১২. সাধারণ নির্বাচন
সিমলা কনফারেন্সের পরে ডাক্তাররা আমাকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য কাশ্মীরে যেতে বলেন। আমার শরীরের অবস্থা তখন এতোই খারাপ হয়ে পড়েছিলো যে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেসব সাধারণ কাজকর্ম করতে হয়, তা করাও আমার পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। জওহরলালেরও বায়ু পরিবর্তনের দরকার হয়ে পড়েছিলো। আমি কাশ্মীরে যাবো শুনে তিনিও আমার সঙ্গে যাবেন বলে মনস্থ করেন। জুলাই এবং আগস্ট মাস আমি গুলমার্গে থাকি। এই সময় আমি জানতে পারি, ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিকদল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। এই খবর জানবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি মিঃ অ্যাটলি এবং স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের কাছে টেলিগ্রামে অভিনন্দনবার্তা প্রেরণ করি। টেলিগ্রামে আমি আশা প্রকাশ করি, এবার যখন শ্রমিকদল ক্ষমতায় এলেন তখন তাঁরা নিশ্চয়ই ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁদের প্রতিশ্রুতিসমূহ কার্যকর করবেন। আমার টেলিগ্রামের উত্তরে মিঃ অ্যাটলি জানান, ভারতের সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান করতে শ্রমিকদল অবশ্যই তাঁদের যথাসাধ্য করবেন। ক্রিপস তাঁর টেলিগ্রামে আশা প্রকাশ করেন, ভারতকে এবার আর হতাশ হতে হবে না। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, ব্রিটিশ নেতাদের সঙ্গে আমার এইসব টেলিগ্রামের আদান-প্রদান গান্ধীজি এবং জওহরলাল পছন্দ করেননি। ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ শ্রমিকদলের মনোভাবকে তাঁরা সুনজরে দেখতেন না। আমি কিন্তু বিশ্বাস করতাম, শ্রমিকদল ভারতবর্ষ সম্পর্কে নতুনভাবে এবং নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করবেন এবং তার ফলাফল ভারতের পক্ষে শুভ হবে।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই ভাইসরয় ঘোষণা করেন, আগামী শীতকালেই ভারতবর্ষে এক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাঁর এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ার্কিং কমিটির এবং এ.আই.সি.সি-র সভা আহ্বান করার দরকার হয়ে পড়ে। সিমলা কনফারেন্স ভেস্তে যাবার ফলে কংগ্রেস এবার কী মনোভাব গ্রহণ করবে সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হয়। কংগ্রেসের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক নতুন করে আন্দোলন শুরু করবার কথা বলছিলেন; আর একদলের অভিমত ছিলো, আন্দোলন শুরু হোক বা না হোক, ভারতের আসন্ন নির্বাচন বয়কট করতেই হবে। আমি কিন্তু এই উভয় মতামতের কোনোটাকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতাম না। আমার মতে সিমলা কনফারেন্স ইংরেজদের দোষে ভেস্তে যায়নি; কনফারেন্স ভেস্তে গেছে সাম্প্রদায়িক কারণে, রাজনৈতিক কারণে নয়।
আমি তখন গুলমার্গে। এই সময় পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা ঘটে যেরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। ঘটনাটি হলো আমেরিকানদের দ্বারা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপরে অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ। এই বোমা ব্যবহারের আগে সাধারণভাবে মনে করা হতো, জাপানের প্রতিরোধ-ক্ষমতা চূর্ণ করতে হলে কমপক্ষে দু বছর সময় লাগবে। কিন্তু হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ঘটনার পরে ঘটনার গতি সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই ভয়াবহ অস্ত্রের মোকাবিলা করবার মতো কোনো শক্তিই জাপানের ছিলো না। তাই তারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ইউরোপের যুদ্ধ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এবার জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধও শেষ হয়ে গেলো। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমেরিকান সেনাবাহিনী জাপানের মাটিতে পদার্পণ করে টোকিও অধিকার করে নিলো। জেনারেল ম্যাকআর্থার জাপানের শাসনকর্তা হয়ে বসলেন।
আমি এখনো মনে করি, আগে থেকে কোনোরকম সাবধানবাণী প্রচার না করে অ্যাটম বোমা ব্যবহার করা উচিত হয়নি। এই বোমা এমনই মারাত্মক অস্ত্র যা শুধু সেনাবাহিনীকেই ধ্বংস করে না, এটা অসামরিক জনসাধারণকেও নিশ্চিহ্ন করে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যৎ বংশধরগণও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা যখন মিত্রপক্ষের ওপরে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করেছিলো তখন সারা পৃথিবী প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলো। জার্মানরা তখন অমানুষিক অপরাধে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয়েছিলো, কিন্তু আমেরিকানদের বেলায় তা না হবার কোনো কারণ থাকতে পারে কি? আমি মনে করি, এই মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করায় মিত্রপক্ষের সুনাম এবং বীরত্বকে যথেষ্ট রকমে ক্ষুণ্ণ করেছে। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করি, এই অমানুষিক কাজকে মিত্রপক্ষ বীরত্বের পরাকাষ্ঠা এবং বিরাট জয় বলে দাবি করেছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদও কোথাও উত্থিত হয়নি।
আমার স্বাস্থ্য তখনো খুবই খারাপ। কাশ্মীরে জুলাই আর আগস্ট মাস মোটেই স্বাস্থ্যকর নয় এবং এই কারণেই আমার স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি হয়নি; কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস পড়তেই আমার স্বাস্থ্যের দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। আমার খিদে বেড়ে যায় এবং আমি ব্যায়াম করতেও সক্ষম হই। আমি যদি আর একটা মাস ওখানে থাকতে পারতাম তাহলে আমি সম্পূর্ণভাবে আমার হৃতস্বাস্থ্য ফিরে পেতাম। কিন্তু ঘটনাচক্রের পরিপ্রেক্ষিতে আমি কাশ্মীর থেকে চলে আসতে বাধ্য হই। ওয়ার্কিং কমিটি এবং এ.আই.সি.সি. আমার উপস্থিতি দাবি করছিলো। ফলে আমি যখন সমতলভূমিতে নেমে এলাম তখন আমার স্বাস্থ্য আবার খারাপ হয়ে পড়লো।
সে সময় কাশ্মীর এবং ভারতের অন্যান্য অংশের মধ্যে বিমান চলাচলের ব্যবস্থা ছিলো না। কাশ্মীরে যেতে হলে তখন সুদীর্ঘ এবং দুর্গম পার্বত্যপথ মোটরে করে পাড়ি দিতে হতো। তবে, আমেরিকান মিলিটারী অফিসাররা প্রায়ই বিমানে করে কাশ্মীরে যেতেন। ওঁরা কাশ্মীরে যেতেন বিশ্রাম নেবার এবং আনন্দ উপভোগ করবার জন্য। প্রতি দু সপ্তাহ অন্তর একদল অফিসার বিমানে করে শ্রীনগরে যেতেন। ওঁদের মধ্যে কেউ কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তাঁরা যখন শুনতে পেলেন আমি দিল্লিতে ফিরে যাচ্ছি, তখন আমাকে তাঁরা একটি বিশেষ বিমান দিতে চাইলেন। তাঁদের দেওয়া বিমানে করেই আমি ১০ই সেপ্টেম্বর দিল্লিতে আসি এবং সেখানে এসেই সোজা রওনা হই পুনার উদ্দেশে। ১৪ই সেপ্টেম্বর পুনায় ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে এবং পরবর্তী সভা বোম্বাইতে হবে বলে স্থির হয়। ওয়ার্কিং কমিটিতে এবং এ.আই.সি.সি.র মিটিংয়ে আমাদের নতুন কর্মপন্থা সম্বন্ধে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। গান্ধীজি সহ বেশিরভাগ সদস্য গঠনমূলক কাজ করার কথা বলেন। তাঁদের মতে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কোনো সুযোগ নেই।
ব্রিটেনে শ্রমিক সরকার গঠিত হওয়ায় সেখানে একটা যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে এ কথাটা আমিও বিশ্বাস করি। শ্রমিকদল সব সময়ই ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো। তাদের সেই মনোভাবকে এবার যাতে তারা সরকারীভাবে প্রকাশ করতে পারে তার জন্য তাদের সুযোগ দেওয়া দরকার। আমি তাই দৃঢ়ভাবে মনে করি, এই সময় কোনোরকম আন্দোলন আরম্ভ না করে সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাই আমাদের উচিত হবে। আমি আরো বলি, সিমলা কনফারেন্সে ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষভাবেই চেষ্টা করা হয়েছে। কনফারেন্স যদিও এ ব্যাপারে কৃতকার্য হতে পারেনি, তবুও লর্ড ওয়াভেল আন্তরিকভাবেই ভারতের সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলেন। এবার শ্রমিকদল ক্ষমতায় আসার ফলে আরো সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। অনেক আলোচনার পর অবশেষে আমার অভিমতই মেনে নেওয়া হয়।
আমি মনে করি, বন্দীমুক্তির প্রশ্নটা এবার উত্থাপন করা দরকার। ভারত সরকার ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মুক্তি দিলেও হাজার হাজার সাধারণ সদস্য তখনো কারাগারে বন্দী ছিলো। সিমলা কনফারেন্সের সময় আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সে বিষয়টা আমার কাছে তেমন স্পষ্ট ছিলো না। এবং এই কারণেই বন্দী-মুক্তির প্রশ্নটি তখন আমি তুলিনি।
কনফারেন্সের পরে দুটি বিশেষ ঘটনা সমগ্র পরিস্থিতিকে পরিবর্তিত করে দেয়। প্রথম ঘটনা হলো ব্রিটেনে শ্রমিকদলের বিরাট জয় এবং দ্বিতীয় ঘটনা হলো অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের ফলে যুদ্ধের অবসান। এর ফলে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় এই উভয় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক চিত্র অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি, এই অবস্থায় আমাদের দ্বৈত-ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। প্রথমত আমরা ভারতবাসীর সংগ্রামী মনোভাবকে জাগরিত রাখতে পারবো, এবং দ্বিতীয়ত এই সময় কোনোরকম আন্দোলন করা থেকে আমরা বিরত থাকবো।
আমি যা ভেবেছিলাম সেইভাবেই ঘটনার গতি এগোতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হবার কয়েকদিন পরেই লর্ড ওয়াভেল ভারতে সাধারণ নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা-বাণী শুনতে পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হয়, এবার হয়তো বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে। ভারতের জনসাধারণ এবং গভর্নমেন্ট উভয়ের স্বার্থেই এটা দরকার। বন্দীরা পাঁচ বছর যাবৎ জেলে রয়েছেন। আরো কিছুদিন থাকতেও তাঁদের আপত্তি হবে না। তাঁদের এই সুদীর্ঘ বন্দীদশা ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের বিশেষ কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এতে এক বিরাট অন্তরায়ের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সরকার যদি নতুন আবহাওয়ার সৃষ্টি করতে চান তাহলে তাঁদের এখন সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতেই হবে।
লর্ড ওয়াভেল এক তারবার্তায় আমাকে জানিয়ে দেন আমার প্রস্তাব তিনি মেনে নিয়েছেন এবং শীঘ্রই রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির আদেশ জারি করছেন। কিন্তু তিনি ব্যাপকভাবে বন্দী-মুক্তির আদেশ জারি করেন না। ফলে বেশির ভাগ কংগ্রেস সদস্য মুক্তি পেলেও বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কিছু সংখ্যক সদস্য তখনো জেলে রয়ে গেলেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামানন্দন মিশ্র এবং আরো কয়েকজন এঁদের মধ্যে ছিলেন।
আমার প্রস্তাবের এইরকম পরিণতি দেখে আমি খুশি হতে পারিনি। সামান্য কয়েকজন বামপন্থী সদস্যকে মুক্তি না দেবার কারণ আমার বোধগম্য হয় না। ভারত সরকার এঁদের ওপরে সন্দেহ পোষণ করতেন। কিন্তু তাঁদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ ছিলো না যে ওইসব সদস্য অন্যান্য কংগ্রেসী সদস্য অপেক্ষা ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনে ভিন্নতর পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। এ.আই.সি.সি.র বোম্বাই অধিবেশনের পরে সেপ্টেম্বর মাসে আমি লর্ড ওয়াভেলকে এক দীর্ঘ পত্র লিখি।
আমি তাঁকে জানিয়ে দিই, কয়েকজন সদস্যকে মুক্তি না দেবার ফলে দেশের মধ্যে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। লর্ড ওয়াভেল যদি একটি নতুন রাজনৈতিক আবহাওয়া সৃষ্টি করতে চান তাহলে তাকে সাধারণ বন্দীমুক্তি (general amnesty) মেনে নিতে হবে। লর্ড ওয়াভেল শেষ পর্যন্ত আমার প্রস্তাব মেনে নেন এবং সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে সম্মত হন।
এ.আই.সি.সি. সিদ্ধান্ত নেয়, কংগ্রেস একটি নির্বাচনী ইস্তাহার প্রচার করবে। সিদ্ধান্তে আরো বলা হয়, ওয়ার্কিং কমিটি ওই ইস্তাহারের খসড়া তৈরি করে অনুমোদনের জন্য তাঁদের কাছে পেশ করবেন। ওয়ার্কিং কমিটিকে কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিটির তরফ থেকে একটি প্রাথমিক ইস্তাহার প্রচার করবার জন্যও বলা হয়। সাধারণ নির্বাচনের দিন নিকটবর্তী হবার ফলে এ.আই.সি.সি. কর্তৃক কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার নিয়ে বিচার-বিবেচনার মতো সময় আর ছিলো না; তাই এ.আই.সি.সি.র সভা আহ্বান না করে ওয়ার্কিং কমিটি তার নিজ ক্ষমতাবলে নিম্নলিখিত ইস্তাহারটি প্রচার করে:
সুদীর্ঘ ষাট বৎসর যাবৎ জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। এবং তার এই বহু বৎসরের ইতিহাস জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামী ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। অতিসামান্য প্রারম্ভিক সূচনা থেকে ধাপে ধাপে প্রগতির পথে অগ্রসর হয়ে এই প্রতিষ্ঠান এক সুমহান জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এবং এই বিরাট দেশের প্রতিটি শহর এবং সুদূর পল্লীগ্রামের মানুষদের কাছেও স্বাধীনতার অমৃতবাণী পৌঁছে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গণশক্তিতে শক্তিমান হয়ে কংগ্রেস এক বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে দেশের অগণিত নরনারী কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হয়ে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং এখনো সেই সংগ্রামী ঐতিহ্যকে বজায় রেখেছে। এই সংগ্রামের সামিল হয়ে তারা অশেষ দুঃখ ও নির্যাতন সহ্য করেছে। এই সংগ্রামে বহুসংখ্যক নরনারী আত্মাহুতিও দিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য জনগণের এই দুঃখভোগ এবং জাতির অবমাননার বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় মনোভাবের কল্যাণে কংগ্রেস বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
কংগ্রেসের ঐতিহ্য একাধারে জনগণের কল্যাণের জন্য গঠনমূলক কাজ এবং স্বাধীনতার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। এই সংগ্রামের জন্য কংগ্রেসকে বহুবার বহুবিধ বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং অস্ত্রবলে বলীয়ান এক বিরাট শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করে কংগ্রেস এই বিপজ্জাল থেকে আত্মরক্ষা করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শক্তি সংগ্রহ করে নব উদ্যমে বলীয়ান হয়ে উঠেছে। বিগত তিন বৎসরের অভাবনীয় গণজাগরণ এবং সেই গণজাগরণ দমনে শাসকশ্রেণীর নিষ্ঠুরতম পীড়ন কংগ্রেসকে আরো শক্তিশালী এবং আরো বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছে।
কংগ্রেস নরনারী-নির্বিশেষে ভারতের প্রতিটি নাগরিকের সম-অধিকার স্বীকার করে সকল সম্প্রদায় এবং সকল প্রকার ধর্মীয় দলভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্য তাদের শুভ-বুদ্ধি জাগ্রত করবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। ভারতের জনসাধারণ যাতে পরিপূর্ণ সুযোগ পেয়ে তাদের নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে উন্নত হতে পারে এবং প্রতিটি সম্প্রদায় ও প্রতিটি অঞ্চল যাতে একজাতি একপ্রাণ হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করে সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কংগ্রেস তার কাজ করে চলেছে। এই উদ্দেশ্যকে সফল করবার জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং বিভিন্ন প্রদেশকে ভাষা এবং কৃষ্টির ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হবে। সামাজিক অত্যাচার এবং নানাবিধ অবিচারের ফলে যেসব লোক অবিরত নির্যাতিত হচ্ছে, কংগ্রেস তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে সমস্ত রকম অত্যাচার ও অবিচারের অবসান ঘটিয়ে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপনের জন্য চেষ্টা করছে।
কংগ্রেস এমন এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, যে রাষ্ট্রের সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার এবং নাগরিক ও পৌর স্বাধীনতা বিধিবদ্ধ থাকবে। কংগ্রেস আরো মনে করে, এই সংবিধান কেন্দ্রীয় ফেডারেল গভর্নমেন্টের ভিত্তিতে রচিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ বিভিন্ন প্রদেশের অথবা রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার থাকবে, রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোও প্রাপ্তবয়স্কের অবাধ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হবে।
দেড় শতাধিক বৎসরের পরাধীনতার ফলে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে এবং এমন সব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলোর আশু সমাধানের প্রয়োজন। অমানুষিক শোষণের ফলে দেশ এবং জাতি আজ দুঃখ, দৈন্য এবং অনাহারের মুখে উপনীত হয়েছে। বৈদেশিক প্রভুত্বের ফলে দেশ যে শুধু রাজনৈতিকভাবে পরাধীন হয়ে অবমাননা সহ্য করছে তাই নয়, সামাজিক, আর্থনীতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও দেশ এবং জাতি আজ পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের সময় এবং এমনকি এখনো সেই শোষণ সমভাবেই চলছে। এ ব্যাপারে শাসক সম্প্রদায় ভারতের স্বার্থকে এমনভাবে পদদলিত করে জনগণের বুকের ওপর দিয়ে নির্দয় শাসন ও শোষণের রথচক্র চালিয়ে দিয়েছে যার ফলে সমগ্র দেশ আজ এক মহা মন্বন্তরের সম্মুখীন হয়েছে এবং জনসাধারণ অশেষ দুঃখ ও ক্লেশ ভোগ করছে। সুতরাং কংগ্রেস যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে সে স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই নয়, সেটি আর্থনীতিক ও সামাজিক স্বাধীনতাও বটে।
বর্তমানে ভারতের সর্বপ্রধান সমস্যা হলো দেশ থেকে দারিদ্র্যকে বিদূরিত করে জনসাধারণের জীবনধারণের মান উন্নত করা। এবং এই উদ্দেশ্যেই কংগ্রেস এ ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়ে গঠনমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এর জন্য শিল্প এবং কৃষিকে আধুনিকভাবে উন্নত করতে হবে এবং সামাজিক অগ্রগতি ও জনগণের উন্নয়নমূলক কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে এমনভাবে দেশের ধনসম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে যাতে অপরের ওপরে নির্ভরশীল না হয়ে দেশ এবং জাতি দ্রুত উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে। এই কর্মসূচীকে রূপায়িত করবার জন্য বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে এমনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যাতে সামাজিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি হতে না পারে এবং যাতে দেশের আর্থনীতিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করে বেকারী ও কর্মহীনতা দূর করতে পারা যায়। দেশের ধনসম্পদ এবং ক্ষমতা যাতে মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থবাদীর করায়ত্ত হতে না পারে, অর্থাৎ খনিজ সম্পদ, পরিবহন ব্যবস্থা এবং কৃষিজ, শিল্পজ ও অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থা যাতে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির করায়ত্ত না হয় পরিকল্পনাকে সেইভাবে রূপ দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কংগ্রেসের উদ্দেশ্য হলো স্বাধীন জাতিসমূহের এক বিশ্ব-ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা। যতোদিন পর্যন্ত বিশ্বে এই অবস্থার সৃষ্টি না হবে, ততোদিন ভারত সর্বদেশের ও সর্বজাতির প্রতি বন্ধুত্ব এবং সৌভ্রাতৃত্বের নীতি মান্য করে চলবে। দূর প্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতবর্ষ সহস্র সহস্র বৎসর বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সূত্রে আবদ্ধ ছিলো, স্বাধীনতা অর্জনের পরে ভারত আবার ওই সকল দেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক সৃষ্টি করবে। সামগ্রিক নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের প্রসারের জন্যও এইসব দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া দরকার। ভারত তার নিজস্ব অহিংস পদ্ধতিতে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। বিশ্বশান্তি এবং বিশ্বের জনগণের সহযোগিতার জন্যও ভারত সব সময় এই নীতিই অনুসরণ করে চলবে। অন্যান্য পরাধীন জাতিসমূহের স্বাধীনতার জন্যও ভারত সর্ব উপায়ে তাদের সাহায্য করবে, কারণ, সে জানে যে সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে এইসব দেশ মুক্তিলাভ না করলে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি যে প্রস্তাব পাস করেছিলো তা ভারতের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। সেই দাবিতে কংগ্রেস এখনো অবিচল রয়েছে এবং সেই দাবিকেই এখনো তার দাবি হিসেবে ব্যক্ত করছে। সেই দাবি এবং সেদিনের সেই রণহুঙ্কার (Battle-cry) পুনর্বার ব্যক্ত করে কংগ্রেস এবার কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চলেছে।
কেন্দ্রীয় আইনসভা একটি ক্ষমতাহীন বাকসর্বস্ব সংস্থা। এর একমাত্র কাজ হলো উপদেশ (advice) দেওয়া, তবে সে উপদেশ অনুসারে কাজ হবে কি হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অকার্যকরী সংস্থাটির লোক-দেখানো যে সামান্যতম গণতান্ত্রিক কাঠামো দেখানো হয়েছে তা নিতান্তই সীমাবদ্ধ। এর জন্য যে নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে তাও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এইসব ভুলত্রুটি সংশোধনেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। বিরাট সংখ্যক ভারতবাসী এখনো কারাগারে বন্দীজীবন যাপন করছে। যারা মুক্তিলাভ করেছে তাদেরও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জনসভা অনুষ্ঠান করবার ওপরে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো সে নিষেধাজ্ঞা এখনো বহু জায়গায় বলবৎ আছে। এই সকল বাধা এবং অসুবিধা সত্ত্বেও কংগ্রেস নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার কারণ হলো, কংগ্রেস বিশ্ববাসীকে দেখাতে চায় স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশ এবং দেশবাসী কংগ্রেসের পেছনেই রয়েছে। সুতরাং এই নির্বাচনে সমস্ত রকম ছোটখাটো বিষয় বাদ দিয়ে একমাত্র স্বাধীনতার দাবি নিয়েই কংগ্রেস নির্বাচনে দাঁড়াবে বলে স্থির করা হয়েছে। কংগ্রেস তাই সারা ভারতে ভোটারদের কাছে এই আবেদন করছে, কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে তারা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে কংগ্রেসের পেছনে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস প্রার্থীদের জয়যুক্ত করেন। ভারতবাসী বহুবার স্বাধীনতার জন্য তাদের দৃঢ়সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত করেছে, সেই সঙ্কল্প এবারও গ্রহণ করতে হবে আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেসকে সমর্থন করে। তবে একথাও মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচনের দ্বারা স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। শীগগিরই এমন সময় আসছে যখন স্বাধীনতার জন্য নির্বাচনের পন্থা বাদ দিয়ে আমাদের ভিন্নতর পথে পদক্ষেপ করতে হবে। এই নির্বাচন আমাদের কাছে একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষারূপে উপস্থিত হয়েছে, যে পরীক্ষা বৃহত্তর ভবিষ্যতেরই সূচনামাত্র। সুতরাং স্বাধীনতার জন্য যারা সংকল্পবদ্ধ তাঁরা যেন এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হবার জন্য পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হন।
.
সাধারণভাবে যা আশা করা গিয়েছিলো নির্বাচনের শেষে তাই সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। বাংলা, পাঞ্জাব এবং সিন্ধুপ্রদেশ বাদে অন্যান্য সব প্রদেশেই কংগ্রেস সর্ববৃহৎ একক দল হিসাবে অর্ধেকেরও বেশি আসনে জয়ী হলো। পাঞ্জাবে ইউনিয়নিস্ট পার্টি এবং মুসলিম লীগ প্রায় সমান সংখ্যক আসন অধিকার করেছে। সিন্ধু প্রদেশে মুসলিম লীগ বহুসংখ্যক আসন লাভ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেনি। একমাত্র বাংলাদেশেই (তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা) মুসলিম লীগ অর্ধেকের বেশি আসন অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে। এই তিনটি প্রদেশেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিম লীগ ওইসব প্রদেশে সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মের জিগির তুলে নির্বাচনে জয়লাভ করতে চেয়েছিলো। লীগের এই সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় জিগিরের ফলে কংগ্রেসের মুসলমান প্রার্থীদের খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এমনও দেখা যায় তাঁরা জনসভা করতেও পারেননি। সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত আবহাওয়া এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে মুসলমান জনসাধারণ কংগ্রেসের মুসলমান প্রার্থীদের বক্তব্যও শুনতে চাননি অনেক জায়গায়। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানরা বিরাটভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে লীগ মোটেই সুবিধা করতে পারেনি। কংগ্রেসই ওখানে গভর্নমেন্ট গঠন করে।
এবারে ভারতের সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা আর একবার উল্লেখ করছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন কমিউনিস্টরা বেশ একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো। হিটলার এবং স্টালিনের মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার ফলেই ওরা ওইরকম বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো। এই চুক্তি সাক্ষরিত হবার আগে পর্যন্ত কমিউনিস্টরা হিটলারের শ্রাদ্ধ করে চলেছিলো এবং কথায় কথায় নাৎসীবাদকে বরবাদ করে চলেছিলো। ভারতের কমিউনিস্টরা অন্তরে অন্তরে বুঝতে পারছিলো, হিটলারের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করে স্টালিন একটা বিরাট রকমের অপকর্ম করে ফেলেছেন। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কমিউনিস্টদের মতো তাদেরও এর বিরুদ্ধে কথা বলবার সাহস ছিলো না। ওরা তাই বিষয়টাকে এই বলে চাপা দেবার চেষ্টা করছিলো যে এর ফলে নাকি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রসারকে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিলো। মহা অসুবিধায় পড়ে ওরা এমন কথাও বলছিলো, হিটলার নাকি ততোটা বদলোক নয়। এইরকম অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়ে ইংরেজকে তারা কোনো সাহায্য করতে পারছিলো না; শুধু তাই নয়, ভারতের নিরপেক্ষ নীতিকেও তারা তখন প্রবলভাবে সমর্থন করতে শুরু করেছিলো। কিন্তু এরপর হিটলার যখন রাশিয়া আক্রমণ করে বসলো তখন কমিউনিস্টরা হঠাৎ একেবারে ভোল পাল্টে ফেললো। ওরা তখন যুদ্ধটাকে ‘জনযুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করে পরিপূর্ণভাবে ইংরেজদের সমর্থন করতে শুরু করলো। ভারতে তারা প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধের প্রচারকার্যেও সহায়তা করতে লাগলো। মিঃ এম. এন. রায় ইংরেজদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রকাশ্যভাবেই যুদ্ধের পক্ষে প্রচার করতে লাগলেন। কমিউনিস্টরাও নানাভাবে গভর্নমেন্টের কাছ থেকে সাহায্য পেতে লাগলো। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা যুদ্ধের পক্ষে প্রচারের কাজে গভর্নমেন্টকে সহায়তা করছিলো বলে তাদের পার্টির ওপরে যে নিষেধাজ্ঞা ছিলো সেই নিষেধাজ্ঞাও গভর্নমেন্ট তুলে নিলেন।
অপরপক্ষে কংগ্রেস তখন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক কংগ্রেসী সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু কমিউনিস্টদের বেলায় অন্যরকম দেখা যায়। আগে যেসব কমিউনিস্টকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো অথবা কমিউনিস্ট পার্টির যেসব সদস্য আত্মগোপন করে অবস্থান করছিলো তারা সবাই বেরিয়ে এসে তাদের দলীয় স্বার্থে কাজ করতে শুরু করলো। এরপর সিমলা কনফারেন্সের পরে যখন কংগ্রেস সদস্যরা মুক্তিলাভ করলো তখন কমিউনিস্টরা তাদের পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করতে না পেরে কংগ্রেসের পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
এই সময় আর একটি নতুন জিনিস দেখা গেলো। এটা হলো সরকারী কর্মচারীদের মনোভাবের পরিবর্তন। যুদ্ধের সময় প্রতিরক্ষা বিভাগ বিরাট সংখ্যক ভারতীয় যুবককে সেনা-বিভাগে নিযুক্ত করেছিলো। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী থেকে এদের সংগ্রহ করা হয়েছিলো। আগের দিনে ভারতের কয়েকটি মাত্র বিশেষ সম্প্রদায় থেকে ইংরেজরা সৈনিক সংগ্রহ করতেন, কিন্তু এবারের যুদ্ধে প্রয়োজনের তাগিদ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় আগের দিনের সেই বাদ-বিচার তুলে দেওয়া হয়। ভারতীয় যুবকদের বলা হয়েছিলো যুদ্ধের পরে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। ইংরেজের এই কথায় বিশ্বাস করেই ভারতীয় যুবকরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো। এবং এই বিশ্বাসের ফলেই তারা যুদ্ধের সময় প্রাণ তুচ্ছ করে যুদ্ধের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলো। এবার যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় ওরা আশা করলো ভারত এবার স্বাধীন হবে।
সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখা, অর্থাৎ নৌবাহিনী, স্থলবাহিনী এবং বিমানবাহিনী। এই তিন শাখাই তখন দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তাঁদের এই দেশাত্মবোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, কোনো কংগ্রেস নেতাকে দেখলে তাঁর কাছে নিজেদের মনোভাব অকপটে প্রকাশ করতেন। ওই সময় আমি যেখানেই গেছি, সেখানেই সশস্ত্র বাহিনীর যুবকরা আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা ইংরেজ অফিসারদেরও তোয়াক্কা করতেন না। আমি যখন করাচিতে গিয়েছিলাম, সেই সময় নৌবাহিনীর একদল অফিসার আমার সঙ্গে দেখা করেন। কংগ্রেসের প্রতি তাঁরা তাঁদের আন্তরিক সমর্থন জানিয়ে বলেন, কংগ্রেস ডাক দিলেই তাঁরা ছুটে আসবেন। তাঁরা আরো বলেন, কংগ্রেস এবং সরকারের মধ্যে যদি কোনো বিরোধ সৃষ্টি হয়, তাহলে তাঁরা কংগ্রেসকেই সমর্থন করবেন, সরকারকে নয়। বোম্বাই শহরেও নৌবাহিনীর শত শত অফিসার এই মনোভাবই ব্যক্ত করেন।
এইরকম মানসিকতা যে শুধু অফিসারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, নিচু স্তরের নৌ-সৈনিকরাও এই মনোভাবই পোষণ করতেন। এই সময় আমি পাঞ্জাবে সরকার গঠন করবার উদ্দেশ্যে বিমানে করে লাহোরে গিয়েছিলাম। বিমানক্ষেত্রের পাশেই স্থানীয় গুর্খা রেজিমেন্টের সদর কার্যালয় অবস্থিত ছিল। ওই রেজিমেন্টের সৈনিকরা যখন শুনতে পান আমি ওখানে আসছি, তখন তাঁরা লাইনবন্দী হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন আমাকে দর্শন করবার জন্য। এমনকি, পুলিশের লোকেরাও এই মনোভাবই সেদিন ব্যক্ত করেছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দেখা গেছে, পুলিশরা সব সময়ই সরকারকে সমর্থন করে এসেছে। রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীদের প্রতি তাদের সহানুভূতি আদৌ দেখা যায়নি। তাঁদের প্রতি সব সময়ই ওরা খারাপ ব্যবহার করে এসেছে। এহেন পুলিশ দলও শেষ পর্যন্ত দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং কংগ্রেসের প্রতি তাদের আনুগত্য জ্ঞাপন করে।
একবার আমি যখন কলকাতার লালবাজার স্ট্রিট দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন সেখানে ট্র্যাফিক জ্যাম থাকায় আমার গাড়িটা থামাতে বাধ্য হই। এই সময় কয়েকজন কনস্টেবল আমাকে চিনতে পেরে নিকটবর্তী পুলিশ ব্যারাকে খবর দেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বহুসংখ্যক কনস্টেবল এবং হেড-কনস্টেবল এসে আমার গাড়িটা ঘিরে ফেলে। ওরা আমাকে সেলাম করে এবং কেউ কেউ আমার পা ছুঁয়েও প্রণাম করে। ওরা সবাই কংগ্রেসের প্রতি ওদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। ওরা আরো বলে যে, আমাদের নির্দেশমতো ওরা কাজ করবে। আরো একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। বাংলার গভর্নর একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি যখন লাট-কুঠিতে যাই, তখন ওখানে প্রহরারত কনস্টেবলরা আমার গাড়িটাকে ঘিরে দাঁড়ায়। এরপর আমি যখন গাড়ি থেকে নেমে মাটিতে পা দিই, তখন ওরা একে একে এগিয়ে এসে আমাকে অভিনন্দন জানায়। ওরা সবাই আমাকে বলে ওরা আমার নির্দেশ অনুসারে কাজ করবে। কিন্তু আমি সেদিন গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে গেছি বলে ওখানে কোনো রকম স্লোগান দেওয়া আমি উচিত মনে করিনি। কনস্টেবলরা কিন্তু চুপ করে থাকে না; তারা মুহুর্মুহু আমার জয়ধ্বনি দিতে থাকে। এইসব ঘটনার ফলে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায়, কনস্টেবলরা মনেপ্রাণে কংগ্রেসকে সমর্থন করে এবং তাদের মনোভাব প্রকাশ করতে তারা মোটেই ভয় পায় না। কংগ্রেসের প্রতি তাদের এই সহানুভূতির জন্য সরকার যদি তাদের শাস্তি দিতেন, তাতেও তাদের আপত্তি ছিল না।
এই সব ঘটনা স্বভাবতই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে। সরকার তখন এই যাবতীয় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহ করে ভারত-সচিবের কাছে পাঠিয়ে দেন। এর ফলে ইংরেজরা বুঝতে পারেন, ভারতের প্রতি স্তরের প্রতিটি মানুষই স্বাধীনতার জন্য পাগল হয়ে ওঠায় সেখানে এক অগ্নিগর্ভ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি এখন আর শুধু কংগ্রেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এ দাবি এখন ভারতের সর্বস্তরের মানুষদের। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সামরিক এবং অসামরিক সরকারি কর্মচারীদের মনোভাবের পরিবর্তন। একথা আর তখন গোপন নেই যে, সর্বশ্রেণীর সরকারি কর্মচারীরা স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিক এবং অফিসাররা প্রকাশ্যেই তখন ঘোষণা করছেন, যুদ্ধের পরে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে বলে তাঁদের কাছে কথা দেওয়া হয়েছিল বলেই তাঁরা তাঁদের রক্ত ঢেলেছেন। এবার তাঁরা দাবি করছেন তাঁদের যে কথা দেওয়া হয়েছিল, সে কথাকে সম্মান দিতে হবে।
সাধারণ নির্বাচনের পরে প্রত্যেক প্রদেশে নতুন করে সরকার গঠনের প্রশ্ন উঠল। এর ফলে আমাকে বিভিন্ন প্রদেশের রাজধানীতে গিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে তদারক করার প্রয়োজন দেখা দিল। আমার হাতে তখন বেশি সময় ছিল না। কিন্তু বিমানে যাতায়াত করায় সমস্যাটার সমাধান করা গেল। যুদ্ধের সময় বিমান পরিবহন ব্যবস্থাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন আনা হয়েছিল। বিমানে অসামরিক যাত্রীদের কতগুলো আসন ব্যবহার করতে দেওয়া হবে, তাও সরকারই স্থির করে দিতেন। আমার ক্ষেত্রে লর্ড ওয়াভেল নির্দেশ জারি করেছিলেন, আসনের ব্যাপারে আমাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। লর্ড ওয়াভেলের এই নির্দেশের ফলেই অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশের রাজধানীতে হাজির হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।
বিহারে গিয়ে আমি দেখতে পাই, কংগ্রেসের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে তখন এমন রেষারেষি চলছে যে, মন্ত্রিসভা গঠনের কাজ রীতিমতো জটিল হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে আবার কোনো কোনো নেতার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাও যুক্ত হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ সিংহ এবং অনুগ্রহনারায়ণ সিংহের মধ্যে আগে থেকেই রেষারেষি ছিল। এবার তা আরো বেশি করে প্রকট হয়ে উঠেছে। ডাঃ সৈয়দ মামুদের বিরুদ্ধেও কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। অবশেষে এই তিনজনকেই মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়ে সমস্যার সমাধান করা গেল। বিহারের কংগ্রেস নেতাদের এবং বিশেষ করে ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের প্রচেষ্টার ফলেই সমস্যাটার সমাধান করা গিয়েছিল।
আমি স্থির করেছিলাম, মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে মুসলিম লীগের প্রতি আমরা সদিচ্ছামূলক মনোভাব গ্রহণ করব। মুসলিম লীগের টিকিটে যেসব মুসলমান সদস্য আইনসভায় এসেছিলেন, আমি তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে তাঁদের সহযোগিতা করতে অনুরোধ করি। যেসব প্রদেশে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল অথবা যেসব প্রদেশে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রাধান্য অর্জন করেছিল, সেসব প্রদেশেও আমি মুসলিম লীগের সদস্যদের কাছে এই প্রস্তাব রেখেছিলাম। আমি জানতাম, অনেক প্রদেশে, বিশেষ করে বিহার, আসাম এবং পাঞ্জাবে মুসলিম লীগের সদস্যরা আনন্দের সঙ্গে মন্ত্রিসভায় অংশ গ্রহণ করতে সম্মত ছিলেন, কিন্তু মি. জিন্নাহর নীতি ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে সর্বতোভাবে অসহযোগিতা করা।
পাঞ্জাবের পরিস্থিতিই ছিল সবচেয়ে জটিল। পাঞ্জাব মুসলমানপ্রধান প্রদেশ হওয়া সত্ত্বেও কোনো পার্টিই ওখানে সুস্পষ্টভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। মুসলিম সদস্যরা ইউনিয়নবাদী দল (Unionist Party) এবং মুসলিম লীগের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আমি উভয় দলের সঙ্গেই আলোচনা করি; কিন্তু মি. জিন্নাহর অসহযোগী মনোভাবের ফলে মুসলিম লীগ আমার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। তবে ইউনিয়নবাদী দল আমার সমর্থনে মন্ত্রিসভা গঠন করতে সম্মত হয়। পাঞ্জাবের গভর্নর ব্যক্তিগতভাবে মুসলিম লীগের পক্ষপাতী ছিলেন, কিন্তু তিনি দেখতে পান যে, ইউনিয়নবাদী দলের নেতা খিজির হায়াৎ খানকে মন্ত্রিসভা গঠন করবার জন্য আহ্বান করা ছাড়া তাঁর গত্যন্তর নেই।
এইবারই প্রথম কংগ্রেস পার্টি পাঞ্জাবের সরকারে প্রবেশ করে। এটা যে সম্ভব হবে বা হতে পারে, আগে তা চিন্তাও করা যায়নি। এ ব্যাপারে সারা ভারতের রাজনৈতিক মহল একবাক্যে স্বীকার করল, পাঞ্জাবে মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে আমি অসাধ্যসাধন করেছি। সমগ্র দেশের নির্দলীয় সদস্যরাও আমাকে অভিনন্দন জানালেন। উত্তর প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপত্র ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখল, পাঞ্জাবের জটিল সমস্যাকে আমি যেভাবে সমাধান করেছি, তাতে আমার গভীর রাজনীতিজ্ঞান এবং জটিল সমস্যার গ্রন্থিমোচনে আমার অসামান্য পারদর্শিতাই সূচিত হয়েছে।
দেশের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে আমি খুবই খুশি হই। তবে সাময়িকভাবে একটা ব্যাপারে আমি দুঃখিত না হয়ে পারি না। আমি কংগ্রেসে আসার পর থেকেই জওহরলালের সঙ্গে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়। প্রতিটি পদক্ষেপেই আমরা উভয়ে উভয়কে সর্বতোভাবে সমর্থন করতে থাকি। আমাদের ভেতরে কোনো রকম ঈর্ষা অথবা প্রাধান্য অর্জনের মনোভাব কখনো দেখা যায়নি। বস্তুতপক্ষে নেহরু-পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর আমল থেকেই। প্রথম দিকে আমি জওহরলালকে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পুত্র হিসেবে দেখতাম এবং তিনিও আমাকে তাঁর পিতৃবন্ধু হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন।
জওহরলালের উদার হৃদয়ে ব্যক্তিগত ঈর্ষা কখনো স্থান পায়নি। কিন্তু তাঁর আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে এমন কিছু লোক ছিলেন, যাঁরা আমার এবং তাঁর ভেতরের হৃদ্যতাটা সুনজরে দেখতেন না। তাঁরা তাই সব সময় চেষ্টা করতেন আমাদের সেই প্রীতির বন্ধনকে ছিন্ন করে দিতে। জওহরলালের মনে তথ্যের প্রতি একটা স্বাভাবিক দুর্বলতা ছিল। ওইসব লোক তাঁর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে তাঁর মনটাকে বিষিয়ে তুলবার জন্য সচেষ্ট হন। তাঁরা জওহরলালকে বলেন, ইউনিয়নবাদী দলের সঙ্গে কংগ্রেসের সহযোগিতা করাটা নীতির দিক থেকে একটি ভুল পদক্ষেপ। তাঁরা বলেন, সমঝোতা এবং সহযোগিতা করতে হলে মুসলিম লীগের সঙ্গেই করা দরকার, কারণ মুসলিম লীগই হলো মুসলমান জনগণের সর্ববৃহৎ দল। কমিউনিস্টরাও এই মতবাদ পোষণ করতেন এবং প্রকাশ্যেই সে কথা ঘোষণা করতেন। এই ধরনের কথা এবং মতবাদ জওহরলালকে প্রভাবিত করে। তিনি হয়তো মনে করেন, ইউনিয়নবাদী দলের সঙ্গে সমঝোতা করে আমি বামপন্থী মতবাদকে বিসর্জন দিয়েছি।
আমার এবং জওহরলালের মধ্যে যারা বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছিলেন, তাঁরা তাঁকে আরো বলতে থাকেন, আমার প্রতি যেভাবে প্রীতি ও সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে, তাতে অন্যান্য নেতার প্রতি রীতিমতো অবিচার করা হচ্ছে। জওহরলালের উদার মনোভাবের কথা তাঁরা ভালো করেই জানতেন, সেইজন্য তাঁরা তাঁর কথা বাদ দিয়েই অন্যান্য নেতার কথা বলেন। কিন্তু আমার প্রতি তাঁর মনকে বিরূপ করে তোলবার জন্য তাঁরা তাঁকে বোঝাতে থাকেন, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ পত্রিকায় যেভাবে আমার প্রশস্তি প্রকাশ করা হচ্ছে, তার ফলে আমি নাকি শিগগিরই কংগ্রেসের মধ্যে অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে একমেবাদ্বিতীয়ম নেতা হিসেবে পরিগণিত হব—যেটা নাকি গণতন্ত্র এবং কংগ্রেস, কারো পক্ষেই মঙ্গলজনক হবে না।
আমি জওহরলালকে ব্যক্তিগত ঈর্ষা এবং রেষারেষির ঊর্ধ্বে বলে মনে করি। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যাপারে তাঁর মনটা হয়তো বা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বোম্বাই অধিবেশনের সময় এটা আমি সর্বপ্রথম লক্ষ্য করি তিনি আমার বিরোধিতা করছেন। এতদিন আমরা একসঙ্গে কাজ করে এসেছি এবং এতদিন কোনো ব্যাপারেই তিনি আমার বিরোধিতা করেননি; কিন্তু বোম্বাইতে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় তিনি আমার প্রত্যেকটি প্রস্তাবেরই বিরোধিতা করতে লাগলেন। জওহরলাল যে অভিমত ব্যক্ত করলেন তা হলো, পাঞ্জাবে আমি যে নীতি গ্রহণ করেছি তা সঠিক নয়। তিনি একথাও বললেন, আমি কংগ্রেসের সুনামকে মসীলিপ্ত করেছি। তাঁর মুখ থেকে এই কথা শুনে আমি রীতিমতো বিস্মিত এবং দুঃখিত হই। পাঞ্জাবে আমি যা করেছি তা হলো, ওখানকার গভর্নরের মনোগত বাসনাকে নস্যাৎ করে আমি কংগ্রেসকে সরকারের ভেতরে আনতে পেরেছি। গভর্নরের ইচ্ছা ছিল মুসলিম লীগই ওখানে মন্ত্রিসভা গঠন করুক। আমার প্রচেষ্টার ফলেই কংগ্রেস সংখ্যালঘু দল হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাব মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে। খিজির হায়াৎ খান কংগ্রেসের সমর্থনেই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি কংগ্রেসের প্রভাবাধীনে এসে পড়েছেন।
জওহরলালের বক্তব্য হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করে মন্ত্রিসভায় যাওয়াটা উচিত নয়। এতে কংগ্রেসকে আপসের পথে আসতে হবে, যার ফলে হয়তো তার নীতিকেও বিসর্জন দিতে হবে। আমি বলি, নীতি বিসর্জন দেবার কোনো প্রশ্নই এখানে উঠছে না। সঙ্গে সঙ্গে আমি একথাও বলি, ওয়ার্কিং কমিটি যদি আমার কাজকে অনুমোদন না করেন, তাহলে তাঁরা যে-কোনো নতুন নীতি গ্রহণ করতে পারেন। পাঞ্জাবের মন্ত্রিসভাকে কংগ্রেস এমন কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি যে, মন্ত্রিসভায় কংগ্রেস থাকবেই। সুতরাং কংগ্রেসী সদস্যরা যখন খুশি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন।
এই সময় গান্ধীজী দৃঢ়ভাবে আমার মতামতকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন, পাঞ্জাবে কংগ্রেস পার্টি সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও আলোচনার মাধ্যমে সে মন্ত্রিসভায় আসতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব কংগ্রেসের ওপরেই নির্ভর করছে। তিনি আরো বলেন, এর চেয়ে ভালো সমাধান আর কিছু হতে পারে না এবং আমি ওখানে যে ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি, সে ব্যবস্থার কোনো রকম পরিবর্তন করা কোনোক্রমেই উচিত হবে না। গান্ধীজী যখন ওইভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর মতামত ব্যক্ত করলেন, তখন ওয়ার্কিং কমিটির সকল সদস্যই আমাকে সমর্থন করলেন। জওহরলালের প্রস্তাব গৃহীত হলো না।
এই ঘটনার পরে জওহরলাল হয়তো মনে করেছিলেন তিনি আমার কাছ থেকে এত দূরে সরে গেছেন, যার ফলে আমার মনে রীতিমতো আঘাত লেগেছে। আগের মতো এবারেও আমি ভুলাভাই দেশাইয়ের বাড়িতেই উঠেছিলাম। ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ের পরদিন সকালেই তিনি সেখানে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন, ওয়ার্কিং কমিটিতে তিনি আমার কাজের যে সমালোচনা করেছেন, সেটা নেহাতই মামুলি। আমার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং প্রীতি ঠিক আগের মতোই আছে এবং আমার নেতৃত্বের প্রতিও তাঁর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি অকপটভাবে স্বীকার করেন, তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘটনাবলির বিচার করেছিলেন, তা সঠিক ছিল না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, জওহরলাল কোনো সময়ই ভুল স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করতেন না। তাঁর কথা শুনে আমি খুবই খুশি হলাম। আমরা সব সময়ই একে অপরের অকৃত্রিম বন্ধু, সুতরাং তাঁর এবং আমার ভেতরে কোনো রকম মতানৈক্য থাকা মোটেই উচিত নয়।
আমি আগেই বলেছি, নৌবাহিনীর কয়েকজন অফিসার করাচিতে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সে সময় কথা প্রসঙ্গে তাঁরা আমাকে জানিয়েছিলেন, নৌবাহিনীতে জাতিভেদ প্রথা বিদ্যমান আছে। তাঁরা আরো বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তাঁরা আপত্তি উত্থাপন করলেও কর্তৃপক্ষ তাঁদের আপত্তিতে কর্ণপাত করেননি। এই ব্যাপারে তাঁদের মনে যে বিদ্রোহী মনোভাব সঞ্চিত হয়েছিল, তা বেড়েই চলতে থাকে। আমি দিল্লীতে থাকাকালে একদিন হঠাৎ খবরের কাগজে দেখতে পাই, নৌবাহিনীর অফিসাররা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে পদক্ষেপ করেছেন। সরকারের কাছে এক নোটিস দিয়ে তাঁরা বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে যদি তাদের দাবি-দাওয়া মেনে না নেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা একযোগে পদত্যাগ করবেন। সেই নির্দিষ্ট তারিখ তখন পার হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা তাই তাঁদের সেই দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বোম্বাই শহরে এক বিরাট জনসভা করে সেই সভায় প্রকাশ্যভাবে তাঁদের দাবি পুনরুত্থাপন করে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এই সংবাদ বিদ্যুৎচমকের মতো সারা দেশে চমক সৃষ্টি করে এবং দেশের জনগণের বেশিরভাগ অংশই তাঁদের পেছনে এসে দাঁড়ায়। ব্যাপার দেখে সরকার রীতিমতো রুষ্ট হয়ে ওঠেন। তাঁরা নৌবাহিনীর ইংরেজ সৈনিকদের আহ্বান করেন এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর সমস্ত জাহাজকে ইংরেজ অফিসারদের হাতে তুলে দেন।
আমি মনে করি এ সময় কোনো রকম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম অথবা গণ-আন্দোলন করা ঠিক হবে না। এখন আমাদের ঘটনাস্রোতকে লক্ষ্য করতে হবে এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করতে হবে। তাই ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসারদের এই কাজকে আমি ভুল পদক্ষেপ বলে মনে করি। জাতিভেদ প্রথার জন্য যেসব অসুবিধে তাঁরা ভোগ করছেন, তা শুধু নৌবাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আসলে ওটা সমগ্র সেনাবাহিনীতেই বিদ্যমান রয়েছে। এই অসাম্য দূর করবার জন্য প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে তাঁরা ঠিকই করেছিলেন, কিন্তু আমার মতে বর্তমান সময়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে নামাটা তাঁদের পক্ষে অবিবেচনার কাজ হয়েছে।
শ্রীমতী আসফ আলী নৌ-অফিসারদের দাবি সমর্থন করে প্রবলভাবে তাঁদের সমর্থন করতে থাকেন। এ ব্যাপারে তিনি দিল্লীতে এসে আমার সঙ্গেও দেখা করেন এবং আমার সমর্থন আদায় করবার চেষ্টা করেন। আমি তাঁকে বলি, অফিসাররা সুবিবেচনার পরিচয় দেননি, সুতরাং তাঁদের নিঃশর্তে কাজে যোগদান করা উচিত। বোম্বাইয়ের কংগ্রেস কমিটি আমার কাছে টেলিফোন করে আমার উপদেশ জানতে চান। আমি তাঁদের কাছে একটি টেলিগ্রাম করে আমার উপরোক্ত অভিমত জানিয়ে দিই। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তখন বোম্বাইতে ছিলেন। তিনিও এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁকেও আমি বলি, নৌ-অফিসাররা যে পথে গেছেন, সেটা ভুল পথ। সুতরাং তাঁদের এখন কাজে ফিরে যাওয়াই উচিত। সর্দার প্যাটেল আমাকে জিজ্ঞেস করেন, সরকার যদি তাঁদের কাজে যোগদান করবার সুযোগ না দেন, তাহলে কী করা হবে। এর উত্তরে আমি বলি, ঘটনাবলিকে আমি যেভাবে বিশ্লেষণ করেছি, তাতে আমার ধারণা সরকার কোনো রকম বাধার সৃষ্টি করবেন না এবং অফিসারদের কাজে ফিরে যাবার প্রস্তাবে সম্মত হবেন। তবে সরকার যদি কোনো রকম অসুবিধের সৃষ্টি করেন, তাহলে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করব।
পরদিনই আমার পেশাওয়ার রওনা হবার কথা। মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারেই আমার ওখানে যাবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য আমি পেশাওয়ার যাত্রা স্থগিত রেখে কমান্ডার-ইন-চিফ লর্ড অচিনলেকের সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করতে চাই। পরদিন সকাল দশটায় তিনি আমার সঙ্গে পার্লামেন্ট ভবনে দেখা করেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনার সময় আমি নিম্নোক্ত বিষয় দুটি উত্থাপন করি:
১. নৌ-অফিসারদের কাজকে কংগ্রেস সমর্থন করে না। কংগ্রেস তাঁদের অবিলম্বে কাজে যোগ দেবার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। তবে কংগ্রেস আশা করে তাঁদের ওপরে কোনো রকম প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। সরকার যদি প্রতিশোধ নেবার মতলব করেন, কংগ্রেস তাহলে নৌ-অফিসারদের পক্ষে দাঁড়াবে।
২. জাতিভেদমূলক অসুবিধে এবং নৌ-অফিসারদের অন্যান্য অভাব-অভিযোগ বিচার-বিবেচনা করতে হবে এবং সেগুলোকে দূর করতে হবে।
লর্ড অচিনলেক এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো আলোচনা করেন। আমি যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও আন্তরিকতা লক্ষ্য করি তাঁর কথাবার্তায়। তিনি বলেন, অফিসাররা যদি নিঃশর্তে কাজে ফিরে আসেন, তাহলে তাঁদের ওপরে কোনো রকম প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। জাতিভেদমূলক অসাম্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, ওই অসাম্য যাতে সম্পূর্ণভাবে বিদূরিত হয়, তার জন্য তিনি সর্বতোভাবে চেষ্টা করবেন। তাঁর বক্তব্য শুনে আমি খুবই খুশি হই। আমি তখন একটি বিবৃতি প্রচার করে অফিসারদের কাজে ফিরে যেতে বলি। আমি তাদের এ আশ্বাসও দিই, তাঁদের ওপরে কোনো রকম প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না।
তৎকালীন পরিস্থিতিতে বোম্বাইয়ের নৌবাহিনীর অফিসারদের বিদ্রোহ একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের পরে এই প্রথমবার ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে প্রকাশ্য বিদ্রোহ দেখা দেয়। এটা যে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা তা কিন্তু মোটেই নয়। যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের ফলেই সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহের মনোভাব সঞ্চারিত হয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের সেই বাহিনী ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত আক্রমণ করেছিল এবং একসময় তারা ইম্ফল অধিকার করে নেবার অবস্থায় এসে পড়েছিল। জাপানের আত্মসমর্পণের পরে ইংরেজরা ব্রহ্মদেশকে পুনরায় অধিকার করে নেন এবং সেই সময় আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের বন্দী করেন। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকরা ইংরেজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার ব্যাপারে কোনো রকম অনুশোচনাই প্রকাশ করেন না। এঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তখন রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এইসব ঘটনার ফলে ইংরেজদের মনে হয়, ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর ওপরে কর্তৃত্ব বজায় রাখা আর সম্ভব হবে না।
আমি যখন সিমলা কনফারেন্সের পরে কাশ্মীরের গুলমার্গে বাস করছিলাম, সেই সময়ই আমি সর্বপ্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বন্দী করবার সংবাদ শুনতে পাই। মি. প্রতাপ সিং নামে পাঞ্জাব হাইকোর্টের একজন বিচারপতি একদিন উত্তেজিতভাবে আমার কাছে এসে বলেন, সুভাষচন্দ্র বসুর অধীনে যে সেনাবাহিনী ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, সেই বাহিনীর কয়েকজন অফিসারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধৃত অফিসারদের মধ্যে ওই ভদ্রলোকের একজন আত্মীয় ছিলেন বলেই তিনি এতটা উত্তেজনা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মনোভাবটা তৎকালীন সিভিলিয়ানদের মতোই ছিল। তিনি এই মত প্রকাশ করেছিলেন, কংগ্রেস যদি এ ব্যাপারে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করে, তাহলে মামলাটা খারাপের দিকে যাবে। অতএব কংগ্রেস যেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যাপারে নাক না গলায়। তাঁর মতে এই বিচারকে রাজনীতির বাইরে রাখাই ঠিক হবে। আমি তাঁকে বলি, তাঁর মতটা একেবারেই ভুল। কংগ্রেস যদি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে সরকার আই. এন. এ. অফিসারদের কঠিন সাজা দেবেন। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো চরম দণ্ড দেওয়া হবে। এইসব অফিসারদের মধ্যে এমন কয়েকজন প্রতিভাসম্পন্ন যুবক ছিলেন, যাদের কারাদণ্ড বা প্রাণদণ্ড হলে জাতির সমূহ ক্ষতি। আমি তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, আই. এন. এ. অফিসারদের বিচারে কংগ্রেস তাঁদের পক্ষ সমর্থন করবে। আমি তাই কালবিলম্ব না করে এক বিবৃতির মাধ্যমে আমার সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করি।
যা ভাবা গিয়েছিল তাই হলো। আমি ভেবেছিলাম ব্রিটিশ সরকার ওইসব অফিসারদের কাজকর্ম সম্বন্ধে কোনো অভিযোগই আনতে পারবেন না। ভারতীয় বাহিনীর একটি অংশকে ব্রহ্মদেশে এবং সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। জাপান যখন ওই অঞ্চলগুলো অধিকার করে নেয়, ইংরেজরা তখন ভারতীয় সৈনিকদের ভাগ্য তাদের নিজেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সরে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে একজন ইংরেজ অফিসারই ভারতীয় সৈনিকদের জাপানের হাতে ছেড়ে দেন। ভারতীয় সৈনিকরা যদি যুদ্ধবন্দী হিসেবে থাকতেন, তাহলে শত্রুপক্ষ তাঁদের দিয়ে রাস্তা তৈরির কাজ করাতো অথবা তাঁদের কলকারখানায় নিয়োজিত করত। এবং ওইসব কাজ জাপানের যুদ্ধপ্রচেষ্টারই সহায়ক হতো। তাঁরা যখন এইভাবে জাপানের হাতের ক্রীড়নক পরিণত হয়েছিলেন, সেই সময় তাঁরা যদি জাপানের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে থাকেন, তাহলে সেটা মোটেই দূষণীয় কাজ বলে গণ্য হতে পারে না। কিন্তু তাঁরা ঠিক জাপানের তাঁবেদার হতে চাননি। তাঁরা একটি স্বাধীন ফৌজের সামিল হয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্যই যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁরা যতদিন জাপানিদের হাতে যুদ্ধবন্দী অবস্থায় ছিলেন, ততদিন ব্রিটিশ সরকার তাঁদের কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারেননি। সুতরাং তাঁরা যদি জাপানের পক্ষভুক্ত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন, তাহলে ব্রিটিশ সরকারের কিছু বলবার থাকত না। কিন্তু ওঁরা অনেক ভালো কাজ করেছেন। এঁরা স্বাধীন মুক্তিফৌজ গঠন করে মাতৃভূমিকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করবার জন্য অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। এ কাজ নিঃসন্দেহে শ্রেয়তর। এঁরা বিশ্বাস করতেন, ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে পারলে তারা ভারত দখল করে স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার গঠন করতে পারবেন। দেশকে জাপানিদের হাতে তুলে দেবার কোনো রকম ইচ্ছা তাদের কখনো ছিল না। আমি তাই আই. এন. এ.-এর সদস্যদের বিচার করবার মতো কোনো কারণই দেখতে পাই না।
কংগ্রেস মনে করে, সরকার যদি আই. এন. এ. অফিসারদের বিচার করতেই চান, তা করতে হবে প্রকাশ্য আদালতে এবং সেই বিচারের সময় কংগ্রেস তাদের পক্ষ সমর্থন করবে। আমি এই বিষয়ে লর্ড ওয়াভেলকে একটি চিঠি লিখে তাঁকে অনুরোধ করি, তিনি যেন কংগ্রেসের এই অভিমত মেনে নেন। লর্ড ওয়াভেল আমার প্রস্তাবে সম্মত হন এবং এক আদেশ জারি করে বলেন, আই. এন. এ. অফিসারদের বিচার প্রকাশ্যভাবে লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত হবে। এই বিচার জনসাধারণের মনে এক বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। কয়েক মাস বিচার চলবার পর অবশেষে অফিসাররা মুক্তি পান। কেউ কেউ আদালতের আদেশেই মুক্তি পান এবং বাকি আসামিরা মুক্তি পান ভাইসরয়ের বিশেষ আদেশের ফলে।
কয়েকজন অফিসারের সম্বন্ধে আদালতের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়; তাই প্রথম দিকে তাঁরা মুক্তি পান না। এর ফলে জনগণের মধ্যে বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন চলতে থাকে। আমি যখন পাঞ্জাবের মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে লাহোরে গিয়েছিলাম, সেই সময় ওখানকার ছাত্ররা এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করে। তারা সমগ্র শহর পরিক্রমা করে আমি যে বাড়িতে বাস করছিলাম, সেখানে এসে হাজির হয়। আমার কিন্তু প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল এ কাজটি ঠিক হচ্ছে না। আমি তাই দৃঢ়ভাবে ছাত্রদের বলি, কংগ্রেস যখন এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে, সে অবস্থায় ছাত্রদের এইভাবে প্রতিবাদ করে শোভাযাত্রা বের করা অনুচিত হয়েছে। আমরা বন্দীদের পক্ষ সমর্থন করবার এবং তাঁদের মুক্ত করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবং এর জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথে সর্বপ্রকার আইনসম্মত পন্থা গ্রহণ করেছি। সুতরাং এই অবস্থায় অননুমোদিতভাবে কোনো রকম প্রতিবাদ বা আন্দোলন করলে মামলাটির ক্ষতিই করা হবে। ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তখন আলাপ-আলোচনা চলছে। ব্রিটেনে শ্রমিকদল পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নতুন সরকার গঠন করেছেন। তারা আমাদের কথা দিয়েছেন, ভারতীয় সমস্যার সমাধানকল্পে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। তাঁদের সে সুযোগ দিতেই হবে। কংগ্রেস তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বর্তমানে কোনো রকম আন্দোলন করা হবে না। অতএব দেশবাসীদের এখন সর্বতোভাবে কংগ্রেসের নির্দেশ মেনে চলা উচিত।
আগেই বলেছি যে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন চলছিল। কোনো কোনো জায়গায় সে আন্দোলন হিংস্র পথেও গিয়েছিল। দিল্লীতে জনসাধারণ সরকারি ভবনগুলোতে অগ্নিসংযোগ করতে চেষ্টা করেছিল এবং অনেক সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করেছিল। আমি দিল্লীতে ফিরে এসে লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে ওইসব ঘটনার কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, শান্তিপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা হবে বলে কংগ্রেস যে কথা দিয়েছিল, এইসব ঘটনা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাঁর সেই অভিযোগ মেনে নেওয়া ছাড়া আমার কোনো পথ ছিল না। কারণ অভিযোগগুলো সবই সত্যি ছিল। আমি তখন দিল্লীর সমস্ত কংগ্রেস কর্মীকে ডেকে পাঠাই। তাদের কাছে আমি বলি, কংগ্রেস এক মহা সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে। প্রতিটি জাতীয় আন্দোলনেই এমন একটা স্তর আসে, যখন নেতাদের স্থির করতে হয় তাঁরা নেতৃত্ব দেবেন, না আন্দোলনকারী জনতাকে অনুসরণ করে চলবেন। ভারতেও তখন তেমনি এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কংগ্রেস যদি মনে করে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ভারতীয় সমস্যার সমাধান করা হবে, তাহলে কংগ্রেস কর্মীদের কর্তব্য হবে জনগণের কাছে সেই কথা পৌঁছে দেওয়া এবং কংগ্রেসের নির্দেশ অনুসারে কাজ করা। আমি তাদের আরো বলি, জনতা যদি অবৈধ কার্যকলাপ লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের কাছে আমি কোনোক্রমেই নতি স্বীকার করতে রাজি নই। আমি জনমতকে সঠিক পথে সংগঠিত করতে চেষ্টা করব এবং তাদের যথাকর্তব্য নির্দেশ দেব, কিন্তু কোনোক্রমেই জনতার যে-কোনো কাজকে সমর্থন করে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করব না।
বর্তমান পরিচ্ছেদ সমাপ্ত করবার আগে নবগঠিত কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি দল থেকে ভুলাভাইকে কেন বাদ দেওয়া হলো, সে সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলার দরকার বোধ করছি। তাঁকে পার্লামেন্টারি দলে স্থান না দেওয়ায় অনেকেই বিস্ময়বোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন যে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, সে কথা মাত্র কয়েকজন লোক ছাড়া আর কেউ জানতেন না। আমি মনে করি ওই ব্যাপারে আমি যদি সেই ইতিহাস না বলি, তাহলে সে ব্যাপারটা চিরদিন অজ্ঞাতই থেকে যাবে।
ভুলাভাই ছিলেন বোম্বাইয়ের সবচেয়ে নামকরা ব্যবহারজীবী। পরবর্তীকালে তিনি সমগ্র ভারতের মধ্যেই ‘অগ্রগণ্য ব্যবহারজীবী’ হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। প্রথমে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না; কিন্তু ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হবার পর কংগ্রেস যখন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি কংগ্রেস টিকিটে কেন্দ্রীয় আইনসভায় আসেন। তিনি তখন কেন্দ্রীয় আইনসভায় কংগ্রেস পার্টির নেতা নির্বাচিত হন এবং অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে কর্তব্য সম্পন্ন করতে থাকেন। তাঁর সুষ্ঠু কাজের ফলে অচিরেই তিনি কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ মহলে স্থানলাভ করেন। পরে তিনি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং একজন প্রথম সারির নেতারূপে পরিচিত হন। কংগ্রেসের মধ্যে ভুলাভাইয়ের এইরকম প্রতিষ্ঠা দেখে কয়েকজন নেতা তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। তাঁরা মনে করেন, নবাগত একজন ব্যক্তিকে এতটা প্রাধান্য দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।
শেষদিকে ভুলাভাইয়ের স্বাস্থ্য ভালো চলছিলো না। আমি তাই আমার ওয়ার্কিং কমিটিতে তাঁকে গ্রহণ করিনি। এই কারণেই ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গ্রেপ্তার হননি। এর ফলে জেলের বাইরে তিনিই ছিলেন কংগ্রেসের প্রধান নেতা। ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দে গান্ধীজীর মুক্তির পরে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, সে সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে। প্রথম দিকে তিনি যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় ভারতীয়দের সহযোগিতার প্রশ্নে ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু মুক্তিলাভের পর তাঁর মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। তিনি তখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে সম্মত হন। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা সাফল্য লাভ করে না; পরিস্থিতি যেমন ছিল তেমনি থেকে যায়। দিল্লীতে তখন অনেকেই মনে করতে থাকেন, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের ভেতর আলোচনার অচল অবস্থার অবসান হবে না; এটা হতে পারে কেন্দ্রীয় আইনসভার কংগ্রেস পার্টি ও মুসলিম লীগ পার্টির মধ্যে আলোচনা হলে। উভয় পার্টির আলোচনায় যদি কোনো রকম সমাধানের পথ পাওয়া যায়, সে সমাধান হবে সাময়িকভাবে; তবে যুদ্ধ চলাকালে যদি মতৈক্য হয় বা হতে পারে, তাহলে যুদ্ধ শেষ হবার পর সেই মতৈক্যের ভিত্তিতেই কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে স্থায়ীভাবে একটি নিষ্পত্তিও হতে পারবে।
উভয় পক্ষের সঙ্গে পরিচিত এবং উভয় পক্ষের বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তিরা তখন মুসলিম লীগ পার্টির ডেপুটি লিডার লিয়াকত আলী এবং কংগ্রেস পার্টির নেতা ভুলাভাই দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তাদের মধ্যে আলোচনার কথা বলেন। লিয়াকত আলী এতে সম্মত হন।
এই আলোচনার প্রস্তাবে ভুলাভাইও আগ্রহান্বিত ছিলেন, তবে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলে দেন যে, কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া এ ব্যাপারে তিনি এগোতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, আইনসভার উভয় পার্টির মধ্যে সমঝোতায় বিশেষ কোনো ফল হবে না। সমঝোতা হওয়া দরকার উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। কংগ্রেসের সব নেতারা তখন জেলে থাকায় তাঁদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। ভুলাভাই তখন বলেন, এ ব্যাপারে তিনি গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর উপদেশ মতো কাজ করবেন।
ভুলাভাই তখন গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করে লিয়াকত আলী এবং অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা গান্ধীজীর কাছে প্রকাশ করেন। ভুলাভাই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন সোমবারে। কিন্তু সোমবার গান্ধীজীর মৌনদিবস হওয়ায় তিনি তাঁর অভিমত গুজরাটি ভাষায় লিখে দেন। তাঁর সেই লিখিত বক্তব্যের সার কথা হলো, ভুলাভাই এ ব্যাপারে এগিয়ে যেতে পারেন এবং আলোচনার বিষয়বস্তু ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে স্থির করে আবার যেন তাঁকে জানিয়ে দেন।
গান্ধীজীর নির্দেশ পাবার পর ভুলাভাই লিয়াকত আলীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনায় স্থির হয়, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল পুনর্গঠিত হবে এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সদস্যরা তাতে অংশগ্রহণ করবেন। আলোচনায় আরো স্থির হয়, আইনসভায় কংগ্রেস পার্টির লিডার হিসেবে ভুলাভাই এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে যোগদান করবেন, কিন্তু তা যদি কোনো কারণে সম্ভব না হয়, তাহলে ডেপুটি লিডার আব্দুল কাইয়ুম খান কাউন্সিলে আসবেন। ভুলাভাই এসব কথা গান্ধীজীকে জানিয়ে দেন। কিন্তু নানা কারণে আলোচনা আর এগোয় না, ফলে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে আমরা সবাই যখন জেল থেকে বেরিয়ে আসি, তখন উপরোক্ত আলোচনার কথা আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তখন আর একবার দীর্ঘ আলোচনা চলে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভুলাভাই যে গান্ধীজীর মতানুসারে উক্ত আলোচনা করেছিলেন, সে কথা কেউ গ্রাহ্যই করেন না। এ ব্যাপারে সর্দার প্যাটেলই অগ্রণী ভূমিকা নেন। এবং কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যে-কোনোভাবেই হোক, এইরকম একটা ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ভুলাভাই লিয়াকত আলীর সঙ্গে আলোচনা করে পেছনের দরজা দিয়ে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। আগেই বলেছি, ভুলাভাইয়ের ওপরে অনেক কংগ্রেস নেতাই ঈর্ষার মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি যে দ্রুতগতিতে কংগ্রেসের ভেতরে প্রতিষ্ঠা অর্জন করছেন, এটা তারা সুনজরে দেখতেন না। ভুলাভাইয়ের বিরোধীরা গান্ধীজীর কাছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে নানা রকম কুৎসা করে গান্ধীজী-কে-ও শেষ পর্যন্ত ভুলাভাইয়ের বিরোধী করে তুলতে সক্ষম হন। এইসব অভিযোগের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল মিথ্যা। কিন্তু কয়েক মাস ধরে এমনভাবে প্রচার চালানো হয়, যার ফলে ভুলাভাই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হন।
কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে এমনও কয়েকজন ছিলেন, যারা গান্ধীজীকে তাদের স্বমতে আনবার জন্য তাঁর অন্তরঙ্গ মহলের সাহায্য নিতেন। অন্তরঙ্গ মহলের ওইসব লোকেরাই গান্ধীজীর কানে নানা রকম কথা তুলতেন। সাধারণত গান্ধীজী ওইসব কান ভাঙানো কথায় সায় দিতেন না। কিন্তু বার বার যখন একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর কানে তোলা হতো, তখন তাঁর বিচারবোধ ক্ষুণ্ণ হতো। আমার মনে আছে, মতিলাল নেহরুর বিরুদ্ধেও গান্ধীজীর মনকে ঠিক এইভাবেই বিষাক্ত করে তোলা হয়েছিল। জওহরলালের বিরুদ্ধেও একবার এইরকম একটি ব্যাপার ঘটেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে গান্ধীজী যখন প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেন, তখন তিনি সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভুলাভাইয়ের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয় এবং গান্ধীজীর মন থেকে ভুলাভাইয়ের প্রতি বিরুদ্ধ ভাবটা বিদূরিত হয় না।
আমি আগেই বলেছি, লিয়াকত আলীর সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে গান্ধীজীর পরামর্শ নেবার জন্য ভুলাভাই এক সোমবারে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং সেদিনটি গান্ধীজীর মৌনদিবস হওয়ায় তিনি তাঁর বক্তব্য একটি কাগজে লিখে ভুলাভাইয়ের হাতে দিয়েছিলেন। গান্ধীজীর লেখা সেই কাগজটি ভুলাভাই যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। তিনি সেই কাগজটি সর্দার প্যাটেল এবং অন্যান্য নেতাদের দেখিয়ে দেন এবং তাদের বলেন, গান্ধীজীর মত নিয়েই তিনি আলোচনা চালিয়েছিলেন, সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁর ওপরে দোষারোপ করা সঙ্গত হচ্ছে না।
ভুলাভাইয়ের এই আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাপারে নেতারা কোনো কথাই বলেন না। অর্থাৎ, তাঁর বক্তব্যকে (এবং গান্ধীজী-লিখিত অভিমতকেও) ওইসব নেতারা কোনো রকম আমল দেন না। উপরন্তু, ভুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রচার চলতে থাকে তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। এই প্রচার তখন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে (১৯৪৫-৪৬) ভুলাভাইকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয় না।
এই ব্যাপারে ভুলাভাই বিশেষভাবে মানসিক আঘাত পান এবং সেই মানসিক আঘাত তাঁর স্বাস্থ্যের ওপরেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আগেও তিনি হৃদযন্ত্রের অসুখে ভুগছিলেন, কিন্তু এই ঘটনার পরে প্রায়ই তাঁর হার্ট অ্যাটাক হতে থাকে। তাঁর মনে বার বার এই কথাটিই ঘুরতে থাকে, বিশ্বস্তভাবে কংগ্রেসের সেবা করার ফল হিসেবে তিনি পেলেন শুধু অসম্মান এবং অপমান।
এই সময়ে আমি একবার বোম্বাইয়ে যাই এবং চিরাচরিত অভ্যাসবশে ভুলাভাইয়ের বাড়িতেই বাস করি। আমি যখন তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হই তখন দেখতে পাই তিনি শুয়ে আছেন। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। তাঁর প্রধানতম দুঃখ হলো, গান্ধীজী সবকিছু জেনেও তাঁর পক্ষে দাঁড়ালেন না। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি কিন্তু তাতে কোনোই ফল হয় না। আমি এই বিষয়ে পরে গান্ধীজীর সঙ্গে আলোচনা করি। কিন্তু ইতিমধ্যে ভুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে এতো সব অভিযোগ তাঁর কাছে করা হয়েছিলো যে তার মনটা ভুলাভাইয়ের প্রতি রীতিমতো বিষাক্ত হয়ে উঠেছিলো। এর কিছুদিন পরেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ভুলাভাই পরলোকগমন করেন। এই ঘটনা আজও আমি ভুলতে পারিনি। আজও ভুলাভাইয়ের কথা মনে পড়লে আমার মন দুঃখে এবং শোকে অভিভূত হয়ে পড়ে। বার বার আমার মনে হয় ভুলাভাই কংগ্রেসকে কায়মনোবাক্যে সেবা করেছিলেন, কিন্তু সেই সেবার পরিবর্তে তিনি পেয়েছিলেন চরম অবিচার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন