২। প্রথম খণ্ডের সংক্ষিপ্তসার

২. প্রথম খণ্ডের সংক্ষিপ্তসার

আমার পূর্বপুরুষরা হেরাত থেকে ভারতে এসেছিলেন বাবরের আমলে। ভারতে এসে প্রথমে তাঁরা আগ্রায় বসবাস করতে থাকেন, পরে সেখান থেকে দিল্লীতে চলে আসেন। পরিবারটি শিক্ষার দিক থেকে বিশেষ উন্নত ছিল। আকবরের আমলে এই পরিবারের মৌলানা জামালউদ্দিন ধার্মিক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। জামালউদ্দিন সাহেবের পরে এই পরিবার বৈষয়িক উন্নতির দিকে নজর দেন; যার ফলে এই পরিবারের কয়েকজন লোক গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদে অধিষ্ঠিত হন। এই ধারা পরবর্তীকালেও চলতে থাকে। শাহজাহানের আমলে এই পরিবারের অন্যতম কৃতী পুরুষ মহম্মদ হাদি আগ্রা দুর্গের অধিনায়ক পদে নিযুক্ত হন।

আমার প্রমাতামহ (অর্থাৎ আমার পিতার মাতামহ) মৌলানা মুনাওয়ারউদ্দিন ছিলেন মোগল আমলের সর্বশেষ রুকন্-উল্ মুদারাসিন। এই পদটি প্রথমে সৃষ্ট হয়েছিলো শাহজাহানের আমলে। সাম্রাজ্যের শিক্ষা এবং শিক্ষা-উন্নয়ন ব্যবস্থাগুলোর তদারকি করবার জন্যই পদটি সৃষ্ট হয়। এই পদে যিনি অধিষ্ঠিত থাকতেন তাঁর নির্দেশেই অনুদানসমূহ প্রদত্ত হতো। অনুদান নানারকমের ছিলো, যেমন নগদ অর্থসাহায্য, ভূ-সম্পত্তি প্রদান এবং বার্ধক্য-বৃত্তি। খ্যাতনামা পণ্ডিত এবং শিক্ষাব্রতীদের এইসব অনুদান দেওয়া হতো। সে আমলের এই পদাধিকারীকে হাল আমলের শিক্ষা অধিকর্তার পদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পরবর্তীকালে মোগল রাজশক্তি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাঁদের সৃষ্ট অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদ এখনো প্রচলিত রয়েছে।

আমার পিতা মৌলানা খয়েরউদ্দিনের বয়স যখন খুবই অল্প সেই সময় আমার পিতামহের মৃত্যু হয়। পিতৃহীন হবার পর তাঁর প্রতিপালনের ভার নেন তাঁর মাতামহ। সিপাহী বিদ্রোহের দু বছর আগে মৌলানা মুনাওয়ারউদ্দিন ভারতের তৎকালীন অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে মক্কায় চলে যাবেন বলে স্থির করেন। মক্কার পথে তিনি যখন ভূপালে উপনীত হন তখন ভূপালের নবাব সিকান্দার জাহান বেগম তাঁকে কিছুদিন ওখানে থেকে যেতে বলেন। তিনি ভূপালে থাকাকালেই বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, যার ফলে দু বছর তিনি স্থানত্যাগ করতে পারেন না। এরপর তিনি বোম্বাইতে যান, কিন্তু মক্কায় যাওয়া তাঁর হয় না, কারণ বোম্বাইতে এসেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।

আমার পিতার বয়স তখন পঁচিশ বছর। তিনি মক্কায় চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। ওখানে তিনি নিজস্ব বাসভবন তৈরি করে শেখ মহম্মদ জাহের ওয়াত্রির কন্যাকে বিবাহ করেন। শেখ মহম্মদ জাহের ছিলেন মদিনার একজন বিখ্যাত পণ্ডিত। তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি তখন আরবের সীমা ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমার পিতা কর্তৃক আরবীতে রচিত দশ খণ্ডে বিভক্ত এক বিরাট গ্রন্থ মিশর থেকে প্রকাশিত হবার পর তিনিও ইসলাম-জগতে সুপরিচিত হয়ে পড়েন। তিনি কয়েকবার বোম্বাইতে এবং একবার কলকাতায় এসেছিলেন। উভয় স্থানেই বহু লোক তাঁর গুণগ্রাহী এবং শিষ্য হন। ইরাক, সিরিয়া এবং তুরস্কেও তিনি ব্যাপকভাবে পরিভ্রমণ করেন।

মক্কা শহরে তখন পানীয় জলের প্রধান উৎস ছিলো নহর জুবেইদা নামে একটি খাল। এটি খনন করিয়েছিলেন খলিফা হারুণ-অল-রশিদের পত্নী বেগম জুবেইদা। কালক্রমে উক্ত খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় মক্কা শহরে জলাভাব দেখা দেয়। এই জলাভাব আরো প্রকট হয়ে উঠতো হজের সময়। তীর্থযাত্রীরা জলের অভাবে অবর্ণনীয় কষ্টভোগ করতেন। আমার পিতা এই খালটি সংস্কার করেন। ভারত, মিশর, সিরিয়া এবং তুরস্ক থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে খালটিকে তিনি এমনভাবে উন্নত করেন যার ফলে বেদুইনরা ওটার কোনোরকম ক্ষতি করবার সুযোগ পায় না। এই সময় তুরস্কের সম্রাট ছিলেন সুলতান আবদুল মজিদ। আমার পিতার এই সৎ কাজের কথা জানতে পেরে তিনি তাঁকে তুরস্কের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান-প্রতীক মজিদী পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।

এবার আমার কথা বলছি। আমার জন্ম হয় মক্কা শহরে, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। আমার জন্মের দু বছর পরে অর্থাৎ ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে আমার বাবা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। কিছুদিন আগে জেদ্দায় আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে তাঁর পায়ের হাড় ভেঙে গিয়েছিলো। হাড়টাকে সংস্থাপিত করা হলেও সেটা ঠিকমতো সেট না হওয়ায় তাঁকে কলকাতায় থেকে যাবার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁকে বলা হয়, কলকাতার সার্জনরা তাঁর হাড়কে ঠিকমতো সেট করে দিতে পারবেন। তিনি মনে মনে স্থির করেছিলেন, কলকাতায় তিনি বেশিদিন থাকবেন না। কিন্তু তাঁর শিষ্য আর ভক্তরা তাঁকে ছেড়ে দিতে চান না। আমরা কলকাতায় আসবার এক বছর পরে আমার মায়ের মৃত্যু হয় এবং ওখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

আমার পিতা ছিলেন প্রাচীনপন্থী এবং রক্ষণশীল। পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা-পদ্ধতিকে তিনি সুনজরে দেখতেন না এবং এই কারণে আমাকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করবার কথা তিনি ভাবতেও পারতেন না। তাঁর মতে আধুনিক শিক্ষা ছিলো ধর্মবিশ্বাসের ধ্বংসকারী শিক্ষা। তিনি তাই প্রাচীন ধারাতেই আমার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন।

এই প্রাচীন শিক্ষাধারা অনুসারে ভারতের মুসলমান ছেলেদের প্রথমে ফার্সী ও পরে আরবী শেখানো হতো। এই দুটি ভাষা আয়ত্ত করবার পরে তাদের আরবীর মাধ্যমে দর্শনশাস্ত্র, জ্যামিতি, পাটিগণিত এবং বীজগণিত শেখানো হতো। এ ছাড়া ঐস্লামিক কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিও ছিলো শিক্ষার একটি প্রধান অঙ্গ। প্রথমদিকে বাবা আমাকে বাড়িতেই পড়াতেন, কারণ আমাকে তিনি কোনো মাদ্রাসায় পাঠানো পছন্দ করতেন না। তখন ‘কলিকাতা মাদ্রাসা’ সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলেও সেই শিক্ষালয় সম্বন্ধে বাবা মোটেই উচ্চধারণা পোষণ করতেন না। প্রথমদিকে তিনি নিজেই আমাকে পড়াতেন। পরে বিভিন্ন বিষয় পড়াবার জন্য তিনি বিভিন্ন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাকে বিশেষভাবে শিক্ষিত করে তুলতে।

এই চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব ছেলে লেখাপড়া করতো তাদের পড়াশুনা সাধারণত কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে সমাপ্ত হতো। তবে শিক্ষা সমাপ্ত করার আগে কিছুদিন তাদের শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করে নবাগত শিক্ষার্থীদের পড়াতে হতো। তারা তাদের অধীত বিষয় কতোটা আয়ত্ত করেছে তা দেখার জন্যই এই ব্যবস্থাটি প্রচলিত ছিলো। আমি ষোলো বছর বয়সেই আমার শিক্ষা সমাপ্ত করতে সক্ষম হই। বাবা তখন জন-পনেরো নতুন ছাত্র এনে আমার কাছে তাদের পড়তে দেন। এইসব ছাত্রকে আমি উচ্চতর দর্শন, গণিত এবং ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলাম।

এই সময় আমি স্যার সৈয়দ আহম্মদের লেখা শিক্ষাবিষয়ক কয়েকটি রচনা পড়ার সুযোগ পাই। ওইসব রচনায় তিনি আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর মতামত আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। আমি বুঝতে পারি, বর্তমান যুগে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্য সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকলে প্রকৃত শিক্ষালাভ করা যায় না। কিন্তু এসব বিষয় শিখতে হলে ইংরেজি ভাষা জানা দরকার। আমি তাই ইংরেজি শিখবো বলে মনে মনে স্থির করি এবং আমার মনোবাসনার কথা প্রাচ্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান পরীক্ষক (Chief Examiner of Oriental Course of Studies) মহম্মদ ইউসুফ জাফরীকে বলি। তিনি আমাকে ইংরেজি বর্ণমালা শেখান এবং প্যারীচরণ সরকারের ‘ফার্স্ট বুক’ পড়তে দেন। ওই বইটি পড়ে ইংরেজি ভাষায় কিছুটা জ্ঞানলাভের পর আমি বাইবেল পড়তে শুরু করি। বাইবেল পড়ার সময় আমি ইংরেজি বাইবেলের সঙ্গে বাইবেলের পার্শী এবং উর্দু অনুবাদও একই সঙ্গে পড়তে থাকি। এইভাবে পড়ার ফলে ইংরেজি বাইবেলের বিষয়বস্তু সহজেই আমি বুঝতে পারি। এরপর আমি অভিধানের সাহায্য নিয়ে ইংরেজি খবরের কাগজ পড়া শুরু করি। এইভাবে পড়ার ফলে ইংরেজি ভাষার ওপর আমার যথেষ্ট দখল জন্মে। আমি তখন ইতিহাস এবং দর্শনশাস্ত্র পড়তে শুরু করি।

মানসিক প্রতিক্রিয়া

এই সময় আমার মনোজগতে এক বিরাট প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যে পরিবারে আমি জন্মগ্রহণ করেছি সে পরিবার সবদিক দিয়ে প্রাচীনপন্থী এবং ধর্মীয় অনুশাসনের বশবর্তী। ওখানে প্রাচীন সংস্কারেরই প্রাধান্য; যা কিছু প্রাচীন তাই ওখানে শ্রেয় বলে বিবেচিত হতো। এবং তা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিও এ পরিবার সহ্য করতো না। আমি কিন্তু এই রক্ষণশীলতাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারিনি। প্রায়ই আমার মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠতো। নিজ পরিবার এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে যে ভাবধারা এবং শিক্ষা আমি লাভ করেছি তাতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমার মনের কোণে তখন বারবার যে কথাটা উঁকি দিতো তা হলো—‘সত্য কী এবং সত্যের পথই বা কোনটা?’ আমার তখন সব সময়ই মনে হতো, সত্যের সন্ধান আমাকে জানতে হবে এবং নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে সে পথের সন্ধান।

এইরকম মানসিক অবস্থায় পিতৃগৃহের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। আমি তাই পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে নিজের পথে চলতে থাকি।

এই সময় প্রথমেই যে জিনিসটি আমার মনের ওপর ধাক্কা দেয় তা হলো, বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ। একই ধর্মবিশ্বাসের অনুবর্তী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর কেন খাড়া হয়েছে আমি তা বুঝতে পারি নে। কেন যে এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে হীন প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করে তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি নে। রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের এই গোঁড়ামি আর সংকীর্ণ মনোভাব দেখে ধর্ম সম্বন্ধেও আমার মনে সন্দেহের বীজ উপ্ত হয়। ধর্ম যদি একমাত্র সত্য হয় তাহলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যেই বা এত বিভেদ কেন? কেনই বা প্রত্যেক ধর্ম নিজেকে একমাত্র সত্য এবং অপর ধর্মকে মিথ্যা বলে অভিহিত করে!

দু-তিন বছর পর্যন্ত আমার মনে এই ধরনের অস্থিরতা চলতে থাকে। এই সময়টায় আমি এইসব প্রশ্নের সদুত্তর জানবার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়ি। আমি তখন শুরু করি পড়াশুনা আর অনুশীলন। স্তরে স্তরে চলতে থাকে এই অনুশীলন পর্ব। অবশেষে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করবার পর আমার মন থেকে সমস্তরকম সংকীর্ণতা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয়ে যায়। পারিবারিক সূত্রে এবং বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে যে শিক্ষা আমি পেয়েছি তার ফলে আমার মনে নানারকম সংস্কার এসে দানা বেঁধেছিলো। আমার মনের ভেতরের সেইসব সংস্কার হঠাৎ যেন কোথায় পালিয়ে গেলো। এর পর থেকেই আমি ‘আজাদ’ (স্বাধীন) ছদ্মনাম গ্রহণ করি। এই ছদ্মনাম গ্রহণের অর্থ হলো, সমস্তরকম সংস্কার এবং সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে আমি মুক্ত করে নিয়েছি। এই বিষয়টা আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডে আরো বিস্তৃতভাবে আলোচনা করবার ইচ্ছা রইলো।

বিপ্লবী দলে যোগদান

আমার রাজনৈতিক ধ্যানধারণাও এই সময় পালটাতে শুরু করে। বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার জন্যই এটা হয়েছিলো। ভারতবর্ষের ভাইসরয় তখন লর্ড কার্জন। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভেদনীতির ফলে বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা তখন অগ্নিগর্ভ। এই অগ্নিতে তিনি ঘৃতাহুতি দিলেন বঙ্গবিভাগের আদেশ জারি করে। এই ঘোষণাবাণী প্রচারিত হয় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিলো, বৃহত্তর বঙ্গদেশকে বিভক্ত করলে বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে। বঙ্গদেশ কিন্তু লর্ড সাহেবের এই সাধে বাধ সাধলো। সারা বাংলা জুড়ে শুরু হলো প্রচণ্ড বিক্ষোভ। সে বিক্ষোভ শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো না; সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী কর্মতৎপরতাও শুরু হয়ে গেলো বাংলার বুকে। অরবিন্দ ঘোষ বরোদা থেকে বাংলায় এসে এখানেই তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র স্থাপন করলেন। তাঁর পত্রিকা ‘কর্মযোগী’ তখন জাতীয় জাগরণের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেছে।

এই সময় আমি তৎকালীন বিখ্যাত বিপ্লবী কর্মী শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সংস্পর্শে আসি এবং তাঁর মাধ্যমে অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে পরিচিত হই। আমার বেশ মনে আছে, অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে এই সময় আমার দুবার কিংবা তিনবার সাক্ষাৎ হয়। বিপ্লবীদের সঙ্গে এইভাবে মেলামেশার ফলে আমি বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত আমি বিপ্লবী দলে যোগদান করি।

সে সময় শুধু মধ্যবিত্ত হিন্দুদের ভেতর থেকেই বিপ্লবী কর্মী সংগ্রহ করা হতো। বিপ্লবী দলে যোগদান করবার পরে আমি দেখতে পাই, সব বিপ্লবী দলই মুসলমানদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। এর পেছনে কিছু কারণও ছিলো। বিপ্লবীরা দেখেছিলেন, ইংরেজ সরকার মুসলমানদের ব্যবহার করতো ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতিকে বন্ধ করার জন্য। মুসলমানরাও ইংরেজ শাসকদের সেই রাজনীতির খেলার ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে চলেছিলো। নবগঠিত পূর্ববঙ্গ প্রদেশের (পূর্ববঙ্গ ও আসাম) নবনিযুক্ত লেঃ গভর্নর বমফিল্ড ফুলার তখন প্রায়ই বলতেন, মুসলমানরা হলো ইংরেজ সরকারের সুয়োরানী। এ ছাড়া আরো একটি ব্যাপারে বিপ্লবীরা মুসলমানদের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা জানতে পেরেছিলেন, উত্তরপ্রদেশ থেকে একদল মুসলমান অফিসার আমদানি করে বাংলার গোয়েন্দা বিভাগের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে ঢেলে সাজা হয়েছে এবং সেইসব মুসলমান অফিসারদের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা সরকার হিন্দু অফিসারদের ওপরে আস্থা রাখতে পারেনি। সরকার হিন্দু অফিসারদের বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে মনে করতো। সরকারের ধারণা হয়েছিলো, হিন্দুরাই যেহেতু ভারতের রাজনৈতিক এবং বৈপ্লবিক আন্দোলনের হোতা, সেইহেতু সরকারের হিন্দু অফিসাররাও হয়তো হিন্দু বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। এইসব কারণেই নেতৃস্থানীয় হিন্দুরা, বিশেষ করে বিপ্লবীরা মুসলমানদের ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপন্থী বলে মনে করতেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী যখন আমাকে বিপ্লবীদের সঙ্গে পরিচিত করে দেন এবং তাঁরা যখন জানতে পারেন আমি তাঁদের দলে যোগ দিতে চাই তখন তাঁরা রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যান। একজন মুসলমান যুবক বিপ্লবী দলে যোগ দিতে আসবে, এটা হয়তো তারা ভাবতেই পারেননি। এরপর সত্যি সত্যিই আমি যখন বিপ্লবী দলে যোগ দিলাম তখনো তাঁরা আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। প্রথমদিকে আমাকে তাঁরা পরিহার করেই চলতেন। এমন কি, দলের গোপনীয় সভাগুলোতেও আমাকে তাঁরা স্থান দিতেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন এবং সমস্ত গোপনীয় বিষয়ই আমার সঙ্গে আলোচনা করতে থাকেন। এই সময় আমি তাঁদের বলি, কয়েকজন মুসলমান অফিসারের কাজকর্ম দেখেই তাঁরা যেন সমগ্র মুসলমান সমাজকে বিচার না করেন। আমি তাঁদের আরো বলি, মিশর, ইরান এবং তুরস্কে মুসলমান যুবকরাই বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করছেন। সুতরাং ভারতীয় মুসলমানরাও রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবে, তবে এর জন্য আমাদের মুসলমানদের ভেতরে কাজ করতে হবে এবং বন্ধুভাবে তাদের হৃদয় জয় করতে হবে। আমি তাঁদের এ কথাও বলি, মুসলমানরা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে থাকলে অথবা রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি বিমুখ হয়ে থাকলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে উঠবে। অতএব মুসলমান সমাজের বন্ধুত্ব এবং সহায়তালাভের জন্য আমাদের সর্বতোভাবে সচেষ্ট হতে হবে।

প্রথমদিকে বিপ্লবী বন্ধুরা আমার অভিমতকে আমল দিতে চাননি। কিন্তু পরবর্তীকালে অনেকেই আমার অভিমত মেনে নেন। আমি ইতিমধ্যেই মুসলমানদের ভেতরে কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম। আমি দেখতে পেয়েছিলাম, মুসলমানদের মধ্যে এমন একদল যুবক রয়েছে যারা রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে ব্যগ্র হয়ে আছে।

প্রথমে আমি যখন বিপ্লবী দলে যোগ দিই তখনই আমি দেখতে পাই, বিপ্লবীদের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ বাংলা এবং বিহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিহার তখন বঙ্গদেশেরই একটি অংশ ছিল। আমি তখন আমার বিপ্লবী বন্ধুদের বলি, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও আমাদের আন্দোলনকে প্রসারিত করা দরকার। কিন্তু প্রথমদিকে আমার এই প্রস্তাব তাঁরা মেনে নেন না। তাঁরা বলেন, গুপ্ত ক্রিয়াকলাপকে ব্যাপক করতে গেলে বিপদের সম্ভাবনাও আছে। অন্যান্য প্রদেশে যদি শাখা খোলা হয় মন্ত্রগুপ্তি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। মন্ত্রগুপ্তিই বিপ্লবী আন্দোলনের আসল কথা; সুতরাং একে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি তাদের আমার মতের সপক্ষে আনতে সক্ষম হই। ফলে আমার যোগদানের পর দু বছরের মধ্যেই বোম্বাই এবং উত্তর-ভারতের অনেক জায়গায় গুপ্ত-সমিতি স্থাপিত হয়। এ সম্বন্ধে, অর্থাৎ বিভিন্ন স্থানে গুপ্তসমিতি স্থাপনের এবং বিপ্লবী কর্মী সংগ্রহের ব্যাপারে আরো অনেক চিত্তাকর্ষক কাহিনী বলতে পারি, তবে তার জন্য পাঠকদের আরো কিছুদিন অর্থাৎ আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এই সময় আমি একবার ভারতের বাইরে যাবার সুযোগ পাই। এবং সেই সুযোগে আমি ইরাক মিশর সিরিয়া এবং তুরস্ক পরিভ্রমণ করি। ওইসব দেশে ফরাসী ভাষার প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ দেখে আমিও ফরাসী ভাষা শিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি বুঝতে পারি, ইংরেজি ভাষা দ্রুতগতিতে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রসারিত হচ্ছে। সুতরাং প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ইংরেজি ভাষাই আমাকে বেশি সাহায্য করবে।

এই সুযোগে আমি স্বর্গত মহাদেব দেশাইয়ের একটি ভুল মন্তব্যের সংশোধন করার দরকার বোধ করছি। তিনি যখন আমার জীবনচরিত রচনা করছিলেন তখন আমাকে তিনি কতকগুলো প্রশ্ন করে সেগুলোর উত্তর দিতে বলেছিলেন। তাঁর একটি প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমার বয়স যখন কুড়ি বছর সেই সময় আমি একবার ব্যাপকভাবে মধ্যপ্রাচ্য পরিভ্রমণ করেছিলাম এবং সেই সময় বেশ কিছুদিন মিশরে অবস্থান করেছিলাম। তার আর একটি প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, মুসলমান সমাজের চিরাচরিত শিক্ষাধারাকে আমি সন্তোষজনক বলে মনে করি নে। আমি তাঁকে আরো বলি, শুধু ভারতেই নয়, কায়রোর সুবিখ্যাত আল এজাহার বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ধরনের অসন্তোষজনক শিক্ষাব্যবস্থাই প্রচলিত আছে। আমার সেই উত্তর শুনে মহাদেব দেশাই হয়তো ধরে নিয়েছিলেন, আমি আল এজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার জন্যই মিশরে গিয়েছিলাম। আসল কথা হলো, আমি আদৌ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি। কিন্তু শ্রীদেশাই হয়তো ধরে নিয়েছিলেন, শিক্ষিত হিসাবে যারা পরিচিত তাঁরা নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকেন। তিনি আরো জানতেন, ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়িনি। এবং এই কারণেই তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, আমি আল এজাহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেছি। ১১০৮ খ্রিস্টাব্দে আমি যখন কায়রোতে গিয়েছিলাম তখন আল এজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি এমনই ত্রুটিপূর্ণ ছিল, তাতে শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নতি তো হতোই না, উপরন্তু প্রাচীন ইসলামীয় বিজ্ঞান এবং দর্শনশাস্ত্রও ভালোভাবে শেখানো হতো না। শেখ মহম্মদ আবদুল্লা এই ত্রুটি সংশোধন করতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু প্রাচীনপন্থী উলেমাদের বিরোধিতার ফলে তিনি কিছুই করতে পারেননি। তিনি তাই আল এজাহারের উন্নতির আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে ‘দারুল-উল্ম’ নামে একটি নতুন কলেজ স্থাপন করেছিলেন। সেই কলেজটি আজও চলছে। সুতরাং এই যেখানকার অবস্থা সেখানে আমার পড়াশুনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

মিশর থেকে আমি তুরস্কে যাই। সেখান থেকে যাই ফ্রান্সে। লণ্ডনে যাবার ইচ্ছেও আমার ছিলো কিন্তু পারীতে থাকাকালে বাবার অসুখের খবর পেয়ে আমি কলকাতায় ফিরে আসি। এই কারণেই সে যাত্রায় আর লণ্ডনে যাওয়া হয় না। আমি লণ্ডনে গিয়েছিলাম এর বহুদিন পরে।

আগেই বলেছি, কলকাতা থেকে বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে আমার রাজনৈতিক ধ্যানধারণা ছিলো বিপ্লবী রাজনীতির পক্ষে। তাই আমি যখন ইরাকে আসি তখন ওখানকার কয়েকজন বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। মিশরে থাকাকালে মুস্তাফা কামাল পাশার সঙ্গেও আমি আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ পাই। এ ছাড়া আরো কয়েকজন তুর্কী বিপ্লবীর সঙ্গেও আমার আলাপ-আলোচনা হয়। এঁরা কায়রো শহরে একটি বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করে সেই কেন্দ্র থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পরে আমি যখন তুরস্কে যাই তখন আরো কয়েকজন তুর্কী বিপ্লবীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। এঁরা তখন ‘নব্য তুর্কী আন্দোলন’ চালাচ্ছিলেন। আমি ভারতে ফিরে আসার পরেও বহুদিন এঁদের সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলাম।

ওইসব বিপ্লবীর সঙ্গে যোগাযোগের ফলে বিপ্লবী রাজনীতির প্রতি আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। ওই বিপ্লবী বন্ধুরা ভারতের মুসলমানদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনে ভারতীয় মুসলমানদের ঔদাসীন্যের কথাও তাঁদের অবিদিত ছিলো না। তাছাড়া ভারতীয় মুসলমানরা যে জাতীয় আন্দোলনের বিরোধিতা করছিলেন সে কথাও তাঁদের অজানা ছিলো না। তাঁরা তাই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ভারতের মুসলমানরা কেন যে ইংরেজদের তাঁবেদারী করছেন তা তারা বুঝতে পারেন না। তাঁরা আরো বলেছিলেন ভারতের মুসলমানদের উচিত জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যোগদান করে সর্বউপায়ে তার পৃষ্ঠপোষকতা করা। আমিও এই অভিমতই পোষণ করতাম। আমি তাই মনে মনে স্থির করি, ভারতে ফিরে গিয়েই আমি মুসলমানদের মধ্যে কাজ আরম্ভ করবো। আমার কাজ হবে ইংরেজের প্রতি তাদের যে অন্ধবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে তা বিদূরিত করে মুসলমান সমাজকে জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করা। এই সংকল্প নিয়েই আমি ভারতে ফিরে আসি।

আল হিলাল পত্রিকা প্রকাশ

ভারতে ফিরে এসেই আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী হবে তা নিয়ে কিছুদিন চিন্তা করবার পর আমি এই সিদ্ধান্তে আসি, মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করতে হলে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা দরকার। সে সময় পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশ থেকে কয়েকটি দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হতো। কিন্তু সে-সব পত্রিকার বিষয়বস্তু এতোই নিম্নমানের এবং সেগুলোর ছাপা, প্রচ্ছদপট ইত্যাদি এতোই নিম্নস্তরের ছিলো যে জনসাধারণের মধ্যে কোনোরকম প্রভাবই তা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাছাড়া ওইসব পত্রিকা লিথোগ্রাফী পদ্ধতিতে ছাপা হতো বলে আধুনিক যুগের উপযোগী কোনো ফিচার ওগুলোতে স্থান পেতো না। হাফটোন ব্লকও ওইসব পত্রিকায় ছাপা হতো না। আমি তাই স্থির করি, আমার পত্রিকা হবে সবদিক থেকেই উন্নত। পত্রিকাটি ছাপা হবে টাইপে এবং আধুনিক সংবাদপত্রের সবকিছুই তাতে থাকবে। পত্রিকার নাম স্থির করতেও দেরি হয় না। নাম সাব্যস্ত করি ‘আল হিলাল’। একই নামে একটি ছাপাখানাও আমি স্থাপন করি কিছুদিনের মধ্যেই। সেই ছাপাখানা থেকেই অবশেষে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ‘আল হিলাল’ আত্মপ্রকাশ করে।

প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পত্রিকাটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে উর্দু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘আল হিলাল’ এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। পত্রিকার চাহিদাও বাড়তে থাকে প্রচণ্ডভাবে। শুধু ভালো ছাপা আর ভালো প্রচ্ছদপটের জন্যই নয়, আসলে এর জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের জন্যই জনসাধারণ এর দিকে অতোটা আকৃষ্ট হয়। পত্রিকার চাহিদা এতো বেড়ে যায় যে প্রথম তিন মাসের যাবতীয় সংখ্যা আবার নতুন করে ছাপতে হয়। নতুন গ্রাহকরা প্রথম সংখ্যা থেকে সমস্ত সংখ্যা চাইবার ফলেই পূর্ববর্তী সংখ্যাগুলো ছাপতে হয়েছিলো।

মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব সে সময় আলিগড় দলের হাতে ছিলো। ওই দলের লোকেরা মনে করতেন, তাঁরাই ছিলেন স্যার সৈয়দ আহম্মদের রাজনীতির ধারক ও বাহক। তাঁরা যে রাজনীতি প্রচার করতেন তার মূল কথা ছিলো রাজভক্তি। তাঁরা বলতেন, মুসলমান সমাজ সব সময় ইংরেজদের বশংবদ হয়ে থাকবে এবং স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবে। কিন্তু ‘আল হিলাল’ যখন জোরালো বক্তব্য উপস্থিত করে মুসলমান সমাজকে জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হবার জন্য আহ্বান জানালো এবং মুসলমান সমাজও সে আহ্বানে সাড়া দিলো তখন আলিগড় দলের প্রতিক্রিয়াপন্থী নেতারা ‘আল হিলাল’-এর বিরুদ্ধতা করতে শুরু করলেন। কিন্তু বিরোধিতা যতোই বাড়তে লাগলো, ‘আল হিলাল’ও ততোই জনপ্রিয় হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত এর প্রচারসংখ্যা ছাব্বিশ হাজারে পৌঁছে গেলো—উর্দু সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটা তখন অভাবনীয় ছিলো।

এদিকে ‘আল হিলাল’-এর জাতীয়তাবাদী মতবাদে ইংরেজ শাসকশ্রেণী তখন রীতিমতো বিচলিত হয়ে উঠেছেন। তাঁরা তখন ‘আল হিলাল’কে (এবং তার সম্পাদককে, অর্থাৎ আমাকে) তার মতবাদ থেকে বিচ্যুত করবার উদ্দেশ্যে তাঁদের চিরাচরিত পন্থায় প্রেস আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে দু হাজার টাকা জামানত দাবি করলেন। জামানতের টাকা যথারীতি দাখিল করা হলো; কিন্তু ‘আল হিলাল’ তার মতবাদ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হলো না। আমি অকুতোভয়ে আমার বক্তব্য প্রচার করে চললাম। ফলে জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করে সরকার নতুনভাবে দশ হাজার টাকা জামানত দাবি করলো। সে টাকাও জমা দেওয়া হলো এবং যথারীতি বাজেয়াপ্ত হলো। কিন্তু জামানত জব্দ করেও সরকার ‘আল হিলাল’কে জব্দ করতে পারলো না।

ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। এর এক বছর পরে, অর্থাৎ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সরকার ‘আল হিলাল’ প্রেসটি বাজেয়াপ্ত করে নিলো। কিন্তু প্রেস বাজেয়াপ্ত হলেও আমি দমে গেলাম না। আমি তখন ‘আল বালাঘ’ নামে আর একটি প্রেস স্থাপন করে সেই নামেই নতুন পত্রিকা বের করলাম। আমার কাজকর্ম দেখে ইংরেজ শাসকরা বুঝে নিলেন, প্রেস আইনের দ্বারা আমার ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করা যাবে না। তাঁরা তখন ভারতরক্ষা আইনের বলে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আমার ওপরে এক বহিষ্কারের আদেশ জারি করে অবিলম্বে আমাকে কলিকাতা পরিত্যাগ করতে বললেন। ওদিকে পাঞ্জাব, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ এবং বোম্বাই সরকারও অনুরূপ আদেশ জারি করে আমাকে সেইসব অঞ্চলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন। আমার পক্ষে তখন একমাত্র স্থান ছিলো বিহার। আমি তাই বাধ্য হয়ে রাঁচিতে চলে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়েও আমি স্বাধীনভাবে থাকতে পারলাম না। মাস ছয়েক যেতে না যেতেই আমাকে নজরবন্দী করা হলো।

দীর্ঘ চার বছর নজরবন্দী অবস্থায় থাকার পরে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি আমাকে মুক্তি দেওয়া হলো। যুদ্ধশেষে বন্দীমুক্তির জন্য রাজকীয় আদেশ জারি হবার ফলেই আমি মুক্তিলাভ করি। আমার মতো আরো অনেক বন্দী উক্ত আদেশের বলে একই দিনে মুক্তিলাভ করে।

গান্ধীজীর পরিকল্পনা

ইতিমধ্যে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে গান্ধীজী আত্মপ্রকাশ করেছেন। আমি যখন রাঁচিতে বন্দীজীবন যাপন করছিলাম সেই সময় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে বিহার সরকারের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু সরকার তাঁকে অনুমতি দেননি। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। তাঁর সঙ্গে প্রথমে আমার দেখা হয় আমার মুক্তির পরে। এ সাক্ষাৎকার ঘটে দিল্লীতে, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। সে সময় তুরস্কের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভারতের মুসলমান সমাজ রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। এবং সেই দুশ্চিন্তার জন্য মুসলমান সমাজের নেতারা ‘খিলাফত আন্দোলন’ নামে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করার কথা চিন্তা করছিলেন। গান্ধীজী তাদের সেই প্রস্তাবিত আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। মুক্তির পরে আমি যখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলাম সেই সময় খিলাফত এবং তুরস্কের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভারতের মুসলমান সমাজের মনোভাব ভাইসরয়কে জানিয়ে দেবার জন্য একটি ডেপুটেশন পাঠাবার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। যে আলোচনা সভায় এই প্রস্তাব গৃহীত হয় সেখানে গান্ধীজীও উপস্থিত ছিলেন এবং উক্ত প্রস্তাবের প্রতি তাঁর সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছিলেন। মুসলিম নেতাদের তিনি আরো বলেন; এই ব্যাপারে তিনি সব সময় তাঁদের সঙ্গে আছেন ও থাকবেন। এর পর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি দিল্লীতে একটি সভা হয়। উক্ত সভায় গান্ধীজী, লোকমান্য তিলক এবং আরো অনেক কংগ্রেসী নেতা খিলাফতের প্রশ্নে ভারতের মুসলমানদের দাবিকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেন।

ডেপুটেশন ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে। আমি স্মারকপত্রে স্বাক্ষর করলেও ডেপুটেশনের সঙ্গে যাইনি, কারণ আমার মতে বিষয়টা তখন স্মারকলিপি অথবা ডেপুটেশন স্তরের বাইরে চলে গেছে। ডেপুটেশন ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করলে প্রতিনিধিদের তিনি বলেন, তাঁরা যদি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছে মুসলমানদের মনোভাব জানাবার জন্য একটি ডেপুটেশন পাঠাতে চান তাহলে সরকার তাঁদের লণ্ডনে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধে দিতে সম্মত আছে। তিনি নিজে এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না বলে প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেন।

এর পরেই শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব। কয়েকদিন পরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হলো। সে সভায় মিঃ মহম্মদ আলী, মিঃ শৌকত আলী, হাকিম আজমল খাঁ এবং লক্ষ্ণৌয়ের ফিরিঙ্গি মহলের মৌলবী আবদুল বারি উপস্থিত ছিলেন। গান্ধীজী সেই সভায় অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনা উপস্থাপিত করেন। তিনি বলেন, ডেপুটেশন এবং স্মারকপত্র প্রেরণের স্তর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এখন আমাদের সর্বতোভাবে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করতে হবে এবং শুধু এই পথেই সরকারকে নতি স্বীকার করাতে পারা যাবে। তিনি প্রস্তাব করেন, সবরকম সরকারী খেতাব বর্জন করতে হবে এবং আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে বয়কট করতে হবে। ভারতীয়রা সরকারী চাকরিতে ইস্তফা দেবে এবং নবগঠিত আইনসভায় অংশগ্রহণ করবেন না।

গান্ধীজী তাঁর এই প্রস্তাব উত্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেলো, অনেক বছর আগেই টলস্টয় এ কথা বলেছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে জনৈক সন্ত্রাসবাদী যুবক যখন ইতালির রাজাকে আক্রমণ করেছিলো সেই সময় সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠিতে টলস্টয় বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসের পথ আদৌ সঠিক পথ নয়, কারণ ক্ষুদ্র একটি আক্রমণের ফলে বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। একজন ব্যক্তিকে হত্যা করলে আর একজন তার স্থান অধিকার করবে। গ্রীক পুরাণে উল্লেখিত আছে, একজন মৃত সৈনিকের রক্ত থেকে ১১৯জন সৈনিক জন্মগ্রহণ করে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ড্রাগনের দাঁতকে আরো জোরদার করে। সুতরাং এ পথ পথই নয়। কোনো প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে যদি নতি স্বীকার করাতে হয় তাহলে সর্বোত্তম পন্থা হলো কর দেওয়া বন্ধ করা, সবরকম সরকারী চাকরিতে ইস্তফা দেওয়া এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বয়কট করা। এই পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করলে সহজেই সরকারকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা যায়।”

আমার আরো মনে আছে, ‘আল হিলাল’ পত্রিকার কোনো একটি সংখ্যাতেও এই ধরনের কথা আমি লিখেছিলাম। সুতরাং গান্ধীজীর এই পরিকল্পনাটা তাঁর নিজস্ব মৌলিক পরিকল্পনা নয়। কিন্তু এটা তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা না হলেও এই পথই যে সর্বোত্তম পথ তাতে আমার মনে কোনো সন্দেহই ছিলো না।

এদিকে গান্ধীজী যখন এই পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করলেন, তখন সভায় উপস্থিত নেতারা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। হাকিম আজমল খাঁ বললেন, পরিকল্পনাটা ভালোভাবে বিচার-বিবেচনা করে দেখার জন্য তিনি কিছুদিন সময় চান। তিনি আরো বললেন, যতোদিন তিনি এই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পারছেন ততোদিন তিনি তাঁর অনুগামীদের এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না। মৌলবী আবদুল বারি আবার আরো এককাঠি ওপরে উঠলেন। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে তিনি ধ্যানযোগে আল্লার নির্দেশ জানতে চাইবেন। এবং যতোদিন তিনি তা না জানতে পারছেন ততোদিন এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারবেন না। আবদুল বারি সাহেব যে এইরকম একটা কিছু বলবেন এ কথা আগেই বুঝতে পারা গিয়েছিলো। ব্যাপার দেখে গান্ধীজী আমার দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁকে জানিয়ে দিলাম, এই পরিকল্পনা আমি সর্বতোভাবে সমর্থন করি। আমরা যদি তুরস্ককে সাহায্য করতে চাই তাহলে এই পথেই আমাদের চলতে হবে।

এই সভার কয়েক সপ্তাহ পরে মীরাট শহরে খিলাফত সম্মেলন নামে বড় রকমের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনেও গান্ধীজী উপস্থিত ছিলেন। ওখানেই তিনি তাঁর প্রস্তাবিত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে বিস্তৃত পরিকল্পনা উপস্থাপিত করেন। ওখানেও আমি তাঁর বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করি। এরপর গান্ধীজী তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়ে কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন। সেই আলোচনায় স্থির হয়, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে (অর্থাৎ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে) কলকাতায় কংগ্রেসের যে বিশেষ অধিবেশন হবে সেই অধিবেশনে গান্ধীজীর পরিকল্পনাটি বিবেচনা করা হবে।

যথাসময়েই কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। উক্ত অধিবেশনে গান্ধীজী বলেন, আমরা যদি স্বরাজ আশা করি তাহলে তা আদায় করে নেবার জন্য অসহযোগ আন্দোলনই হবে সর্বোত্তম পন্থা। তিনি আরো বলেন, খিলাফত সমস্যারও এতে সুষ্ঠু সমাধান হবে।

উক্ত অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন লালা লাজপত রায় এবং প্রধান বক্তা ছিলেন মিঃ সি. আর. দাশ। এঁরা দুজনেই গান্ধীজীর সঙ্গে একমত হতে পারেননি। বিপিনচন্দ্র পালও গান্ধীজীর প্রস্তাব পুরোপুরি মেনে নিতে চান না। তিনি বলেন, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হলো বিলাতী পণ্য বয়কট করা। কিন্তু তাঁদের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অসহযোগের প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে গৃহীত হয়।

গান্ধীজী তখন আসন্ন আন্দোলন সম্পর্কে দেশবাসীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং তাঁদের কাছে অসহযোগ আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সফর করতে শুরু করেন। তাঁর সেই সফরের সময় আমি প্রায়ই তাঁর সঙ্গে থাকতাম। মহম্মদ আলী এবং শৌকত আলীও মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে থাকতেন।

ডিসেম্বর মাসে নাগপুর শহরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হয়। ইতিমধ্যে দেশবাসীর মনোভাব অসহযোগের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মিঃ সি. আর. দাশও তখন প্রস্তাবিত আন্দোলনকে প্রকাশ্যেই সমর্থন করলেন। লালা লাজপত রায় প্রথমদিকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও পাঞ্জাবের প্রতিনিধিদের মনোভাব দেখে শেষ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষেই তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, নাগপুরের এই অধিবেশনের সময়েই মহম্মদ আলী জিন্না কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যান।

নাগপুর অধিবেশনের পরেই শুরু হয়ে যায় সরকারী চণ্ডনীতির প্রয়োগ। সারা ভারতের কংগ্রেস নেতাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়। বাংলায় মিঃ সি. আর. দাশ এবং আমি সর্বাগ্রে গ্রেপ্তার হই। গ্রেপ্তার করার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় আলিপুর সেনট্রাল জেলে। কয়েকদিন পরে সুভাষচন্দ্র বসু এবং বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকেও নিয়ে আসা হয় জেলখানায়। আমাদের থাকতে দেওয়া হয় ইয়োরোপীয়ান ওয়ার্ডে, ফলে উক্ত ওয়ার্ডটি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক আলোচনার একটি বিশেষ কেন্দ্র।

কিছুদিন বিচারাধীন অবস্থায় থাকার পর মিঃ সি. আর. দাশ ছ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। আমার বিচার হয় বেশ কিছুদিন পরে। কি কারণে জানি না, আমাকে অনেকদিন বিচারাধীন বন্দী হিসেবে রেখে অবশেষে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আমি প্রকৃতপক্ষে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারির আগে মুক্তি পাইনি। মিঃ সি. আর. দাশ আগেই মুক্তি পান এবং কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। গয়া অধিবেশনের সময় কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। সি. আর. দাশ, মতিলাল নেহরু এবং হাকিম আজমল খাঁ স্বরাজ্য দল গঠন করে আইনসভায় প্রবেশ করার পক্ষে অভিমত জ্ঞাপন করেন। পক্ষান্তরে গান্ধীজীর অনুগামী রক্ষণশীল নেতারা তাঁদের বিরোধিতা করেন। ফলে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠান সংস্কারবাদী (pro-changers) এবং রক্ষণশীল (no changers) এই উভয় শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। আমি জেল থেকে মুক্তি পাবার পরে উভয় দলের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হই। আমার এই প্রচেষ্টার ফলে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে বিবদমান দল দুটির মধ্যে একটা আপস হয়ে যায়। স্থির হয়, উভয় দলই কংগ্রেসের মধ্যে থাকবে এবং কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই যে যার পথে চলতে পারবে। কংগ্রেসের সেই বিশেষ অধিবেশনে আমাকেই সভাপতি করা হয়। আমার বয়স তখন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। এত কম বয়সে আমার আগে আর কেউ কংগ্রেসের সভাপতি হননি।

১৯২৩ সনের পরে কংগ্রেসের ক্রিয়াকলাপ প্রধানত স্বরাজ্য দলের হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়। এই দল প্রায় সব প্রদেশের আইনসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পার্লামেন্টারী পথে সংগ্রাম শুরু করে। স্বরাজ্য দলের বাইরে যারা ছিলেন তাঁরা তখন গঠনমূলক কাজ শুরু করেন, কিন্তু স্বরাজ্য দলের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন না। এই সময় এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে যার ফলে ভারতের রাজনীতিতে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, কিন্তু সেসব কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছে না। ওসব বিষয় জানতে হলে পাঠকদের আরো কিছুদিন, অর্থাৎ আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলছি।

১৯২৮ সনে সাইমন কমিশনের নিযুক্তি এবং সেই কমিশনের ভারত ভ্রমণের ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। ১৯২১ সনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে এক নোটিস দিয়ে জানিয়ে দেয়, এক বছরের মধ্যে জাতীয় দাবি মেনে না নিলে কংগ্রেস সারা ভারত জুড়ে এক গণআন্দোলন শুরু করবে। ইংরেজরা আমাদের সে দাবিকে কোনোরকম আমলই দেয় না। কংগ্রেস তখন ১৯৩০ সনে লবণ আইন অমান্যের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হবার মুখে অনেকেই এর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু সত্যাগ্রহের পরবর্তী চেহারা এবং ব্যাপকতা দেখে সরকার ও দেশের জনসাধারণ রীতিমতো বিস্মিত হয়ে পড়ে। সত্যাগ্রহের ব্যাপকতা দেখে সরকার কড়া ব্যবস্থা অবলম্বন করে। তারা তখন কংগ্রেসকে বে-আইনী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে এবং কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সহ ওয়ার্কিং কমিটির প্রত্যেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দেয়। সরকার যে এইরকম একটা কিছু করবে তা আমরা আগেই অনুমান করেছিলাম। সুতরাং নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের ফলে কংগ্রেসের কাজকর্ম যাতে বন্ধ না হয় তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে স্থির করেছিলাম, একজন প্রেসিডেন্ট গ্রেপ্তার হবার সঙ্গে সঙ্গে আর একজন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর ওয়ার্কিং কমিটিও নতুন করে গঠন করবেন। আরো স্থির হয়, নতুন সভাপতি কার্যভার গ্রহণ করেই তাঁর পরবর্তী সভাপতি মনোনীত করে রাখবেন। এই ব্যবস্থা অনুসারে আমি যখন সভাপতি হই তখন আমি আমার ইচ্ছামতো সদস্য নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করি এবং পরবর্তী সভাপতি হিসেবে ডাঃ আনসারীকে মনোনীত করি। ডাঃ আনসারী প্রথমে আন্দোলনে যোগদান করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন কিন্তু আমি তাঁর মত পরিবর্তন করতে সক্ষম হই। এইভাবেই আমরা সরকারী চণ্ডনীতির মোকাবিলা করে আন্দোলনকে চালু রাখি।

মীরাটের এক জনসভায় আমি যে বক্তৃতা করি তার ফলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরে আমাকে প্রায় দেড় বছর মীরাট জেলে বন্দী করে রাখা হয়।

এক বছরেরও বেশি এইভাবে আন্দোলন চলবার পর তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড আরউইন গান্ধীজীকে এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের যুক্তি দেন। বলা বাহুল্য, আমিও সেই সময় মুক্তিলাভ করি। মুক্তিলাভের পর প্রথমে আমরা এলাহাবাদে এবং তারপর দিল্লীতে মিলিত হই। এই সময় গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে সব কংগ্রেসকর্মীকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং বিলাতে গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস অংশগ্রহণ করবে বলে স্থির হয়। কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে গান্ধীজীকে বিলাতে পাঠানো হয়। কিন্তু গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা ফলপ্রসূ হয় না এবং গান্ধীজী খালি হাতে ফিরে আসেন। লণ্ডন থেকে ফিরে আসার পরেই গান্ধীজীকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং নতুন করে দমননীতি চালানো হতে থাকে। নতুন ভাইসরয় লর্ড উইলিংডন কংগ্রেস এবং তার যাবতীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম বলে আমাকে দিল্লী জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এক বছরেরও বেশি আমি দিল্লী জেলে বন্দীজীবন যাপন করি। এই সময় এমন সব ঘটনা ঘটে যেগুলো ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষভাবে চিহ্নিত হবার মতো। তবে এখানে আমি সেসব ঘটনা সম্বন্ধে আলোচনা করছি না। এ বিষয়েও পাঠকদের প্রথম খণ্ডের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

১৯৩৫ সনে ভারত শাসন আইন (Government of India Act) বিধিবদ্ধ হয়। উক্ত আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং কেন্দ্রে একটি ফেডারেল সরকার গঠনের ব্যবস্থা হয়। এখান থেকেই আমার এই কাহিনীর সূত্রপাত, অর্থাৎ বর্তমান গ্রন্থে এখান থেকেই আলোচনা শুরু হবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন