাবটিকে সদস্যরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করতে শুরু করলেন।
গান্ধীজী প্রথম দিন থেকেই প্রস্তাবটির বিরুদ্ধতা করছিলেন। তাঁর যুদ্ধ-বিরোধী মনোভাবটাই এ ব্যাপারে প্রাধান্য পেয়েছিল। এবং এই মনোভাবের জন্যই প্রস্তাবের অন্যান্য দিক সম্বন্ধে তিনি চিন্তা করেননি। ভারতবর্ষ যুদ্ধে জড়িত হবে এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এবং সেইজন্যই তিনি প্রস্তাবটির প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছিলেন। তাছাড়া প্রস্তাবের শেষদিকের বক্তব্যকেও তিনি সুনজরে দেখতে পারেননি। ওখানে বলা হয়েছিল, যুদ্ধের শেষে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সুযোগ দেওয়া হবে।
গান্ধীজী যখন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে প্রথমবার দেখা করেন তখনও মিঃ ক্রিপস তাঁকে তাঁর (ক্রিপসের) প্রাথমিক বিবৃতির কথা মনে করিয়ে দেন। ক্রিপস বলেন, উক্ত বিবৃতিটি গান্ধীজী এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি রচনা করেছিলেন। এর মর্মকথা হলো, যুদ্ধ চলাকালে একজিকিউটিভ কাউন্সিলকে পুরোপুরিভাবে ভারতীয় করা হবে এবং যুদ্ধ শেষ হলে ভারতকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা হবে। বর্তমানে তিনি যে প্রস্তাবটি নিয়ে এসেছেন সেটি মূলত তাঁর সেই পূর্ববর্তী বিবৃতিরই অনুরূপ।
গান্ধীজী বলেন, ওরকম কোনো বিবৃতির কথা তিনি স্মরণ করতে পারছেন না। তাঁর শুধু এই কথাটাই মনে আছে, সে সময় মিঃ ক্রিপসের সঙ্গে শুধু নিরামিষ ভোজন সম্বন্ধে কথা হয়েছিল। এর উত্তরে ক্রিপস বলেন, এটা তাঁর নিতান্ত দুর্ভাগ্য যে গান্ধীজী শুধু খাদ্য সম্বন্ধে আলোচনার কথাটাই মনে রেখেছেন, কিন্তু তিনি যে গান্ধীজীর সঙ্গে পরামর্শ করেই বিবৃতিটি রচনা করেছিলেন সেকথা তিনি আদৌ স্মরণ করতে পারছেন না।
আলোচনার সময় গান্ধীজী এবং ক্রিপসের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয়েছিল এবং তাঁদের সে আলোচনা বেশ সরস ও হৃদয়গ্রাহীও হয়েছিল, তবে সেই বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যেও উভয়ের মধ্যে তীব্র মতভেদ দেখা দিয়েছিল। গান্ধীজী বলেছিলেন, প্রস্তাবগুলো এমনভাবে কাটাই করে এবং শুকিয়ে নিয়ে, তৈরি হয়েছে যে তা নিয়ে বিচার-বিবেচনা করবার আর কোনো সুযোগই দেখা যাচ্ছে না। তিনি হাসতে হাসতে ক্রিপসকে সাবধান করে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, আমি তাঁকে এমন একটা সুদীর্ঘ রজ্জু দিয়েছি যার সম্বন্ধে তাঁর সচেতন থাকা দরকার। স্যার ক্রিপসও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাস্যরসাত্মক বাক্যে এর উত্তর দেন। তিনি বলেন, আমার সেই দীর্ঘ রজ্জুটা যে তাঁকে ফাঁসীতে ঝোলাতে পারে সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত আছেন।
এশিয়া এবং ইউরোপের তৎকালীন অবস্থা এবং ঘটনাবলীর প্রসার দেখে জওহরলাল গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিশেষভাবে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর স্বাভাবিক সহানুভূতি ছিল গণতান্ত্রিক শিবিরের পক্ষে এবং সেইজন্য তিনি গণতান্ত্রিক শিবিরকে যতটা সম্ভব সাহায্য করবার জন্য ব্যগ্র হয়েছিলেন, এবং এই কারণেই তিনি প্রস্তাবটা সুবিবেচনার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ভারতের জনমত তখন এতো বেশি ইংরেজবিরোধী ছিল যে তিনি জোরের সঙ্গে কিছু বলতে পারছিলেন না। আমি তাঁর সেই অব্যক্ত মনোভাব বুঝতে পারি এবং তাঁর মতামতের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে পড়ি।
ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগেরই যুদ্ধ সম্বন্ধে কোনো রকম সুস্পষ্ট অভিমত ছিল না। এঁরা সবাই তাকিয়ে ছিলেন গান্ধীজীর দিকে। এ ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন শ্রীরাজাগোপালাচারী। তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণের পক্ষেই তার মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য সদস্যরা তাঁর মতামতকে কোনো রকম গুরুত্ব না দিয়ে তাঁকে নরমপন্থী বলে মনে করছেন। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
ওয়ার্কিং কমিটি দু’দিন ধরে প্রস্তাবটা নিয়ে বিচার-বিবেচনা করলেও, কোনো রকম সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। অবস্থা দেখে আমার মনে হয়, প্রস্তাব সম্পর্কে আরো ব্যাখ্যা এবং কোনো কোনো বিষয়ে আরো বিস্তৃত বিবরণ স্যার স্ট্যাফোর্ডের কাছ থেকে সংগ্রহ করা দরকার। যে মৌলিক প্রশ্নে স্যার স্ট্যাফোর্ডের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয় তা হলো একজিকিউটিভ কাউন্সিলের ক্ষমতা। স্যার স্ট্যাফোর্ড বলেছিলেন, কাউন্সিল আগের মতোই থাকবে। তবে তা গঠিত হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক পার্টির মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা। তিনি আমাকে মৌলিকভাবে এমন আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে ভাইসরয় শুধু নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হয়ে থাকবেন। ওয়ার্কিং কমিটি বলেন এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রস্তাবের মধ্যে উল্লিখিত থাকা দরকার। ওয়ার্কিং কমিটির এই দাবি অনুসারে আমি ১লা এপ্রিল (১৯৪২) আর একবার ক্রিপসের সঙ্গে দেখা করি।
স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে এবারের সাক্ষাৎকারটা হয় রীতিমতো বস্তুনিষ্ঠভাবে। প্রায় তিন ঘণ্টা আমাদের মধ্যে আলোচনা চলে। এই সময় আমি লক্ষ্য করি, অবস্থাটা ইতিমধ্যে সম্পূর্ণভাবে পালটে গেছে। তাঁর এবারের কথাগুলোর মেজাজ পূর্ববর্তী কথাগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি যখন তাঁর কাছে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের ব্যাখ্যা দাবি করি তখন তিনি বলেন, যুদ্ধের সময়ও কাউন্সিল মন্ত্রিসভার মতো কাজ করবে বলেই তিনি আশা করেন। আমি তখন জানতে চাই, এর অর্থ কি এই—কাউন্সিলের বেশিরভাগ সদস্য যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সেই সিদ্ধান্তই হবে শেষ এবং অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত? ক্রিপস তখন এক অসঙ্গতিপূর্ণ উত্তর দেন। শেষ সিদ্ধান্ত যে ভাইসরয়ের ওপরই ন্যস্ত থাকবে সেকথা তিনি স্পষ্ট করে না বললেও তিনি যা বলেন তার মর্মকথা হলো, শেষ এবং অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা কাউন্সিলের থাকবে না। বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করবার জন্য তিনি যা বলতে চেষ্টা করেন তা হলো, ভাইসরয় বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছেন, আইনগত দিক থেকে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। তবে তিনি বারবার একটা কথার ওপর জোর দেন, আইনগত দিক থেকে ভাইসরয়ের অবস্থা যাই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবেই কাজ করবেন।
আমি স্যার স্ট্যাফোর্ডকে স্মরণ করিয়ে দিই পূর্ববর্তী সাক্ষাৎকারের সময় তিনি আরো বেশি বস্তুনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি তখন সওয়াল করে আমাকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেন, মৌলিক অবস্থার কোনোই পরিবর্তন হয়নি। আগে তিনি যে কথা বলেছিলেন এখনও সেই কথাই বলছেন। আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই আগের বার আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন কাউন্সিল ঠিক মন্ত্রিসভার মতোই কাজ করবে কিন্তু আজ তিনি বলছেন আইনগত অবস্থাটা অপরিবর্তিত থাকবে। এবং এবার তিনি আমাকে শুধু মৌলিকভাবে আশ্বাস দিতে চাইছেন কাউন্সিল মন্ত্রিসভার মতো কাজ করবে বলেই তিনি আশা করেন। প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় যে কথা আমাকে বলা হয়েছিল এবং তার ফলে যেরকম ধারণা নিয়ে গিয়েছিলাম তা ঠিক এবারের মতো নয়। আমি তখন ইন্ডিয়া অফিস এবং ভারতসচিবের (Secretary of State for India) কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি তখন বলেছিলেন, ভারতসচিব কমনওয়েলথ সেক্রেটারীর মতো কাজ করবেন। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, ইন্ডিয়া অফিস এবং ভারতসচিবের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে হলে পার্লামেন্টে নতুন করে আইন পাস করাতে হবে। এর উত্তরে ক্রিপস বলেন, তিনি আশা করেন ইন্ডিয়া অফিস পরিবর্তিত অবস্থাটা উপলব্ধি করে নতুন পরিস্থিতি অনুসারে কাজ করবে, তবে ভারতসচিবের অবস্থানকে কমনওয়েলথ সেক্রেটারীর পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য আইন প্রণয়ন করতে নানারকম অসুবিধে আছে।
এরপর আমি যুদ্ধশেষে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে বলে যে কথাটা বলা হয়েছে সেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করি। ক্রিপস বলেন, ভারতের সমস্যাবলীকে যুদ্ধের পরে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা হবে এবং তার ফলে ভারত তার নিজের ভাগ্য নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তিনি তাই বন্ধুভাবে আমাদের পরামর্শ দিচ্ছেন আমরা যেন আর কোনো বাধার সৃষ্টি না করে ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের প্রস্তাবটা যেভাবে এসেছে ঠিক সেইভাবেই গ্রহণ করি। তিনি আরো বলেন, ভারত যদি যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেনের সঙ্গে সর্ববিষয়ে সহযোগিতা করে চলে তাহলে যুদ্ধশেষে তার স্বাধীনতা প্রাপ্তিও সুনিশ্চিত।
স্যার স্ট্যাফোর্ডের এই মত পরিবর্তন নিয়ে ভারতে এবং ভারতের বাইরেও নানারকম সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি যেসব অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে কেন তিনি তা থেকে সরে এসে অন্যরকম কথা বললেন তা নিয়ে নানারকমের জল্পনাকল্পনা শুরু হয়। নানা রকমের ব্যাখ্যাও চলতে থাকে বিষয়টা নিয়ে। একটি ব্যাখ্যা হলো, স্যার স্ট্যাফোর্ড হয়তো আশা করেছিলেন ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাবে মৌলিক পরিবর্তনের কথা না থাকলেও তিনি জোরালো সওয়ালের সাহায্যে এবং বিশেষ করে তাঁর চিত্তাকর্ষক চালচলনের দ্বারা কংগ্রেস কর্তৃক প্রস্তাবটা গ্রহণ করাতে সক্ষম হবেন। এবং এই কারণেই তিনি প্রথমদিকে কংগ্রেস নেতাদের সামনে আশার একটি আলোকবর্তিকা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেস নেতারা যখন প্রস্তাবটাকে নানাদিক থেকে বিচার-বিবেচনা করে নতুন করে ব্যাখ্যা দাবি করেন এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁকে জেরা করতে শুরু করেন তখন তিনি কথা বলবার সময় রীতিমতো সাবধান হয়ে যান। তিনি তখন এমন কোনো কথা বলেন না যা ভবিষ্যতে রক্ষিত হবে না। এ ব্যাপারে আর একটি বিকল্প ব্যাখ্যাও করা হয়। এটি হলো, কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রথম এবং দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের অন্তর্বর্তী সময়ে ভারত সরকার তাঁকে সাবধান হতে পরামর্শ দেন। তিনি সব সময় ভাইসরয় এবং তাঁর বশংবদ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবৃত ছিলেন। সুতরাং এটা মনে করা অসঙ্গত হবে না যে স্যার স্ট্যাফোর্ডের পরবর্তী কথাবার্তায় তাদের অভিমতই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি ছাড়া আরো একটি ব্যাখ্যা সে সময় চালু ছিল। এই তৃতীয় ব্যাখ্যাটি হলো, অন্তর্বর্তী সময়ে দিল্লি এবং লন্ডনের মধ্যে মতবিনিময় হয়েছে এবং ইংল্যান্ডের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা তাকে নতুন কোনো নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেই নির্দেশের ফলেই তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অভিমত থেকে দূরে সরে গেছেন।
তাঁর এই মত পরিবর্তনের পেছনে আসলে কী ঘটেছিল সে কথা আমার জানা নেই। তবে মনে হয়, উপরে বর্ণিত ব্যাখ্যাগুলিতে যেসব কথা বলা হয়েছে তার এক বা একাধিক কারণে তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন। ক্রিপস আসলে একজন অ্যাডভোকেট। সুতরাং আইনজীবীর মতোই তিনি প্রথমদিকে নানা বর্ণে রঞ্জিত করে প্রতিপক্ষের সামনে তুলে ধরে তাদের মন জয় করতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া সমস্ত বিষয়টাকে তিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেই প্রথমদিকে বিচার করেছিলেন এবং নিজে যা মনে করেছিলেন সেই কথাই ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা যখন তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা দাবি করি তখন তিনি বিপদ দেখে পশ্চাদপসরণ করেন। পরে আমি জানতে পারি মস্কোতেও তিনি ঠিক একই কায়দায় তাঁকে দেওয়া নির্দেশসমূহকে অন্যভাবে চিত্রিত করেছিলেন। এ ব্যাপারে একটি বোধগম্য ব্যাখ্যা দেওয়া চলে। একজন ইংরেজ হিসেবে তিনি লিখিত স্বীকৃতি অপেক্ষা প্রচলিত ধারা অনুসারে কাজ করার ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি হয়তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন একবার যদি তাঁর প্রস্তাবটি গৃহীত হয় তাহলে প্রচলিত ধারা অনুসারে তাঁর প্রথমের কথা অনুসারেই সমস্ত বিষয় চলতে থাকবে। সুতরাং সঙ্গতভাবেই তিনি কোনো রকম লিখিত আশ্বাস দিতে সম্মত হতে পারেননি। এবং এই কারণেই আমরা যখন তাঁর কাছে ব্যাখ্যা দাবি করি তখন তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অভিমত থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
এবারের সাক্ষাৎকারে তাঁর কাছ থেকে আমি যা জানতে পারি তাতে এক নতুন চিত্র ফুটে ওঠে। আমার তখন প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো ওয়ার্কিং কমিটির কাছে স্যার স্ট্যাফোর্ডের এই পশ্চাদপসরণকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। আমি ওয়ার্কিং কমিটির কাছে ক্রিপসের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের যে বিবরণ পেশ করি তার পরিপ্রেক্ষিতে ২রা এপ্রিল সকালে ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন শুরু হয়।
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে আমার এই দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকারের বিবরণ আমি ২রা এপ্রিল সকালে ওয়ার্কিং কমিটির কাছে পেশ করি। অবস্থাটা আমি নিম্নবর্ণিতভাবে উপস্থাপিত করেছিলাম:
১. এবার আমি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি, ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভা যুদ্ধ চলাকালে ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত নন। ইংরেজরা মনে করছে যে এতে একটা বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হবে। এবং সেই ঝুঁকি নিতে তারা প্রস্তুত নয়।
২. যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি এবং বিশেষ করে আমেরিকার চাপের ফলে ইংরেজদের মতিগতি সামান্য কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। চার্চিল সরকারও এখন মনে করছে যে যুদ্ধের ব্যাপারে ভারতের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সাহায্য পাবার জন্য একটা কিছু করা দরকার। এইজন্যই তারা ভারতীয় সদস্যদের দ্বারা একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন করে সেই কাউন্সিলের হাতে কিছু বেশি ক্ষমতা দিতে চাইছে। আইনের চোখে কাউন্সিল শুধু কাউন্সিল হিসেবেই থাকবে, মন্ত্রিসভার মতো ক্ষমতা এরা পাবে না।
৩. বাস্তবক্ষেত্রে ভাইসরয় হয়তো কাউন্সিলের প্রতি কিছুটা সদয় মনোভাবই পোষণ করবেন এবং সাধারণভাবে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। তবে কাউন্সিল সব সময়ই তাঁর অধীনস্থ থাকবে এবং কোনো ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তাঁর হাতেই থাকবে, কাউন্সিলের হাতে নয়।
৪. অতএব ওয়ার্কিং কমিটি যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন, অর্থাৎ শেষ সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, তার উত্তরে বলা যায়, এটা ভাইসরয়ের হাতেই থাকবে।
৫. ক্রিপস যে বক্তব্য রেখেছেন সেই অনুসারে ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভা হয়তো ভবিষ্যতে ভারতীয় সমস্যাটা একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করবেন, কিন্তু যুদ্ধের পরে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
৬. যুদ্ধের পরে রক্ষণশীল সরকারের পরিবর্তে আবার কোনো নতুন সরকার গঠিত হবার বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে। এমনও হতে পারে, সেই নতুন সরকার ভারতের প্রশ্নটি সহানুভূতির সঙ্গেই বিচার করবে। কিন্তু এই ধরনের কোনো সম্ভাবনা বর্তমান প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।
৭. এর ফলশ্রুতি হলো, কংগ্রেস যদি ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা করা হবে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে মেনে নিয়েই, অর্থাৎ যুদ্ধের পরে ভারতের ভবিষ্যৎ কী হবে সে সম্বন্ধে কোনো রকম নিশ্চয়তা না পেয়েই তা করা হবে।
ক্রিপস মিশন সম্পর্কে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যে ঘোষণা প্রচার করেছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে বিচার-বিবেচনা করি। উক্ত ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে ভারত এবার তার নিজের ভাগ্য নিজেই নিয়ন্ত্রণ করবার সুযোগ পাবে। ক্রিপসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনিও এইরকম কথাই বলেছিলেন, কিন্তু আলোচনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী রঙিন চিত্রও ফিকে হয়ে আসতে থাকে।
অন্যান্য কারণেও আলোচনার গতি ভিন্ন পথে প্রবাহিত হয়েছিল। আমি আগেই বলেছি, স্যার স্ট্যাফোর্ড ভারতে আসবার সময় কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানাবার জন্য ভাইসরয়কে বলেছিলেন। এই নেতাদের মধ্যে পরলোকগত মি. আল্লা বক্সও ছিলেন। কিন্তু ভারতে এসে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী অভিমতের কিছুটা পরিবর্তন করেন। মনে হয়, ভাইসরয়ের প্রভাবের ফলেই এটা হয়েছিল। আল্লা বক্স ভাইসরয়ের নিমন্ত্রণপত্র পেয়েই দিল্লিতে এসে স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ স্থির হলো না। ব্যাপারটা একটা বিশ্রী অবস্থায় দাঁড়াচ্ছে দেখে আমি স্যার স্ট্যাফোর্ডের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করি। তিনি তখন বলেন, শিগগিরই তিনি আল্লা বক্সের সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু এ কথা বলা সত্ত্বেও আল্লা বক্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কোনো ব্যবস্থাই হলো না। এর ফলে আল্লা বক্স রীতিমতো বিরক্ত হয়ে দিল্লি পরিত্যাগ করবেন বলে স্থির করেন। আমি যখন ব্যাপারটা জানতে পারি তখন আমি আর একবার স্যার স্ট্যাফোর্ডের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করি। এবার আমি বেশ একটু দৃঢ়ভাবেই তাকে বলি, আল্লা বক্সের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করাটা তাঁর পক্ষে মোটেই উচিত হচ্ছে না। এতে যে শুধু আল্লা বক্সকেই অপমান করা হচ্ছে তাই নয়, মুসলমান সমাজের একটা বিরাট অংশকেও এর দ্বারা অপমান করা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সঙ্গে দেখা করবার অনিচ্ছা থাকলে সেটা আগেই স্থির করা উচিত ছিল; নিয়ন্ত্রণ করে এনে তাকে দিল্লিতে বসিয়ে রাখাটা মোটেই উচিত হচ্ছে না।
আমার হস্তক্ষেপের ফলে পরদিনই স্যার স্ট্যাফোর্ড আল্লা বক্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সে সাক্ষাৎকার হয় নিতান্তই প্রহসনের মতো। মাত্র এক ঘণ্টা তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয় এবং সমগ্র আলোচনাটাই মামুলি ধরনের কথাবার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আমার মতে ক্রিপস এ ব্যাপারে রাজনীতিকের মতো ব্যবহার করেননি।
আরো একটি ঘটনার ফলে আমার মনটা বিরূপ হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভার প্রস্তাবের বিষয়বস্তু প্রচারিত হবার পর ভারতের বেশিরভাগ দৈনিক পত্রিকা তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলোর ভাষা হয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং তীব্র। ওইসব সমালোচনা পড়ে ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন চলাকালেই স্যার স্ট্যাফোর্ড আমার কাছে একখানা চিঠি লিখে তাতে মন্তব্য করেন, হিন্দু পত্রিকাগুলো তাঁর প্রস্তাবকে সুনজরে না দেখলেও তিনি আশা করেন আমি তার প্রস্তাবটি উদার দৃষ্টিতে দেখবো। তাঁর ওই ‘হিন্দু পত্রিকা’ কথাটা আমার মোটেই ভালো লাগেনি। আমার মনে হয়, আমি মুসলমান বলেই তিনি ‘হিন্দু পত্রিকা’ কথাটার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কোনো পত্রিকার সমালোচনা অথবা মন্তব্য তাঁর মনঃপূত না হলে তিনি সংশ্লিষ্ট পত্রিকা অথবা পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন। যাই হোক, তাঁর সেই চিঠির উত্তরে আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জানিয়ে দিই, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বিষয়টাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন না; পত্রিকার সমালোচনা যাই হোক না কেন, ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত তার দ্বারা প্রভাবিত হবে না।
ওয়ার্কিং কমিটির এবারের অধিবেশন ২৯শে মার্চ থেকে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত চলে। এই সময় আমি সারাদিন কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতাম এবং ২রা এপ্রিলের পর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করতাম। এই সময় জওহরলালও প্রায়ই আমার সঙ্গে থাকতেন। একমাত্র জওহরলাল ছাড়া ওয়ার্কিং কমিটির আর কোনো সদস্য তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি, আমিই তাঁদের নিষেধ করেছিলাম। স্যার স্ট্যাফোর্ডের ভারতে আসবার কথা প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করতে নিষেধ করে এক সার্কুলার লেটার প্রেরণ করি। এরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করবার কারণ হলো, আলাদা আলাদা ভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করলে সময় সময় এমন সব কথাও আলোচিত হতে পারত যার ফলে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব ছিল না। সার্কুলার লেটারে আমি আরো বলি, পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে অথবা অন্য কোনো বিশেষ কারণে যদি কারো স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে দেখা করার দরকার হয় তাহলে সে কথা তিনি যেন আগে আমাকে জানিয়ে তারপর দেখা করেন।
ক্রিপস আমার কাছে অভিযোগ জানান, আগেরবারে তিনি যখন ভারতে এসেছিলেন সে সময় ওয়ার্কিং কমিটির অনেক সদস্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন কিন্তু এবার আমি নিষেধাজ্ঞা জারি করায় কোনো সদস্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করছেন না। কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের আপত্তির জন্য তাঁরা সামাজিক অনুষ্ঠানেও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না।
স্যার স্ট্যাফোর্ডের এই অভিযোগের উত্তরে আমি বলি, একটি দায়িত্বশীল সংগঠন যখন গভর্নমেন্টের সঙ্গে আলোচনায় ব্রতী হয়েছে তখন সে আলোচনাটা তাদের মুখ্য প্রতিনিধির মারফত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় এবং এই কারণেই ওয়ার্কিং কমিটি স্থির করেছেন, গভর্নমেন্টের সঙ্গে যা কিছু আলোচনা হবে তার সবই হবে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে। অন্যান্য সদস্যদের পক্ষে আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনা করাটা মোটেই ঠিক হবে না। তবে ক্রিপস যদি নিজে থেকে কোনো সদস্যের সঙ্গে দেখা করতে চান আমি তাতে আনন্দের সঙ্গেই সম্মতি দেবো।
ক্রিপস তখন বলেন তিনি ভুলাভাই দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহান্বিত। আগের বারে ভুলাভাইয়ের বাড়িতেই তিনি ছিলেন। নিজের পরনের খাদি স্যুটটি দেখিয়ে স্যার স্ট্যাফোর্ড বলেন, আজ যে পোশাক আমি পরে আছি, এটাও ভুলাভাই দেশাইয়েরই উপহার! ক্রিপসের কাছ থেকে এই কথা শোনবার পর আমি ভুলাভাই দেশাইকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলি এবং তিনিও দেখা করেন।
এদিকে প্রস্তাব সম্বন্ধে ওয়ার্কিং কমিটিতে আলোচনা চলতেই থাকে। গান্ধীজি প্রথম থেকেই উক্ত প্রস্তাব গ্রহণের বিরুদ্ধে ছিলেন। তবে জওহরলাল ছিলেন প্রস্তাবটা গ্রহণের পক্ষে। আমি কিন্তু তাঁদের উভয়ের মতামতেরই বিরুদ্ধে ছিলাম। গান্ধীজি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন, কারণ তাঁর অভিমত আগাগোড়াই যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। অন্যদিকে জওহরলাল প্রস্তাবটা গ্রহণের পক্ষে ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অবিচল নিষ্ঠার জন্য। এছাড়া ভারতের জনগণের কাছে মার্শাল চিয়াং কাই-শেক যে আবেদন জানিয়েছিলেন সেই আবেদনটাও তাঁর মনকে প্রভাবিত করেছিল। জওহরলাল যে অভিমত পোষণ করতেন তা হলো, কংগ্রেসের সম্মানকে কোনোরকম ক্ষুণ্ন না করে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা যেতে পারে।
আমার মতে প্রস্তাবটি গ্রহণ অথবা বর্জন সম্বন্ধে একটিমাত্র প্রশ্ন ছিল। সেটা হলো, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের এই প্রস্তাবে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে আদৌ কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা। তা যদি হয় তাহলে আমরা প্রস্তাবটা গ্রহণ করবো; কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে আমরা প্রস্তাবটাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবো। অর্থাৎ প্রস্তাবটা গ্রহণ বা বর্জনের ব্যাপারে আমার কাছে ভারতের স্বাধীনতাই ছিল মুখ্য বিষয়।
আলোচনার শুরু থেকেই আমার প্রচেষ্টা ছিল ক্রিপস প্রস্তাবকে এমন এক অবস্থায় আনা যাতে আমরা প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে পারি। আমি চেয়েছিলাম, একজিকিউটিভ কাউন্সিল প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রিসভার মতো কাজ করবে এবং ভাইসরয় শুধু নিয়মতান্ত্রিক প্রধানরূপে থাকবেন। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলে যুদ্ধের সময়েই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে বলে আমরা জোর করবো না।
আগেই বলেছি, আলোচনাটা চলেছিল দীর্ঘ দু সপ্তাহ ধরে। দিনের বেলায় ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসতো এবং সন্ধ্যার সময় আমি ক্রিপসের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সঙ্গে নতুন করে আলোচনা করতাম এবং পরদিন সকালে আমাদের সেই আলোচনার বিষয়বস্তু ওয়ার্কিং কমিটিকে জানিয়ে দিতাম। এখানে আর একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ওয়ার্কিং কমিটির সভা চলাকালে ক্রিপস ভাইসরয়ের সঙ্গেও আলোচনা করেন। পরবর্তীকালে আমি আরো জানতে পারি, এই সময় ক্রিপস অন্তত বার তিনেক চার্চিলের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন। এছাড়া মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গেও হয়তো তিনি আলোচনা করে থাকবেন।
ক্রিপস সব সময় একটা কথার ওপরে জোর দিতেন, যুদ্ধ চলাকালে যে বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তা হলো, সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া। এদিকে যুদ্ধ তখন এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছে যে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থার ওপরেও ভীষণভাবে চাপ পড়েছে। এইরকম পরিস্থিতির ফলে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের পক্ষে যুদ্ধের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা কোনোমতেই সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। আমি তাই বলি, ভারতীয় একজিকিউটিভ কাউন্সিলের এ ব্যাপারে মতামত প্রকাশের অধিকার থাকা উচিত এবং ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভারও কাউন্সিলের ওপরে পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত।
স্যার স্ট্যাফোর্ড তখন সওয়াল করে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউন্সিলের ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে জোর দেওয়াটা ঠিক হবে না এবং এমন কথাও বলা উচিত হবে না যে শাসন ব্যাপারে শেষ ক্ষমতা কাউন্সিলের হাতেই থাকবে। তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলো, ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই কাউন্সিলের হাতে ক্রমশ বেশি ক্ষমতা আপনা থেকেই এসে যাবে।
সে সময় ভারতের কমান্ডার-ইন-চিফ ছিলেন লর্ড ওয়াভেল। ক্রিপস তাঁর সঙ্গেও একাধিকবার আলোচনা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনার ফলে ক্রিপসের মনে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে আমি যদি লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁর কাছ থেকে যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থাটা জানতে পারি তাহলে হয়তো আমরা তাঁর প্রস্তাবটা সহজেই মেনে নেবো। তিনি তাই আমার কাছে একটি চিঠি লিখে আমাকে লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করেন। আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হই। আমার সম্মতি পাবার পর তিনি অবিলম্বে আমার সঙ্গে লর্ড ওয়াভেলের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন।
ক্রিপস নিজেই জওহরলালকে এবং আমাকে সঙ্গে করে ওয়াভেলের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েই তিনি বিদায় নেন। আমরা তখন এক ঘণ্টারও বেশি লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে আলোচনা করি। তবে সে আলোচনায় এমন কোনো নতুনত্ব আমরা পাইনি যাতে মৌল বিষয়ে, অর্থাৎ প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষে নতুন করে আমরা কিছু চিন্তা করতে পারি। এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, আলোচনার সময় লর্ড ওয়াভেল সৈনিকের মতো কথাবার্তা না বলে একজন ঝানু রাজনীতিকের মতোই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, যুদ্ধ চলাকালে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধটাকে চালিয়ে যাবার ব্যাপারটাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমিও এটা অস্বীকার করিনি। তবে আমাদের মূল প্রশ্নটাও তাঁকে জানিয়ে দিতে ভুল করিনি। আমি তাঁর কাছ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানতে চাই, শাসন ব্যাপারের আসল ক্ষমতা কার হাতে থাকবে—কাউন্সিলের হাতে, না ভাইসরয়ের হাতে? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।
লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে আমাদের আলোচনার পরে ক্রিপস আমাদের কাছে এক নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবে বলা হয়: একজিকিউটিভ কাউন্সিলের একজন সদস্যের ওপরে যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এই প্রস্তাব উত্থাপন করে ক্রিপস আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে এই ব্যবস্থার ফলে যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারেও ভারতীয় সদস্যের হাতে দায়িত্ব দেওয়া হবে।
কিন্তু উক্ত সদস্যের সঙ্গে কমান্ডার-ইন-চিফের সম্পর্কটা ঠিক কিরকম হবে তা তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। এই ব্যাপারে তিনি আর একবার আমার সঙ্গে লর্ড ওয়াভেলের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। এবারে আমি লর্ড ওয়াভেলের কাছে জানতে চাই, ভারতীয় কাউন্সিলের ভূমিকা মন্ত্রিসভার মতো হবে কিনা? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তার সঙ্গে আলোচনা করে এবারে আমি যা বুঝতে পারি তা হলো, কোনো ভারতীয় সদস্যের ওপরে যুদ্ধ সম্পর্কিত দায়িত্ব দেওয়া হলেও কোনো রকম ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হবে না। তিনি শুধু ক্যান্টিন, যানবাহন এবং কমিশারিয়েট প্রভৃতি সাধারণ বিষয়গুলোই দেখাশোনা করবেন, যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর ব্যাপারে তাঁর কোনো কর্তৃত্বই থাকবে না।
এর ফলে অবস্থাটা যা দাঁড়ায় তা সংক্ষেপে এইরকম: ক্রিপসের প্রস্তাবে দেখা যায়, যুদ্ধের পর ভারতের স্বাধীনতা স্বীকৃত হবে। যুদ্ধের সময় শাসন ব্যাপারে যেটুকু পরিবর্তন করা হবে তা হলো, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে তাদের দ্বারা একজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন। সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানকল্পে ক্রিপসের অভিমত হলো, যুদ্ধের শেষে প্রদেশগুলো ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেবে কিনা তা তারা নিজেরাই স্থির করবে।
ক্রিপস প্রস্তাবের যে অংশে বলা হয়েছে যুদ্ধের পরে ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হবে, সে অংশের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো বক্তব্য ছিল না। প্রস্তাবিত কাউন্সিল সম্বন্ধে আমার অভিমত এই ছিল, কাউন্সিলকে যদি কোনোরকম ক্ষমতা না দেওয়া হয় তাহলে এই পরিবর্তনের কোনো অর্থই হবে না। ক্রিপসের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি বলেছিলেন, কাউন্সিল প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রিসভার মতোই কাজ করবে; কিন্তু পরবর্তী আলোচনায় আমরা জানতে পারি, ও কথাটা তিনি কবিত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে বেশ কিছুটা বাড়িয়ে বলেছিলেন। তাঁর আসল প্রস্তাবটা সম্পূর্ণ আলাদা।
ক্রিপসের আর একটি কুপ্রস্তাব হলো, প্রদেশগুলোকে তাদের ইচ্ছামতো ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকার অধিকার দেওয়া। এই প্রস্তাব এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ক্রিপসের অন্যান্য প্রস্তাবে গান্ধীজি রীতিমতো বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং এর বিরুদ্ধে তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানান। ক্রিপসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের পরে আমি যখন গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবের বিষয়বস্তু তাঁকে জানিয়ে দিই তখনই তিনি বলেছিলেন, প্রস্তাবটি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এর দ্বারা সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের পথে রীতিমতো জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
এই ব্যাপারটা নিয়ে ক্রিপসের সঙ্গে আমি বিশেষভাবে আলোচনা করি। এ সম্পর্কে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের অভিপ্রায় কি, তা আমি তাঁর কাছ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানতে চাই। ক্রিপস তখন আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, সাম্প্রদায়িক সমস্যার একটি সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, দু’রকমভাবে এর সমাধান করা যায়। একটি হলো, এখনই এ সমস্যার সমাধান করা এবং অপরটি হলো, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাপারটাকে মুলতুবি রাখা। তাঁর মতে এখনই এ সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না; এতে আরো জটিলতার সৃষ্টি হবে। তবে তিনি এ কথাও আমাকে জানিয়ে দেন, হিন্দুরা এবং মুসলমানরা যদি তাদের সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারেন তাহলে এখনই এর সমাধান হতে পারে।
আমি তখন ক্রিপসকে বলি, প্রদেশগুলোকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকার অধিকার দেবার অর্থ হলো ভারত বিভাগের দরজা খোলা রাখা। ক্রিপস আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, প্রদেশগুলোকে এই অধিকার সাধারণভাবে দেওয়া হবে, কোনো সম্প্রদায়বিশেষকে তা দেওয়া হবে না। তাঁর মতে প্রদেশগুলোকে এই অধিকার দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রদেশই এ অধিকার প্রয়োগ করতে চাইবে না, কারণ এর দ্বারা শুধু সন্দেহ আর অবিশ্বাসেরই সৃষ্টি হবে। প্রদেশগুলো যখন বুঝবে যে বাইরে থাকা বা না থাকা তাদের ইচ্ছাধীন তখন তারা এটাকে কেবলমাত্র বস্তুগত দিক থেকেই বিবেচনা করবে।
আমাদের মধ্যে যখন এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে সেই সময় ক্রিপস আমাকে একদিন টেলিফোনে জানিয়ে দেন, পরদিন স্যার সিকান্দার হায়াৎ খান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। ক্রিপসের ধারণা, সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে স্যার সিকান্দার আমাদের সাহায্য করতে পারবেন। পাঞ্জাব যেহেতু মুসলমানপ্রধান প্রদেশ সেইহেতু পাঞ্জাব যদি ভারতের সঙ্গে থাকে তাহলে অন্যান্য মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলোও পাঞ্জাবের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। আমি বলি, স্যার সিকান্দার এ ব্যাপারে আদৌ কোনো সাহায্য করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কিন্তু যেহেতু তিনি এই ব্যাপারে আলোচনার জন্য দিল্লিতে আসছেন, আমি তাঁর সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করবো।
পরদিনই স্যার সিকান্দার দিল্লিতে আসেন এবং ক্রিপসের সঙ্গে দেখা করার পরেই আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ক্রিপস যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেইটিই হবে সর্বোত্তম পন্থা। তিনি আরো বলেন, বিষয়টি যদি পাঞ্জাবের আইনসভার সামনে ভোটের জন্য উপস্থাপিত করা হয় তাহলে আইনসভা অবশ্যই ভারতের সঙ্গে থাকার পক্ষেই অভিমত দেবে। এর উত্তরে আমি বলি, বিষয়টি যদি এখনই আইনসভার সামনে উত্থাপন করা হয় তাহলে হয়তো তাঁর অনুমান সঠিক হবে, কিন্তু যুদ্ধের পরে কি অবস্থা হবে তা তিনি বা আমি কেউই বলতে পারি না। তাছাড়া তখনও যে তাঁর জনপ্রিয়তা আজকের মতোই থাকবে তা নাও হতে পারে।
ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর ব্যাপারেও ক্রিপস প্রস্তাবে রাজন্যবৃন্দকে তাঁদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। প্রদেশগুলোর মতো তাদেরও ভারতের সঙ্গে থাকার বা না থাকার অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। ক্রিপসের প্রতি বিশ্বাস রেখেও আমি বলবো, রাজন্যবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি তাঁদের কাছে একটা সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। কাশ্মীরের মহারাজাকে তিনি বলেছিলেন তাঁর রাজ্যের ভবিষ্যৎ ভারতের সঙ্গেই ন্যস্ত থাকবে। কোনো দেশীয় রাজাই যেন এ কথা মুহূর্তের জন্যও মনে না করেন তিনি যদি আলাদা হয়ে থাকতে চান তাহলে ইংল্যান্ডের রাজা তাঁর সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবেন। অতএব রাজন্যবৃন্দ যেন তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য ইংল্যান্ডের রাজমুকুটের দিকে না তাকিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গেই আলোচনা করেন। আমার মনে আছে, বেশিরভাগ নৃপতিই ক্রিপসের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে বেশ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
ক্রিপস-প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্কিং কমিটি একটি খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এই প্রস্তাবটি ২রা এপ্রিল তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও আলোচনা ফেঁসে না যাওয়া পর্যন্ত এটাকে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়নি। ক্ষমতা হস্তান্তরের সাধারণ খুঁটিনাটি বিষয় ছাড়াও একটা বড় রকমের অসুবিধা দেখা দেয় কমান্ডার-ইন-চিফ এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্যের ক্ষমতার ব্যাখ্যা নিয়ে। ক্রিপস বলেছিলেন, ভারতীয় সদস্য প্রধানত জনসংযোগ, ডিস-মোবিলাইজেশন, যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন এবং সেনাবাহিনীর সভ্যদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধে দেবার বিষয়গুলোই দেখাশোনা করবেন। কংগ্রেস এগুলোকে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বলে অভিহিত করে এক বিকল্প প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়, কমান্ডার-ইন-চিফের বিশেষ এখতিয়ারভুক্ত বিষয়গুলো ছাড়া অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ই থাকবে প্রতিরক্ষা সদস্যের অধীনে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিপস আরো কিছু পাল্টা প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেইসব পাল্টা প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত নয়, কারণ তিনি চেয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সবই থাকবে কমান্ডার-ইন-চিফের এখতিয়ারে।
৯ই এপ্রিল সন্ধ্যার পরে আমি আবার ক্রিপসের সঙ্গে আলোচনায় বসি এবং ১০ই এপ্রিল সকালে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ওয়ার্কিং কমিটিকে জানিয়ে দিই। এই সময় আমরা দুঃখের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে আসি, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাবটি যে অবস্থায় আছে তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪২-এর ১০ই এপ্রিল আমি ক্রিপসকে একটা চিঠি লিখে জানিয়ে দিই, খসড়া ঘোষণাপত্রে (in the Draft Declaration) ভারতীয় সমস্যাকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তা শুধু বেঠিকই নয় উপরন্তু এতে ভবিষ্যতে বিরাট জটিলতার সৃষ্টি হবে। ক্রিপস আমার চিঠির উত্তর দেন ১১ই এপ্রিল। তাঁর সেই উত্তরে তিনি সওয়াল করে বুঝিয়ে দিতে চান যে ভারতীয় সমস্যার সমাধানে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাই তাঁর প্রস্তাবে সন্নিবেশিত হয়েছে, সুতরাং তা থেকে বিচ্যুত হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। চিঠিতে তিনি কংগ্রেসের ওপরে দোষারোপ করেন এবং তাঁর চিঠিখানা প্রকাশ করতে চান। সেইদিনই আমি তাঁর চিঠির উত্তর দিই। সেই চিঠিতে আমি তাঁর বক্তব্যকে অগ্রাহ্য করে এই অভিমত প্রকাশ করি, চিঠিপত্রগুলো প্রকাশিত হলে যে-কোনো নিরপেক্ষ বিচারকের দৃষ্টিতে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে মিশনের অকৃতকার্যতার জন্য তিনিই একমাত্র দায়ী, কংগ্রেস কোনোক্রমেই দায়ী নয়। পাঠকদের অবগতির জন্য আমার সেই চিঠির প্রধান বক্তব্যগুলো উল্লেখ করা হলো। তবে অনুসন্ধিৎসু পাঠকবৃন্দ যাতে পুরোপুরিভাবে সমস্ত বিষয় জানতে পারেন তার জন্য আমার চিঠি, ক্রিপসের উত্তর এবং তার উত্তরে আমার পরবর্তী চিঠি এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে আমি ১০ই এবং ১১ই এপ্রিল যে চিঠি দুটি লিখেছিলাম তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইরকম:
খসড়া ঘোষণাপত্রে বর্তমানের পরিবর্তে ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা সম্বন্ধেই বেশি করে জোর দেওয়া হয়েছে অথচ কংগ্রেসের দাবি হলো বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন। প্রস্তাবিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় কোনো কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলেও জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারে কংগ্রেস এখনো একটা আপসে আসতে চায়। জনগণের মনে উৎসাহ সৃষ্টির জন্য এবং আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে জনসাধারণের মানসিকতাকে সংহত করবার জন্য একটি জাতীয় সরকার গঠনের বিশেষ প্রয়োজন আছে। জনসাধারণকে এটা বুঝতে দিতে হবে যে তাঁরা তাঁদের নিজের দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনভাবে দেশের প্রতিরক্ষায় অংশ গ্রহণ করছেন।
আমার চিঠিতে আরো লিখিত হয়েছিল, যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে কংগ্রেস কোনো রকম বাধাই সৃষ্টি করতে চায়নি। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ চলাকালে কংগ্রেস প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সদস্যের ক্ষমতা খর্ব করতেও সম্মত ছিল; কিন্তু একথা আমরা ভুলতে পারিনি, দেশের প্রতিরক্ষার দাবিই সর্বাগ্রে স্থান পাবে। যুদ্ধের সময় অসামরিক শাসনব্যবস্থা স্বভাবতই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অপেক্ষা গৌণস্থান লাভ করে; সুতরাং প্রতিরক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ভাইসরয় অথবা কমান্ডার-ইন-চিফের ওপরে থাকার অর্থ এই দাঁড়ায় যে সর্বক্ষমতা তাদের হাতেই ন্যস্ত থাকবে, এমন কি কাউন্সিলের সদস্যদের ওপরে যে সীমিত ক্ষমতা দেওয়া হবে তার ওপরেও তাঁরা খবরদারি করবেন।
আর একটি বিষয়ের ওপরেও আমি জোর দিই। তা হলো সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কংগ্রেস সব সময় সজাগ আছে। আমরা স্বীকার করি, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হলে কোনো-না-কোনো স্তরে সাম্প্রদায়িক সমস্যার প্রশ্ন উঠবেই। অতএব এ সমস্যার সমাধান করা অবশ্যই প্রয়োজন। আমি তাঁকে জানিয়ে দিই, ভারতের প্রধান রাজনৈতিক সমস্যার একটা সুসমাধান হয়ে যাবার পর সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব আমরাই গ্রহণ করবো। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান আমরা নিশ্চয়ই করতে পারবো।
এরপর আমি যে বিষয়ের উল্লেখ করি, তা হলো, আমার প্রথম সাক্ষাতের সময় ক্রিপস কর্তৃক আমার সামনে প্রস্তাবের যে চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছিল, পরবর্তীকালে আমরা প্রস্তাব সম্বন্ধে যতই ব্যাখ্যা দাবি করতে থাকি ততই সে চিত্রের উজ্জ্বলতা ফিকে হতে থাকে। এরপর আমি যখন ৯ই এপ্রিল তাঁর সঙ্গে শেষবার সাক্ষাৎ করি তখন চিত্রটি সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে দেখতে পাই, যার ফলে আপসের সম্ভাবনাই প্রায় তিরোহিত হয়ে যায়।
স্যার স্ট্যাফোর্ড এরপর যখন তাঁর চিঠিখানা প্রকাশ করবার কথা বলেন, তখন আমি তাকে লিখিতভাবে জানিয়ে দিই, আমরাও তাহলে এ সম্পর্কে যত চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে, এবং আমরা যে প্রস্তাব পাস করেছি সেগুলো সবই প্রকাশ করলে তিনি নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। এর উত্তরে ক্রিপস আমাকে লেখেন, এতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। ক্রিপসের চিঠি পাবার পর ১১ই এপ্রিল এ সম্পর্কে যাবতীয় বিষয় সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়।
ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবটা এইরকম ছিল:
ওয়ার্কিং কমিটি ইংল্যান্ডের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার ভারত সম্পর্কিত প্রস্তাব এবং সেই সম্পর্কে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের পরবর্তী ব্যাখ্যাগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করেছে। ঘটনাবলীর চাপে পড়ে প্রয়োজনের অনেক পরে প্রস্তাবটি এলেও ভারতের স্বাধীনতা এবং বিশেষ করে যুদ্ধজনিত বর্তমান গুরুতর পরিস্থিতির কথা মনে রেখেই কমিটি এই প্রস্তাবটি বিবেচনা করেছে।
১৯৩৯ সনের সেপ্টেম্বর মাসে যখন যুদ্ধ আরম্ভ হয় তখন থেকেই কংগ্রেস বারবার বলে আসছে যে ভারতের জনসাধারণ কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে গণতান্ত্রিক শক্তিজোটের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সম্মত আছে। যেসব শর্তের কথা বলা হলো সেগুলোর মধ্যে প্রধানতম শর্তটি হলো—ভারতের স্বাধীনতা। কারণ, ভারতের কোটি কোটি মানুষ যখন জানতে পারবে তাঁরা স্বাধীনভাবে তাদের দেশরক্ষার কাজে অংশ গ্রহণ করছে তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের হৃদয় উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পূর্ণ হবে এবং তারা কায়মনোবাক্যে দেশরক্ষার ব্যাপারে সর্ববিধ উপায়ে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির যে সর্বশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, সেই অধিবেশনে বলা হয়েছিল, একমাত্র স্বাধীন ভারতই জাতীয় ভিত্তিতে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
ইংল্যান্ডের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার নতুন প্রস্তাবে যুদ্ধের পরে কি হবে প্রধানত সেই কথাই বলা হয়েছে। উক্ত প্রস্তাবে যুদ্ধ শেষ হবার পর ভারতের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিগতভাবে স্বীকৃত হলেও কমিটি গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, প্রস্তাবে এমন সব শর্ত আরোপ করা হয়েছে যার ফলে সম্মিলিত এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথে নানারকম বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এমন কি কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠনের ব্যাপারেও এমন সব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে এবং উক্ত সংস্থায় জনগণের প্রতিনিধিদের যেভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে তার ফলে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে।
ভারতের জনসাধারণ সামগ্রিকভাবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেছে এবং কংগ্রেসও বারবার ঘোষণা করেছে যে সমগ্র ভারতের স্বাধীনতা ছাড়া অপর কিছু গ্রহণযোগ্য নয়। কমিটি লক্ষ্য করেছে, ইংরেজ সরকারের প্রস্তাবে ভবিষ্যতে স্বাধীনতা দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হলেও ওতে এমন সব বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে যার ফলে স্বাধীনতা একটি আকাশকুসুমে পরিণত হয়েছে।
ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোর ন কোটি অধিবাসীর গণতান্ত্রিক অধিকারকে যেভাবে নস্যাৎ করা হয়েছে এবং যেভাবে শাসকশ্রেণী কর্তৃক তাদের পণ্যদ্রব্যের মতো ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে তাতে গণতন্ত্র এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। সংবিধান রচনাকারী সংস্থায় দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হলেও প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের কোনো রকম অধিকারই দেওয়া হয়নি। এমন কি তাদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা করার কথাও বলা হয়নি। এইসব রাজ্য স্বাধীন ভারতের অগ্রগতিতেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যেসব জায়গায় এখনো বৈদেশিক প্রভুত্ব বজায় রয়েছে এবং যেসব জায়গায় বৈদেশিক সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন রাখার সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে সে-সব ভূখণ্ডের অধিবাসীদের কোনো রকম স্বাধীন সত্তা তো থাকবেই না, উপরন্তু ভারতের বাকি অংশের ওপরেও তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
প্রদেশগুলোকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকবার অধিকার দেওয়াটাও আর একটি প্রতিক্রিয়াশীল প্রস্তাব। এর দ্বারা ভারতের ঐক্য এবং সংহতির ওপরে এক বিরাট আঘাত হানা হয়েছে। এই প্রস্তাব দ্বারা প্রদেশগুলোকে ভারত রাষ্ট্রের অধীনস্থ না হবার কথাই প্রকারান্তরে বলা হয়েছে।
কংগ্রেস সব সময় অখণ্ড এবং ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বাধীনতার কথাই বলে থাকে। বর্তমান বিশ্বে যখন বৃহত্তর সংহতির কথা চিন্তা করা হচ্ছে সেই সময় ভারতের ঐক্য এবং সংহতি বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো প্রস্তাব গ্রহণের কথা কংগ্রেস চিন্তাও করতে পারে না। কমিটি তাই মনে করে, ভারতে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে সারা ভারতের জনসাধারণ এক জাতি এক প্রাণ হয়ে অখণ্ড জাতি গঠনে আগ্রহান্বিত হবে।
কমিটি যে মনোভাব নিয়ে ক্রিপস-প্রস্তাবের মৌল অংশ মেনে নিতে স্বীকৃত হয় তা হলো, কেন্দ্রীয় সরকার তথা যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটানো হবে না। পরিবর্তন ঘটালে তার অর্থ এই হবে, রাষ্ট্রের ভেতরে অন্যান্য দলের উদ্ভব হয়ে নতুন জটিলতার সৃষ্টি হবে। ওয়ার্কিং কমিটি যে ধরনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অনুমোদন করে তাতে প্রতিটি আঞ্চলিক ইউনিট যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে থেকেই যথাসম্ভব স্বায়ত্তশাসন অধিকার ভোগ করবে এবং সবগুলো ইউনিটের ওপরে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃত্ব করবে। কিন্তু ইংরেজ সরকার যে প্রস্তাব পাঠিয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিভেদের মনোভাব দেখা দেবে, যার ফলে ঐক্যের পরিবর্তে সৃষ্টি হবে অবিশ্বাস এবং শত্রুতার মনোভাব। কমিটি মনে করে, সাম্প্রদায়িক দাবি মেটাবার জন্যই এইরকম ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সমস্যা আরো গভীর হবে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে নানারকম প্রতিক্রিয়াশীল উপদলের সৃষ্টি হয়ে জটিলতা বৃদ্ধি করবে এবং নতুন বিপদের পথ উন্মুক্ত করবে এবং জনগণের দৃষ্টিকে মূল বিষয় হতে সরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যাবে।
ভারতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যে-কোনো প্রস্তাব অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যেরকম গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাতে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানের কথাও বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে, অর্থাৎ বর্তমান ব্যবস্থার ওপরেও বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। ভবিষ্যৎ ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান ব্যবস্থা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত; সুতরাং কমিটি সঙ্গতভাবেই বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। জনগণের মনোভাব এবং ইচ্ছার প্রতি লক্ষ্য রেখেই এ ব্যাপারে কমিটি তার মতামত ব্যক্ত করেছে।
ইংল্যান্ডের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা বর্তমান ব্যবস্থা সম্বন্ধে যে প্রস্তাব করেছেন তা অসম্পূর্ণ এবং অর্থহীন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে বর্তমান শাসন-ব্যবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন করা হবে না। ওতে আরো বলা হয়েছে, ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইংরেজদের অধীনেই থাকবে। দেশ শাসনের ব্যাপারে দেশের প্রতিরক্ষা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকে। যুদ্ধের সময় এর গুরুত্ব এতোই বৃদ্ধি পায় যে সমগ্র শাসন-ব্যবস্থাই প্রতিরক্ষার অধীনস্থ হয়ে পড়ে। সুতরাং প্রতিরক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ইংরেজদের হাতে রাখায় ভারতীয়দের হাতে দায়িত্ব অর্পণ একটা প্রহসনে পরিণত হবে। এর অর্থ এই দাঁড়াবে, ভারতীয় প্রতিনিধিদের কোনো রকম স্বাধীনতাই থাকবে না, অর্থাৎ যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন তাদের ভাইসরয়ের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হবে। এই বিষয়টি বিবেচনা করে কমিটি আর একবার এই অভিমত ব্যক্ত করছে, ভারতের জনগণকে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে দিতে হবে তারা সবরকম অধীনতা পাশ থেকে মুক্ত তাদের নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে। কমিটির মতে জনগণের মনে এইরকম বিশ্বাস উৎপন্ন করে তাদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করাই বর্তমানে সবচেয়ে দরকারি জিনিস। কিন্তু প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত এটা হতে পারে না। কমিটি মনে করে, এখনো উপরোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে জনগণকে উদ্দীপিত করা যায়। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার প্রাদেশিক এজেন্সিগুলো বাস্তববুদ্ধিহীন এবং ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। একমাত্র ভারতের জনগণই তাদের বিশ্বাসভাজন প্রতিনিধিদের মারফত এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে; কিন্তু এর জন্য তাদের ওপর পূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে।
ইংরেজ সরকার এটা মেনে নিতে অস্বীকৃত হওয়ায় ওয়ার্কিং কমিটি অনন্যোপায় হয়ে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে।
১৯৪২ সনের ১১ই এপ্রিল আমি এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করি। বহুসংখ্যক সাংবাদিক উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। আমি তাদের কাছে ক্রিপস-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণগুলো ব্যাখ্যা করি। তাঁদের কাছে আমি যে কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছিলাম সেগুলো সবই ওয়ার্কিং কমিটির উপরোক্ত প্রস্তাবে এবং ক্রিপস ও আমার মধ্যে যেসব চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে তাতে উল্লিখিত হয়েছে বলে এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করা হলো না। এখানে শুধু সাংবাদিকদের কাছে আমি বিশেষভাবে যে কথাগুলো বলেছিলাম সেই সম্বন্ধেই বলা হচ্ছে। প্রথম দিকে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস তার প্রস্তাবের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমাদের সামনে যেরকম উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরেছিলেন, পরবর্তী আলোচনার সময় তা ক্রমশ ফিকে হতে থাকে। লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকারের পরে দেখতে পাওয়া যায়, ক্রিপস প্রস্তাবের উজ্জ্বলতা একেবারেই নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। আলোচনার সময় স্যার স্ট্যাফোর্ড বারবার এই কথা ব্যক্ত করেছিলেন, ভারতীয় সদস্যদের হাতে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেবার ব্যাপারে নানারকম অসুবিধে আছে। তিনি আরো বলেন, আমরা যদি লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করি তাহলে তিনি (অর্থাৎ লর্ড ওয়াভেল) এইসব অসুবিধের কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পারবেন। তাঁর কথামতো আমরা লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করি। লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে আলোচনার সময় সামরিক বিভাগের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বিস্ময়ের কথা এই, লর্ড ওয়াভেল কোনো রকম অসুবিধের কথাই আমাদের বলেন না। আলোচনাটা পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকে। উক্ত আলোচনার সময় আমার একবারও মনে হয়নি আমরা একজন সামরিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলছি। লর্ড ওয়াভেল আমাদের সঙ্গে একজন ঝানু রাজনীতিকের মতো কথা বলছিলেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে আমি আরো একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই। কোনো কোনো সংবাদপত্রে মহাত্মা গান্ধীর মতামত সম্বন্ধে নানারকম উল্টো-পাল্টা কথা প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দেবার জন্য আমি তাঁদের বলি, গান্ধীজি যুদ্ধের বিরোধী হলেও ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়নি অথবা ওয়ার্কিং কমিটিকে তিনি কোনোভাবে প্রভাবিত করতেও চাননি। গান্ধীজি ওয়ার্কিং কমিটিকে যা বলেছিলেন তা হলো, ব্রিটিশ প্রস্তাবের গুণাগুণ বিবেচনা করে আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। প্রথম দিকে তিনি ওয়ার্কিং কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতেই চাননি; কিন্তু আমার বিশেষ অনুরোধেই কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে সম্মত হন। কিন্তু পরে তিনি মনে করেন ওখানে থাকার তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বিশেষ চেষ্টা করেও তাঁকে রাখতে পারিনি। সাংবাদিকদের আমি আরো বলি, ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত সর্বাংশে সর্বসম্মত ছিল।
অবশেষে আমি তাঁদের বলি, আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা সত্ত্বেও আমরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। তবে একটি বিষয় অনস্বীকার্য, আলোচনা সব সময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশেই হয়েছে। যদিও কোনো কোনো সময় ক্রিপস এবং আমাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছে এবং আলোচনা রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তবুও স্যার স্ট্যাফোর্ড এবং আমরা কোনো রকম উত্তেজিত হইনি এবং ধীরস্থিরভাবেই সমস্ত বিষয় আলোচনা করেছি।
এইভাবেই কংগ্রেস ক্রিপস-প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু এ বিষয়ে জওহরলাল এবং রাজা গোপালাচারী কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করেন। অতএব পরবর্তী অধ্যায়ে আসবার আগে তাদের মতামত এবং প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার বোধ করছি।
স্যার স্ট্যাফোর্ড ভারত থেকে চলে যাবার অব্যবহিত পরে জওহরলাল ‘নিউজ ক্রনিক্যাল’ পত্রিকার প্রতিনিধিকে তাঁর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার মঞ্জুর করেন। এই সাক্ষাৎকারের সময় জওহরলাল যে মতামত ব্যক্ত করেন তাতে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে কংগ্রেসের মতানৈক্যকে অনেকটা হালকা করে দেখানো হয়। তিনি বলেন, কংগ্রেস ক্রিপস-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও যুদ্ধের ব্যাপারে ভারত ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে।
আমি আরো জানতে পারি, জওহরলাল অল ইণ্ডিয়া রেডিও মারফত একটি বিবৃতি দেবেন বলে স্থির করেছেন। এই খবরটা জানবার পর আমার আশঙ্কা হয়, জওহরলালের বেতার ভাষণের ফলে জনসাধারণের মনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। জওহরলাল তখন এলাহাবাদে চলে গেছেন। আমিও কলকাতায় ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আমি তাই স্থির করি, কলকাতা যাবার পথে আমি জওহরলালের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করব। মনে মনে এইরকম স্থির করে আমি এলাহাবাদে গিয়ে জওহরলালের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে বলি, ওয়ার্কিং কমিটি যখন একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাস করেছে সে অবস্থায় কোনো কিছু বলা সম্বন্ধে তাঁকে বিশেষভাবে সাবধান হতে হবে। তিনি যদি এমন কিছু বলেন যাতে জনসাধারণের মনে হয় যুদ্ধের ব্যাপারে কংগ্রেস কোনো-রকম বিরোধিতা করবে না, তাহলে কংগ্রেসের প্রস্তাবটিই হাস্যকর হয়ে পড়বে। কংগ্রেস যে প্রস্তাব পাস করেছে, তা হলো, একমাত্র স্বাধীন দেশ হিসেবেই যুদ্ধের ব্যাপারে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে। আমি ভালোভাবেই জানতাম, জওহরলালও এই অভিমতই পোষণ করেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও জানতাম, আন্তর্জাতিক অবস্থার কথাও তাঁর মনে সব সময় জাগরূক থাকে। আমি আরো জানতাম বর্তমান যুদ্ধে তাঁর সহানুভূতি সব সময় গণতান্ত্রিক শিবিরের পক্ষেই রয়েছে। সুতরাং এই মনোভাবের ফলে তিনি যদি এমন কিছু বলে ফেলেন যে যুদ্ধের ব্যাপারে কংগ্রেস মিত্রপক্ষকে তথা ইংরেজ সরকারকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে, তাহলে কংগ্রেসের প্রস্তাবটাই অকেজো বলে প্রতিপন্ন হবে। আমি তাই জওহরলালকে বিশেষভাবে অনুরোধ করি, তিনি যেন কোনো বিবৃতি না দেন।
আমার কথা শুনে প্রথমে তিনি আমার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু পরবর্তী আলোচনায় তিনি আমার অভিমতই মেনে নেন। তিনি আমাকে কথা দেন, তিনি কোনো বিবৃতি দেবেন না এবং প্রস্তাবিত বেতার-ভাষণও বাতিল করে দেবেন।
আমি এখানে সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, জওহরলালের মনে যে ভিন্ন অভিমত দেখা দিয়েছিলো সেটা হয়েছিলো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে। তাঁর ফ্যাসিবিরোধী মনোভাবও এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া তাঁর সাম্প্রতিক চীন ভ্রমণ এবং মার্শাল চিয়াং কাই-শেকের সঙ্গে আলোচনাও তাঁর মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল। জাপানের বিরুদ্ধে চীনের সংগ্রামের কথা বিবেচনা করেও তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, গণতন্ত্রকে যে-কোনো উপায়ে রক্ষা করতেই হবে। এইরকম আন্তর্জাতিক মনোভাবই তাঁর মতামতের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে আমি আরো একটি কথা বলতে চাই, আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে জওহরলাল যতোটা চিন্তা করতেন, জাতীয় ব্যাপারে ততোটা চিন্তা করতেন না। আন্তর্জাতিক ব্যাপারে আমিও তাঁর সঙ্গে একমত ছিলাম কিন্তু আমার কাছে ভারতের স্বাধীনতাই ছিলো মুখ্য বিষয়। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শিবিরের বিরোধিতা সম্বন্ধে আমিও কোনোরকম বিরূপ মনোভাব পোষণ করতাম না, কিন্তু আমার মতে যতদিন ভারতের পক্ষে সেই গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রযুক্ত না হচ্ছে ততোদিন গণতন্ত্র সম্বন্ধে ইংরেজরা যাই কিছু বলুক না কেন তা ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। এই ব্যাপারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কথাটাও আমার মনে পড়ছে। সেবারও ইংরেজ সরকার ঘোষণা করেছিলো, ক্ষুদ্রতর জাতিসমূহের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্যই তারা জার্মান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট উইলসনও তাঁর চোদ্দ দফা সনদে পৃথিবীর সমস্ত জাতির স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের পরে ভারতের স্বাধীনতার কথা মোটেই বিবেচনা করা হয়নি; এমন কি প্রেসিডেন্ট উইলসনের সেই চোদ্দ দফার সনদও ভারতের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়েছিলো। আমি তাই মনে করি, এবারেও যদি ভারতের বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচিত না হয় তাহলে গণতান্ত্রিক শিবিরের সব কথাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। কলকাতা অভিমুখে রওনা হবার আগে ‘নিউজ ক্রনিক্যাল’-এর প্রতিনিধির কাছেও আমি এই অভিমতই ব্যক্ত করেছিলাম।
এই সময় জওহরলাল একটি গুরুতর মানসিক অশান্তির ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। আগেই বলেছি, তিনি সম্প্রতি চীনদেশ ভ্রমণ করে এসেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি জেনারেলিসিমো এবং মাদাম চিয়াং কাই-শেকের সঙ্গে যে সব আলোচনা করেছিলেন তাতে তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, চীন-জাপান যুদ্ধে চীনকে সাহায্য করা ভারতের কর্তব্য। ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন যখন চলছিলো সেই সময় একদিন সন্ধ্যার পরে জওহরলাল আমার সঙ্গে দেখা করেন। তখন তাঁর সঙ্গে আমার যে আলোচনা হয় তাতে আমি বুঝতে পারি, ইংরেজ সরকার আমাদের দাবি মেনে না নিলেও তিনি ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হয়ে বুঝিয়ে দিতে চান, ক্রিপস যেভাবে তাঁর প্রস্তাব ব্যাখ্যা করেছেন তাতে আমাদের কোনোরকম সন্দেহ প্রকাশ করা উচিত হবে না। যদিও ঠিক এই কথাই তিনি বলেননি; তবুও তাঁর কথাবার্তা শুনে এইরকমই আমার মনে হয়েছিলো।
জওহরলালের সঙ্গে আলোচনার সময় আমি এতোই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে রাত দুটো পর্যন্ত আমি সেদিন ঘুমোতে পারিনি। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আমি শ্রীমতী রামেশ্বরী নেহরুর বাসভবনে উপস্থিত হই। জওহরলাল তখন সেই বাড়িতেই ছিলেন। আমি জওহরলালের সঙ্গে এক ঘণ্টারও বেশী সময় বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করি। আমি তাঁকে এ কথাও বলি, তাঁর চিন্তাধারা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাড়িয়েছে। ভারতবাসীর হাতে আসল ক্ষমতা না দিয়ে একটি লোক-দেখানো এক্জিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের কোনো অর্থই হয় না। আমরা যদি এই ক্ষমতাহীন এক্জিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের কথা মেনে নিই তাহলে আমরা শুধু ভবিষ্যতের জন্য একটি সদিচ্ছার কথা ছাড়া ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে আর কিছু পাবো না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের সদিচ্ছার কোনো অর্থই হয় না। যুদ্ধের পরে অবস্থা কী দাঁড়াবে এবং প্রকৃতপক্ষে তখন কী হবে সে-কথা কেউ বলতে পারে না। আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীন জাতি হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে, কিন্তু সে ব্যাপারে ক্রিপস-প্রস্তাবে আমরা কিছুই পাইনি। যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তও আমাদের দ্বারা গৃহীত হয়নি; এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভাইসরয়। ক্রিপস আমাদের ভাইসরয়ের সেই সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে বলছেন এবং এ বিষয়ে আমাদের কোনোরকম বিচার-বিবেচনা করবার সুযোগ দিতেও তিনি সম্মত হননি। আমি তাঁকে আরো বলি, আমরা যদি ক্রিপসের এই প্রস্তাব মেনে নিই তাহলে আজ পর্যন্ত যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি সেগুলো সবই ভ্রান্ত বলে গণ্য হবে। যুদ্ধের পরে পৃথিবীতে বিরাট পরিবর্তন আসতে বাধ্য; সুতরাং বিশ্ব-রাজনীতির খবরাখবর যারা রাখেন তাঁরা এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই পোষণ করেন না, যুদ্ধের পরে ভারত অবশ্যই স্বাধীন হবে। কিন্তু আমরা যদি ক্রিপস-প্রস্তাব মেনে নিই তাহলে যুদ্ধের পরে এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে থেকে যাবে। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যদি তাদের কথা না রাখেন তাহলে নতুন করে কোনোরকম আলোচনা শুরু করবার পথও আমাদের সামনে থাকবে না। বর্তমান যুদ্ধ ভারতের স্বাধীনতা লাভের পথে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। সুতরাং ইংরেজের কথার ওপরে নির্ভর করে এ সুযোগ আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না।
আমার মুখ থেকে এইসব কথা শুনে জওহরলাল বিশেষভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েন। আমি বেশ বুঝতে পারি, তিনি তার নিজের অবস্থা সম্বন্ধেও সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। তার মনের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁর মানসিক অবস্থাকে রীতিমতো বিচলিত করে ফেলে। কিছুক্ষণ তিনি কোনো কথাই বলতে পারেন না। অবশেষে তিনি বলেন: ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি আমার ব্যক্তিগত মতামতের ওপরে কোনোরকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো না। আমার সিদ্ধান্ত যাতে আমার সহকর্মীদের সিদ্ধান্তের অনুরূপ হয় আমি তা অবশ্যই দেখবো।’
জওহরলাল যেসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন, অথবা যেসব বিষয় তাঁর মনের ওপরে গভীরভাবে রেখাপাত করতো, সেগুলো সম্বন্ধে ঘুমের মধ্যে তিনি কথা বলতেন। আমার সঙ্গে উপরোক্ত আলোচনাও তাঁর মনে এমনভাবে রেখাপাত করেছিলো যে সে রাত্রে তিনি অনেকবার ঘুমের ঘোরে ওই বিষয় সম্বন্ধে কথা বলেছিলেন। এটা আমি জানতে পারি শ্রীমতী রামেশ্বরী নেহরুর কাছে। আমি যখন পরদিন তাঁর বাড়িতে যাই, সেই সময় তিনি আমাকে বলেন, গতরাত্রে শ্রীনেহরু ঘুমের ঘোরে কার সঙ্গে যেন তর্ক করেছেন। তিনি আরো বলেন, জওহরলাল কখনো কখনো মৃদুস্বরে এবং কখনো বা বেশ জোরে জোরে কথা বলেছেন। এই সময় তিনি কয়েকবার ক্রিপসের নাম উল্লেখ করেছেন। গান্ধীজীর নাম এবং আমার নামও উচ্চারিত হয়েছে কয়েকবার।
শ্রীমতী নেহরুর কাছ থেকে এই কথা শুনে আমি বুঝতে পারি, গতকাল আমার সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়েছিলো সেই আলোচনার বিষয়বস্তু তাঁর মনকে বিশেষভাবে বিচলিত করে ফেলেছিলো।
ক্রিপস-প্রস্তাব এবং সেই সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা শ্রীরাজাগোপালাচারীর মনেও গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো। সাম্প্রদায়িক অবস্থার অবনতি দেখে কিছুদিন যাবৎ তিনি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মতে সাম্প্রদায়িক সমস্যার ব্যাপারে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে মতভেদের ফলেই ভারতের স্বাধীনতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। আমি যেভাবে ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ করেছিলাম তাতে আমার মনে হয়েছিলো, যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার কোনো রকম ঝুঁকি নিতে সম্মত ছিলেন না। সুতরাং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে সাম্প্রদায়িক সমস্যা মোটেই অন্তরায় ছিলো না। ইংরেজরা এটাকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিলো এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতরের মতানৈক্যকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করেছিলো। আমার এই বিশ্লেষণ রাজাগোপালাচারী মেনে নিতে পারেননি। তিনি তাই ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার পরে প্রকাশ্যেই বলতে থাকেন, যদি মুসলিম লীগের দাবি মেনে নিতো কংগ্রেস তাহলে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে যে বাধা উপস্থিত হয়েছে তা থাকতো না। রাজাগোপালাচারী এইরকম মতামত ব্যক্ত করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি মাদ্রাজ বিধানসভার কংগ্রেস সদস্যদের দ্বারা এই ব্যাপারে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি এইরকম:
মাদ্রাজ বিধানসভার কংগ্রেস পার্টি গভীর দুঃখের সঙ্গে এই মত প্রকাশ করছে, ভারতের বর্তমান গুরুতর পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেছে এবং এর ফলে জাতীয়তাবাদী ভারত এক বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ভারত যখন শত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হবার মুখে এসে পড়েছে সেই সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা কোনোক্রমেই উচিত নয়। আবার সরকারী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংস্রবহীন থেকে ভারতের পক্ষে নিজস্ব কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। বর্তমান বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য কংগ্রেসের উচিত ছিলো জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে যাবতীয় বাধা-বিপত্তিকে যে-কোনো উপায়ে অপসারিত করে বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলা করা। এই ব্যাপারে মুসলিম লীগের দাবি যথাসম্ভব স্বীকার করে নেওয়া উচিত বলে এই পার্টি মনে করে। মুসলিম লীগের দাবি হলো, ভারতের কোনো কোনো অংশ সেইসব অংশের অধিবাসীদের ইচ্ছা অনুসারে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করা। এই পার্টি তাই নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কাছে অনুরোধ জ্ঞাপন করছে, তারা যেন বর্তমান গুরুতর পরিস্থিতির সময় জাতীয়তাবাদের বিতর্কমূলক প্রশ্নকে পরিহার করে অপেক্ষাকৃত কম বিপজ্জনক পন্থা গ্রহণ করুন এবং মুসলিম লীগের ভারত বিভাগের দাবিকে মেনে নেন। ভারতের সামনে যখন তার নিজস্ব সংবিধান রচনা করবার সুযোগ উপস্থিত হয়েছে তখন সেটাকে নষ্ট না করে কংগ্রেসের উচিত এ ব্যাপারে মুসলিম লীগকে সম্মত করার জন্য তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানে আসা। এই পার্টি মনে করে, এই পথেই জরুরী অবস্থার মোকাবিলা করা যাবে।
এই প্রস্তাব উত্থাপন এবং গ্রহণ করবার আগে রাজাগোপালাচারী আমার সঙ্গে আদৌ কোনো আলোচনা করেননি। আমার বিশ্বাস, ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্যের সঙ্গেও তিনি এ ব্যাপারে কোনোরকম আলোচনা করেননি। মাদ্রাজ বিধানসভার এই প্রস্তাবটি যখন আমি সংবাদপত্রে দেখতে পাই তখন আমি রীতিমতো মর্মাহত হয়ে পড়ি। আমি মনে করি, ওয়ার্কিং কমিটির কোনো সদস্য যদি এইভাবে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন তাহলে কংগ্রেসের শৃঙ্খলার ওপরে এক বিরাট আঘাত হানা হবে। শুধু তাই নয়, এর ফলে জনসাধারণের মনেও ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হবে এবং এর দ্বারা শুধু সাম্রাজ্যবাদীদের হাতই জোরদার করা হবে। আমি তাই মনে করি, এই ঘটনাটি অবিলম্বে ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক বিবেচিত হওয়া দরকার।
আমি তাই রাজাগোপালাচারীকে বলি, মাদ্রাজ বিধানসভার কংগ্রেস পার্টি কর্তৃক গৃহীত এই প্রস্তাব কংগ্রেসের ঘোষিত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ওয়ার্কিং কমিটির একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে শ্রীরাজাগোপালাচারীর উচিত ছিলো এই প্রস্তাবের সঙ্গে কোনোরকম সংস্রব না রাখা। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি তিনি মনে করতেন এই প্রস্তাব উত্থাপন এবং পাস না করলে তাঁর পক্ষে কর্তব্য পথ পরিহার করার সামিল হবে তাহলে তিনি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যপদে ইস্তফা দিয়ে নিজের ইচ্ছায় কাজ করতে পারতেন।
রাজাগোপালাচারী স্বীকার করেন, প্রস্তাবটি বিধানসভায় উত্থাপনের আগে ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা উচিত ছিলো। কিন্তু প্রস্তাব যখন পাস হয়ে গেছে এবং তাতে তাঁর মতামত প্রতিফলিত হয়েছে সে অবস্থায় এখন আর ওই প্রস্তাব প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। তিনি এ সম্পর্কে আমার কাছে একটি চিঠি লিখে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এই রকম একটি বিতর্কমূলক বিষয় কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে পূর্বাহ্ণে আলোচনা না করে প্রকাশ্যভাবে প্রচার করা উচিত হয়নি। পাঠকদের অবগতির জন্য শ্রীরাজাগোপালাচারীর পত্রটি আমি নিচে উদ্ধৃত করছি:
১৯, এডমস্টন রোড,
এলাহাবাদ
এপ্রিল ৩০, ১৯৪২
প্রিয় মৌলানা সাহেব,
আমার দ্বারা উত্থাপিত এবং মাদ্রাজ বিধানসভার কংগ্রেস পরিষদীয় দল কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব সম্পর্কে আপনার অভিমত স্বীকার করিয়া বলিতেছি যে উক্ত প্রস্তাবটি উত্থাপনের পূর্বে আপনার সঙ্গে এবং ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করা আমার উচিত ছিলো। বিশেষ করিয়া আমি যখন তাঁহাদের দ্বারা গৃহীত প্রস্তাবের বিষয় পরিজ্ঞাত ছিলাম। আমি এই পত্রে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করিতেছি।
আমি আমার দৃঢ় বিশ্বাসের কথাও আপনার নিকট ব্যক্ত করিয়াছি। আমি মনে করি, আমি যদি আমার সুচিন্তিত মতামতকে জনগণের বিচারের জন্য তাঁহাদের সম্মুখে তুলিয়া না ধরিতাম তাহা হইলে আমি আমার কর্তব্য হইতে বিচ্যুত হইতাম। আমি মনে করি, জনসাধারণের স্বার্থের খাতিরে মিঃ সাপ্তানমের দ্বারা প্রস্তাব উত্থাপন এবং তাহা যথাযথভাবে পাস করিয়া আমি আমার কর্তব্যই পালন করিয়াছি। আমি তাই আপনাকে অনুরোধ করিতেছি, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যপদে ইস্তফা দিতে আপনি আমাকে অনুমতি দিবেন।
আমি যে সুদীর্ঘ বৎসরসমূহ ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকিয়া দেশের সেবা করিয়াছি সেই সময় আপনি এবং আমার সহকর্মীগণ আমার প্রতি যেরূপ বিশ্বাস এবং প্রীতি পোষণ করিয়াছেন তজ্জন্য আমি কৃতজ্ঞতার সহিত আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি।
আপনার চিরবিশ্বস্ত
সি. রাজাগোপালাচারী
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন