১৫। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

১৫. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আমি আগেই বলেছি, কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দায়িত্ব পার্লামেন্টারী কমিটির ওপর অর্পণ করেছিল। কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্ত অনুসারে জওহরলাল, প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ আর আমি ১৭ই আগস্ট দিল্লীতে এক ঘরোয়া সভায় মিলিত হই। আমার সহকর্মীরা আমাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করবার জন্য বিশেষভাবে চাপ দেন। গান্ধীজীও তাঁদের বক্তব্যই সমর্থন করেন। আমার কাছে এটি ছিল একটি বিশেষ প্রশ্ন, কিন্তু বিশেষভাবে চিন্তা করবার পর অবশেষে আমি সরকারের বাইরে থাকবো বলেই স্থির করি। আমি তাই আমার পরিবর্তে আসফ আলীকে মন্ত্রিসভায় নিতে বলি। আসফ আলী এ কথা শুনবার পর তিনিও আমাকে সরকারে যোগদানের জন্য চাপ দিতে থাকেন, কিন্তু আমি তাতে সম্মত হইনি। আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই তখন বলতে থাকেন, আমার সিদ্ধান্তটি ভুল। এখনো তাঁরা এই কথাই বলছেন। তাঁদের মতে দেশের স্বার্থে এবং বিশেষ করে যে রকম বাধা-বিঘ্নের ভেতর দিয়ে আমরা এখন চলেছি তাতে আমার সরকারে আসাটা অত্যন্ত বেশি প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে তখনো আমি চিন্তা করেছি এবং এখনো করছি, কিন্তু আমার সেদিনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, না ভ্রান্ত ছিল, সে কথা আমি ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। আমি যদি সরকারে যোগ দিতাম তাহলে হয়তো আমি আরো বেশি করে দেশকে সেবা করতে পারতাম। কিন্তু তখন আমার এই কথাই মনে হয়েছিল, সরকারের বাইরে থাকলেই বেশি করে জনগণকে সেবা করতে পারবো। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি, সরকারে যোগদান করলেই দেশের এবং দশের সেবা করবার বেশি সুযোগ আমি পেতাম।

সিমলা সম্মেলনের সময় পার্শীকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেবার জন্য আমি বিশেষভাবে চাপ দিয়েছিলাম। এখন কংগ্রেস যখন সরকার গঠন করতে চলেছে, সেই সময় আবার আমি আমার সেই পূর্ব-অভিমতের পুনরাবৃত্তি করি। আমার সহকর্মীরা তখন কিছুক্ষণ আলোচনা করে এতে সম্মত হন। কিন্তু পার্সী সম্প্রদায় যেহেতু বোম্বাই শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেইহেতু আমরা মনে করি পার্সীদের ভেতর থেকে মন্ত্রিসভায় কাকে নেওয়া হবে তা সর্দার প্যাটেলই ভালোভাবে বলতে পারবেন। এই কথা মনে করে সর্দার প্যাটেলের ওপরেই এ ব্যাপারে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরে তিনি মিঃ সি. এইচ. ভাবার নাম প্রস্তাব করেন। পরে আমরা জানতে পারি, মিঃ ভাবা ছিলেন সর্দার প্যাটেলের ছেলের বন্ধু। আমরা আরো জানতে পারি, তিনি পার্সী সম্প্রদায়ের নেতা তো ছিলেনই না, এমনকি ওই সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিনিধিও তিনি ছিলেন না। সুতরাং আমাদের সেই নির্বাচন সঠিক হয়নি। কিছুদিন পরেই মিঃ ভাবা সরকার থেকে বেরিয়ে যান।

আমরা আরো স্থির করেছিলাম, অর্থ বিভাগের প্রথম সদস্য হিসেবে একজন অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদকে নিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা ডঃ জন মাথাইকে মনোনীত করি। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ডঃ মাথাই কোনোভাবেই কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যে শুধুমাত্র দলীয় প্রতিনিধিদের নিতে হবে এমনও কোনো বাধ্যবাধকতা তখন ছিল না।

এই ব্যাপারে মুসলিম লীগ রীতিমতো হতাশ এবং রুষ্ট হয়ে পড়ে। লীগ মনে করে, ইংরেজরাই তাদের ওইভাবে কোণঠাসা করেছে। লীগ তাই দিল্লী শহরে এবং আরো কয়েক জায়গায় প্রতিবাদ মিছিল বের করতে চেষ্টা করে কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা বিফল হয়। উপরন্তু এর ফলে সারা দেশব্যাপী তিক্ততা এবং নানা রকম ঝামেলার সৃষ্টি হয়। লর্ড ওয়াভেল মনে করেন, লীগকে সরকারে অংশগ্রহণের জন্য তিনি আর একবার চেষ্টা করবেন। এই কথা মনে করে তিনি মিঃ জিন্নাকে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য ডেকে পাঠান। মিঃ জিন্না তখন দিল্লীতে এসে কয়েকবার তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন। অবশেষে ১৫ই অক্টোবর মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

আমিও এই সময় কয়েকবার লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে বলেন, মুসলিম লীগ সরকারে অংশগ্রহণ না করলে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা ঠিকমতো রূপায়িত হবে না। তিনি আরো বলেন, দেশের মধ্যে যেভাবে সাম্প্রদায়িক হানাহানি চলছে মুসলিম লীগ সরকারের মধ্যে না আসা অবধি তা চলতেই থাকবে। আমি তাকে বলি, সরকারে লীগের যোগদানের ব্যাপারে কংগ্রেসের তরফ থেকে কোনো সময়ই কোনো আপত্তি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আমি বার বার এই অভিমত প্রকাশ করেছি, মুসলিম লীগের সরকারে আসা দরকার। জওহরলালও এই অভিমতই পোষণ করেন। তাই তিনি সরকারে প্রবেশ করবার আগে এবং পরে মিঃ জিন্নার কাছে সহযোগিতার জন্য আবেদন করেছেন।

এই সময় আমি আর একটি বিবৃতি প্রচার করি। সেই বিবৃতিতে আমি বলি, মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাবে মুসলিম লীগের সব রকম ভীতিরই নিরসন করা হয়েছে। যুক্ত পরিষদে অংশগ্রহণ করে লীগের নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করবার পূর্ণ স্বাধীনতাও মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাবে দেওয়া হয়েছে। অতএব লীগ কর্তৃক পরিষদকে বয়কট করবার কোনোই কারণ নেই। এরপর আমি যখন লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করি তখন আমাকে তিনি বলেন, আমার এই বিবৃতি পড়ে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, আমার বিবৃতির একটি কপি তিনি মিঃ জিন্নাকে দেখাবার জন্য লিয়াকত আলীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

এখানে আমি, মিঃ জিন্না যাদের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে কিছু বলছি। মুসলিম লীগের মধ্যে লিয়াকত আলী নিঃসন্দেহে ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। এছাড়া আরো যে দুজন অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন তাঁরা হলেন বাংলার খাজা নাজিমুদ্দিন এবং উত্তরপ্রদেশের নবাব ইসমাইল খান। সুতরাং আগে থেকেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম, মুসলিম লীগ মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা মেনে নিলে লীগ-প্রতিনিধি হিসেবে এই তিনজন ব্যক্তি অবশ্যই মনোনীত হবেন। সিমলা সম্মেলনের সময়ও বার বার এই তিনজনের নাম উল্লেখিত হয়েছিল। কিন্তু এবারে লীগ যখন ব্যবস্থাপক সভায় অংশগ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন মিঃ জিন্নার মতিগতি বিস্ময়করভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। খাজা নাজিমুদ্দিন এবং নবাব ইসমাইল খান কংগ্রেসের সঙ্গে লীগের মতবিরোধের ব্যাপারে কখনই উগ্র মনোভাব দেখাননি। এর ফলে মিঃ জিন্না তাঁদের ওপরে মোটেই খুশি ছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন এঁরা দুজন তাঁর ‘জো হুকুম’ পর্যায়ে কখনোই আসবেন না, সুতরাং প্রতিনিধির তালিকায় এঁদের দুজনের নাম বাদ গেলো। এটা যদি আগে থেকে জানা যেতো তাহলে লীগ কাউন্সিলের ভেতরে নিশ্চয়ই একটা সোরগোল উঠতো। তিনি তাই লীগ কাউন্সিলকে দিয়ে এইভাবে একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন যে প্রতিনিধি নির্বাচনের পূর্ণ ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হলো।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে লীগ প্রতিনিধি

লর্ড ওয়াভেলের কাছে তিনি যে লীগ প্রতিনিধিদের নামের তালিকা পেশ করেন তাঁরা হলেন লিয়াকত আলী, আই. আই. চুন্দ্রীগর, আবদুর রব নিস্তার, গজনফর আলী এবং যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। এই জে. এন. মণ্ডল সম্বন্ধে আমি আলাদাভাবে বলছি। অপর যে তিনজনকে পাঠানো হয়েছিল তাঁরা সবাই ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ওই তিনটি কালো ঘোড়া সম্বন্ধে লীগের সদস্যরাও বিশেষ কিছু জানতেন না। তবে একথা অনস্বীকার্য, লীগ কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনে নামেনি অথবা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেনি। সুতরাং খুব কমসংখ্যক নেতাই সর্বজনপরিচিত ছিলেন। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন এবং নবাব ইসমাইল খান সম্বন্ধে এরকম কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এঁরা দুজনেই সারা ভারতে সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু মিঃ জিন্নার ওই তিনজন হুকুম বরদারের জন্য তাঁদের নাম বাদ গেলো।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের নাম ঘোষিত হয় ২৫শে অক্টোবর। এর কিছুদিন আগে থেকেই খাজা নাজিমুদ্দিন, নবাব ইসমাইল খান এবং আরো কয়েকজন লীগ নেতা উক্ত ঘোষণার জন্য অধীরভাবে ইম্পিরিয়াল হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা দৃঢ়নিশ্চয় ছিলেন নামের তালিকায় তাঁদের নাম অবশ্যই দেখতে পাওয়া যাবে। এই রকম অনুমান করে বহু সংখ্যক লীগ সদস্য ফুলের মালা এবং তোড়া নিয়ে সেখানে এসে সমবেত হয়েছিলেন। এরপর যখন নামের তালিকা ঘোষিত হলো এবং দেখা গেলো যে ওঁরা দুজনেই বাদ পড়েছেন, তখন সমবেত জনতা কি রকম হতাশ এবং রাগান্বিত হয়েছিলেন সে কথা যে কোনো লোকই অনুমান করতে পারবেন। মিঃ জিন্না তাঁদের আশার ওপরে বরফ-জল ঢেলে দিলেন।

লীগের আর একটি অপকর্ম হলো প্রতিনিধি তালিকায় মিঃ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নাম অন্তর্ভুক্ত করা। ইতিপূর্বে মিঃ জিন্না নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন কংগ্রেস শুধু হিন্দুদেরই প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাতে পারবে। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেস যখন হিন্দু, শিখ, পার্সী, তপশিলী সম্প্রদায় এবং খ্রীষ্টানদের ভেতর থেকে প্রতিনিধি মনোনয়ন করলো তখন মিঃ জিন্না মনে করলেন তিনিও এবার দেখিয়ে দেবেন মুসলিম লীগ শুধু মুসলমানদেরই প্রতিনিধিত্ব করে না, অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বও সে করে। এবং এই উদ্দেশ্যেই তিনি একজন অ-মুসলমানকে লীগের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করবেন বলে স্থির করেন। এই কারণেই তিনি মিঃ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে মনোনীত করেন। তাঁকে মনোনীত করবার সময় মিঃ জিন্না তাঁর নিজের দাবীর কথাও ভুলে গেলেন। আগে তিনি দাবী তুলেছিলেন, কংগ্রেস শুধু হিন্দু প্রতিনিধি এবং মুসলিম লীগ শুধু মুসলমান প্রতিনিধি পাঠাবে। ও কথা বাদ দিলেও দেখা যায় মিঃ জিন্নার এই বিশেষ কাজটির ফলে লীগ মহলে হাসি-তামাসা এবং রাগের সঞ্চার হয়। মিঃ সুরাবর্দী যখন বাংলায় লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তখন তিনি তাঁর সেই মন্ত্রিসভায় একমাত্র অমুসলমান সদস্য হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে নিয়েছিলেন। ওই ভদ্রলোক তখন বাংলাদেশে একেবারেই অপরিচিত ছিলেন এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর কোনো স্থানই ছিল না। কিন্তু যেহেতু তিনি মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিনিধি সেই হেতু কোনো একটি বিভাগের দায়িত্বও তাঁকে দিতে হবে। এই কারণে তাঁকে আইন বিভাগের সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়। সে সময় বেশিরভাগ সেক্রেটারিই ছিলেন ইংরেজ। মিঃ মণ্ডলের বিভাগেও ইংরেজ সেক্রেটারী ছিলেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই অভিযোগ জানাতে লাগলেন যে মিঃ মণ্ডলের মতো একজন সদস্যের সঙ্গে কাজ করা অসম্ভব।

এবার লীগ সরকারে যোগদান করতে সম্মত হওয়ায় কংগ্রেসকে বিভিন্ন বিভাগ পুনর্বিন্যাস করে লীগ প্রতিনিধিদের জন্য স্থান করে দেবার প্রয়োজন অনুভূত হলো। লীগ প্রতিনিধিদের স্থান দেবার জন্য তিনজন কংগ্রেসীর পদত্যাগ করা দরকার। আমরা তাই স্থির করলাম, মিঃ শরৎচন্দ্র বোস, স্যার সাফাত আহমদ খান এবং সৈয়দ আলী জাহির সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন। এরপরেই ওঠে বিভাগ বণ্টনের কথা। লর্ড ওয়াভেল বলেন, গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ লীগ প্রতিনিধিকে দিতে হবে। তিনি প্রস্তাব করেন, স্বরাষ্ট্র বিভাগ লীগকে দেওয়া হোক। এই বিভাগের সদস্য ছিলেন সর্দার প্যাটেল। তিনি তীব্রভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। আমার মতে আইন ও শৃঙ্খলা ছিল একান্তভাবেই প্রদেশগুলোর এক্তিয়ারে। মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাতেও বলা হয়েছিল, আইন ও শৃঙ্খলার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ কিছু করণীয় ছিল না। সুতরাং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র বিভাগটি তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল না। আমি তাই লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবটি মেনে নিতে বলি, কিন্তু সর্দার প্যাটেল এ ব্যাপারে রীতিমতো একগুঁয়ে মনোভাব প্রকাশ করেন। তিনি এমন কথাও বলেন, স্বরাষ্ট্র বিভাগ ছাড়তে হলে তিনি সরকার থেকে বেরিয়ে যাবেন।

লিয়াকত আলীর হাতে অর্থবিভাগ

আমরা তখন বিকল্প ব্যবস্থা সম্বন্ধে চিন্তা করতে থাকি। এই সময় রফি আমেদ কিদোয়াই বলেন, অর্থবিভাগটি মুসলিম লীগকে দেওয়া হোক। অর্থবিভাগ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। কিন্তু ওটি এমনই একটি বিভাগ যা চালাতে হলে বিশেষ ধরনের টেকনিক্যাল জ্ঞান থাকা দরকার। লীগ প্রতিনিধিদের মধ্যে অর্থবিভাগ পরিচালনা করবার মতো কেউ ছিলেন না। কিদোয়াই ভেবেছিলেন, লীগ হয়তো অর্থবিভাগের দায়িত্ব নিতে চাইবেন না। তা যদি হতো তাহলে কংগ্রেসকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগই হারাতে হতো না। আবার লীগের কোনো প্রতিনিধি যদি অর্থবিভাগের দায়িত্ব নেনই, তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে বেকুব হয়ে সরে আসতে হবে। তিনি তাই ভেবে নিয়েছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিভাগই কংগ্রেসকে ছাড়তে হবে না।

সর্দার প্যাটেল লাফিয়ে উঠে এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন। আমি তখন তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করি, অর্থবিভাগ যদি লীগের হাতে যায় তাহলে তাঁরা নানাভাবে অসুবিধে সৃষ্টি করতে পারবেন। সর্দার প্যাটেল বলেন, লীগ কিছুতেই অর্থবিভাগ চালাতে পারবে না, সুতরাং তাঁরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না। আমি কিন্তু এতে খুশি হতে পারিনি। কিন্তু সবাই যখন এ প্রস্তাব মেনে নিলেন তখন বাধ্য হয়েই আমাকেও এটা মেনে নিতে হলো। এরপর ভাইসরয়কে জানিয়ে দেওয়া হলো কংগ্রেস অর্থবিভাগটি মুসলিম লীগকে ছেড়ে দিতে চায়।

লর্ড ওয়াভেল যখন এই সংবাদটি মিঃ জিন্নাকে জানালেন তখন মিঃ জিন্না তাঁকে বললেন, এ সম্পর্কে তাঁর উত্তর পরের দিন জানানো হবে। মনে হয়, প্রথমদিকে মিঃ জিন্নার মনে এই প্রস্তাব সম্বন্ধে কিছুটা অনিশ্চিত ভাব ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, মন্ত্রিসভায় লীগের তরফ থেকে লিয়াকত আলীই হবেন মুখপাত্র। কিন্তু তিনি অর্থবিভাগের ভার নিয়ে সুষ্ঠুভাবে ওই বিভাগটি চালাতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে তাঁর মনে সন্দেহ ছিল। এদিকে এই খবরটা যখন অর্থবিভাগের চৌধুরী মহম্মদ আলী জানতে পারেন তখন তিনি অবিলম্বে মিঃ জিন্নার সঙ্গে দেখা করে বলেন, কংগ্রেসের এই প্রস্তাব লীগের সামনে মহা সুযোগ এনে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, কংগ্রেস যে অর্থবিভাগটি ছেড়ে দিতে চাইবে এটা তিনি ভাবতেও পারেননি। এই বিভাগের ভার লীগের হাতে থাকার ফলে সরকারের প্রতিটি বিভাগের ওপরেই লীগ তার কর্তৃত্ব খাটাতে পারবে। তিনি তাই মিঃ জিন্নাকে বলেন, এ ব্যাপারে তাঁর চিন্তিত হবার কোনোই কারণ নেই। মিঃ লিয়াকত আলী যাতে সমস্ত বিষয় সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারেন তার জন্য তিনি তার সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবেন। মিঃ জিন্না তখন প্রস্তাবটি মেনে নেন এবং লিয়াকত আলী অর্থবিভাগের ভার নেন। কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেস বুঝতে পারে, লীগের হাতে অর্থবিভাগ ছেড়ে দিয়ে মহা ভুল করেছে।

সব দেশেই সরকারের চাবিকাঠি থাকে অর্থমন্ত্রীর হাতে। ভারতবর্ষে এটি আরো গুরুত্বপূর্ণ; কারণ ইংরেজ সরকার অর্থবিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্যকে সরকারের স্বার্থরক্ষক বলে মনে করেন। এই বিভাগের ভার চিরদিনই কোনো-না-কোনো ইংরেজের হাতে রাখা হয়েছে, অর্থবিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সরকারের প্রতিটি বিভাগের ওপরেই খবরদারি করতে পারতেন এবং এই কারণে সরকারী নীতি নির্ধারণের ব্যাপারেও তাঁর বিরাট প্রভাব ছিল। সুতরাং লিয়াকত আলী যখন অর্থবিভাগের সদস্য হলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকারের চাবিকাঠি তাঁর হাতে গিয়ে পড়ে। সরকারের যে কোনো বিভাগের যে কোনো প্রস্তাবই অর্থবিভাগের বিবেচনাধীন ছিল। এ ব্যাপারে অর্থবিভাগের সদস্যের হাতে প্রকৃতপক্ষে ভেটো ক্ষমতা বিদ্যমান ছিল। তাঁর বিভাগের অনুমোদন ছাড়া একজন চাপরাশী নিযুক্ত করাও সম্ভব ছিল না।

সর্দার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র বিভাগটি তাঁর নিজের হাতে রাখতে অতিমাত্রায় আগ্রহান্বিত ছিলেন। এবার তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেন লীগকে অর্থবিভাগ ছেড়ে দিয়ে তিনি লীগের হাতে গিয়ে পড়েছেন। তিনি যখনই কোনো প্রস্তাব করেছেন, সে প্রস্তাব লিয়াকত আলী হয় বাতিল করেছেন অথবা এমনভাবে সংশোধন করেছেন যাতে প্রস্তাবটি একেবারেই ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। তাঁর এই ধরনের কাজের ফলে কংগ্রেস সদস্যরা কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে করতে পারছিলেন না। ফলে, সরকারের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি হয় এবং সে মতবিরোধ উত্তরোত্তর বেড়েই চলতে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন এক আবহাওয়ার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিল যখন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস একেবারে তুঙ্গে উঠেছিল। সরকারে যোগদানের আগেও লীগ কংগ্রেসকে অবিশ্বাস করত এবং নতুন ব্যবস্থাপক সভা গঠনের ব্যাপারেও এই অবিশ্বাসই তাদের প্রভাবিত করেছিল। ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বর মাসে যখন সর্বপ্রথম লীগ কাউন্সিল গঠিত হয়েছিল তখনই তাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছিল, প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্ব কার ওপরে থাকবে। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্যই ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস চেয়েছিল প্রতিরক্ষা বিভাগটি তাদের বিশ্বাসভাজন কোনো ব্যক্তির হাতে থাকবে। কিন্তু লর্ড ওয়াভেল বলেন, এর ফলে নানা রকম অসুবিধে দেখা দেবে। তাঁর মতে প্রতিরক্ষা বিভাগকে রাজনীতির আওতা থেকে বাইরে রাখা উচিত। প্রতিরক্ষা বিভাগটি যদি কোনো কংগ্রেস সদস্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে লীগ সব সময় ভিত্তিহীন অভিযোগ পেশ করতে থাকবে। তিনি আরো বলেন, লীগ যদি সরকারে অংশ গ্রহণ করে তাহলেও তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগটি কোনো লীগ সদস্যের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নন। তিনি প্রস্তাব করেন, প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্ব কোনো হিন্দু অথবা মুসলমানকে দেওয়া ঠিক হবে না। সেই সময় শিখ সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে সর্দার বলদেও সিংকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছিল। লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবক্রমে তাঁর ওপরেই প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো।

মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের মনে কী ধরনের সন্দেহ আর অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল সে সম্বন্ধে এখানে একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবার পরে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করেছিলেন, সদস্যরা সরকারীভাবে কোনো সভায় সমবেত হবার আগে বে-সরকারীভাবে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে নেবেন। এইভাবে পূর্বাহ্ণে আলোচনা করবার ফলে পরে সরকারীভাবে আলোচনার সুবিধে হবে। মনে করা গিয়েছিল, এইভাবে প্রাক্-আলোচনার ফলে এমন একটি নজির সৃষ্টি হবে যে ভাইসরয়ই সরকারের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। এই সব আলোচনা-সভা বিভিন্ন সদস্যের ঘরে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হতো।

জওহরলাল প্রায়ই সদস্যদের চা-চক্রে যোগদানের জন্য আহ্বান করতেন। সাধারণত এই নিমন্ত্রণ জানানো হতো জওহরলালের একান্ত সচিবের মাধ্যমে। মুসলিম লীগ সরকারে আসবার পরেও এই পদ্ধতিটি অনুসৃত হতে থাকে। এ ব্যাপারে লিয়াকত আলী বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হন। তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেন, জওহরলালের একান্ত সচিব কর্তৃক এইভাবে নিমন্ত্রণপত্র প্রেরণ তাঁর পক্ষে অসম্মানজনক। তিনি আরো মনে করেন, পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্টরূপে জওহরলালের এমন কোনো ক্ষমতা নেই যাতে তিনি এইভাবে বেসরকারী আলোচনা সভায় সদস্যদের আহ্বান করতে পারেন। জওহরলালের ক্ষমতা অস্বীকার করলেও দেখা যায়, লিয়াকত আলী নিজেও এইরকম সভা আহ্বান করতে লাগলেন। ঘটনাটি সামান্যই। কিন্তু এই সামান্য ঘটনা থেকেই মুসলিম লীগ প্রতিনিধিদের কংগ্রেসের সঙ্গে অসহযোগিতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অক্টোবরের শেষ দিকে জওহরলাল এমন একটি অকাজ করে বসেন যার ফলে আমি প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হই। প্রকৃতিগতভাবে তিনি প্রায়ই হৃদয়াবেগ দ্বারা চালিত হন। এতে সময় সময় ভুল-ভ্রান্তিরও সৃষ্টি হতো। কিন্তু পরে যখন বিষয়টা তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হতো তখন তিনি অকপটেই ত্রুটি স্বীকার করতেন। তবে সময় সময় তিনি ঘটনাবলীকে সম্যকভাবে বিবেচনা না করেই কোনো-না-কোনো কাজ করে বসতেন। এবং একবার এই রকম একটা কাজ করে ফেললে সেই কাজটি তিনি সমর্থন করবার জন্য অনেক দূর অগ্রসর হতেন।

উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানরা ছিলেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত ওখানকার মন্ত্রিসভা কংগ্রেসই নিয়ন্ত্রণ করেছে। এটা সম্ভব হয়েছিল খান আবদুল গফ্ফর খান এবং তাঁর খোদাই খিদমতগার দলের কার্যকলাপের ফলে। প্রকৃতপক্ষে সীমান্ত প্রদেশের যাবতীয় বিষয়ের জন্যই আমরা খান আবদুল গফ্ফর খান এবং তাঁর ভাই ডাঃ খান সাহেবের ওপর নির্ভর করতাম।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবার অব্যবহিত পরেই দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের অধিবাসীদের ওপরে বোমাবর্ষণ নিষিদ্ধ করে এক হুকুমনামা জারি করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে জওহরলালের কাছে নানা সূত্র থেকে খবর আসতে থাকে, সীমান্ত প্রদেশের বিপুল সংখ্যক অধিবাসী কংগ্রেস তথা খান-ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরোধী। স্থানীয় আমলারা বার বার এই অভিমত ব্যক্ত করে,

স্থানীয় জনসাধারণ কংগ্রেস অপেক্ষা মুসলিম লীগের দিকেই বেশি করে ঝুঁকেছে। জওহরলাল মনে করেন, আমলাদের এই অভিমত সত্যি নয়। ইংরেজ কর্মচারীরাই এইরকম একটা ধারণার সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়েছে। কারণ তারা কংগ্রেসকে কখনো সুনজরে দেখতো না। লর্ড ওয়াভেল এ ব্যাপারে জওহরলালের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তবে রিপোর্টটিকে পুরোপুরিভাবেও তিনি মেনে নেননি। তিনি মনে করতেন সীমান্ত প্রদেশের জনগণ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একভাগ খান ভ্রাতৃদ্বয়কে সমর্থন করছে এবং অপরভাগ মুসলিম লীগকে সমর্থন করছে। কংগ্রেস মহলের ধারণা ছিল, জনগণের বৃহত্তর অংশই খান-ভ্রাতাদের সমর্থক। জওহরলাল বলেন, তিনি সীমান্ত প্রদেশ সফর করে প্রকৃত অবস্থাটা জানতে চেষ্টা করবেন।

জওহরলালের এই সিদ্ধান্তের কথা আমি যখন জানতে পারি তখন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলি, এ ব্যাপারে এখনই কিছু করা ঠিক হবে না। সীমান্ত প্রদেশের প্রকৃত ঘটনাবলী এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। সব প্রদেশেই জনগণ দুই অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। সীমান্ত প্রদেশেও এই ব্যাপারই ঘটেছে এবং ওখানেও একদল লোক খান ভ্রাতাদের বিরোধিতা করছে। কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান করলেও নিজেদের এখনো শক্তিশালী করতে পারেনি। এই সময়ে তাঁর সীমান্ত প্রদেশ সফর বিরোধীদের মনোভাবকে আরো বিরোধী করে তুলবে। তাছাড়া সরকারী কর্মচারীদের বেশিরভাগ অংশ যেখানে লীগের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন, তাতে প্রকাশ্যে কিছু না করলেই গোপনে গোপনে তারা বিরোধীদের মদত দেবে। সুতরাং এই অবস্থায় সীমান্ত সফর বাতিল করাটাই শ্রেয় হবে। গান্ধীজীও আমার অভিমত সমর্থন করেন কিন্তু জওহরলাল বলেন, যাই ঘটুক না কেন, তিনি ওখানে যাবেনই।

খান-ভ্রাতৃদ্বয় সঠিকভাবেই দাবী করতেন, সীমান্ত প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক লোক তাঁদের পেছনে ছিল। কিন্তু তাঁরা তাঁদের জনপ্রিয়তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেননি। এটাই স্বাভাবিক, কারণ প্রত্যেকেই তাঁর নিজের শক্তি সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। হয়তো ওঁরা আমাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, অন্যান্য প্রদেশে জনগণের মধ্যে বিরোধ থাকলেও সীমান্ত প্রদেশ সব সময়ই কংগ্রেসের সঙ্গে আছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, জনগণের একটি শক্তিশালী অংশ খান-ভ্রাতাদের বিরোধী ছিল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ডাঃ খান সাহেবের কার্যকলাপের ফলেই এইভাবে বিরোধী দলের সৃষ্টি হয়েছিল। সারা প্রদেশের ওপরে নিজের প্রাধান্য সৃষ্টি করবার সুযোগ তাঁর থাকলেও তাঁর কিছু কাজের ফলে বিরোধী দল শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

এইসব ত্রুটির মধ্যে কিছু ছিল ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং কিছু ছিল সামাজিক ব্যাপার। সীমান্তের পাঠানরা তাঁদের আতিথেয়তার জন্য খ্যাত ছিলেন। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে শেষ রুটিখানাও তাঁর সঙ্গে সমভাবে ভাগ করে নিয়ে তাঁরা আহার করতেন। অপরের কাছ থেকেও তারা এইরকম আতিথেয়তাই আশা করতেন। এ ব্যাপারে কারো কাছ থেকে তাঁরা কৃপণতা এবং সহৃদয়তার অভাব দেখলে অত্যন্ত বিরক্ত হতেন। এই ব্যাপারে খান-ভ্রাতৃদ্বয়ের কাজকর্ম মোটেই ভালো ছিল না। সুতরাং তাঁদের সমর্থকরা ক্রমশ তাঁদের ওপরে বিরক্ত হয়ে পড়ছিলেন।

খান-ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন খানদানি পরিবারের লোক। কিন্তু স্বভাবের দিক থেকে তাঁরা অতিথিপরায়ণ ছিলেন না। ডাঃ খান সাহেব মুখ্যমন্ত্রী হবার পরে কোনো লোককেই তাঁরা তাঁদের বাড়িতে আহারের নিমন্ত্রণ করেননি। কোনো লোক যদি চা-পানের সময় অথবা ডিনারের সময় তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তখন তাঁকে ওঁরা খেতে বলতেন না। তাঁদের এই কৃপণ স্বভাবের জন্য জনসাধারণের অর্থও তাঁরা সঠিকভাবে ব্যয় করতেন না। সাধারণ নির্বাচনের সময় কংগ্রেস বিরাট অঙ্কের টাকা তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিল কিন্তু খান-ভ্রাতৃদ্বয় সে টাকার অল্পই ব্যয় করেছিলেন। সময়মতো অর্থ সাহায্য না পেয়ে এবং প্রয়োজনীয় অর্থ না পেয়ে অনেক প্রার্থীই নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা যখন জানতে পারেন হাতে যথেষ্ট টাকা থাকা সত্ত্বেও সে টাকা ব্যয় করা হয়নি, তখন তাঁরা তাঁদের শত্রু হয়ে পড়েন।

এইরকম একটি ঘটনার ফলে পেশোয়ার থেকে কিছু সংখ্যক লোক কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তখন চা-পানের সময় হয়েছিল বলে আমি তাঁদের চা আর বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়িত করি। প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েকজন লোক তখন বিস্মিতভাবে বিস্কুটগুলোর দিকে তাকান। একজন একখানা বিস্কুট হাতে তুলে নিয়ে তার নাম জানতে চান। তাঁরা খুশি মনেই বিস্কুটগুলো খান। খেতে খেতে তাঁরা বলেন, এইরকম বিস্কুট তাঁরা ডাঃ খান সাহেবের বাড়িতেও দেখেছেন। কিন্তু তিনি কখনো আমাদের চা-বিস্কুট খেতে দেননি।

১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় আসে যে সীমান্ত প্রদেশে খান-ভ্রাতৃদ্বয়ের জনপ্রিয়তা রীতিমতো কমে গিয়েছিল।

অশুভ সময়ে জওহরলালের সীমান্তপ্রদেশ সফর

জওহরলাল যখন পেশোয়ারে পদার্পণ করেন তখন সেখানকার পরিস্থিতি দেখে তিনি রীতিমতো মর্মাহত হয়ে পড়েন। সীমান্তপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তখন ডাঃ খান সাহেব। মন্ত্রিসভাও কংগ্রেসী সদস্যদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল। আমি আগেই বলেছি, ওখানকার ইংরেজ অফিসাররা কংগ্রেস-বিরোধী ছিলেন। তাঁরা জনসাধারণকে নানাভাবে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছিলেন। জওহরলাল বিমান-বন্দরে অবতরণ করেই দেখতে পান হাজার হাজার পাঠান কালো পতাকা হাতে নিয়ে সেখানে সমবেত হয়েছেন। জওহরলালকে দেখতে পেয়েই তাঁরা কংগ্রেস-বিরোধী ধ্বনি দিতে শুরু করেন। ডাঃ খান সাহেব এবং আরো কয়েকজন মন্ত্রী জওহরলালকে স্বাগত জানাবার জন্য বিমান-বন্দরে এসেছিলেন। তাঁদের অবস্থা তখন রীতিমতো গুরুতর হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে তাঁরা তখন পুলিসের রক্ষণাধীনে রয়েছেন। সুতরাং ওখানকার পরিস্থিতির মোকাবিলা করা তাঁদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। জওহরলাল মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই জনতা মুহুর্মুহু ‘জওহরলাল মুর্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে তাঁর গাড়ির দিকে ছুটে আসতে থাকে। ব্যাপার দেখে ডাঃ খান সাহেব এতোই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে তিনি তাঁর রিভলবার বের করে জনতার ওপরে গুলি করতে চেষ্টা করেন। রিভলবার দেখে জনতা কিছুটা দূরে সরে যায়। এরপর পুলিস কর্ডন করে জওহরলালকে গাড়িতে তুলে দেয় এবং পুলিসের রক্ষণাধীনেই গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকে।

পরদিন জওহরলাল উপজাতি-অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শন করবার উদ্দেশ্যে পেশোয়ার পরিত্যাগ করেন। কিন্তু যেখানেই তিনি যান সেখানেই বিশাল জনতা সমবেত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে। ওয়াজিরি প্রদেশের মালিক সম্প্রদায়ই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছিল। কোনো কোনো জায়গায় তারা জওহরলালের গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়েছিল। এই সময় তাদের নিক্ষিপ্ত একটি ইটের টুকরো এসে জওহরলালের কপালে আঘাত করে। জওহরলাল বুঝতে পারেন উপজাতীয় মুসলমানদের ওপরে ডাঃ খান সাহেবের আদৌ কোনো প্রভাব নেই; তিনি তাই নিজেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন বলে স্থির করেন এবং সাহসের সঙ্গে বিরোধীদের সম্মুখীন হন।

জওহরলাল পাঠানদের হৃদয় জয় করেন

পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার জন্য জওহরলাল যে রকম সাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দেন তাতে পাঠানরা তাঁদের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা জওহরলালের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। জওহরলাল দিল্লীতে ফিরে আসবার পরে লর্ড ওয়াভেল তাঁর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তিনি এ বিষয়ে একটি তদন্তের ব্যবস্থা করছেন। কারণ তিনি বুঝতে পারছেন যে সরকারী কর্মচারীদের প্ররোচনার ফলেই সীমান্তপ্রদেশের জনসাধারণ জওহরলালের ওপরে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছিল। জওহরলাল কিন্তু এ প্রস্তাবে সম্মত হননি। তাঁর এই মনোভাব দেখে লর্ড ওয়াভেল খুবই খুশি হন। আমিও এ ব্যাপারে জওহরলালকে সমর্থন করি।

কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিল। কংগ্রেস তখনই পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করে চলেছিল। তাদের তরফ থেকে একমাত্র যে বাধাটা এসেছিল, তা হলো আসামের কয়েকজন কংগ্রেস নেতা ‘গ’ শ্রেণীর প্রাদেশিক বিভাগকে মেনে নিতে পারছিলেন না। বাংলাকে তাঁরা ভীতির চোখে দেখছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, বাংলা আর আসামকে যদি একই এলাকাভুক্ত করা হয় তাহলে পুরো এলাকাটাই মুসলমানদের অধীনে গিয়ে পড়বে। মন্ত্রিমিশনের এই পরিকল্পনা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আসামের নেতারা এ বিষয়ে তাঁদের আপত্তি উত্থাপন করেন। প্রথম দিকে গান্ধীজী মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা সমর্থন করে বলেন, এই পরিকল্পনার ফলে দুঃখকষ্টের দিন শেষ হয়ে নতুন এক সুখ ও সমৃদ্ধির দিন আসবে। ‘হরিজন’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধ লিখে তিনি আরো বলেন, মন্ত্রিমিশন এবং ভাইসরয় কর্তৃক প্রস্তাবিত সরকারী কাগজপত্র চার দিন যাবৎ পরীক্ষা করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ইংরেজ সরকার এর চেয়ে ভালো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারতেন না।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ তাঁর বিরোধিতা পরিত্যাগ করেন না। মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাব অনুসারে বাংলা আর আসামকে একটি এলাকার অধীনে আনার বিরুদ্ধে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কাছে একটি স্মারকলিপি দাখিল করেন। ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমরা তাই স্থির করি যে এলাকা-ভিত্তিক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্নটি আর নতুন করে তোলা হবে না। তবে আসামের সহকর্মীদের আপত্তির আংশিক সমাধানের জন্য আমরা ব্যবস্থাপক সভায় ইংরেজদের অংশ গ্রহণের প্রশ্নটা তুলি। আমি ভাইসরয়কে লিখি, বাংলা ও আসামের বিধানসভার ইংরেজ সদস্যরা যদি ভোট বা মনোনয়নের মাধ্যমে ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, তাহলে কংগ্রেস হয়তো মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাব পুরোপুরিভাবে অগ্রাহ্য করবে। এই আপত্তি গৃহীত হয় এবং বাংলার বিধানসভার ইংরেজ সদস্যরা ঘোষণা করেন, তাঁরা ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। ইতিমধ্যে গান্ধীজীর মনোভাবে পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি বরদলৈ-এর প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। জওহরলাল কিন্তু এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হন যে, আসামের নেতাদের আশঙ্কা নিতান্তই অমূলক। তিনি তাই আসামের নেতাদের মন থেকে তা দূর করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁরা জওহরলাল এবং আমার কথা মানতে চান না। গান্ধীজী তাঁদের সমর্থন করেছেন বলেই তাঁরা এইরকম মনোভাব গ্রহণ করেন। জওহরলাল তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সর্বতোভাবে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করতে থাকেন।

আমি আগেই বলেছি, লীগ মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা অগ্রাহ্য করায় আমরা বিশেষভাবে চিন্তিত হয়েই পড়েছিলাম। লীগের সেই আপত্তি খণ্ডন করবার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি যে পন্থা গ্রহণ করেছিল, সে কথাও আমি উল্লেখ করেছি। এটি করা হয়েছিলো ১০ই আগস্ট একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ওই প্রস্তাবে সুষ্ঠুভাবে বলা হয়েছিল, মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার কোনো কোনো প্রস্তাব সম্বন্ধে আমাদের আপত্তি থাকলেও পরিকল্পনাটিকে আমরা পুরোপুরিভাবেই গ্রহণ করেছিলাম। মিঃ জিন্না এতে খুশি হন না। তাঁর বক্তব্য সম্বন্ধে আমি আগে যা বলেছি, তা ছাড়াও তিনি আরো বলেন, মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনায় প্রদেশসমূহকে যে এলাকাভিত্তিক পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে, সে সম্বন্ধে ওয়ার্কিং কমিটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কোনো কথাই বলেনি। এই বিশেষ ব্যাপারটিতে ইংরেজ সরকার এবং লর্ড ওয়াভেল লীগের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন।

আমি সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমে সমস্তরকম বিরোধের মীমাংসা করতে চেষ্টা করছিলাম। এ ব্যাপারে লর্ড ওয়াভেল সর্বতোভাবে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করছিলেন। এই কারণেই তিনি মুসলিম লীগকে সরকারের ভেতরে আনবার জন্য আগ্রহান্বিত ছিলেন। তিনি তাই এ সম্বন্ধে আমার বিবৃতিকে স্বাগত জানালেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাই সর্বোত্তম উপায়। তিনি একাধিকবার আমাকে বলেন, মুসলিম লীগের মনোভাবের দিক থেকেও এর চেয়ে কোনো ভালো সমাধান সম্ভব নয়। এখানে উল্লেখযোগ্য, মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটি আমার ১৫ই এপ্রিলের বিবৃতির ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিল বলে স্বাভাবিক কারণেই আমি তাঁর সঙ্গে একমত হই।

অ্যাটলি কর্তৃক ভাইসরয় এবং দলীয় নেতাদের আমন্ত্রণ

মিঃ অ্যাটলি ভারতের অগ্রগতির সম্বন্ধে ব্যক্তিগতভাবে সবকিছু লক্ষ্য রাখছিলেন। ২৬শে নভেম্বর তিনি লর্ড ওয়াভেল এবং কংগ্রেস ও লীগ প্রতিনিধিদের ইংল্যান্ডে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। অচলাবস্থার অবসান ঘটাবার জন্যই এই আমন্ত্রণ। কংগ্রেস প্রথম দিকে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে না বলে স্থির করে। জওহরলাল লর্ড ওয়াভেলকে বলেন, এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনার জন্য ইংল্যান্ডে যাবার মতো কোনো কারণ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে বহুবার বহুভাবে আলোচনা হয়েছে, সুতরাং নতুন করে আলোচনা শুরু করলে লাভের চেয়ে লোকসানই হবে বেশি।

লর্ড ওয়াভেল জওহরলালের এই অভিমত মেনে নিতে পারেন না। তিনি তাই এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, মুসলিম লীগের বর্তমান মনোভাব যদি চলতে থাকে, তাহলে শুধু যে সরকার পরিচালনার ব্যাপারেই অসুবিধার সৃষ্টি হবে তাই নয়, শান্তিপূর্ণভাবে ভারতীয় সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও এর ফলে নতুন নতুন বাধার সৃষ্টি হবে। তিনি আরো বলেন, লন্ডনে গিয়ে আলোচনা করলে নেতৃবৃন্দ সমগ্র বিষয় সঠিকভাবে বিচার-বিবেচনা করবার সুযোগ পাবেন। তাঁদের ওপরে কোনোরকম চাপ সৃষ্টি করা হবে না এবং ভারত থেকে বহু দূরে থাকার ফলে দলের লোকেরাও তাদের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। ওয়াভেল বেশ জোর দিয়েই বলেন, মিঃ অ্যাটলি ভারতের একজন অকৃত্রিম বন্ধু, সুতরাং আলোচনার সময় তাঁর উপস্থিতি সবদিক থেকেই মঙ্গলজনক হবে।

লর্ড ওয়াভেলের এই যুক্তিসঙ্গত বক্তব্য আমি মেনে নিই এবং আমার সহকর্মীদেরও তাতে সম্মত করতে সক্ষম হই। তখন স্থির হয়, জওহরলাল কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করবেন। লীগের প্রতিনিধিত্ব করবেন মিঃ জিন্না ও লিয়াকত আলী। বলদেও সিং যাবেন শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরূপে। ৩রা থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আলোচনা চলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় না।

আলোচনার সময় প্রদেশসমূহকে বিভিন্ন এলাকায় ভাগ করার প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়। মিঃ জিন্না এই অভিমত প্রকাশ করেন, পরিকল্পনার কাঠামোতে কোনো রকম অদলবদল করবার ক্ষমতা ব্যবস্থাপক সভার থাকতে পারে না। এলাকাভিত্তিক পুনর্বিন্যাসের বিষয় মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার একটি অপরিহার্য অঙ্গ, সুতরাং এ ব্যাপারে কোনো রকম অদলবদল করা হলে পরিকল্পনার মূল ভিত্তিই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, এলাকাগুলো তাদের শাসনতন্ত্র রচনা করবার পরে কোনো প্রদেশ ইচ্ছা করলে বেরিয়ে যেতে পারবে। মিঃ জিন্নার মতে প্রদেশগুলোর পক্ষে এটাই হবে রক্ষাকবচ, কারণ যে-কোনো প্রদেশ তার এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু আসামের কংগ্রেস নেতারা মনে করেন, যে-কোনো প্রদেশ প্রথম থেকেই বাইরে থাকতে পারে। যে-কোনো প্রদেশ তার ইচ্ছানুসারে এলাকার বাইরে থেকে তার নিজের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারে। মিঃ জিন্না এ ব্যাপারে ভিন্ন অভিমত পোষণ করেন। তাঁর বক্তব্য হলো, প্রদেশগুলো আগে তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় যোগ দেবে, পরে ইচ্ছা হলে এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু আসামের কংগ্রেস নেতাদের অভিমত হলো, প্রথম থেকেই যে-কোনো প্রদেশ আলাদাভাবে থাকতে পারবে। পরে ইচ্ছা হলে তারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় যোগদান করতে পারবে। মন্ত্রিমিশন মনে করেন, এ ব্যাপারে মিঃ জিন্নার বক্তব্যই সঠিক। মিঃ জিন্না সওয়াল করেন যে, এই ভিত্তিতেই কেন্দ্র, প্রদেশসমূহ এবং এলাকাসমূহের ভেতরে ক্ষমতা বণ্টিত হবে বলে স্থির হয়েছে এবং এই ভিত্তির ওপরে আস্থা রেখেই তিনি লীগকে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা মেনে নেওয়াতে পেরেছেন। আসামের কংগ্রেস নেতারা এতে সম্মত হন না। এদিকে সামান্য কিছু দ্বিধার পরে গান্ধীজী আসামের নেতাদের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন। এখানে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ ব্যাপারে মিঃ জিন্নার বক্তব্যই ছিলো জোরালো।

৬ই ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের মন্ত্রিসভা এক বিবৃতি প্রচার করে এলাকাভিত্তিক পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে মুসলিম লীগের বক্তব্যই সমর্থন করেন। এর ফলে কংগ্রেস এবং লীগের ভেতরের বিরোধের কোনোই অবসান হয় না।

ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে সভাপতি কে হবেন। জওহরলাল এবং সর্দার প্যাটেল উভয়েই বলেন, গভর্নমেন্টের বাইরে যারা আছেন তাঁদের ভেতর থেকেই কাউকে সভাপতি নির্বাচিত করা হবে। ওঁরা দুজনেই আমাকে এই পদ গ্রহণ করবার জন্য চাপ দেন। কিন্তু আমি এতে সম্মত হইনি। এরপর আরো অনেকের নাম প্রস্তাবিত হয়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। অবশেষে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে নির্বাচিত করা হয়। তিনি গভর্নমেন্টের ভেতরে থাকা সত্ত্বেও তাকেই নির্বাচিত করা হয়। এই নির্বাচন খুবই সঙ্গত হয়েছিলো, কারণ পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সুষ্ঠুভাবে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বহুবিধ সমস্যা ও বিরোধের ক্ষেত্রে মূল্যবান অভিমত দিয়ে সমস্যাবলীর সমাধান করেছেন।

আমি আগেই বলেছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবার সময় গান্ধীজী এবং আমার সহকর্মীরা আমাকে উক্ত সরকারে যোগ দেবার জন্য চাপ দেন। আমি তখন মনে করি, কংগ্রেসের কোনো একজন প্রবীণ নেতাকে সরকারের বাইরে রাখা দরকার। আমি আরো মনে করি, এর ফলে আমি সমগ্র বিষয় নিরপেক্ষভাবে দেখবার সুযোগ পাব। এইজন্যই আমি আসফ আলীকে সরকারের ভেতরে পাঠাই। লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেবার পর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে নতুন অসুবিধে দেখা দেয়। এই অসুবিধে দূরীকরণের জন্য আবারও আমাকে সরকারের ভেতরে নেবার কথা ওঠে। এ ব্যাপারে গান্ধীজী আগের চেয়েও বেশি জোর দিয়ে আমাকে সরকারের ভেতরে যেতে বলেন। তিনি আমাকে খোলাখুলিভাবে বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত যাই হোক না কেন, দেশের স্বার্থের জন্য আমার সরকারে যোগ দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, আমি বাইরে থাকায় ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জওহরলালও একই অভিমত জ্ঞাপন করেন।

গান্ধীজী বলেন, শিক্ষাবিভাগই হবে আমার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত দপ্তর; জাতীয় স্বার্থের দিক থেকেও এর প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি। তিনি বলেন, শিক্ষাই হলো স্বাধীন ভারতের মৌলিক প্রশ্ন। গান্ধীজীর অনুরোধে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি আমি শিক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সদস্যরূপে সরকারে যোগ দিই। আমার আগে এই দপ্তরটি ছিলো শ্রীরাজাগোপালাচারীর হাতে।

শিক্ষাদপ্তরের দায়িত্ব নেবার পরে শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যাপারে আমি যেসব নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম সেগুলো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। ও-ব্যাপারে আমি যেসব অভিমত পোষণ করেছি সেগুলো সংগ্রহ করে আলাদাভাবে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং এখানে ও সম্বন্ধে কিছু বলা হচ্ছে না। এখানে আমি শুধু দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধেই আলোচনা করবো। দেশের সাধারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের মতানৈক্যের ফলে উত্তরোত্তর খারাপের দিকেই চলেছিলো।

পরিষদের লীগ সদস্যরা কিভাবে প্রতি পদক্ষেপে আমাদের সামনে বাধার সৃষ্টি করে চলেছিলেন সে কথাও আমি আগেই বলেছি। তারা সরকারের ভেতরে থেকেও সরকারের বিরোধিতা করছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের কাজ ছিলো আমাদের প্রতিটি কাজকে বানচাল করা। অর্থবিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্যের হাতে বিশেষ ক্ষমতা থাকার ফলেই এ ব্যাপারে তাঁদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছিলো। অবস্থা চরমে পৌঁছায় লিয়াকত আলী যখন পরবর্তী বছরের জন্য বাজেট পেশ করেন।

কংগ্রেসের ঘোষিত নীতি ছিলো, সমাজ থেকে অর্থনৈতিক অসাম্য বিদূরিত করে ধনবাদী সমাজব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে সমাজবাদী প্যাটার্নের দিকে নিয়ে আসা। নির্বাচনী ইশতেহারেও কংগ্রেস এই কথাই বলেছিলো। উপরন্তু জওহরলাল এবং আমি আলাদা আলাদা বিবৃতি মারফত যুদ্ধের সময় শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেছেন সে সম্বন্ধে আমাদের অভিমত ব্যক্ত করেছিলাম। প্রত্যেকেই জানেন, এই বিপুল আয়ের একটা বড় অংশ কালো বাজারের অন্ধকারে আত্মগোপন করে, এবং সরকার সেই আয়ের ওপরের আয়কর থেকে বঞ্চিত হন। এর অর্থ হলো, বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তির কথা সরকারের কাছে গোপন করা হয়। আমরা তাই ভেবে রেখেছিলাম, সরকার এ ব্যাপারে দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করে অনাদায়ী কর আদায় করবেন।

লিয়াকত আলী বাজেট পেশ করলেন

লিয়াকত আলী যে বাজেট তৈরি করলেন সেটি আপাতদৃষ্টিতে কংগ্রেসের ঘোষিত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিলো কংগ্রেসকে লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করবার এক চাতুর্যপূর্ণ কৌশল। এটি তিনি করেছিলেন কংগ্রেসের দাবীকে নস্যাৎ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। বাজেটে কর ধার্য করবার যে প্রস্তাবটি তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তা সমস্ত ধনিকশ্রেণীকে দরিদ্রে পরিণত করবার এবং শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে পঙ্গু করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনাদায়ী কর কীভাবে আদায় করা যায় তার উপায় নির্ধারণের জন্য একটি কমিশন নিয়োগের প্রস্তাবও তিনি রেখেছিলেন।

ধনসম্পদ যাতে ধনী ও দরিদ্রের ভেতর সমভাবে বণ্টিত হয় এবং কর ফাঁকি দেনেওয়ালাদের বিরুদ্ধে যাতে আরো বেশি কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করা যায়, এটাই আমরা চেয়েছিলাম এবং সুষ্ঠু উপায়ে এইসব ব্যবস্থা কী করে করা যায় তার জন্য আমরা (অর্থাৎ কংগ্রেসীরা) সবাই উদ্বিগ্ন ছিলাম। সুতরাং নীতিগত দিক থেকে লিয়াকত আলীর প্রস্তাবসমূহের বিরোধী ছিলাম না। লিয়াকত আলী যখন মন্ত্রিসভার সামনে বিষয়গুলো উত্থাপন করেন, তখন তিনি খোলাখুলিভাবেই বলেন, কংগ্রেসের দায়িত্বশীল নেতাদের ঘোষণাবলীকে ভিত্তি করেই তিনি তার প্রস্তাবসমূহ রচনা করেছেন। তিনি আরো বলেছিলেন, জওহরলাল যদি এই সব কথা না বলতেন তাহলে এসব কথা তিনি চিন্তাও করতেন না। কিন্তু সে সময় তিনি তাঁর প্রস্তাবসমূহ বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করেননি। সুতরাং নীতিসংক্রান্ত ব্যাপারে আমরা সাধারণভাবে তাঁর প্রস্তাবসমূহ (অর্থাৎ প্রস্তাবসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ) মেনে নিয়েছিলাম। এবং এইভাবে আমাদের সম্মতি আদায় করে নিয়ে তিনি তাঁর বাজেট প্রস্তাবসমূহকে এমনভাবে তৈরি করেছিলেন যাকে বলা চলে জাতীয় অর্থনীতির ওপরে এক চরম আঘাত!

লিয়াকত আলীর প্রস্তাবসমূহ আমাদের কিছু সংখ্যক সহকর্মীর মনে রীতিমতো বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিলো। তাঁদের মধ্যে এমন কয়েকজন ছিলেন যাঁরা শিল্পপতিদের প্রতি গোপনে সহানুভূতিশীল ছিলেন। এছাড়া আরো কয়েকজন ছিলেন যারা মনে করেছিলেন যে, লিয়াকত আলীর প্রস্তাবসমূহে অর্থনৈতিক বিচার-বিবেচনার পরিবর্তে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের পন্থাই অনুসৃত হয়েছে। সর্দার প্যাটেল এবং বিশেষ করে শ্রীরাজাগোপালাচারী তাঁর এই বাজেটের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁদের মতে, লিয়াকত আলীর বাজেট প্রস্তাব দেশের স্বার্থের পরিপন্থী; এটা শুধু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জব্দ করবার উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছে। তাঁরা আরো মনে করেন, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে আঘাত হানবার পেছনে লিয়াকত আলীর যে আসল মতলবটি প্রকটিত হয়েছে, তা হলো সঙ্গতিপন্ন হিন্দুদের জব্দ করা, কারণ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যাই সর্বাধিক। কেবিনেটের সামনে রাজাজী খোলাখুলিভাবেই তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন তার কারণ হলো, এ সব প্রস্তাব রচিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে। আমি তখন আমার সহকর্মীদের বলি, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাজেট প্রস্তাবে কংগ্রেসের ঘোষিত নীতিই প্রতিফলিত হয়েছে; সুতরাং আগে থেকেই একে বাতিল না করে আমাদের উচিত হবে প্রস্তাবগুলোকে ভালোভাবে বিচার-বিবেচনা করা এবং যদি দেখতে পাওয়া যায় এগুলো আমাদের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে একে মেনে নেওয়া।

আমি আগেই বলেছি, তখনকার পরিস্থিতি খুবই ঘোরালো ছিলো। মুসলিম লীগ প্রথমে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা মেনে নিলেও পরে তাকে অগ্রাহ্য করে। তখন ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলছিলো, কিন্তু সমগ্র দেশ একতাবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য দাবী জানালেও লীগ সে অধিবেশন বর্জন করে। তখন একদিকে দেশবাসীরা স্বাধীনতা অর্জনের’ জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, আবার অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনায় এ সমস্যা সমাধানের জন্য যে একমাত্র উপায়ের কথা বর্ণিত হয়েছিলো সে পথও আমরা গ্রহণ করতে পারছিলাম না আমাদের ভেতরের মতানৈক্যের জন্য।

অ্যাটলি ইংরেজদের ভারত ত্যাগের তারিখ নির্দিষ্ট করে দিতে চান

ব্রিটেনের শ্রমিক সরকার বুঝতে পারছিলেন যে তারা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁরা কি এই অবস্থাই চলতে দেখেন, অথবা নিজেদের তরফ থেকেই এ ব্যাপারে কিছু করবার জন্য এগিয়ে আসবেন? মিঃ অ্যাটলি এই অভিমত পোষণ করছিলেন, পরিস্থিতি এমন এক স্তরে এসে উপস্থিত হয়েছে যা সবদিক থেকেই অনভিপ্রেত। এবং সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার জন্য অবিলম্বে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেবার দরকার হয়ে পড়েছে। তিনি তাই সিদ্ধান্ত নেন, ইংরেজ শক্তিকে ভারত পরিত্যাগ করে চলে আসবার জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ স্থির করে দিতে হবে। এই তারিখ ঘোষণা বিষয়টি লর্ড ওয়াভেল মেনে নিতে পারেন না। তিনি মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাকেই কার্যকর করতে চান, কারণ তিনি মনে করতেন ওই পথেই ভারতীয় সমস্যার সমাধান করা যাবে। তিনি আরো মনে করতেন, ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের আগেই যদি ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হয়, তাহলে ইংরেজ সরকার তাঁদের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবেন। ভারতীয়দের মনোভাব তখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও তখন ভাবাবেগ দ্বারা চালিত হচ্ছেন। লর্ড ওয়াভেলের মতে, এইরকম আবহাওয়ার মধ্যে যদি ইংরেজরা ভারত পরিত্যাগ করেন, তাহলে সারা দেশ জুড়ে প্রচণ্ড রকম হানাহানি শুরু হয়ে যাবে। তিনি তাই পরামর্শ দেন, স্থিতাবস্থা বজায় রেখে দুই বৃহৎ সম্প্রদায়ের বিরোধের মীমাংসা করতে চেষ্টা করা হোক। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, এই সময়, অর্থাৎ কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে একটা সমঝোতা হবার আগেই যদি ইংরেজরা ভারত ত্যাগ করেন, তাহলে তার ফল হবে অত্যন্ত গুরুতর এবং সাংঘাতিক।

মিঃ অ্যাটলি কিন্তু তা স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট তারিখসীমা স্থিরীকৃত হলে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ভারতীয়দের ওপরেই বর্তাবে, সুতরাং এটা যদি না করা হয় (অর্থাৎ ইংরেজ শক্তিকে ভারত পরিত্যাগ করবার নির্দিষ্ট তারিখ যদি ঘোষণা না করা হয়) তাহলে কোনোদিনই সমস্যার সমাধান হবে না। মিঃ অ্যাটলি মনে করেন, যদি স্থিতাবস্থা চলতে দেওয়া হয় তাহলে ভারতীয়রা ইংরেজ সরকারের ওপরে আর বিশ্বাস রাখতে পারবে না। ভারতের পরিস্থিতি তখন এমন অবস্থায় এসে পড়েছিলো যার ফলে নতুন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ইংরেজ রাজশক্তির পক্ষে ভারতে অবস্থান করা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু ইংল্যান্ডের জনসাধারণ এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এই অবস্থায় একমাত্র যে বিকল্প পন্থা ছিলো, তা হলো, দৃঢ় হাতে দমননীতি প্রয়োগ করে সমস্ত রকম হানাহানি দমিত করে দেওয়া, অথবা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। ইংরেজ সরকার অবশ্য ভারতে তাঁদের শাসন চালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তাতে ব্রিটেনের পুনর্গঠনের কাজে বাধার সৃষ্টি হতো। আর একটি বিকল্প পন্থা ছিলো, ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি নির্দিষ্ট তারিখ স্থির করে দেওয়া এবং এইভাবে যাবতীয় দায়িত্ব ভারতীয়দের স্কন্ধে তুলে দেওয়া।

লর্ড ওয়াভেল এতে সম্মত হতে পারেন না। তিনি তখনও বলতে থাকেন, ভারতের সাম্প্রদায়িক অসুবিধেগুলো যদি হিংসার পথে চলে যায় তাহলে ইতিহাস কখনো ইংরেজদের ক্ষমা করবে না। ইংরেজরা একশো বছরেরও বেশি ভারতবর্ষকে শাসন করেছেন, সুতরাং ইংরেজদের ভারত পরিত্যাগের ফলে যদি সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও হিংসা শুরু হয় তার জন্য তাঁরাই হবেন দায়ী। কিন্তু তিনি যখন দেখতে পান মিঃ অ্যাটলিকে তিনি কোনো রকমেই বোঝাতে পারছেন না, তখন তিনি পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।

আজ দশ বছর পরে সেই পুরনো ঘটনার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে আমার মনে এক সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। ওঁদের মধ্যে কে অভ্রান্ত ছিলেন? ঘটনাবলী এমনই জটিল ছিলো এবং পরিস্থিতি এমন এক অবস্থায় ছিলো যাতে এ ব্যাপারে কোনোরকম সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। মিঃ অ্যাটলি চাইছিলেন, ভারতের স্বাধীনতার দাবী যেভাবেই হোক মেটাতে হবে এবং এই রকম মনোভাব নিয়ে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ওই সময় সামান্যতম সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবাপন্ন যে-কোনো ব্যক্তিই ভারতের দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ সরকার চিরদিনই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে নিজেদের সুবিধেমতো কাজে লাগিয়ে এসেছেন। ভারতকে স্বাধীনতা না দেবার জন্যও এটাই ছিলো তাঁদের কাছে প্রধান হাতিয়ার। মিঃ অ্যাটলি কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, শ্রমিক সরকার এমন কোনো নীতি গ্রহণ করবেন না যাতে তাদের ওপরে এই ধরনের অভিযোগ আনা যায়।

এই প্রসঙ্গে আমরা অবশ্যই স্বীকার করবো যে তাঁর উদ্দেশ্য এবং মনোভাব যদি খাঁটি না হতো এবং তিনি যদি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের বিরোধকে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে পোষণ করতেন, তাহলে অতি সহজেই তিনি তা করতে পারতেন। সে অবস্থায় আমাদের বাধা সত্ত্বেও ইংরেজরা আরো এক যুগ এদেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারতেন। তবে সে অবস্থায় সাম্প্রদায়িক হানাহানিও চলতে থাকতো। ভারতীয়দের মনোভাব তখন এমন এক পর্যায়ে এসে গিয়েছিলো, প্রতিপদক্ষেপে তারা ইংরেজ শাসনকে বাধা দিতেন। অপরপক্ষে, ইংরেজরা যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে ভারতীয়দের অন্তর্বিরোধের সুযোগ নিয়ে আরো কয়েক বছর তাঁদের শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যেতে পারতেন। আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না, ফরাসীরা ইংরেজদের চেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন হয়েও প্রায় দশ বছর তারা ইন্দোচীনে টিকে থাকতে পেরেছিলেন। সুতরাং শ্রমিক সরকারকে তাঁদের মনোভাবের জন্য আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো। ওঁরা ভারতবর্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাননি। তাঁদের এই মহান সিদ্ধান্তের জন্য ইতিহাস তাঁদের সম্মান জানাবে; এবং আমরাও আমাদের মনের মধ্যে কোনোরকম দ্বিধা না রেখে এই ঘটনাকে স্বীকার করে নেবো।

অপরপক্ষে লর্ড ওয়াভেল যে ভ্রান্ত ছিলেন সে কথাও কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবেন না। তিনি যে বিপদের সম্ভাবনাকে মনশ্চক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তা অভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। এতেই বুঝতে পারা যায়, তিনি যেভাবে পরিস্থিতিকে অনুধাবন করেছিলেন তা মোটেই ভ্রান্ত ছিলো না। সুতরাং এঁদের মধ্যে কার অভিমত ভ্রান্ত এবং কার অভিমত অভ্রান্ত ছিলো তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাব যদি মেনে নেওয়া হতো এবং ভারতীয় সমস্যার সমাধান যদি আরো এক বছর বা দু বছর পিছিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে মুসলিম লীগ হয়তো তাদের বিরোধিতার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়তো। আবার লীগ যদি কোনোরকম ইতিবাচক মনোভাব না নিতো, তাহলেও ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় মুসলিম লীগের সেই নেতিবাচক মনোভাবকে হয়তো আর মেনে নিতে চাইতেন না। তাছাড়া এমনও হতে পারতো ভারত বিভাগের দুঃখজনক ঘটনাকেও হয়তো পরিহার করা যেতো। এ ব্যাপারে সঠিকভাবে কিছু বলা সম্ভব না হলেও একটি কথা বলা চলে যে, একটি জাতির ইতিহাসে এক বছর বা দু বছর নিতান্তই নগণ্য। হয়তো ইতিহাস এটা স্বীকার করে নেবে যে, লর্ড ওয়াভেলের নীতিকে মেনে নিয়ে তাঁর পরামর্শমতো চললেই হয়তো ভালো হতো।

যখন জানতে পারা গেলো, লর্ড ওয়াভেল বিদায় গ্রহণ করছেন, তখন আমি একটি বিবৃতি মারফত তাঁর সম্বন্ধে আমার অভিমত ব্যক্ত করি। আমি জানতাম জওহরলাল এবং আমার অন্যান্য সহকর্মীরা এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তারা লর্ড ওয়াভেলের বিরোধী ছিলেন; কিন্তু তাঁর অবদান সম্বন্ধে আমার মনোভাব জনসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করেছিলাম। বিবৃতিতে আমি বলেছিলাম:

ভারত সম্পর্কে মিঃ অ্যাটলির বিবৃতি আমার মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। একদিকে আমি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করি, ১৯৪৫-এর জুন মাসে আমি যেভাবে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেছিলাম, ঘটনার আবর্তনে আমার সেই বিশ্লেষণই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে; অন্যদিকে লর্ড ওয়াভেল বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন বলে আমি দুঃখিত না হয়ে পারি না, কারণ ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে নতুন সম্পর্কের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে সে ইতিহাসের তিনিই স্রষ্টা।

সিমলা সম্মেলনের প্রাক্কালে সকলের মনেই ইংরেজদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দেহ আর অবিশ্বাস বিদ্যমান ছিলো। বলতে বাধা নেই, পূর্ববর্তী তিন বছরের ঘটনাবলীর জন্য আমার মনটাও তিক্ত-বিরক্ত হয়েছিলো। সেই রকম মানসিক অবস্থা নিয়েই আমি প্রস্তাবিত সিমলা সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করতে যাই; কিন্তু লর্ড ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা হবার পরে আমার মানসিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হয়। তাঁকে আমি দেখতে পাই একজন বাস্তববাদী সৈনিক হিসেবে। ঘটনার মোকাবিলা করার অথবা বক্তব্য উপস্থাপিত করবার ব্যাপারে তিনি সব সময়ই প্রত্যক্ষ পন্থা অবলম্বন করতেন। রাজনীতিবিদদের মতো তাঁর মনে কোনো ঘোর-প্যাঁচ ছিলো না। তিনি সোজাভাবে যে কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে এমন আন্তরিকভাবে তার মোকাবিলা করতেন যার ফলে তাঁর আন্তরিকতা সম্বন্ধে আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। প্রকৃতপক্ষে এই কারণেই আমি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দেশবাসীকে গঠনমূলক পন্থা গ্রহণ করবার জন্য উপদেশ দিয়েছিলাম। সে সময় সারাদেশে সন্দেহ আর বিরোধিতার আবহাওয়া বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি উক্ত পন্থা থেকে বিচ্যুত হইনি। সকলেই জানেন প্রথম সিমলা সম্মেলনের পরে কংগ্রেসের ভেতর থেকে এবং এমন কি বাইরে থেকেও কংগ্রেসের ওপরে চাপ আসে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করবার জন্য। চারটি বিভিন্ন ঘটনায় চারবার এই রকম চাপ আসে। কিন্তু ইংরেজ সরকারের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব লক্ষ্য করে ওইরকম কোনো আন্দোলন শুরু করাটা আমি সঠিক বলে মনে করিনি।

আমি তখন আমার যাবতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তিকে নিয়োজিত করে কংগ্রেসের অনুসরণীয় পন্থাকে নিয়ন্ত্রণ করি। আজ আমি আনন্দের সঙ্গে বলতে পারি, সে সময় আমি যে পন্থা গ্রহণ করেছিলাম তা কোনোক্রমেই ভ্রান্ত ছিলো না। সিমলা সম্মেলন বানচাল হয়ে যাবার অব্যবহিত পরেই ইংল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং শ্রমিকদল ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় আসবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিকদল ঘোষণা করেন, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁরা পূর্বে যেসব কথা বলেছেন এবার সেগুলোকে কার্যে রূপায়িত করা হবে। ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে যে তাঁদের সেই ঘোষণা ছিলো যথেষ্ট আন্তরিকতাপূর্ণ।

গত দু-তিন সপ্তাহে লর্ড ওয়াভেল এবং ইংল্যান্ডের সরকারের মধ্যে কী ধরনের চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে তা আমি জানি না। তবে এমন কোনো গুরুতর মতানৈক্য অবশ্যই হয়েছে যার ফলে তিনি কার্যভার পরিত্যাগ করছেন। তিনি যেভাবে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেছেন বা ঘটনাবলীকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন তার সঙ্গে আমাদের ঐকমত্য না হতে পারে, কিন্তু তাঁর সততা এবং আন্তরিকতায় সন্দেহ করবার মতো কোনোই কারণ নেই। আমি এ কথাই বিস্তৃত হতে পারি না যে ১৯৪৫-এর জুন মাসে তিনি যেরকম সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তার জন্যই ইঙ্গ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান পরিবর্তিত আবহাওয়ার সৃষ্টি হতে পেরেছে। ক্রিপস মিশন বানচাল হবার পরে চার্চিল সরকার ভারতবর্ষের প্রশ্নটিকে যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল অবধি হিমঘরে রেখে দেবার মতলব করেছিলেন। ভারতের জনমতও কোনোরকম নতুন পথের সন্ধান পাচ্ছিলো না। ফলে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের পরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো, তার চেয়েও বেশি তিক্ততা দেখা দিয়েছিলো। সেদিনের সেই বন্ধ দরজার অর্গল খোলবার কৃতিত্ব একমাত্র লর্ড ওয়াভেলেরই প্রাপ্য। কোয়ালিশন সরকারের তরফ থেকে বাধা এলেও তিনি তাঁদের ভারতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন করে প্রস্তাব উত্থাপনের ব্যাপারে সম্মত করতে সক্ষম হন। এর ফলেই অনুষ্ঠিত হয় সিমলা সম্মেলন। সে সম্মেলন যদিও ফলপ্রসূ হয়নি, কিন্তু তার পর থেকে যা যা ঘটেছে তার প্রতি ব্যাপারেই লর্ড ওয়াভেলের সাহসী পদক্ষেপের চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি, লর্ড ওয়াভেলের অবদান ভারত কখনো বিস্তৃত হবে না। ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকরা স্বাধীন ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করবার সময় ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্কের বিষয় আলোচনা করবেন তখন তাঁরা লর্ড ওয়াভেলের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করে বলবেন, ইঙ্গ-ভারত সম্পর্কের উন্নতি তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই সম্ভব হয়েছিলো।

বিদায়ের প্রাক্কালে লর্ড ওয়াভেল ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যদের এক ডিনার পার্টিতে আপ্যায়িত করেন। উক্ত ভোজসভায় তিনি তাঁদের সবাইকে বিদায় অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। আমার বিবৃতি তাঁর মনে এমনভাবে রেখাপাত করেছিলো যার ফলে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে বলছি, ভারতে অন্তত একজন লোকও আছেন যিনি আমার মতামত অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন।’

বিদায়ের আগের দিন লর্ড ওয়াভেল তাঁর আমলের সর্বশেষ কেবিনেট মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন। সভা শেষ হলে তিনি এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতির মাধ্যমে আমার প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা গভীর আবেগের সঙ্গে প্রকাশ করেন। লর্ড ওয়াভেল বলেন, ‘আমি এক সঙ্কটপূর্ণ সময়ে ভাইসরয় হয়ে আসি এবং আমার সাধ্যানুসারে আমার প্রতি ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে চেষ্টা করে এসেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয় যার ফলে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হই। এই পদত্যাগের ব্যাপারে আমি সঠিক পন্থা অথবা ভ্রান্ত পন্থা গ্রহণ করেছি, সে বিচার করবে ইতিহাস। বিদায়ের পূর্বমুহূর্তে আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আপনারা কোনো ব্যাপারে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আপনাদের কাছ থেকে আমি যেরকম সহযোগিতা পেয়েছি তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’

এই বক্তৃতার পরেই লর্ড ওয়াভেল তাঁর কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি সভাস্থল থেকে বেরিয়ে যান যে আমরা আর কিছু বলারই সুযোগ পাইনি। পরদিনই তিনি দিল্লি পরিত্যাগ করেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন