১১। সিমলা সম্মেলন

১১. সিমলা সম্মেলন

যুদ্ধের শুরু থেকেই আমেরিকার জনগণ বলে আসছে যে ভারতবর্ষের রাজ- নৈতিক সমস্যার সমাধান করা না হলে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় তার কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। তারা তাই ভারতকে স্বাধীনতা দেবার জন্য ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে চাপ দিয়ে আসছে। জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করবার পর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তখন ভারতের বিষয়টি বারবার চার্চিলের কাছে উত্থাপন করেছেন। অবশেষে ইংরেজরাও হয়তো মনে করেছেন যে আমেরিকার দাবী পুরণের জন্য কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে। ক্রিপস মিশন যখন ভারতে আসে তখন বি. বি. সি.র বৈদেশিক সার্ভিস বার বার ঘোষণা করেছে, ভারত এবার স্বাধীনতা লাভের সুযোগ পাচ্ছে এবং এখন সে যুদ্ধ সম্পর্কে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের একজন ব্যক্তিগত প্রতিনিধিও সে সময় ভারতে আসেন। আমার কাছে প্রেসিডেন্ট একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন তাঁর হাত দিয়ে। চিঠিতে প্রেসিডেন্ট এই আশা প্রকাশ করে- ছিলেন, ভারতবর্ষ ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক শক্তিসমুহের পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করবে। কিন্তু ক্রিপস মিশন অকৃতকার্য হওয়ায় পরিস্থিতি আগের মতোই থেকে যায়।

১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে আমাদের গ্রেপ্তারের ঘটনাটা চীন এবং আমেরিকায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তখন আমরা এটা জানতে না পারলেও পরবর্তীকালে জানতে পারি, ওই দুই দেশের জনগণ ইংরেজদের সেই কাজের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের সেনেটে এবং প্রতিনিধি সভায় বিষয়টি আলোচিত হয়। বিভিন্ন বক্তা এর বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় মতামত প্রকাশ করে বক্তৃতা দেন।

ইয়োরোপে যুদ্ধের অবস্থা উন্নতির দিকে যাওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আমেরিকানরা নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। হয়তো এই কারণেই লর্ড ওয়াভেল ভারত সম্বন্ধে পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে সে বিষয়ে ভারত সচিবের সঙ্গে পরামর্শ কররার জন্য ১৯৪৫-এর যে মাসে লণ্ডনে গিয়েছিলেন। পরামর্শে স্থির হয়, এ ব্যাপারে একটি গোলটেবিল বৈঠকের ব্যবস্থা করতে হবে। ইয়োরোপের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে এপ্রিল মাসেই শেষ সিমলা সম্মেলন ১৫৯ হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু এশিয়ার যুদ্ধ তখনো পুরোমাত্রায়ই চলছে, এবং সে যুদ্ধের আশু সমাপ্তিরও কোনোরকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জাপান তখনো বিশাল ভূখণ্ড অধিকার করে বসে আছে এবং তার মূল ভূখণ্ডে কোনোরকম আঘাতই লাগেনি। আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র এতোদিন ইয়োরোপের যুদ্ধেই বেশী করে নিয়োজিত থাকার ফলে জাপানের পরাজয়ের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে জার্মানীর পরাজয় অপেক্ষা জাপানের পরাজয়ই বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এই কারণেই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মার্শাল স্তালিনকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, ইয়োরোপের যুদ্ধ শেষ হলেই রাশিয়া জাপান আক্রমণ করবে। আমেরিকানরা আরো মনে করতেন, ভারতের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পাওয়া গেলে জাপানের পরাজয় সহজতর হবে। জাপানীরা ব্রহ্মদেশ, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া অধিকার করে বসে আছে। এর প্রতিটি অঞ্চলেই ভারত বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে। ইয়োরোপে হিটলারী দণ্ড বিচূর্ণিত হলেও জাপানকে পরাজিত করবার জন্য ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রধানত এই কারণেই, অর্থাৎ ভারতের সমর্থন পাবার জন্যই, আমেরিকানরা ইংরেজের ওপরে চাপ দিচ্ছিলো।

কলকাতা শহর তখন পূর্বাঞ্চলে আমেরিকার সর্ববৃহৎ যুদ্ধ-ঘাঁটি হয়ে উঠে- ছিলো। এই কারণে কলকাতা তখন বহু আমেরিকান সাংবাদিক এবং উচ্চ- পদস্থ সামরিক অফিসারে ভরতি ছিলো। আমার মুক্তির সংবাদ পেয়ে তাঁরা আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়েছিলেন। আমি কলকাতায় আসবার পরের দিনই কয়েকজন আমেরিকান সাংবাদিক আমার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি মূল বিষয়টা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাঁরা ভাইসরয়ের ‘অফার’ সম্বন্ধে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেই সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন করেন। আমি তখন তাদের বলি, উক্ত ‘অফারে’ কী বস্তু আছে তা না জানা পর্যন্ত আমি কোনো সঠিক উত্তর দিতে পারি না। আমি আরো বলি, ভারতবর্ষ যতোদিন ইংরেজের অধীনে থাকবে ততোদিন যুদ্ধের ব্যাপারে তার অনুপ্রাণিত হবার মতো কারণ থাকতে পারে না!

তাঁরা তখন আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন। তাঁদের প্রশ্নটা হলো আটলান্টিক সনদে কি ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি?

এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলি, ওই সনদ আমি দেখিনি এবং ওটা কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে তাও আমি জানি না।

আমি আরো বলি, আটলান্টিক সনদ বলতে তাঁরা হয়তো মিঃ চার্চিলের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আলোচনা এবং তার প্রদত্ত এক বিবৃতির কথা উল্লেখ করছেন। প্রেসিডেন্ট তাঁর সেই বিবৃতিতে বলেছিলেন, যুদ্ধের পরে প্রতিটি জাতিই তার নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই নির্ধারণ করবার সুযোগ পাবে কিন্তু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যখন মিঃ চার্চিলকে প্রশ্ন করা হয় প্রেসিডেন্টের ওই বিবৃতি ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হবে কিনা, তার উত্তরে তিনি সুস্পষ্ট- ভাবে বলেন, ‘না।” বার বার তিনবার তিনি ঘোষণা করেন, তথাকথিত ওই সনদ ভারতের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে না। মিঃ চার্চিলের এই বক্তব্য সম্বন্ধে যখন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় তখন তিনি স্বীকার করেন, মিঃ চার্চিলের সঙ্গে তাঁর শুধু মৌখিকভাবে আলোচনা হয়েছিলো এবং সে আলোচনার কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। অতএব ওটাকে সনদ বলা ঠিক হবে না।

আমেরিকান সাংবাদিকরাও এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন না। তাই আমি যখন তাঁদের বলি, ‘সনদটা কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে তা আমি জানি না’ তখন তাঁদের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। সাংবাদিকদের মধ্যে একজন মহিলা ছিলেন, তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, মিঃ চার্চিলের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলোচনার কোনো লিখিত বিবরণ নেই বলে প্রেসিডেন্টের স্বীকৃতির জন্যই আমি ওকথা বলেছি কি?

এর উত্তরে আমি বলি, ‘হ্যাঁ, এইরকমই আমি মনে করি।’

সাংবাদিকদের সর্বশেষ প্রশ্ন, ‘কংগ্রেস যদি ওয়াভেলের প্রস্তাব গ্রহণ করে তাহলে ভারত কি সৈন্য সংগ্রহের সর্বাত্মক ব্যবস্থা (conspiration ) সমর্থন করবে?’

এর উত্তরে আমি বলি, ভারতকে যদি স্বাধীনতা দেবার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করা হয় তাহলে সে নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগদান করবে। তখন আমাদের প্রথম কর্তব্য হবে জাতিকে সর্বতোভাবে ‘মোবিলাইজ’ করা; সুতরাং ভারত অবশ্যই ‘কনস্ক্রিপশান’ সমর্থন করবে।

আমি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দে যে বিবৃতি দিয়েছিলাম সেই বিবৃতির কথাটা সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দিই। সেই বিৰ্ব্বতিতে আমি বলেছিলাম, ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হলে সে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগদান তে। করবেই, তাছাড়া সে ‘কনস্ক্রিপশান’ ব্যবস্থা মেনে নিয়ে প্রতিটি সক্ষম যুবককে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করবে। আমি তখন আরো বলেছিলাম, এটা শুধু বাঁচার প্রশ্ন নয়,—এটা গণতন্ত্রের জন্য মৃত্যুবরণ করার কথাও বটে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, ইংরেজরা আমাদের সন্মানজনকভাবে মৃত্যুবরণ করবার সুযোগও দেননি। তখন তাঁরা আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

মিঃ আমেরির বিবৃতি

১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই জুন, ভারত সচিব মিঃ এল. এস. আমেরি হাউস অব কমন্সে ঘোষণা করেন, ভারতবাসীকে স্বাধীন জাতি হিসেবে যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের গভর্নমেন্ট পরিচালনা করতে দেওয়া হবে কি না, তার উত্তরে মিঃ আমেরি বলেন, তিনি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে গভর্নমেন্ট গঠন করবার জন্য আহ্বান জানাবেন। অতএব কংগ্রেস মৌলানা আজাদ এবং পণ্ডিত নেহরু সহ তার প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে।

এই বিবৃতির ফলে ভারতের জনসাধারণের মনে এইরকম ধারণার সৃষ্টি হয়, অবশেষে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। জনগণ আরো মনে করতে থাকে, এবারের প্রস্তাব গ্রহণ করার ব্যাপারে কংগ্রেসের সামনে আর কোনো বাধার সৃষ্টি হবে না। এই সময় প্রতিদিন শত শত টেলিগ্রাম এবং চিঠি আমার কাছে আসতে থাকে। কংগ্রেস যাতে এবারের প্রস্তাবটি মেনে নেয় সেই কথাই বলা হয় ওইসব টেলিগ্রাম এবং চিঠিতে। দেশের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি দেখে আমি তখন সংবাদপত্রে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রকাশ করি। উক্ত বিবৃতিতে আমি বলি, কংগ্রেস কখনো দায়িত্ব পরিহার করতে চায়নি; সে-সব সময়ই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিলো। ভারতকে যদি তার ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণের, অর্থাৎ তার রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয় তাহলে আমি এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করবার জন্য আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করি, আমাদের উদ্দেশ্য সব সময়ই গঠনমূলক – ধ্বংসমূলক কখনোই নয়।

আমার মুক্তির একদিন পরে, অর্থাৎ আমি যখন কলকাতায় অবস্থান করছিলাম, সেই সময় ভাইসরয়ের কাছ থেকে আমি এক আমন্ত্রণলিপি পাই। উক্ত আমন্ত্রণলিপিতে আমাকে ২৫শে জুন সিমলায় এক গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করবার জন্য অনুরোধ করা হয়। ভাইসরয়ের সেই পত্রের উত্তরে আমি তাঁকে জানিয়ে দিই, ২১শে জুন আমি বোম্বাইতে ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করেছি। উক্ত সভায় তাঁর চিঠিটি আলোচিত হবে এবং প্রতিনিধি হিসেবে কাকে পাঠানো হবে তাও ওই সভাতেই স্থিরীকৃত কবে। আমি তাঁকে আরো লিখি, সিমলা সম্মেলনের আগে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তাছাড়া আমি যখন আহম্মদনগর ফোর্ট জেলে আবদ্ধ ছিলাম সেই সময় আমার আর তাঁর মধ্যে যেসব চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে সেগুলো সংবাদপত্রে প্রকাশ করার ব্যাপারে তাঁর কোনো আপত্তি আছে কি না সে কথাও আমি তাঁর কাছে জানতে চাই।

এই সময় আমার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। আমার ওজন কমে গিয়েছিলো চল্লিশ পাউণ্ডেরও বেশী। ক্ষিদেও ছিলো না। আমার শরীর তখন এতোই দুর্বল হয়ে পড়েছিলে। যে চলাফেরা করতেও কষ্ট হতো। আমার স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে ডাক্তারেরা আমাকে বলেছিলেন সম্মেলনটা আরো দু সপ্তাহ পেছিয়ে দেবার জন্য আমি যেন ভাইসরয়কে অনুরোধ করি। দুসপ্তাহ সময় পেলে চিকিৎসার ব্যাপারে কিছুটা সুরাহা হবে। আমি কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের জন্য ওই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনকে পিছিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না বলে মনে করি।

আমি বঙ্গীয় বিধানসভার নেতৃস্থানীয় সদস্য হুমায়ুন কবীরকে সিম কনফারেন্সের সময় আমার সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করবার জন্য বলি। তাঁর সঙ্গে সেই থেকে আমার যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সে সম্পর্ক এখনো অম্লান রয়েছে। আমি জওহরলালকে একটি চিঠি লিখে সেই চিঠিটি সহ আগেই তাঁকে বোম্বাইতে পাঠিয়ে দিই। ওই চিঠিতে আমি জওহরলালকে বলি, ওয়ার্কিং কমিটির সভা শুরু হবার আগে তাঁর সঙ্গে আমি আলোচনা করে আমাদের কর্মপন্থা স্থির করে নিতে চাই। জওহরলাল আমার প্রস্তাবে সম্মত হন। তিনি বলেন, তিনি নিজেও এই রকমই চিন্তা করছিলেন।

২১শে জুন আমি বোম্বাইতে পৌঁছই। অন্যান্য বারের মতো এবারও আমি ভুলাভাই দেশাইয়ের বাড়িতেই উঠি। ১৯৪২-এর ১ই আগস্ট সকালে যে ঘর থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো, এবারেও সেই ঘরটিতেই আমি থাকি। আমি যখন বারান্দায় বসে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন আমার মনেই হচ্ছিলো না যে ইতিমধ্যে তিনটি বছর পার হয়ে গেছে। জামার মনে হয়েছিলো, আমি যেন গতকাল বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলেছি দিল্লাতে বিরাট অভ্যর্থনা এবং ৯ই আগস্টের ঘটনা আদৌ ঘটেনি। সেই সুপরিচিত পরিবেশে সেইসব পুরনো বন্ধুর সঙ্গেই কথা বলছি। সামনে সেই চিরপরিচিত আরব সাগর সেদিনের মতো আজও দিগন্তবিস্তৃত হয়ে রয়েছে।

গান্ধীজী তাঁর প্রথা অনুসারে বিড়লা ভবনে বাস করছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটির সভাও সেখানেই অনুষ্ঠিত হয়। আমি কমিটির কাছে ভাইসরয়ের সেই আমন্ত্রণলিপির কথা বলি। চিঠিটাও কমিটির সামনে পেশ করি। কমিটি উক্ত চিঠিখানার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আলোচনা করে আমাকেই প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করেন। স্থির হয়, গোলটেবিল বৈঠকে আমিই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করবো। খবরটা ভাইসরয়কে জানিয়ে দেওয়া হলে তিনি বোম্বাই থেকে আমাদের যাত্রার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি আমার ব্যবহারের জন্য একটি এরোপ্লেন পাঠিয়ে দেন। ওই এরোপ্লেনে করে আমি আম্বালায় যাই। সেখান থেকে মোটরে সিমলা যাই। এখানে আর একটা কথা বলে রাখা দরকার, আমি বোম্বাই পরিত্যাগ করবার আগেই ভাইসরয়ের কাছ থেকে আমার চিঠির উত্তর পেয়ে যাই। আমার চিঠিতে লিখেছিলাম, কনফারেন্সের আগে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। উত্তরে ভাইসরয় আনন্দের সঙ্গে আমার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। আমাদের চিঠিপত্র সংবাদপত্রে প্রকাশের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ও ব্যাপারে সাক্ষাতে আলোচনা হবে।

দিল্লীতে বিরাট অভ্যর্থনা

যেদিন আমি দিল্লীতে যাই সেদিনটা ছিলো বেজায় গরম। এতো গরম যে আমি রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। আম্বালা থেকে কালকা পর্যন্ত মোটরে আসবার ফলে আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আসবার পথে অগণিত জনতার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হয়েছে। জনতা অনেক বার আমার গাড়িকে ঘিরে ফেলে আমার গতিরোধ করেছে। অনেকে গাড়ির ভেতরেও উঠে পড়েছে। যারা গাড়ির ভেতর ঢুকতে পারেনি তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাদানিতে এবং ছাদের ওপরেও উঠে পড়েছে। তাদের হাত থেকে সহজে আমি ছাড়া পাইনি। অবশেষে আমি যখন বিশেষ- ভাবে তাদের অনুরোধ করি পথে এইভাবে দেরি করলে কাজের খুব অসুবিধে হবে তখন তারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে ছেড়ে দেয়। অবশেষে রাত প্রায় দশটার সময় আমি সিমলায় উপস্থিত হই। ওখানে পৌঁছে আমি সোজা চলে যাই স্যাভয় হোটেলে। ওই হোটেলে আমার জন্য কয়েকখানা ঘর রিজার্ভ করে রাখা হয়েছিলো। হোটেলে আমাকে বেশীদিন থাকতে হয়নি। আমার স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে লর্ড ওয়াভেল মনে করেন হোটেলে থাকা আমার পক্ষে উচিত হবে না। তিনি তাই বড়লাট ভবনের সংলগ্ন একটা বাংলো আমাকে ছেড়ে দেন। শুধু তাই নয়, লাটপ্রাসাদের কর্মচারীদেরও তিনি নির্দেশ দেন আমাকে দেখাশুনা করবার জন্য। ভাইসরয়ের এই সৌজন্য দেখে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে যাই। এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বলতে চাই, লর্ড ওয়াভেলকে আমি সব সময়ই অপরের সুখ-সুবিধার প্রতি সজাগ থাকতে দেখেছি।

ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার

পরদিন সকাল দশটায় আমি ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার সময় ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাবের বিষয়বস্তুও তিনি আমাকে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শাসনব্যবস্থায় কোনোরকম গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করা হবে না, তবে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল একমাত্র ভারতীয়দের দ্বারাই গঠিত হবে। তিনি আরো বলেন, ভাইসরয় প্রকৃতপক্ষে কাউন্সিলের পরামর্শ মতোই চলবেন। তিনি আমার কাছে আবেদন রাখেন, আমি যেন গভর্নমেন্টকে বিশ্বাস করি। তাঁর আন্তরিক ইচ্ছা, যুদ্ধ শেষ হবার পরেই ভারতের সমস্যা সমাধান হবে, অতএব ভারতের নিজের স্বার্থেই ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাব গ্রহণ করে যুদ্ধকে যাতে জয়ের পথে নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এরপর তিনি মুসলিম লীগ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার।

আমি তাঁকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিই, লীগের সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপারে আমার মনে সন্দেহ আছে। লীগের ঊর্ধ্বতন নেতারা মনে করেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সর্ববিষয়ে তাঁদের সমর্থন করেন, সুতরাং তাঁরা কোনো কথাই শুনতে চাইবেন না।

ভাইসরয় তখন দৃঢ়ভাবে বলেন, গভর্নমেন্ট কর্তৃক লীগকে সমর্থনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মুসলিম লীগের নেতাদের মনে যদি এইরকম ধারণা থেকে থাকে তাহলে তা হবে নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। তিনি আমাকে পরিষ্কারভাবে বলেন, এ ব্যাপারে গভর্নমেন্ট সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবে।

এরপর আমি আহম্মদনগর ফোর্ট জেলে থাকাকালীন আমার এবং তাঁর মধ্যে যেসব চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে সেগুলো সম্বন্ধে কথা তুলি। আমি তাঁকে বলি, ওগুলো খবরের কাগজে প্রকাশ করতে তাঁর তরফ থেকে কোনোরকম আপত্তি হবে না বলে আশা করি।

ভাইসরয় বলেন, আমি যদি ওগুলো প্রকাশ করবার জন্য খুবই আগ্রহান্বিত হই তাহলে তিনি তাতে আপত্তি করবেন না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওগুলো প্রকাশিত হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা যখন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন করে আলোচনায় বসছি, তখন অতীতের তিক্ততা ভুলে যাওয়াটাই সঙ্গত হবে। এই সময় যদি পূর্বতন ঘটনাবলীকে পুনরায় টেনে আনা হয় তাহলে পরিবেশটা বদলে যাবে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ার পরিবর্তে ক্রোধ এবং অবিশ্বাসের সৃষ্টি হবে। তিনি তাই আমার কাছে বিশেষভাবে আবেদন করেন, আমি যেন ওইসব চিঠিপত্র প্রকাশ করবার ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাব গ্রহণ না করি। অবশেষে তিনি বলেন, তাঁর কথাটা আমি মেনে নেব বলে তিনি আন্তরিকভাবে আশা করেন।

আমি বুঝতে পারি, ভাইসরয় এখন সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য আন্তরিকভাবে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছেন। আমি তাই তাঁকে বলি, তাঁর প্রস্তাব আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি। পরিবেশটা যাতে সুস্থ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ হয় তার জন্য আমিও তারই মতো আগ্রহান্বিত। সুতরাং আবহাওয়ার অবনতি ঘটে এমন কোনো কাজ আমি কখনোই করব না। অর্থাৎ, আমি তাঁর প্রস্তাব মেনে নিলাম।

ভাইসরয় তখন আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে দুবার বলেন, আমার এই মনোভাব দেখে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন।

এরপর ভাইসরয় তাঁর প্রস্তাবের খুঁটিনাটি আমার কাছে প্রকাশ করেন। প্রস্তাবের ব্যাখ্যা শুনে প্রথমটায় আমার মনে হয়, ক্রিপস প্রস্তাবের সঙ্গে বর্তমান প্রস্তাবের বিশেষ কোনো তফাৎ নেই। তবে একটি বিষয়ে উভয় প্রস্তাবের মধ্যে পার্থক্য অবশ্যই আছে। ক্রিপস প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল এমন সময়, যখন ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা ইংরেজের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন ছিল। আজ ইয়োরোপের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং মিত্রপক্ষ হিটলারের বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাদের পূর্ব প্রস্তাব পুনরুত্থাপন করেছেন ভারতে এক নতুন রাজনৈতিক আবহাওয়া সৃষ্টি করবার উদ্দেশ্যে।

আমি ভাইসরয়কে জানিয়ে দিই, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যদিও আমাকে তার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছে এবং আমার ইচ্ছামত কাজ করবার স্বাধীনতা দিয়েছে তবুও এ ব্যাপারে মতামত দেবার আগে আমি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই। আমি তাই সিমলাতে ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করি। বলা বাহুল্য, ভাইসরয়ের প্রস্তাবটি নিয়ে বিচার-বিবেচনা করবার জন্যই ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহূত হয়। আমি মনে করি, এই বিচার-বিবেচনার ফলে কংগ্রেসের বক্তব্য আমি আরো সুষ্ঠুভাবে কনফারেন্সের সময় তুলে ধরতে পারব। আমি ভাইসরয়কে বলি, এ ব্যাপারে যাতে কোনো রকম অসুবিধের সৃষ্টি না হয় এবং আমরা যাতে একটা সমাধানে আসতে পারি তার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

ভাইসরয় যেরকম আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর প্রস্তাবটি ব্যাখ্যা করলেন তাতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এ ব্যাপারে তিনি রাজনীতিকের মতো কথা না বলে সৈনিকের মতো বলেছেন। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে কোথাও কোনো গোপনীয়তা ছিল না। আমি আরো লক্ষ্য করি, তাঁর কথাবার্তা এবং চালচলন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের কথাবার্তা এবং চালচলন অপেক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা। স্যার স্ট্যাফোর্ড অনেক কিছু গোপন রেখে তাঁর প্রস্তাবটিকে চমকপ্রদ বস্তু হিসেবে উপস্থাপিত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন; কিন্তু লর্ড ওয়াভেল আসল ঘটনার ওপরে কোনো রকম রঙ চাপিয়ে তাকে উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত করতে চাননি। তিনি বলেন, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, কারণ প্রাচ্য ভূখণ্ডের প্রবল শত্রু জাপান এখনো ভীষণভাবে সক্রিয়, সুতরাং এ অবস্থায় কোনো রকম সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। তবে তিনি এমন একটা আশা প্রকাশ করেন যে ভবিষ্যতের বিরাট পরিবর্তনের ভিত্তি এখনই স্থাপিত হতে চলেছে। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলকে ভারতীয়করণের ফলে দেশের সর্বোচ্চ শাসনব্যবস্থাও ভারতীয়দের হাতে থাকছে। একবার এই ব্যবস্থা চালু হলে পরবর্তীকালে আরো অনেক পরিবর্তন ঘটবে।

লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার সিমলায় এক নতুন আবহাওয়ার সৃষ্টি করে। সেই রাত্রেই ভাইসরয় এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভার ব্যবস্থা করেন। পরে আমি জানতে পারি, উক্ত ভোজসভায় তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে আমার প্রশংসা করেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁর যতই মতবিরোধ থাক না কেন, কংগ্রেসের নেতারা সবাই যে অত্যন্ত ভদ্র সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। কংগ্রেস নেতাদের সম্বন্ধে ভাইসরয়ের এই মন্তব্য সিমলা শহরের সরকারী এবং বে-সরকারী ব্যক্তিদের মধ্যে এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। যেসব উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী এত দিন কংগ্রেসের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এসেছেন এবং আমাকে অবজ্ঞা করে এসেছেন তাঁরা হঠাৎ আমাদের প্রতি অত্যন্ত সদয় হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে অনেকেই নানারকম উপহার সামগ্রীসহ আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং কথায় কথায় আমাকে জানিয়ে দেন, তাঁরা মনে মনে চিরদিনই কংগ্রেসকে ভালোবেসেছেন। তাঁরা সবাই যে কংগ্রেসের পক্ষে আছেন এ কথাও তাঁরা জানাতে ভুল করেন না।

২৪ তারিখ বিকেলবেলা সর্দার হরনাম সিংয়ের বাসভবনে ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে। গান্ধীজী তখন ওখানেই বাস করছিলেন। সভার প্রারম্ভে আমি ভাইসরয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করি। আমার সেই বক্তব্যে আমি এই অভিমত জ্ঞাপন করি, পূর্ববর্তী ক্রিপস প্রস্তাবের সঙ্গে বর্তমান প্রস্তাবের বিশেষ কোনো হেরফের না থাকলেও এ প্রস্তাব আমাদের গ্রহণ করা উচিত। আমার বক্তব্যের পরিপূরক হিসেবে আমি বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করি। ইয়োরোপের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং জাপানও আর বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। সুতরাং যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে আমাদের সাহায্য চাইবার আর কোনো বিশেষ প্রয়োজন অনুভূত হবে না। এই অবস্থায় লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা আমাদের পক্ষে মোটেই সমীচীন হবে না। অতএব আমাদের পক্ষে সম্মেলনে যোগদান করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাবটা গ্রহণ করাই উচিত হবে।

আমার এই বক্তব্যের পর ওয়ার্কিং কমিটি বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। অবশেষে স্থির হয়, আমরা সম্মেলনে যোগ দিয়ে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো সম্বন্ধে জোরালোভাবে আমাদের অভিমত জ্ঞাপন করবো :

১। ভাইসরয়ের সঙ্গে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সম্পর্ক কী হবে সে সম্বন্ধে আমরা পরিষ্কার ব্যাখ্যা দাবী করব। কাউন্সিল যদি সর্বসম্মতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে আসেন তাহলে ভাইসরয় কি সেই সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন? কাউন্সিলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নাকচ করে দেবার ভেটো ক্ষমতা ভাইসরয়ের থাকবে কি?

২। সেনাদলের অবস্থা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দাবি করতে হবে। জনগণ এবং সেনাদলের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে এমনভাবে তার পরিবর্তন ঘটাতে হবে যাতে ভারতীয় নেতারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার সুযোগ পান।

৩। ভারতের জনমতকে উপেক্ষা করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতকে যুদ্ধের মধ্যে টেনে এনেছেন। কংগ্রেস এটা মেনে নিতে চায়নি। এবার যদি কোনো সমাধান হয় এবং নতুন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠিত হয় তাহলে ভবিষ্যতে কোনো যুদ্ধের ব্যাপারে ভারতের অংশগ্রহণের বিষয়টি আইনসভার সামনে পেশ করবার ক্ষমতা কাউন্সিলের থাকবে। জাপানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ ইংরেজদের অভিপ্রায় অনুসারে চলবে না; এ বিষয়টি ভারতের নিজস্ব প্রতিনিধিদের ভোটে স্থিরীকৃত হবে।

ওয়ার্কিং কমিটির এই সভায় গান্ধীজীও উপস্থিত ছিলেন এবং কমিটি কর্তৃক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তিনিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এবার তিনি অহিংসার প্রশ্নটি তোলেননি; অর্থাৎ যুদ্ধে যোগদান মানেই অহিংসার মতবাদকে বর্জন করা, এ কথাটি তিনি কমিটির সামনে উত্থাপন করেননি। ওয়ার্কিং কমিটির যে কজন সভ্য এই বিষয়টির জন্য আগে একবার রিজাইন দিয়েছিলেন তাঁরাও এবার চুপ করেই থাকেন।

ভাইসরয়ের ঘোষণা অনুসারে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সভাপতিদ্বয় এবং তপশিলী সম্প্রদায় ও শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগদান করবেন বলে স্থির হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় আইনসভার কংগ্রেস লীডার, মুসলিম লীগের প্রতিনিধি হিসাবে কাউন্সিল অব স্টেটের মুসলমান ডেপুটি লীডার এবং আইনসভার অন্যান্য জাতীয়তাবাদী দলগুলোর এবং ইয়োরোপীয় গ্রুপের লীডাররাও নিমন্ত্রিত হন। সম্মেলনে আরো যারা যোগদান করেন তাঁরা হলেন প্রাদেশিক সরকারসমূহের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রীগণ। হিন্দুমহাসভাও নিমন্ত্রণ পাবার জন্য চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভাইসরয় তাদের দাবি মেনে নেননি।

সম্মেলন শুরু হবার কিছুক্ষণ আগেই আমাদের উপস্থিত হতে বলা হয়েছিল। ভাইসরয় আমাদের স্বাগত জানান বড়লাট ভবনের প্রাঙ্গণে। ওখানে আমাদের সবাইকে নিয়মানুগভাবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। আমি তখন এতটাই দুর্বল বোধ করছিলাম যে কয়েক মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল। আমার সেই শারীরিক দুর্বলতার কথা আমি ভাইসরয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারি স্যার ইভান জেনকিন্সকে বললে তিনি আমাকে একটা কোণে নিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে যান। কয়েক মিনিট ওখানে বসবার পরে তিনি একজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে আবার আমার কাছে ফিরে আসেন এবং মহিলাটিকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এই সময় তিনি বলেন, উক্ত মহিলাটি আরবী ভাষায় সু-অভিজ্ঞা। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, আমি ওখানে একা থাকায় একজন সঙ্গী আমার দরকার হবে। এবং এইজন্যই তিনি প্রাচ্যের ওই বিদুষী মহিলাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। আমি মহিলাটির সঙ্গে আরবী ভাষায় কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারি, তার ‘নাম’ (হ্যাঁ) আর ‘লা’ (না) ছাড়া আর কোনো আরবী শব্দ জানা নেই। আমি তখন ইংরেজীতে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, প্রাইভেট সেক্রেটারি তাকে আরবী ভাষায় অভিজ্ঞা বলে মনে করলেন কেন?

আমার কথার উত্তরে মহিলাটি বললেন, ‘গতরাত্রে এক ভোজসভায় আমি সেখানে উপস্থিত ভদ্রলোকদের বলেছিলাম, আরবীয়রা ডিনার টেবিলে বসবার পর ‘আজিব, আজিব’ বলে থাকেন। স্যার জেনকিন্সও সেই ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া তিনি আরো জানতেন আমি কয়েক মাস বোগদাদে ছিলাম।’

এরপর একটু মৃদু হেসে মহিলাটি আবার বলেন, ‘এইজন্যই হয়তো স্যার জেনকিন্স ধরে নিয়েছিলেন, আমি আরবী ভাষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তিলাভ করেছি।’ কয়েক মিনিট পরে লর্ড ওয়াভেল আমার কাছে এসে বললেন, সম্মেলন-কক্ষে যাবার সময় হয়েছে। আপনি আসুন।

সম্মেলনকক্ষে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, সেখানে ভাইসরয়কে মাঝখানে রেখে প্রতিনিধিদের জন্য অর্ধচন্দ্রাকারে আসন স্থাপন করা হয়েছে। প্রধান বিরোধীদল হিসেবে কংগ্রেসের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে ভাইসরয়ের বাম দিকের আসনগুলো এবং লীগের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে ডানদিকের আসনগুলো। সাধারণত সরকারের সমর্থকদলের জন্যই ডানদিকের আসনগুলো নির্দিষ্ট থাকে। এর ফলে সঙ্গতভাবেই মনে হয়, সরকার মুসলিম লীগকে তাঁদের সমর্থক হিসেবে গণ্য করেন। তবে এমনও হতে পারে, উদ্যোক্তাদের অজ্ঞতার জন্যই এরকম ব্যবস্থা হয়েছে।

একটু পরেই সম্মেলন শুরু হলো। লর্ড ওয়াভেল একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করলেন। তাঁর ভাষণ শেষ হতেই আমি দাঁড়িয়ে উঠে সভার সামনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মতামত ব্যক্ত করি। পূর্বে যে তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তার প্রত্যেকটি বিষয়ই আমি সভার সামনে তুলে ধরি।

এরপর ভাইসরয়ের উত্তর দেবার পালা। বলতে বাধা নেই, ভাইসরয় আমার প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই সন্তোষজনক উত্তর দেন।

তার পরেই শুরু হলো আলোচনা এবং সারাদিন ধরেই তা চলতে লাগল, তবে মাঝে একবার লাঞ্চের জন্য কিছুক্ষণ আলোচনা স্থগিত ছিল।

সম্মেলনে যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছিল। সাংবাদিকদেরও সেখানে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি। প্রথম দিনের অধিবেশনের পরেই আমি তাই লর্ড ওয়াভেলকে বলি, সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের যদি সম্মেলন সম্বন্ধে কোনো প্রেসনোট বা ওইরকম কিছু না দেওয়া হয় তাহলে নানারকম গুজবের সৃষ্টি হবে, সুতরাং বিভিন্ন দলের সম্মতিক্রমে ‘প্রেস রিলিজ’ ইস্যু করলে ভালো হয়। আমার কথার উত্তরে ভাইসরয় বলেন, প্রত্যেক অধিবেশনের শেষেই একটি সরকারী বিবৃতি তৈরি করা হবে এবং বিভিন্ন দলের অনুমোদন নিয়ে সেটি সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য দেওয়া হবে। ভাইসরয়ের কথামত সেদিনের অধিবেশন শেষ হতেই সরকারী বিবৃতির একটা খসড়া আমার হাতে তুলে দেওয়া হয়। খসড়াটি পড়ে সামান্য একটু অদলবদল করে আবার আমি সেটিকে ফিরিয়ে দিই। এরপর যখন ‘প্রেস রিলিজ’ তৈরি করে সাংবাদিকদের দেওয়া হয় তখন আমি খুশির সঙ্গে লক্ষ্য করি, আমার প্রতিটি সংশোধনই সরকারী বিবৃতিতে স্থান পেয়েছে। এরপর থেকে প্রতিদিনই এই পদ্ধতি অনুসৃত হতে থাকে।

সম্মেলন শুরু হবার পর থেকেই কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মতবিরোধ সুস্পষ্টভাবে দেখা দেয়। দ্বিতীয় দিনে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ এবং আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত ও গৃহীত হয়। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধের ব্যাপারে সর্বতোভাবে সহযোগিতার কথা এবং ভারত শাসন আইনে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল পুনর্গঠনের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও সম্মেলনে আলোচিত ও গৃহীত হয়। শেষোক্ত ব্যাপারে মিঃ জিন্না দাবি তোলেন: কংগ্রেস শুধু হিন্দু সদস্যদেরই মনোনীত করতে পারবে। মুসলমান সদস্যদের মনোনীত করবে একমাত্র মুসলিম লীগ। মিঃ জিন্নার এই অযৌক্তিক দাবির উত্তরে আমি বলি, কংগ্রেস তাঁর দাবি কখনই মেনে নেবে না। কংগ্রেস চিরদিনই জাতীয় মনোভাব নিয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং সে ব্যাপারে কংগ্রেস কোনোদিনই হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনো রকম পার্থক্য টানেনি। সুতরাং কংগ্রেস যে শুধু হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান এটা সে কিছুতেই মেনে নেবে না। এই কথা বলে আমি পাল্টা দাবি উত্থাপন করে বলি, কংগ্রেস হিন্দু মুসলমান ক্রিশ্চান শিখ পার্সি নির্বিশেষে যে-কোনো ভারতীয়কে তার প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করবে। আমি আরো বলি, কংগ্রেসের এই দাবি মেনে নেওয়া না হলে সে সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়াবে। মুসলিম লীগ তার ইচ্ছামত প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে পারে, সে সম্পর্কে কংগ্রেসের কোনো বক্তব্য নেই।

সম্মেলন আবার শুরু হয় ২৬শে জুন এবং লাঞ্চের বিরতির আগে পর্যন্ত আলোচনা চলে। কথা হয়, লাঞ্চের সময় প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন।

এই সময় মিঃ জিন্না বলেন, তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। আমি তখন পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থকে এ ব্যাপারে মনোনীত করি। আমার মতে মিঃ জিন্নার সঙ্গে আলোচনা করবার ব্যাপারে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। আলোচনা চলে কয়েক দিন ধরে, কিন্তু তাতে কোনোই ফল হয় না। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী খিজির হায়াৎ খানও সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলন চলাকালে তিনি অনেকবার আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। আমি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করি, সম্মেলনে উত্থাপিত প্রতিটি প্রশ্নেই তিনি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রতিটি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য সর্বতোভাবে সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন।

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সিমলা কনফারেন্স একটি যুগান্তকারী ঘটনা। যদিও এই সম্মেলন শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু তা না হবার কারণ ইংরেজ সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ নয়; সম্মেলন ফলপ্রসূ না হবার কারণ হলো মুসলিম লীগের উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবসঞ্জাত অসহযোগিতা। মুসলিম লীগের এই অসহযোগিতার কারণ জানতে হলে লীগের ইতিহাস অনুধাবন করা দরকার। রাজনৈতিক সমস্যার ব্যাপারে মুসলিম লীগের মনোভাবকে সুস্পষ্টভাবে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা যায়। এই তিনটি স্তর সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হচ্ছে।

মুসলিম লীগের উৎপত্তি এবং উদ্দেশ্য

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বড়দিনের সময় ঢাকা শহরে একটি ‘মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলন চলাকালে ঢাকার তৎকালীন নবাব মুস্তাক হোসেনের প্রচেষ্টায় মুসলিম লীগ জন্মগ্রহণ করে। সেই সম্মেলনে আমিও উপস্থিত ছিলাম। উক্ত সম্মেলনে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রস্তাবের মধ্যে দুটি প্রস্তাবের কথা এখনো আমার বেশ মনে আছে। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়, ভারতের মুসলমানদের সর্বউপায়ে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের অনুগত করে তুলতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার নামে এবং সরকারী চাকরিতে মুসলমানদের বেশি করে নেবার দাবিতে হিন্দু এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য উত্থাপন করা হয়। এই কারণেই মুসলিম লীগের নেতারা কংগ্রেস কর্তৃক উত্থাপিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবীর বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁরা মনে করতেন, মুসলমানরা যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের সামিল হয় তাহলে এর পরেই আসে দ্বিতীয় স্তর। মুসলিম লীগ যখন দেখতে পায়, কংগ্রেসের আন্দোলনের ফলে গভর্নমেন্ট নানারকম সংস্কার করতে বাধ্য হচ্ছেন, তখনই লীগ তার কাজের ধারাকে কিছুটা পরিবর্তন করে। লীগ বেশ কিছুটা অস্বস্তির সঙ্গেই লক্ষ্য করে, কংগ্রেস ধাপে ধাপে তার লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এটা দেখেও লীগ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তবে রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকলেও কংগ্রেসকে কোনো সুযোগ-সুবিধে পেতে দেখলেই লীগ এগিয়ে আসতে থাকে সুযোগ-সুবিধের ভাগ বসাবার জন্য। মুসলিম সমাজের স্বার্থরক্ষার নামেই তারা তখন এগিয়ে আসে। মুসলিম লীগের এই প্রোগ্রামটি গভর্নমেন্টের খুবই মনঃপূত হয়। অতএব এটা সঙ্গতভাবেই মনে করা যেতে পারে, মুসলিম লীগ ইংরেজদের ইচ্ছা অনুসারেই চালিত হচ্ছিল। মর্লি-মিন্টো শাসন সংস্কারের সময় এবং গন্টফোর্ড (মন্টেগু চেমসফোর্ড) পরিকল্পিত প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনাধিকার প্রবর্তনের সময়ও মুসলিম লীগ ঠিক এইরকম মনোভাবই নিয়েছিল।

এরপর আসে তৃতীয় পর্ব। এই পর্বের সূচনা হয় প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। এই সময় কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেড়ে যায়। অবস্থা দেখে মনে হয়, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট হয়তো ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেবেন। এই সময় মুসলিম লীগের নেতৃত্ব মিঃ জিন্নার হাতে এসে গিয়েছিল। তিনি তখন শুরু করলেন এক নতুন খেলা। এ খেলা হলো গভর্নমেন্ট এবং কংগ্রেসের মধ্যে প্রতিটি বিরোধের সুযোগ নেওয়া। যখনই কংগ্রেস এবং গভর্নমেন্টের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে কোনো আলোচনা শুরু হতো তখনই মিঃ জিন্না তুষ্ণীভাব অবলম্বন করে চুপ করে থাকতেন। আলোচনা যদি ফেঁসে যেত তখন তিনি উভয়পক্ষের ওপরে দোষারোপ করে বিবৃতি প্রচার করতেন। ওইসব বিবৃতিতে তিনি বলতেন, যেহেতু আলোচনায় কোনো কিছুর সমাধান হয়নি সেইহেতু ব্রিটিশ-প্রস্তাব সম্পর্কে মুসলিম লীগ কোনোরকম অভিমত প্রকাশ করবে না। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট-প্রস্তাব এবং ১৯৪২-এর ক্রিপস-প্রস্তাব সম্পর্কেও মিঃ জিন্না এই খেলাই খেলেন। কিন্তু সিমলা কনফারেন্সে এসে তিনি একটু বেকায়দায় পড়ে যান, কারণ এবার আর তাঁর সেই পুরনো চাল কার্যকরী হবে না বলে তিনি বুঝতে পারেন।

আমি আগেই বলেছি, ইতিপূর্বে কংগ্রেস এবং গভর্নমেন্টের মধ্যে প্রতিটি আলোচনাই রাজনৈতিক কারণে ফেঁসে গেছে। ইংরেজরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সম্মত হতেন না এবং কংগ্রেসও ভারতের স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো সমাধানেই সম্মত হতো না। এই কারণেই পূর্ববর্তী আলোচনাগুলো ভেস্তে গেছে। সুতরাং সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন সেসব ক্ষেত্রে আদৌ উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু সিমলা কনফারেন্সে পরিস্থিতি ভিন্নতর হয়ে ওঠে। এবার আমি লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাব মেনে নিতে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সম্মত করতে সক্ষম হই। সুতরাং এবারে আর উভয়পক্ষের ওপর দোষারোপ করে ভালোমানুষ সাজা সম্ভব হয় না মিঃ জিন্নার পক্ষে। এবারের আলোচনা ভেস্তে গেল নতুন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সদস্য নির্বাচনের প্রশ্নে।

আমি ইতিপূর্বেই ব্যাখ্যা করেছি, এই প্রশ্নে কংগ্রেস জাতীয় মনোভাব গ্রহণ করে কিন্তু মুসলিম লীগ বায়না ধরে যে কংগ্রেস তার জাতীয় চরিত্র পরিহার করে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করুক। মিঃ জিন্না এক অদ্ভুত দাবী তুলে বলেন, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে কংগ্রেস শুধু হিন্দু প্রতিনিধি পাঠাবে। আমি সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের কাছে জানতে চাই, কংগ্রেস কাদের মনোনয়ন দেবে না দেবে সে সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার মিঃ জিন্নাকে এবং মুসলিম লীগকে কে দিয়েছে? কংগ্রেস যদি মুসলমান, পার্সি, শিখ অথবা খ্রিস্টান সদস্য মনোনীত করে তাহলে তো হিন্দু সদস্যের সংখ্যাই কমে যাবে; এতে মুসলিম লীগের কী বক্তব্য থাকতে পারে? আমি লর্ড ওয়াভেলকে সরাসরি প্রশ্ন করি, মুসলিম লীগের এই বক্তব্য তিনি সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন কিনা।

আমার প্রশ্নের উত্তরে লর্ড ওয়াভেল বলেন, মুসলিম লীগের দাবিকে তিনি বাস্তবানুগ বলে মনে করেন না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও বলেন, এই বিষয়টি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে আলোচিত হয়ে স্থির হওয়া দরকার; গভর্নমেন্ট অথবা ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজে উভয় পার্টির ওপরে কোনোরকম সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চান না।

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে সদস্য মনোনয়ন সম্পর্কে

এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন সম্পর্কে এই মতবিরোধ আরো প্রকটিত হয়ে ওঠে যখন রাজনৈতিক বিষয় সম্বন্ধে একটা বোঝাপড়া হয়ে যায়। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি সাধারণভাবে গৃহীত হবার পরেই বিভিন্ন পার্টি কর্তৃক সদস্য মনোনয়নের প্রশ্ন ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেসের তরফ থেকে তার প্রেসিডেন্টের নামই কংগ্রেসী সদস্য তালিকায় শীর্ষস্থান পায়। আমরা জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার প্যাটেলের নামও কংগ্রেসী সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করি। অপর দুজন সদস্যের নাম সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘ আলোচনা হয় এবং অবশেষে আমরা এ বিষয়ে একটি ঐক্যমতেও আসি। আমি একজন পার্সি এবং একজন ভারতীয় খ্রিস্টানকে কংগ্রেসী সদস্য হিসেবে মনোনীত করতে চাই।

এই দুটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে সদস্য নেবার জন্য কেন আমি চাপ দিয়েছিলাম সে সম্বন্ধে কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা যখন গ্রেপ্তার হই সেই সময় কয়েকটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কংগ্রেসের বিরুদ্ধবাদী করে তোলবার জন্য ইংরেজ সরকার বিশেষভাবে চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে একটি ছিল পার্সি সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়টি ক্ষুদ্র হলেও তার শিক্ষা, আর্থিক সচ্ছলতা এবং ক্ষমতার দিক থেকে ভারতের জাতীয় জীবনে এরা এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। বোম্বাইতে যখন প্রথম কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল সেই সময় পার্সি সম্প্রদায়ের মিঃ নরীম্যানের প্রতি অবিচার করা হয়েছিল বলে আমি মনে করি। এছাড়া ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত কংগ্রেসের একটি সিদ্ধান্তও পার্সি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যায়। বোম্বাইতে যখন মদ্যপান নিষিদ্ধ করা হয় তখন পার্সি সম্প্রদায়ের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মদের ব্যবসায়ে এরা প্রায় একচেটিয়া অধিকার ভোগ করত; কিন্তু মদ্যপান নিষিদ্ধ হওয়ায় পার্সি মদ্যব্যবসায়ীদের এক কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়। এইসব কারণেই হয়তো গভর্নমেন্ট মনে করেছিলেন পার্সিরা কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে এগিয়ে আসবে; কিন্তু সম্প্রদায় হিসেবে এরা গভর্নমেন্টের হাতের পুতুল হতে অস্বীকার করে। পার্সি সম্প্রদায়ের সব নেতা এবং প্রায় সব বিশিষ্ট ব্যক্তি এক বিবৃতির মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা অতীতে যেভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন ভবিষ্যতেও ঠিক সেইভাবেই কংগ্রেসের সঙ্গে থাকবেন।

আহম্মদনগর জেলে আমি যখন তাঁদের ওই বিবৃতি খবরের কাগজের মাধ্যমে দেখতে পাই তখন এঁদের প্রতি আমি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হই। আমি তখন আমার সহকর্মীদের কাছে বলি, ওই বিবৃতি প্রচার করে পার্সিরা খুব ভালোভাবে ভারতের সেবা করেছেন। আমি আরো বলি, পার্সিদের এই মনোভাবের প্রতি আমরা অবশ্যই সকৃতজ্ঞ সমর্থন জ্ঞাপন করব। লোকসংখ্যার দিক থেকে নগণ্য হলেও আমি মনে করি, স্বাধীন ভারতে তাঁদের স্থান হবে সর্বাগ্রে। এই কারণেই আমরা যখন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যদের নামের তালিকা প্রণয়ন করতে বসেছিলাম তখন পার্সি সম্প্রদায় থেকে একজন সদস্য নেবার জন্য আমি বিশেষভাবে মত প্রকাশ করেছিলাম। আমার এই মনোভাব দেখে গান্ধীজীও খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু খুশি হলেও তিনি বলেন, কংগ্রেস যখন মাত্র পাঁচজন প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে, তখন পার্সিদের ভেতর থেকে কাউকে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি তাতে সম্মত হতে পারিনি। আমি বলি, ভবিষ্যৎ যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে বর্তমান সুযোগকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে একজন পার্সিকে আমরা অবশ্যই নেব। দুদিন আলোচনার পরে অবশেষে আমার কথাটাই মেনে নেন সবাই।

ভারতীয় খ্রিস্টানদের ভেতর থেকেও একজনকে আমি প্রতিনিধি হিসাবে মনোনীত করতে চাই। আমি জানতাম, শিখ এবং তপসিলী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি কাউন্সিলে আসবার সুযোগ পাবে কিন্তু কংগ্রেস যদি ভারতীয় খ্রিস্টানদের ভেতর থেকে কাউকে না নেয় তাহলে এই সম্প্রদায় থেকে কোনো লোক কাউন্সিলে আসবার সুযোগ পাবে না। এই প্রসঙ্গে আমার আরো মনে পড়ে, ভারতীয় খ্রিস্টানরা সব সময়ই কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন এবং আছেন এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে তারা সব সময়ই কংগ্রেসের বক্তব্য ও কর্মধারাকে সমর্থন করে এসেছেন।

আমাদের আলোচনার ফলশ্রুতি শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়ায়, কংগ্রেস কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধিদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা হয় মাত্র দুজন। এতেই প্রমাণ হয়, অবশ্য প্রমাণ যদি কেউ চায়, কংগ্রেস প্রকৃতই একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। হিন্দুদের ভেতর থেকে এতে আপত্তি ওঠা স্বাভাবিক ছিল, কারণ হিন্দুরাই হলেন ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। কিন্তু তাঁরা এ ব্যাপারে কোনোই আপত্তি তোলেননি। কংগ্রেস যখন তার পাঁচজন সদস্যের মধ্যে মুসলমান, খ্রিস্টান এবং পার্সি সম্প্রদায় থেকে তিনজন এবং হিন্দু সম্প্রদায় থেকে মাত্র দুজন প্রতিনিধি মনোনীত করল, তখন হিন্দুমহাসভা এই ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির মতলবে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। কিন্তু সবাই জানেন, মহাসভা এ ব্যাপারে কোনোই সুবিধে করতে পারেনি। তাদের চিৎকারে কেউ কানই দেননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, হিন্দুমহাসভার মতো মুসলিম লীগও কংগ্রেস কর্তৃক মুসলমান প্রতিনিধি মনোনয়নে আপত্তি জ্ঞাপন করল।

আজ দশ বছর বাদে সেদিনের ঘটনাবলীর কথা বলতে গিয়ে মুসলিম লীগের অদ্ভুত মনোভাব এবং ততোধিক অদ্ভুত আচরণের কথা বার বার বিস্ময়ের সঙ্গে মনে পড়ছে। লর্ড ওয়াভেল সাময়িকভাবে যে তালিকা তৈরি করেছিলেন তাতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের প্রতিনিধি ছাড়া আরো চারজন প্রতিনিধির নাম ছিলো। এই চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন শিখ, দুজন তপসিলি সম্প্রদায়ের লোক এবং বাকি একজন ছিলেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী খিজির হায়াৎ খান। এই তালিকা দেখে মিঃ জিন্না প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে যান। তিনি তীব্রভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেন, মুসলিম লীগের মনোনীত প্রতিনিধি ছাড়া এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে অপর কোনো মুসলমান প্রতিনিধি থাকতে পারবে না। জিন্নার এই বক্তব্য শোনবার পর খিজির হায়াৎ খান আমার সঙ্গে দেখা করে এ ব্যাপারে কংগ্রেসের মনোভাব জানতে চান। আমি তাঁকে জানিয়ে দিই, তাঁর বিরুদ্ধে আমরা একটি কথাও বলবো না অথবা কোনোরকম আপত্তি তুলবো না। লর্ড ওয়াভেলকেও আমি এ সম্বন্ধে বলি, মিঃ জিন্নার বিরোধিতার জন্য সম্মেলন যদি ভেস্তে না যেতো তাহলে যে নতুন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠিত হতো তাতে মুসলমানরাই হতেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগ হওয়া সত্ত্বেও কাউন্সিলের চোদ্দজন সদস্যের মধ্যে সাতজনই হতেন মুসলমান। এই ব্যাপারে একদিকে যেমন কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী মনোভাব আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে মুসলিম লীগের বোকামিও প্রকটিত হয়েছে। লীগ-নেতারা হামেশাই বলতেন, মুসলিম লীগই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা ভারতের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করছে, কিন্তু এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে সদস্য মনোনয়নের ব্যাপারে দেখা গেল বৃহত্তর মুসলিম সমাজের স্বার্থ অপেক্ষা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের দিকেই তাদের নজর বেশি। মুসলিম লীগের বিরোধিতার জন্যই নতুন গভর্নমেন্ট গঠিত হতে পারলো না, যে গভর্নমেন্টের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে মুসলমান সদস্যই হতো সবচেয়ে বেশি।

কনফারেন্স শেষ হবার পরে আমি সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রচার করি। একটি সাংবাদিক সম্মেলনও আমি আহ্বান করি। সিমলা কনফারেন্সে কংগ্রেস যেসব অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিলো সেগুলো আমি সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা করি। আমি বলি, কনফারেন্সের এই প্রস্তাব আমাদের কাছে হঠাৎ আসে। আমি এবং আমার সহকর্মীরা মুক্তিলাভ করি ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন। মুক্তির অব্যবহিত পরেই সিমলা কনফারেন্সে যোগদানের জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সুতরাং এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করবার মতো যথেষ্ট সময় আমরা পাইনি। আমরা বুঝতে পারি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে এবং সেই পরিবর্তনের জন্যই ভারতের সমস্যাকে নতুন করে সমাধানের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর স্বাধীনতার প্রশ্নও এই পরিবর্তনের জন্যই উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এ সব সম্বন্ধে ভালোভাবে বিচার-বিবেচনা করে দেখবার আগেই আমাকে সিমলা কনফারেন্সে যোগদান করতে হলো। কিন্তু এতো সব অসুবিধা সত্ত্বেও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করা হবে বলে ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়।

সাংবাদিকদের আমি বলি, সম্মেলন চলাকালে আমি সব সময়ই কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে জোর দিয়েছিলাম। ভাইসরয়কেও আমি বলেছিলাম, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করবার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি আমাকে সর্বতোভাবে গভর্নমেন্টের সঙ্গে সহযোগিতা করবার নির্দেশ দিয়েছেন।

আমি বলি, সিমলা কনফারেন্স যদি সাফল্যমণ্ডিত হতো তাহলে জাপানের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যে যুদ্ধ চলছে তা শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না, ভারতবর্ষও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। এ ব্যাপারে ভারতবর্ষের একটা দায়িত্বও আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো জাপানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ভারতবর্ষ জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। তবে ওইসব দেশের স্বাধীনতা এই নয় যে, পূর্বতন ইয়োরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার জন্য একজন ভারতীয় সৈনিকও যুদ্ধ করবে না অথবা একটি পাই-পয়সাও ভারত তার জন্য ব্যয় করবে না।

সাংবাদিকদের আমি আরো বলি, ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি যখন মূলগতভাবে স্থিরীকৃত হয় তখন কনফারেন্সে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের গঠনপদ্ধতি এবং সদস্যসংখ্যা নিয়ে বিবেচনা শুরু হয়। এই সময় বিভিন্ন দলের মধ্যে ঘরোয়াভাবে আলোচনার দরুন সভার কাজ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে। কিন্তু সেই ঘরোয়া আলোচনায় কোনো ফলই হয় না। আলোচনার সময় মিঃ জিন্না দাবি করে বসেন, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মুসলমান সদস্যদের মনোনয়ন একমাত্র মুসলিম লীগই করবে; কংগ্রেস কোনো মুসলমান সদস্য মনোনীত করতে পারবে না। কংগ্রেস এ দাবি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না, কারণ এ দাবি মেনে নেবার অর্থ হলো কংগ্রেসের জাতীয় চরিত্রকে বিসর্জন দেওয়া। এটা শুধু সামান্য কটি আসনের ব্যাপারই নয়, এতে কংগ্রেসের মূল নীতিও জড়িত। মুসলিম লীগকে উপযুক্ত স্থান দিতে আমরা সব সময়ই আগ্রহান্বিত ছিলাম। কিন্তু মিঃ জিন্না এক অসহযোগী মনোভাব নিয়ে বসে রইলেন। তাঁর দাবি মেনে নেওয়া না হলে তিনি নামের তালিকা দিতেও অস্বীকৃত হলেন। পরিস্থিতির এইরকম পরিণতি দেখে ভাইসরয় আমাকে বলেন, মিঃ জিন্নাকে সহযোগিতার মনোভাব নেবার জন্য তিনি নানাভাবে চেষ্টা করেও তাঁর মত পরিবর্তন করতে পারেননি। তাঁর এক কথা, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে মুসলমান সদস্য একমাত্র মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটিই মনোনীত করবে। তাঁর এই অযৌক্তিক দাবি ভাইসরয়ও মেনে নিতে পারেন না; তিনি তাই মনে করেন, এরপর সম্মেলন চালিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিরর্থক হবে।

এই সম্পর্কে আমি তখন যে বিবৃতি প্রচার করেছিলাম তা থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে:

বর্তমান পরিস্থিতিতে দুটি বিশেষ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়; একটি হলো মুসলিম লীগের একগুঁয়ে মনোভাবের জন্য সম্মেলন ভেস্তে যাওয়া এবং মুসলিম লীগ সরে দাঁড়ালেও ভাইসরয় এ ব্যাপারে এগিয়ে যাবেন কিনা। ভাইসরয় এ ব্যাপারে আর এগোবেন না বলে মনস্থ করেন। এই সম্পর্কে আমি সম্মেলনে যে কথা বলেছিলাম এখানে আর একবার তার পুনরুল্লেখ করছি। ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ইংলন্ডের সরকারেরও দায়িত্ব আছে এবং সে দায়িত্ব তারা পরিহার করতে পারে না। আজই হোক বা কালই হোক, এ ব্যাপারে তাদের দৃঢ় এবং ন্যায়সঙ্গত মনোভাব গ্রহণ করতেই হবে। এছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। ইংরেজ সরকার যদি এইরকম সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আবার আমরা এগিয়ে আসবো। যারা এগিয়ে যেতে চাইবে তাদের অবশ্যই এগিয়ে যেতে দিতে হবে এবং যারা অসহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বাইরে থাকতে চাইবে তাদের বাইরেই রাখতে হবে। তবে দৃঢ় মনোভাব গ্রহণ না করলে কোনো কিছুই করা সম্ভব হবে না। দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব এবং ভীত পদক্ষেপ কখনোই আমাদের উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারবে না। প্রতিটি পদক্ষেপের আগেই আমাদের বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে; কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে—দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব শুধু দুর্বলতাই প্রকাশ করে।

সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের আমি বলি, সম্মেলনে কংগ্রেস যে মনোভাব গ্রহণ করেছিলো তার জন্য আমি মোটেই দুঃখিত নই। মিঃ জিন্নাকে খুশি করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাঁর সেই অযৌক্তিক দাবি, অর্থাৎ মুসলিম লীগই ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিস্থানীয় সংস্থা, এটা আমরা কিছুতেই স্বীকার করে নিতে পারিনি। যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব প্রদেশেও লীগ-মন্ত্রিসভা নেই। সীমান্ত প্রদেশে রয়েছে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা, সিন্ধু প্রদেশে স্যার গোলাম হোসেনকে কংগ্রেসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আসামেও একই অবস্থা। অতএব মুসলিম লীগই যে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এ দাবি ধোপে টেকে না। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ তখন মুসলিম লীগের আওতার বাইরে ছিলো।

এই পরিচ্ছেদ সমাপ্ত করবার আগে আমি ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সম্বন্ধে কিছু বলার দরকার বোধ করছি। উক্ত আন্দোলনের সময় কয়েকজন নতুন নেতা ও নেত্রী ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ওঁরা সবাই সেই সময়কার পরিস্থিতির সঙ্গে তাল রেখে চলতেন। এঁদের মধ্যে শ্রীমতী অরুণা আসফ আলীও ছিলেন। আমি আগেই বলেছি, ১৯৪২-এর ৯ই আগস্ট তিনি বোম্বাইয়ের রেল স্টেশনে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন তিনি চুপ করে বসে থাকবেন না। আমাদের গ্রেপ্তারের পরে তিনি উল্কার মতো ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছোটাছুটি করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশবাসীদের ক্ষেপিয়ে তুলে এমন এক প্রবল আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিলেন যার ফলে ইংরেজদের যুদ্ধপ্রচেষ্টা ভীষণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলো। ওই আন্দোলন পরিচালনার ব্যাপারে তিনি হিংসা ও অহিংসা নিয়ে মাথা ঘামাননি। প্রয়োজনের তাগিদে তিনি যে-কোনো পন্থাই গ্রহণ করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কার্যকলাপ সম্বন্ধে সরকার সজাগ হয়ে ওঠে। তারা তখন শ্রীমতী অরুণা আসফ আলীকে গ্রেপ্তার করবার জন্য সচেষ্ট হয়। কিন্তু তিনি এমনভাবে আত্মগোপন করে আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন যার ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই সময় বহুসংখ্যক ভারতবাসী তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। সাহায্যকারীদের মধ্যে সরকারী কর্মচারী এবং শিল্পপতির সংখ্যাও কম ছিলো না। এঁরা সরকারের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও শ্রীমতী অরুণা আসফ আলীকে সাহায্য করেছিলেন। বোম্বাই এবং কলকাতার কয়েকজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ীও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। এমন কি সময় সময় তিনি ভারতীয় আই. সি. এস. এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীদের গৃহেও আত্মগোপন করে বাস করেছিলেন। নিজের প্রয়োজনের জন্য অর্থসংগ্রহ করতেও তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। আমরা যতোদিন জেলখানায় বন্দী ছিলাম ততোদিন তিনি এইভাবেই তাঁর কার্যকলাপ চালিয়ে গিয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালে আমি মুক্তিলাভ করবার অব্যবহিত পরেই তিনি কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি তাঁর সম্বন্ধে লর্ড ওয়াভেলকে বললে তিনি আমাকে কথা দেন শ্রীমতী অরুণা আসফ আলীর পূর্বতন কার্যকলাপের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, ভবিষ্যতে কী হবে? আমি লর্ড ওয়াভেলকে বলি, বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তিত হবার ফলে শ্রীমতী অরুণা আসফ আলী আর কোনোরকম গোপন আন্দোলন করবেন না। এরপর আমি যখন বুঝতে পারি তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে না, তখন আমি তাঁকে আত্মপ্রকাশ করতে বলি। আমার কথায় তিনি ১৯৪৫-এর শেষদিকে আত্মপ্রকাশ করেন।

তাঁর কার্যকলাপ সরকারী মহলে এমনই সুপরিচিত হয়ে পড়েছিলো যে ভাইসরয়ও রীতিমতো চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন। একবার একটি বক্তৃতায় তিনি শ্রীমতী অরুণা আসফ আলীর সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতিও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওয়ার্কিং কমিটির একজন সদস্যের স্ত্রী যেখানে হিংসাপদ্ধতি গ্রহণ করে মারমুখী আন্দোলন চালাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে কংগ্রেসের অহিংস-নীতি সম্বন্ধে বিশ্বাস রাখা কঠিন। আমরা আহম্মদনগর দুর্গে বন্দী থাকাকালে যখন এইসব কথা জানতে পারি তখন আসফ আলী তাঁর নিজের বন্দীদশার জন্য চিন্তিত না হলেও তাঁর স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমি তাঁকে তখন এই বলে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি, এজন্য তাঁর চিন্তিত হবার কোনো কারণ নেই। আমার কথার উত্তরে আসফ আলী বলেন, তাঁর স্ত্রী যেরকম অসম-সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন তার জন্য তিনি গর্ববোধ করছেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন