৯. ভারত ছাড়ো প্রস্তাব
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ওয়ার্ধায় ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা হয়।
ওই সভায় যোগ দেবার জন্য আমি ৫ই জুলাই ওয়ার্ধায় উপস্থিত হই। সেই সময় গান্ধীজী আমার কাছে সর্বপ্রথমে তার প্রস্তাবিত ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের কথা বলেন। তাঁর এই নতুন পরিকল্পনা আমি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিলো আমরা একটা অসাধারণ অবস্থার সম্মুখীন হতে চলেছি। আমাদের সহানুভূতি সব সময়ই মিত্রপক্ষের দিকে ছিলো কিন্তু ইংরেজ সরকারের মিত্রপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। একমাত্র স্বাধীন জাতি হিসেবেই আমরা মিত্রপক্ষের পাশে দাঁড়াতে পারতাম, কিন্তু ইংরেজরা আমাদের সে সুযোগ দেয়নি। তারা সব সময় আমাদের পদানত করে রাখতে চায়।
এদিকে জাপানীরা তখন ব্রহ্মদেশ অধিকার করে আসাম অভিমুখে এগিয়ে আসছে। আমি তাই মনে করি, এ সময় আমাদের এমন কিছু করা বা বলা উচিত হবে না যাতে জাপানীরা ভাবতে পারে, আমরা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আমার মনে হয়, এই সময় আমাদের উচিত হবে ঘটনাবলীর দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখা। গান্ধীজী কিন্তু এতেও সম্মত নন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, এখন আমাদের সামনে যে সুযোগ উপস্থিত হয়েছে কংগ্রেস সেই সুযোগ গ্রহণ করে ইংরেজদের অবিলম্বে ভারত ত্যাগ করতে বলবে। ইংরেজরা যদি আমাদের এই দাবি মেনে নেয় তাহলে আমরা জাপানীদের আর বেশী অগ্রসর হতে নিষেধ করবো। তা সত্ত্বেও তারা যদি এগিয়ে আসতে থাকে তাহলেই শুধু মনে করা হবে, ভারত আক্রমণ করাই তাদের উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, এরকম অবস্থার সৃষ্টি হলে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে জাপানীদের প্রতিরোধ করবো।
আমি আগেই বলেছি, যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই আমি ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে চেয়েছিলাম। সে সময় গান্ধীজী আমার কথায় কান দেননি। এখন তাঁর মতের পরিবর্তন দেখে আমি রীতিমতো বিস্মিত হই। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি, ইংরেজবাহিনী ভারতে মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের দাবি মেনে নেবে এবং আমাদের আন্দোলন সহ্য করবে। গান্ধীজী কিন্তু এইরকমই বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, কংগ্রেসের আন্দোলনে ইংরেজরা কোনোরকম বাধা দেবে না বলেই তিনি মনে করেন। আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন বলতে তিনি কী বোঝাতে চান, তার কোনো সদুত্তরই তিনি দিতে পারেননি। তিনি শুধু এই কথাই বলেন, এবারের আন্দোলনে কেউ বিনা বাধায় গ্রেপ্তার বরণ করবে না।
আমি কিন্তু জাপানীদের মতিগতি সম্বন্ধে ভিন্ন ধারণা পোষণ করতাম। তাদের কোনো কথাই আমি বিশ্বাস করতাম না। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিলো, ইংরেজরা পশ্চাদপসরণ করবার সঙ্গে সঙ্গেই জাপানীরা ভারত আক্রমণ করবে, সুতরাং গান্ধীজী যে কথা বলেছিলেন আমি তা বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মতে, এর ফলে জাপানীরা ভারত আক্রমণ করতে আরো বেশী অনুপ্রাণিত হবে এবং ইংরেজের পশ্চাদপসরণের সুযোগে তারা ভারতবর্ষ অধিকার করে নেবে।
গান্ধীজী বলতে চান, তাঁর প্রস্তাবিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইংরেজরা কোনোরকম ব্যবস্থা অবলম্বন করবে না। এবং এর ফলে তিনি আন্দোলনকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট সময় পাবেন এবং আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও স্থির করতে পারবেন। আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস, এটা কখনো সম্ভব হবে না। কংগ্রেস যদি এই ধরনের কোনো প্রস্তাব পাস করে তাহলে সরকার কিছুতেই নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না। তারা তখন গান্ধীজী এবং কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দী করে রাখবে। আর, তা যদি হয়, তাহলে নেতৃত্বের অভাবে সারা দেশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় এসে যাবে এবং সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে জাপানীরা ভারত আক্রমণ করলে নেতৃত্বহীন দেশবাসী তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারবে না। জনসাধারণ কংগ্রেসের ডাকে সাড়া দেয়, তার কারণ হলো, গান্ধীজীর ওপরে তাদের অখণ্ড বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু তিনি এবং তার সহকর্মীরা যদি কারাগারে বন্দী হয়ে থাকেন তাহলে জনসাধারণ তাদের করণীয় কী হবে তা বুঝতেই পারবে না।
এইসব কথা চিন্তা করে অবশেষে আমি স্থির করি, জনসাধারণের উৎসাহ এবং উদ্দীপনা যাতে স্তিমিত না হয় তার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। সরকার যদি গান্ধীজীকে তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধা না দেয় তাহলে গান্ধীজীর নেতৃত্বে সে আন্দোলন অহিংস পদ্ধতিতেই চালিত হবে। কিন্তু আমরা সবাই যদি কারাগারে আবদ্ধ থাকি তাহলে আন্দোলন পরিচালনা করবার এবং জনসাধারণকে সঠিকভাবে চালিত করবার মতো কোনো নেতৃত্বই থাকবে না। এবং সে অবস্থায় জনসাধারণ হিংসা ও অহিংসার প্রশ্ন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আন্দোলন চালাতে থাকবে।
ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এই বিষয়টি আমি পরিষ্কারভাবে সদস্যদের সামনে তুলে ধরি। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে একমাত্র জওহরলাল ছাড়া আর কেউ আমাকে সমর্থন করলেন না; তবে তিনিও আমাকে পুরোপুরি সমর্থন করলেন না। অন্যান্য সদস্যরা ব্যাপারটাকে ভালোভাবে অনুধাবন না করেই গান্ধীজীর অভিমতকে সমর্থন করলেন। এটা অবশ্য আমার কাছে নতুন কিছু নয়। আগেও লক্ষ্য করেছি, একমাত্র জওহরলাল ছাড়া আর সবাই অন্ধভাবে গান্ধীজীর কথামত চলেন। সর্দার প্যাটেল, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং আচার্য কৃপালনীর যুদ্ধ সম্বন্ধে কোনোরকম সুস্পষ্ট ধারণাই ছিলো না। তাঁরা তাই নিজেদের বিচারবুদ্ধি অনুসারে ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ না করে গান্ধীজীর কথাতেই সায় দিতেন। আমার তাই মনে হয় ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। ওঁদের কথা হলো, ‘গান্ধীজীর ওপরে আমাদের বিশ্বাস রাখতেই হবে।’ ওঁরা মনে করতেন, গান্ধীজী একটা না একটা পথ অবশ্যই বের করবেন। এই প্রসঙ্গে ওঁরা ১৯৩০ সালের লবণ সত্যাগ্রহের কথা উল্লেখ করেন। লবণ সত্যাগ্রহ যখন শুরু হয় তখন অনেকেই জানতেন না ভবিষ্যতে সে আন্দোলন কিরকম রূপ নেবে। এমন কি সরকারও প্রথম দিকে লবণ সত্যাগ্রহকে একটি তামাশার ব্যাপার বলে মনে করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে আন্দোলন যখন ব্যাপকভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সরকার তখন বাধ্য হয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে একটি আপসে আসে। সর্দার প্যাটেল এবং তাঁর অনুগামী বন্ধুরা তাই মনে করেছিলেন এবারেও গান্ধীজী ঠিক সেইভাবেই সাফল্য অর্জন করবেন। আমার কিন্তু মোটেই তা মনে হয়নি।
গান্ধীজীর অভিমত হলো, যুদ্ধটা যেহেতু ভারতের দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়েছে, সেইহেতু আন্দোলন শুরু করার এইটাই হলো প্রকৃষ্ট সময়। তাঁর মতে, কংগ্রেস যদি এই সময় গণ-আন্দোলন শুরু করে, তাহলে ইংরেজরা অবশ্যই কংগ্রেসের সঙ্গে আপসরফা করতে চেষ্টা করবে। আর এটা যদি তারা নাও করে, তাহলেও তারা কোনো গুরুতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। এবং এর ফলে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নির্ধারণ করার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। আমার বিশ্লেষণ কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। আমি মনে করতাম, যুদ্ধের পরিস্থিতি যখন জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে এসে গেছে, তখন সরকার কিছুতেই কংগ্রেসকে গণ-আন্দোলন চালিয়ে যেতে দেবে না। সরকার তথা ইংরেজের পক্ষে এটা একটা বিপজ্জনক সময় এবং যুদ্ধটা তাদের মরণবাঁচন সমস্যায় এসে পৌঁছেছে; সুতরাং এ সময়ে ভারতে যদি গণ-আন্দোলন শুরু হয়, তাহলে তারা সে আন্দোলনকে দমন করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। আমি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, আমরা গণ-আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকার কংগ্রেসের প্রত্যেক নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করবে। এবং তারপর কী হবে, সে কথা কেউই বলতে পারে না।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম, তৎকালীন পরিস্থিতিতে কোনো গণ-আন্দোলন অহিংসভাবে চালানো সম্ভব ছিল না। গণ-আন্দোলন ততক্ষণই অহিংস থাকে, যতক্ষণ নেতারা উপস্থিত থেকে আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নেতারা বন্দি হবেন। আমার আরো মনে হচ্ছিল, কংগ্রেস যদি অহিংসার ওপর জোর না দেয়, তাহলে নেতাদের অনুপস্থিতিতেও আন্দোলন চলবার সম্ভাবনা আছে। নেতৃত্ব যদি নাও থাকে তাহলেও জনগণ নিজে থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাবে। তারা যদি নিজেদের ইচ্ছামতো আন্দোলন চালাবার সুযোগ পায়, তাহলে তারা চলাচল ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটাতে পারে, সেনাবিভাগের ব্যবহার্য জিনিসপত্র এবং মিলিটারি ডিপোগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করতে পারে এবং আরো বহুবিধ উপায়ে ইংরেজের যুদ্ধ-প্রচেষ্টার ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। আমি তাই মনে করি, এইরকম অবস্থার উদ্ভব হলে যে ধরনের গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তার ফলে ইংরেজরা হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা আপসে আসতে বাধ্য হবে। তবে এটা যে একটা বিরাট ঝুঁকি তাতে কোনোই ভুল নেই। কিন্তু ঝুঁকি যদি নিতেই হয়, তাহলে খোলা চোখেই তা নিতে হবে, অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী ঘটবে বা ঘটতে পারে সে কথা জেনেশুনেই গণ-আন্দোলনের ঝুঁকি নিতে হবে। কিন্তু গান্ধীজীর প্রস্তাবিত অহিংস আন্দোলন এ অবস্থায় কী ভাবে চলতে পারে, তা আমার বোধগম্য হয় না।
আমাদের আলোচনা শুরু হয় ৫ই জুলাই এবং সেই আলোচনা চলে কয়েক দিন ধরে। আলোচনার সময় গান্ধীজীর সঙ্গে আমার তীব্র মতবিরোধ হয়। আগেও অনেকবার তাঁর সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়েছে, কিন্তু এবারের মতো তীব্র মতবিরোধ আগে কোনোদিনই হয়নি। অবস্থা চরমে পৌঁছায় যখন গান্ধীজী আমাকে একটি চিঠি লিখে জানিয়ে দেন, আমাদের মধ্যে মতবিরোধ এমন তীব্র হয়ে উঠেছে যার ফলে তাঁর পক্ষে আমার সঙ্গে একত্রে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চিঠিতে তিনি আরো লেখেন, কংগ্রেস যদি তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেয় তাহলে আমাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে এবং ওয়ার্কিং কমিটি থেকে সরে যেতে হবে। জওহরলালের সম্বন্ধেও তিনি একই কথা বলেন, অর্থাৎ তাঁকেও ওয়ার্কিং কমিটি থেকে সরে যেতে হবে। এই চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি জওহরলালকে খবর দিয়ে এনে গান্ধীজীর চিঠিখানা তাঁকে দেখাই। কিছুক্ষণ পরে সর্দার প্যাটেল আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং গান্ধীজীর চিঠি দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীজীর কাছে চলে যান এবং এ ব্যাপারে তীব্রভাবে আপত্তি জানান। তিনি গান্ধীজীকে বলেন, আমি যদি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যাই এবং আমি আর জওহরলাল ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বিদায় নিই তাহলে সারা ভারতে এক গুরুতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। এতে জনসাধারণের মনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি তো হবেই, উপরন্তু কংগ্রেসের ভিত্তিমূলই এর ফলে বিচলিত হয়ে উঠবে।
গান্ধীজী আমাকে ওই চিঠিটি লিখেছিলেন ৭ই জুলাই সকালে। ওই দিনই দুপুরের দিকে তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, সকালে তিনি তাড়াতাড়ি করে চিঠিখানা লিখেছিলেন, কিন্তু পরে এ বিষয়ে আরো চিন্তা করে তিনি চিঠিখানা প্রত্যাহার করে নেবেন বলে স্থির করেছেন। গান্ধীজীকে এইভাবে নতি স্বীকার করতে দেখে আমিও আর তাঁর সঙ্গে বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হই না এবং তাঁর অভিমতই মেনে নিই।
এরপর বেলা তিনটের সময় যখন ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে তখন গান্ধীজী বলেন, মৌলানার কাছে অন্যায়কারী ফিরে এসেছে। আমরা তখন ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব, প্রস্তাবিত আন্দোলনের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করি। এই সময় গান্ধীজী বলেন, অন্যান্য বারের মতো এবারের আন্দোলনও অহিংস পদ্ধতিতেই চলবে এবং হিংসার পন্থা ছাড়া যে-কোনো পন্থা অবলম্বিত হবে। এই সময় জওহরলাল বলেন, গান্ধীজী যা বলছেন তা প্রকৃতপক্ষে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর মতে এটাকে ‘অহিংস বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দেওয়া যায়। জওহরলালের দেওয়া এই সংজ্ঞাটি গান্ধীজীর খুবই মনঃপূত হয়। তিনিও তখন প্রস্তাবিত আন্দোলনকে ‘অহিংস বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দেন।
এরপর ১৪ই জুলাই ওয়ার্কিং কমিটি নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি পাস করে:
দিনের পর দিন যেসব ঘটনা ঘটছে এবং ভারতের জনসাধারণ যেসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসকর্মীরা মনে করে, ভারতে ইংরেজ শাসনের এখনই অবসান হওয়া দরকার। বিদেশী শাসন জনগণের পক্ষে শুধুমাত্র অপমানজনক বলেই নয়, পরন্তু ভারতীয়রা পরাধীন থাকার ফলে দেশের প্রতিরক্ষার ব্যাপারেও তারা কিছু করতে পারছে না এবং যে যুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির ওপরে এক মহা অভিশাপরূপে দেখা দিয়েছে তার বিরুদ্ধেও কোনোরকম ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারছে না। ভারতের স্বাধীনতা শুধু যে তার নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন তাই নয়, পৃথিবীকে বিপন্মুক্ত করার জন্য এবং নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ এবং জঙ্গীবাদ প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদের অপরাপর পদ্ধতির অবসানের জন্য এবং এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির ওপরে প্রভুত্বের অবসানের জন্যও এর প্রয়োজন আছে।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার সময় থেকেই কংগ্রেস ব্রিটেনকে বিব্রত করতে চায়নি; এমনকি সত্যাগ্রহ আন্দোলন করতেও সে চায়নি। কংগ্রেস মনে করেছিলো, ইংরেজরা তার এই সদিচ্ছা ও সুনীতিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে দেশের শাসনভার ছেড়ে দেবে যার ফলে ভারতের জনগণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জনগণের মতো স্বাধীনতার স্বাদ উপলব্ধি করতে পারবে এবং সেই অনুসারে কাজ করতে পারবে। কংগ্রেস আরো মনে করেছিলো, ইংরেজরা এমন কিছু করবে না যার ফলে ভারতের ওপরে তাদের অধিকার এবং প্রভুত্ব আরো দৃঢ় হবে।
কিন্তু তার এই আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ক্রিপস-প্রস্তাব দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতের প্রতি ইংরেজের মতিগতির কোনোই পরিবর্তন হয়নি। উক্ত প্রস্তাব দ্বারা আরো বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতের ওপর থেকে ইংরেজরা তাদের বজ্রমুষ্টি কোনোরূপেই শিথিল করবে না। স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে আলোচনার সময় কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলো জাতীয় দাবির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ন্যূনতম ক্ষমতাও অন্তত ভারতীয়দের হাতে অর্পণ করা হবে; কিন্তু সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। ভারতবাসীর প্রতি এইরকম অবজ্ঞা আর অবিশ্বাসের ফলে তাদের মনে ইংরেজের প্রতি ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাপানের প্রতিও তারা সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। ওয়ার্কিং কমিটি এইসব বিষয় লক্ষ্য করে গভীরভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কমিটি মনে করে, এখনই এর অবসান ঘটাতে না পারলে দেশবাসীর এই মনোভাব পরোক্ষভাবে শত্রুপক্ষকেই সাহায্য করবে। কমিটি আরো মনে করে, সব রকম আক্রমণকেই প্রতিরোধ করা দরকার, কারণ আক্রমণকারীর প্রতি দেশবাসীর সহানুভূতির অর্থ তাদের নৈতিক অধঃপতন। ভারতেও মালয়, সিঙ্গাপুর এবং ব্রহ্মদেশের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয় কংগ্রেস তা চায় না। এবং এই কারণেই সে যথোপযুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে জাপান এবং যে-কোনো আক্রমণকারীর মোকাবিলা করতে চায়।
ইংরেজের প্রতি ভারতীয়দের মনে যেরকম ক্রোধ ও ঘৃণার সঞ্চার হয়েছে কংগ্রেস তার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশবাসীকে ইংরেজের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সদিচ্ছাপরায়ণ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু এটা সম্ভব হতে পারে একটি মাত্র উপায়ে এবং সে উপায়টি হলো ভারতীয়দের হৃদয়কে স্বাধীনতা-দীপালোকে আলোকিত করা।
কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা দেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে; কিন্তু ভারতের বুকে বিদেশী শক্তির অবস্থানের জন্যই তার এই শুভ প্রচেষ্টা সাফল্যলাভ করতে পারেনি। এই বিদেশী শক্তির অতীত ক্রিয়াকলাপ থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারা গেছে, সে ‘বিভক্ত করে শাসন’-এর নীতি গ্রহণ করে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রেখে তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। বিদেশীদের আধিপত্যের অবসান ঘটলেই বর্তমান অশান্ত অবস্থা পুনরায় শান্ত হয়ে আসবে এবং জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে ভারতের জনসাধারণ তাদের নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারবে। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো ইংরেজের প্রসাদলাভ করে তাদের সাহায্য করবার উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছে। বিদেশীদের আধিপত্যের অবসান হলে এইসব রাজনৈতিক দলও আর কোনো কাজ বা অকাজ করবার সুযোগ পাবে না। ভারতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই বোধের সৃষ্টি হবে: রাজা, জমিদার, জায়গীরদারও ভূম্যধিকারী এবং ধনবান ব্যক্তিরা যেসব চাষী ও শ্রমিকদের শোষণ করে এসেছে, এবার সেই শোষিত মানুষদের হাতেই ক্ষমতা আসছে। ভারতের বুক থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান হবার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব-শীল ব্যক্তিরা এগিয়ে এসে সাময়িকভাবে তাদের সরকার গঠন করবে; তারপর ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা একত্রে বসে এমন এক পরিকল্পনা গ্রহণ করবে যার দ্বারা একটি গণপরিষদ গঠিত হবে এবং সেই গণপরিষদ এমন এক সংবিধান রচনা করবে যা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতবাসীর গ্রহণীয় হবে। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের প্রতিনিধিরা এবং গ্রেট ব্রিটেনের প্রতিনিধিরা একত্রে বসে উভয় দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কিরকম হবে এবং উভয় দেশ কিভাবে একে অপরের মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে শত্রুর মোকাবিলা করবে তা স্থির করবে। শত্রুকে যথোপযুক্তভাবে প্রতিরোধ করাই হলো কংগ্রেসের মুখ্য উদ্দেশ্য। এবং এই উদ্দেশ্য সে জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও সদিচ্ছার সাহায্যেই সাধন করবে।
ভারত থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটাবার প্রস্তাব করা হলেও গ্রেট ব্রিটেন এবং মিত্রপক্ষকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ব্যাপারে কোনোরকম বিব্রত করবার ইচ্ছা কংগ্রেসের নেই। তাছাড়া শত্রুপক্ষকে ভারত আক্রমণের সুযোগ দেবার অথবা চীনের ওপরে জাপান অথবা অক্ষশক্তির অপর কোনো দেশ কর্তৃক চাপ বৃদ্ধি করবার প্রচেষ্টাকেও কংগ্রেস সর্বতোভাবে বাধা দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মিত্রপক্ষের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কোনোরকম খর্ব করবার বাসনাও কংগ্রেসের নেই। জাপানী আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য এবং চীনকে সাহায্য করবার জন্য মিত্রপক্ষ যদি ভারতের বুকে তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখতে চায় তাতেও কংগ্রেসের কোনো আপত্তি নেই।
এখানে আরো প্রকাশ থাকে যে, ভারত থেকে ব্রিটিশ শক্তির অপসারণ প্রস্তাব দ্বারা সকল ইংরেজকে ভারত থেকে বিদায় নেবার কথা বলা হচ্ছে না। যেসব ইংরেজ ভারতের নাগরিক হিসেবে ভারতে বসবাস করতে ইচ্ছুক তারা প্রত্যেকেই ভারতবাসীর সঙ্গে সমান সুযোগ-সুবিধে নিয়ে ভারতে থাকতে পারবেন। এই সম্পর্কে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ওয়ার্কিং কমিটি বিষয়টিকে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কাছে পেশ করছে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভা আগামী ৭ই আগস্ট (১৯৪২) বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হবে।
ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতের বুকে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ চলতে শুরু করে। প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিবেচনা না করে জনসাধারণ মনে করতে থাকে, ইংরেজদের ভারত থেকে বিদায় করবার জন্য কংগ্রেস খুব শিগগিরই এক গণ-আন্দোলন শুরু করবে। বাস্তবক্ষেত্রেও দেখা যায়, জনগণ এবং সরকার উভয়েই এই প্রস্তাবকে ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব বলে মনে করছে। ওয়ার্কিং কমিটির কতিপয় সদস্যের মতো ভারতের জনসাধারণেরও গান্ধীজীর ওপরে একটা অখণ্ড বিশ্বাস ছিলো। তারা মনে করতো, গান্ধীজীর মনে এমন কোনো উদ্দেশ্য আছে যার দ্বারা তিনি সরকারকে অচল করে ফেলে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে পারবেন। এই প্রসঙ্গে আমি আরো একটি কথা বলতে চাই, ভারতে তখন এমনও অনেক লোক ছিলো যারা মনে করতো গান্ধীজী কোনোরকম অলৌকিক ক্ষমতাবলে ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারবেন। এবং এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তারা প্রস্তাবটির ফলাফল সম্বন্ধে কোনোরকম চিন্তাই করলো না।
প্রস্তাব পাস করবার পর ওয়ার্কিং কমিটি সরকারের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করবার উদ্দেশ্যে কয়েকদিন অপেক্ষা করবে বলে স্থির করে। সরকার যদি প্রস্তাবে উল্লিখিত দাবি মেনে নেয় অথবা প্রস্তাব সম্বন্ধে সুবিবেচনার পরিচয় দেয় তাহলে তাদের সঙ্গে পরবর্তী আলোচনায় বসা যাবে। কিন্তু সরকার যদি কংগ্রেসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে গান্ধীজীর নেতৃত্বে সংগ্ৰাম শুরু হবে। আমার মনে কিন্তু কোনোরকম সন্দেহই ছিলো না যে সরকার এই দাবি কিছুতেই মেনে নেবে। পরবর্তী ঘটনাবলীই প্রমাণ করে, আমার ধারণাই সঠিক ছিলো।
বিদেশী সংবাদপত্রের বহুসংখ্যক প্রতিনিধি তখন ওয়ার্ধায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সবাই ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত জানবার জন্য আগ্রহান্বিত ছিলেন। ১৫ই জুলাই গান্ধীজী এক সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন। উক্ত সম্মেলনে কোনো এক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে গান্ধীজী বলেন, আন্দোলন শুরু হলে তা ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে অহিংস বিদ্রোহের রূপ নেবে।
প্রস্তাব পাস হবার পরে গান্ধীজীর সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই মিস স্লেডকে বলেন, তিনি যেন ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবের বিষয়বস্তু তাঁকে বুঝিয়ে দিয়ে আসেন। এখানে মিস স্লেডের একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। ইনি ছিলেন ইংরেজদের নৌ-বাহিনীর একজন অ্যাডমিরালের মেয়ে। কিন্তু ইংরেজ-দুহিতা হয়েও ইনি গান্ধীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর আশ্রয়ে বাস করতে থাকেন। ইনি মীরা বেন নামে জনসাধারণের কাছে সমধিক পরিচিতা ছিলেন।
মিস স্লেডকে বলা হয়েছিলো, কংগ্রেসের প্রস্তাবিত আন্দোলন কিভাবে চলবে সে কথা যেন তিনি ব্যাখ্যা করে ভাইসরয়কে বুঝিয়ে দেন।
মহাদেব দেশাইয়ের কথামতো মিস স্লেড ওয়ার্ধা থেকে দিল্লীতে গিয়ে ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু ভাইসরয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারি তাঁকে জানিয়ে দেন, গান্ধীজী তাঁর প্রস্তাবিত আন্দোলনকে ‘বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দেওয়ায় ভাইসরয় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সম্মত নন। প্রাইভেট সেক্রেটারি তাঁকে সুস্পষ্টভাবে বলে দেন, যুদ্ধের সময় সরকার কোনোরকম বিদ্রোহ বরদাস্ত করবে না—সে বিদ্রোহ হিংসই হোক বা অহিংসই হোক। তাছাড়া যে প্রতিষ্ঠান বিদ্রোহের কথা বলে তার কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে সরকার কোনোরকম আলোচনা করতেও ইচ্ছুক নয়।
ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে মীরা বেন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। আমি তখন দিল্লীতে ছিলাম বলে তিনি সেই আলোচনার বিষয়বস্তু আমাকেও জানিয়ে দেন। এরপর তিনি ওয়ার্ধায় ফিরে গিয়ে গান্ধীজীকেও সব কথা জানিয়ে দেন।
এর কয়েকদিন পরেই মহাদেব দেশাই সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, গান্ধীজীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বিভিন্ন মহলে নানারকম ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। গান্ধীজী ইংরেজদের বিরুদ্ধে অহিংস বিদ্রোহ শুরু করবেন বলে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা মোটেই ঠিক নয়।
মহাদেব দেশাইয়ের এই বিবৃতি পড়ে আমি রীতিমতো বিস্মিত হই। আসল ব্যাপার হলো, ‘অহিংস বিদ্রোহ’ কথাটা প্রথম জওহরলাল ব্যবহার করেন এবং তার পর থেকেই গান্ধীজী ওই কথাটা বলতে শুরু করেন। তিনি হয়তো কথাটাকে একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এবং সে সম্বন্ধে নিজের মনে একটি ব্যাখ্যাও তৈরি করে রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখ থেকে ওই কথাটা শুনে জনসাধারণের মনে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয় যে কংগ্রেস এবার ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করবার জন্য অহিংস পদ্ধতিতে বলপ্রয়োগ করবে। আমি আগেই বলেছি, গভর্নমেন্টের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আমার মনে কোনোরকম ভ্রান্ত ধারণা ছিলো না। সুতরাং গান্ধীজী অথবা তাঁর প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে ভাইসরয়ের অসম্মতির কথা শুনে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি।
এরপর বোম্বাইতে এ. আই. সি. সি.-র সভা আহ্বান করা হয়। স্থির হয়, ১৯৪২-এর ৭ই আগস্ট উক্ত সভা অনুষ্ঠিত হবে এবং সেই সভায় এই বিষয়টি আলোচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
১৪ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত আমি সারা দেশময় উল্কার মতো ছোটাছুটি করে বিভিন্ন অঞ্চলের কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করি। আমি তাঁদের বুঝিয়ে দিতে চাই, সরকার যদি আমাদের দাবি মেনে নেয় কিংবা নিদেনপক্ষে তারা যদি আমাদের আন্দোলনে বাধা না দেয় তাহলে আমাদের এই আন্দোলনটা গান্ধীজীর নির্দেশ অনুসারেই চলবে। কিন্তু সরকার যদি গান্ধীজী এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করে তাহলে হিংসা-অহিংসার কথা বিবেচনা না করে জনসাধারণ তাদের ইচ্ছামতো আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ সরকার যদি হিংসাপদ্ধতি গ্রহণ করে তাহলে যে-কোনো উপায়ে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। নেতারা যতোদিন বাইরে থাকবেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন ততোদিন আন্দোলনের নেতৃত্ব তাঁদের হাতেই থাকবে। কিন্তু সরকার যদি তাদের গ্রেপ্তার করে তাহলে ফলাফলের জন্য তারাই দায়ী হবে। স্বাভাবিক কারণেই এইসব নির্দেশ গোপন রাখা হয়েছিলো। আন্দোলন সম্পর্কে আমি বুঝতে পেরেছিলাম তা হলো: বাংলা, বিহার, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বোম্বাই এবং দিল্লী সর্বতোভাবে প্রস্তুত ছিলো। ওইসব প্রদেশে আন্দোলন যে ব্যাপকভাবে চলবে তাও বুঝতে পেরেছিলাম। সে সময় আসাম ছিলো ইংরেজদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্র। ওখানে তখন প্রচুরসংখ্যক সৈনিক এবং সেনানায়ক উপস্থিত ছিলো। এই কারণে ওখানে কোনোরকম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করা সম্ভব ছিলো না। ওখানে যা কিছু করতে হবে তার সবই করা হবে বাংলা এবং বিহারের মাধ্যমে এবং এই কারণে উক্ত প্রদেশ দুটোর গুরুত্ব ছিলো অত্যন্ত বেশি। অন্যান্য প্রদেশগুলোকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতেও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম। তবে বলতে বাধা নেই, সেসব প্রদেশের প্রকৃত অবস্থা আমি সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।
ভাইসরয় মীরা বেনের সঙ্গে দেখা করতে অসম্মত হবার ফলে গান্ধীজী বুঝতে পারেন গভর্নমেন্ট সহজে নতি স্বীকার করবে না। সুতরাং তাঁর মনে যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিলো তা কিছুটা শ্লথ হয়ে আসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মনে করেছিলেন, গভর্নমেন্ট হয়তো গুরুতর কিছু করবে না। তিনি তাই স্থির করেছিলেন, এ. আই. সি. সি.-র মিটিংয়ের পরে আন্দোলন কিভাবে চালানো হবে তার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করবার মতো যথেষ্ট সময় তিনি পাবেন এবং সেই পরিকল্পনা অনুসারে আন্দোলনকে ব্যাপকতর করে তুলতে পারবেন। আমি কিন্তু এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করতাম। ২৮শে জুলাই আমি গান্ধীজীর কাছে বিস্তারিতভাবে একটি চিঠি লিখে তাতে জানিয়ে দিই, সরকার সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়ে আছে এবং বোম্বাইতে এ. আই. সি. সি.-র মিটিং শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তারা তাদের কাজ করবে। এর উত্তরে গান্ধীজী লেখেন, তিনি নিজেও এ বিষয়ে ঘটনাবলীর দিকে লক্ষ্য রাখছেন এবং তিনি এখনো বিশ্বাস করেন কোনো-না-কোনো পথ নিশ্চয়ই বের করা যাবে। সুতরাং আমি যেন তাড়াতাড়ি করে কোনোরকম সিদ্ধান্ত না নিই।
৩রা আগস্ট আমি কলকাতা থেকে বোম্বাই রওনা হই। সেই সময় আমার কেন যেন মনে হয়েছিলো, এবার আমি দীর্ঘদিনের জন্য কলকাতা পরিত্যাগ করছি। আমি যেসব খবর পেয়েছিলাম তা থেকে জানতে পেরেছিলাম, সরকার এমনভাবে প্রস্তুত হয়ে আছে যে কংগ্রেস তার প্রস্তাব পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই তারা কংগ্রেসের সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করবে।
৫ই আগস্ট ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে। সেই সভায় কমিটি একটি খসড়া প্রস্তাব রচনা করে এবং খসড়া প্রস্তাবটি ৭ই আগস্ট এ. আই. সি. সি.-র সামনে পেশ করা হয়। আমার উদ্বোধনী ভাষণে আমি এ. আই. সি. সি.-র বিগত অধিবেশনের পরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিই। ওয়ার্কিং কমিটি কেন তার পূর্ব অভিমত পরিহার করে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাতিকে এক নতুন আন্দোলনে নামবার জন্য ডাক দিয়েছে, তার কারণও আমি সংক্ষেপে ব্যক্ত করি। আমি আরো বলি, জাতির ভাগ্য যখন দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে তখন সে কিছুতেই নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারে না। ভারত গণতান্ত্রিক পক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলো কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতের এই সদিচ্ছাকে কার্যে পরিণত করতে দেননি। এদিকে জাপানী আক্রমণ আসন্ন হয়ে পড়ায় জাতির পক্ষে আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ইংরেজরা যেভাবে সিঙ্গাপুর, মালয় এবং ব্রহ্মদেশ থেকে সরে এসেছে, তারা ইচ্ছা করলে ভারত থেকেও সেইভাবে সরে যেতে পারে। কিন্তু ইংরেজরা সরে গেলেও ভারতবাসীরা তাদের নিজের মাতৃভূমি পরিত্যাগ করতে পারে না। অতএব ইংরেজের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করবার জন্য শক্তি সঞ্চয় করা জাতির পক্ষে আরো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সামান্য-সংখ্যক কমিউনিস্ট বাদে এ. আই. সি. সি.-র প্রায় সব সদস্যই ওয়ার্কিং কমিটির খসড়া প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। গান্ধীজীও এই সভায় বক্তৃতা করেন। দুদিন উক্ত খসড়া প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা এবং বিচার- বিবেচনা করবার পর ৮ই আগস্ট বিপুল ভোটাধিক্যে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করা হয়। এ. আই. সি. সি.-র প্রস্তাবটি এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে দেখতে পাওয়া যাবে।
আমি বোম্বাই গেলে প্রায়ই ভুলাভাই দেশাইয়ের বাড়িতে থাকতাম। এবারেও আমি সেখানেই উঠলাম। শ্রীদেশাই তখন অসুস্থ ছিলেন। কিছুদিন যাবৎ তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। আমি এ. আই. সি. সি.-র মিটিংয়ের পরে যখন ভুলাভাইয়ের বাড়িতে ফিরলাম তখন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, ভুলাভাই আমার জন্য জেগে বসে আছেন। তখন বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলে। আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো শুয়ে পড়েছেন। তাঁকে জেগে থাকতে দেখে আমি বলি, অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকাটা তাঁর উচিত হয়নি। কিন্তু আমার কথায় কান না দিয়ে তিনি বললেন, মহম্মদ তাহের নামে আমার এক আত্মীয় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাহের সাহেব বোম্বাইতে ব্যবসা করতেন। শ্রীদেশাই বললেন, তিনি আমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন, কিন্তু আমি আসছি না দেখে তিনি ভুলাভাইয়ের কাছে একটা খবর দিয়ে গেছেন। বোম্বাইয়ের পুলিস বিভাগে মহম্মদ তাহেরের একজন বন্ধু চাকরি করতেন। তিনি সেই পুলিস অফিসারের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন পরদিন ভোরবেলাতেই কংগ্রেসের সব নেতা গ্রেপ্তার হবেন। তাহের সাহেবের বন্ধু তাঁকে আরো বলেছেন, সঠিকভাবে না জানলেও তিনি যে সংবাদ পেয়েছেন, তা হলো, সবাইকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
কলকাতা থেকে রওনা হবার আগে আমিও এইরকম একটা খবর পেয়েছিলাম। এবার বুঝতে পারলাম সে খবরটা মোটেই ভিত্তিহীন নয়। গভর্নমেন্ট হয়তো ভেবেছে গ্রেপ্তার করবার পর আমাদের ভারতে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে না। এইজন্যই তারা দক্ষিণ আফ্রিকার গভর্নমেন্টের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিলো। হয়তো শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার গভর্নমেন্টের সঙ্গে তাদের মতবিরোধ হয় এবং সেই কারণে তারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। শিগগিরই আমরা জানতে পারি, গান্ধীজীকে পুনা জেলে এবং অন্যান্য নেতাদের আমেদাবাদ ফোর্ট জেলে বন্দী করে রাখা হবে।
তাহের সাহেবের কাছ থেকে খবরটা জানবার পর ভুলাভাই রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এবং এই কারণেই তিনি আমার জন্য জেগে বসেছিলেন। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম বলে ওসব গুজব শোনবার কোনোরকম ইচ্ছা আমার ছিলো না। আমি তাই ভুলাভাইকে বলি, খবরটা যদি সত্যি হয় তাহলে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আমি স্বাধীন থাকতে পারবো। সুতরাং ওসব কথা চিন্তা না করে আমি তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়বো যাতে সকালবেলা আমি ভালোভাবে ঘটনার মোকাবিলা করতে পারি। যে সামান্য সময় আমার স্বাধীনতা আছে, সে সময়টা গুজবের কথা নিয়ে আলোচনা না করে ঘুমিয়ে নেওয়াই সঙ্গত হবে। ভুলাভাইও এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত হন এবং এ ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা না করে শুয়ে পড়েন।
ভোরবেলা কিছুক্ষণ ভ্রমণ করা আমার বহুদিনের অভ্যাস। সেদিনও আমি তাই ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠি। তখনো আমার শরীরের ক্লান্তি দূর হয়নি। আমার মাথাটা তখনো বেশ ভারি বোধ করছিলাম। আমি দুটো অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট এবং এক কাপ চা খেয়ে কাজ করতে বসে যাই। আমরা স্থির করেছিলাম, কংগ্রেসের প্রস্তাবের একটা নকল এবং একখানা চিঠি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে পাঠিয়ে দেবো। ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন বলেই আমরা এটা করতে চেয়েছিলাম। আমি তাই প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে যে চিঠি লেখা হবে তার খসড়া তৈরি করতে শুরু করি। কিন্তু আমার শারীরিক ক্লান্তির জন্যই হোক বা অ্যাসপিরিন ব্যবহারের জন্যই হোক, ঘুমে আমার চোখ বুজে আসছিলো। তাই লেখা বন্ধ করে আবার আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
পনেরো মিনিটও ঘুমোইনি, হঠাৎ কে যেন আমার পায়ে হাত দিচ্ছে বলে মনে হলো। চোখ খুলতেই দেখি ভুলাভাইয়ের ছেলে ধীরুভাই দেশাই একখানা কাগজ হাতে নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাগজখানা যে কী বস্তু তা আমি ওটার দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারি। ওটা যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তা বুঝতে আমার দেরি হয় না। ধীরুভাইও এই কথাই বলে। সে বলে, বোম্বাইয়ের ডেপুটি কমিশনার অব পুলিস আমাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য ওই ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছিলো। ধীরুভাই আরো বলে, তিনি আমার জন্য বারান্দায় অপেক্ষা করছেন। আমি ধীরুভাইকে বলি, সে যেন ডেপুটি কমিশনারকে জানিয়ে দেয়, আমার প্রস্তুত হতে সামান্য একটু সময় লাগবে।
আমি স্নান সেরে জামাকাপড় পরে নিলাম। ইতিমধ্যে আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি মহম্মদ আজমল খাঁ আমার কাছে এসে হাজির হয়েছিলেন। তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবার পর আমি বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই দেখি, ভুলাভাই এবং তাঁর জামাই ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি মৃদু হেসে ভুলাভাইকে বললাম, গতরাত্রে যে বন্ধুটি এসে খবর দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সেই খবরটা দেখছি সত্যি। এরপর আমি ডেপুটি কমিশনারের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি প্রস্তুত। সময় তখন ভোর পাঁচটা।
আমি ডেপুটি কমিশনারের গাড়িতে উঠে বসলাম। আর একটি গাড়িতে আমার জিনিসপত্র তুলে নেওয়া হলো। গাড়ি দুটো সোজা এসে হাজির হলো ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে। তখন লোকাল ট্রেনগুলো ছাড়বার কথা, কিন্তু আমি দেখতে পেলাম, স্টেশনে একখানা লোকাল ট্রেনও নেই। কোনো যাত্রীও দেখতে পেলাম না সেখানে। মনে হলো সব ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
আমি মোটর থেকে নামতেই অশোক মেহতাকে দেখতে পেলাম। তাঁকেও গ্রেপ্তার করে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসে আনা হয়েছে। তাঁকে দেখে বুঝতে পারলাম, গভর্নমেন্ট শুধু ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হননি; বোম্বাইয়ের অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার আরো মনে হলো, সারা ভারতবর্ষ জুড়েই হয়তো ওইভাবে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্ল্যাটফর্মে তখন একটি মাত্র ট্রেন অপেক্ষা করছিলো। একটি ইঞ্জিন তখন একটা ডাইনিং কারকে সেই ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছিলো। ট্রেনটাতে করিডর থাকায় এক কামরা থেকে অপরাপর কামরায় যাবার সুযোগ ছিলো। এই ধরনের করিডরযুক্ত ট্রেন বোম্বাই ও পুনার মধ্যে চলাচল করতো। আমাকে ওই ট্রেনের একটি কামরায় তুলে দেওয়া হলে আমি একটা জানলার পাশে আসন গ্রহণ করলাম।
একটু পরেই জওহরলাল, আসফ আলী এবং ডঃ সৈয়দ মামুদ এসে হাজির হলেন। জওহরলালের কাছ থেকে শুনলাম গান্ধীজীকেও স্টেশনে আনা হয়েছে এবং তাঁকে অপর একটি কামরায় স্থান দেওয়া হয়েছে। এই সময় একজন ইউরোপিয়ান মিলিটারী অফিসার আমাদের সামনে এসে আমরা চা খেতে চাই কি না জানতে চাইলো। আমি যদিও সকালে চা খেয়ে এসেছি তবুও আর এক কাপ চাইলাম।
এই সময় আর একজন মিলিটারী অফিসার আবির্ভূত হয়ে আমাদের গুনতে শুরু করলো। তার চালচলন দেখে আমার মনে হলো, কোনো ব্যাপারে সে একটু ঘাবড়ে গেছে। এরকম মনে হলো তাকে বার বার গুনতে দেখে। আমাদের কামরায় এসে সে বেশ একটু জোরে উচ্চারণ করলো— ত্রিশ। দু-তিনবার যখন সে ত্রিশ সংখ্যাটি উচ্চারণ করলো, তখন আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম— বত্রিশ। আমার কথা শুনে লোকটা আরো ঘাবড়ে গেলো। সে তখন আবার গুনতে শুরু করলো। একটু পরেই গার্ডের বাঁশি বেজে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা চলতে শুরু করলো। এই সময় আমি শ্রীমতী আসফ আলীকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তিনি তাঁর স্বামীকে বিদায় অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি চুপ করে বসে থাকবো না।’ পরবর্তীকালে জানতে পারি, তিনি তার কথামতোই কাজ করেছিলেন।
আগে বলেছি, ট্রেনটাতে করিডর ছিলো। শ্রীমতী নাইডু আমাদের কামরায় এসে বললেন, গান্ধীজী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। তার কথা শুনে আমরা করিডর দিয়ে গান্ধীজীর কামরায় গেলাম। গান্ধীজীকে তখন খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো। আমি তাঁকে এতোটা বিমর্ষ আর কোনোদিন দেখিনি। আমার মনে হলো, ব্যাপারটা যে এতোদূর গড়াবে, অর্থাৎ তাঁকে যে এইভাবে গ্রেপ্তার করা হবে এটা হয়তো তিনি আশা করেননি। তিনি ভেবেছিলেন গভর্নমেন্ট কোনোরকম গুরুতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। আমি কিন্তু আগেই তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিলাম এতোটা আশাবাদী হওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু তিনি তাঁর বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। এবারে তাঁর চিন্তাধারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হওয়ায় পরবর্তী পন্থা কী হবে তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।
মিনিট দুই কথা বলবার পর গান্ধীজী আমাকে বললেন, ‘গন্তব্যস্থানে পৌঁছেই আপনি গভর্নমেন্টকে জানিয়ে দেবেন, এখনো আপনি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন; এবং এর জন্য আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে আপনার কাছে আসা-যাওয়া করতে দিতে হবে এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে। গতবারে আপনাকে যখন গ্রেপ্তার করে নাইনি জেলে রাখা হয়েছিলো সেই সময় গভর্নমেন্ট আপনাকে এই সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলো। এবারেও আপনি সেইরকম সুযোগ-সুবিধা দাবি করবেন এবং দরকার হলে এই ব্যাপারটাকে প্রাধান্য দেবেন।’
আমি কিন্তু গান্ধীজীর সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। আমি তাঁকে বললাম, এবারের অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা খোলা চোখেই আমাদের পথ বেছে নিয়েছি, সুতরাং তার ফলাফলের জন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কংগ্রেসের কোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে যদি আমাকে সংগ্রাম করতে হতো তাহলে আমার কোনো আপত্তি হতো না, কিন্তু ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য সংগ্রাম করাটা আমি সঠিক কাজ বলে মনে করতে পারি না। আমার আরো মনে হয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করবার জন্য আমার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে আমার কাছে যাতায়াত করবার দাবি জানানোটা ঠিক হবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের কাজ করা, অর্থাৎ এইরকম একটা সামান্য ব্যাপারকে প্রাধান্য দিয়ে তিলকে তাল করাটা কোনোক্রমেই সঙ্গত হবে না।
আমরা যখন গান্ধীজীর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম সেই সময় বোম্বাইয়ের পুলিস কমিশনার সেখানে এসে হাজির হলেন। তিনি আমাদের নিজের নিজের কামরায় চলে যেতে বললেন। তিনি আরো বললেন, গান্ধীজীর কাছে একমাত্র শ্রীমতী নাইডু ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবেন না। আমি আর জওহরলাল তখন আমাদের কামরায় ফিরে এলাম। ট্রেন তখন দ্রুত-গতিতে কল্যাণ অভিমুখে যাচ্ছিলো। কিন্তু কল্যাণ স্টেশনে না থেমে ট্রেন পুনার পথ ধরলো। আমার তখন মনে হলো, আমাদের হয়তো ওখানেই বন্দী করে রাখা হবে। আমার এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হলো, যখন আমি দেখতে পেলাম ট্রেন পুনা স্টেশনে এসে থেমে গেলো।
ওখানকার দৃশ্য দেখে আমার মনে হলো, আমাদের গ্রেপ্তারের সংবাদ আগেই পুনায় পৌঁছে গেছে। সারা প্ল্যাটফর্মটা পুলিসে ভরতি হয়ে রয়েছে এবং তারা জনসাধারণকে সেখানে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। কিন্তু ওভারব্রীজের ওপরে বহু লোক জমায়েত হয়েছে দেখা গেলো। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই জনতা ‘মহাত্মা গান্ধীকি জয়’ বলে চিৎকার করতে শুরু করলো। জনতার সেই চিৎকার থামাবার উদ্দেশ্যে কমিশনার তাদের ওপর লাঠি চার্জ করবার জন্য পুলিসকে নির্দেশ দিলেন। কমিশনার বললেন, কোনোরকম জনজমায়েত অথবা ধ্বনি উচ্চারণ করা বরদাস্ত করা হবে না বলে গভর্নমেন্ট আদেশ জারী করেছেন।
জওহরলাল একটি জানলার পাশে বসে ছিলেন। তিনি যখন দেখতে পেলেন পুলিস জনতার ওপরে লাঠিচার্জ করছে তখন তিনি এক লাফে কামরা থেকে নেমে দ্রুতপদে পুলিসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘জনতার ওপর লাঠিচার্জ করবার কোনো অধিকার তোমাদের নেই।’
জওহরলালকে ওইভাবে এগিয়ে যেতে দেখে পুলিস কমিশনার ছুটতে ছুটতে তাঁর কাছে গিয়ে তাকে কামরায় ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হলেন। জওহরলাল কিন্তু তাঁর কোনো কথাই শুনতে রাজী হলেন না। তিনি তখন ভীষণ রেগে গেছেন। এই সময় ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য শঙ্কররাও দেও-ও প্ল্যাটফর্মে নেমে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে চারজন পুলিস তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালো এবং তাঁকে ট্রেনে ওঠবার জন্য বলতে লাগলো। কিন্তু তিনি যখন তাদের নির্দেশ মানতেও সম্মত হলেন না তখন তারা তাঁকে ধরে পাঁজাকোলা করে ট্রেনে তুলে দিলো। আমি তখন জওহরলালের দিকে তাকিয়ে তাঁকে ফিরে আসতে বললাম। জওহরলাল রাগান্বিত দৃষ্টি নিয়েই আমার দিকে ফিরে তাকালেন। কিন্তু তিনি আমার অনুরোধ মেনে নিলেন। এই সময় পুলিস কমিশনার আমার কাছে এসে বললেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত, কিন্তু গভর্নমেন্ট আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন আমি তা মানতে বাধ্য।’ কথাটা তিনি দু-তিনবার বললেন।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমি দেখতে পেলাম, গান্ধীজী এবং শ্রীমতী নাইডুকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছুদিন পরে আমরা জানতে পারি, তাঁদের আগা খাঁর প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বোম্বাইতে গ্রেপ্তার হওয়া আর একজন লোকও ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিস তাঁকে বাধা দিতে এগিয়ে আসে। কিন্তু পুলিসের বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন। পুলিস তখন তাঁকে জোর করে ধরে ট্রেনে তুলে দেয়। আমার মনে হয় তিনি গান্ধীজীর নির্দেশ অনুসারেই পুলিসের বাধাকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। গান্ধীজীর নির্দেশ স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, বর্তমান আন্দোলনে কোনো লোকই স্বেচ্ছায় পুলিসের এবং বিনা বলপ্রয়োগে গ্রেপ্তার বরণ করবে না।
গান্ধীজীকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পর ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। এবার আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের আহম্মদনগরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বেলা প্রায় দেড়টার সময় আমরা স্টেশনে এসে উপস্থিত হলাম। প্ল্যাটফর্মে তখন কয়েকজন পুলিস অফিসার ছাড়া আর কোনো জনপ্রাণী ছিলো না। ওখানে আমাদের ট্রেন থেকে নামতে বলা হলো। আগে থেকেই কয়েকটা মোটরগাড়ি স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিলো। আমাদের সবাইকে সেইসব গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। আমরা বসতেই গাড়িগুলো চলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আহম্মদনগর দুর্গের ফটকের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একজন মিলিটারী অফিসার সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিস কমিশনার একটা তালিকা বের করে তাঁর হাতে দিলেন। তালিকাটি দেখে সেই মিলিটারী অফিসার একে একে আমাদের নাম ডাকতে লাগলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যার যার নাম ডাকা হলো তাদের প্রত্যেককে ভেতরে যেতে বললেন। প্রকৃতপক্ষে পুলিস কমিশনার আমাদের ভার মিলিটারী কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত করলেন। এখন থেকে আমরা মিলিটারীর অধীনস্থ হলাম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন